তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৪২+৪৩

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৪২

মিঃ জায়ান আহমেদ’র দুই কন্যা সন্তান ছিলেন, হৈমন্তী আর আশালতা। তার পুরো পরিবার লন্ডনে সিফট হবার কিছু বছর পর’ই তার স্ত্রী মারা যায়। আশালতার বয়স তখন ১৫ বছর। তার খালা দিতা বেগম আশালতা কে নিয়ে তার কাছে রাখেন। হৈমন্তী তখনো ছিল তার বাবা’র সাথে। হঠাৎ এভাবে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় অনেকটাই ভেঙে পড়েন তিনি। নিজের বাবা’র কাছে থেকে তাকে দেখেশুনে রাখতো হৈমন্তী! একই মায়ের দু বোন হওয়া সত্ত্বেও তাদের আচরণ ছিল ভিন্ন। হৈমন্তী অনেকটাই ঘরোয়া থাকতে পছন্দ করতো অন্যদিকে আশালতা ছিল ভিন্ন। কিন্তু দু’বোনের ভালোবাসা অক্ষত ছিল। প্রচন্ড রকম ভালোবাসতো দু’বোন দুজনকে।

আশালতা যখন নেপালে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যায় তখন তার দেখা হয় একটা ছেলের সাথে। শুধু মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য ঘুরতে যায় সে, এর মাঝেই সেই ছেলের সাথে চেনা জানা হয়ে যায়। নিজের মনের অজান্তেই তাকে ভালোবেসে ফেলতে শুরু করে আশালতা। এই কথাটা অবশ্য হৈমন্তী জানতো, তাকে বলেছিল, “একটা অচেনা ছেলেকে সে তার মন দিয়ে বসেছে। যদিও ছেলেটার নাম ছাড়া এখনো কিছুই জানে না সে।”

বোনের এমন পাগলামী কথা শুনে হৈমন্তী হাসতো। হেসে বলতো, “দেখিস বোন, শেষে না কোন ঠক বাজকে ভালোবেসে ফেলিস।

“আপা এভাবে বলিস না।”

“তো আর কি বলবো, চেনা নেই জানা নেই এমন একটা ছেলেকে ভালোবেসে ফেললি, এটা বললেই কি হলো নাকি। দেখি একটা ছবি দে তো ছেলেটার।”

“ইশ, রে আপা, ছেলেটর কোন ছবি তো নেই আমার কাছে।”

“যা, যাকে মন দিয়ে বসলি তার ছবি নিতেই ভুলে গেলি, তা মনটা কি ফেরত এসেছিস নাকি সেটাও দিয়ে এসেছিস!”

আশালতার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সত্যি, অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। ছেলেটার কোন খোঁজখবর নেওয়া হয় নি, এমনকি তার নামটা ছাড়া আর কিছুই জানে না আশালতা। আর কি কখনো দেখা হবে ছেলেটার সাথে তার। কে জানে? আশা ছেড়ে দিয়েছিল আশালতা!

পরের বছর আবারো সেই ঘুরতে যাবার জন্য নেপালে পা রাখল আশালতা। সেই একই রিসোর্টে গিয়ে উঠল। এবার একাই এসেছিল, কারণ একটাই ছিল। সেই ছেলেটার সাথে আবার দেখা করবার। এবার অবশ্য এক সপ্তাহের জন্য’ই এসেছিল সে।
দেখতে দেখতে কেটে গেল ৩ টি দিন, কিন্তু এখনো সেই ছেলেটার কোন খোঁজ পেলো না সে। এখানে আসাটাই যেন বোকামি হয়ে গেল। তার মন বলছে বলে এসেছে কিন্তু এর মানে এটা নয় সেই ছেলেটাও আসবে। কেন আসবে? এখন সে যেটা অনুভব করছে সেই ছেলেটাও যে সেরকমই অনুভব করছে এমন তো কোন মানে নেই। বিষণ্ণ মনে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। এতো সুন্দর, শীতল আবহাওয়ায় যে কারোরই মন ভালো হবার কথা ছিল, সেখানে তার মনটাই ছিল বিষণ্ণ! আশালতা মুখ ফিরে তাকিয়ে দেখল আরো অনেক কাপল একসাথে ঘোরাঘুরি করছে। সকাল সকাল এমন একটা আবহাওয়ায় দুজন প্রিয় মানুষ সময় কাটাচ্ছে, হাতে হাত রেখে হাঁটছে তো চা খাচ্ছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কেন আসতে গেলো একা একা! বড্ড ভুল হয়ে গেছে তার, বড্ড! গতরাতে হৈমন্তী কে বলছিল তার এই বিষণ্ণ মনের কথা। হৈমন্তী বলল, “এভাবে একা কষ্ট না পেয়ে তার কাছে চলে যেতে। সেই ছেলেটা যে সত্যি আসবে এমন তো কোন মানে নেই।”

সত্যিই বলেছে হৈমন্তী। আশালতাও ভেবে নিল আগামীকাল’ই চলে যাবে সে। তবুও আজ একটু আশা রাখবে, যদিও একদিনে যে তার স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাবে এমনটা তো আর না। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কফি মগে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। সকালে সূর্য তো উঠে গেছে অনেকক্ষণ তবুও চারদিকে ঘন কুয়াশা। গলায় মাফলার টা জড়িয়ে নিল আশালতা। খুলে দিল তার জানালা, দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। কোন ওয়েটার এসেছে হয়তো, নাস্তা তো ঘরেই দিয়ে যাবার কথা ছিল। দরজা খুলতেই যেন চমকে উঠল আশালতা। সেই ছেলেটায় দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। প্রথমে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না আশালতার, স্বপ্ন’ই মনে হচ্ছিল তার। তবুও এক ধ্যানে ছেলেটার দিকেই তাকিয়ে রইল। আগের চেয়ে এখন অনেকটাই বদল ঘটেছে। চেহারার বদলের একটাই কারণ, থিতুনির কাছে তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আশালতার বেশ মনে আছে, গতবছর তো দাড়ি ছিল না, এবার আছে। এটা সত্যিই তো সে!

মৃদু স্বরে সে নিজেই বলে উঠল, “চিনতে পেরেছেন আমায়, আমি কবীর!

খানিকটা ধাক্কার মতো গেল আশালতা। প্রায় এক বছর পর শুনছে সেই আওয়াজ, এই শীতের মাঝেও তার কান দিয়ে বোধহয় গরম ধোঁয়া বের হচ্ছিল। আশালতা কিছু না বলে শুধু হাসল। ভীষণ ইচ্ছে করছিল ঝাপটে এসে তাকে ধরতে। কবীর হেসে আবারো বলল, “মিস আশা!

“আমি আশালতা!

“জানি, আমি তো শুধু একটু শর্ট করে বললাম। তা ভিতরে আশবার অনুমতি কি দিবেন আমায়।

“আসুন, তা এখানে কি ভেবে আসা!

“বলতে পারেন বিশেষ কোন কাজে..
কিঞ্চিত হাসল কবীর। দুজনেই হেঁটে চলে এলো বেলকনির দিকে। চেয়ারে বসে চোখ ফিরাল আশালতার দিকে। মেয়েটা বোধহয় অনেকটাই সুন্দর হয়ে গেছে। প্রচন্ড শীত খানিকটা কাবু করে বসেছে তাকে। হাত ঘসছে বারবার। আশালতা তার দিকে ফিরতেই চোখ সরিয়ে নিল কবীর। সামনে তাকিয়ে বলল, “কাকতালীয় ব্যাপার বটে, আমি তো ভাবিই নি আপনি আসবেন।”

আশালতা গ্রিলের কাছে ঘেসে দাঁড়িয়ে বলল, “তা ঠিক বলেছেন।

“আপনি বোধহয় জানতেন আমি আসবো, তাই কি মিস আশা!

চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল। আশালতা চোখ সরিয়ে বলল, “হঠাৎ এই কথা কেন মনে হলো?

“না তেমন কিছু না, আগের রুমটাই নিলেন দেখি।

“খালি ছিল বলেই নেওয়া হলো, কফি খাবেন!

“খাওয়াই যায়, যদিও এক কাপ খেয়েই এসেছি।

“তাহলে আর দরকার আছে।

“দরকার আছে বৈ কি, আপনার একটু সঙ্গ দেই আর কি।

ফের ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“ব্রেকফাস্ট করেছেন!

আশালতা কে অনুসরণ করে,
“না, তবে আপনার কাছে এজন্য’ই এসেছি।

ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢালতে ঢালতে,
“কি জন্য?

“ইনভাইট করতে, আপনি কি আপনার সকালের মূল্যবান সময়টুকু আমাকে দিয়ে একসাথে ব্রেকফাস্ট করবেন।

কফি মগ এগিয়ে দিয়ে হাসল আশালতা।
“ভালোই তৈরি হয়ে এসেছেন দেখছি।

কফি মগে চুমুক দিয়ে, “দুঃখিত আপনাকে ওয়েট করানোর জন্য!

“মানে?

“আমি জানি, আপনি তিনদিন আগেই এসেছেন তবে আমার আসতে দেরি হয়ে গেল। গতরাতেই এসেছিলাম, তবে ওতো রাতে কোন মেয়েকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আলাপ করা নিশ্চয়ই ভদ্রতা বলে গণ্য হত না।

“বাহ ভালোই দেখছি। বেশি ভাবছেন, আপনাকে কে বলল আমি আপনার অপেক্ষা করছি।

“কি জানি, মনে হলো?

“মনকে নিজের আয়ত্তে রাখুন কবীর সাহেব!

কবীর আবারো হেসে বলল, “মন কি আর আটকে রাখার জিনিস, তা এবার চলা যাক। এমন সুন্দর সকালে যদি আপনার সাথে বসে ব্রেকফাস্ট না করতে পারি তাহলে দিনটাই ব্যর্থ!

“যদি বলি ব্রেকফাস্ট করেই বসে আছি।

“আমি খবর নিয়েই এসেছি!

আশালতা শব্দ করে হেসে বলল, “তাহলে বলি যেতে ইচ্ছে করছে না।

“এভাবে আমার হৃদয় ব্যাথিত করবেন আপনি, একটু মায়া করুন।

“মায়ায় জড়াতে চাইছেন দেখছি!

“যা আপনি বুঝেন।

কফি মগ রেখে বলল, “চলুন তাহলে।

কবীরের ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিত হাসির রেখা দেখা গেল। রায়ান তখন দরজায় বাইরে দাঁড়ানো। দুজনকে দেখতেই বলল, “স্যার সব তৈরি!

আশালতা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আপনি তো দেখছি বেশ গোছানো!

“এটাই তো মুশকিল, গোছানো মানুষকে কেউ ভালোবাসতে চায় না।

“তবে গোছানো মানুষ আমার পছন্দ!

বলেই হেসে এগিয়ে চলে গেল। কবীর মাথা চুলকে রায়ানের দিকে তাকাল। সে মুখ টিপে হাসছে। কবীর এবার পা বাড়াল। রিসোর্টের এক পাশে খালি জায়গায় বেশ সুন্দর করে আয়োজন করা হয়েছে সবকিছুই। সাদা পর্দা, সাদা টেবিল আর সাদা রঙের চেয়ারে সবকিছুই যেন শুভ্রতা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আশালতা মুগ্ধ হয়েছিল বলা যায়। কবীর চেয়ার টেনে দিল তার জন্য। আশালতা হেসে বসল তাতে। খানিকক্ষণ কেটে গেল এখানে বসে। কবীরের ব্যক্তিত্ব তাকে বরাবরই মুগ্ধ করে যাচ্ছিল। তার প্রেমে যে আশালতা হাবুডুবু খাচ্ছিল এতে কোন দ্বিধা নেই। এক সপ্তাহের ট্রিপে এসে এক মাস কাটিয়ে দিল এই অচেনা ছেলের সাথে।‌ মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে লাগল তাকে। যতই তার সাথে সময় কাটাতে লাগল ততোই যেন তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার সাধ জেগে উঠলো তার মনে। চঞ্চল এই মেয়ে সংসার গোছানোর কথাটুকুও ভেবে নিল। সম্পর্কটা গভীর হতে সময় নিল না। দুজনেই খুব কাছাকাছি হয়ে সময় কাটাচ্ছে। ঘনিষ্টতা বাড়ে দুজনের মধ্যেই! ফিরার আগে বেলকনিতে বসে একজনের কাঁধে মাথা রেখে বসে নিশ্চুপ ভাবে। আশালতার মনটা যে আজ বড় বিষণ্ণ! কবীর তার হাতের উপর হাত রেখে বলল, “এতো মন খারাপ করো না।

“তোমার হচ্ছে না।

“হচ্ছে, তবুও যতটুকু সময় একসাথে আছি একটু প্রাণ খুলে হাসতে তো পারি।

“তোমার ইচ্ছে হলে তুমি হাসো, আমার ইচ্ছে করছে না।

“আহ রাগ করছো কেন?

“তোমাকে না দেখে গোটা একটা বছর কাটাতে হবে আমায়।

“এতো টুকু অপেক্ষা করো,‌আমি ফিরেই বাবা কে বলবো তোমার কথা।

“সামনের বছর তুমি আসবে তো আমার সাথে দেখা করতে, ঠিক এখানে, এখানে আমার পাশে বসে হাতে হাত ধরে বলবে তো ভালোবাসি!

“আমি তো এখনো বলছি, আমি তোমায় ভালোবাসি!

“আগে বলো, রোজ কথা বলবে তো আমার সাথে।

“তোমার টেলিফোন নাম্বার আমার মুখস্থ, বলবো আরেকবার।

“না হয়েছে, রাখো!

বলেই আবারো কাঁধে মাথা রেখে চুপ হয়ে গেল আশালতা। কবীরের মনটা এবার ব্যথিত হলো। মুখ ফিরিয়ে আশালতার থিতুনি তে হাত রেখে বলল,‌ “এভাবে বসে থাকলে আমার কি ভালো লাগবে বলছো।

“জানি না,

“কিছুই তো জানো না, এবার না জেনে একবার হাসো তো দেখি।

“পারব না।

“কেন?

“হাসতে ইচ্ছে করছে না।

মুখ গোমড়া করে কথাটা বলল আশালতা। কবীর তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।‌ আশালতা কেমন বাচ্চাদের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরেকটু এগিয়ে চুমু খেয়ে বসল তার শুষ্ক ঠোঁটে। অজান্তেই হেসে ফেলল আশালতা। বুকের ভেতর মুখ গুঁজে বলল,‌”আমি তোমায় অনেক ভালবাসি গো, অনেক ভালোবাসি

“আমিও বাসি!

বুকে পাথর চাপা দিয়ে বিদায় দিল একজন আরেকজনকে। আফসোস হচ্ছিল বারবার, ইশ আরেকটু সময় যদি কাটাতো একজন আরেকজনের সাথে তাহলে কি খুব মন্দ হতো। এতো কষ্টে কান্না পাচ্ছিল বারবার। ইচ্ছে করছিল জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ‌। কিন্তু তা কি আর হয়, সে তো আর বাচ্চা নয়। কবীর দুই বাহুতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি আবার আসবো এখানে, আবারো দেখা হবে আমার।

অভিমানী স্বরে বলল,
“কথা দিচ্ছ তো।

“অবশ্যই।

শেষ বারেও তার হাসি মুখখানি দেখাতে হয়েছিল তাকে। ফিরে এলো অবশেষে, খালা তার দিকে ফিরে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। কিছু একটা টের পেয়েছে নিশ্চিত। তবুও আশালতা এড়িয়ে যেতে লাগলো। এতো এতো ছবি তোলা সত্বেও কোনোটাই দেখানো হলো না হৈমন্তী কে। কি করেই বা দেখাতো, দুজনের একসাথে তোলা ছবি দেখে যে তার গাল দুটোই লাল হয়ে যেতে। অন্যজন দেখে মজা নেবে এতে কোন সন্দেহ নেই। হৈমন্তী এতো বার চাওয়া সত্বেও তার ছবি দেখানো হলো না। শেষমেষ হৈমন্তী একটা নাম দিয়ে বসল, “আশালতা প্রেমিক বাবু!”নামটাই যেন স্থায়ী হয়ে গেল।

ঠিক পরের বছর আশালতা আবারো উপস্থিত সেখানে, সেই রিসোর্টে’ই। এবার কোন দিন ঠিক করেনি সে, যতদিন ইচ্ছে ততোদিন থাকবে। দরকার পড়লে তার সাথেই চলে যাবে। সব বন্দোবস্ত করেই এসেছিল। দিন পেড়িয়ে যেতে লাগলো তবুও যে তার দেখা মিলল না। আশালতা এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ করে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করল। প্রতিটা শীতের মনোমুগ্ধকর সকালের দৃশ্য একাই বিষণ্ণ মনে কাটাতে লাগল সে। একবার ফিরে যাবে বলেও আরো তিনদিন রয়ে গেল। এই কয়েকদিনে যে টেলিফোন করেনি তা না, কিন্তু ফোন যে লাগছিল না। চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল সে, এমনতো নয় বিপদ আপদ কিছু হলো। এদিকে দু সপ্তাহ আগে থেকেই বোনের বিয়ের জন্য ডাকতে ডাকতে অস্থির হয়ে উঠছিল তার বাবা জায়ান আহমেদ। ছোট মেয়েকে ছাড়াই বড় মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন করলেন তিনি। আশালতা এতে অবশ্য মন খারাপ করে নি। দোষ তো তার’ই ছিল, তবে অবাক লাগতে লাগল। এতো কিছু থাকতে বাবা শেষমেষ বাংলাদেশেই হৈমন্তী কে বিয়ে ছিল। কবীরও তো বাংলাদেশেই থাকে, সেখানে একবার যাবে নাকি সে। খোঁজখবর নিবে, বাংলাদেশ তো আর ছোট না তবে খোঁজা যে মুশকিল সেটাও না। ইচ্ছে করলে তো কতো কিছুই করা যায়।

মন ঠিক করে কঠিন মনোবলে পাড়ি জমালো বাংলাদেশে! সেই ৭ বছর বয়সে এখান থেকে চলে গিয়েছিল আর আজ তার বয়স ২১! বাহ অনেক গুলো বছর চলে গেছে তার জীবন থেকে। এয়ারপোর্ট থেকে নামবার সময়ই ভেবে নিল প্রথমে যাবে আপার বাসায়। তার সাথে দেখা, সুখ দুঃখের গল্প করে তিন দিন কাটানোর পরই কবীরের খোঁজে বের হবে।‌ আপা বলেছিল গাড়ি পাঠিয়ে দিবে, দুলাভাই না আসতে পারলেও গাড়ি দিয়ে কাউকে না কাউকে পাঠাবেই।‌ বিয়ে হয়ে গেছে দেড় মাস হতে চলল, এতোদিন পর বোনের শ্বশুরবাড়ি যাবে এটাও যেন কি লজ্জার বিষয়। একটা মাত্র’ই তো ছোটবোন তবুও সে আসলো না। সেই বাড়িতে কি কথাবার্তা কম হয়েছে নাকি।

কিন্তু বাইরে এসে যা দেখল এতেই যেন সে চমকে উঠল। রায়ান! এই রায়ান কে তো সে চিনে, কবীরের সাথে সবসময় থাকে। একপ্রকার ছুটেই গেল তার কাছে। রায়ানও যেন হতভম্ব, এদিকে আশালতা চোখে যেন অশ্রু বাঁধে না। এতো সহজে কবীর কে পেয়ে যাবে ভাবতেই পারি নি সে। কিন্তু এরপর যা শুনলো এতে তার দুনিয়ায় থমকে গেল। রায়ান কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু জিজ্ঞেস করছিল, “আপনি কি হৈমন্তী ম্যাম’র‌ বোন আশালতা।”

আশালতা তখনো হেসেই জবাব দিচ্ছিল। তার চোখে মুখে কৌতুহল ছিল। কৌতুহলে্র বশেই চট করে জিজ্ঞেস করল, “কবীর কোথায়? ও কেন আসেনি দেখা করতে। তুমি তো জানো, ও বলেছিল ও আসবে। আসেনি কেন?

কথাগুলো তিরিক্ষি মেজাজে বললেও তার চোখে মুখে অন্যরকম অস্থিরতা। কবীরের খবর শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছিল সে। তাই রায়ানের বলা অস্পষ্ট কথাটা শুনতে পারল না সে। কিন্তু দ্বিতীয় ঠিক’ই শুনলো। মুখটা তার থমথমে, “আপার সাথেই বিয়ে হয়েছে কবীরের!

তার পৃথীবিতে বেঁচে থাকাই যেন নিঃস্ব প্রমাণ হলো। নিঃশ্বাসটা বোধহয় আঁটকে যাচ্ছিল। হৃৎস্পন্দনও থমকে যাচ্ছিল। পড়ে যেতে নিতে নিতে রায়ান তার হাত খানি আঁকড়ে ধরল। আশালতা কখন যে কেঁদে উঠলো বোঝা গেল না। তবুও সে কাঁদতে লাগল, নিঃশব্দেই কাঁদতে লাগল।

গাড়ির পেছনের সিটে আশালতা বসে আছে। ড্রাইভারের সিটে রায়ান। আশালতার মুখটা এখনো থমথমে, রায়ান বুঝল আশালতা মেয়েটা অনেকটা শক্ত। নিজেকে ঠিক সামলে বসে আছে সে সত্যিটা শুনতে। রায়ান বলতে শুরু করল, “স্যার জানে না আপনি হৈমন্তী ম্যামের বোন!”

কঠিন গলায় বলল,
“কেন? জানলে বুঝি বিয়ে করতো না।

হতচকিয়ে গেল রায়ান। সে ইতিমধ্যেই ঘামতে শুরু করেছে। রুমাল বের করে ঘাম মুছে বলল, “বোধহয় করতো!

“ফোন কেন ধরছিল না আমার।

“বিয়ের কথা আপনাকে জানানোর সাহস হয় নি বলেই টেলিফোন ভেঙ্গে ফেলেছিল।

“বিয়ে কবে হয়েছিল,

“আপনার সাথে দেখা করতে যাবে বলে যেদিন ঠিক করল সেদিন।

“আপা কিছু জানে?

“আপাতত এখনো না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশালতা। রায়ান ভাবল প্রশ্ন করা বোধহয় শেষ। কিছু একটা বলতে নিবে তখনই আশালতা অনেকটা ক্লান্ত গলায় বলে উঠল, “আচ্ছা, বিয়েটা করা কি এতোই জরুরি ছিল!

রায়ান যেন তৈরিই ছিল। বেশ গুছিয়েই বলল, “কবীর স্যারের বাবা, দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বেঁচে থাকা অবস্থায় কবীর স্যারের বিয়ে দেখতে। কবীর স্যারের মা তাকে ছোট রেখেই মারা যান। তার বাবা’র কথা ফেলতে পারেন নি তিনি। তখনো ভেবেছিল আপনার কথা বলবে কিন্তু তার আগেই তার বাবা ঠিক করলেন তার বন্ধু জায়ান আহমেদ’র বড় মেয়ে হৈমন্তী ম্যামের সাথে কবীর স্যারের বিয়ে হবে। শয্যাশয়ী বাবার ইচ্ছে পূরণে এই বিয়ে করতে বাধ্য হন তিনি। অবশ্য বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই স্যারের বাবা মারা যান।

আশালতা শুধু বলল, ওহ!
তার মনে পড়ে বাবা তাকেও বলেছিলেন তার সাথে বাংলাদেশে আসতে। বাবা’র কোন বন্ধু অসুস্থে শয্যাশয়ী, তাকে দেখতে যাবেন। কিন্তু কবীর কে দেখার লোভে বাবার সাথে আর গেলো না আশালতা। এখন মনে হচ্ছে সেদিন বাবার সাথে আসলেই বোধহয় ভালো হতো। লোভে পড়ে এমন কাজটা না করলেও পারতো। তাহলে কবীর আজ শুধুই তার হতো। চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো আশালতা। রায়ান অনেকটা অপ্রস্তুত গলায় বলে উঠল, “ম্যাম, গাড়ি কি স্টার্ট দেবো।

“না, বাইরে বেরিয়ে জেনে আসো, লন্ডনে যাবার ফ্লাইট কয়টায়।

“ম্যাম আপনি কি পরের ফ্লাইটেই ব্যাক করবেন।

“হুম।

“কিন্তু হৈমন্তী ম্যাম যদি জানে..

“তোমার কি মনে হয় রায়ান, এখন ওখানে গেলে বেশি ভালো হবে আমার পক্ষে, মোটেও না আরো তিনটে জীবন নষ্ট হবে। কি হবে না !

রায়ান চুপ হয়ে গেল, আশালতা ম্যাম মিথ্যে কিছু বলে নি। সত্যি বলতে কবীর চৌধুরী এখনো আশালতা ম্যাম কেই ভালোবাসেন। একজন আদর্শ স্বামীর অভিনয় করার পরও দিনশেষে আড়ালে তিনি আশালতা ম্যাম কে নিয়েই ভাবেন। কিন্তু তার মুখোমুখি হবার সাহস নেই বলেই কিছু করতে পারছেন না।

রায়ান ফিরে এসে জানাল ৪ ঘন্টা পর একটা ফ্লাইট আছে। আশালতা হাসল, হেসে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

“আমি ফিরে যাচ্ছি রায়ান।

“ম্যাম, এতোক্ষণ কোথায় থাকবেন। আমি আপনার তো একটা….

“বাদ দাও! আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নেবো।

“আমি হৈমন্তী ম্যাম কে কি বলব?

“বলবে আমি ব্যাক করেছি, আমার এক বন্ধু নাকি অসুস্থ, তাকে দেখতে গেছি।

“ম্যাম অনেক রাগ করবে।

“কিছু করার নেই। তুমি চলে যাও রায়ান!

অতঃপর নির্বিকারে ব্যাগ হাতে সামনে এগিয়ে গেল আশালতা। ভাবতে লাগল, এই ৪ টা ঘন্টা তার কাছে ৪ বছরের মতো লাগবে।

হৈমন্তী অনেক কষ্ট পেলো, এতোই কষ্ট পেলো সে তার কান্না পেতে লাগল। কবীর অফিস থেকে ফিরতেই তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল সে। সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না কবীরের। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগল সে। হৈমন্তী অনেকটা নরম মনের মানুষ, তাই কিছুর তে কিছু হলেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয় সে। হৈমন্তী জড়িয়ে ধরলেই কবীরের বার বার মনে পড়ে আশালতার কথা। ইচ্ছে করে হৈমন্তী কে সরিয়ে দিতে কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর সব করা যায় না। বিয়ে করা বউ সে, দায়িত্ব অবহেলা করবে কি করে?

কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল হৈমন্তী। কবীর তাকে বিছানায় শুইয়ে চাদর টেনে নিল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে খোঁজ করতে লাগল রায়ানের। হুট করেই বিয়েটা হয়েছিল কোন ব্যবস্থা ছাড়া। হৈমন্তী শুধু তিনদিন থাকবে বলে বন্দোবস্ত করে এসেছিল। যখন এসেছিল তখন তার পরনে ছিল শার্ট আর প্যান্ট, বিদেশি বিদেশি ভাব। আর এখন, এখন সে শাড়ি পড়ায় অভ্যস্ত! খুব দ্রুতই সবকিছু সয়ে নিতে পারে। পর পর একসপ্তাহ শাড়ি পড়ে থেকেই দিব্যি এখন শাড়ি পড়ে ঘোরাফেরা করছে সে। আচ্ছা আশালতা কি এটা পারতো।

সিগারেট ধরাল কবীর, সচরাচর ধূমপান করে না। হৈমন্তীর পছন্দ না, তবুও মন খারাপ হলে আড়ালে খেয়েই থাকে। হেমন্তী অবশ্য বুঝতে পারে তবুও কিছু বলে না। একবার শুধু বলেছে, “আমার সামনে না পড়লেই হয়, যদি একবার পরো তাহলে দেখো।”

কবীর কিছু বলে না শুধু হাসে। আর একটা ব্যাপার অবশ্য আছে। মনে মনে ভাবছে, রায়ান এলেই তাকে বলবে। রায়ান এসে পাশে দাঁড়াল। অনেকটা বিচলিত সে। বাবা মারা যাওয়ার পর তার সব ব্যবসাপাতি এখন দেখতে হচ্ছে কবীর কেই। তার একজন সহকারী শুধুই এই রায়ান।

সিগারেটের ছাই এসট্রে তে ফেলে কবীর বলে উঠল, “কি হয়েছে ?

“কিছু না স্যার!

“অনেকটা অস্থির লাগছে যে তোমায়।

“কিছু না স্যার, আপনি ডেকেছিলেন!

“হুম। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো।

“বলুন স্যার

“আমি একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছি।

“কি ব্যাপার স্যার?

“বলছি, তার আগে বসো তুমি।

রায়ান বেশ অনেকটা ভয়ে ভয়েই বসল। কবীর শান্ত ভাবেই বলল, “তুমি একটা জিনিস খেয়াল করেছো?

“কোনটা স্যার?

“হৈমন্তী আর আশালতার চেহারায় কিন্তু অনেক মিল আছে!

রায়ান চুপ হয়ে রইল। কবীর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “আবার ওদের নামও মিল। তা তুমি তো আজ ওর বোনকে দেখলে, কি মনে হলো?

“মনে হবার কি ছিল?

“আশালতা চলে গেল কেন?

“তার বন্ধু অসুস্থ ছিল বলে!

কবীর কিছু বলল না। আবারো নতুন করে সিগারেট ধরাল সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রায়ানের দিকে।‌এদিকে রায়ান আঁতকে অস্থির। না জানি আশালতা ম্যামের খবর পেয়ে কবীর স্যার কি করবে। কিছুক্ষণ পর পরই ঢোক গিলছে সে। কবীর শীতল গলায় বলে উঠল, “আমার কাছ থেকে কি লুকাচ্ছ রায়ান।

“কিছু না তো স্যার।

“তুমি আমার খুব বিশ্বস্ত জানো?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রায়ান। অপ্রস্তুত গলায় বলে উঠল, “হৈমন্তী ম্যামের বোন’ই আশালতা স্যার।‌ আপনার বিয়ের খবর পেয়েই চলে গেছে উনি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কবীর! ক্লান্ত গলায় বলল, “ফ্লাইট কখন তার?

রায়ান ঘড়ি দেখল। ঘড়ি দেখে বলল,‌ “৪০ মিনিট পর!

অসহায়ের মতো কবীর বলল,
“আমাকে তুমি একবার নিয়ে যাবে রায়ান,‌ তার কাছে ক্ষমা চাওয়া যে খুব দরকার আমার।

রায়ান মুখ তুলে তাকাল কবীরের দিকে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে তার। সে শুকনো ঢোক গিলল।

এয়ারপোর্টে আসতে আসতে তখন বেশ দেরি হয়ে গেল। আশালতা চলে গেছে। অক্লান্ত দেহ, অজানা কষ্ট আর ব্যর্থিত হৃদয় নিয়ে বের হলো কবীর! গাড়ির কাছে আসতেই নিচে পড়ে গেল সে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে উপড়ে তাকাল সে। একটা প্ল্যান উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। কবীর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেখানে। রায়ান তাকে উঠানোর জন্য বসে পড়ল। হাত ধরে বলল, “উঠুন স্যার!

“আশালতা অভিমান করে চলে গেছে রায়ান, আমি শেষবারের মতো তার কাছে ক্ষমাও চাইতে পারলাম না। আমি আর জানি না তার সাথে দেখা হবে কি না।‌ অনেক রাগ পুষে রাখবে সে আমার জন্য, অনেক অভিমান করবে। ঘৃণায় আমার মুখটাও দেখতে চাইবে না আর।‌ এগুলো কি সত্যিই আমার প্রাপ্য ছিল রায়ান!

রায়ান কিছু্ই বলল না। নিরব হয়ে রইল। কবীর চোখ বন্ধ করল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আশালতার মুখখানি। বেচারি অনেক অভিমান নিয়ে বলেছিল, “তুমি আসবে তো আমার সাথে দেখা করতে, বলো না আসবে তো! জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি গো, অনেক ভালোবাসি!

কবীরও ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, “আমিও তোমায় অনেক ভালোবাসি!
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৪৩ [ প্রথমাংশ ]

আজ বহু বছর পর তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশে পা রাখতে চলেছে আশালতা। এর আগেও আরেকবার এসেছিল যখন শান্ত’র জন্ম হয়, তখন! এসেছিল বাবা’র সাথেই আবার কিছুদিন পর ফিরেও গেছে বাবার সাথে। কিন্তু এবার সে একাই এসেছে, এসেছেও আজ অনেক বছর পর। এখন অবশ্য শান্ত অনেক বড় হয়ে গেছে। ৮ কি বা ৯ বছর তো হবেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশালতা। বোনের সংসার সুখের আছে বলে নিজের ব্যাথিত হৃদয় কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলে তার। বাইরে এসে খোঁজ করতেই দেখল কবীর কে! চমকে উঠলেও সেটা প্রকাশ করল না। এতোবছর তাকে দেখেও কেন সেই আগের অনুভূতি! ভয়ে সারা শরীর কেঁপে উঠলো তার। এখানে আসাটাই কি ভুল হলো নাকি। ইচ্ছে করছে এখন’ই চলে যেতে। কিন্তু পারছে না,‌ হেমন্তী বেশ কিছু মাস ধরে অসুস্থ, বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না। বোনের এই দুঃসময়ে তাকে পাশে চাইছে হৈমন্তী। কিভাবে না এসে পারত, কিন্তু এখন তো ভয় হচ্ছে বোন কে আরো কষ্ট দিয়ে না ফেলে। কবীরের থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল আশালতা। হেসে বলে উঠল, “আরে দুলাভাই যে, কেমন আছেন?

কবীর যেন তৈরিই ছিল। মৃদুস্বরে বলল, “ভালোই! তুমি বলো কেমন আছো? আসতে কোন অসুবিধা হয় নি তো।

“না, কোন অসুবিধা হয় নি। শান্ত কেমন আছে?

“ভালোই আছে। গাড়িতে বসো!

বললাম আশালতার ব্যাগ গুলো নিয়ে গাড়ির ডিকিতে রেখে দিল। আশালতা বসল গাড়ির পিছনে সিটে। এই দৃশ্য কবীরের মন ব্যাথিত করল। ড্রাইভিং‌ সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট কবীর। দুজনেই নিঃশব্দে কাটালো কিছুক্ষণ। আশালতার বরাবর মনে হচ্ছে কবীর আয়নাতে তাকে দেখছে। নিজের মন ঠিক রাখা যেন মুশকিল হয়ে পড়ছে। অস্থির হয়ে যাচ্ছে আশালতা। গাড়ির জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকাল আশালতা। এখন কিছুটা হলেও ভালো লাগছে তার।‌ কিছুক্ষণ পর নিজেই জিজ্ঞেস করল, “আপা এখন কেমন আছে?

“মোটামুটি ভালো।

“মোটামুটি ভালো? কেন? কি হয়েছে আপার?

“ডাক্তার দেখানো হয়েছে। সবাই বলছে হৈমন্তীর হার্ট নাকি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে!

“কিহ?

“চিকিৎসা করা হচ্ছে, ঔষধও নিচ্ছে। সুস্থ হতে সময় লাগবে। দিনরাত টেনশন করে বলে এই অবস্থা। সারারাত ঘুমায় না সে।

“এসব কি বলছেন? সারারাত ঘুমাবে না কেন?

“আমি জানি না।

“জানেন না কেন? স্বামী হয়ে স্ত্রীর সেবাযত্ন করতে পারছেন না। এসব কি? নিজের স্ত্রীকে নিজের ভালোবাসায় সুস্থ করে তুলবেন, তা না করে তাকে অসুস্থ করে দিচ্ছেন।

এক প্রকার রেগেই কথাগুলো বলল আশালতা। রাগে ফুসফুস করছে এখন সে।‌ কবীর শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, “আমি যতটুকু পারি ততোটুকুই করছি। গত কয়েকমাস ধরে সব কাজ বন্ধ করে তার কাছেই আছি। খেয়াল রাখছি সবসময়।

আশালতা রাগ সামলে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কে জানে আপনার অবহেলায় আজ আপার এই অবস্থা!

“কি জানি।

“কতোটা নির্লজ্জ আপনি, এ কথাটা বলছেন কি করে?

“আশা, আমার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না।

“একটা মানুষকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে খু/ন করে ফেলছেন আপনি, সেই খেয়াল কি আছে আপনার!

চেঁচিয়ে বলে উঠল আশালতা। কবীর আয়নাতে তার মুখের দিকে তাকাল। রেগে লাল হয়ে গেছে সে,‌ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। রাগে রীতিমতো কাঁপছে সে। কবীর আর জবাব দিল না, জবাব দিলেই তর্ক বেঁধে যাবে। তার ইচ্ছে করছে না কিছু করতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি চালানোতেই মনোনিবেশ করল সে। আশালতা জবাব না পেয়ে আরো চটে গেল। সামনের বসা এই মানুষটিকে দেখে খুব ঘৃণা লাগছে তার, খুব! এতোটা নিষ্ঠু/র হৃদয়ের মানুষও বুঝি হয়। কিভাবে এতোদিন এই মানুষটির জন্য জন্য কাঁদল সে, কি ভেবে তাকে দিনের পর দিন ভালোবেসে গেল। ইচ্ছে করছে গাড়ি থেকে এখুনি নেমে যেতে। ঠান্ডা গলায় বলল, “গাড়ি থামান আপনি?

“পাগলামি করো না।

“আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আপনার সাথে এক গাড়িতে করে যাবার।

কবীর আবারো শীতল গলায় বলল, “হৈমন্তী আমায় নিজে বলেছে তোমাকে নিয়ে আসতে, দায়িত্ব পালন করছি আমি!

“দায়িত্ব! স্ত্রীর প্রতি নিজের যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন কখনো। আপনি যে কতোটা নিষ্ঠুর তা কি জানেন?

কবীর এবারো চুপ করে রইল। আশালতার ইচ্ছে করছে এখন কাঁদতে।‌বোনের সুখের জন্য নিজেই সবকিছু ছেড়ে চলে গেছিল। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে তার বোন’ই সুখে নেই। কেন হলো এমনটা? সেদিন হৈমন্তীর সাথে ফোনে কথাবার্তা বলার সময়’ই কিছু ঠিক নেই বলে মনে হচ্ছিল। ভ*য়ংকর কিছু হতে চলেছে তার মন বলছিল। ভয় করছে এখন না তা সত্যি হয়ে যায়। বোন কি সব জেনে গেলো তাহলে তার ব্যাপারে। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগল আশালতা। এখানে এসে মস্ত বড় ভুল করেছে এটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কবীর একবার দেখতে পেল আশালতা কাঁদছে, এভাবে তাকে দেখে খুব কষ্ট লাগছে তার।

বাড়িতে পা রাখতেই শান্ত দৌড়ে ছুটে এলো তার কাছে। ছোট শান্ত’র ছটফটানি দেখে খুব ভালো লাগছিল আশালতা। শান্ত’র মাঝে হৈমন্তী আর কবীর দুজনের ছোঁয়ায় আছে। যেমন তার মুখের ধরণ টা কবীরের মতো কিন্তু চোখ আর ঠোঁট দুটো হচ্ছে হৈমন্তীর মতো গায়ের রঙটাও হৈমন্তীর হুবহু! আশালতার গলা জড়িয়ে ধরল শান্ত। রোজ টেলিফোনে কথা বলে খালামনির সাথে। যদিও তাকে আম্মু ডেকেই অভ্যস্ত শান্ত। আম্মু আম্মু করে তার গলা জড়িয়ে ধরলো সে। এতোক্ষণ মনে যেই কষ্ট ছিল, নিমিষেই যেন তা উধাও হয়ে গেল। ছোট্ট শান্ত চুমু খেলো আশালতার গালে। আশালতা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে।

ভেতরে এসে দেখল হৈমন্তী হূস্থহুল কান্ড করে বসে আছে। বোন আসবে বলে, তার জন্য নিজের হাতে রান্না করতে ঢুকেছে রান্না ঘরে। ডাক্তার যেখানে তাকে বলেছে বেড রেস্ট এ থাকতে সেখানে তার এমন আচরণ অনেক ক্ষুদ্ধ করলো কবীর কে। আশালতা এসেছে দেখে হৈমন্তী খুশিতে চোখের জল ফেলে জড়িয়ে ধরল তাকে। হৈমন্তী কে দেখে আশালতা খুব অবাক! কি হলো আর এই কি হাল তার! বোনের এমন সুন্দর গায়ের রঙের এই কি হাল। অসুখ যে তাকে কাবু করে ফেলেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। চোখের নিচটা কালো হয়ে গেছে, কতোকাল ধরে ঘুমায় না কে জানে। যতটা কি না তার বয়স তার চেয়েও আরো বয়স্ক দেখাচ্ছে তাকে। আশালতা অবাক চোখে শুধু তাকিয়েই রইল। হৈমন্তী বোনের হাত ধরে তাকে বসিয়ে নাস্তা আনতে গেল। তার হাবভাব টা এমন কিছুই হয় নি। বেশ সুস্থের মতো চলাফেরা করছে। কোন মানুষ প্রথমে তাকে দেখে বলতেই পারবে না, দীর্ঘদিন ধরে সে অসুস্থ!

আশালতা বিরক্ত হয়ে বলল, “এসব কি করছিস আপা, তুই তো বাড়াবাড়ি করছিস?

“বাড়াবাড়ি কোথায় করলাম বোন, এতোদিন পর এলি তুই..

“এখুনি চলে তো আর যাচ্ছি না। পাগল হয়ে গেছিস তুই। ডাক্তার তোকে বেড রেস্ট এ থাকতে বলেছে সেই খেয়াল আছে।

“বাবা কেমন আছে?

“তোর চিন্তায় এখন নিজেও অসুস্থ, মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী বলে আসতে পারছে না। কিন্তু আসবে বলেছে।

“আর যা বললি, আমার বাবা এখনো আমার মা কে পাগলের মতো ভালোবাসে। পাগলপ্রেমিক বুঝলি! ( কবীরের দিকে তাকিয়ে ) তা তুমি শুনলে তো, আমি মা’রা যাবার পরও তুমি আমাকে ভালোবাসব তো, ভুলে যাবো না তো আবার।
অনেকটা অভিমান নিয়েই কথাটা বলল। কবীরের মুখে বিরক্তি প্রকাশ পেল। আশালতা বোনের হাতে হাত রেখে বলল, ” এ কি বলছিস পাগলের মতো কথাবার্তা, তোর ম*রতে যাবি কেন?

“আমার দিন যে ঘনিয়ে আসছে বোন, শোন আমি ম*রে গেলে আমার শান্ত কে দেখে রাখবি তুই। বুঝলি তো, একদম মায়ের মতো আগলে রাখবি তাকে।

“আপা, তুই বেশি বকছিস, আমি কি এসব শুনতে এসেছি তোর!

হৈমন্তী অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। কবীর কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার ঔষধের সময় হয়ে গেছে, ঘরে চলো।

“আহা, বোন এসেছে একটু গল্প করতে তো দাও।

“বোন পালিয়ে যাচ্ছে না, চলো এখন তুমি। খেয়েছো কিছু ( সার্ভেন্টকে উদ্দেশ্য করে ) ম্যামের খাবার ঘরে পাঠিয়ে দাও!

“আমি খেয়েছি তো!

“হুম,‌ভালো করেছো। চলো এবার!

এক প্রকার টেনেই হৈমন্তী কে নিয়ে চলে গেলো কবীর। শান্ত তখন দৌড়ে এসে বসল আশালতার পাশে। একটা কাগজ দেখিয়ে বলতে লাগলো, “আম্মু দেখো দেখো!

আশালতা তাকিয়ে দেখল ছবিতে একটা ছবি একা। এতোটা ভালো নয় তবু খুব খারাপও নয়। একটা বাচ্চা ছেলে মা আর বাবার হাত ধরে হাঁটছে। আশালতা বুঝতে পারল ছবি গুলো আসলে কাদের। সে হেসে শান্ত’র মাথায় হাত বুলাল।

রাতে বোনের সাথে গল্প করে শেষে ঘর থেকে বেরুতেই মুখোমুখি হলো কবীরের সাথে। আশালতা এড়িয়ে চলে গেল তাকে। কবীরের মনে হলো সে স্পষ্ট আশালতার চোখে তার জন্য ঘৃণা দেখতে পেল। বেশ কয়েকবছর আগেও যখন দেখেছিল তখন এই ঘৃণা দেখতে পায় নি সে। তখন তার দুচোখে দিল তাকে হারানোর বেদনা। কবীর তা স্পষ্ট বুঝতে পারতো। সেই বার শেষদিন যাবার আগে আশালতা খুব অভিমানী স্বরে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। সেদিন শুধু ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। এক পর্যায়ে কান্না থামিয়ে দু’চোখ মুছে কবীরের দিক করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমাকে দয়া করে ভুলে যেও তুমি। আপা কে কষ্ট দিও না কখনো, কথা দাও আমায় কখনো কষ্ট দিবে না।

কবীর মূর্তির মতো সেদিন শুধু তাকিয়েছিল। জবাব দেবার মতো কিছু্ই ছিল না তার। মুখ ফুটে কিছু বলবে তার আগেই কারো চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেল। দৌড়ে এসে দেখল সার্ভেন্ট চেঁচাচ্ছে। ঘরের ভেতর শান্ত কে কোলে নিয়েই হৈমন্তী জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। কোলের ভেতর শান্ত থাকায় অতোটা চোট পায় নি, কিন্তু এই শিশু প্রচন্ড রকম ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগল। এমনকি রাতে ভীষণ জ্বরও এলো। সারারাত আশালতা তাকে নিয়ে বসে রইল আর হৈমন্তী’র পাশে বসে রইল কবীর। প্রেসার বাড়ার কারণে এমনটা হয়েছিল বলে ধারণা। ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে যাবার পরই ঘুমিয়ে ছিল হৈমন্তী। পরদিনই আশালতা চলে গেল। কবীরের কিছুই করার ছিল না, সেদিন মুখ ফুটে সে আশালতা কে বলতে পারে নি, এখনো আশালতাকেই ভালোবাসে সে। অন্য কাউকে সেখানে জায়গা দেবে কি করে? না হৈমন্তী কে বলতে পেরেছে সত্যি টা। কতোটা ভীতু প্রকৃতির মানুষ সে! নিজের প্রতি এখন নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে কবীরের। আজ আশালতার চোখেও সেই ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে সে। আচ্ছা হৈমন্তী কি সেদিন তাদের দেখেছিল,‌ শুনেছিল তাদের কথা। হৈমন্তী অনেক নিশ্চুপ স্বভাবের। নিজের কষ্টটা ভেতরে রাখাই তার স্বভাব। যদি শুনেও থাকে তবে তাকে কখনোই কিছু জিজ্ঞেস করবে না, এখন অবদিও করে নি!

কবীর ঘরে ঢুকতেই হৈমন্তী উঠে বসল। বিছানার পাশে বসে বলল, “ঘুমিয়ে পড়ো!

“শান্ত আজ ওর আম্মুর সাথে ঘুমাবে বলে চলে গেছে।

“ঠিক আছে, তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়ো। ওর কথা না ভেবে নিজের কথাটা ভাবো।

“ওর কথা না ভেবে কি করে থাকবো বলো। আচ্ছা একটা কথা বলি!

হৈমন্তীর এমন কথায় খানিকটা চমকে উঠল কবীর। মলিন মুখে বলল, “বলো!

“তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো একটু!

“এসো!

হৈমন্তী কবীরের কোলে মাথা রাখল। ধীরে ধীরে বলল, “শান্ত যতদিন আশালতা’র সাথে ঘুমাবে ততোদিন আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো ঠিক আছে।

“আচ্ছা, এখন কথা না বলে ঘুমাও!

“ঘুম তো আসছে না যে, মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না।

“দিচ্ছি, তুমি কথা বাড়িয়ে না। ডাক্তার বলেছে, জলদি জলদি তোমায় ঘুমিয়ে পড়তে।

“ডাক্তার তো কতো কিই বলে, এটাও বলেছে আমি বেশিদিন বাঁ*চবো না, বলো!

কবীর জবাব দিল না। সে জানে, এখন জবাব দিলেই হৈমন্তী কথা বলতে থাকবে। আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। হৈমন্তী ঘুমিয়ে পড়ছে। সামনের আয়ানায় স্পষ্ট তার মুখটা দেখছে কবীর। বড্ড মায়া লাগছে হৈমন্তীর জন্য তার। কোনদিনও একটিবারের জন্য ভালোবাসতে পারে নি এই মেয়েটাকে। এতো নি/ষ্ঠুর কি করে হলো সে। আশালতা ঠিক’ই বলেছে, খুব নিষ্ঠু/র সে, খুব!

আশালতা’র কাছে আহনাফের গল্প করছে শান্ত। আশালতা গরম দুধের গ্লাস তার হাতে দিয়ে বলল, “আহনাফ বুঝি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড!

শান্ত মাথা নেড়ে বলল, “মা বলে আহনাফ আমার বড় ভাই! জানো তো আম্মু, আহনাফ সত্যি সত্যি ভাইয়ের মতো করে। কেউ আমাকে কিছু বললে খুব রেগে যায়।

“তাই নাকি!

“হুম হুম!

“আচ্ছা দুধের গ্লাস টা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ো, কাল তো স্কুল আছে সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।

“না, মা বলেছে কয়েকদিন স্কুলে যেতে না,‌ আমি কাল যাবো না। দেখবে তখন আহনাফ তখন আমার বাসায় আসবে। তোমাকে দেখাবো।

“আচ্ছা, দেখিয়ো।

শান্ত দুধের গ্লাস শেষ করে আশালতার হাতে দিল। শান্ত’র মুখ মুছে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল তাকে। শান্ত আশালতার গলা জড়িয়ে কানের কাছে বলল, “আম্মু একটা কথা বলি তোমায়!

“বলো!

“তুমি কাউকে বলবে না তো।

“না, বলবো না।

“জানো তো, তুমি আসার আগে মা প্রতিদিন রাতে না ঘুমিয়ে বসে বসে কাঁদতো!

আশালতা ভ্রু কুঁচকে ফিরল শান্ত’র দিকে। ভয়ে মুখটা ছোট হয়ে গেছে তার। কোন ভুল যেন করে ফেলেছে সে। আশালতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “বাবা অনেক রাত হয়ে গেছে, ঘুমিয়ে পড়ো তুমি!

শান্ত কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ল, এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। কিন্তু সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারল না আশালতা। কিছু একটা তো হতে চলেছে, তার মন বলছে ভয়া/বহ কিছু একটা হবে। একটা ঝড় আসবে, ঝড়ে বদলে যাবে কয়েকটা জীবন। কি করবে সে, কি’ই বা করার আছে তার!
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৪৩ [ বর্ধিতাংশ ]

শান্ত আর আহনাফ বাগানের কাছে খেলছে। দূরে ছায়ার তলে বসে আছে আশালতা আর হৈমন্তী। দুজনের হাতেই চায়ের কাপ। কবীর সকালে কোথায় বের হলো। আশালতা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একবার তাকাচ্ছে শান্ত’র দিকে তো আরেকবার তাকাচ্ছে হৈমন্তীর দিকে। তার মলিন মুখের মিষ্টি হাসি দেখে ভালো লাগল তার। আশালতা মৃদুস্বরে বলল,‌ “আপা এখন কেমন লাগছে তোমার?

“ভালোই লাগছে।

“শান্ত খুব খুশি নাহ!

“আহনাফ কে পেলেই অনেক খুশি। আচ্ছা দেখ না ওদের খাবার টা তৈরি হলো কি না, ওদের এভাবে দৌড়াদৌড়ি করতে মানা কর না। পড়ে গেলে লাগবে যে !

অনেকটা অস্থির হয়েই কথাটা বলল হৈমন্তী। দেখতে দেখতে শান্ত পড়েও গেল। তবে ব্যাথা পেল না। উঠে আবারো দাঁড়িয়ে খেলতে লাগল। আশালতা হৈমন্তীর হাতের উপর হাত রেখে বলল, “আপা শান্ত হও, সব হয়ে যাবে। তুমি খামোখা এতো টেনশন করছো।

“দেখলি, বললাম পড়ে যাবে আর পড়েও গেল। আবার দৌড়াচ্ছে। কে জানে লেগেছে কি না?

“আহ বড্ড ভাবছো তুমি।

“আমাকেই তো ভাবতে হবে, জানিস আহনাফের মা নেই। দেখ কি লক্ষী ছেলে, আহা বড্ড মায়া লাগে জানিস তো।

“হুম বুঝলাম, তোমার ঔষধের সময় হয়েছে আমি আনছি!

ঔষধ নিয়ে ফিরে এলো আশালতা। বোনকে ঔষধ খাইয়ে পাশে বসল সে। হৈমন্তী বিরক্তি মুখে বলল, “ঔষধ খেতে আর ইচ্ছে করে না। মুখটা তেতো হয়ে গেছে এতো দিন ঔষধ খেতে খেতে। ডাক্তার গুলোও বুঝলি পাগল, ভাবছে ঔষধ খাইয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। তা কি আর সম্ভব বল তো, আমি জানি আমার সময় হয়ে আসছে।

“খুব বেশি বকছো কিন্তু আজকাল।‌

“আচ্ছা আশা, তোর ওই প্রেমিক বাবুর খবর কি বল তো। আর পেলি কি তার দেখা।

“যে ছেড়ে চলে যায়, তার দেখা কি পাওয়া যায় আপা।

“বিয়ে করবি না বলেই কি ঠিক করলি নাকি?

“ইচ্ছে করছে না এখন এসব!

“এ কেমন কথা, সারাজীবন কি কুমারী হয়ে থাকবি নাকি।

“মন্দ কি আপা, বেশই তো আছি।

হৈমন্তী সেই কথা কানে তুললো না। সে দেখছে শান্ত কে। ভাবছে তার চলে যাবার পর শান্ত’র কি হবে? আশালতা হাতের উপর হাত রেখে বলল, “কি ভাবছিস এতো আপা?

“আশা একা কথা রাখবি আমার!

আশালতা’র হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল তখনই। হৈমন্তীর মুখখানি কেমন জানো লাগছিল তার কাছে। তার দিকে ফিরে মুচকি হেসে বলল, “আমার কিছু হয়ে গেলে শান্ত’র খেয়াল রাখবি, শান্ত তোকেও তো আম্মু বলে ডাকে। নিজের ছেলের মতো রাখবি ওকে বুঝলি। কখনো কষ্ট পেতে দিস না, আগলে রাখিস কি রাখবি তো আশা!

“এ কি ধরণের কথা বার্তা আপা, তুই কোথায় যাবি যে আমায় এসব বলছিস।

হৈমন্তী জবাব দিল না, তার চোখ দুটো ভিজে উঠছিল। আশালতার চোখ থেকে সেটা আড়াল হলো না তবুও নিরব হয়ে গেল সে। হৈমন্তী চোখের অশ্রু মুছে আবারো দেখতে দেখতে লাগল শান্ত কে। ইচ্ছে করছে চেঁচিয়ে বলতে, এভাবে ছোটাছোটি করো না শান্ত লাগবে যে, বাবা আহনাফ! থামতে বলো না ওকে!

শান্ত মায়ের ঘরের দরজায় আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা কাঁদছে, খুব খারাপ লাগছে শান্ত’র‌। আগে মাঝে মাঝেই ঘুম থেকে জেগে দেখতো মা কাঁদছে। বিছানার এপাশে তখন বাবা কে খুঁজে পেতো না সে। এখন তো বাবা কে পায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাবা থাকলে মা কে কাঁদতে দেখতে পেতো না শান্ত। এটা তার বেশ ভালো লাগতো। বাবা কে মনে হতো যেন সুপারম্যান!

কিন্তু আজ কিছু বছর হলো সে এখন আর মায়ের সাথে ঘুমায় না। এখন তার আলাদা ঘর হয়েছে। সেই ঘরেই ঘুমোয় সে। মা কে তেমন আর কাঁদতে দেখতো না ‌। মা হাসতো! খিলখিলিয়ে হাসতো, মায়ের হাসির শব্দ শুনতে খুব ভালো শান্ত’র! কিন্তু আজ মা কাঁদছে, কেন কাঁদছে? কি হয়েছে মায়ের। মা’র কি কষ্ট লাগছে, কিন্তু কেন লাগছে। সে কি আম্মু কে ডেকে আনবে।

শান্ত গুটিগুটি পায়ে ভেতরে আসতেই হৈমন্তী টের হলো। দ্রুত তার বাক্সে কিছু একটা রেখে দিল। শান্ত’র চোখে পড়ল, মায়ের একটা বাক্স আছে। তাকে দেখলেই মা বাক্স টা আড়াল করে রাখে। কি আছে এতে?

দ্রুত চোখের জল মুছে ফেলল হৈমন্তী। শান্ত কে ডেকে বলল, “আমার বাবা ট এসে গেছে গেছি দেখি।

আদুরে গলায় শান্তও ডেকে উঠে, “মা!

হৈমন্তী হেসে কাছে ডাকে তাকে। শান্ত বিছানায় উঠে কোলে মাথা রাখে হৈমন্তীর। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে হৈমন্তী বলে, “শান্ত, আব্বু চুল গুলো তো অনেক বড় হয়ে গেছে।

“থাক!

“থাক কি বাবা, কাটতে হবে তো।

“পরে কাটবো।

“বেশ কেটো, খেয়েছো।

“হুম, আম্মু খাইয়ে দিয়েছে।

“কোথায় আম্মু?

“নানাজানের সাথে কথা বলছে।

“তুমি বলেছো?

“হুমমম!

“তোমার আব্বু কি এসেছে?

“না এখনো আসে নি?

“আহনাফ তো চলে গেছে, তাই না।

“আমি বলেছি আবার কাল আসতে।

“আচ্ছা বেশ তো, ঘুমাবে একটু।

শান্ত মাথা দুলাল। হৈমন্তী মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গল্প ধরতে লাগলো। গল্পটা শান্ত’র জানা, তবুও চুপচাপ শুনছে। মায়ের মুখে গল্প টা শুনতে খুব ভালো লাগে তার।

——

কবীর শান্ত কে তার ঘরে শুইয়ে দিয়ে এসে দেখল হৈমন্তী বিছানায় নেই। গেলো কোথায়? বেলকনিতে উঁকি দিয়ে দেখল দেওয়ালে ঠাঁই দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হৈমন্তী। কবীর তার কাছে যেতেই তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি জানো আজ পূর্ণিমা!

“না জানতাম না, এখন জানলাম কিন্তু এখানে কি করছো?

“চাঁদ দেখতে এসেছি।

“চাঁদ দেখার মাঝে কি আছে?

“অনেক কিছু! তুমি জানো প্রতিটা পূর্ণিমা কি নিয়ে আসে, একটা ভালোবাসার গল্প নিয়ে। প্রতিটা গল্পের বিশেষ চরিত্র গুলো পূর্ণিমায় একে অপরের হাতের উপর হাত রেখে রাতটা পার করে দেয়।

“এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না, ঘরে চলো।

“আমার খুব সাধ গো, তোমার হাতে হাত রেখে পূর্ণিমা দেখবো।

“আরেকদিন দেখো।

“যদি সময় না হয়!

কথাটা কবীরের বুকে এসে বিধল। হৈমন্তী কে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল সে। হৈমন্তী তার বুকে মাথা ঠেকাল। কবীর তার হাত দুটো শক্ত করে ধরে রইলো। হাতের উপর তরল জাতীয় কিছু পড়তেই কবীর চমকে উঠলো। বলে উঠল, “তুমি কাঁদছো?

“আমি কতোদিনের সাধ ছিল তোমাকে বোঝাতে পারবো না। পূর্ণিমা তো অনেকবার’ই এলো কিন্তু কখনো তোমার সাথে বসে একসাথে পূর্ণিমা দেখা হলো না। আজ এই ইচ্ছা পূরণ হলো এখন মরলেও কোন আফসোস থাকবে না আমার।

“চুপ করো!

“সারাদিন চুপ’ই ছিলাম। আশা’র সাথে একটু কথা বলি ও বলে চুপ থাকো, এভাবে চুপ করে কিভাবে থাকবো।

“আচ্ছা, বলো। কি বলবে আমায় বলো।

“তুমি জানো, তোমাকে বলার অনেক কথা ছিল আমার।

“বলো এখন!

হৈমন্তী চোখের জল মুছলো। কবীরের দিকে ফিরে হেসে বলল, “যাহ ওইদিন কি আর আছে। এখন বসে তোমায় ভালোবাসি কথা বলবো আমি।

অদ্ভুত ভাবে জিজ্ঞেস করল কবীর,
“কেন বলবে না?

স্পষ্ট স্বরে জবাব দিল হৈমন্তী, “এখন তুমি আমার কথা শুনবে কারণ তোমার মনে অপরাধ জাগান দিয়েছে। তুমি এখন বুঝতে পারছো আমার উপর কি অন্যায় করছো তাই এখন এসেছো প্রায়সিত্ব করতে। তাই না বলো!

কবীর জবাব দিল না। হৈমন্তীর এসব কথা শুনতে বেশ কষ্ট লাগছে তার। হৈমন্তী আবারো আশ্রয় নিল তার বুকে। ধীরে ধীরে বলল, “তুমি নিজেকে দোষী ভেবো না গো, বিশ্বাস করো আমি কখনো তোমায় দোষী ভাবি নি। যা ছিল আমার ভাগ্যে লেখা ছিল। তোমায় দোষ দিয়ে কি হবে? সত্যি বলতে তোমার আর আশালতার মাঝে তো আমি এসে পড়লাম তাই না বলো।

কবীর অন্যদিকে চোখ ফিরাল। যেই ভয়টা পাচ্ছিল তাই সত্যি হলো। হৈমন্তী জানে তার আর আশালতার কথা। হৈমন্তীর কষ্ট টা বোধহয় এখন অনেকটাই বুঝতে পারছে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছে এভাবে থাকতে। স্বাভাবিক থাকার শত চেষ্টা করেও পারছে না। হৈমন্তী আবারো বলতে শুরু করল, “জানো আমার বোন তোমাকে খুব ভালোবাসে, আমাকে সবসময় বলতো ওর ভালোবাসার কথা। বোকা ছিল বোনটা, একবারও বলল না ওর ভালোবাসার মানুষটি তুমি। বললেই বোধহয় সব বদলে যেত কিংবা যেত না। আমি বোধহয় স্বার্থপর হয়ে পড়তাম, ছাড়তে চাইতাম না তোমায়। পাগলামি করে বসতাম এই ভয়ে বলে নি বুঝলে। তুমি খুব ভালোবাসো না ওকে!

অশ্রু বাধ মানলো না, গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। কবীর তা আড়াল করার চেষ্টা করল। হৈমন্তী জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বলল, “আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি জানো তো। খুব! একটা আবদার করবো তোমার কাছে, আমি যদি মা’রা যাই তখন তুমি আশালতা কে আবার বিয়ে করবে ঠিক আছে।

“অনেক কথা বলেছো, এখন চুপ থাকো!

“কথা এখনো শেষ হয় নি, শোন! আমি খুব ভয়ে ছিলাম, যদি আমি চলে যাই তখন শান্ত’র কি হবে? কিন্তু এখন আমার চিন্তা শেষ হয়েছে, তুমি আশা কে বিয়ে করলে শান্ত ওর আম্মু কে পাবে। তুমিও তাকে পেয়ে যাবে।

“আমি কাউকে বিয়ে করছি না, কিছু হবে না তোমার। পাগলের মতো কথা বলো না।

হৈমন্তী হাসল, হেসে মুখ ফিরল কবীরের দিকে। বিচলিত হয়ে বলল, “একি তুমি কাঁদছো কেন? কেঁদো না, আমি কাঁদার মতো কি কিছু বলেছি। ( কবীরের চোখের জল মুছে দিয়ে ) শোন, মায়ের অভাব আমি খুব বুঝি। আমার মা ছিল কিন্তু সেও বেশির ভাগ সময়ই অসুস্থ থাকতো। আমি দেখতাম বাবা খুব আগলে রাখতো তাকে। সেও জানতো, মা বেশিদিন থাকবে না তার সাথে। আর দেখো শেষমেষ রইলোও না ‌। আমার ভাগ্যটাও বুঝি আমার মায়ের মতোই হলো। কিন্তু আমার মতো আমার ছেলের ভাগ্য যেন না হয়। ও তো মায়ের ভালোবাসা পাবে বলো। আশালতা ওকে নিজের ছেলের মতোই আগলে রাখবে তাই না বলো।

কবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঘুমোবার সময় হয়ে গেছে। চলো ঘুমোতে চলো।

“আমায় একবার চুমু খাবে তুমি!

করুণ স্বরে বলল হৈমন্তী। কবীর তার গাল দুটো ধরে কপালে চুমু খেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল হৈমন্তীকে। হৈমন্তী ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছে। কবীর ক্ষমা চাইছে তার কাছে। তার জন্য’ই আজ এতো কিছু। তার অবহেলা, বঞ্চনা থেকেই হৈমন্তীর এই হাল। নিজেকে দোষী মানা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। হৈমন্তী শীতল কণ্ঠে বলল, “বললাম তো তোমার কোন দোষ নেই, ক্ষমা কেন চাইছো। ক্ষমা চাইতে হবে না। শুধু আমার আবদার টুকু রেখো তুমি!

কবীর মুখ ফিরিয়ে নিল। হৈমন্তী কবীরের বুকের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, “জানো তো আমার খুব শীত লাগছে।

“চলো ঘরে চলো!

“উঠতে ইচ্ছে করছে না,‌শরীর গুলিয়ে যাচ্ছে বারবার। বোধহয় দাঁড়াতে পারব না।

“এতো বেশি কথা বলো না তুমি, অনেক কথা বলেছো আজ!
অতঃপর কবীর উঠে দাঁড়াল। কোলে তুলে নিল হৈমন্তী কে। বিছানায় তাকে শুইয়ে দিয়ে বসে রইল তার পাশে। হৈমন্তী তার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল, “যতদিন আছি ততোদিন শুধু ভালোবাসো আমায়। দয়া করে হলেও ভালোবাসো। বাসবে তো!

কবীর তার হাত দুটো শক্ত করে আগলে ধরল। মাথায় হাত বুলাতে লাগল। হৈমন্তী ঘুমানোর আগ অবদি বলে গেল, “তুমি বিয়ে করো আশালতা কে, আমি চলে যাবার পর তাকেই বিয়ে করো তুমি!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here