তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৬২+৬৩

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৬২

আজ ৫ দিন হলো নিঝুম তাকে নিজের ঘরে বন্দি করে রেখেছে। তার সামনে তার বন্ধ ফোন। গত পাঁচদিন ধরে এটা বন্ধ’ই আছে। মা বাবা দুজনেই চিন্তিত তাকে নিয়ে। খোলাখুলি ভাবে কিছুই বলছে না কাউকে। বেশিরভাগ সময়ই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছে অন করবে, কি না? নিশ্চিত অশান্ত তাকে অনেকগুলো ফোন করেছে। যখন জেনেছে তার ফোন বন্ধ তখন সে বসে রইল কি করে। বাসায় একবার এসে তো নিঝুমের খোঁজ করতে পারতো। অসম্ভব কিছু তো ছিল না এটা। অভিমানে নিঝুমের চোখ ভরে উঠল। ফোন আর অন করল না সে। বালিশে মুখ গুজে শুয়ে রইল। দরজা নক করছে কেউ। নিঝুম চশমা পড়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?

ওপাশ থেকে হিনার গলার স্বর পাওয়া গেল। চুপচাপ ঘরের ভেতর এসে দাঁড়াল নিঝুমের সামনে। তার ফোনটা বিছানায় রেখে বলল, “কথা বল!

অতঃপর বেরিয়ে গেলো সে। নিঝুম খানিকটা অবাক হলো কিন্তু দ্রুত তা সামলে ফোনটা কানে তুললো। ওপাশ থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ! এই শব্দটা তার অতি পরিচিত! ভাঙা গলায় কেউ বলে উঠল, “হ্যালো, চশমিশ! আমি বলছি!”

কেঁপে উঠলো নিঝুমের সর্বাঙ্গ! তার গলা ধরে আসছিল বার বার। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলল, “হুম!

“কেমন আছো?

“ভালো!

“ওহ! আমি আজ পাঁচদিন হলো নানাজানের কাছে এসেছি।

“কেন?

“সেদিন রাতে ফোন এলো, নানাজনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তাই রাতের ফ্লাইটে চলে এলাম এখানে।

“ওহ! নানাজান কেমন আছে?

“আগের থেকে এখন ভালো।

“আপনি কেমন আছেন?

“আছি বেশ‌। আচ্ছা এবার নানাজানের কাছে যেতে হবে। পরে কথা বলব। আর তোমার ফোনটা অন করো।

“অশান্ত!

“হুঁ!

“চিন্তা করবেন না, নানাজান খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।

“হুম , নিজের খেয়াল রেখো। রাখছি!

“হুঁ!

ফোনটা কেটে দিল শান্ত। নিঝুম খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। কেন জানি কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তবু সে ঠোঁট কামড়ে আছে।‌ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে নিজের কান্না আটকানোর জন্য! জানালার দিকে দৃষ্টি ফিরে বাইরে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে! আকাশের ওই চাঁদের মতো নিজেকেও খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে তার, খুব নিঃসঙ্গ!

ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শান্ত। দৃষ্টি ফিরে তাকাল নানাজানের দিকে। তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক! শান্তিতে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে, তবুও তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। শান্ত এসে পাশে বসল তার। নানাজানের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলো। নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছে, তবুও তার চোখে অশ্রু টলমল। তার জীবনে একমাত্র আপনজন বলতে শুধু এই নানাজান’ই আছে। অসম্ভব ভালোবাসে তাকে। ছোটবেলায় যখন ভয়ে ঘুমোতে পারতো তখন নানাজান পাশে বসিয়ে তাকে গল্প শোনাতে। যতবার ফোনে কথা হতো ততোবার’ই বলতো, “চলে আয় আমার কাছে।” সে যেতে চাইতো না। উল্টো সে বলতো চলে আসতে। নানাজান তখন হাসতে হাসতে বলতো, “এখান থেকে নড়বার শক্তি যে আমার নেই, তোর নানির শেষ স্মৃতি টুকু যে এখানেই। এগুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। তুই কি আমায় মারতে চাস!” শান্ত তখন হাসতো। নানির প্রতি নানাজানের এই ভালোবাসায় অভিভূত হতো সে। চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। শান্ত ভাঙা গলায় বলে উঠল, “নানাজান! খুব মিস করছি তোমায়। চলে যেও না। থাকো না আমার পাশে। আমাকে ঠিকমতো বোঝার জন্য যে একমাত্র তুমিই আছো।”

গলার স্বর কেঁপে উঠলো বার বার। আর কিছু বলতে পারল না সে। চোখের অশ্রু মুছে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ তখন নানাজান বলে উঠল, “এতো ভালোবাসিস তুই আমায়। আমার জন্য কাঁদছিস যে!”

“নানাজান! তোমার জ্ঞান ফিরল কখন, চিনতে পারছো আমায়?”

নানাজান হাত দিয়ে মুখের মাস্ক টা খুলে ফেলে বলল, “গতকাল ফিরেছিল!”

“তুমি আমায় আজ বলছো?”

“তো এতে কি হয়েছে?”

শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলল। নানাজান তাকে দেখে হাসছে। সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। এক হাত শান্ত’র পিঠে রাখল নানাজান। ধীরে ধীরে বলে উঠল, “আমার আরো কটা দিন আছি তোর সাথে, এতো তাড়াতাড়ি কিছু হবে না।”

“তুমি শুয়ে থাকো, আমি ডাক্তার ডেকে আনছি।”

“বাদ দে, এখানকার ডাক্তার’রা ঔষধের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। একগাদা নিয়ম বলে কান খারাপ করে দেবে। আমি বরং উঠে বসি!

শান্ত উনাকে ধরে উঠে বসাল। শান্ত জায়ান আহমেদ’র সিকিউরিটি কে বলে ডাক্তার ডাকালো। নানাজান কে চেকআপ করে তিনি একগাদা নিয়ম বালি বলে গেলেন। নানাজান বাচ্চাদের মতো মুখ করে সবটা শুনতে লাগল। শান্ত পাশেই বসা ছিল। ডাক্তার যেতেই নানাজান বলে উঠল, “দেখলি তো, একগাদা বকবক। আমার শরীর আবার খারাপ করে দিল।

“তুমি বরং শুয়ে থাকো একটু।

“শুয়ে থাকতে থাকতে কোমর গেছে। আচ্ছা এলিসা দেখতে আসেনি আমায়।

“এলিসা আবার কে?

“কে তোকে বলি নি।

“নানা! বাদ দাও ওসব। এখন চুপচাপ শুয়ে থাকো তুমি!

“না এলিসা কে দেখতে ইচ্ছে করছে। তুই বরং ওদের বল এলিসা কে নিয়ে আসতে। বাড়ির ঠিকানা জানে। অসুস্থ আসি শুনে ছুটে আসবে দেখতে।

শান্ত হা হয়ে নানাজানের বকবকানি শুনছে। কে বলবে এই মানুষটা অসুস্থ! দিব্যি বকবক করেই যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে শান্ত কে খবর পাঠাতে হলোই।
নানাজানের হাতে একটা ম্যাগাজিন। শান্ত’র হাতে সুপের বাটি। একটু একটু করে নানাজানের মুখে তুলে দিচ্ছে সে। নানাজান হঠাৎ বলে উঠলেন, “ওই মেয়ের সাথে কথা বলছিলি তাই না!

শান্ত কিঞ্চিত হাসল।‌ নানাজান হেসে বললেন, “খুব ভালোবাসিস না তাকে।

শান্ত আবারো হাসল।‌ জায়ান আহমেদ নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “থাক, আমি চলে গেলেও চিন্তা নেই। কেউ একজন তো থাকবে তোর পাশে।

“আবোলতাবোল কি বলছে?

“কিছু বলি নি। আর খাবো না এই অখাদ্য!

“এসব’ই খেতে হবে।

“ছিঃ এসব মানুষ খায়। তুই এলিসা কে খবর পাঠিয়েছিস?

“পাঠিয়েছি এসে পড়বে। তুমি বরং খেয়ে নাও।

জায়ান আহমেদ মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। শান্ত তাকে সাধছে! হঠাৎ দৌড়ে রুমে প্রবেশ করল একজন। জায়ান আহমেদ খানিকটা অবাক হলেন। আশালতা ছুটে এলো বাবা’র কাছে। শান্ত মুখটা নিচু করে রেখেছে। ঠিক তখনি আরেকজনের প্রবেশ ঘটলো রুমে। কবীর চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে। আশালতা জিজ্ঞেস করছে, “বাবা এখন কেমন আছো তুমি? এতো বড় একটা ঘটনা হয়ে গেল আর তুমি আমায় জানালে না।

জায়ান আহমেদ মলিন মুখে বললেন, “আমার জ্ঞান ছিল নাকি, যে তোমাদের জানাবো।

“বাবা আমি মজা করছি না।

“মজা আমিও করছি না। কখন এলে? এতো দৌড়াদৌড়ি করে আসবার কিছু হয় নি। আর কাঁদছো কেন? কান্না থামাও!

আশালতা কান্না থামিয়ে শান্ত’র দিকে ফিরলেন। শান্ত উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। কবীর চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে বললেন, “এখন কেমন আছেন বাবা?

ভেতরে যেনো এতোক্ষণ দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল শান্ত’র। বাইরে এসে বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। হাঁটাচলা করছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত! জায়ান আহমেদ’র সিকিউরিটি তখন এসে জানাল এলিসা কে নিয়ে আসা হয়েছে। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কোথায় সে?

সিকিউরিটি সরে দাঁড়াল। তার পিছন দাঁড়ানো পাঁচ বছরের ছোট একটা মেয়ে। শান্ত হতবাক হয়ে দেখছে তাকে। মেয়েটা ভিনদেশী! তার ফর্সা গাল লাল হয়ে গেছে। নীল রঙের চোখগুলো অদ্ভুত ভাবে দেখছে শান্ত’কে। মাথায় সোনালী চুলের বাহার। দুই হাতে বড় একটা পুতুল কে আঁকড়ে ধরে আছে। শান্ত বলে উঠল, “এলিসা!

মেয়েটা ফট করে কাছে এসে মাথা নেড়ে বলল, “Hi! I’m Alica. Who are you?

শান্ত হেসে উঠলো। সত্যি সত্যি এলিসা নামের মেয়েটিকে তার চমৎকার লাগছে। কিভাবে নানাজান তাকে নিয়ে মজা করল। শান্ত নিচু হয়ে বসল। কিছুক্ষণ কথা বলল এলিসার সাথে। তাদের বলা কথাগুলোর অনুবাদ এমন ছিল, “আমি শান্ত!

“ওহ শান্ত! জায়ানের দাদুর নাতি তুমি?

“তুমি চিনো আমায়!

এলিসা মাথা নাড়ল। শান্ত হেসে উঠলো। এলিসা জিজ্ঞেস করল, “দাদু কোথায়?

শান্ত উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বলল, “এসো আমার সাথে, নিয়ে যাচ্ছি!

এলিসা শান্ত’র হাতটা কোন সংকোচ ছাড়াই ধরে পড়ল। তার পরনে গোলাপী রঙের একটা ফ্রক ‌, পায়ে গোলাপী রঙের জুতা। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সে শান্ত’র হাত ধরে। যেতে যেতে আবার জিজ্ঞেসও করছে দাদুর কথা। শান্ত ভাবল, “এই ছোট পরীর চেয়ে বড় ঔষধ আর কিছু না। দুদিন এর সাথে কথা বলেই নানাজান ঠিক হয়ে যাবে।” ঠিক তাই ঘটল। রুমে আসার পর থেকেই এলিসা কথাই বলে যাচ্ছে দাদুর সাথে। তার কথা যেনো শেষ’ই হচ্ছে না। বাড়ির কথা, স্কুলের কথা সব কথা বলে যাচ্ছে হাত নাড়িয়ে। এলিসা নামের এই মেয়েটির‌ বাবা নেই। মা চাকরি করে। একা একা সারাদিন বাসায় বসে থাকে সে। আর কোন ভাইবোন নেই তার। বেশ কিছু সময় জায়ান আহমেদের সাথে কাটায়। রাতে যখন এলিসার মা তাকে নিতে এলো এলিসা গেল না। দাদুর জামা ধরে টেনে বসে রইল। সে যাবে না, তার নীল রঙের ভাসা ভাসা চোখ গুলোতে অশ্রু জমে যাচ্ছিল। যেকোন মূহুর্তে নিচে গড়িয়ে পড়বে। শেষমেষ রাতটা এই হসপিটালেই থাকতে হলো এলিসা কে। শান্ত দূরে বসে বসে দেখছে। খানিকটা হিংসে হচ্ছে তার। এলিসা আসবার পর থেকে নানাজান আর তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না! কিন্তু নানাজানের খেয়াল তাকেই রাখতে হচ্ছে। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হন নি তিনি। নিজ মেয়ে আশালতা কে চলে যেতে বলেছেন। কারণ আশালতা এখানে থাকলে শান্ত থাকবে না। নিরুপায় হয়ে বেরিয়ে গেল আশালতা!

——-

সেদিনের পর আজ আরো দুদিন পেরিয়ে গেছে। নিঝুম এখন অবদি শান্ত’র কাছ থেকে একটা ফোন অবদি পায় নি। ব্যস্ততায় আছে ভেবে সাহস করে নিজেও কল করেনি। প্রায় সাতদিন পর নিঝুম কে ভার্সিটিতে আসতে দেখে আহনাফ ছুটে এলো তার কাছে। বলতে লাগলো, “কি হয়েছিলো তোমার? এতো দিন আসো নি কেন? কতবার কল করলাম, তাও ধরলে না।”

“কিছু না, আহনাফ। এই তো।

“শান্ত’র‌ সাথে কথা হয়েছে!

“হুম।

“চিন্তা করো না, একটু সময় দাও!

নিঝুম হাসার চেষ্টা করল। ক্লাসে একদম তার মন বসে নি। তিথি কিসব কথা বকবক করে বলেই গেল। নিঝুম তাও মনোযোগ দিয়ে শুনলো না। চোখ ফিরিয়ে কয়েকবার দেখল ইফা কে। ইফা বদলে গেছে, অনেকটা বদলে গেছে। নিজেকে কেমন চট করেই গুছিয়ে নিয়েছে। নিঝুম হাতের ফোনটা অন করে করল। নাহ! শান্ত এখনো কোন কল করে নি তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ক্লাস শেষে বের হতেই কেউ ছুটে এলো তার দিকে। নিঝুম খানিকটা হতভম্ব হয়েই পিছনে তাকাল। খুশি বলে উঠল, “ফাইনালি তুমি এলে, কতো খুঁজেছি তোমায় জানো?

“তুমি!

“হ্যাঁ এদিকে আসো, কথা আছে তোমার সাথে।

বলেই হাতটা ধরে এদিকে নিয়ে এলো নিঝুম কে। নিঝুমের অবাকের রেশ এখনো কাটছে না। খুশি খানিকটা দম ফেলে বলল, “তোমার আর শান্ত’র‌ নাকি ঝগড়া হয়েছে।
নিঝুম মহাবিরক্ত হলো। আজব তো! এখন এই মেয়েটাকেও কি বলতে হবে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে। কে ও? এতো কৈফিয়ত কেন দিবে সে! খুশি জবাবের অপেক্ষা না করেই বলে উঠল, “ঝগড়া কি আমার জন্য হয়েছে!

“না তোমার জন্য কেন হতে যাবে! ওই তো ওভাবেই..

খুশি চট করে নিঝুমের হাতটা ধরে বলল, “কথা গুলো শোন! মন দিয়ে শুনবে, কথার ভাজে কথা বলবে না। এজন্য সেদিন তোমাকে কিছুই বলতে পারি নি আমি। নিঝুম! তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন কিছু না। আমি তোমাদের মাঝে তৃতীয় কোন ব্যক্তিই না। হ্যাঁ এটা তোমার কাছে অস্বাভাবিক লাগতেই পারে, শান্ত আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলে কিন্তু এমন কিছুই না। যতটুকু সময় ও আমার সাথে থাকে ততোক্ষণ’ই তোমার কথা বলতে থাকে। বিশ্বাস করো এমন কিছুই নেই আমাদের মাঝে। শুধু শুধু আমার জন্য নিজের সম্পর্কটা নষ্ট করো না!

“অশান্ত কি বলেছে তোমায় আমার ব্যাপারে?

খুশি হাতটা ছেড়ে দিল। একগাল হেসে বলল,‌ “অশান্ত তার চশমিশ কে অনেক ভালোবাসে!

নিঝুম নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল। খুশি হাসছে, তারও হাসা উচিত। অশান্ত তো খুব সুন্দর একটা কথা বলেছে, সে তাকে ভালোবাসে! সত্যিই তো অনেক ভালোবাসে। বড্ড ভালোবাসে। নিঝুম পিছন ফিরে হাঁটা ধরল। তার শরীরে কেমন ঝিম ধরে গেছে। মুখটা থমথমে! আচ্ছা! সে কি একটু বেশিই কথা ফেলল অশান্ত কে। অশান্ত কি খুব কষ্ট পেয়েছে। সে কি সত্যিই ভুল কিছু বলে ফেলল। অশান্ত কি তাকে ছেড়ে চলে যাবে। না! এসব কি ভাবছে? এমন কিছু হলে কেন তাকে কল করতো। কেন বলতো পরে আবারো কথা বলবে। এতো টুকু ঝগড়ার জন্য অশান্ত কেন তাকে ছাড়তে চাইবে!
নিঝুম এলোমেলো ভাবে হাঁটছে। তার মাথা ব্যাথা করছে, বড্ড ব্যাথা করছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। হঠাৎ সামনে এক পরিচিত মুখ থেকে ধমকে গেল সে।
“আহনাফ!

“নিঝুম ঠিক আছো তুমি?

নিঝুম মাথা নেড়ে না বলল। আহনাফ হতচকিয়ে গেল। নিঝুম কাঁদতে শুরু করেছে। আহনাফ কি করবে বুঝতে না পেরে ঘাড়ে হাত রাখল তার। বিচলিত হয়ে বলল,‌‌ “কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?

“আহনাফ! আহনাফ অশান্ত!

“কি হয়েছে শান্তর! আবারো ঝগড়া করেছে তোমার সাথে। কিছু বলেছে তোমায়!

নিঝুম মাথা নেড়ে না বলল। আহনাফ বলে উঠল, “তবে কাঁদছো কেন?

“আমি জানি না আহনাফ!

আহনাফ থমতম খেয়ে খেল। নিঝুমের কান্না থামছে না। বরং বাড়ছে। সে ধপ করে নিচে বসে পড়ল। কাঁদতে লাগল শব্দ করে। আহনাফ নিচু হয়ে বসে বলল, “নিঝুম!

“আহনাফ, অশান্ত কিছু করেনি। আমি ভুল বুঝেছি তাকে। কেন এমনটা হলো আহনাফ! অশান্ত কি খুব রেগে গেলো আমার উপর। অশান্ত কবে ফিরবে? কবে আসবে উনি। আমার খুব কান্না পাচ্ছে আহনাফ, আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি আমি!

আহনাফ নিশ্চুপ! তার চোখে অশ্রু টলমল। নিঝুম কে শান্ত করবার পুরো চেষ্টা করছে সে। এদিকে তানিশা হাতে ফোন নিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে দেখল নিঝুম নিচে বসে কাঁদছে। আহনাফ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। তানিশা থমকে দাঁড়াল। শান্ত আর নিঝুমের ঝগড়ার ব্যাপারে শুনেছে সে। তবে কি ঝগড়াটা খুব ভয়াবহ ছিল। এর প্রভাব কি পড়বে তাদের সম্পর্কের মাঝে! এমনটা হলে যে খুব ভালো হবে না! বিচ্ছেদের কষ্ট যে সবাই নিতে পারে না। নিঝুমও পারবে না! এই প্রথমবার নিঝুমের জন্য খারাপ লাগছিল। এভাবে তাকে কাঁদতে দেখে কষ্ট হচ্ছিল তার। তানিশা বিস্ময় দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে রইল।

আহনাফের পিছন থেকে এগিয়ে আসছিল নীলাভ্র! নিঝুম কে এভাবে নিচে বসে কাঁদতে দেখে হতভম্ব সে। শ্বাস নিতেও হঠাৎ করে কষ্ট হচ্ছিল তার। নীলাভ্র ঢোক গিলল। নিঝুম কেন এভাবে কাঁদছে? কি হলো তার! ভালোলাগার সেই মানুষটিকে হাসতে দেখবার জন্য সে যে পিছিয়ে এলো, এই কি তার পরিণাম! নীলাভ্র চোখ ফিরিয়ে নিল। ভাগ্যের চক্র বড় জটিল। এই একটি ভাগ্যের সাথে আর কতোটি ভাগ্য জড়িত কে জানে?

নিঝুমের মুখটা উদাসীন! পার্কের এক বেঞ্চে বসে আছে সে। বেঞ্চের এই প্রান্তে একা সে, ওই প্রান্ত’টা খালি। ওখানেই বসে থাকতো শান্ত। আইসক্রিমের গাড়ি নিয়ে আইসক্রিম ওয়ালা হাজির। শান্ত রোজ তাকে আইসক্রিম কিনে দিত। ওই গাছে ফুটে থাকা জবা ফুল ছিঁড়ে আনতো। যদিও লেখা ছিল, “ফুল ছেড়া নিষেধ!” তবুও শান্ত এমনটা করতো। এসব কথা ভাবতেই তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। তবে হাসি বেশিক্ষণ ছিল না। মুখটা মলিন হয়ে গেল আবারো। পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে চোখ ফিরাল সে। নীলাভ্র একগাল হেসে আইসক্রিম টা এগিয়ে দিল তার দিকে। নিঝুম হেসে বলল, “ইচ্ছে করছে না নীলাভ্র!

“আহ, নাও তো। কিনে আনলাম আর তুমি বলছো খাবে না।

নিঝুম প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বসে রইল। নীলাভ্রের হাতেও আইসক্রিম। সে আইসক্রিম খেতে খেতে বলল, “তোমার চোখ এতো ফুলে আছে কেন?

“কেঁদেছি বলে!

“কাঁদছিলে কেন?

“মন খারাপ বলে!

“আইসক্রিম নিয়ে বসে আছো কেন? আইসক্রিম খাও! মন খারাপ ঠিক হয়ে যাবে। নাহলে শেষে শান্ত বলবে, চশমিশের মন খারাপ করে ছিল আর আমরা কিছুই করলাম না।

নিঝুম হাসার চেষ্টা করল। আইসক্রিম খেতে লাগল সে। নীলাভ্র হাসছে। হাসি হাসি মুখে বলল, “তুমি বড্ড বেশি ভাবো। শান্ত যাবার আগেও বলেছে, এসেই সব ঠিক করবে। আর মন খারাপ করো না।

“আপনার সাথে কথা হয়েছে অশান্ত’র!

“না, ওর সাথে না। তবে নানাজনের একজন লোকের সাথে কথা হয়েছে। আর তো কেউ নেই বলো। সবটা শান্ত কেই দেখতে হবে।

নিঝুম মাথা নাড়ল। নীলাভ্র মাথা উঁচু করে আকাশ দেখতে লাগল। আকাশ এখন কেমন মেঘলা মেঘলা। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ অথচ বৃষ্টি হবে না। দু’তিন দিন ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল, “নিঝুম! ভালোবাসা বুঝলে এতো সহজ না। এটা খুব জটিল বিষয়।

“কেমন জটিল?

“খুব জটিল! তোমার ওই মাথায় এটা ঢুকবে না।

“আপনি আমায় অপমান করছেন।

“না বুঝাচ্ছি!

“এভাবে কাকে বোঝাতে দেখেছেন। সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন!

“বাহ! ভালোবাসো তুমি আর বোঝাতে বলছো আমাকে।

নিঝুম চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। নীলাভ্র হেসে উঠল। “শোন! ভালোবেসে তুমি আজীবন সুখ পাবে এমনটা ভেবো না, ভালোবাসায় সুখ কষ্ট দুই থাকে। ভালোবেসে তুমি যেমন আগে হেসেছিলে আজ ভালোবেসেই কেঁদেছো!

নিঝুম একবার এদিক একবার ওদিক তাকালো। অতঃপর মাথা দুলিয়ে বলল, “বুঝতে পেরেছি!

“তুমি এখনো বুঝতে পারো নি। আচ্ছা থামো, চলো বাসায় যাবে।

“হুম!

“আসো, আজ তোমায় আমি এগিয়ে দিই। কি যাবে তো?

নিঝুম হেসে মাথা নাড়ল।
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৬৩

আজ ছুটির দিন। নিঝুম আজ সারাদিন’ই ঘরে বসে কাটিয়ে দেবার চিন্তা করছে। সকালে নাস্তা করেও নি ঠিকমতো। মা কতোক্ষণ বকাঝকার পর দুটো বিস্কিট খেয়ে বসে আছে। মুখটা ভার! রাগ হচ্ছে নিজের উপর’ই। কিছুক্ষণ পর পর আয়নাতে তাকিয়ে নিজেকে নিজে দেখছে আর ভ্রু কুঁচকাচ্ছে। ইচ্ছে করছে চশমা খুলে বসে থাকতে। রাগের কারণ হচ্ছে, গতকাল ভোররাতে অশান্ত কল করেছিল। তাও ৫ বার! সে যে কি গভীর ঘুমে ছিল সে নিজেও জানে। কল ধরতে পারে নি। রাগে তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। অশান্ত একটা মেসেজও করেছিল। লিখেছে তার আসতে আরো কিছুদিন লাগবে, নানাজান এখন অনেকটা সুস্থ আর সেও ভালো আছে। ঠিক মতো নিজের খেয়াল রেখো! ব্যস! এরপর থেকে নিঝুম যখন’ই কল করছে তখনি ফোন বন্ধ। ইচ্ছে করছে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে।‌ কিন্তু তা সম্ভব নয়, অশান্ত আবারো কল করতে পারে। আজ প্রায় ১৭ দিন হয়ে গেল অশান্ত কে দেখতে পারছে না সে। একবার ভিডিও কল করলেও তো পারতো! আরো নাকি কয়েকদিন লাগবে। আচ্ছা অশান্ত কি পারে না, নানাজান কে সাথে করে নিয়ে আসতে। না! তা কি করে হয়, এখানে কি ভালো কোন ডাক্তার আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। চাদর মুড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। আজকের প্রোগ্রাম সারাদিন শুয়ে থাকবে। এক দন্ড নড়বে না এখান থেকে।

বিকালের দিকে তাহমিনা বেগমের সাথে দেখা হলো তিথির। মেয়েটিকে তার বেশ পছন্দ, খুব হাসি খুশি মেয়ে। তার একটা ছেলে থাকলে নিশ্চিত এই মেয়ের সাথে বিয়ের ব্যবস্থাটা করতেন। মেয়েটি তার সামনে বসে একের পর এক পাকোরা খেয়ে যাচ্ছে আর প্রশংসা করছে। তাহমিনা বেগমের বেশ ভালো লাগছে। তিনি গরম গরম আরো দুটো পাকোরা তুলে দিলেন তিথির প্লেটে। তিথি হেসে বলল, “খালামনি দারুণ হয়েছে খেতে!”

তিথি তাহমিনা বেগম কে খালামনি বলে ডাকে। কারণ তার এক খালামনির সাথে নাকি তাহমিনা বেগমের বেশ মিল। পাকোরা গুলো বানানো হচ্ছে নিঝুমের জন্য। দুপুরে কিছু খায়নি সে, এই পাকোরা গুলো নিঝুমের বেশ পছন্দ। নিশ্চিত এগুলো সে এড়িয়ে যাবে না। দ্বিতীয় মেয়ে হিনা গেছে এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। সন্ধ্যার পর পরই আসার কথা। তাহমিনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি জানি কি বলবে বলছিলে মা?”

“হ্যাঁ খালামনি। বলছিলাম কি, আমি নিঝুম কে একটু নিতে এসেছি।

“তা বেশ কিন্তু বিশেষ কোন আয়োজন!

“হুম, আমার এক মামাতো বোনের বিয়ে। আজ গায়ে হলুদ হবে, সারাদিন একটু মজা করবো এই আরকি! তাই নিঝুম কে নিতে এসেছি।

“ভালো কথা, নিয়ে যাও একটু ওকে। কি জানি কি হয়েছে? সারাদিন মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে। বের’ই হতে চায় না।

“চিন্তা করবেন না, আমি নিয়েই ওর মন ঠিক করে দেবো।

“আর দুটো নাও!

“দিন দিন!
বলেই তিথি প্লেট পেতে দিল। তিথি বলে উঠল, “খালামনি, ও কিন্তু সারারাত থাকবে আমাদের সাথে!

“সারারাত!

“হ্যাঁ‌ খালামনি। প্লিজ না করো না।

“কিন্তু মা, তুমি তো ওর বাবা কে চিনো না। সে সারারাত ঘুমাবে না,মেয়ে ঘরে না থাকলে।

“খালামনি প্লিজ একটু খালুজান কে বুঝিয়ে বলো না প্লিজ। দরকার পড়লে রাতে কল করে কথাও বলে নিবে। দেখো সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু আর আমি এখন এখানে এসেছি নিঝুম কে নিতে। অনেকবার বলেছি ওকে,‌ও বলছে যাবে না যাবে না। তাই এখানে আসা।

তাহমিনা বেগম বেশ খানিকক্ষণ ভাবলেন।মেয়ের হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন তিনি। শুকনো কাশি কেশে বললেন, “তিথি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

“বলো না!

“নিঝুম কি কোন ছেলের চক্করে পড়েছে।

“কি বললেন, নিঝুম তাও কোন ছেলের চক্করে! এ কিরে হয় খালামনি।

“তবে হঠাৎ যে এমন?

“ওই তেমন কিছু না খালামনি। সামনে এক্সাম! তার টেনশনে এই অবস্থা। আপনি চিন্তা করবেন না, সেরকম কিছু হলে আমি আপনাকে জানাবো। বিশ্বাস করেন তো আমায়।

তাহমিনা বেগম হাসলেন। তিথি তার হাসিতে স্বস্তি পেল। খালামনি বানানো গল্পটা তবে বিশ্বাস করেছে। এখন নিঝুম কে নিয়ে এখান থেকে যেতে পারলেই হয়।

দিয়ার ধৈর্য্য এবার শেষ পর্যায়ে, বিরক্ত স্বরে বলল, “আর কতোক্ষণ! আমরা কেন এখানে ওই মেয়েটার জন্য ওয়েট করছি তানিশা।”

“নিঝুমের জন্য?

“জানি? কিন্তু কেন?

“দরকার আছে তাই!

“কি দরকার? আমি হঠাৎ বুঝতে পারছি না, এই মেয়েটার জন্য তোর এতো দরদ কেন হচ্ছে।

তানিশা জবাব দিল না। দিয়া রাগে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রিয়া এতোক্ষণ চুপ থাকবার পর এবার বলে উঠল , “তুই কি ভাবছিস তানিশা?

“সময় এলেই দেখবি!

রিয়া ভ্রু কুঁচকে নিল। কিছু একটা তো হবেই। তানিশা এবার গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। নিঝুম আসছে। তিথি তার কথা রাখতে পেরেছে।‌ নিঝুমের মুখটা ফ্যাকাশে। বোঝাই যাচ্ছে নিতান্ত অনিচ্ছায় এখানে এসেছে সে। তিথি সমান তালে বকবক করেই যাচ্ছে। এর বকবকানিতে মাথা ধরে গেছে তার। সহ্য না করতে পেরে চলে এসেছে। ভেবেই এসেছে বেশিক্ষণ থাকবে না। খুব করে হলেও ঘন্টা খানেকের মতো। এরপরই চলে আসবে। তিথি জোরে তানিশার বলে ডাকল। সামনে তানিশা কে দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাক হলো নিঝুম। অতঃপর ভাবলো, হয়তো তারাও যাচ্ছে অনুষ্ঠানে।

গাড়িতে বসে যাচ্ছে সবাই। কারো মাঝেই কোন কথাবার্তা নেই, সবাই যেন নিরব হয়ে গেছে। নিঝুম হঠাৎ কি মনে করে বলে উঠল, “আচ্ছা তিথি, তোর তো কোন মামাই নেই। মামাতো বোন এলো কি করে?

সবাই যেন খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। নিঝুমের চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে জবাব না পেয়ে চুপ করে যাবে। তিথি হতভম্ব করে বলল, “আরে আজব তো, মামা নেই এটা কখন বললাম। হ্যাঁ আমার মায়ের নিজের কোন ভাই নেই, তাই বলে কি তার খালাতো‌, চাচাতো ভাই বোন নেই।

“এতো দূরের সম্পর্ক!

“সম্পর্ক নিয়ে তুই কি করবি। অনুষ্ঠান হচ্ছে তো আমাদের বাসায়।

নিঝুম দৃষ্টি বাইরে সরিয়ে বলল, “কিন্তু এটা তো তোর বাসার রাস্তা নয়?

তিথি হতচকিয়ে গেল। তানিশা চট করে বলে উঠল, “গোয়েন্দা গিরি বন্ধ করো, আমরা শপিং এ যাচ্ছি। কিছু কেনাকাটা করে বাসার দিকে রওনা হবো।

নিঝুম চুপ হয়ে গেল। দৃষ্টির নজর এখনো বাইরে।‌ রাস্তাটা অনেক চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু সে চিনতে পারছে না। আগে কখনো কি এসেছিল এখানে?

গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে সবাইকে বের হতে দেখে সেও বের হলো। এতোক্ষণে পারল সে কোথায়? কিন্তু এখন এয়ারপোর্টে আসবার কারণ কি? কেউ কি আসছে? তিথি কে জিজ্ঞেস করল, অথচ জবাব দিল না। হাত টেনে সামনে নিয়ে গেল। খানিকটা সামনে এসেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল নিঝুম। সে ঠিক দেখছে তো!
শান্ত আর আহনাফ জড়িয়ে ধরে আছে একে অপরকে। শান্ত দেশে ফিরল কবে? তার আশপাশে জড়ো হয়ে আছে আহিম, আফিন আর নীলাভ্র! শান্ত আসবে এতো গুলো মানুষ জানতো, অথচ সেই জানতো না। শান্ত কি তবে এতোটাই রেগে আছে তার উপর। শান্ত হাসছে। আহনাফ তাকে ছেড়ে দিয়ে নানাজানের খোঁজখবর নিচ্ছে। হঠাৎ নীলাভ্র বলে উঠল “নিঝুম?

শান্ত আর আহনাফ হতচকিয়ে গেল। পরক্ষনেই দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো। নিঝুম কে দেখতে পেয়ে হতভম্ব সে। নিঝুমের চোখ ভরে উঠছে। সে ছুটে এলো শান্ত’র কাছে। ভরা লোকজনের মাঝে জড়িয়ে ধরল শান্ত কে। তাকে ধরেই কাঁদতে লাগল সে। নিজেকে লুকিয়ে রাখছে শান্ত’র বুকের মাঝে। শান্ত এতো হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে আছে। একই সঙ্গে সে হতভম্ব আর হতবাক। নিঝুম কি করে জানলো সে এখানে। সবাইকে বারণ করে দিয়েছিল নিঝুম কে জানানোর জন্য। তবে কে জানালো তাকে। হাত দুটো দিয়ে নিঝুম কে আঁকড়ে ধরে আছে সে। একটু পর পরই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আহনাফ ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল, “নিঝুম এখানে কি করে এলো?

আহিম ফিসফিসিয়ে বলল, “তানিশা এনেছে!

আহনাফ মুখ ফিরিয়ে তাকাল তানিশার দিকে। তানিশার ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিত হাসি। সেই হাসি আবারো মলিন হয়ে গেল আহনাফ কে দেখে। মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। আহনাফের বড্ড খারাপ লাগল। তার কারণে তানিশার মুখ থেকে হাসির রেখা টা চলে গেল। এমনটা তো সে করতে চায় নি।

এদিকে নিঝুম যেন থামবার নামই নিচ্ছে না, কেন এতো কাঁদছে সে? বড্ড মন খারাপ লাগছে শান্ত’র। সে তো এখানে চশমিশ কে কাঁদাতে আসেনি। অবশেষে নিঝুম কান্না থামাল। চোখ মুছে ফিরল শান্ত’র দিকে। তার চোখে এখনো অশ্রুতে টলমলে। ভাঙা গলায় সে বলে উঠল, “আপনি আসবেন আমায় কেন জানালেন না অশান্ত?”

শান্ত’র মুখটা থমথমে। পরিস্থিতি যেন ক্রমশ’ই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। নীলাভ্র বলে উঠল, “এসব কথা কোথাও বসেও করা যেতে পারে। চলো কোথায় বসি!

——-

রেস্টুরেন্টে’র এক কোনে টেবিলে জড়ো হয়ে বসেছে সকলে। শান্ত পানির গ্লাসটা নিঝুমের সামনে রেখে বলল, “আমি আসবো এটা তোমাকে তখনি জানাই নি কারণ তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম। আর কিছু না।

আফিন, আহিম সকলে সহমত হল শান্ত’র‌ সাথে। তবুও প্রশ্ন একটা থেকে গেল। নিঝুম কে এখানে কে আনাল। আহিম ফট করে আবারো নাম নিল তানিশার। তানিশা এমন ভান করল সে কিছুই করেনি। কফি মগে চুমুক দিয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে রইল সে। দিয়া বলে উঠল, “হ্যাঁ এই কাজটা তানিশা’ই করেছে। কি জানি? হঠাৎ কেন এতো দরদ উথলে উঠছে ওর।

“আহ দিয়া চুপ কর তো! এই নিঝুম উঠো!

“কেন?

“দরকার আছে তাই, শান্ত তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল, আমি তার সারপ্রাইজ নষ্ট করতে পারি না। চলো আমাদের সাথে, তোমার অশান্ত কে সময় দাও!

নিঝুম যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়াল। সবাই খানিকটা অবাক হলো। নিঝুম তানিশার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল। গাড়িতে উঠবার সময় নিঝুমের হঠাৎ কিছু মনে পড়ল। অশান্ত কে একটা কথা বলা হয়নি তার। তানিশার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি একটু আসছি?

“কোথায় যাচ্ছ?

“একটা কাজ আছে আমার!

বলেই পিছন ছুটতে লাগল সে। ছুটতে ছুটতে খানিকদূর আসার পর দেখল শান্ত ও ছুটতে ছুটতে এখানেই আসছে। নিঝুম দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। শান্ত এগিয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “তুমি এখানে?

“একটা কথা বলার ছিল, কিন্তু আপনি?

“আমারও একটা কথা বলার ছিল!

বলেই শান্ত খানিকটা এগিয়ে গেল। নিঝুমও এগিয়ে এলো। মুখোমুখি দুজন! শান্ত ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। নিঝুম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শান্ত’র দিকে। শান্ত হাত বাড়িয়ে নিঝুমের হাত দুটো ধরল। কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। সাথে নিঝুমও! দুজনেই একসাথে বলে উঠল, “আইম সরি চশমিশ!

“আমি আপনাকে ভালোবাসি অশান্ত!

কথাগুলো শোনামাত্র ধমকে গেল দুজনেই, ধমকে গেল সময়! একে অপরকে দেখতে লাগল অপলক ভাবে। সূর্যের একটু আলো মুখে এসে পড়ল নিঝুমের মুখে! শান্ত’র মনে হলো, “এক অপরূপ রমনী দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে!” কিঞ্চিত হাসল সে!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here