তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৬০+৬১

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৬০

“স্যার আসবো?

“রায়ান, এসো!

অনুমতি পাওয়া মাত্র’ই রায়ান কেবিনে ঢুকল। কবীর চৌধুরী পানির গ্লাস নামিয়ে রেখে বললেন, “বলো কি খবর?

“ছেলেটা এসে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে,‌ নিয়ে আসবো!

“হুম!

রায়ান চলে গেল। খানিকক্ষণ বাদে একটা ছেলেকে নিয়ে ফিরল। সে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে রইল। রায়ান তার পাশে দাঁড়িয়ে। কবীর চৌধুরী উঠে দাঁড়াল। বলে উঠলেন, “তোমার নাম কি?

“জি ঈশান!

“আচ্ছা, তো বলো ঈশান, কি খবর নিয়ে এসেছো?

“স্যার, শান্ত স্যার ভালোবাসে নিঝুম নামের মেয়েটিকে।

“খুব কি ভালোবাসে?

“জি স্যার!

“আর মেয়েটি?

“জি, স্যার। দুজনেই দুজনকে ভালোবাসে।

“মেয়েটার সম্পর্কে কি জানলে?

“মেয়েটি সহজ সরল, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। আগে অন্য কোথাও থাকতো, বাবা…

“এসব আমি জানি। নতুন কিছু জানলে বলো!

“আপাতত স্যার এতোটুকুই!

কবীর ভ্রু কুঁচকালো। একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল শূন্যে। অতঃপর বলে উঠল, “আর কিছু বলবে?

ঈশান ঢোক গিলল। কবীর চৌধুরী দ্বিতীয় বারের মতো সিগারেট টেনে বলল, “বলো কি করেছো?

“আসলে স্যার, আমার জন্য তাদের দুজনের মাঝে কিছু মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে?

কবীর চৌধুরী কপাল কুঁচকিয়ে বলল, “যেমন?” রায়ান খানিকটা বিচলিত। কি জানি ছেলেটা আবার কি করে বসেছে। এই কাজের জন্য এমন একটা ছেলেকে বাছা ভুল হয় নি তো আবার। ঈশান খানিকটা হতভম্ব করে বলল, “আসলে স্যার আমি কিছুই করি নি। পুরোটাই এক্সিডেন্টলি হয়েছে। আমি বুঝতে পারি নি এমনটা হবে?

“কি করেছ, সেটা বলো?

“নিঝুম নামের মেয়েটিকে জানার জন্য ওর সাথে একটু কথা বলতাম। ব্যাপারটা শান্ত স্যারের পছন্দ ছিল না, তবুও বলতাম। আসলে স্যার আমি মেয়েটিকে বোঝার চেষ্টা করতাম। শুধু ভুল ক্রমে… বলার আর সাহস হলো ঈশানের। সে এবার অস্বস্তি বোধ করছে। কবীর রায়ানের দিকে ফিরল। বলে উঠল, “শান্ত তোমায় কিছু বলেছে?

“না স্যার, তবে খবর আছে মেয়েটির সাথে ঝগড়া হয়েছে। হয়তো কাল আমাকে!

“কাল থেকে তুমি আর ভার্সিটি যাচ্ছ না আর হ্যাঁ নিঝুম কে ম্যাম বলবে।

“জি স্যার!

“রায়ান, ওকে নতুন কাজটা বুঝিয়ে দিও।

রায়ান মাথা নাড়ল। কবীর চৌধুরীর হাতের সিগারেট শেষ করে এস্ট্রে তে ফেললেন। ঈশান বেরিয়ে গেল। রায়ানের অস্বস্তি এখনো কাটেনি। হুট করেই কবীর হেসে উঠলেন। খুব জোরে জোরে হাসছেন তিনি। রায়ান হতবুদ্ধি’র মতো তাকিয়ে রইল। কবীর চৌধুরী বলল, “দেখলে রায়ান?

“জি স্যার?

“আমার ছেলে কতো বড় হয়ে গেছে। একটা মেয়েকে এখন ভালোবাসতেও শুরু করেছে। আর যে ভালোবাসায় নজর দিচ্ছে তাকেও ছেড়ে দিচ্ছে না। খেয়াল রেখো ঈশান যেনো তার সামনে না যায়। ছেড়ে দেবে না কিন্তু? বেচারা শেষে বিনা অপরাধে মা’র খাবে।

রায়ান মাথা দুলাল। মন থেকে চাপটা সরে গেছে তার। কবীর চৌধুরী উঠে দাঁড়াল। বাসায় যাবার সময় হয়ে এসেছে। রায়ান তখন বলে উঠল, “স্যার, একটা কথা ছিল?

“আশালতা কে নিয়ে? আবার নতুন কি করলো?

“শান্ত বাবার বাড়িতে যেই ভদ্রমহিলা রান্না করতে যান তাকে টাকা দিয়ে শান্ত’র বাবার খবর নেন। এছাড়া তার কলেজের কাছের একটি কফি শপ ঘন্টা খানেকের জন্য বুক করে বসে থাকে!

“শান্ত কে দেখার জন্য!

“জি স্যার, আপনি বললে..

“কিছু করবার দরকার নেই। ও যা করছে করতে দাও। খোঁজখবর তো নিজের ছেলেরেই নিচ্ছে। ক্ষতি কি? তবে সে কি করছে না করছে সব খবর আমার জানা চাই।

রায়ান পুনরায় মাথা দুলাল।

—–

“আপনি, এখন, এখানে! কি করে? কিভাবে এলেন? কেউ দেখে নি আপনাকে? সোজা আমার ঘরে?

শান্ত পেছন ফিরে বলল, “দম নাও একটু?

“আপনি এখন এখানে কি করছেন?

“দেখতে এলাম তোমায়।

“দেখতে এলাম মানে?
নিঝুম তড়িখড়ি করে বিছানা ছেড়ে নামল। তার চক্ষু চড়কগাছ! দরজা খুলে বাইরে এদিক ওদিক তাকাল। না আশেপাশে মা বাবা কেউই নেই। এমনকি ঘরে আসবার দরজাও বন্ধ। নিঝুম মিনমিনয়ে বলল, “আপনাকে ঘরে ঢোকালো কে?

“আমার শ্যালিকা!

“শ্যালিকা মানে?

“শ্যালিকা মানে শ্যালিকা!

কথাটা বলেই সামনে তাকাল। নিঝুম ফিরে দেখল রান্না ঘর থেকে হিনা বের হচ্ছে। তার আগে একটা আইসক্রিম। নিঝুম হতবুদ্ধি’র মতো সামনে চেয়ে রইল। চোখাচোখি হলো হিনার সাথে। সে একগাল হেসে হাত নাড়ল। দ্রুত দরজা বন্ধ করে শান্ত’র দিকে ফিরে বলল, “আপনি হিনা কে চিনেন?

“না চেনার কি আছে? আমাকে সাহায্য করলো তো সেই। বউ’র চেয়ে শ্যালিকা কোন অংশে কম না।

“অশান্ত, আপনি পুরো পাগল হয়ে গেছেন। বাবা যদি জানতে পারে আমাকে আস্ত রাখবে না। মা তো কোন কথা ছাড়াই ঘর থেকে বের করে দেবো?

শান্ত নিঝুমের চুল গুলো কানে গুঁজে বলল, “সমস্যা কি? আমার বাসায় এসে থাকবে।

“অশান্ত আপনি পুরো পাগল হয়ে গেছেন!

“এই এতো রাতে তোমার চুল ভিজে কেন?

“এটা তেল! তেল দিয়েছি। হিনা ইচ্ছে করে এত্তো এত্তো দিয়েছে আমায়। ফকিন্নি ফকিন্নি লাগছে!

“বাহ, ফকির কেও এতো সুন্দর লাগে আগে জানতাম না তো!

“অশান্ত!

শান্ত হেসে উঠলো। নিঝুম ভার করে এদিক চলে এলো। শান্ত তার পিছু পিছু এসে বলে উঠল, “কেমন আছো?

“সারাদিন তো আপনার সাথেই থাকলাম, এখন জিজ্ঞেস করছেন?

“না, মানে আমি ওই..

“রাগ কমেছে আপনার?

“সরি!

“এটা বলতে এখানে এসেছেন, ফোন করলেই তো হতো!

“না আরো একটা কাজ আছে।

“কি?

শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শার্টের বোতাম খুলে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। নিঝুম হতভম্ব হয়ে সামনেই তাকিয়ে রইল। সে হতবাক! অশান্ত এটা কি করছে? তোতলাতে তোতলাতে বলল, “অশশান্ত আপনি , এখানে এসব কি করছেন?
শান্ত জবাব দিল না। নিঝুম পিছুতে পিছুতে এসে দেওয়ালে এসে পিঠ ঠেকলো। শান্ত দেওয়ালে এক হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিল নিঝুম! শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, “নাও!

“কি?

“কামড় দাও!

“কোথায়?

“কোথায় আবার ঘাড়ে, কতো খাটো তুমি! সবসময় হিল জুতো পড়ে থাকবে বুঝলে নাও!

বলেই শান্ত আরো খানিকটা ঝুঁকি গেল। নিঝুম মুখ ফিরে তাকাল শান্ত’র ঘাড়ের দিকে। ঘাড়ের দিকে কালো একটা তিল দেখা যাচ্ছে। ফর্সা ঘাড়ের রগ গুলো দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট! শান্ত ঢোক গিলছে বার বার। নিঝুম চোখ বুজে সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিল। না এ কোনভাবেই হয় না ‌ শান্ত আবারো বলে উঠল, “কি হলো? নাকি রাগ এখনো কমে নি। জানি তুমি অনেক ব্যাথা পেয়েছ। তাই তো বলছি, তুমিও কামড় দাও। তাহলে শোধবাধ হয়ে যাবে।

“আমি পারবো না!

“কেন পারবে না?

নিঝুম চোয়াল শক্ত করে সামনে ফিরল। ধাক্কা মেরে সরিয়ে ফেলল শান্ত কে।
“পাগল হয়ে গেছেন, আমি আপনার ওখানে কামড় দেবো?

“কেন? এখানে দিলে কি সমস্যা? কি হয়েছে এখানে?

“কিছু না, যান বাসায় ফিরে যান। কামড় টামড় কিছু দেবার কোন দরকার নেই।

“ধীরে কথা বলো, এতো চেঁচিয়ে কেন বলছো? আর এতো হাইপাই হবার’ই বা কি আছে?

নিঝুম হতভম্ব হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। শান্ত নিজের ঘাড়ের দিকে ফিরে শার্টের বোতাম লাগিয়ে ফেলল। এগিয়ে এসে বলল, “আচ্ছা আবারো সরি, খুব রেগে ছিলাম তাই!

“তাই, বলেই আমার ঘাড় টাই পেলেন আপনি? দেখুন দেখুন কেমন দাগ হয়ে আছে?

শান্ত ফিরে তাকাল। ঘাড়ের দিকে দাগটা দেখতে পেয়েই চোখ নামিয়ে ফেলল। নিঝুমও চোখ মুখ শক্ত করে আছে। শান্ত সামনে এসে হুট করেই নিঝুম কে জড়িয়ে ধরল। নিঝুম হতচকিয়ে গেল! শান্ত তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আর কখনো করবো না, সত্যি বলছি। আর কখনো তোমায় এভাবে কষ্ট পেতে দেবো না কখনো না!

নিঝুম তবুও কঠিন মুখে। শান্ত একহাতে নিঝুম কে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতে গালে হাত রেখে বলল, “বললাম তো সরি, আর কতো সরি বলবো। এর থেকে ভালো তুমি একটা কামড় দিয়ে দিতে।

নিঝুম ভ্রু কুঁচকিয়ে নিল। শান্ত হেসে আবারো তার ঘাড়ের দিকে এগিয়ে গেল। কামড় দেওয়া জায়গায় আলতো করে চুমু খেয়ে বলল, “রাগ কমেছে?

নিঝুম সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিল লজ্জায়। অথচ তার মুখটা এখনো থমথমে। এতোটাই লজ্জা পাচ্ছে যে শান্ত কে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না। শান্ত খানিকক্ষণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেল। নিঝুম ঠোঁট কামড়ে ধরল। শান্ত কানে ফিসফিসিয়ে বললো, “তোমার জন্য এক বক্স আইসক্রিম এনেছি।

“সত্যি!

“হুম! রাগ কমেছে এবার!

নিঝুম জোরে জোরে মাথা দুলাল। শান্ত হেসে উঠলো। নিঝুম চোখের চশমাটা ঠিক করে শান্তর দু গালে হাত রেখে কপাল বরাবর চুমু খেলো।
মিটিমিটি পায়ে হেঁটে শান্ত কে দরজার কাছে নিয়ে এলো নিঝুম। তাদের দেখে মুখ টিপে হাসছে হিনা। দরজা খুলে শান্ত কে বাইর বের করে দিয়ে বলল, “বাই!

শান্ত তবুও চলে গেল না, দাঁড়িয়ে রইল। নিঝুম চোখের ইশারায় যেতে বলছে, শান্ত তবুও দাঁড়িয়ে।‌ হুট করেই সামনে ফ্লাটের আন্টি দরজা খুলে ফেললেন। তিনিও বোধহয় বাইরে যাবেন। তাকে দেখেই নিঝুম জড়োসড়ো হয়ে গেল। হাসতে হাসতে বলে উঠল, “ভাইয়া, সাবধানে বাসায় যাবেন। বললাম, রাতটা থেকে যেতে গেলেন না। বাসায় গিয়েই মামা’র শরীর কেমন বাবা কে কিন্তু অবশ্যই ফোন করে জানাবেন। বাবা বার বার বলে দিয়েছে হ্যাঁ!

শান্ত হা হয়ে শুধু তাকিয়েই রইল। কি বলছে কি নিঝুম এসব? পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি। নিঝুম হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই আন্টি!

আন্টি হেসে মাথা দুলিয়ে চলে গেলেন। শান্ত মুখ অন্ধকার করে পিছন ফিরল। নিঝুম চট করে তাকে একটা চিমটি কেটে বলল, “যান যান, বাসায় চলে যান। এখানে এসে বিপদ বাড়ালেন আমার। আল্লাহ হাফিজ!

বলেই ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হিনা এখনো মুখ টিপে হাসছে। অমনি ঘর থেকে মায়ের গলার স্বর এলো, “কিরে নিঝুম? কে এলো এখন?

নিঝুম হতভম্ব হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে উঠল, “কেউ না মা!” বলেই ঘরে ছুটে গেল। হিনা কি করবে না বুঝতে পেরে মুখের সামনে বই ধরে বসল। নিঝুম হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। শান্ত এসে দাঁড়াল রাস্তার সামনে। দুই হাত প্যান্টের প্যাকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। নিঝুম জোরে জোরে হাত নাড়ল তাকে দেখে। শান্ত হেসে উঠলো!

——

সেদিনের পর ঈশানের কোন খবর না পেয়ে শান্ত আর নিঝুম দরুণ অবাক। ব্যাপারটা কি হলো কিছু্ই তাদের মাথায় ঢুকছে না। আহনাফও বুঝতে পারল না বিষয়টা! খুব অদ্ভুত একটা বিষয় !
সন্ধ্যা হতেই নিঝুম বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরল শান্ত। হঠাৎ তার মনে হলো কেউ আড়াল থেকে তাকে দেখছে। শুধু আজ না, ইদানিং কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে। তবে সেটা শুধু নিঝুমের সাথে থাকলেই মনে হয়। একা থাকলে এমনটা লাগে না। এছাড়া নিঝুমও বলেছিল তাকে জানি কে সবসময় ফলো করে। শান্ত খানিকটা সরে এসে দাঁড়াল। ব্যাপারটা কি হচ্ছে জানা দরকার। নামাজের সময়, রাস্তা ঘাটে মানুষজনও তেমন নেই। ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে একজন কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। তার নজর নিঝুমের বাসার দিকে। শান্ত পেছন থেকে ঘুরে এসে তার হাত ধরতেই ছুটে যেতে নিল সে। কিছু ব্যর্থ হলো। শান্ত তার মাথায় ক্যাপ খুলতেই অবাক চোখে বলল, “তুমি? তুমি এখানে কি করছো?

“শান্ত স্যার, শান্ত স্যার আমি কিছুই করি নি।

শান্ত প্রথমে খানিকটা অবাক হলেও দ্রুত তা সামলে কলার ধরলে বলে উঠল, “তুমি এখানে কি করছো? ফলো করছো নিঝুম কে?

“আমি স্যার মানে আমি..

“কে পাঠিয়েছে তোমায়?

ঈশান কিছু্ই বলতে পারছে না। শান্ত একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো শান্ত’র। কোন এক আননোন নাম্বার থেকে ফোনটা করা। শান্ত একহাতে ঈশান কে ধরে রেখে অন্য হাতে ফোনটা রিসিভ করল। কানের কাছে নিতেই একজন বলে উঠল, “ওকে ছেড়ে দাও, ও আমার লোক!”

শান্ত হতবাক, হতবুদ্ধি’র মতো চেয়ে রইল ঈশানের দিকে। গলার কলার ছেড়ে দিল সে। ঈশান দাঁড়িয়ে রইল না। এর মাঝেই তার ফোন বেজে উঠলো। সে ফোন হাতে বেরিয়ে গেল।‌‌ শান্ত নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনের ওপাশের মানুষ টি কে সে জানে। এমন কিছুই একটা ভেবেছিল সে। কিন্তু দুজনের কেউই কিছু বলছে না। কবীর চৌধুরী দীর্ঘদিন পর ছেলের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগলেন।

#চলবে….#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৬১

ভালোবাসার সম্পর্কে তিক্ততা আসাটা স্বাভাবিক। খুব তীব্র ভালোবাসা একটু তুচ্ছ কারণেই ঘৃণার মুখোমুখি হয়। ভালোবাসায় ফোটা ফুলও তো একদিন ঝড়ে পড়ে যায়। তার সৌন্দর্য, সৌরভ, সুবাস সবকিছু্ই অতীত হয়ে থেকে যায়। কে জানতো, এতো সৌন্দর্য নিয়ে ফোটা ফুল টারও একদিন এই হাল হবে। সম্পর্ক চিরকাল এক থাকে না। একসময় সম্পর্কে মরচি ধরবেই। তাই বলেই কি সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। ভালোবাসা থেকে যাবে স্মৃতি হয়ে, নাকি নতুন কোন ভালোবাসার সূচনা হবে!

নিঝুম আর শান্ত’র সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে গেছে।‌‌ শান্ত অর্নাস কমপ্লিট করে মাস্টার্স ভর্তি হয়েছে। নিঝুম এবার অর্নাস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী! নিঝুমের কাছে এখনো মনে হয়, এই তো সবে দেখা হলো অশান্ত’র সাথে। কিন্তু সময় যে কতোটা দ্রুত চলে যায় এটাই তার প্রমাণ! তবে ওই যে, সম্পর্কে তিক্ততা আসার বিষয়টা! এটাই বোধহয় এসে পড়ল তাদের সম্পর্কের মাঝে। তাদের ভালোবেসে বলা প্রতিটা কথা, কথার মাঝে এতো খুনসুটি হঠাৎ কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। নিঝুমের কেবলই মনে হতে থাকল অশান্ত তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সত্যিই কি তাই! দেখতে দেখতে ৫ বার কল দেওয়া হয়ে গেল অশান্ত কে। শান্ত একবারও কল ধরলো না। আজ সারাটা দিনও দেখা হলো না। এখন যে তার ঘুমও আসছে না। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা বিছানার এক কোনে রেখে দিল। দু’চোখে যেন সবকিছুই ঝাপসা হতে লাগল। আশ্চর্য! সে কি কাঁদছে। কাঁদবার’ই বা কি হলো? অশান্ত কথা বলতেই পারে একটা মেয়ের সাথে। না হয় একটু হেসেই বলেছিল। তাতে কি হয়েছে? সে তো এটাও বলেছিল, “এটা নিঝুম! আমার গার্লফ্রেন্ড!” তো এরপর, এরপর এসব নিয়ে ভাবা বোকামি ছাড়া আর কি? কেন এসব নিয়ে এতো ভাবতে হবে। “নিঝুম তুই কি বোকা হয়ে যাচ্ছিস?” নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল নিঝুম! চোখের চশমা খুলে রেখে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। মা দরজার কাছে এসে খানিকটা অবাক হলেন। রাত সবে ৮ টা! মেয়েটা এই অসময়ে এভাবে শুয়ে আছে কেন? ঘুমিয়ে পড়ল নাকি অন্যকিছু! আলো জ্বালিয়ে কয়েকবার ডাক দিলেন, সাড়া পাওয়া গেলো না। কপালেও হাত রাখলেন। না তেমন কিছু হয় নি। বোঝাই যাচ্ছে মেয়ে ঘুমাচ্ছে। মেয়েকে আর জ্বালালেন না তাহমিনা বেগম! ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

নিঝুমের ঘুম ভাঙল ভোর রাতে। লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে চশমা চোখে দিয়ে হুড়মুড় করে ফোন চেক করল। একটাও কল নেই কেন? অশান্ত কি একবারও মনে করল না তাকে? তার চশমিশ কি করছে না করছে একবারও কি খোঁজ নিল না। এতো বার কল দিলো সেটাও কি দেখলো না। একটা মেসেজ তো দেবার দরকার ছিল? কোন দরকার ছিল না, তবুও নিঝুম মেসেঞ্জার চেক করল। গতকালের দেওয়া একটা লাভ রিয়েক্ট! দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। অশান্ত কি সত্যি সত্যি ভুলে যেতে শুরু করল তাকে।

পেটে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। রাতে একটা খাবারও পেটে পড়ে নি। নিঝুম এতো ভোরে খাবারের খোঁজে রান্না ঘর গেল। কিছু না কিছু তো একটা থাকবেই ফ্রিজে। এখন শুধু সকাল হবার অপেক্ষা, সকাল হলেই শান্ত’র বাসায় গিয়ে উপস্থিত হবে সে।

কলিং বেল বেজে যাচ্ছে বার বার। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগছে মিনি আর অমি’র! শান্ত মেঝেতে শুয়ে ছিল। উঠে বসল সে। গতরাত বেশ মনে আছে সোফায় শুয়ে ছিল। মেঝেতে কখন পড়ে গেলো মনে পড়ছে না। কেউ একজন দরজার ওপাশে তীব্র অপেক্ষায় আছে। শান্ত উঠে দরজা খুলতেই নিঝুম কে দেখতে পেয়ে একগাল হাসল। নিঝুম থমথমে মুখে ঘরে ঢুকল। শান্ত হেসে বলল, “গুড মর্নিং চশমিশ!

নিঝুম নিজেকে প্রস্তুত করছে। কঠিন কিছু কথা এবার বলা উচিত! সে বলে উঠল, “কি করেছিলেন?

“দেখে বুঝতে পারছো না, ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু এতো সকালে তুমি এখানে?

“কেন বিরক্ত করলাম!

“রেগে আছো নাকি?

“গতকাল এতো বার কল করলাম ধরলেন না কেন?

“আসলে আমি তানিশার বাসায় ছিলাম। ওর আম্মু দাওয়াত করছিল। এখন সেখানে তার সামনে কিভাবে কথা বলাতাম।

“তো একটা মেসেজ করতেন?

“হুমম, করা তো যেত। কিন্তু কি বলো তো, তানিশার বাবা একটু অন্য রকমের। যা বলেন সোজাসাপ্টা সবার সামনে বলে ফেলেন। এই বয়সে এমন কিছু একটা বলে ফেলে যে লজ্জার সীমা থাকে না। ফোন হাতে থাকলে নিশ্চিত সবার সামনে কিছু একটা বলতেন তাই আর বল..!.

“কখন এসেছেন বাসায়।

“অনেক রাত!

“সে যতোই রাত হোক, আপনার উচিত ছিল আমাকে একটা কল করবার?

কথা বলতে বলতে নিঝুমের গলা ধরে আসছিল। সে নিজেও বুঝতে পারছিল না এতো কেন রাগ করছে সে। একদিন কথা না বলা এতো কোন বড় ব্যাপার না।‌ শান্ত হাসছে, বোধহয় সে মজা পাচ্ছে। শান্ত’র এই হাসি মুখ’ই রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে নিঝুমের।‌ কাছে এসে নিঝুমের‌ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমি সত্যি খুব ক্লান্ত ছিলাম, দেখো এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছি। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার ফোনটা গাড়িতে রেখেই উপরে চলে এসেছি। আর নিচে যেতে ইচ্ছে করল না‌।‌ কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরও পেলাম না। আচ্ছা তুমি কি খুব রাগ করেছো? সকাল সকাল যেভাবে চলে এলে?

“এসে মনে হচ্ছে বড় কোন ভুল করে ফেলেছি।

“আচ্ছা সরি! বলো ব্রেকফাস্ট করেছো?

“করেই এসেছি।

“তো কি, আবার করবে!

দেখতে দেখতে মিনি এসে নিঝুমের পায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। শান্ত হেসে বলল, “তুমি মিনির সাথে খেলো আমি ফ্রেস হয়ে আসছি!

——

ভার্সিটিতে কঠিন মুখে বসে থাকাও মুশকিল! যে দেখছে সেই জিজ্ঞেস করছে। আহিম একবার জিজ্ঞেস করে গেল, আফিনও তাই! নীলাভ্র কিছু জিজ্ঞেস না করলেও খানিকক্ষণ পাশে বসে থাকল। শেষে আহনাফ এসে বলল, “কি হয়েছে নিঝুম?

“কিছু না!

“তাহলে এভাবে বসে আছো কেন?

“কেন খুব কি অন্যায় করে ফেলেছি।

আহনাফ একটু হতচকিয়ে গেল। তার সাথে সাথে নিঝুমও। সে কি বলছে না বলছে এটা নিজেও বুঝতে পারছে না। শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, “আহনাফ সরি,‌ আমি ওভাবে বলতে চাই নি।

“তুমি কি খুব ডিস্টার্ব!

নিঝুম হাসার চেষ্টা করল। শান্ত এসে বলল, “কে ডিস্টার্ব?

নিঝুম উঠে দাঁড়াল। আহনাফ দাঁড়িয়ে বলল, “নিঝুম! তুই বরং ওকে কয়েকটা আইসক্রিম কিনে দে। বেচারি মুড টা একটু ঠিক করুক!
শান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি হয়েছে চশমিশ?

নিঝুম মাথা দুলিয়ে না বলল।‌ আহনাফ হেসে চলে গেল সেখান থেকে। শান্ত নিঝুমের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো আইসক্রিম খাওয়াবে বলে।‌ নিঝুমের মুড টা বোধহয় এবার ঠিক’ই হতে যাচ্ছিল। তার হাতে আইসক্রিম, সামনে শান্ত! নিঝুমের খুশি যেন ধরে না।‌ কিন্তু কোখান থেকে খুশি নামের মেয়েটা এসে সব ভেস্তে দিল। শান্ত কে দেখেই বলল, “বাহ! ভালোই তো প্রেম জমছে তোমাদের!

শান্ত হাসল। নিঝুম মুখটা গম্ভীর করে রেখে শান্ত’র‌ হাসি দেখছে। খুশি হাসতে হাসতে বলল, “আচ্ছা শান্ত, তুমি কি নিঝুমের পছন্দ অপছন্দ সব জানো?

“হ্যাঁ অবশ্যই! নিঝুমের সবচেয়ে বেশি পছন্দ আইসক্রিম। এটা এনে দিলেই তার রাগ ঠান্ডা হয়ে যায়।

“তাই নাকি নিঝুম!

নিঝুম হাসার চেষ্টা করল। অথচ তার শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে।‌ শান্ত কেন তাকে আবারো নিঝুম বলে ডাকছে। এই মেয়েটা সামনে বলে? কে এই মেয়ে? কোথাকার এই মেয়ের জন্য অশান্ত এতো ভাবছে। ওমা! আবার একি? অশান্ত তাকেও আইসক্রিম কিনে দিচ্ছে! নিঝুমের কাছে এখন আইসক্রিম পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাবার বলে মনে হচ্ছে। হাতের আইসক্রিম টাও নিচে ফেলে দিলো সে।‌ শান্ত অবাক হয়ে বলল, “কি হলো?

“কিছু না,‌পড়ে গেলো!

“আচ্ছা আরেকটা কিনে দিচ্ছি!

“না থাক, ছেড়ে দিন।‌ আর ইচ্ছে করছে না।

শান্ত নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “চশমিশ তুমি ঠিক আছো?

নিঝুম মাথা দুলাল। মিথ্যে বলল? সে ঠিক নেই, কিছুতেই ঠিক নেই সে‌।‌ তার কেন বার বার এটাই মনে হচ্ছে অশান্ত তাকে কম ভালোবাসছে। তার সাথে কথা কেন বেশি বেশি কথা বলছে না, এমনকি তাকে ঠিক মতো দেখছেও না। কেন অশান্ত কেন? আপনি তো এমন করবেন আগে কখনো বলেন নি। ভালোবাসা কি তবে এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। কেন মনে হচ্ছে এখন আমার এমনটা। কেন আপনি এখন এমন করছেন আমার সাথে।‌ কষ্ট হচ্ছে খুব আমার,‌খুব কষ্ট পাচ্ছি! আপনি কি সেটা বুঝতে পারছেন না।

বলার মতো এতো কিছু থাকলেও নিঝুম যেন কিছুই বলল না। এমনকি শান্ত তাকে আর দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেসও করল না। সত্যি! মানুষ কতো দ্রুত বদলে যায়! তবে সবাই বদলে যায় না, কিছু কিছু যেন আগের মতোই থাকে। ধরাই যাক না তানিশার কথা। তার মনে আহনাফের জন্য যেই তীব্র ভালোবাসার অনুভূতি আছে সেটা কি আজও কমেছে। না তো, সেটা বরং বেড়েই যাচ্ছে।‌ তানিশা মাঝে মাঝে ভাবে, আহনাফ কে এখনো নিজের পাই নি বলেই হয়তো এই ভালোবাসা বেড়ে যাচ্ছে। কি হবে? যদি তাকে পেয়ে যায় সে। অমনিই কি সব ভালোবাসা কমে যাবে। গাছে ফুটে থাকা ছোট ফুলটা ছিঁড়ে নিল তানিশা। ছিঁড়ে ফেলার পর মনে হচ্ছে ফুলটা ছিঁড়ে ফেলা একদম অনুচিত কাজ হয়েছে। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। মনোযোগ দিয়ে সেই ফুলের সৌন্দর্য দেখছে। এই ফুলের সুবাস নেই, কিন্তু সৌন্দর্য কম না।‌ হঠাৎ করেই সামনে মনোযোগ দিতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। যাকে দেখে পড়ল সেই এসে বাঁচাল তাকে। আহনাফের দুই বাহুতে বন্দি ছিল সে। দ্রুত সরে এলো তার কাছ থেকে। ফুলটাকে নিচ থেকে তুলল আহনাফ। কিঞ্চিত হেসে বাড়িয়ে দিল তানিশার হাতে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তানিশা। এই ফুল সে কি? কার কাছ থেকে? আহনাফের! আজ অবদি যত আহনাফের হাত থেকে যত ফুল পেয়েছে সবটাই যে প্রত্যাখানের জন্য। সাহসে কুলালো না তার। হন হন করে পাশ বেয়ে চলে গেল ‌সে। আহনাফ একটু অবাক হলো। তাকিয়ে রইল ফুলটার দিকে। তার অসম্ভব সৌন্দর্য দৃষ্টি কাড়ল তার। ফুলটা ফেলে না দিয়ে বইয়ের পাতায় গুঁজে রাখল। কাজটা অজান্তেই করল! কিছু কিছু সময় যেন নিজের অজান্তেই কিছু করাটা মনের মধ্যে প্রশান্তি বয়ে আনে। এই কাজটা করে আহনাফের তেমনি বোধ হলো। তবে কাজটা কি খানিকটা বাচ্চামি হয়ে গেল না!

——-

শান্ত কে দেখে মনে হচ্ছে সে মারাত্মক রেগে আছে। নিঝুমও তার চেয়ে কম না। ইদানিং তাদের দুজনের মাঝে যেন সমস্যা তৈরিই হয়ে আসছে। শান্ত খুব চেষ্টা করছে সবকিছু ঠিক রাখতে। কিন্তু নিঝুম যেন ততোই সব বিগড়ে দিচ্ছে। না বলে এইটা করছে,ওটা করছে! সেদিন এতোবার কল করাবার পরও তার ফোন ধরল। শেষ রাতে ফোন ধরে জিজ্ঞেস করবার পর বলল, “ইচ্ছে করছিলো না তাই!” শান্ত’র প্রচুর রাগ হলো। ইচ্ছে করল কল’টাই কেটে দিতে। কিন্তু পারল না! এর চেয়ে মিথ্যে বলে ঘুমিয়ে ছিলাম বললেও হয়তো এতো রাগ লাগতো না। শান্ত তখনো চুপ ছিল! কিন্তু এবার বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেল। নিঝুম সুইসা’ইড প্ল্যান করে বসেছিল! বলছিল একগাদা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। কে চুপচাপ মেনে নিবে এই সব! শান্ত’র‌ ইচ্ছে করল একটা চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু রাগটা চেপে গেল সে। তবুও কম কিছু করেনি। একটা ধমক দিয়ে বসল। কেঁপে উঠল নিঝুম। শান্ত তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠল, “আপনি আমায় কতোটা ভালোবাসেন এটা দেখতে চেয়েছিলাম! কিন্তু দেখুন অশান্ত আমি তো সত্যি সত্যি কিছুই খাই নি!” অশান্ত তখনো চুপ ছিল। কিছু কঠিন কথা বলতে চেয়েও পারল না। মাঝপথে নিঝুম কে একা রেখেই বাসায় চলে গেল সে। সকাল সকাল ভার্সিটিতে এসে দেখে নিঝুম মুখ ভার করে বসে আছে।‌ কেন? সে এমন কেন করবে? সরি তো তার বলা উচিত ছিল! ভুলটাতো সে করেছে? না নিঝুম তাও করবে না। তাহলে সে করবে তো করবে কি? ইদানিং তার আবদার যেন সব বেড়েই যাচ্ছে। তাও যদি কিছু কাজের হতো।‌ সবটাই যেন তাকে নাজেহাল করানোর জন্য! এসব কি সত্যিই মানা যায়। না মানা যায় না, তাই এবার খোলাখুলি কথা বলতে চাই শান্ত! জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “সমস্যা কি তোমার?

“কিছু না!

“কিছু না, কিছু না একদম বলবে না।

“কেন বলবো না, একশবার বলবো।

“এমন পাগলামী কেন করছো?

“কেন? একসময় তো এমন পাগলামিই ভালো লাগতো আমার!

“চশমিশ! তুমি আমায় একবার ভেবে বলো, তোমার এমন পাগলামিতে আমি কখন তোমার পাশে ছিলাম।

“কখনো করি নি বলেই আজ করেছি।

“আমায় পাগল বানাতে চাও তুমি!

“হ্যাঁ চাই!

নিঝুমও রেগে রেগেই যেন কথা বলছে। শান্ত নিজেকে ঠান্ডা করবার চেষ্টা করলো। আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আহনাফ, নীলাভ্র তাকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলেছে। শান্ত শীতল গলায় বলল, “আচ্ছা বলো কি হয়েছে? কিছু করেছি আমি!

“এখন জিজ্ঞেস করছেন? গত কয়েকদিন ধরে কি করে যাচ্ছেন। সব সময় আমাকে অবহেলা করছেন। অশান্ত আপনার কাছে আমার ইম্পর্ট্যান্টেস কমে গেছে। গুরুত্ব তো থাক, ঠিক মতো কথা বলছেন না। এমনকি ঠিক মতো তাকাচ্ছেন ও না আমার দিকে।

“নিঝুম তুমি ভুল বুঝছো আমায়!

নিঝুম দাঁড়িয়ে গেল। চেঁচিয়ে বলো উঠল, “ভুল বুঝছি না অশান্ত! আপনি আমায় কেন নিঝুম বলে ডাকছেন। আমার প্রতি আপনার সমস্ত ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি সবকিছু কমে যাচ্ছে। আপনি কি এটা বুঝতে পারছেন না ‌।

“চেঁচিয়োও না। চেচানোর মতো কিছু হয় নি। যা ভাবছো সব তোমার ভুল ধারণা!

“কিছু ভুল ধারণা না। গত তিন দিনে আপনি আমায় একবারও কল করেন নি। এমনকি একটা মেসেজও করেন নি।

“সেটার কারণও বলেছিলাম তোমায়!

নিঝুম ব্যাথিত স্বরে বলে উঠল,
“আপনি আগের মতো নেই অশান্ত। ভালোবাসেন না আমায় আগের মতো!

শান্ত দাঁড়িয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে বলল, “কি বলছো কি এসব?

“ঠিক বলছি। আপনি আগে তো এভাবে কথা বলতেন না আমার সাথে, এখন কেন বলছেন?

“বলছি তার কারণ আছে। তুমি এমন’ই অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করছো। খুশি কে কি বলেছো তুমি?

“কিছু বলি নি!

“মিথ্যে বলবে না একদম!

“হ্যাঁ বলেছি, বলেছি আমার অশান্ত থেকে দূরে থাকুন।

“কেন বললে তুমি এমনটা?

“কেন? আপনার কি খুব খারাপ লেগেছে!

“হ্যাঁ লেগেছে, ওর আর আমার মাঝে এমন কিছু নেই। তুমি একবারও ভেবেছো, এমন কথা বলার পর ও কি ভাববে?

“যা ইচ্ছে তাই ভাবুক, আমার কিছু যায় আসে না।

“তোমার তো কখনোই কোন কিছুতে যায় আসে না।

“অশান্ত আপনি এভাবে কথা বলবেন না আমার সাথে।

“পাগলামি টা তুমি শুরু করেছো!

চোখ রাঙিয়ে কথাটা বলল শান্ত। আশপাশ সবকিছুই নিরব। নিঝুম নিজের চোখ সরিয়ে আনলো। তার ইচ্ছে করছে এখানেই বসে বসে কাঁদতে। কিন্তু সে কাঁদবে না, একদম কাঁদবে না। অশান্ত কেন বুঝতে পারছে না, কেন তাকে বকছে এভাবে। চোখের অশ্রু টলমল করছে তার। নিঝুম চোখের চশমা খুলে আবারো পড়ল। রাগে থরথর কাঁপছে শান্ত। তার রাগ বাড়ছে বরং কমছে না। ঠোঁট কামড়ে ধরছে বার বার। নিঝুম এবার বলে উঠল, “হ্যাঁ করছি আমি পাগলামি, আমিই শুরু করেছি। কারণ আমার ভালো লাগে না, আমার অশান্ত আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবুক, আমার সাথে কম কথা বলুক। আমার অশান্ত আমায় ছাড়া অন্য কাউকে আইসক্রিম কিনে দিক, অন্য কারোর সাথে হেসে হেসে বলুক। আমার ভালো লাগে না অশান্ত! ভালো লাগে না আমার কোন কিছু। আপনি বদলে গেছেন। আপনি অনেক বদলে গেছেন। আপনি এখন আর আগের অশান্ত নেই, এখন আর আপনি ভালোবাসেন না আমায়।

“চশমিশ!

“সত্যি বলছি আমি , ভালোবাসেন না আমায়। বাসেন না আপনি। আপনার কাছে এই চশমিশ এবার পুরোনো হয়ে গেছে। তাই এখন আর আমাকে ভালো লাগছে না আমার।

“কিছু বলার আগে ভেবে নাও কি বলছো?

“কিছু ভাবার দরকার নেই, কারণ আমি এখন আর আপনার সাথে কথাই বলছি না।

শান্ত’র‌ চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল নিঝুম। শান্ত ঠিক দেখতে পেল তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নিঝুম কাঁদছে ! কিন্তু রাগটাই যেন মন দখল করে নিল। সবসময় যে শরীর মনের কথা শুনে না আজ তা প্রমাণ হয়ে গেল। শান্তও চোয়াল শক্ত করে‌ বলল, “ঠিক আছে! বলো না কথা। তুমি আমার সাথে কথা না বললে পৃথিবী উল্টে যাবে না!”

কথা গুলো যেন শেষ হবার অপেক্ষায় ছিল,ব্যাগ হাতে হন হন করে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো নিঝুম! ঠিক করে নিল মনে মনে, “আর কখনো অশান্ত’র কাছে আসবে না সে! কখনো না। কখনো তার সাথে কথা বলবে না!”
শান্ত রেগে সামনে থাকা চেয়ারে এক লাথি বসিয়ে দিয়ে নিঝুমের দিকে ফিরল। সে চলে যাচ্ছে , অথচ শান্ত তাকে আটকাতে পারছে না। উল্টো দিকে ফিরে হেঁটে চলে গেল সে। আহনাফ আর নীলাভ্র নিশ্চুপ দর্শকের মতো সবটা দেখে গেল। কিছুই বুঝতে পারল না তারা। তাদের কাছে কেবল মনে হচ্ছে, “সবটা বোধহয় এখানেই শেষ হয়ে গেল!”

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here