তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৫৮+৫৯

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৮

শান্ত ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে সামনে। আহনাফ ছোট ছোট চোখ করে দেখছে শান্ত কে। ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “এমন ভাবে কাকে দেখছিস?

“ওই ছেলেটা কে?

“কোন ছেলে?

“নিঝুমের পাশে যেই ছেলেটা!

“ওহ আচ্ছা! মনে তো হচ্ছে ওর ক্লাসমেট।

“আচ্ছা!

“তুই কি জেলাস।

“আমাকে দেখে কি তোর সেটা মনে হয়।

আহনাফ দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, “একদম না, তুই খুব ভালো বয়ফ্রেন্ড। খুব কেয়ার করিস নিঝুমের।

“হুম ঠিক বলেছিস, কিন্তু দেখ ও অনেকক্ষন ধরে কথা বলছে ছেলেটার সাথে।

“হয়তো দরকারি কথা?

“এমন কি কথা, যে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে বলা লাগে।

“ওরা পাঁচ মিনিট হলো কথা বলছে শান্ত!

শান্ত বাঁকা চোখে তাকাল আহনাফের দিকে। আহনাফ কথা ঘুরিয়ে বলল, “ওই দেখ, কথা বলা হয়তো শেষ!

শান্ত সামনে ফিরল। তার বর্ণ‌হীন ফ্যাকাশে মুখ এবার স্বাভাবিক হলো। নিঝুম একগাল হেসে বলল, “হাই অশান্ত!

শান্ত হাতে থাকা জুসের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “কার সাথে কথা বলছিলে?

“ও, ওই ছেলেটা। ওর নাম তো ঈশান!

“ছেলেটা কে?

“আমার সাথেই, আমরা সেম ইয়ারে। সমস্যা ছিল বলে ক্লাস করতে পারে নি। পরিক্ষার সময় পরিচয় হয়েছিল।

“এখন কি বলছিল?

“ওই গতকালের নোট গুলো নাকি দরকার ছিল, সেগুলোই চাচ্ছিল!

“তুমি কি বললে?

“বললাম ক্লাস শেষে দিচ্ছি।

“ক্লাস আছে তোমার?

নিঝুম জুসের প্যাকেট মুখে নিয়ে বলল, “দশ মিনিট পর!

“আচ্ছা যাও, ক্লাসে যাও!

“আচ্ছা!

মাথা দুলিয়ে নিঝুম চলে গেল। শান্ত মুখটা গম্ভীর করে সামনে তাকিয়ে আছে। ঈশানের পাশ দিয়ে নিঝুম যেতেই ঈশান একগাল হাসল। নিঝুমও হাসল! দুজনের হাসি দেখে শান্ত’র চোখ আরো ছোট হয়ে গেল। আহনাফ সবটা পর্যবেক্ষণ করে শুকনো কাশল। শান্ত বলে উঠল, “আহনাফ দেখছিস?

“কি দেখবো?

“ছেলেটা কিভাবে দেখছে নিঝুম কে?

“হ্যাঁ দেখছি, কিন্তু তোর রেগে যাবার কোন কারণ নেই। নিঝুম তো তোকেই ভালোবাসে তাই না।

“আমি তোকে বলেছি আমি রেগে গেছি।

“না যেভাবে তাকিয়ে আছিস তাই…

শান্ত কিছু না বলে নির্বিকারে হেঁটে চলে গেল। আহনাফ একবার এদিক দেখছে আরেকবার ওদিক। নিঝুম কে বলা দরকার, ঈশানের থেকে দূরে থাকার কথা। শান্ত এটা মোটেও পছন্দ করছে না। ঘূর্ণিঝড়ের আভাস পাচ্ছে সে!

ক্লাস শেষে নিঝুম যখন লাইব্রেরীর দিকে হাঁটা ধরল তখন শান্ত পিছন থেকে ডেকে উঠল তাকে। নিঝুম থমকে পেছন ফিরল। শান্ত বলে উঠল, “কোথায় যাচ্ছ?

“নোট গুলো দিতে!

“ওহ, ফোন আছে তোমার সাথে?

“হ্যাঁ কেন?

“দাও তো, আমার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছি না।

নিঝুম ব্যাগ থেকে বের করে ফোনটা দিল। শান্ত ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “তোমার ফোন নম্বর কি তোমার মনে আছে!

“হ্যাঁ আমার মুখস্থ, বলবো!

“না! তোমার মুখস্থ না।

“মানে?

“কেউ যদি জিজ্ঞেস করে , তোমার ফোন নম্বর মুখস্থ কি না, বলবে না। বুঝতে পেরেছো!

“আচ্ছা!

“হ্যাঁ , যাও এবার!

“আচ্ছা!

বলেই নিঝুম সামনে ফিরল। আবারো দাঁড়িয়ে গেল সে। এটা কি হলো? নিজের চশমা ঠিক করে পেছন ফিরল।‌অশান্ত নেই! কিন্তু অশান্ত এতোক্ষণ এসব কি বলছিল? আর সেই বা কেন তার কথায় ওমন ভাবে সায় দিচ্ছিল। হঠাৎ এ কি হলো তার? নিঝুম ভাবতে ভাবতে সামনে আগাল। এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে? কার জন্য জানি এসেছিল, সেটাও ভুলে গেছে! ঈশান অমনি হাত নাড়ল। নিঝুমের মনে পড়ল। সে দ্রুত ঈশানের কাছে এসে খাতা বার করল বলল, “এই খাতায় আছে?

“ধন্যবাদ নিঝুম, খুব হেল্প করলে তুমি আমার!

“ইটস্ ওকে, খাতা টা আমার দরকার। একটু তাড়াতাড়ি ফেরত দিয়ো।

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি জলদি ফেরত দিয়ে দেবো।

নিঝুম মাথা দুলিয়ে চলে আসতে নিল। ঈশানও তার পিছন পিছন হাঁটছে। দুজন’ই বের হতে ঈশান বলে উঠল, “আচ্ছা নিঝুম, তোমার ফোন নাম্বার টা দাও তো। যদি আমি আসতে না পারি তো তোমার সাথে কন্টাক্ট করবো কি করে?

“ওহ হ্যাঁ তাইতো,
এই বলেই নিঝুম ব্যাগে হাত রাখল। অমনি মনে পড়ল তার ফোন তো তার ব্যাগে নেই। অশান্ত নিয়ে গেছে। নিঝুম চশমা ঠিক করে বলল, “ফোন তো ব্যাগে নেই।

“ওহ, নাম্বার তো মুখস্থ নেই।

নিঝুম মাথা দুলিয়ে না করল। ঈশান হেসে বলল, “আচ্ছা আমার নাম্বার তোমায় লিখি দিচ্ছি তাহলে!

নিঝুম মাথা নাড়ল। ঈশান নাম্বার লিখে কাগজ এগিয়ে দিতেই শান্ত হাজির হলো। নিঝুমের ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, “মা ফোন করেছে কয়েকবার!

শান্ত’র মুখের দিকে তাকিয়ে নিঝুম ফোনটা এগিয়ে নিল।‌ঈশানের দিকে ফিরে কাগজের টুকরো টা হাতে নিল। ঈশান হেসে বলল, “তোমরা কি ভাই বোন, নাহ মানে ওর মা কে মা বলছো তাই..

নিঝুম মাথা দুলিয়ে বলল, “না না, আমরা ভাই বোন না।

শান্ত ফট করে নিঝুমের হাত ধরে বলল, “তবে আমারও মা। একচুয়েলি মাদার ইন ল! বলামাত্র নিঝুম কে টেনে নিয়ে এলো। ঈশান এখনো হতভম্ব! নিঝুম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “এসব কি বলেছিলেন?

“কিছু না, তোমার হাতে ওটা কি?

“এটা, এটা তো ঈশানের নাম্বার!

“দেখি!

নিঝুম এগিয়ে দিল। শান্ত কাগজের টুকরো টা প্যাকেটে রেখে দিল। নিঝুম বলে উঠল, “একি করছেন? এটা তো ও আমায় দিল।

“তোমার এটার দরকার নেই, আমার দরকার! চলো তুমি!

নিঝুম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।‌ শান্ত তাকে গাড়ির কাছে এনে গাড়িতে বসাল।
গাড়ি চলছে , নিঝুম অনেকক্ষণ ভাবার পর বলে উঠল, “অশান্ত আপনি জানতেন ঈশান আমার নাম্বার চাইবে তাই ইচ্ছে করে ওরকম করলেন তাই না!
অশান্ত জবাব না দিয়ে খানিকটা হাসল। নিঝুম অশান্ত’র গাল টেনে বলল, “আপনাকে রাগলে অনেক কিউট লাগে অশান্ত!

“আমি তো রেগে নেই!

“সমস্যা নেই, আপনাকে এভাবেও অনেক কিউট লাগে।
শান্ত তার হাসি লুকানোর চেষ্টা করলো। গাড়ির সামনের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে লাগলো।

——-

ঈশান দৌড়ে এসে নিঝুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কেমন আছো?

“ভালো!

“আমায় আর ফোন করলে না যে!

“ওই আসলে কাগজ টা..

“তোমার বয়ফ্রেন্ড বারণ করেছিল।

“না, তেমন কিছু না!

“তোমার বয়ফ্রেন্ড খুব প্রসেসিভ তোমায় নিয়ে তাই না।

“নাহ তেমন কিছু না, অশান্ত খুব ভালো!

“হুম, তবে একটু রাগী। গতকাল আমার সাথে তোমায় দেখে রেগে গেছিল তাই না!

“না না অশান্ত রাগ করে নি।

“তাই, তাহলে পিছনে ফিরো না।

“কেন?

“তোমার অশান্ত পিছনে দাঁড়ানো!

“কি?

বলেই নিঝুম পিছন ফিরতে নিল। ঈশান ফট করে নিঝুমের হাত ধরে নিল। নিঝুম পেছন ফিরার বদলে সামনে ফিরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ঈশানের দিকে। দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। ঈশান বলে উঠল, “আহ, রাগ করো না। শুধু পিছনে ফিরো না।

“কেন?

“দেখি, তোমার বয়ফ্রেন্ড রাগ করে কি না?

নিঝুম ভ্রু কুঁচকে নিল। চোখের চশমা ঠিক করে বলল, “অশান্ত মোটেও অমন না বুঝলে!

এদিকে শান্ত নিজেকে শান্ত রাখার সবোর্চ্চ চেষ্টা করছে।‌ঈশান ফট করে নিঝুমের হাত ধরায় রেগে যাবার বদলে একগাল হেসে ফেলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই হাত প্যান্টের প্যাকেটে ঢুকিয়ে জোরে ডাক দিল, “ঝুম ঝুমাঝুম ঝুম!

নিঝুম দ্রুত পিছন ফিরল। শান্ত একগাল হেসে বলল, “আইসক্রিম খাবে?..

নিঝুম জোরে জোরে মাথা দুলাল। ঈশানের দিকে ফিরে বলল, “দেখলেন তো, বলেছিলাম না!

বলেই ছুটে গেল‌ অশান্ত’র কাছে। শান্ত নিঝুমের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনে আগাল। একবার চোখাচোখি হলো ঈশানের সাথে! তার দৃষ্টি তখনো শীতল!

——-

“বিশ্বাস করবেন না ম্যাম, এমন নির্লজ্জ মাইয়া আমি আগে কখনো দেখি নাই, কেমন কইরা জড়াইয়া ধরলো শান্ত বাবারে! তার ঘরে ছোটাছুটি করতাছে, এই তার বেড রুমে যাইতাছে কি একটা অবস্থা। আমার তো মনে হয় রাইতেও এই মাইয়া আছিলো। কোন শরম লজ্জা কিছু নাই। এমন মাইয়া শান্ত বাবা’র লইগা একদম ভালো না! এদের কু’মতলব থাকে ম্যাম। বুঝলেন!

আশালতা চোখের পাতা ফেলে বললেন, “হুমম বুঝলাম!
বলেই একটা খাম এগিয়ে দিলেন। দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলা খামটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন। খাম নেবার সময় তার চোখ দুটো চকচক করছিল। আশালতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই কফি শপের কফি টা খেতে দারুন লাগে তার। পুরো কফি শপে সে একাই আছে। বলতে গেলে এই ঘন্টা খানিকের‌ জন্য পুরো কফি শপটাই বুক করেছে সে।
আশালতা কফি হাতে উঠে দাঁড়াল। কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে কে আছে খুব সহজেই তা দেখা যায়। হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিল সে। এই সময়েই শান্ত এখান দিয়ে ফিরবে বন্ধুদের সাথে। আশালতা মিনিট দুই অপেক্ষা করবার পর শান্ত কে দেখতে পেলেন। বন্ধুদের সাথে হই হই করতে করতে চলে যাচ্ছে সে। চোখে থাকা কালো সানগ্লাস টা খুলে ভালো করে দেখতে লাগলেন শান্ত কে। দেখতে দেখতে তার শান্ত কতোটা বড় হয়ে গেল। সময় কি দ্রুত’ই না চলে যায়। অতীত মুছে যায়, স্মৃতি থেকে মুছে যায় ফেলে আসা সময় শুধু মনে থাকে কিছু জমে থাকা রাগ আর অভিমান! সময়ের সাথে সাথে সবকিছু চাপা পড়লেও ঘৃণা চাপা পড়ে থাকে না। বরং সেটা যেন বাড়তেই থাকে। একসময় শান্ত’ও চোখের আড়াল হয়ে গেল। আশালতা চোখে থাকা অশ্রু কণা আড়াল করবার জন্য সানগ্লাস টা আবারো পড়ে নিলেন। কফি মগে চুমুক দিয়ে ভাবতে লাগলেন, নিঝুমের কথা! মেয়েটার উদ্দেশ্য ভাবাচ্ছে তাকে। মেয়েটার সম্পর্কে আরো জানা দরকার। যারা ঘরের যাবতীয় কাজ করে তারা অনেক কিছুই বানিয়ে বলে। তিল কে তাল করে ছাড়ে। এই ভদ্রমহিলার সমস্ত কথা বিশ্বাস করবার কোন দরকার নেই। কিছু কিছু কথা বিশ্বাস করাই যায়, যেমন শান্ত কে জড়িয়ে ধরেছিল! আজকাল তো বন্ধুরাও জড়িয়ে ধরে। ঘরে ছোটাছুটি করে, বেড রুমেও যায়। সেটা ফ্যাক্ট না! ফ্যাক্ট হচ্ছে, মেয়েটা শুধুই কি শান্ত’র‌ বন্ধু আরো অন্য কিছু!

——-

নিঝুম আসছিল আর তানিশা যাচ্ছিল। নিঝুম ইচ্ছে করে চোখের চশমা খুলে তানিশা ধাক্কা মারল। দিয়া হতচকিয়ে গেল। নিঝুম দ্রুত চশমা চোখে পড়ে বলল, “সরি সরি, চশমা ছিল না বলে দেখতে পাই নি।

দিয়া বিশ্বাস করল না, কিছু বলার জন্য এগিয়ে যেতে নিল। তানিশা মাঝপথে তাকে থামিয়ে “ইটস্ ওকে” বলে চলে গেল। নিঝুম মুখ ফিরিয়ে হেসে সামনে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেল।‌ আহনাফ খোলা বইটা বন্ধ করে বলল, “ভালো অভিনয় জানো দেখছি!

নিঝুম একগাল হেসে আহনাফের হাত চাপড়ে বলল, “একটু মজা করছিলাম আহনাফ!

“হ্যাঁ,ভালোই! খুব ইনোসেন্ট সাজো দেখছি!

“আহনাফ!

“আচ্ছা আচ্ছা, যাও কাউকে বলছি না।

“এই তো কতো ভালো আপনি, আচ্ছা অশান্ত কোথায়?

“তোমার অশান্ত ওদিকে আছে, কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা আছে।

“বলুন বলুন!

“আমি তোমার একটা কথা রাখছি, তো তুমিও আমার কথা রাখবে। কোন প্রশ্ন করবে না ঠিক আছে।

“আচ্ছা বলুন!

“ঈশান ছেলেটার সাথে কথা বলো না।

“কেন?

“এই তো বললাম।

“ওহ হ্যাঁ আচ্ছা আচ্ছা বলবো না,‌ওকে!

“ওকে!

“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।

নিঝুম হেলেদুলে সামনে এগিয়ে গেল। নীলাভ্র কে দেখে ধপ করে দাঁড়িয়ে গেল। হাত নেড়ে বলল, “হাই নীল!

“হাই, কি করছো?

“অশান্ত’র‌ কাছে যাচ্ছি!

“চকলেট খাবে!

“হ্যাঁ, দিন।

আহনাফ পিছন ফিরল, নীলাভ্র হেসে আহনাফের দিকে ফিরল। আহনাফ ছোট ছোট চোখ করে বলল, “কি ছোচা গো তুমি!

“আমি মোটেও ছোচা না। নীলাভ্র চকলেট দিন।

“ওই যে, আবার চকলেট চাচ্ছে।

“আপনার কাছে তো চাচ্ছি না।

নীলাভ্র হেসে চকলেট এগিয়ে দিল। নিঝুম ছোঁ মেরে চকলেট নিয়ে দৌড়। আহনাফ আর নীলাভ্র একসাথে হেসে উঠলো।

ঈশান ফোন টিপতে টিপতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। হুট করে শান্ত তার সামনে এসে দাঁড়াল। ঈশান মুখ তুলে তাকাতেই শান্ত বলে উঠল, “হ্যালো ব্রাদার!
ঈশান কিঞ্চিত হাসল!
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৯

“কেমন আছো?

“এইতো, তোমার কথা বলো?

“তুমি ভালো থাকতে দিচ্ছ কোথায় আমায়। যতোই চেষ্টা করছি শান্ত থাকার পারছি না তো।

“এটাই আমি নিঝুম কে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম,‌ যে তার অশান্ত আসলেই কতো অশান্ত। কিন্তু সে তো মানতেই নারাজ!

শান্ত শব্দ করে হেসে ফেলল। ঈশানের ঘাড় চাপড়ে বলে উঠল, “নিঝুমের থেকে দূরে থাকো!

“কেন? মানে তোমার কি বিশ্বাস নেই তোমার ভালোবাসার প্রতি!

“অবশ্যই আছে, কিন্তু আমার সহ্য হচ্ছে না তোমাকে ওর পাশে।

“সহ্য করতে শিখো তাহলে!

“তুমি বোধহয় এখনো আমায় ঠিক করে চিনতে পারো নি। তুমি জানো না, তোমার ভালো জীবন টা এখানে আমি কিভাবে নরক বানিয়ে ফেলতে পারি।

“না, পারবে না। কারণ তোমার নিঝুমের কাছে তোমায় ভালো থাকতে হবে তো, তাই না!

“ও আমার’ই , ম্যানশন করবার কোন দরকার নেই।

“ওই তো, এসে পড়েছে তোমার নিঝুম!

শান্ত পিছন ঘুরলো। নিঝুম কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে রেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। শান্ত একগাল হেসে বলল, “তুমি!

“হ্যাঁ আপনাকেই খুঁজছিলাম, কিন্তু আপনি!

“কথা বলছিলাম ওর সাথে!

“একচুয়েলি আমায় ধমকা’চ্ছিল বলতে পারো!

নিঝুম হতভম্ব হয়ে গেল। শান্ত ঈশানের চোখের দিকে তাকাল। ঈশান হাসছে, তার সাথে হাসি মিলিয়ে বলল, “হ্যাঁ , ওই আর কি!

ঈশান হেসে নিঝুম কে বলে উঠল, “হুম, তুমি খুব লাকি নিঝুম,‌ শান্ত খুব ভালোবাসে তোমাকে! মানে আসলেই খুব!

“কিন্তু যে বললেন, ধমকা’চ্ছিলো!

“ও কিছু না, একটু চমকে দিতে চেয়েছিলাম। আর দেখো তুমি চমকেও গেলে।

“আমিও তো তাই বলি, অশান্ত এসে শুধু শুধু আপনাকে কেন ধমকাবে!

শান্ত হাসার চেষ্টা করলো। নিঝুম এসে শান্ত’র হাতটা ধরে বলল, “অশান্ত চলুন, বাসায় যাবো। আল্লাহ হাফিজ‌, ঈশান!

ঈশান হেসে হাত নাড়ল। শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে নিঝুমের হাতটা ধরল। সামনে এগিয়ে যেতে লাগল তারা।

—–

নিঝুম আহনাফের কথা রেখেছে। ঈশান’কে একদমই ইগনোর করতে না পারলেও করবার চেষ্টা করছে। ঈশান সেটা বুঝতে পেরে’ও না বুঝার ভান করছে। বলতে গেলে নিঝুম উড়ো উড়ো খবর’ই জানলো। শান্ত’র একদম পছন্দ না, সে ঈশানের সাথে কথা বলুক। তাই নিঝুম ও এবার থেকে সতর্ক হয়ে গেল। কিন্তু তবুও বুঝি শেষ রক্ষে হলো না। সেই ঘুরে ফিরে ওই ঈশানের সামনে এসেই তাকে পড়তে হয়। আজ তবে একটা কান্ড ঘটল! নিঝুম একা একা ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটছিল। তার হাঁটার ধরণও ছিল অদ্ভুত! এক পা বাড়িয়ে দেবার পর একটু ঘুরতো, আবারো এক পা বাড়ালো। গুন গুন করে গান গাইতে লাগলো। দূর থেকে অভিশপ্ত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ইফা! ভাবছে,‌ এই‌ মেয়েটা কেমন এক নিমিষেই তার থেকে সবকিছু কেড়ে নিল। ওদিকে দাঁড়ানো আহনাফ, সে নিঝুমের এমন অদ্ভুত হাঁটার ধরণ থেকে খানিকটা অবাক। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছাল তখন, যখন দেখল ঈশান হুট করে এসে নিঝুমের পাশে দাঁড়াল। সে নিঝুম কে ডাক দিতেই নিঝুমের মনোযোগ বিগড়ে গেল। এবার ঘুরতে গিয়ে অসাবধানতায় পড়ে যেতে নিল। ঈশান তখন ধপ করে এসে ধরল তাকে। কি হলো বুঝতে নিঝুমের কয়েক সেকেন্ড লাগল। তবুও যতক্ষণে বুঝল ততোক্ষণে বোধহয় সবকিছু্ই হাতের বাইরে। মানে ঈশানের হাত তার কোমরে পৌঁছে গেছে। সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরতেই দেখল শান্ত দাঁড়ানো! সে হতবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। নিঝুম দ্রুত সরে দাঁড়াল ঈশানের থেকে। আহনাফ শান্ত কে দেখা মাত্র শুকনো ঢোক গিলল। কিছু তো একটা হবেই এবার! শান্ত মোটেও ছেড়ে দেবে ঈশান কে। হয়তো রাগ ঝাড়বে ঈশানের উপর কিংবা নিঝুমের উপর। তবে যেই হোক না, তার রাগের মাত্রা হবে অতিরিক্ত! ইফা বেশ বুঝতে পারল, কিছু একটা তো হতে চলেছে। তবে সেটা যেটাই হোক না কেন? নিঝুমের জন্য ভালো হবে না, ব্যস এটা জানতে পেরেই সে খু্শি!

——

“অশান্ত,‌আই এম সরি!

“সরি কেন বলছো? আমি কি রেগে আছি নাকি?

“জানি আপনি রেগে নেই, তবুও সরি অশান্ত!

“বার বার এই কথা বলো না, রাগ লাগছে!

“আচ্ছা!

বলেই নিঝুম সোফার এক কোনে চুপটি করে বসে পড়ল। অমি আর মিনি খুব দৌড় ঝাঁপ করছে। শান্ত একপর্যায়ে রেগে তাদের দু’জনকে’ই ধমক মেরে বসল। কেঁপে উঠলো নিঝুমও! অমি আর মিনি নিচু স্বরে মিয়াও মিয়াও বলে ডেকে, চুপচাপ বসার থেকে চলে গেল। নিঝুম যেখানে ছিল সেখানেই গুটি শুটি মেরে বসে রইল। হঠাৎ করেই শান্ত উঠে দাঁড়াল। নিঝুমও লাফিয়ে উঠল। তার বুক ধড়ফড় করছে। শান্ত হেঁটে গেল রান্না ঘরের দিকে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেতে লাগল।‌ ফোনে মেসেজ আসার শব্দ! শান্ত ফোন বের করে দেখল আহনাফের‌ মেসেজ!
লেখা আছে,‌” শান্ত রেগে যাস না, ওটা পুরোই একটা এক্সিডেন্ট!”

শান্ত রেগে ধপাস করে ফোনটা রেখে দিল। নিঝুম এবার ভয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। শান্ত হন হন করে এসে বলল,‌ “বাসায় চলে যাও!”

“অশান্ত আপনি কি রেগে আছেন?

“তোমাদের সবার কেন মনে হচ্ছে আমি রেগে আছি!
খানিকটা চেঁচিয়ে’ই কথাটা বলল শান্ত। নিঝুম শুকনো ঢোক গিলল। সোফার ওদিক থেকে তার ব্যাগ নেবার জন্য অগ্রসর হলো। শান্ত ঠিক ওখানেই দাঁড়ানো। শান্ত কে খুব ভয় লাগছে তার,‌কেন লাগছে সেটা বুঝতে পারছে না। এই মনে হচ্ছে ব্যাগ টা নিতে গেলেই শান্ত খপ করে তার হাতটা ধরে ফেলল। এরপর তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকবে। খুব জোড়ে একটা ধমক মেরে বসবে।‌ নিঝুম তখন কি করবে? কি করা উচিত তার। হ্যাঁ কাঁদবে সে, কেঁদে ফেলবে দ্রুত। তাহলেই শান্ত আর রেগে থাকতে পারবে না। হুম প্ল্যান সেটআপ করা শেষ!

সত্যি সত্যি ব্যাগ ধরতে গিয়েই শান্ত খপ করে তার হাত ধরে ফেলল। নিঝুম চশমার আড়াল থেকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল অশান্ত’র দিকে। তার কান দুটো লাল হয়ে গেছে দ্রুত! নিঝুম কিছু বলবার আগেই শান্ত তাকে টেনে দেওয়ালের সাথে ঠেকাল! নিঝুমের ভয়ে চোখের পাতা বার বার ফেলছে। শান্ত মৃদুস্বরে বলে উঠল, “ভয় কেন পাচ্ছ আমায়?

“ভয়, কেন ভয় পাবো। ভয় পাচ্ছি না তো আমি।

“তাহলে ঘামছো কেন?

“ওহ খুব গরম তো তাই।

“ঘরে এসি চলছে।

“বোধহয় আপনার এসি টা নষ্ট হয়ে গেছে অশান্ত,‌ দেখুন আমার খুব গরম লাগছে।

শান্ত খানিকটা ঝুকে গেল। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিঝুমের দিকে। নিঝুম যেন পারলে দেওয়ালের ভিতরেই ঢুকে পড়ে। শান্ত শীতল কণ্ঠে বলে উঠল, “তোমার কি মনে হয়, আমি রেগে আছি।

নিঝুম দ্রুত মাথা দুলিয়ে বলল, “না!

“না, আমি‌ রেগে আছি। আমি খুব রেগে আছি নিঝুম।‌আমার খুব রাগ রাখছিল যখন ও তোমায় ছুঁয়েছিল! কিন্তু কি বলোতো, রাগ এখন বেড়ে যাচ্ছে। কারণ আমি কিছুই বলতে পারছি না।

“তাহলে একটু চেঁচান আমার উপর, দেখবেন রাগ পড়ে যাবে।

“আমি তো পারছি না সেটা করতে!

নিঝুম শব্দ করে শ্বাস ফেলল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, “তাহলে আপনি কামড় দিন আমায়। যখন আমার খুব রাগ হয় তখন আমি এটাই করি। কিন্তু অশান্ত, কিন্তু আস্তে কামড় দিবেন, ঠিক আছে!

শান্ত’র দৃষ্টি এখনো শীতল। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে নিঝুমের দিকে‌। নিঝুম ঢোক গিলছে বার বার। হঠাৎ শান্ত কে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল সে। শান্ত বোধহয় এবার কামড় দিবে তাকে। সত্যি সত্যিই কি দেবে, ও তো এভাবেই বলে ফেলেছিল।কিন্তু না, হঠাৎ শান্ত তার গাল আঁকড়ে ধরল। নিঝুম দ্রুত চোখ মেলে তাকাল। শান্ত এগিয়ে যাচ্ছে, তার ঠোঁটের পাশ বেয়ে এগিয়ে গিয়ে ঘাড়ে কামড় বসাল জোরে। নিঝুম তার শ্বাস বন্ধ করে নিল প্রায়। খুব কষ্টে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অশান্ত!

শান্ত দ্রুত তাকে ছেড়ে দিল। নিঝুমের চোখে পানি জমে গেছে।‌ শান্ত অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার ঘাড়ের দিকে। কামড়ের দাগ বসে গেছে সেখানে। শান্ত’র মুখ থমথমে। একি করল সে? নিঝুম তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে অশ্রু টলটল! শান্ত দ্রুত তার বেডরুমে দিকে গেল।‌ পিছন পিছন ছুটলো নিঝুম!দরজা বন্ধ করে দিল সে। দরজা ধাক্কাতে লাগল নিঝুম! শান্ত বলে উঠল, “তুমি চলে যাও এখান থেকে!

“কিন্তু অশান্ত?

“আমি বললাম তো, চলে যাও এখান থেকে!

নিঝুম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। শান্ত ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। নিজেকে ‌ঠান্ডা রাখার সবোর্চ্চ চেষ্টা করছে।

——-

আয়নাতে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে নিঝুম! ঘাড়ের দিকটা কেমন দাগ বসে গেছে। কিছুটা কমেছে সেই দাগ, তবুও বোঝা যাচ্ছে এটা কামড়ের দাগ। নিঝুম হাত দিয়ে তা ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। হঠাৎ করেই দরজা ঠেলে কেউ রুমে ঢুকতেই দ্রুত উড়না দিয়ে গলা পেঁচিয়ে নিল সে। হিনা হতভম্ব হয়ে বলল,‌ “কি হলো?

“কই কিছু না তো?

“আমার কেন মনে হলো তুই ভয় পেয়েছিস!

“না, ভয় কেন পাবো। কিন্তু তুই এখানে কেন?

“মা পাঠিয়েছে, দেখছিস না তেলের বাটি হাতে। বলেছে চুলে তেল দিয়ে দিতে।

“আমি চুলে তেল দেবো না।

“দিতে হবে। চুল পড়ে পড়ে তো টাক হয়ে যাচ্ছিস। শেষে কি তোর বিয়ে হবে।

“হবে হবে, এতো চিন্তা করতে হবে না তোর। যা দেখি এখান থেকে।

হিনা গেল না।‌ তার রাগ লাগছে, কারণ মা জোড় করে তার চুলেও তেল মেখে দিয়েছে। যে করেই হোক সেই শোধ তুলতে হবে। আর সেটা তুলতে হবে নিঝুমের চুলে তেল মেখে। দু’জনের মাঝেই যুদ্ধ লেগে গেল। হিনা বুদ্ধি করে সমস্ত তেলের বাটিটাই নিঝুমের মাথায় উপুড় করে ফেলে দিল। শরীরে তেল মেখে টেখে কি বিশ্রী এক অবস্থা। শেষ অবদি নিঝুমের চুলেও তেল মাখা হলো। রাগে নিঝুমের শরীর কাঁপছে!

রাত তখন অনেক, নিঝুমের বাবা সবে ঘুমানোর প্রস্তুতি করছেন। ঘুমানোর আগে কয়েক দফা তার হাঁটাহাঁটি চলবে। আর মা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে তখন থালাবাসন মাজবে। নিঝুম পুরো বিছানায় বই টই খুলে বসে আছে। যে ভাবেই হোক পড়ায় তাকে মনোযোগ দিতে হবে। এবার আর আহনাফ তাকে সাহায্য করে দেবে না বলেই দিয়েছে। ফোন হাতে নিয়ে একবার ভাবছে অশান্ত কে কল করা যাক। আবার ভাবলো, রাগ কমে গেলে শান্ত’ই‌ হয়তো কল করবে। তবুও বার বার ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল সে। মা বাবা বোধহয় ঘুমোতে চলে গেছে। হিনা গল্পের বই পড়ছে। নিঝুম একটু জোরে চেঁচিয়ে বলল, “হিনা একটা পেন্সিল দে তো!”

হিনা বসার ঘরে, গল্প পড়বার সময় তার হাতে একটা পেন্সিল থাকে, খুব সুন্দর কিছু লাইন দাগিয়ে রাখার জন্য। নিঝুমের বইতে মুখ গুজে আছে। ঘরে কেউ প্রবেশ করলো বোধহয়। নিঝুম মুখ না তুলেই হাত বাড়াল। পেন্সিল হাতে কেউ বাড়িয়ে দিতেই নিঝুম ভ্রু কুঁচকে গেল। হাত ধরে বলল, “তুই নখ কবে কাটলি হিনা!” বলেই গন্ধ শুঁকতে লাগল। এই গন্ধ তার চেনা। নিঝুম হতভম্ব হয়ে সামনে মুখ তুলে তাকাতেই দেখল শান্ত কে। হাঁ হয়ে সে তাকিয়েই রইল,‌ অশান্ত হাসছে। আচ্ছা এটা সত্যি অশান্ত তো, নাকি সে কল্পনা দেখছে!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here