তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৪৪+৪৫

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৪৪

রাত তখন অনেক গভীর, শান্ত ঘুমের ঘোরে বিছানার এপাশে থেকে ওপাশে হচ্ছে। হঠাৎ কিছু পড়ে যাবার শব্দে ঘুম ভাঙল শান্ত’র। কি পড়ল ওমন ভাবে, গা শিউরে উঠল। এপাশে ঘুরে হৈমন্তী না দেখতে পেয়ে যেন ভয়*টা আরো বেড়ে গেল। তার নিশ্চিত মনে আছে হৈমন্তীর কোলে’ই ঘুমিয়েছিল সে। ঘরটাও মায়ের তাহলে মা কোথায়? শান্ত কয়েকবার “মা মা”! বলে ডাকল। কোন সাড়াশব্দ পেল না। বিছানা ছেড়ে নামতেই গা ঝ্মঝ্ম করে উঠল। মনে হচ্ছে পুরো বাড়িতে সে ছাড়া আর কেউই নেই। “মা কোথায় তুমি?” বলে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বের হলো। সদর দরজা কেন খোলা? মা কি তবে নিচে! শান্ত দৌড়ে নামল সিঁড়ি বেয়ে। বাইরে ছুটে এসে মা কে খুঁজতে আসল। হঠাৎ উপরে তাকিয়ে দেখল মা দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কোনে। মা ওখানে কেন দাঁড়িয়ে আছে? পড়ে যাবে যে? শান্ত চেঁচিয়ে বলল, “মা তুমি ওখানে কি করছো? পড়ে যাবে তো! কথা আর শেষ হলো কি? তার আগেই লাফি*য়ে পড়ল হৈমন্তী। তার র*ক্তাক্ত শরীর দেখে শিউরে উঠল শান্ত। পুরো শরীর কাঁপছে তার। মা’র স্থির চোখ দুটো যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে!

ঘুম ভেঙে গেল তার। চমকে উঠে থরথর করে কাঁপতে লাগল সে। আশালতা পাশেই ছিল, শান্ত’র এই হাল দেখে জড়িয়ে ধরল তাকে। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল শান্ত! কেঁপে কেঁপে “মা” কে ডাকছে সে। বুঝতে বাকি নেই, দুঃ*স্বপ্ন দেখেছে শান্ত। আশালতা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “কাঁদে না বাবা, কিছু হয়নি তো! এই তো আম্মু আছি তোমার এইখানে। কিছু হয় নি!

তবুও চুপ হয় না সে। মা’র কাছে যাবে বলে কেঁদে উঠে। আশালতা কোনমতে তাকে সামলে ধরে আছে। হৈমন্তী মা*রা যাবার বছর খানেক পার হবার পরও শান্ত’র মন থেকে মা’র নামটা এখনো মুছে যায় নি। শুধু শান্ত কেন, এই বাড়ির কারোর মন থেকেই মুছে নি। অন্ধকার যেন ছেয়ে গেছে এই বাড়িতে। হৈমন্তীর মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিল কবীর, তবে তাকে দেখলে সেটা বোঝা যেত না। ভেতরে ভেতরে নিজেকে দোষী ভাবতে ভাবতে এখন ক্লান্ত সে।
হৈমন্তী মা”রা গেছে ছাদ থেকে পড়ে! সেদিন বাবার সাথে বসে গল্প করছিল শান্ত। হঠাৎ আচমকা কিছু পড়ার শব্দে দুজনেই ছুটে বাইরে চলে এলো। নিজের মা’র রক্তা*ক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে প্রথমেই এক পা পিছিয়ে গেল শান্ত। ভয়ে তার শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেল। হঠাৎ কি যে হলো, ছুটে এসে মা*কে নিজের কোলে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল সে। মা কে এতো বার ডাকার পরও মা জবাব দিচ্ছে না কেন? কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে পড়ল সে। কবীর যেন পাথরের ন্যায় স্থির! হৈমন্তীর মৃ*ত্যু যেন মেনে নিতে পারছে না সে। চোখ বুলিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখল ছাদের কোনে দাঁড়ানো আশালতা নিস্তব্ধ, নিরব, হতবুদ্ধি’র মতো দাঁড়িয়ে দেখছে হৈমন্তী কে।কবীরের জ্ঞান এইবার বুঝি ফিরল। ছুটে এলো হৈমন্তীর কাছে, কি থেকে কি হয়ে গেল? কিছুই যেন তার মাথায় ঢুকছে না। একটু আগেও তার হাতে হাত রেখেই দু’টো মিষ্টি কথা বলছিল। এখন কি হলো তার। শান্ত কাঁদতে কাঁদতে তার বাবা কে জিজ্ঞেস করছে, “মা’র কি হলো আব্বু, মা কথা বলছে না কেন?

কবীর মুখ ফিরিয়ে শান্ত’র দিকে তাকাল। ইতিমধ্যে বাড়ির সার্ভেন্ট আর দাড়োয়ান এসে হাজির। কবীর হৈমন্তী কে কোলে তুলে নিয়ে ছুটে গেল গাড়ির কাছে। কিন্তু হাসপাতালে নেবার পর’ই ডাক্তার তাকে মৃ*ত ঘোষণা করেন।

মায়ের স্মৃতি এখনো আঁকড়ে ধরে তাকে শান্ত। আশালতা কোনভাবে তাকে শান্ত করিয়ে ঘুম পাড়াল। শান্ত ঘুমাচ্ছে, আশালতা বিছানা ছেড়ে উঠল। তার আর কবীরের বিয়ে হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক হবে। অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এখন সে যাচ্ছে হৈমন্তীর ঘরে, কবীর সেখানেই আছে। দীর্ঘদিন ধরে রাত জাগা যেন কবীরের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সবাই ভেঙে পড়লেও পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে শুধু আশালতা! সে যেন ভেঙে যেতেই জানে না।
বেলকনিতে বসে এক হাতে ম*দের গ্লাস অন্যহাতে সিগারেট ধরিয়েছে কবীর। এখানে এসে বসলেই তার মনে পড়ে যায় হৈমন্তীর কথা। মনে হয় তার পাশেই হৈমন্তী বসে আছে,‌ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হৈমন্তীর মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কবীরের উপর। হৈমন্তী বোধহয় এটাই চেয়েছিল, তার মৃ*ত্যুর পরেও কবীর যেন তাকে মনে রাখে। সারাক্ষণ শুধু তাকে নিয়েই ভাবে। কবীরও তাই করছে, হৈমন্তীর আশা বোধহয় এইবার পূরণ হলো। বেচারি বেঁ*চে থেকে যদি দেখতে পেত কবীর তার নিয়ে এতো ভাবছে তাহলে বোধহয় খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠতো।

কবীর গ্লাসে চুমুক দেবার আগেই আশালতা এসে আটকালো। রোজ রোজ এভাবে এসব খাওয়া যে মোটেই ঠিক না, আশালতা এখন অবদি কবীর কে সেটা বোঝাতে পারল না। সিগারেট টা হাত থেকে কেড়ে নিল আশালতা, একমসয় এর অভ্যাস তারও ছিল। কিন্তু এখন ছেড়ে দিতে হয়েছে শান্ত’র জন্য। সিগারেট’র গন্ধ শান্ত’র মোটেও সহ্য হয় না। এজন্য বাবার কাছেও আসে না সে। আশালতা সিগারেটের টা ছুড়ে ফেলল। কবীর নির্বিকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “শান্ত ঘুমিয়েছে!

“হুম!

“তুমি ঘুমাবে না?

“এই কথাটা কি আমার জিজ্ঞেস করার কথা না

“আমার যে রাতে ঘুম আসে না আশালতা।

“কাল থেকে এই ঘরে আর আসবে না তুমি, আজই শেষ দিন।

“এভাবে কেন বলছো, এখানে আসতে আমার বেশ লাগে

“ঢং করো না তো, তোমার ঢং আমার সহ্য হয় না। বেঁচে থাকতো তো দুটো ভালোবাসার কথা বলো নি আর এখন বিরহ দেখাচ্ছ!

কবীর হাসল। হেসে আবারো গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “যখন বেঁচে ছিল তখন তার ছায়া পড়তো না আমার কাছে, আর এখন মরা*র পর তার সেই ছায়াই আঁকড়ে ধরেছে আমায় আশালতা! নিজের জীবনের সব ভুল সুধরে ফেললেও এই ভুলের কথা আমি কখনো ভুলবো না। হৈমন্তী আমায় ভুলতে দিবে না!
আশালতা রেগে যেন ঘর ছেড়েই বের হয়ে গেল। কালই এই ঘরে তালা দেবে সে। এভাবে তো আর চলা যায় না।

রোজই সার্ভেন্টদের ফিসফিস কথা শুনে শান্ত, সবাই বলে “তার ছোট আম্মু নাকি তার মা কে ছাদ থেকে ফে*লে দিয়েছে”‌ এসব আজেবাজে কথা কানে দেয় না সে।আম্মু কেন মা*রবে মা কে! সবাই এমন ভুল কথা কেন বলে।
মায়ের ঘরের কাছে এসে দেখল দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছে। তালা কেন ঝুলছে, শান্ত রেগে গেল। সে সার্ভেন্ট কে ডাকতেই সে ছুটে এলো। দরজা খুলে দিলে বলল, “ম্যাম বলেছিল দরজা বন্ধ করে দিতে।”
শান্ত আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, মায়ের ঘরে এসে বসে থাকতে ভালো লাগে তার। কিছুক্ষণ এভাবে ঘরে বসে ছিল। বিছানায় হামাগুড়ি গেল, বালিশে এখন মায়ের গন্ধ পায় সে। খুব ভালো লাগে, ঘুম ঘুম একটা ভাব এসে ধরে। শান্ত বিছানা ছেড়ে উঠল, আম্মু কেন দরজা বন্ধ করে দিল এটা নিয়ে ভাবতে লাগল। আলমারির কাছে যেতেই কি মনে করে আলমারি খুলল সে। মায়ের সেই বাক্স টা চোখে পড়ল তার। শান্ত খুশি হয়ে গেল হঠাৎ করে। বাক্স টা নিয়ে আবারো বিছানায় উঠলো। বাক্স খুলতেই চোখে পড়ল তার ছবি,‌মা কি তাহলে তার ছবি এখানে রাখতো। শান্ত’র বাচ্চা কালের ছবিও আছে এখানে। মা আর বাবার হাত ধরে থাকা ছবিটাও আছে। এসব সে যত্ন করে রেখে দেবে ভেবে নিল। এসব ছবির আড়ালেও আরো দুটি ছবি নজরে পড়ল তার। সেখানে ছোট আম্মু আর তার বাবা একসাথে! কিন্তু শান্ত মনে করতে পারল না, বাবা আর আম্মু ( আশালতা) এভাবে কবে ছবি তুলল। তখন কি সে ছিল না। ছবি গুলো দেখে কেন জানি শান্ত’র রাগ হতে লাগল। ভালো লাগছে তা বাবা কে এভাবে ছোট আম্মুর পাশে! রেগে সব কিছু বাক্সে ভরে আবারো আগের জায়গায় রেখে দিল। তার ছোট্ট মনে এই ছবি গুলো একটা জায়গা করে নিয়েছিল। ভালো মন্দ তখন সবে বুঝতে পারছিল শান্ত! আম্মু কে এই প্রথমবার তার খারাপ মনে হতে লাগল। এই খারাপের কারণ না কমে বরং বাড়তে লাগলো। স্কুলে যেতেই সবাই গুনগুন করে বলতে লাগল, তার আম্মু তার মা কে মেরে ফেলেছে তার বাবা কে বিয়ে করার জন্য!”

কথাগুলো কি সেই বাচ্চাগুলো জানত,না সেটা না। তাদের বাবা মা এসব আলোচনা যখন তাদের সামনে করত সেসব শুনেই এখানে এসে শান্ত বলে শোনাত তারা। একসময় শান্ত রেগে ঝগ*ড়া বেধে গেল একটা ছেলের সাথে। দুজনের মার*ধোরে শান্ত তার চোখেমুখে খাম*চি দিয়ে বসল। প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠালেন কবীর কে। শান্ত’র নামে নালিশ পড়ল কবীরের কাছে, বাসায় এসে শান্ত কে বকতে লাগল সে। মুখে মুখে তার সাথেও ত*র্ক করে যাচ্ছিল শান্ত! তার মনে যে শুধু আম্মু কে নিয়ে খারাপ লাগা শুরু হয়েছিল তা না , বাবা কেও এখন আর তার সহ্য হতো না। কবীর এক পর্যায়ে রে*গে চ*ড় বসিয়ে দিল। তাকে একা রুমের বন্ধ করে রাখল। আশালতা শত চেষ্টা করেও কবীর কে বোঝাতে পারি নি। সেদিন বেশ রাত অবদি কাদলো শান্ত! যেই বাবা কে আগে সুপারম্যান বলে মনে হতো এখন তাঁকেই প্রচন্ড খারাপ একটা লোক বলে মনে হতে লাগল। এখন সে বুঝতে পারল হৈমন্তী রাতে কেন কাদতো। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল মনে নেই তবে ঘুমানোর পর একসময় কবীর নিজেই দরজা খুলে তাকে কোলে তুলে নিল। বিছানায় তাকে শুইয়ে দিয়ে তার কপালে চুমু খেল। তাকে চ*ড় মারাটা একদমই যে ঠিক হয় নি এখন সেটা বুঝতে পারল। হৈমন্তী শেষবারও তাকে বলেছিল, শান্ত’র খেয়াল রাখতে। তাকে আজ এভাবে মার*ল সে। কি করে পারল, দিন দিন কতোটা নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে সে!

শান্ত’র হাল দিন দিন খারাপ হতে লাগল। আগে যারা ফিসফিসিয়ে বলত এখন সেই সার্ভেন্টরা এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে কবীর আর আশালতা কে নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। তাদের মত এটাই আশা কবীর স্যার কে বিয়ে করবে বলে হৈমন্তী ম্যাম কে ছাদ থেকে ফে*লে দিয়েছে। “কি বেহায়া মেয়ে রে বাবা, ম্যাম তো আর দুদিন পর এভাবেই ম*রে যেত। ধৈর্য্য আর রাখতে পারল না, স্যারের সাথে শো*বার জন্য নিজের বোন কে মেরে ফেলল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এমন মেয়ে যেন কোন ঘরে না হয়।

আরেকজন আবার তাল মিলিয়ে বলতে লাগলো,
“এখন বাচ্চাটার সাথে কি করছে, শুনলাম কাল নাকি চ*ড় মেরে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। বুঝলে আশা মেয়েটা ডাইনি, একটা ডাইনি। নাহলে নিজের বোনের সাথে এমন করে এখন ছেলের সাথেও করে। সবকিছু নিজের করে নেবে বলে এমনটা করে। কি সুন্দর একটা সংসার এভাবে এই ডাইনি নষ্ট করে দিল দেখলে। নজর কতো খারাপ!

“কবীর স্যার বুঝি ভালো, আমার তো মনে হয় তিনিও আছেন এসবে।

এসব কথা আশালতা বরাবর এড়িয়ে গেলেও শান্ত এবার যেতে পারল না। তার ছোট মনে যেই একটা আগু*ন জ্বলছিল তারা যেন সেটাই আরো জ্বালিয়ে দিল।এখন আর কাউকে সহ্য হয় না। নিজের ঘরে আশালতা আর কবীরকে আসতেও দেয় না সে। মাঝে মাঝে খাবার প্লেট নিয়ে দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে আশালতা, অনেক ডাকে শান্ত কে। শান্ত শুধু বলে খাবার রেখে চলে যেতে।‌সে খেয়ে নিবে। এখন আর শান্ত কে বোঝতে পারে না সে। খাবার সেখানে রেখেই চলে যেতে হয় তার। শান্ত যে এখন আর তাকে সহ্য করতে পারে না এটা সে বেশ বুঝতে পারে। তবুও চেষ্টা করে তার কাছে থাকবার। শান্ত দিন দিন বড় অভিমানী হয়ে উঠছে, কথা শুনতে চাইছে না। অ*বাধ্য হয়ে যাচ্ছে, রোজ স্কুল থেকে ডাক পড়ছে তার নামে। এসব কবীর থেকে আড়াল করে রাখছে আশালতা। নাহলে কবীর এসব জানলে যে কু*রুক্ষেত্র বেঁধে যাবে।

কিন্তু আর কয়দিন, যখন শান্ত’র মডেল টেস্ট পরিক্ষা খারাপ হলো তখন স্কুল থেকে কবীরকেই আসতে বলল। তার পড়াশোনায় অমনোযোগীতা, অবাধ্যতা সব বলা হলো কবীরের কাছে। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থেকে ছেলের উপর সময় দিতে না পারায় নিজেকেই প্রথম দোষী ভাবল সে। শান্ত কে বুঝিয়ে পড়াতে লাগল।‌কিন্তু শান্ত যে এখন সত্যি বড় অবাধ্য হয়ে উঠেছে।কবীরের কোন কথাই সে শুনতে চায় না। মুখে মুখে তর্ক করতে থাকে সবসময়। একেক সময় কবীর রেগে গেলেও ভালোবেসে বোঝানোর চেষ্টা করে। লাভ না, ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে বকঝকা, ঘরে বন্দি করে রাখা সব কিছুই করতে থাকে। শান্ত’র এমন পরিবর্তন চোখে পড়ে আহনাফেরও , সেও তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ হয় না।

এভাবে এভাবে চলে যায় আরো কয়েকদিন। দেড় মাস পড় শান্ত’র ফাইনাল পরীক্ষা! কবীর আর আশালতা দুজনেই এখন শান্ত’র উপর বেশ নজরদারি করছে। তবুও শান্ত পড়াশোনা কিছুই করতে চায় না। সেদিন হলো এক কান্ড, ঝগড়া বেঁধে গেল আশালতা’র সাথে। এখন আর তাকে আম্মু বলে ডাকে না শান্ত। তাকে এখন দায়ী করে তার মায়ের খু*নি বলে। অনেক অপবাদ দেয় তাকে, তার’ই সামনে দাঁড়িয়ে। শান্ত’র প্রতিটা কথা যেন ক্ষত বি*ক্ষত করে আশালতার হৃদয়। কাছে গিয়ে বোঝাতে চায় সে। শান্ত বুঝে না, সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার মা কে তুমি মেরে ফেলেছো, তুমি মেরেছো। ভালো না তুমি, খুব খারাপ। আমি থাকবো না তোমার সাথে। কারো সাথে থাকবো না আমি।”

সদ্য অফিস থেকে ফিরে ছোট শান্ত’র মুখে এমন কথাবার্তা শুনে যেন থমকে যায় কবীর। থমথমে মুখে তাকিয়ে থাকে শান্ত’র দিকে। একি সত্যি তার শান্ত! আশালতা কাছে এগিয়ে যেতেই জিনিসপত্র ছুঁ*ড়ে মারে শান্ত। ফুলদানি টা শেষ অবদি কপালে লেগে কেস*টে যায়। কবীর হতবাক! শান্ত এতো অবাধ্য! চেঁচিয়ে তাকে ডাকতেই ভয়ে কেঁপে উঠে শান্ত। বাবা এখন খুব ভয় পায় সে। এদিকে যা হয়েছে সেটাও ভুলবশত। কবীর কাছে এগোতেই দৌড়ে লুকিয়ে পড়ে সে। আশালতা থামানোর চেষ্টা করে কবীর কে। কিন্তু কবীরের রা*গ যেন মাথায় চড়েছে এবার। শান্ত কে টেনে তার গালে চড় বসিয়া দেয় একটা। শান্ত কাঁদতে কাঁদতে বলে, “তুমিও খারাপ, দুজনেই খারাপ তোমার। তোমরা সবাই মিলে আমার মা কে মেরে ফেলেছো। আমি নানাজান কে বলবো এ কথা। কেউ ভালো না তোমরা কেউ না!

কবীর অবাক হয়ে যায় এসব শুনে। শান্ত’র‌ গালে এখনো অনেক ব্যাথা। লাল হয়ে গেছে পুরো গাল। কিন্তু কবীরের রাগ যেন এখনো কমে না। তাকে স্টোর রুমে নিয়ে হাত পা বেঁধে রেখে দেয়।‌ তার এই ছোট শান্ত যে কতো ভয়া*নক হয়ে যাচ্ছে আশালতা কে দেখে সেটা বেশ টের পাচ্ছে কবীর। তার গাল বেয়ে র*ক্ত ঝড়ছে বাঁধ ভেঙে। আশালতা কাকে বোঝাবে, কেউ যে তার কথাই শুনছে না। না পারছে কবীর কে বোঝাতে না পারছে শান্ত কে বোঝাতে। সবকিছু যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। হৈমন্তী চেয়েছিল আগলে রাখতে, সেও চাইলো তেমনটা। কিন্তু কিছুই যে ঠিক মতো হচ্ছে না।
কবীর তার মাথায় ব্যান্ডেজ করানো শেষে আশালতা বিনীত স্বরে বলল শান্ত কে বের করে আনতে। কিন্তু কবীর যেন কঠিন মাটিতে গড়া। কিভাবে না করে দিল। দিন দিন নি*ষ্ঠুর বাবার তালিকায় পড়ছে সে এটা কি সে জানে। তবুও তাকে অমান্য করে শান্ত কে স্টোর রুম থেকে তুলে আনলো আশালতা। কাঁদতে কাঁদতে আবারো ঘুমিয়ে পড়ল সে। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল, আশালতা’র খুব কষ্ট লাগলো। হাত পায়ের বাঁধন খুলে হাত দিয়ে আদর করতে লাগল সে। শান্ত জেগে উঠল, আশালতা কে দেখে আবারো রে*খে গেল। আশালতা কে এখন দু’চোখে সহ্য হয় না তার। চেঁচামেচি শুনে কবীর আবারো এলো। কবীর কে দেখতে পেয়েও নিমিয়ে গেল না শান্ত! কবীর তার এই ছোট ছেলের চোখে যেই ভয়ানক রা*গ দেখতে পাচ্ছিল তা দেখে সে বিস্মিত! আশালতা কে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আবারো আটকে দিল তাকে। শান্ত অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাল। হাঁপিয়ে উঠার পর ফোন করল আহনাফ কে।‌ কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলল, বাবা তাকে ঘরে আটকে রেখেছে। খুব ভয় করছে তার!

শান্ত’র কান্নার আওয়াজ পেয়ে অস্থির হয়ে উঠল আহনাফ। ফোনটা রেখেই বাবাকে সাথে করে ছুটে এলো শান্ত’র বাড়িতে। আরমান আহমেদ বুঝতে পারলেন কবীরের যন্ত্রণা। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন তাকে। হতাশা কবীর কে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ছেলেটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। শেষে যখন শান্ত’র ঘর খোলা হলো, শান্ত কে সেখানে আর দেখতে পেলো না আহনাফ! কোথায় গেলো শান্ত? পুরো ঘর খুঁজেও পাওয়া গেল না, শেষে দেখা গেল বাথরুমের জানালা দিয়ে পালিয়েছে সে। আহনাফের এই প্রথম কবীর কে বড্ড খারাপ বলতে ইচ্ছে করল। সবাই খুঁজতে বের হলো শান্ত কে।‌ আহনাফ এতোবার কল করেও তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। ফোনটা ঘরেই ফেলে রেখে গেছে যে। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সেও।‌ কোথায় আছে শান্ত, কোথায় সে?

শান্ত দাঁড়িয়ে আছে কবরখানার সামনে। মা’র করবটা তার বেশ চেনা। অনেকবার এসেছে মা’র কবর জিয়ারত করতে। কাঁদতে কাঁদতে মা’র কাছেই যায় সে। কিন্তু এমন নিস্তব্ধ, নিরব জায়গায় ভয়ও করতে লাগলো তার। এদিক ওদিক কতো কবর! তবুও সে মায়ের কবরের সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল, বাবা তাকে মে*রেছে, সেই অভিযোগ জানাচ্ছিল সে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কিসব শব্দ তার কানে আসতেই কেঁপে উঠে সে। এখন খুব লাগছে তার। “মা মা” বলে চেঁচিয়ে ডাকলেও যেন কেউ সাড়া দেয় না। এই মনে হয় পেছনে কেউ দাঁড়ানো। কি হচ্ছে তার সাথে, সে তো ভয় পাচ্ছে। মা কেন আসছে না তাকে বাঁচাতে। মা কি তবে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কোত্থেকে আবার কুকুর ডাকার শব্দ। কুকুর ডাকছে সুরে সুরে। এই শব্দ শুনেও ভয়ে কেঁপে উঠলো সে। সবাই বলে মানুষ ম*রে গেলে ভূ*ত হয়ে যায়। মা”ও কি তবে ভূত হয়ে গেছে। ভয়ে শান্ত অস্থির! তার গলা শুকিয়ে আসছে বার বার। এদিকে ওদিক ভয়ে তাকাচ্ছে সে। খুটখুটে অন্ধকারে কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। দৌড়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। শুধু একট কথাই মনে বাজতে লাগল, মা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, রাখে নি তার সাথে। তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে পাথরের সাথে হোঁ*চট খেয়ে খুব জোরে পড়ে গেল। পায়ে, হাতে খুব জোরে আঘাত পেলো। হাঁটুর অনেকটা ছি*লে গেছে, র*ক্ত পড়ছে। গায়ের জামাটায় ধুলে গেলে একাকার। মুখেও কোথাও ব্যাথা করছে, এখন তো হাঁটতে ও কষ্ট হচ্ছে । তবুও এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে গেল শান্ত!

আহনাফ সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে, রাত কম হয় নি, পুরো রাস্তাই অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। আহনাফের চেনা জানা সব জায়গায় খুঁজতে লাগল শান্ত কে। প্রায় পাগলের মতোই খুঁজছিল তাকে। অবশেষে একটা কফি শপের বাইরে দেখতে পেল তাকে। দোকানের বাইরে বসে কাঁদছে সে। তার পুরো শরীর কাঁপছিল। আহনাফ সাইকেল রেখে হেঁটে এলো তার কাছে। শান্ত’কে ডাকতেই মুখ ফিরে তাকাল। মুখের কপালে আ*ঘাত, ঠোঁট কেটে র*ক্ত পড়ছে। গালের এদিকটাও ফুলে উঠেছে এতোক্ষণে। ফর্সা মুখখানা কান্নার প্রভাবে লাল হয়ে গেছে। ছোট একটা বাচ্চার মতো কাঁদছে সে। মনে হচ্ছে ৫ বছরের কোন বাচ্চা রাস্তায় হামাগুড়ি খেয়ে কাঁদছে। গায়ের জামায় ময়লা লেগে আছে। আহনাফ বসল শান্ত’র সামনে। কি মনের করে বলে উঠল, তুই আন্টির কাছে গেছিল!

শান্ত’র কান্না তখন বেড়ে গেল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আ..আমি খুব ভয় পেয়েছি আহনাফ। আম্মু কথা বলেনি আমার সাথে। অ…অনেক অন্ধকার ছিল সেখানে। আম্মু আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।দেখ আমি পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি!

বলেই হাত দেখাতে লাগলো আহনাফ কে। আহনাফ তাকিয়ে দেখল হাত ছি*লে রক্ত পড়ছে। খেয়াল করল পড়া প্যান্ট টাও ছিঁড়ে গেছে হাঁটুর কাছে। আহনাফ তখন শান্ত’র হাতে ফু দিয়ে বলল, আমি ফু দিয়ে দিচ্ছি দেখবি ব্যাথা কমে যাবে!

শান্ত কান্না থামিয়ে দিল। আহনাফ তার ছোট হাত দুটো ধরে ফু দিতে লাগলো। অতঃপর নিজের পকেটে হাত দেখল টাকা আছে। শান্ত’র দিকে ফিরে হেসে বলল, আইসক্রিম খাবি, আমার কাছে টাকা আছে!

শান্ত মাথা নাড়ল। অতঃপর আহনাফের সাথে দাঁড়িয়ে গেল সে। আহনাফ শান্ত’র হাত ধরতে গিয়ে দেখল তার হাতের ডগায় লাল দাগ হয়ে আছে। কিন্তু সেটা কিসের দাগ তখন বুঝতে পারি নি আহনাফ। দুই বন্ধু আইসক্রিম খেতে খেতে ফিরছিল। পথের মাঝেই তখন দেখা মিলল কবীর আর আরমানের। দু’জনেই তাদের দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শান্ত কবীর কে দেখা মাত্র আহনাফের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। কবীর হতভম্ব! আদুরে স্বরে শান্ত কে ডাকলেও সে কাছে যেতে রাজি না। আহনাফের পিছনেই লুকিয়ে রইল সে। আরমান আহমেদ শান্ত কে বোঝাচ্ছিলেন, বাবা’র সাথে যেতে কিন্তু শান্ত মুখ ফুটে বলে উঠলো, “আমি যাবো না তার সাথে। উনি আমার বাবা না!

বলে আবারো লুকিয়ে পড়ল আহনাফের পিছনে। আরমান শান্ত’র এই হাল দেখে তাকে আর জোর করার সাহস পেলেন না। কবীর হতবুদ্ধি’র মতো দাঁড়িয়ে রইল শান্ত’র কথা শুনে। শান্ত’র চোখে তিনি স্পষ্ট ঘৃণা দেখতে পাচ্ছিলেন। আরমান আহমেদ এখন শান্ত কে বাদ দিয়ে কবীর চৌধুরী কে বোঝাতে লাগলেন। আহনাফ আর শান্ত কে নিয়ে রওনা দিলেন তার নিজ বাসায়। কবীর সেদিন শান্ত কে ছাড়াই বাড়ি ফিরল। আশালতা বার বার শান্ত’র কথা জিজ্ঞেস করার পর একবার শুধু মুখ ফুটে বলল, “শান্ত আহনাফের বাসায়!”

এছাড়া আর কিছুই বলল না সে। তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে পড়ল সোফায়। আশালতা পাশে বসে বলল, “আজ একটু বেশিই করে ফেললে তুমি। সবসময় শাসন দিয়ে কখনো কিছু হয় না।”

কবীর কিছু বলল না। শুধু চোখ বুঝে ভাবল শান্ত’র কথা। শান্ত এখন আর তাকে পছন্দ করে না, ঘৃণা করে তাকে। তাকে বাবা বলতেও অস্বীকার করল। কেন এতো অল্পতেই এভাবে রেগে গেল কবীর। সে কি বদলে যাচ্ছে, কেন বদলে যাচ্ছে। কি বদলে দিচ্ছে তাকে। জীবনের একটা সময় মানুষ অনেক কিছু করে। না জেনে বুঝে রাগের বসে অনেক ভুল করে ফেলে। সেই ভুলটাই কি করল সে। কেন এতো ভুল করে সে। বার বার ভুল’ই করে বসে। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ কিভাবে বদলে যাচ্ছে তার।

প্রতিটা সকাল নতুন দিনের সূচনা নিয়েই আসে। শান্ত’র জীবনেও তাই হলো, তার জীবনের নতুনের সূচনা। সকালে আশালতা আর কবীর তাকে আনতে গেলে সে যাবে বলে দিল। এমনকি তাদের দুজনের সামনেও এলো না। ঘরের দরজার কাছে এসেও ফিরে গেল আশালতা। বার বার শান্ত কে কে ডাকার পর শান্ত শুধু এতটুকুই বলল, “আমি তোমাকে ঘৃণা করি, আমার মা নও তুমি! তুমি আমার মায়ের খু*নি!
শান্ত’র মনের পরিবর্তন ঘটল না, মনের ভেতর নিজের মা আর বাবা কে নিয়ে যে রাগ সে পুষে রাখল সেটা কখনোই শেষ হলো না। এতো সব কান্ডের কথা শুনে জায়ান আহমেদ ফিরলেন দেশে। শান্ত’র কিছুদিন থাকল নানাজানের সাথে। সব কথা বলল নানাজান কে! নানাজান বেশ বুঝতে পারলেন শান্ত’র মনে এখন কি চলছে। তিনি এখন বিপক্ষে কথা বললে শান্ত আর নানাজান কেও পছন্দ করবে না হয়তো। তাহলে এই শান্ত’র কি হবে। তার বড় মেয়ে হৈমন্তীর একমাত্র চিহ্ন এটা। এভাবেই কি তা নিঃস্ব করে দেবেন। অবাক হয়েছেন আশালতা আর কবীরের কথা শুনে। শান্ত কেন তাদের পছন্দ করছে না। মায়ের বাক্সের সে ছবি গুলো শান্ত দেখালো নানাজান কে। নানাজান দুয়ে দুয়ে চার করলেন তবুও তিনি বিশ্বাস করলেন তার ছোট মেয়ে বড় মেয়েকে খু/ন করতে পারে। কিন্তু তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আশালতাকে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করলেন, “কবীরের সাথে তোমার সম্পর্ক কি ছিল আশফিয়া! ( আশালতা নামটা তার ছিল তার মায়ের দেওয়া। কিন্তু ছোট মেয়েকে আদর করতে ডাকতেন আশফিয়া। এটা ছিল জায়ান আহমেদ’র মা’র নাম। ছোট মেয়ে নাকি দেখতে পুরো তার মায়ের মতো। তাই এই নাম রাখা। যদিও এই নাম ধরে শুধু তার বাবাই ডাকেন )

আশালতা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে আসলে কথা বোঝার চেষ্টা করছে। তবে বুঝতে দেরি হলো না। জায়ান আহমেদ ছবি গুলো সামনে রাখতেই সব স্পষ্ট হয়ে গেল। আশালতা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছবিগুলোর দিকে। একই হাল কবীরের। আরো অবাক হলো এসব শুনে ছবি গুলো শান্ত’র কাছেই ছিল। আর তার আগে ছিল হৈমন্তীর কাছে। অপরাধ বোধ দুজনের হৃদয়কেই ক্ষত*বিক্ষত করে দিচ্ছিল। জায়ান আহমেদ’র যা বোঝার তা বুঝেছিলেন। তিনি শুধু বললেন, “এমনটা তোমরা না করলেও পারতে। আমার কাছে তো সবটা বলতে পারতে।

আশালতা বাবার পায়ের কাছে ঠাঁই নিল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলতে লাগল, “আমি বুঝতে পারি না বাবা, এসবের জন্য এতো কিছু হবে।”

জায়ান আহমেদ কথা বাড়ালেন না। দাঁড়িয়ে বললেন, “যা হবার হয়ে গেছে। এই নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো!

“বাবা!

“তোমরা থাকো সুখে, যা চেয়েছিল তা পেয়ে গেছো!

কবীর দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি যা ভাবছেন এমন কিছু না হৈমন্তীর সাথে‌ বিয়ের পর এমন কোন কিছু ছিল না আমাদের সাথে। আমরা সবাই পরিস্থিতির স্বীকার!

“তোমরা বড়, পরিস্থিতি কি বুঝ। শান্ত’র অবশ্যই সেটা বোঝার বয়স হয় নি।

“আমি জানি বাবা!

“তোমার প্রতি শান্ত’র ব্যবহার আমি শান্ত কে দেখেই বুঝেছি।

“বাবা একটিবার আমার কথাটা শুনুন!

“থামো! না জেনেছি যথেষ্ট, আর জানবার কিছু নেই। শান্ত’র দায়িত্ব এখন আমার।

আশালতা দাঁড়িয়ে বলল, “বাবা এসব কি বলছো, শান্ত আমার ছেলে!

“কিন্তু শান্ত তোমাকে মা বলতে নারাজ। এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ো না। শান্ত যা পেয়েছে যথেষ্ট!

জায়ান আহমেদ এবার বের হবার প্রস্তুতি নিলেন। মাঝপথেই আশালতা দাঁড়িয়ে বলল, “বাবা, তুমিও কি মনে করো আপা কে আমি…

“আমার মনে করাতে না করাতে কিছু যায় আসেনা। আমি জানি আমার দুই মেয়ে ছিল আর তারা দুজনেই এখন সুখী!

বললাম হন হন করে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। রায়ান তাকে বাইরে অবদি এগিয়ে নিয়ে গেল।
জায়ান আহমেদ’র এতো বলা সত্ত্বেও শান্ত তার সাথে দেশ ছাড়তে রাজি না হলো। সে এখানেই থাকবে আহনাফের সাথে। নাতির কথা রাখতে দীর্ঘ কিছু বছর তিনি এখানেই ছিলেন শান্ত’র সাথে। কিন্তু নিজের মৃ*ত স্ত্রীর স্মৃতি বার বার তার মনে উঁকি দিচ্ছেন। তাই তিনি একাই দেশ ছাড়েন। শান্ত’র দায়িত্ব তখন নেন আরমান আহমেদ, আহনাফের বাবা!

বর্তমানে…

নিঝুম অন্যদিকে ফিরে নিজের চশমা খুলে চোখের জল মুছল। আহনাফ অন্যদিকে ফিরে আছে। তার হৃদয় ভার, তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এরপর অশান্ত আর কখনো তার মা বাবার সাথে দেখা করেনি।

“না, কখনো না।

“আহনাফ, আপনার কি মনে হয়। হৈমন্তী আন্টিকে কি আসলেই আশালতা আন্টি খু*ন করেছিলেন।

“আমি জানি না, কিন্তু শান্ত’র এখনো তাই মনে হয়। যদি খু*ন নাও করে থাকে তবে সে মা”রা যাবার পেছনে দায়ী তারা এটা আমি মনে করি। জানো নিঝুম, আমার মা’কে আমি দেখে নি। আমার জন্মের পর পরই তিনি মারা যান। যখন মা কি সেটা বুঝলাম তখন হৈমন্তী আম্মু আমাকে অনেক আদর করতেন। তাকে ছোট আম্মু বলে ডাকতাম আমি। তিনি বলতেন, আম্মু বলে ডাক আমায়।” তার মৃত্যু*তে খুব গভীর পেয়েছিলাম। কিন্তু তার চেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছিল শান্ত কে দেখে। সুন্দর গোছানো একটা জীবন কিভাবে যে নষ্ট হয়ে গেল তা শান্ত কে দেখেই বুঝলাম!

আহনাফের কণ্ঠ ভার হয়ে আসছিল। নিঝুম আর কথা বাড়াল। কোনমতে নিজেকে আটকে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কোথায় সেই অশান্ত, কে বলবে তাকে দেখে এতোটা কষ্ট পেয়েছেন তিনি। নিঝুম নিচে তাকাল। অশান্ত আর আহিম দৌড়াদৌড়ি করছে। এই দৃশ্য তার এই গম্ভীর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল। নিঝুম হাসল, আহনাফ তার হাসির দিকে তাকিয়ে রইল!
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৪৫

নীলাভ্র রেস্টুরেন্টে বসে অপেক্ষা করছে। নিঝুম তাড়াহুড়ো করে ঢুকল! নীলাভ্র তার দিকে ফিরে তাকাল।‌অবাক করবার বিষয় হচ্ছে, নিঝুম কে জানাবে না বলেও শেষমেষ নিঝুমকেই প্রথমে জানালো সে। নিঝুম একগাল হাসল তাকে খুঁজে পেয়ে। ছুটে এসে বসে পড়ল চেয়ারে। নীলাভ্র ভ্রু কুচকালো। নিঝুম একটু ভাব নিয়ে বলল , “দেখলেন, বলেছিলাম তো আপনি প্রথম আমাকেই কল করবেন!

“ফোন করতাম না, নেহাত এতো বার রিকোয়েস্ট করল তাই..

“হুম, শুধু একবার বলেছি আপনাকে!

“হ্যাঁ‌,ছাড়ো এবার।‌ তুমি আমাকে শান্ত পেয়ো না যে তোমার এক কথার ভাঁজে আরেকটা কথা বলবে ঝগড়া করবে।

নিঝুম মুখ ভেংচি কাটল। পাশে তাকিয়ে দেখল একটা পিচ্চি ছেলে বসে বার্গার খাচ্ছে। ছেলেটার অবস্থা ওতোটা ভালো নয়। বিবর্ণ বলা যায়। এ ছেলের মতো অনেক ছেলে রাস্তার পাশেই তাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়ে ফেলে‌। না আছে এদের থাকার মতো একটা ভালো জায়গা, না আছে পরার মতো ভালো কিছু! কিছু লোক চোখ ঘুরিয়ে বার বার এই টেবিলেই নজর দিচ্ছে। নিঝুম আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,‌ “নাম কি তোমার পিচ্চি!

ছেলেটা বড় বড় চোখ করে তাকাল। নিঝুম একগাল হেসে বলল, “এরপর আর কিছু খাবে তুমি!

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বলল, “আইসক্রিম!”

নীলাভ্র বলে উঠল, “বলা হয়েছে, আসছে!

সাথে সাথে ওয়েটার এসে একটা আইসক্রিম সার্ভ করে গেল।‌ নিঝুম তার সাথে আরো দু’টো আইসক্রিম ওর্ডার করলো।‌ নীলাভ্র জিজ্ঞেস করল, “আরো দু’টো!

“একটা আমার আর একটা ওর। তা আপনি খেতে চাইলে অর্ডার করে নিন!

না ফিরেই কথাগুলো বলে ছেলেটার সাথে ভাব জমাতে লাগল। নীলাভ্র অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। ভাবছে কি করে তাকে ফোন দিল সে। কথা ছিল, আহনাফ কে জানানোর। সেটা না করে নিঝুম কে কেন জানাতে গেল? মেয়েটা তখন যেভাবে বলল,‌ সে ভ্যাবাচেকা খেতে বাধ্য ছিল তাই বলে সত্যি সত্যি ফোন করে তাকেই ডাকল। নীলাভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। কিছু তো আছে এই মেয়েটার মাঝে। প্রথমে আহনাফ তারপর শান্ত আর এখন সে! মনে হচ্ছে ওর ক্ষমতা আছে কাউকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার। সেও কি তবে সেভাবেই তার উপর প্রভাবিত হলো।

নিঝুম আবারো জিজ্ঞেস করল, “তোমার নামটা জানি কি?

“পল্টু!

“তা পল্টু , তুমি কি আমাদের একটা কাজ করবে!

পল্টু মাথা দুলিয়ে বলল, “হুমমম করবো!

নিঝুম হেসে নীলাভ্রের দিকে তাকাল। নীলাভ্র বেশ বুঝতে পারল নিঝুমের মাথায় কিছু একটা চলছে!

——

“স্যার আসবো!

ফাইলের পাতা উল্টে কবীর চৌধুরী মাথা দুলাল। রায়ান ভিতরে ঢুকল। আরো একটা কালো রঙের ফাইল টেবিলের উপর রাখল সে। কবীর চৌধুরী সে ফাইলে চোখ রাখতেই রায়ান বলে উঠল, “শান্ত বাবার রেকর্ড!

“এক্সি*ডেন্ট’র খবর কি পেলে?

“শান্ত বাবা একদম ঠিক আছে। যেই চোরটা এক্সি*ডেন্ট করেছে সে মা*রা গেছে। ট্রাক টার খোঁজ এখনো চলছে।

কবীর চৌধুরী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, “যেভাবেই হোক খুঁজে বের করো। তাকে মিনিমাম ১০ বছরের জন্য হলেও জেলে ঢুকিয়ে ছাড়বো আমি। মনে রেখো গাড়িতে কিন্তু শান্ত’র থাকার কথা ছিল। ভাগ্য ভালো ছিল বলে কিছু হলো না। আর চোর টার কোন খবর?

“স্যার তার বউ হাসপাতালে ভর্তি আর দুটো ছেলেমেয়ে আছে!

“হুমম, দেখো বউয়ের চিকিৎসা যেন ভালো করে হয়। আর ওদের দায়িত্ব কিন্তু এখন আমার। চোরটার উপর আমি ঋণী। তার জন্য আমার ছেলের প্রাণ বেঁচেছে!

রায়ান মাথা দুলাল। কবীর চৌধুরী হাতের ফাইলটা রেখে ওই ফাইল হাতে নিয়ে বলল, “শান্ত কে একটা নতুন গাড়ি দেবার ব্যবস্থা করো।

“স্যার, শান্ত বাবা নিবে না।

কবীর মুখ তুলে রায়ানের দিকে ফিরল। রায়ান সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলল। বসের মুখের উপর কথা বলার নিয়ম কারো নেই। রায়ান সেই নিয়ম’ই ভঙ্গ করেছে। ভয় যে লাগছে না তেমনটা না। কবীর হেসে বলল, “আমার ছেলেকে খুব ভালো করে বুঝো তুমি!

“না স্যার তেমনটা না।

কবীর উঠে দাঁড়াল। রায়ানের কাছে এসে তার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “আজ কতো বছর ধরে আছো আমার সাথে, ত্রিশ বছর তো হতেই চলল। তবুও আমার প্রতি তোমার কতো ভক্তি, বিশ্বস্ত তুমি আমার।

“এটাই আমার কাজ স্যার!

“রায়ান, তুমি জানো তুমি আমার একজন ভালো বন্ধু।

রায়ান কিঞ্চিত হাসল। কবীর শান্ত’র ফাইলে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে বলল, “নিঝুম নামের এই মেয়েটা কে?

“স্যার ওখানে ছবি আছে, দেখুন!

কবীর চৌধুরী ছবি দেখলেন। শান্ত আর মেয়েটা পাশাপাশি হেঁটে কথা বলছে। মেয়েটাকে সবসময়ই শান্ত’র সাথে দেখা যাচ্ছে। কবীর কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে রায়ানের দিকে ফিরতেই চুপ হয়ে গেল। দরজার আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনবার চেষ্টা করছে। এই বাড়িতে আশালতা ছাড়া আর কেউই এমনটা করবে না, তাই কথা না বাড়িয়ে ধীর স্বরে রায়ান কে বলল, “মেয়েটার খোঁজ নাও।

বলেই ফাইলটা টেবিলে রেখে দিলেন। রায়ান বুঝল তার কাজ শেষ। এদিকে আশালতাও বুঝল কবীর তাকে দেখে ফেলেছে। নাহলে কথা আরো কিছুক্ষণ চলতো।‌ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের বাইরে এসে দাঁড়াল। রায়ান চলে যেতেই সে ঘরে ঢুকল।‌ কবীর কলো রঙের ফাইলটা সরিয়ে রাখল। আশালতা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “খাবে চলো!

সিগারেট এস্ট্রে তে ফেলে কবীর শীতল দৃষ্টিতে আশালতার দিকে ফিরল। এই এতো বড় বাড়িতে এই দুজন ছাড়া কাজের মানুষ আছে ৬ , ৭ জন। কিন্তু তাদের অবস্থাও টের পাওয়া যায় না। আশালতার মুখটা মলিন। বয়সের ছাপ তার মুখে স্পষ্ট। রাতে ঘুমের টেবলেট না খেলে তার ঘুম’ই হয় না। আশালতা যে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে এটা সে জানে। কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। তার ধারণা, কবীর তাকে শান্ত’র থেকে দূরে সরাতে চাইছে। আর দিন দিন তার এই ধারণা বেড়েই যাচ্ছে।
কবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিছু বলবে?

“না বললেও তুমি জানো আমি কি জানতে চাই।

“জানি, তবুও বলো শুনি!

“এই নিয়ে পাঁচ জন পাঠালাম শান্ত’র‌ খোঁজ আনতে। পাঁচজনই যাচ্ছে ঠিক কিন্তু খবর নিয়ে ফিরছে না। আমি জানি এটা তোমার কাজ। জিজ্ঞেস করবো না কেন করছো? কিন্তু একটা কথা মনে রেখো শান্ত’র‌‌ খোঁজ আমি পেয়েই ছাড়বো আর তাকে নিয়েও আসবো এই বাড়িতে!

কবীর হাসল, আশালতা এখনো শান্ত কে সেই বাচ্চা’ই ভাবছে। বুঝতে পারছে কতো খানি সময় যে এখন পেরিয়ে গেছে। তার সেই ছোট শান্ত যে এখন আর ছোট নেই। তবুও আশালতার মন রাখতে বলল, “আচ্ছা এনো!

নিজের কথাগুলো বলে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছিল আশালতা। রাগে তার চোখ মুখ সব লাল হয়ে যাচ্ছিল। খানিকটা কাঁপছিলও সে। হঠাৎ কবীরের এই কথার জন্য তার রাগ টা কিছুটা হলেও কমলো। কবীর কাছে এসে আশালতার দুই বাহুতে হাত রেখে বলল, “চলো!

আশালতা হাঁটতে লাগল। তার শরীর এখন তার মনের মতোই দুর্বল। কে জানে আশালতা কতোটুকু শুনেছ। শান্ত’র এক্সি*ডেন্ট’র খবর নিশ্চয়ই শুনে নি। শুনলে নিশ্চিত এতো শান্ত থাকতো না।

——

শান্ত ভ্রু কুঁচকে দেখছে নিঝুম! এতো হেসে হেসে কেন কথা বলছে মেয়েটা। নিঝুম একবার এদিকেও ফিরল কিন্তু এমন ভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিল যেন কিছুই হয় নি। অথচ শান্ত সেই কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। চশমিশ কি তবে সত্যি সত্যি ভেবেই অশান্ত কে সে ইগনোর করবে।
আচ্ছা তা না হয় সব বুঝা গেল, কিন্তু নীলাভ্রের সাথে নিঝুমের এতো ভাব হলো কবে থেকে। শান্ত প্রায় অবাক নিঝুম আর নীলাভ্র কে দেখে। নিঝুম কি সুন্দর দিব্যি কথা বলে যাচ্ছে। কে বলছে কি জানি, কিন্তু নীলাভ্র যেভাবে হাসছে, সত্যিই কি এমন হাসির কথা বলছে। আহিম পাশ দিয়ে যেতে নিতেই শান্ত শক্ত করে তাকে ধরে বলল, “এই দেখ তো এটা!

“কি দেখবো?

“দেখতে পাচ্ছিস না কিছু?

“দেখার কি আছে নীলাভ্র আর ঝুমঝুমা ঝুম ঝুম কথা বলছে।

“ভালো করে দেখ, আর কিছু দেখছিস না?

“ওহ আচ্ছা, কথা বলছে আর হাসছে।

শান্ত এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই কি সত্যি আর কিছু দেখতে পাচ্ছিস না।

রাগের কারণ খুঁজে পেল না আহিম।‌ তবুও আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ মানে একটু বেশিই ভাব আর কি, কিন্তু এটা কবে হলো

“হ্যাঁ এটাই জিজ্ঞেস করছি।

“তবে নীলাভ্রের জায়গায় তুই থাকলে বেশ মানাতো।

“হুম ঠিক বলেছিস, ( হতচকিয়ে গিয়ে) ননাহ মানে কি বলছিস এসব। আমি কেন থাকবো।

“হ্যাঁ তাই তো, আমি তো এভাবেই এভাবেই বললাম। তবে পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে কেন। কি জ্বলছে!

শান্ত ঠোঁট কামড়ে ধরল।‌ আহিম হাসি থামানোর চেষ্টা করল। শান্ত বলতে নিল, “হ্যাঁ জ্বলছে তো, তোমার বা…!

কথা শেষ হবার আগেই তিথি এসে চেঁচিয়ে বলল, “এই আহিমের বাচ্চা!

শান্ত বাকি কথা পেটে চালান করলো। আহিম বলে উঠল, “কি হইছে?

“আপনি আমার সব পোস্ট এ হা হা রিয়েক্ট কেন দিছেন?

“রিয়েক্ট তো আমিই দিবো, যা ইচ্ছে হয় তাই দিবো।

“তাই বলে আমার এমন সুন্দর সুন্দর ছবিতে কেন দিলেন?

“ছবি গুলো সুন্দর’ই ছিল তবে তুমি তো সত্যি আর এতো সুন্দর নয়।‌ কোন অ্যাপ দিয়ে ইডিট করলে!

তিথি বিস্ফো*রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।‌ আহিম আর শান্ত’র‌ বেশ মজা লাগছে। কিন্তু তিথি দ্রুত তার মুখের ভঙ্গি চেঞ্জ করে ফেলল। এখন চোখে পানি টলটল করছে। সে ভার ভার গলায় বলল, “আমি তাহলে দেখতে এতো অসুন্দর!

থতমত খেয়ে গেল দুজনেই। এই মেয়ে এই কাদলো বলে। চোখের অশ্রুও গড়িয়ে পড়ল। তিথি চলে গেল কাঁদতে কাঁদতে।‌ শান্ত পিঠে চড় মেরে বলল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন, মেয়েটাকে কাঁদিয়ে ছাড়লি। এখন যদি পুরো ক্যাম্পাসে এমন কেঁদে বেড়ায় কি হবে ব্যাপারটা!

আহিম মাথা চুলকাতে চুলকাতে ছুটল তিথির পিছনে। শান্ত হাঁপিয়ে উঠে পেছন ফিরে দেখল নিঝুম আর নীলাভ্র দুজনের কেউই নেই। ব্যাপার কি গেলো কোথাও? কি হচ্ছে কি এসব? আহনাফ কে দ্রুত বলতে হবে, নিঝুমের কথাটা। কি করতে চলেছে এই মেয়েটা!

এদিকে নীলাভ্র আর নিঝুম দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো একপাশে।‌ নীলাভ্র এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার আর শান্ত’র‌ কি ঝগড়া হয়েছে?

নিঝুম চোখের চশমাটা মুছতে মুছতে বলল,‌”না ঠিক ঝগড়া না। অশান্ত আমায় ইগনোর করছে তাই আমি ভাবলাম আমিও করি!

“কোন কারণ ছাড়াই, হঠাৎ করে!

নিঝুম চোখের চশমা পড়ে সামনে ফিরে বলল, ” মনে হচ্ছে পেয়ে গেছি!

“কিহহ ( সামনে ফিরে ) ওহ তানিশা!

তানিশা হেসে সামনে এগিয়ে এসে নিঝুমের দিকে ফিরে বলল, “যাই বলো, কিছু আছে তো আছেই তোমার মধ্যে। আগে আহনাফ আর শান্ত আর এখন, নীল তুই!

নীলাভ্র বেশ জানে তানিশা নিঝুম কে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সত্যি বলতে নিঝুমের সাথে থাকতে এখন তার বেশ ভালো লাগছে। তবে এই ভালো লাগার ব্যাপারটা প্রকাশ করা যাবে না। সে কোনরকম অজুহাতে সরে গেল সেখান থেকে। নিঝুমের দৃষ্টি এখনো তানিশার দিকে। মুখোমুখি দুজন!

“আমার মন বলছে তুমি কিছু একটা পেয়েছ?

“পেয়েছি তো অবশ্যই, কিন্তু সেটা তোমার জন্য বোধহয় ভালো না।

“শত্রু তাহলে আমাদের ভিতরেই!

তানিশা মুখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। মেঘলা মেঘলা আকাশ দেখতে আজ বেশ ভালো লাগছে। বৃষ্টি হলে খুব ভালো হতো।‌ ঝিরঝিরে বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে।‌ হঠাৎ নিঝুম বলে উঠল, “আকাশের মেঘ কেটে যাবে, বৃষ্টি হবে না!

তানিশা সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিল।‌ নিঝুম কে দেখে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “তোমার আকাশের মেঘ যে এতো সহজে কাটবে না। সেখানে এবার ঝড়ের আভাস পাচ্ছি আমি!

“কি বলতে চাও?

“ঈর্ষা কি জানো তুমি?

“যা তুমি আমায় করো!

“তোমার সত্যি মনে হয় আমি তোমায় ঈর্ষা করি।

“সন্দেহ নেই।

তানিশা সামনে এগিয়ে এলো। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে নিল। তানিশা ফিসফিসিয়ে বলল, “সত্যিই বলেছো। আমি তোমায় ঈর্ষা করি কারণ তুমি আমার থেকে আমার আহনাফ কে কেড়ে নিচ্ছ। বিশ্বাস করো,‌অনেক খুশি হতাম যদি মানতে পারতাম, তোমাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা আমিই করি!

“কি বলতে চাও!

তানিশা মৃদু হাসল। কানের কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আমার চেয়েও অনেক বেশি ঈর্ষা আর ঘৃণা করে তোমায় আরেকজন। সে তোমার বড্ড কাছের। এখন ভেবে নাও তুমি কি করবে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখো,‌তোমার ক্ষতিতে কিন্তু সবচেয়ে বেশি খুশি আমিই হবো!

হাতে একটা কাগজের চিরকুট দিয়ে বলল,‌”চেক ইট!

নিঝুম চিরকুটার দিকে তাকিয়ে রইল।‌ তানিশা আবারো তাকে দেখে হাসল। নিঝুম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।‌ “আমার কাজ শেষ”! বলে তানিশা সেখান থেকে চলে গেল। নিঝুম হাতের চিরকুট খুলে দেখবার আগেই তিথি দৌড়ে এসে বলল, “তুই এখানে, চল আমার সাথে চল!

“কোথায় যাবো?

“আয় তো!

হাত টেনে ধরে নিয়ে এলো তিথি। ছোট একটা মিটিং বলেই মনে হচ্ছে। মিটিংএ সবাই আছে শুধু রিয়া ছাড়া। এদিকে শান্ত আরেকবার তাকিয়ে দেখল আরেকজন নেই নীলাভ্র! নিঝুম আছে নীলাভ্র কোথায়?

আফিন মাথা চুলকাতে লাগল,‌ ইফা কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, “কাল তো বউয়ের বার্থডে আর তুই সেটাই ভুলে গেলি।

“বিশ্বাস কর আমার খেয়াল ছিল না।

দিয়া আফিনের ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “তা আর থাকবে কি করে? এদিকে রিয়া যে খুব বড়োসরো একটা সারপ্রাইজের পাবে বলে বসে আশা করছে সেই খেয়াল আছে।

“একটা তো দিলাম কিছুদিন আগে।

আহিম তার মাথায় বাড়ি মেরে বলল,‌”কিপ্টা কোথাকার?

তিথি মুখ টিপে হাসছে। ইফা আফিনের গাল টেনে বলল, “এভাবে বললে তো হবে না, প্রেম যখন করছো খরচা তো করতেই হবে।

“তোরা সবসময় আমার পিছন কেন লাগিস বল তো!

আহিম হেসে বলে উঠে, “আমাদের মধ্যে একমাত্র প্রেম তুইই করিস আমাদের আরেক বন্ধুর সাথে, তাই পকেট খালি তো তোর’ই করতে হবে।

আফিন চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। হঠাৎ মাঝখানে নিঝুম বলে উঠল, “কিন্তু এখানে আমাকে কেন ডাকা হলো!

তার এমন উটকো কথায় সবাই হতবাক! এর কোন উওর আদৌও কি আছে? তানিশা হেসে বলে উঠল, “আহনাফের বিশেষ ফ্রেন্ড বলে কথা, তোমাকে তো থাকতেই হবে তাই না!

কথাটা বলেই আহনাফের দিকে ফিরল। আহনাফের দৃষ্টি যে তার দিকেই ছিল এটা জানা ছিল না। তবে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল দ্রুত! আহিম বলে উঠল, “তুমি কি আমাদের ফ্রেন্ড ভাবো না!

শান্ত ফিসফিসিয়ে আহনাফের কানের কাছে বলল, “বকবকানি শুরু!

আহনাফ হেসে নিঝুমের দিকে ফিরল। নিঝুম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “না, তেমন কিছু না!

আফিন বলে উঠল, “তাহলে?

নিঝুম ভেবে পেল না কি বলবে। তার মাথায় শুধু চিরকুটের কথাই বাজছে। হঠাৎ এমন সময় ফোন বাজতেই তার ছুতায় পালিয়ে গেল সে। শান্ত ভ্রু কুঁচকালো। স্বাভাবিক ভাবে দেখলো শুধু বাকি সবাই!

নিঝুম ফোনে কথা বলতে বলতে এসে হাজির হলো নীলাভ্রের সামনে। নীলাভ্র তাকে দেখতে পেয়েই পল্টুর হাত ছেড়ে বলল, “তুমি একা কেন? বাকি সবাই কোথায়?

“ওরা কেউ আসবে না!

“আসবে না কেন? নাহলে ও খুঁজবে কিভাবে কে সেই মেয়ে!

নিঝুম দৃষ্টি ফিরাল ওদিকে। নীলাভ্র ওদিক তাকিয়ে বলল, “তুমি কি ভাবছো!

“যদি এটা সত্যি হয়?

“আমার বন্ধুরা এমন কখনো করবে না!

“বন্ধুদের মাঝে শত্রু লুকিয়ে থাকে।

“পাগল হয়ে গেলে নাকি!

নিঝুম হাসল। পল্টুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “দেখো তো, মেয়েটা ওদিকে আছে কি না!

নীলাভ্র চেঁচিয়ে বলে উঠল, “নিঝুম!

নিঝুম এতে পাত্তা দিল না। পল্টু দূর থেকেই দেখছে তাদের, সকলের আড়ালে! হঠাৎ পল্টু আঙ্গুল তুলে দেখালো একজন কে। নিঝুমের দৃষ্টি নির্বাক! নীলাভ্র ছুটে এসে পল্টুর হাত ধরে বলল, “ভালো মতে ভেবে বল,‌‌ শুধু শুধু একজন কে দোষ দিবি না!

চট করে মাথায় বাজল চিরকুটের কথা। নিঝুম দ্রুত চিরকুট খুলল। এবার বোধহয় সবকিছু্ই থমকে গেল। থমথমে চেহারায় নীলাভ্র কে বলে উঠল, “ও ঠিক বলেছে!

নীলাভ্র থেমে গেল। হতবুদ্ধি’র মতো চেয়ে রইল শুধু। তানিশার নজরে পড়ল নিঝুম কে। নিঝুম তার দিকেই চেয়ে আছে। সে আবারো হাসল। তার মুখে এবার রহস্যময়ী হাসি। দারুন লাগবে তার, দুই বান্ধবীর ঝগ*ড়া দেখতে!

——-

নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে তার মুখোমুখি, বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছে ইফা এমনটা করতে পারে তার সাথে।সতিই কি ভালোবাসা এভাবেই বন্ধুত্ব কে নষ্ট করে দেয়। রাগে ফুসফুস করছে ইফা, নিজ বন্ধুর চোখে এভাবে ঘৃণা দেখতে পেয়ে হতবাক সে। তবুও হেসে নিঝুম মৃদুস্বরে ইফার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “যার জন্য এমনটা করলি, তাকে কি তুই সত্যিই পাবি ইফা। অশান্ত কি সত্যিই তোকে ভালোবাসে!”

ইফা রেগে গেল, বিচলিত হয়ে তাকিয়ে রইল নিঝুমের দিকে। অস্থির হয়ে পড়ছে সে। চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। সামনে এসে মিনতি করে নিঝুম কে বলল, “নিঝুম তুই চলে যা, প্লিজ তুই চলে যা। আমাদের মাঝে থেকে চলে যা।

“আমি তো তোদের মাঝে আসি নি!

“এসেছিস তুই! তুইই এসেছিস আমাদের মাঝে। ( কাছে এগিয়ে নিঝুমের বাহু শক্ত করে ধরে ) আমি ভালোবাসি শান্ত ভাইয়া। অনেক অনেক‌ বেশি ভালোবাসি। তার পাশে কাউকে সহ্য হয় না আমার, কাউকে না।

“বন্ধুত্বের নামে এভাবে ঠকালি আমায়!

“সরি নিঝুম!

বলা মাত্র ইফা নিঝুম কে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল ছাদ থেকে। নিঝুম নির্বাক! শান্ত ফোন হাতে সবে বের হতেই উপর থেকে চশমিস কে পরতে দেখে নিস্তব্ধ!

#চলবে….

[ পরবর্তী পর্বের একটু টুইস্ট দিলাম, এখন না বুঝলে পরের পর্বে ঠিক বুঝবেন। আর হুম একটা অনুরোধ, আমার ভুল গুলো দয়া করে কমেন্ট এ বলবেন। আমি সুধরানোর চেষ্টা করবো। যদি আপনারা কখনো না বলেন তাহলে আমার চোখেও কখনো পড়বে না। আসসালামুয়ালাইকুম 🌼 ]

Mimi Muskan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here