এক সমুদ্র প্রেম পর্ব -৩৮

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩৮)

কতগুলো আশ্চর্যান্বিত, বিহ্বল চোখ একইসাথে আ*ছড়ে পরল ইকবালের লম্বাটে মুখের ওপর । তার হঠাৎ চিৎকারে হকচকিয়ে গেল সকলে। তটস্থ নজর বিক্ষিপ্তভাবে নি*ক্ষেপ হলো । দশাধিক তীব্র শাণিত দৃষ্টি দেখে ঘাব*ড়ে গেল ইকবাল। একটু আগের ফুলকে ওঠা রা*গটা টুপ করে মিইয়ে এলো। নার্ভাসনেসে ঘাড় অবধি মাটির নীচে গেড়ে গিয়েছে যেন। সে ভীত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকায়। সবার অদ্ভূত চাউনী মস্তিষ্ক শূন্য,শুকনো বানিয়ে দেয়। ভোকাল কর্ডের সমস্ত জোর থিতিয়ে আসে মুহুর্তে।
পুষ্প-পিউ এক সাথে ঢোক গি*লছে। আগত পরিস্থিতি ভেবে তাদের রুদ্ধ কণ্ঠনালী কাঠ-কাঠ।

‘ কী সমস্যা?’
ধূসরের মুখ-চোখের অন্য রকম গাম্ভীর্য, গুমোট স্বরের প্রশ্নে ভী*তশশস্ত্র ইকবাল। পেটের মুধ্যে গুড়গুড় করা কথাগুলোর ঘুরপাক খাওয়া তৎক্ষনাৎ থেমে গেল। হাতের তালু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে, জোর করে হেসে বলল,
‘ না মানে,সমস্যা ওই,এত কম সময়ের মধ্যে বিয়ের আয়োজন কীভাবে করবি? ‘
ধূসর বিরক্ত হলো বোধ হয়। তার মসৃন কপাল সবেগে কুঁচকে আসে।

আমজাদের চওড়া নাকের ডগা ফেঁপে উঠল। চুপ থাকার পণে পরাজিত হলেন। ইকবালের আচরণে মেজাজ চটে গেল। প্রচন্ড থমথমে গলায় বললেন,
‘ সেসব ভাবার জন্য আমরা আছি। তুমি বোসো।’
‘তুমি বোসো’ টুকু ধম*কের মত শোনায়। ইকবাল সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে বসে পরল জায়গায়।

পুষ্প এতক্ষণে শ্বাস ফেলল। রোবটের ন্যায় শরীরটা ছেড়ে দিয়ে শান্ত হলো। পিউ ‘চ’ সূচক শব্দ করল মুখে। টান টান উত্তেজনার মুহুর্তটা এক ধা*ক্কায় মাটি হওয়ায় সে খুশি হতে পারল না। এই ফাঁকে ইকবাল ভাই সত্যিটা বললেই পারতেন। উফ! তারপর পুষ্পর মুঠোয় থাকা স্বীয় হাতখানা ফেরত আনতে চাইল। এই মেয়ে চিন্তার তোপে পাঁচটা নখই বসিয়ে দিয়েছে। হাল্কা পাতলা জ্বল*ছেও এখন। অথচ পুষ্প দিলো না। সে টান বসালে আরো শক্ত করে চে*পে রাখল। অন্য হাত দিয়ে ওড়না উঠিয়ে ঘাম মুছল কপালের। ঠোঁট গোল করে দম ছাড়ল পিউ। তাদের সিকদার বাড়ি আর বাড়ি নেই। সার্কাস হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন একটা না একটা কাহিনী লেগেই থাকে। রমরমা ঘটনা ঘটে। শীর্ষবিন্দু কখনও ধূসর,কখনও সাদিফ,কখনও পুষ্প।
আর এই দারূন,অনবদ্য,আর অসাধারন ঘটনা গুলোর সময়েই তার টেস্ট পরীক্ষার আগমন। এসব রেখে কারো মন বসে টেবিলে? এখন যদি রেজাল্ট খা*রাপ হয়,তার কী দোষ?
পিউয়ের সাথে সাথে আরেকটা চেহারায়ও দেখা গেল হতাশার ছাপ। সন্তর্পনে বিরক্তি প্রকাশ করল সে। ইকবাল দাঁড়িয়ে যাওয়ায় যে আশার আলোয় মুখস্রী জ্ব*লে উঠেছিল নিমিষে নিভে গেল তা।

‘ তাহলে এখন কী করব ভাইজান? বিয়ের জন্য কেনাকাটা শুরু করব?’
পুষ্প বিদ্যুৎ বেগে ধূসরের দিক তাকায়। হাজার আকুতি সেখানে। ভরসায় বিভ্রান্তি। ভাইয়াতো বলেছিলেন,উনি কিছু করবেন,বিয়ে আটকাবেন। তবে চুপ করে আছেন কেন?
জবার কথায় আমজাদ স্বায় দিলেন। বললেন,
‘ সময় কম যখন,সব কিছু তাড়াতাড়ি করলেই ভালো হবে।’

দূশ্চিন্তায়, দূর্ভাবনায় ইকবালের হার্টবিট বন্ধ হবার উপক্রম। ধূসর আর সাদিফের মাঝে বসে সে যেন হাঁপানি রোগী। শ্বাস পরছেনা। নড়াচড়ার বিরাট জায়গা পেয়েও এক চুল সরার জো নেই। গতর টা লোহায় পরিনত হয়েছে। হাত পা কেমন অসাড় হয়ে আসছে।
বসার ঘরে এত মানুষের মাঝে সম্মুখে দাঁড়ানো পুষ্পর দিক তাকানোও ক*ঠিন। আবার তারই সামনে চলছে ওর বিয়ের আলাপ। এইভাবে, একইসাথে এতগুলো নি*ষ্ঠুর পরীক্ষায় কেন বসল সে?
এই পরীক্ষায় পাশ মার্ক আদৌ আসবে?
তার চিন্তার মাঝে ধূসরের আওয়াজ কানে লাগে। সে সাদিফকে জিজ্ঞেস করল,
‘ বিয়েতে সময় লাগে,অতদিনের ছুটি পারবি ম্যানেজ কর‍তে?’
সুমনা তাল মেলালেন,
‘ হ্যাঁ অনেকদিই লাগবে। আমরা কিন্তু সঙ্গীত ও করব আপা। সিকদার বাড়ির প্রথম ছেলে মেয়ের বিয়ে,মনে রাখার মতোন না হলে হয়।’
বড়দের ঠোঁটের কোনায় মৃদূ হাসি দেখা গেল।
সাদিফ বিলম্বহীন, নিরস উত্তর দিলো,
‘ চেষ্টা করব।’
ইকবাল দাঁত কিড়*মিড় করল। দুপাশের চোয়াল মটমট করে ওঠে। চোখের পাশের পেশী গুলো অভ*ঙ্গুর।
অদৃশ্য ভাবে সাদিফের গালে এলোপাথাড়ি থাপ্প*ড় বসাল সে। ওর ভদ্র কা*টছাট দেয়া চুল গুলো খা*মচে ধরে বলল,
‘চেষ্টা করব? অন্যের প্রেমিকাকে বিয়ে করার এত শখ? অফিস থেকে ছুটি নিবি? নেয়াচ্ছি। ‘
তারপর সাদিফের মাথাটা সেন্টার টেবিলে ঠু*কে দিলো ইকবাল। সাদিফ আআ বলে চিৎকার করতেই ধ্যান ছুটে গেল তার। ভড়কে গেল। নিজের কল্পনায় নিজেরই ঘাম ছুটেছে। সে,সতর্ক চোখা চাউনীতে একবার পাশে তাকায়। সাদিফ সুস্থ সবলভাবে বসে আছে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তে আক্ষেপ হলো। কল্পনাটা সত্যি হলেই ভালো হোতো না? তার হাতের পঞ্চ অঙ্গুলি শিরশির করছে। ইচ্ছে করছে চড়ি*য়ে সাদিফকে কানা বানিয়ে দিতে। যাতে এই ছেলের বিয়ের আগ্রহ,ইচ্ছে,রুচি সব আজন্ম মিটে যায়। বিয়ের’ ব ‘শুনলেও লেজ তুলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পালায়।

‘ তাহলে এই শুক্রবার আংটিবদল করলে কেমন হয়?’
ইকবালের বুক ধ্বক করে উঠল। আজ সোমবার,এর মানে তো আর চারদিন। তার পুষ্পরানির অনামিকায় আংটি পরাবে অন্য কেউ? দলিল করে নিয়ে যাবে ওরই সামনে থেকে? ইকবালের মানস্পটে সত্যিই সেই দৃশ্য হানা দিলো। ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে, সাদিফ পুষ্পর আঙুলে আংটি পরাচ্ছে। সে আবার খুইয়ে বসল ধ্যান-জ্ঞান। একইরকম ছিটকে দাঁড়াল ফের। চেঁচিয়ে বলল,
‘ না! কী আবোল তাবোল বলছেন!’

মিনা বেগম ভ্যাবাচেকা খেলেন। হতভম্ব হয়ে বললেন,
‘ কেন বাবা, কী বললাম?’
ধূসর মহা বির*ক্ত হয়ে হাত দিয়ে থুত্নী ঘষল। ইকবাল পুনরায় মিইয়ে আসে। সে দাঁড়াচ্ছে যতবার,পুষ্পর হৃদপিণ্ড ছ*ল্কে উঠছে ততবার।
সে খিটমিট করে বলল ‘ এই লোকের কৃমি রোগে ধরেছে মনে হয়। বারবার চিংড়ি মাছের মত লাফাচ্ছে দ্যাখ।’
পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইকবাল ভাই যে একটা জ্ব*লন্ত উনুনের ওপর বসে আছেন, দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে সে। ওইজন্যেইতো বারবার লাফিয়ে উঠছেন। তারও বা কী দোষ!
আচ্ছা,আজ যদি ধূসর ভাইয়ের সামনে তার বিয়ের আলাপ হতো,তিনিও কি এমন করতেন? পিউ ধূসরের দিক তাকাল। তার তিঁতিবির*ক্ত মুখবিবরটাও কী অতুলনীয় দেখতে!
যাকে ভালো লাগে,তার সবকিছু ভালো লাগে তাইনা? ধূসর ভাইয়ের দৃষ্টি, কণ্ঠস্বর,ছাঁয়া টুকুও তার অন্তস্থলে ঝুমঝুম বর্ষা নামায়। হৃদয়ে ছড়ায় সূর্যকিরণ, রোমাঞ্চিত করে মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন। এই অপার,সীমাশূন্য মুগ্ধতা কোথায় রাখবে সে? বক্ষস্থলে যে আর জায়গা হচ্ছেনা! আস্ত ধূসর ভাইটাকে রেখেই সে শান্তিতে বসতে পারেনা,খেতে পারেনা,ঘুমোতে পারেনা।
এই মানুষটাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে,ইশ! এ ভাবাও পাপ।
কাউকে দরকার নেই,সে নিজেই নিজের প্রেম নিয়ে যথেষ্ট পসেসিভ। প্রেমের আ*গুনে স্বেচ্ছায় ঝাঁ*পিয়ে পড়েছে যে। অন্তকরনের প্রণয় বেড়ি,তাকে অষ্টপ্রহর আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখছে। এই প্রেম আটকানোর সাহস আছে কারো? এ যে অপ্রতিরোধ্য,দুর্নিবার, বেপরোয়া।

আপুওতো প্রেম করেছে। তাহলে
কেন যে চুপ করে আছে ও ! ধূসর ভাইয়ের দিক হা করে না থেকে, নিজেওতো কিছু বলতে পারে।
প্রেমে পড়লে চুপ থাকতে নেই। চুপ থাকাকে মানুষ দূর্বলতা ভেবে নেয়। প্রেম হলো শক্তিশালী বস্তু। বিড়াল প্রেমে পড়ে বা*ঘ হতে না পারলে প্রেমের সফলতা কোথায়?

ইকবাল আরেকবার সবার দিক তাকাল। সজাগ মস্তিষ্কে, দ্বিতীয়বার মুখ বন্ধ হয়ে এলো। কাষ্ঠ হেসে বলল,
‘ না আসলে আন্টি,বলছিলাম যে একটু বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছেনা? ‘

আমজাদ মেজাজী কণ্ঠে শুধালেন ‘ কীসের তাড়াহুড়ো? ‘
সে মিনমিন করে বলল,
‘ ইয়ে,ওরা তো ছোটবেলা থেকে ভাইবোন ভেবে এসেছে নিজেদের,হুট করে বিয়ে দিলে ওরা কীভাবে নেবে? ওদেরও সময় দেয়া উচিত।’

আমজাদ সিকদার রে*গে গেলেন।
তার চোখের বালি রাজনীতি। সেখানে এক হাঁটুর বয়সী রাজনৈতিক নেতার লেকচার তিনি গ্রহন করবেন? তাও আবার যে ছেলের জন্য তার বাড়ির একটা স্বর্নের টুকরো বিপথে গিয়েছে! আজমল সাফাই দেয়ার ভঙিতে বললেন,

‘ আমরাতো ওদের মতামত নিয়ে….’
পথিমধ্যে হাত উঁচিয়ে থামালেন আমজাদ। সোজাসুজি ধম*কে বললেন,
‘ এই ছেলে, এসব আমাদের ব্যাপার। তুমি এর মধ্যে ঢুকছো কেন?’

আফতাব আস্তে করে বললেন ‘ আহ ভাইজান! শান্ত হন।’
‘ কীসের শান্ত হব? ও কেন বারবার কথার মধ্যে বা হাত দিচ্ছে? একটা পারিবারিক আলোচনার মধ্যে এভাবে ঢুকতে নেই, এই নূন্যতম ম্যার্নাসটুকুও কি কাউকে শিখিয়ে দেয়া যায়?’

ইকবালের মুখে ঘোর আমাবস্যা নামল। মাথা নত করল অপরাধির ন্যায়। পুষ্পর হৃদয় নিংড়ে কা*ন্না পায়। ইকবালের ভেতরকার অস্থিরতা তার মতো করে কেউ বুঝবেনা। কারোর সাধ্যই নেই বোঝার। ছেলেটা তাকে কতটা ভালোবাসে,সে অক্ষরে অক্ষরে জানে।
পুষ্পর চোখ ফেঁটে জল গড়াল। পিউয়ের বুক হুহু করে উঠল দেখে। নরম হাতে মুছিয়ে দিলো বোনের অক্ষিদ্বয়। সবার কান এড়িয়ে আশ্বাস দিলো,
‘ কাঁদিস না আপু, ধূসর ভাই আছেন তো।’

আমজাদ মোক্ষম সুযোগ পেলেন যেন। ভেতরের পোষা রা*গ উগড়ে দিতে বললেন,
‘ আমি বুঝলাম না ধূসর, তুমি তোমার বন্ধুকে আমাদের পারিবারিক ব্যপারের মধ্যে কেন এনেছো? ও একটা কথাও বলতে দিচ্ছেনা কাউকে। ঘরের মধ্যে অহেতুক অভদ্রর মত চিৎ*কার,চেঁচামেচি করছে।’

ধূসর জবাব দেওয়ার আগেই ইকবাল বলে বসল,
‘ কারণ ছাড়া আমি এমন করছিনা আঙ্কেল। আমি নিশ্চিত, আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেও এরকমই করবে।’
কণ্ঠস্বর ভে*ঙে এলো তার। আমজাদ ভ্রুঁ বেঁকে বললেন,
‘ ভণিতা না করে ঝেড়ে কাশো। এত সময় নেই হাতে।’
ইকবাল অস্থির ভঙিতে আই-ঢাই করল। হা করে কথা বলতে গিয়ে, আবার ঠোঁট চে*পে ধরল। অসহায় চোখে একবার তাকাল ধূসরের দিকে। ধূসরের কপালে ভাঁজ। চোখ দুটো সরু হয়ে বসে। ইকবালের সেই দৃষ্টি সদর্পে শিথিল হয়। ঢোক গেলে সে। স্কুল জীবন থেকে, একে অপরের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত,এক এক করে ভেসে উঠল চক্ষুপটে।
থেমে গেল সে। প্রযত্নে গি*লে নিলো সব কথা। সবাই নিশ্চয়ই ওকে দোষ দেবে। বলবে, জেনে-শুনে বন্ধুর বোনের সাথে প্রেম করে, এখন কেন এত নাটক? কিন্তু কাকে বোঝাবে ও, সে বন্ধুর বোন কে ভালোবাসেনি। যাকে ভালোবাসল, দূর্ভাগ্যক্রমে সেই হয়ে বসল তার প্রিয় বন্ধুর সহোদরা। কত চেষ্টাই তো করেছিল দূরে থাকার! মনের কাছে হার মেনেছে শেষমেষ। পারেনি অনুভূতিদের সংবরণ করতে। পুষ্পর প্রেম দুপায়ে ঠেলে দেয়ার মত দুঃসাহসী,নি*র্মম হতে বিফল সে।
আফসোস! যদি পারতো! আজ এই দোটানা,দ্বিধা*দ্বন্দ্বে পরে মস্তিষ্ক ছি*ড়ে যেত না। বন্ধুত্বের দোহাইটা গলায় কা*টার মতোন বিঁধতো না। ধূসর যখন শুনবে এসব, ওকে ঘৃ*না করব নিশ্চয়ই। ও কি ত্যাগ করবে তার মত বেঈ*মানের সঙ্গ?
ভেবেই আঁ*তকে ওঠে ইকবাল। ভ*য়ডরে শরীর বিবশ লাগে। ধূসরের মত বন্ধু তার জীবনে
আশীর্বাদ! খুব ভাগ্য করলে এমন বন্ধু পাওয়া যায়৷ এত সুপ্রসন্ন নিয়তিতে যাকে পেয়েছে তাকে হারাবে ভাবলেই অন্তঃপটে চিনচিনে ব্য*থা হয়৷ বুকের ভেতর দলা পাঁকানো অপরাধ*বোধ তা*ণ্ডব করে,উল্লাসে মাতে। অনুশোচনা থেকে, লুকিয়ে লুকিয়ে বাঁচার ক্লান্তিটা হুহু করে বাড়ল৷ কেমন দৈত্যের ন্যায় চে*পে ধরল বক্ষগহ্বর। সে কাতর চোখে একবার পুষ্পকে দেখল, একবার ধূসরকে। কী করবে,কী বলবে অব্যবস্থ,দ্বিধাগ্রস্ত সে।

আজমল সুন্দর,শান্ত গলায় শুধালেন,
‘ তুমি কি কিছু বলতে চাও ইকবাল?’

চটক কা*টল তার। সম্বিৎ পেয়ে বলল ‘ হু? ‘
তারপর দুপাশে মাথা নেড়ে বোঝাল ‘ না।’
আফতাব বললেন
‘ তাহলে বোসো বাবা, বাকী কথা শেষ করে নেই। ‘

ইকবাল নিরুত্তর। সে কী আদৌ এক দণ্ড শান্তিতে বসতে পারছে? তার ব্যকুল,ব্যগ্র,ধড়*ফড়ে বুক একটুখানিও স্বস্তি দিচ্ছে না।

আমজাদ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ সময় ন*ষ্ট করতে ওস্তাদ একেকজন। নিজেদের মত ইউজলেস মনে করে। ‘

ধূসরের চিবুক শ*ক্ত হয়। চোখ বুজে আবার খোলে। অথচ বিন্দুমাত্র অপমা*নিত বোধ করল না ইকবাল। এর থেকে বড় জ্বা*লায় বুক পুড়*ছে তার। একদিকে ভালোবাসা, অন্যদিকে বন্ধুত্ব, দুইয়ের তাপে,মধ্যিখানে কয়লা হচ্ছে সে।

ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাগ্যের ওপর সবটা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তার পরা*স্ত,ব্যর্থ চেহারা দেখে পুষ্পর কা*ন্না বাড়ল। কেউ যাতে বুঝতে না পারে, ঠোঁট চে*পে শব্দ আটকাল।
সাদিফ মলিন মুখে দেখল সেই কা*ন্না। চোখ নামিয়ে নিলো পরপর। পরিতাপে দগ্ধ হয়ে, মনে মনে বলল,
‘ আমায় ক্ষমা করিস পুষ্প। কিচ্ছু করতে পারলাম না তোর জন্য ।’

ইকবাল ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখে আমজাদ খ্যাক করে উঠলেন, ‘ এই ছেলে! কিছু না বললে বোসছো না কেন?’
সে চকিত হয়। নড়ে ওঠে। মিনা বললেন,
‘ আহা এমন করছেন কেন? ছেলে মানুষ! তাছাড়া ওতো আমাদের অতিথি।’

‘ অতিথি তো চুপচাপ বসুক। এরকম ঝা*মেলা করছে কেন? সমস্যাটা কী?’
‘ সমস্যাটা আমি বলছি….’
ধূসর উঠে দাঁড়াল। ওমনি মেরুদণ্ড সোজা করে ফেলল পিউ। মুখে ফুটল উদ্বীগ্নতা, উত্তেজনা।
সবার চোখ যখন তার দিকে আমজাদ কপাল কুঁচকে শুধালেন,
‘ তুমি আবার কী বলবে?’

ইকবাল সন্দিগ্ধ। কী বলবে ধূসর?
পুষ্পর কা*ন্না শেষ। তার চিত্ত আকুল। হার্টবিট জোড়াল।
ধূসর সোজাসুজি ইকবালের চোখের দিকে চাইল। কোনও রকম ভণিতা ছাড়াই ঘোষণা করল,

‘ ইকবাল আর পুষ্প একে অন্যকে পছন্দ করে। ওরা বিয়ে করতে চায়।’

পিলে চমকে উঠল ইকবালের। ঝুলে গেল চোয়াল। বিরাট বজ্রপাত ছাদ ভে*ঙে যেন আছ*ড়ে পরল মেঝেতে।
ধূসরের এই একটা কথা কিছু সময়ের জন্য সময়টাকে তুষার খণ্ডের ন্যায় জমিয়ে দেয়। ঠোঁট নির্বাক,টু শব্দ হলো না কারো। ইকবালের প্রাণ বুঝি থমকে দাঁড়িয়েছে। চোখেমুখে প্রগাঢ় অবিশ্বাস। ধূসর কী করে জানল?

বিস্ময়ের এই ধা*ক্কা সামলাতে সময় লাগল সবার। হুশে ফিরতেই সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন তারা। বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে রইল একেকজন। শুধুমাত্র হেলদোল দেখাল না সাদিফ। সে একইরকম নিস্পৃহ বসে। তবে অবাক হয়েছে। ধূসর এসব জানে,সে জানতোনা। পরপর ঠোঁটে ভিড়ল রহস্যময় হাসি। সেই হাসি অতিদ্রুত মুছেও গেল আবার।
আমজাদ সিকদার নিস্তব্ধ ছিলেন। নিজের কানকেই ভরসা হলোনা। কেমন আর্ত*চিৎকার দিলেন,
‘ কীই?’

উঁচু আওয়াজে, পুষ্প থরথর করে কেঁ*পে উঠল। ছাল তুলে ফেলল পিউয়ের নরম হাতের। ধূসর সম্পূর্ন এড়িয়ে গেল তার প্রশ্ন। সে তখনও ইকবালের দিকে চেয়ে। ছেলেটার চেহারার প্রতিটি পরতে পরতে অনিশ্চয়তা,সংশয়,আতঙ্ক।
ধূসর ভ্রু নাঁচিয়ে শুধাল, ঠিক বললাম?’

তার সাড়াশব্দ এলো না। দু ইঞ্চি ফাঁকা ওষ্ঠযূগল নিয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে সে।

আজমল আকাশ থেকে পরলেন,
‘ ধূসর! তুমি কি মজা করছো? ‘
‘ এটা কি মজা করার মত ব্যাপার সেজো চাচ্চু?’
তিনি অপ্রস্তত কণ্ঠে বললেন,
‘ না মানে…এসব সত্যি?’
চার জা আহ*তের মতন একে অপরকে দেখলেন। মিনা শঙ্কি*ত নজরে তাকালেন স্বামীর দিকে। আমজাদের চোখমুখ রক্তা*ভ। আসন্ন পরিস্থিতি ভেবে ভয়ে হিম-শীতল হয়ে পরলেন তিনি।
ধূসরকে বললেন ‘ ধূসর,আমার মনে হয় তোর কোথাও ভুল হচ্ছে।’

আমজাদ কো*পিত কণ্ঠে বললেন,
‘ তুমি কি বলছো তুমি জানো ধূসর?’
সে বুক টানটান করে জানাল,
‘ জানি। না জেনেবুঝে কোনও কথা আমি বলিনা আপনি জানেন। তবুও বিশ্বাস না হলে,পুষ্পকে জিজ্ঞেস করুন। ‘

ধূসরের সুদৃঢ় প্রত্যয় দেখে আমজাদ ভ্রান্ত হলেন। পরপর অ*গ্নি দৃষ্টিতে ফিরলেন পুষ্পর দিকে। যেই দৃষ্টিতে কলিজা ছলাৎ করে উঠল মেয়েটার। আমজাদ ডাক ছুড়লেন,
‘ পুষ্প! ‘

পুষ্পর রুহ উড়ে গেল। উত্তর দিতে গিয়ে কণ্ঠনালি হাতড়ে শব্দ পেলোনা। শুধু ভেজা,চকচকে,অশ্রুরুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আমজাদ নিম্নভার কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ এসব সত্যি?’

পুষ্প আ*তঙ্ক নিয়ে পিউয়ের দিক তাকায়। সে চোখ দিয়ে ইশারা করে ‘ হ্যা ‘বলার। পুষ্প মাথা নামিয়ে নিলো। ধড়ফড়ে বুক নিয়ে মুখ খুলল,

‘ হহ্যাঁ।’
পিউ বিজয়ী হাসল। যেন কথাটায় নিজে জিতেছে,শান্তি পেয়েছে। আমজাদের চোখমুখ পাথরের ন্যায় শক্ত হলো ওমনি। তলিয়ে গেলেন উষ্মায় । ‘ তোমার এত বড় সাহস!’ বলে তে*ড়ে গেলেন। আঁত*কে উঠল সকলে। পুষ্প ত্রাসে পিউয়ের পেছনে লুকাল।

আচমকা মাঝপথে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরল ইকবাল। নিরব বাঁধা*য় থেমে গেলেন তিনি। সম্মুখে অপছন্দের চেহারাটা দেখতেই পি*ষে ধরলেন দাঁত।
চোখ মাটিতে রেখে ইকবাল ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ আমার জন্য পুষ্পর গায়ে হাত তুলবেন না আঙ্কেল। অপ*রাধ আমার,ওর নয়৷ যা বলার আমাকে বলুন।’

পিউ, পুষ্পর দিক ঘাড় ফিরিয়ে হাসল। বোঝাল তার মুগ্ধতা। একইরকম বিমোহিত ধূসর। মুখমন্ডলের পরিবর্তন না হলেও চোখ হাসল তার। আমজাদ আরো ক্ষে*পে গেলেন। ক্রু*দ্ধ কণ্ঠে বললেন,
‘ তোমার স্প*র্ধা তো কম নয়। আমার মেয়ের সাথে আমি কী করব,কী না করব, কী বলব সেসব তুমি ঠিক করবে? তুমি শেখাবে আমায়?’

প্রতিটি দেয়ালে তার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়। রাদিফ,রিক্ত মায়ের শরীর আকড়ে ধরে ভ*য়ে। বড় চাচার এই ক্রো*ধাদ্দীপন রূপ এর আগে দেখেনি ওরা।

ইকবাল কিছু বলল না। চোখ ও তুলল না। আমজাদ ভীষণ ক্ষে*পে তার বাহু ধরে ধা*ক্কা মেরে সরিয়ে দিলেন। যেন উচ্ছিষ্ট হঁটালেন রাস্তা থেকে। অচিরাৎ হাম*লায় পর‍তে ধরল সে। কোনও রকমে সামলাল নিজেকে।
তিনি গজগজিয়ে হেঁটে মেয়েদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পুষ্প ভ*য়ে অন্ধকার দেখছে।
আমজাদ হু*ঙ্কার দিলেন
‘ সামনে এসো। ‘
পুষ্প এলোনা। উলটে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে থাকল পিউকে। ঠকঠক করে ঠোঁট কা*পছে তার। ক্ষুদ্র প্রাণ ওষ্ঠাগত।
‘ পুষ্প তোমাকে সামনে আসতে বলেছি আমি।’
পিউ বোঝাতে গেল,
‘ আব্বু,আপুর কথাটা একটু শুনলে হোতোনা? ইকবাল ভাইতো ভালো মানুষ। উনি…’
আমজাদ রা*গে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য । যে ছেলে তার নাখোশের খাতায়,তার সম্পর্কে একটি প্রসংশাও হজম হলোনা। পিউকে আজ অবধি কোনোদিন ধম-ক না দেয়া লোকটা আচমকা চ*ড় মে*রে বসলেন।
স্তব্ধ হয়ে গেল বসার ঘর। পিউ কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বাবার হাতে কখনও মা*র খায়নি সে। অভিমান,আর বিস্ময়ে মেয়েটার কোটর ছড়িয়ে গেল মুহুর্তে। পুষ্প মুখ চে*পে ধরল দুহাতে।
নিজেকে আড়াল করার বিন্দুমাত্র প্রয়াস রইলনা আর । তার জন্য তার আদরের বোন মা*র খাবে? মেয়েটার ভয়*ভীতি তৎক্ষনাৎ উবে গেল। সহসা প্রগাঢ় সাহস ভর করল দুকাঁধে। কবুতর ছানার ন্যায় ছোট্ট বোনটাকে চট করে টেনে সরিয়ে দিয়ে বাবার মুখোমুখি হতে চাইলে বাঁধা দিলো ধূসর। আকষ্মিক ঢালের ন্যায় মাঝে এসে দাঁড়ায় সে। চওড়া দেহে পুষ্প আড়াল হয়ে পিছিয়ে যায়। চেয়ে থাকে ভাইয়ের পিঠের দিকে।
ধূসর সোজাসাপটা চাচার চোখের দিকে তাকায়। টগবগে র*ক্তলাল চেহারাটা দেখেও সামান্য ত্রাস,গ্রাস সেখানে নেই। সে সম্পূর্ন সহজ- স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘ গায়ে হাত তুললেই, পুষ্প কিন্তু ইকবালকে ভালোবাসা ছেড়ে দেবেনা।’

চলবে
আমার গ্রুপ লিংক:
https://facebook.com/groups/282026373399245/

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here