#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৮.
.
নিস্তব্ধ রাতের শুনশান নীরবতায় কে*টে গেল কিছু সময়, কিছু মুহুর্ত। এক সময় ফোঁপানোর শব্দও কমে গেল, থেকে গেল শুধু নিশ্বাসের আনাগোনা। ঠিক কতটা সময় কে*টে গেছে জানা নেই। কিন্তু মধ্য রাত যে পেরিয়ে গেছে সেটা ঠিকই অনুভব করতে পারছি। তাসফি ভাইয়ের প্রতি আমার ভয়টা একটুও কমে নি, কিন্তু তবুও ঘাপটি মে*রে পড়ে আছি ওনার বুকে। উনিও দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরেছেন নিজের সাথে। ওনাকে ভয় লাগলেও বারংবার মনে হচ্ছে এটাই আমার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। যতকিছুই হয়ে যাক না কেন, ওনার বুকে থাকলে কখনোই কোনো ক্ষতি হবে না আমার।
তাসফি ভাই কয়েকবার ডেকে গেলেও সারা দিলাম না আমি, সেভাবেই পড়ে রইলাম ওনার বুকের সাথে, ঝাপটে ধরে। আমার সারা না পেয়ে একটু থামলেন উনি। এক হাত আমার কোমর থেকে উঠিয়ে গালে রাখলেন। ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলাম যেন, অস্পষ্ট সুরে ‘আহ্’ করে আত্মদান বেরিয়ে এলো। আমার ব্যাথার উৎসটা উনি হয়তো ঠিক বুঝতে পারলেন না। আবারও গালে হাত চেপে ধরতেই অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,
“আহ্! লাগছে আমার….”
“কি হয়েছে? কোথায় লাগছে তোর….”
ওনার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না আমি। ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেষ্টা করলাম। আস্তে করে বলে উঠলাম,
“এ..এখানে কি করছেন আপনি? চচ্…চলে যান।”
ওনাকে ছেড়ে একটু দূরে সরে গেলাম। উনি সাথে সাথে এগিয়ে এলেন। দু’ হাতে ধরতেই আমি আবারও পিছনে সরে গেলাম। আমাকে এভাবে সরে যেতে দেখে উনি আস্তে করে বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে রুপু… এমন করছিস কেন? বল আমাকে, কোথায় লাগছে?”
“চলে যান না আপনি…. আমি আর কারোর সাথে কথা বলবো না… কারোর সাথে না। প্লিজ! তাসফি ভাই, আপনি চলে যান।”
“এই রুপু…. রুপুসোনা তাকা আমার দিকে, দেখ আমাকে। তুই কি আমাকে ভয় পাচ্ছিস?”
উত্তর দিলাম না ওনার কথার। মনের ভয়টা কিছুতেই বের করতে পারছি না যেন। মনে হচ্ছে, এই বুঝি আরেক গালে ওনার শক্তপোক্ত হাতের থাপ্পড় পরবে। ভেবেই নিজেকে আরও গুটিয়ে নিলাম। হঠাৎ থেমে গেলেন উনি। না আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন, আর না কিছু বললেন। প্রায় মিনিট দুয়েক পর যখন বুঝতে পারলাম উনি চুপ করে গেছেন, তখন মাথাটা হালকা করে তুলে তাকালাম ওনার দিকে। বারান্দা ও জানালা দিয়ে আসা রাতের আলোয় ওনার চেহারা দেখতে কোন অসুবিধা হলো না আমার। থমকে গিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। এক পলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি কিছু সময় পর হুট করেই এগিয়ে এলেন আমার কাছে। চমকে গিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই দু’ হাতে আগলে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,
“সরি! রুপুসোনা, ভুল করে ফেলেছি আমি। প্লিজ! ক্ষমা করে দে আমাকে। একবার তাকা আমার দিকে। এভাবে ভয় পাস না, দূরে ঠেলে দিস না আমাকে।”
একটু চুপ থেকে কপালে আলতে করে ঠোঁটের স্পর্শ দিলেন। আরও কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠলেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দে রুপু, তখন সত্যিই ওমনটা করতে চাই নি। রাগের মাথায় তখন কি করেছি নিজেই জানি না। ছেলেটার সাথে তোকে ওভাবে দেখে মাথা ঠিক ছিলো না আমার, কিছু জানার চেষ্টা না করে রাগ দেখিয়েছি। সরি! রুপু, এভাবে ভয় পেয়ে থাকিস না।”
“আ..আপনার ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারছি না তাসফি ভাই, কিছুতেই পারছি না।”
“একদম ভয় পাবি না, কিছু করবো না আমি তোকে, আমার রুপুসোনা কে কিছু করবো না।”
বলেই আবারও বুকের সাথে আবারও জড়িয়ে নিলেন। অনেক কিছু বলে বোঝাতে চাইছেন আমাকে, বারংবার বলতে লাগলেন যেন ভয় না পাই ওনাকে। পুরোপুরি ভয়টা না কাটলেও ওনার টি-শার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে নিলাম।
.
সকালের সদ্য ওঠা সূর্যের তীব্র আলো মুখের উপর পরতেই ঘুমটা আলগা হয়ে এলো। জানালা দিয়ে আসা প্রতিদিনের যান্ত্রিক শব্দ আজকে কেন জানি তীব্র ভাবে অনুভব হতে লাগলো। গভীর ঘুমটাও ছুটে গেল তাতে। প্রচন্ড মাথা ভার অনুভব হওয়ায় চোখটাও খুলতে পেলাম না। তবুও বেশ কিছু সময় নিয়ে চোখ দু’টো খোলার চেষ্টা করলাম, বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হতে নিয়ে সময়টা দেখে নিলাম। সাতটা বাজে, খুব একটা সকাল বলে মনে হলো না। মোবাইলটা আবারও আগের জায়গায় রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম। শরীরটা কেন জানি একদমই ভালো লাগছে না। না চোখ দুটো খুলপ রাখতে পারছি, আর না পারছি শরীরের দূর্বলতা কাটাতে। চুপ করে বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে রইলাম।
.
ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলো পুরো শরীর, কানে এলো তাসফি ভাইয়ের কণ্ঠস্বর। মিটমিট করে চোখ খুলতেই ভেসে উঠলো ওনার চেহারা। একটুপর ফুপির কণ্ঠও ভেসে উঠলো। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই ফুপি ঝাপিয়ে পড়লো আমার উপর। দু’ হাতে আমাকে ধরে উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলেন,
“ঠিক আছিস তো মা? শরীর কেমন লাগছে এখন? এতটা জ্বর উঠেছে, আমাকে ডাকিস নি কেন? রূপা…. এই রূপা….”
“আম্মু…. সরো তুমি, আমাকে দেখতে দাও।”
“কি দেখবি তুই…. কি দেখবি… হ্যাঁ? খবরদার ওর কাছে আসবি না। দেখছিস? মে*রে কি অবস্থা করেছিস ওর? গালটা কেমন লালচে ধরে আছে, জ্বরে গা টা পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার।”
ফুপির কথায় সহসায় উত্তর দিলেন না উনি। একটু সময় নিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“এখন কি এসব বলার সময় আম্মু? এমনিতেই ও অসুস্থ, তার মাঝে তুমিও শুরু করলা? দেখতে দাও আমাকে। ওকে কিছু খাইয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে।”
আর কিছু বললো না ফুপি, আমি একটু ওঠার চেষ্টা করতেই তাসফি ভাইয়া এসে ধরলেন আমাকে। ফুপিকে বললেন, উনি আমাকে সামলাচ্ছে, ফুপি গিয়ে তরল কিছু বানিয়ে আনে যেন। বাধা দিলো না ফুপি। আমাকে সামলে রাখতে বলে চলে গেলেন খাবার আনার জন্য।
ফুপি রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই তাসফি ভাইয়া কিছু বলতে চাইলেন। তার আগেই আমি অস্পষ্ট সুরে বললাম ওয়াশরুমে যাবো, ছেড়ে দিতে। উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামলেন, আমি নামার জন্য একটু এগোতেই উনি একটু নিচু হয়ে ফট করে কোলে তুলে নিলেন আমাকে। দূর্বল শরীরে ছটফট করতে না পারলেও মুখ ফুটে অস্পষ্ট সুরে বলতে লাগলাম নামিয়ে দিতে। কিন্তু কোন কথায় কানে নিলেন না উনি, সোজা ওয়াশরুমে নিয়ে গেলেন আমাকে।
.
সারাদিন কিভাবে কে*টে গেল বুঝতেই পারলাম না। প্রচন্ড জ্বরের মাত্রায় শরীরের দূর্বলতা আর মাথা ব্যাথা নিয়েই কে*টে গেছে যেন। জ্বরের ঘোরে সারাটাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেও মাঝে মাঝে যখন জেগে ছিলাম তখন ঠিকই সবার কথা অনুভব করতে পেরেছি। ফুপি ও তাসফি ভাইয়া সারাদিন আমার পাশে থেকে নড়ে নি। ফুপি কাজের জন্য গেলেও তাসফি ভাইয়া এক মুহুর্তের জন্যও নড়েন নি হয়তো আমার পাশে থেকে। যতবারই চোখ মেলে তাকিয়েছি ঠিক ততবারই ওনাকে দেখতে পেয়েছি।
বিকেলের পর কিছুটা জ্বর কমলেও রাতের বেলা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেলো যেন। গায়ে মোটা কম্বল দিয়েও কেঁপে কেঁপে উঠলাম শুধু। ফুপি অনেক কষ্টে কিছুটা সুপ খাইয়ে দিলো, তারপর ওষুধটা খাইয়ে দিতে গিয়ে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। বমি করে একাকার অবস্থা হয়ে গেল। তারপরই একদম নির্জীব হয়ে গেলাম। তাসফি ভাই ও ফুপির কথা কানে এলেও কোন কথাই ঠিকঠাক ভাবে ধারণ করতে পারলাম না মস্তিষ্কে।
সারারাত একই ভাবে কেটে গেল যেন, থেকে থেকে বেশ কয়েকবার বমি হলো। আমাকে সামলাতে সামলাতে নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো ফুপি ও তাসফি ভাই। ফুপি একটু ঘুমালেও তাসফি ভাই একইভাবে পাহারা দিয়ে গেলেন আমাকে।
.
ম্যাচ ম্যাচে শরীর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতেই কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলেন তাসফি ভাই। আমাকে এক হাতে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে রূপু? উঠছিস কেন, কিছু লাগবে? লাগলে আমাকে বল, আমি এনে দিচ্ছি। ”
অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। এতটুকুতেই কতটা উত্তেজিত হয়ে গেছেন উনি, ওনার চেহারার দিকেও ঠিকভাবে তাকানো যাচ্ছে না। কি অবস্থা করেছেন নিজে এই তিন দিনে।
আজকে তিন দিন পর কিছুটা ভালো লাগছে শরীরটা। এই তিন দিনে প্রতিটা মুহুর্তে তাসফি ভাই সামলিয়েছেন আমাকে, আগলে রেখেছেন সবসময়। আমার কোন উত্তর না পেয়ে গেলাম উনি আবারও ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“রুপু! কিছু লাগবে? বল আমাকে…”
মাথা ঝাঁকালাম আমি, বোঝালাম লাগবে না কিছু। উনি কপালে হাত দিলে, দেখতে লাগলেন জ্বরটা কেমন আছে। কপালে হাত দিয়ে জ্বরের মাত্রটা হয়তো বুঝতে পারলেন না। হাত নামিয়ে গালে রাখলেন, তারপর গলায় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“শরীর কেমন লাগছে এখন? ভালো লাগছে তো?”
“হুম…. ”
“আগের থেকে ভালো লাগছে তো? মাথা ব্যাথা কমেছে?”
“হুম!”
এবারও ছোট করে জবাব দিলাম। আমার পজিটিভ উত্তর পেয়ে জোরে করে নিশ্বাস ছাড়ললেন, এবার হয়তো কিছুটা শান্ত হলেন উনি। আমি এক মনে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে, কয়েকদিনে নিজের চেহারাটাই যেন অন্যরকম বানিয়ে ফেলেছেন উনি। খাওয়া দাওয়া ঘুম সব কিছুই যেন ছেড়ে দিয়েছেন।
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলতো করে গালে হাত দিলেন। বললেন,
“কি হয়েছে? কিছু বলবা আমাকে?”
“নিজের যত্ন নেন নি কেন? চেহারার এই অবস্থা হয়েছে কেন আপনার?”
আমার কথায় হাসি ফুটে উঠলো ওনার ঠোঁটের কোণে। সহসায় কিছু বললেন না। একটু সময় নিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“আমার রুপুসোনা এভাবে পড়ে আছে, আর আমি নিজের যত্ন নিবো? এটা কিভাবে সম্ভব, বলো?”
“ভালো লাগছে না আপনাকে এভাবে দেখতে।”
এবার বেশ শব্দ করেই হেঁসে উঠলেন উনি। আমাকে আলতো করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলেন,
“তাহলে, তোমাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আমার কেমন লেগেছে, বলো? কিভাবে সহ্য করেছি আমি? একদম ভালো লাগে নি আমার, তোমাকে এভাবে দেখে, একদমই না।”
প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না আমি। ওনার বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইলাম। এই কয়েদিনে যে ফুপি ও উনি ঠিক কতটা কষ্ট করেছেন, সেটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি। ওই বাসায় জানাতে চাইলেও আমি বারণ করে দিয়েছি ফুপিকে না বলতে। গালের লালচে দাগটা দু’দিন খুব স্পর্শ ভাবেই ছিলো, যা অনায়াসে সবার নজরে পড়তো, প্রশ্ন উঠতো সেটা নিয়ে। তাই জ্বরের ব্যাপারটাও না জানাতে বলেছি। অনেক ভেবে ফুপিও আর জানায় নি। এই কয়েটাদিন আমার জন্য বেশ কষ্টও হয়েছে সবার। আগামীকাল রাতে ফুপাও বাসায় এসেছেন। সেদিন দুপুরের বিষয়টা না জানার কারণে কাউকে কিছু বলেনও নি।
তাসফি ভাইয়া হঠাৎই নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নিলেন আমাকে। গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“সরি রুপুসোনা, অনেক অনেক সরি। অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে, তাই না? অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তোমাকে এভাবে দেখে। সবকিছুর জন্য সরি! প্লিজ ক্ষমা করে দিও আমাকে।”
.
.
চলবে…..
রি।]