একতরফা ভালোবাসা পর্ব -০১

#একতরফা ভালোবাসা (পর্ব -১)
#মৌমিতা হোসেন

সন্ধ্যা হয়ে গেছে মাগরিবের আযান দিচ্ছে অথচ তুহিন এখনো ঘুমাচ্ছে। আজ ভার্সিটি শেষ করে স্টুডেন্ট পড়িয়ে বাসায় এসেই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে তুহিন। তাই আজ ওর ঘুম যেনো ভাঙার নামই নিচ্ছেনা। এমন অবস্থায় মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙতেই দেখে সামনে বড় ভাই(তারেক) আর মা (সাবেরা বেগম) বসে আছে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে জটিল কোন বিষয়ে কথা বলবে। তুহিন মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে মা বলে,”তুহিন বাবা আমার একটা কথা ছিলো।”

হাই তুলতে তুলতে তুহিন বলে, ” কি বলবে বলো মা। জটিল কিছু?কোন সমস্যা?”

“না না তেমন কিছু না।”

“তাহলে বলে ফেলো। তোমাকে দেখেতো আমার টেনশন হচ্ছে।”

তারেক এতোক্ষণ চুপচাপ বসে মায়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলো। মা কিছু বলতে যাবে অমনি তারেক নিজেই বলে উঠলো,”শোন তুহিন আমার চাকরি হয়েছে। আগামী সপ্তাহে জয়েন করতে হবে। ইনডাস্ট্রিয়াল জব। তাই ব্যস্ত থাকত হবে সব সময়।”

তুহিন একটু বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারন ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই দেখছে মা আর ভাই রহস্য করছে। তাই বিরক্তি নিয়েই বলে,”ভাই তোমরা এতো ভনিতা না করে আসোল কথাটা বলোতো। কি হয়েছে?”

সাবেরা বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই তারেক বলে,”আরে তেমন কিছুই না। ঐ যে আমাদের এলাকার শিউলি অছেনা? জানিস তো ওকে আমি পড়াই। ওকে তো আমি আর পড়াতে পারবোনা। সময় পাবোনা। তাই ভাবছি তুই যদি একটু ওকে পড়া দেখিয়ে দিতি। তাহলে খুব ভালো হতো রে।”

কথাটা শুনে তুহিন বেশ বিরক্ত হয়। তুহিন এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে তুহিন চতুর্থ। ভাই-বোনদের মধ্যে তুহিন একটু অন্য রকম। শান্ত, ভদ্র, পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। অহেতুক আড্ডা দেয়া, সিগারেট খাওয়া থেকে শুরু করে কোন রকম বাজে অভ্যাস তুহিনের নেই। সারাক্ষন পড়াশোনা নিয়েই থাকে। তবে খুব রাগী। উল্টাপাল্টা কিছু দেখলে খুব রেগে যায়। রেগে নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখে। বাসায় কারো সাথে কথা বলেনা। কয়েকদিন পর অবশ্য আবার ঠিক হয়ে যায়। তুহিন দেখতেও বেশ সুদর্শন। লম্বা, ফর্সা, চোখে চশমা এক কথায় যে কোন কেউ একবার দেখলে আর একটু কথা বললেই তুহিনের প্রেমে পড়ে যাবে।

অনার্সে ভর্তির পর তুহিন ওদের বাসার সামনের দুটো রুম নিয়ে একটি কোচিং সেন্টার খোলে। তুহিন একতলা টিনসেড বাসায় থাকে। এটা ওদের নিজেদের বাড়ি। অনেক আগের বানানো। মাঝখানে করিডোর আর দুই পাশে পাঁচটা করে মোট দশটা রুম। আর এখানেই বাবার অনুমতি নিয়ে তুহিন কোচিং সেন্টার খোলে। তুহিন আর ওর আরও দুই বন্ধু মিলে বাচ্চাদের পড়ায়। পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চাদের পড়ানোর কাজটাও তুহিন খুব দায়িত্বের সাথেই করা শুরু করে। আর খুব অল্প দিনেই এলাকায় তুহিনের নাম ডাক ছড়িয়ে পরে। কারন তুহিনের পড়া বোঝানোর ক্ষমতা ছিলো দারুন। এক কথায় সকল গুনের জন্য এলাকায় সবাই তুহিনকে খুব পছন্দ করে।

তুহিনের বাড়ির তিনটি বাড়ি পরেই থাকে শিউলি। শিউলি মাত্র কৈশোরে পা দিয়েছে। এবার অষ্টম শ্রেনীতে পড়ছে। চার ভাই বোনের মধ্যে শিউলি সবার ছোট। একটু খাটো হলেও শিউলি দেখতে দারুন সুন্দরী। গায়ের রং দুধে আলতা,চুল কোমর ছাড়িয়েছে। শান্ত, ভদ্র, চুপচাপ একটা মেয়ে। বেশী সুন্দরী হওয়ায় বোরখা পরেই স্কুলে যাতায়াত করে। তবে ওর ভাইরা সবাই মোটামুটি বখাটে টাইপের। পড়াশোনা রেখে আড্ডা দেয়া, ঘুরে বেড়ানো, মেয়েদের টিজ করা সহ আরো বিভিন্ন খারাপ কাজে সারাক্ষন ব্যস্ত থাকে। আর এসব কারনে তুহিন ওদের পরিবারের সাথে মেশেনা বা ওদের তেমন একটা পছন্দ করেনা। সব সময়ই ওদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আর এজন্যই ওকে পড়ানোর কথা শোনা মাত্র তুহিন খুব বিরক্ত হয়।

যাই হোক ভাইয়ের কথা শোনা মাত্রই তুহিন বলে,”না ভাই আমি ওকে পড়াতে পারবোনা। জানোই তো ওদের পরিবারকে আমার পছন্দ না। তাই দয়া করে আমাকে এই অনুরোধটা করোনা।”

মা সাবেরা বেগম এই ধারনাই করছিলো যে তুহিন পড়াতে রাজি হবেনা। ছোটবেলা থেকে একই এলাকায় বড় হলেও তুহিন কখনোই শিউলিদের পছন্দ করতো না। কিন্তু সাবেরা বেগম শিউলির মায়ের কথাই বা ফেলে দেয় কি করে! তিনি খুব করে অনুরোধ করেছে যে তারেক না পড়াতে পারলেও তুহিন যেনো শিউলিকে একটু পড়ায়। এখন তুহিন রাজি না হওয়ায় কীভাবে ছেলেকে রাজি করাবে সেটা নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। কারন বেশি জোর করলে দেখা যাবে তুহিন রেগে নিজেকে গৃহবন্দি করে রেখেছে। সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই ঠান্ডা মাথায় রাজি করাতে হবে।

মায়ের ভাবনার মাঝেই তারেক বলে,”রাজি হয়ে যা ভাই। ঠিক আছে নাহয় এ বছরটাই শুধু দেখিয়ে দে। নাইন থেকে নাহয় বলে রাখবো যে তুই আর পড়াতে পারবিনা। তখন ওরা অন্য টিচার রাখবে। এই মাঝ পথে ছেড়ে দেয়া কেমন লাগে বল। আমি পারলে আর তোকে বলতাম না। সবাই তোকে খুব ভালো জানে। ওর মা খুব করে অনুরোধ করছে নাহলে বলতাম না। প্লিজ ভাই আমার একটু পড়া।”

তারেক এর সাথে সাবেরা বেগম নিজেও তাল মেলান। আর বলেন,”হ্যা বাবা রাজি হয়ে যা। এই কয়টা মাস একটু কষ্ট করে পড়া।”

ভাইয়ের কথা শুনে তুহিন ভাবে ঠিকই তো একই এলাকায় থাকে ওরা। ওকে সবাই খুব ভালো জানে। একটু পড়াতে আর এমন কি সমস্যা। তাই তুহিন ভাই আর মায়ের কথা ফেলতে পারে না। তবে শর্ত দেয়। তুহিন বলে, “আমি পড়ালেও কিন্তু বাসায় গিয়ে পড়াতে পারবোনা। আমার কোচিং এ এসে পড়তে হবে।”

তুহিনের কথা শুনে মা,ভাই দুজন খুব খুশি হয়ে বলে,”ঠিক আছে তুই যেমন চাইবি তেমনটাই হবে। এই বছরটা একটু কষ্ট করে পড়া তাহলেই হবে।”

মা আর ভাইয়ের কথামতো তুহিন শিউলিকে পড়ানো শুরু করে। বছরের ছয় মাস শেষে পড়া শুরু করায় শিউলির পড়া বুঝতে বেশ সমস্যা হয়। তাছাড়া একটু লাজুক হওয়ায় ক্লাসে শিউলি খুব কম কথা বলে। এদিকে পরীক্ষাও সামনে। তাই তুহিন ঠিক করে শিউলিকে দুই তিন দিন একটু বেশি পড়াবে।যাতে শিউলি পড়া ভালো ভাবে বুঝতে পারে। কারন পড়াশোনার ব্যাপারে তুহিন সব সময় খুব সিরিয়াস। আর এই কদিনে দেখলো ভাইয়েরা বখাটে হলেও শিউলি বেশ ভদ্র মেয়ে। প্রায় মাস খানেক ধরে ওর কাছে পড়ছে অথচ এতো দিনে একবারও তুহিনের অবাধ্য হয়নি বা তুহিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলেনি। এতে তুহিন বেশ খুশি হয়।

এদিকে কোচিং এর বেশিরভাগ মেয়েই সরাসরি বা আড়ালে তুহিনকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়‌। আসলে তুহিন ছেলেটাই এমন যে ওকে না পছন্দ করে উপায় নেই। তবে তুহিনের এসব একদম পছন্দ ছিলো না। তাই খুব কড়াভাবে ওদের বকে আর এমন আচরন আবার করলে কোচিং থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়। এসবের মাঝেই শিউলিও কীভাবে যেনো তুহিনকে ভালোবেসে ফেলে। কৈশোরে প্রথম কাউকে ভালো লাগার অনুভূতিটাই আলাদা। তবে শিউলি তুহিনকে এসবের কিছু বুঝতে দেয়নি বা কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলেওনি।

এভাবেই দিন কাটতে থাকে। তুহিন ছোট বোনের মতোই শিউলিকে পড়াতে থাকে। বছর শেষ করে শিউলি নাইনে ওঠে। এবার তুহিন জানিয়ে দেয় যে, ও এখন আর শিউলিকে পড়াতে পারবেনা। শিউলি এটা শুনে খুব মন খারাপ করে। কিন্তু কিছুই করার থাকেনা। শিউলির জন্য বাসায় ওর মা অন্য টিচার রেখে দেয়। কারন কোচিং এ সবার সাথে পড়া বুঝতে ওর বেশ সমস্যা হচ্ছিলো। তবে মাঝে মাঝে যখনই শিউলি পড়া না বোঝে তখনই বই নিয়ে দ্রুত তুহিনের কাছে চলে আসে। আর এই পড়া বোঝাটা ছিলো নেহায়েত একটা অজুহাত। শিউলি আসলে তুহিনকে মন ভরে দেখার জন্যই নানা কারন দেখিয়ে তুহিনের কাছে পড়তে আসতে থাকে। আর এভাবেই দিন কাটতে থাকে।

_______

দিন যায়,মাস যায়,বছর ঘুরে নতুন বছর আসে। এখন তুহিন মাস্টার্সে পড়ে। ওর কোচিং সেন্টারের সুনাম দিন দিন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে এলাকায় সবার কাছে এখন তুহিন এক নামে পরিচিত। সবাই খুব পছন্দ করে ওকে। কিন্তু আজকাল একটা বিষয় নিয়ে তুহিন একটু চিন্তায় পড়ে যায়। সেটা হলো ও প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে নিজের রুমের সামনে ফুল, চিঠি,কলম,বই সহ বিভিন্ন রকম গিফ্ট পড়ে থাকতে দেখে। কিন্তু কে যে এতো সব গিফট দিচ্ছে সেটা বুঝতে পারেনা। তুহিন সব গিফট নিয়ে ড্রয়ারে রেখে দেয়। মনে মনে ভাবে যে, “কে এই পাগলি যে প্রতিদিন কিছু না কিছু দরজার কাছে রেখে যায়?” মা, ভাইকে অনেক বার জিজ্ঞেস করলেও কোন সদুত্তর পায়না। কারন তারাও সঠিক জানেনা যে কাজটা কে করছে। অনেক বছর ধরে এই এলাকায় থাকার জন্য আর একতলা বাড়ি হওয়ায় ওদের বাসার মেইন গেট সব সময় লাগানো থাকতো না। তাছাড়া অনেক ছাত্র ছাত্রি আসতো বাসায়। তাই কে এই কাজ করছে সেটা বোঝারও কোন উপায় ছিলোনা। তুহিন অবশ্য জানে যে অনেক ছাত্রী তাকে পছন্দ করে। মনে মনে ভাবে, হয়ত তাদের মধ্যেই কেউ এই কাজ করছে।

এদিকে শিউলিও দেখতে দেখতে বড় হয়ে যায়। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এখন কলেজে পড়ছে। সৌন্দর্য এখন বহুগুন বেড়ে গেছে শিউলির। এই বয়সেই বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছে। শিউলির বাবা -মা অবশ্য এটা সেটা বলে কাটিয়ে দিচ্ছে। কারন তারা চায় শিউলিকে আরো পরে বিয়ে দিতে। তারা চায় মেয়েকে আরেকটু পড়াশোনা করাবে। তারপর নাহয় বিয়ে দেবে। আর শিউলিও এই সুযোগটাকে কাজে লাগায়। কারন ওর মনের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়েই রয়েছে এখন তুহিনের অবস্থান।

এজন্য শিউলি আজকাল পড়া বোঝার নাম করে মাঝে মাঝেই তুহিনের বাসায় যায়। উদ্দেশ্য একটাই তুহিনকে এক পলক দেখবে। এই চার বছরে একবারও সাহস করে তুহিনকে মনের কথা জানাতে পারেনি শিউলি। কবে জানাবে সেটাও ও জানে না। তবে না জানালেও তুহিন কে এক পলক দেখার লোভ ও সামলাতে পারেনা। তাই কারনে অকারণে সুযোগ পেলেই ও তুহিনের বাসায় পা রাখে। এতে অবশ্য সাবেরা বেগমও কিছু মনে করেনা। কারন ছোট বেলা থেকেই ওকে দেখে আসছে। আর এতো ভালো ব্যবহার এর জন্য তিনি শিউলিকে একটু বেশি পছন্দ করেন।

দেখতে দেখতে তুহিনের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়। পরীক্ষা শেষ হবার পরপরেই তুহিন বেশ ভালো একটা চাকরি পায়। তবে অফিস হলো নারায়নগঞ্জ। এই কারণে তুহিনের এতো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। কারন এতো দুরে অফিস করে একসাথে দুটো সামলানো ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। আর অফিসেও থাকার ব্যবস্থা আছে। তাই ঠিক করে যে ওখানে থেকেই অফিস করবে।

এদিকে তারেক এরও বিয়ে ঠিক হয়। আর বাড়িটাও ডেভেলপারকে দিয়ে দেয়। যার কারনে তুহিনরা বাসা চেঞ্জ করে। এতে করে শিউলি মনে খুব কষ্ট পায়। কারন শিউলি বিভিন্ন কাজের বাহানায় প্রায়ই তুহিনের বাসায় আসতো। তুহিনরা চলে গেলে তো বিভিন্ন বাহানায় শিউলি আর তুহিনের বাসায় আসতে পারবে না আর তুহিন কে দেখতেও পাবেনা। কিন্তু এক্ষেত্রে শিউলির কিছুই করার থাকেনা। তাই বিষয়টা মেনে নিতে বাধ্য হয়।

শিউলি অনেক বার ঠিক করে যে তুহিনকে মনের সব কথা বলবে। কিন্তু তুহিন সামনে এলে শিউলি সব কথা ভুলে যায়। দরকারি কথা ছাড়া কিছুই বলতে পারেনা। আর যেহেতু তুহিন এর মনে শিউলির জন্য কোন অনুভূতি নেই তাই ওর মনে কি চলছে সেটাও তুহিনের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়না।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here