‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৫৬||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
আধভিক আর সিয়ারা নিজেদের মধ্যে এতটাই মগ্ন ছিলো যে কেউ যে অনেকক্ষণ ধরে নক করছে দরজায় সেটা তাঁরা টের পায়নি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে দরজাটা একটু আলগা করতেই চোখ বড়ো হয়ে গেলো তাঁর।
আধভিক সিয়ারাকে ডেস্কের উপর বসিয়ে ওর গলায় মুখ ডুবিয়ে রেখেছে এবং ওর দুই হাত সিয়ারার কোমরে ও পিঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সিয়ারা চোখ বন্ধ করে আধভিকের ভালোবাসার ছোঁয়াগুলো উপভোগ করছে, ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে। হঠাৎই সিয়ারা চোখ ও ভ্রূ কুঁচকে একটু কুঁকিয়ে উঠলো কিন্তু তার পর পরই ঠোঁট কামড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। আধভিক সরে এসে সিয়ারার দিকে তাকালে সিয়ারা চোখ খুলে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
সিয়ারা: কামড়ালে কেন? এটা শাস্তি ছিলো বুঝি?
আধভিক: বলতে পারো!
আধভিক কথাটা বলেই আবারও সিয়ারার গলায় কামড় দেওয়া জায়গায় গভীর ভাবে কিস করলো। সিয়ারা সেটা চোখ বুঝে অনুভব করলো এবং চোখ খোলার সাথে সাথেই ওর মনে হলো দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো।
সিয়ারা: আভি? আমার মনে হয় কেউ অনেকক্ষণ ধরে দরজা নক করছিলো? আমরা টের পাইনি।
আধভিক: (অবাক হয়ে) রিয়েলি? বাট আমরা কেন টের পাইনি সিয়ু? (না জানার ভান করে, বাঁকা হেসে)
সিয়ারা লাজুক হেসে আধভিকের বুকে মুখ গুঁজে একটা কিল বসিয়ে দিলো। আধভিক সিয়ারাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখার পর জিজ্ঞেস করলো,
আধভিক: দেব আর দিয়ার মধ্যে সব ঠিক হয়েছে?
সিয়ারা: (সোজা হয়ে) হম, ঠিক তো হয়ে যাওয়ার কথা। আব, তোমাকে আমি প্রথম থেকে কিছু জানায়নি কারণ আমি ভেবেছিলাম সবটা ঠিক হলে বলবো।
আধভিক: তাহলে বলো শুনি।
সিয়ারা: আভি দেব দিয়াকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ছিলো কিন্তু সেটা বুঝতে পারেনি। ও তো জানোই ভালোবাসায় বিশ্বাসী না খুব একটা। এদিকে দিয়াকে ও অন্য কাওর সাথে সহ্য করতে পারছিলো না তাই…
দেবাংশু দিয়ারাকে কি কি বলেছিলো এবং তার পর ওদের মধ্যে কি ঘটেছিলো তা বলার পর সিয়ারা ভেবেছিলো আধভিক প্রচণ্ড রেগে যাবে। ভুল বুঝবে দেবাংশুকে কিন্তু সিয়ারাকে অবাক করে দিয়ে আধভিককে চিন্তামগ্ন ও শান্ত দেখায়। সিয়ারা দেবাংশুকে কি কি বুঝিয়েছে সেটা বলার পর আধভিকের মুখ হালকা হাসি ফুটে ওঠে সেটাও লক্ষ্য করে সিয়ারা।
সিয়ারা: এরপর আমি দিয়ার কাছে যাই আর অর্জুনের সাথে দেবাংশুর একটা চ্যালেঞ্জ হয়েছিলো সেটা জানতে পারি দিয়ার কাছ থেকে। আমি দিয়াকে তারপরেও দেবাংশুর সাথে কথা বলতে বলেছিলাম। আসলে আমি সবটা জানার পর দেবকে কিছুতেই দোষ দিতে পারছিলাম না। তাই দিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) আভি, দেবের একটা পাস্ট আছে সেটা হলো…
আধভিক: দেবের মা কখনও দেবের সাথে ভালো ব্যবহার করেননি। ও’কে কষ্ট দেওয়া ছাড়া উনি আর কিছুই দেননি দেবকে। তারপরে স্যার আর দেব জানতে পারে যে, দেবের মায়ের এক্সট্রা ম্যারাইটাল অ্যাফেয়ার ছিলো। আর সেই ঘরের ছেলে হলো অর্জুন। (সিয়ারার দিকে তাকিয়ে) ভুল বললাম?
সিয়ারা: (অবাক হয়ে) তুমি, তুমি সবটা জানো? কিন্তু কীভাবে আভি? দেব তো তোমাকে বলেনি বলেই জানি আমি।
আধভিক: আমি কখন বললাম দেব আমাকে বলেছে?
সিয়ারা: তাহলে? তাহলে কে বলেছে তোমাকে? …. সুধাংশু আংকেল?
আধভিক না বোধক মাথা নাড়লো যার ফলে সিয়ারা চিন্তিত হয়ে পরলো। এটা কীভাবে সম্ভব? দেবাংশু আর সুধাংশু বাবু ছাড়া কেউই তো তেমন জানে না এই বিষয়ে। মিডিয়া শুধু জেনেছিল সুধাংশু বাবুর ডিভোর্স হয়ে গেছে, কি কারণে কি বৃত্তান্ত কেউ জানতে পারেনি কখনও। তাহলে আধভিক কীভাবে…কথাটা ভাবতেই আধভিক বলে উঠলো,
আধভিক: ড্যাড!
সিয়ারা: (চমকে উঠে) কি? আভাস আংকেল? সেটা কীভাবে সম্ভব?
আধভিক: (একটা নিশ্বাস ছেড়ে) আমার ড্যাডকেও বাদ রাখেনি ওর মা।
সিয়ারা চোখ বন্ধ করে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। সিয়ারার বিশ্বাস হচ্ছে না যে একটা মেয়ে মানুষ এমনও হতে পারে? কীভাবে সম্ভব? কি করে এতটা নীচ হতে পারে সে? যাঁকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে সেই বা কীভাবে মেনে নিল এসব?
সিয়ারা: আমি তো ভেবে পাচ্ছি না উনি যাঁকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন সে কীভাবে এসব জানার পরেও কিছু বলেননি। সঙ্গে সঙ্গে কেন ডিভোর্স দিতে বলেন নি। আদৌ ওই মানুষটা ভালোবাসার মানে জানে? জানলে অন্তত এতটা নীচ হতে পারতেন না।
আধভিক: (তাচ্ছিল্য হেসে) আর এদিকে আমার মা কে দেখো! চাইলেই পারতো অন্য একজনকে বিয়ে করে সুখী থাকতে। অনেক অফার এসেছিলো মায়ের কাছে অভিনয়ের জন্য। মা রাজি হয়নি। যখনই বুঝতে পেরেছে কিছু প্রোডিউসারদের উদ্দ্যেশ্য ভালো না সাথে সাথে না করে দিয়েছিল এবং জানিয়ে দিয়েছিলো কখনও জানো মায়ের জন্য কোনো অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে এই বাড়িতে কেউ না আসে। এতো সৎ থাকার পরিবর্তে উনি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই পেলেন না।
সিয়ারা: (আধভিকের কাঁধে হাত রেখে) তোমার ড্যাড প্রথম থেকেই জানিয়েছিল সে তোমার মা কে ভালোবাসেনি। সে ডিভোর্স দিতেও চেয়েছিলো কিন্তু তোমার ঠাম্মির জন্য পারেনি। আসলে তোমার ড্যাড যাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো তাঁকে ঠাম্মির পছন্দ ছিলো না। এদিকে ঠাম্মির যাঁকে পছন্দ ছিলো তাঁকে তোমার ড্যাডের পছন্দ ছিলো না। তোমার ড্যাড শুধু চেষ্টা করেনি তোমার মা কে মেনে নেওয়ার।
আধভিক: আমার মাকে ডিভোর্স না দিয়ে বিয়ে করাটা কি খুব জরুরী ছিল? শুধু বিয়ে না, ছেলে বড়ো হওয়ার পর ড্যাড সবটা জানিয়েছিল। সেটা যদি না করতো সেদিন তাহলে আমার মা…আমার মা আজ আমার সাথে থাকতো। ঠাম্মি আমার সাথে থাকতো।
সিয়ারা: আংকেল কখনও তোমার মায়ের দিকটা ভেবে দেখেননি, এটাই সবথেকে বড়ো ভুল ছিলো ওনার জীবনের।
আধভিক: হম, এদিকে স্যার কে দেখেছো? ঐরকম একটা মানুষ, যে ওনাকে কখনও ভালোবাসেনি তাঁর জন্য নিজের সারাজীবন লিখে বসে রইলেন। কি অবাক বিষয় তাই না? আসলে এই দুটো ঘটনাই প্রমাণ করে যে, একটা ছেলে ও মেয়ে দুজনেই সৎ ভাবে ভালোবাসতে পারে আবার ঠকাতেও পারে।
সিয়ারা: হম। (কিছুক্ষণ পর) দেব অনেক স্ট্রং জানো তো আভি? এতকিছুর পরও নিজেকে ঠিক রেখেছে। সুধাংশু আংকেলের পাশে দাঁড়িয়েছে।
আধভিক সিয়ারার দিকে তাকালো তারপর মনে মনে বললো,
আধভিক: (মনে মনে — ওর কি অবস্থা ছিলো সেটা যদি তুমি জানতে সিয়ু, তাহলে হয়তো…দেব সব বলতে পারে সবাইকে। শুধু নিজের জীবনের ওই সময়টুকু কাওকে বলতে পারে না। যেই সময়টায় শুধু আমি ছিলাম ওর পাশে। অনেকটা কাছ থেকে দেখেছিলাম ও’কে।) হম, ঠিক বলেছো। (হেসে)
সিয়ারা: কি লুকাচ্ছো আমার থেকে আভি? সেই সময় তুমি ছিলে ওর সাথে তাই না? তাই তুমিই এটা ভালো বলতে পারবে।
আধভিক: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) আমরা দুজন দুজনের জন্য ছিলাম সিয়ু। প্রায় একসময়ে আমাদের দুজনের সাথে ঘটনাটা ঘটেছিলো। আমারটা আগে আর ওরটা পরে। ছাড়ো, বাদ দাও এসব! আগে বলো আমাকে এরপর কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো ওদের মধ্যে?
সিয়ারা: আব, আজকে আমি দিয়ার পি এ কে ফোন করেছিলাম। আমাকে জানালো কালকে রাতে দেব দিয়াকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে গেছে। অর্জুনের অফিসে গেলে জানতে পারবো ভালো করে।
আধভিক: হম। আর সিয়ু, তুমি বলছিলে না যে কীভাবে অর্জুনের বাবা এসব মেনে নিল? (তাচ্ছিল্য হেসে) ওর বাবা শুধুমাত্র টাকা ভালোবাসেন। একচুয়ালি দুজনেই শুধু টাকা, নাম খ্যাতি লাইমলাইট এসব পছন্দ করেন। ওর বাবা এসব পাচ্ছিলো তাই আর বারণ করেনি। এদের কাছে ভালোবাসা জিনিসটা ম্যাটার করে না, ওরা জানেই না এমন কিছু আছে বলে। তাই প্লিজ বলো না উনি যা করেছিলেন কাওকে ভালোবেসে করেছিলেন।
সিয়ারা: আচ্ছা বাদ দাও। আমি আর ওনাকে নিয়ে ভাবতে চাই না। আমি শুধু ভাবছি দেব কীভাবে দিয়ারা আর অর্জুনকে মেনে নেবে।
আধভিক: (হেসে) চিন্তা করো না। ঠিক মেনে নেবে। ও যদি দিয়াকে ভালোবেসে থাকে তাহলে ঠিক মেনে নেবে। কারণ ভালোবাসলেই বিশ্বাস থাকবে, আর বিশ্বাস থাকলে সব মেনে নিতে পারবে। অতীতের যে ভয়টা ও’কে তাড়া করছিলো সেটা যখন কেটে গেছে তখন আর চিন্তা নেই।
সিয়ারা: হুঁ! আভি?
আধভিক: আবার কি প্রশ্ন আছে?
সিয়ারা: আব, তুমি, তুমি এখনও আংকেল কে মন থেকে ক্ষমা করতে পারোনি তাই না?
আধভিক চুপ করে গেলো। সিয়ারার কাছ থেকে দূরে সরে পিছন ফিরে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। সিয়ারা ডেস্কের থেকে নেমে গিয়ে আধভিকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
আধভিক: আমি জানি উনি নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। আমি কখনও ওনার পরিচয় চাইনি। আমি নিজের পরিচয় নিজে তৈরী করতে চেয়েছিলাম। যাঁর কাছে আমি একটা মিস্টেক আমি তাঁর পরিচয় নিয়ে কেন বাঁচবো? ওনার আমাকে “মিসটেক” বলাটা আমি কখনও ভুলতে পারবো না আর ক্ষমা করতে পারবো। উনি এখন যা করছেন, কেন করছেন আমি কিছুই জানি না। আমার কোনো মাথা ব্যথাও নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, যখন তুমি ছিলে না তখন উনি আমাকে সামলেছেন, আমাকে চোখে চোখে রেখেছিলেন যাতে নিজের ক্ষতি করতে না পারি।
আধভিও থেমে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলে,
আধভিক: তাই যখন উনি আমার সামনে আসেন তখন আমি পারি না নিজেকে কঠোর বা নিষ্ঠুর তৈরি করতে। আমার মনে হয়, এই একটাই তো মানুষ যে আমার খারাপ সময়ে পাশে ছিলো। ওনার কাছে আমি মিস্টেক হলেও ওনার রক্ত আমার শরীরে বইছে, আমি ওনার নিজের ছেলে আর উনি আমার বাবা। এটা আমি অস্বীকার করতে পারবো না তবে অনেক পুরোপুরি ক্ষমা করতেও পারবো না। উনি আমার মা আর ঠাম্মির মৃত্যুর জন্য দায়ী।
সিয়ারা: আমার মনে হয় আংকেল নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন আভি।
আধভিক: তাতে কি আমার মা আমার কাছে ফিরে আসবে নাকি ঠাম্মি ফিরে আসবে? আমি তো বুঝতে পারি না মায়ের যাওয়ার পর উনি কেন আমার সাথে রয়ে গেলেন ওই বাড়িতে। ওনার উচিৎ ছিলো নিজের বাড়িতে চলে যাওয়া যেখানে ওনার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে উনি ছিলেন। এই বাড়িটা আমার নামে করে গেছিলো ঠাম্মি তাই এখানে একাই থাকতাম। দরকার ছিলো না আমার ওনার। তাও যদি আমাকে নিজের সাথে রাখতেন, ভালোবাসতেন তাহলে মেনে নিতাম প্রায়শ্চিত্ত করছেন। কিন্তু উনি তো আমাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিলেন, নিজে থেকে দূরে। যেখানে ওই সময় কিছু না বুঝে ড্যাডকেই আকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম আমি।
আধভিক ঘুরে নিজের ডেস্কের কাছে যেতে গিয়েই দেখলো আভাস বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। সিয়ারাও আধভিকের দিকে ঘুরতেই আভাস বাবুকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো।
সিয়ারা: আংকেল? আপনি, আপনি কখন এলেন?
আভাস বাবু: এইমাত্র। আসলে আমি নক করতে ভুলে গেছিলাম।
আধভিক: ফর্মালিটিস করা কবে থেকে শুরু করেছো তুমি আবার? আমার মনে পরে না তুমি আমার ঘরে আসার আগে কখনও নক করতে বলে।
সিয়ারা: আভি!
আধভিক: হোয়াট? ড্যাড, তুমি আজকে এদিকটা একটু সামলাও। আমি সিয়ুকে অর্জুনের অফিসে ড্রপ করে একটা ক্লাইন্টের সাথে মিটিংয়ে যাবো।
আভাস বাবু: ঠিক আছে।
আধভিক: বায় দ্যা ওয়ে! তোমার কাজ কে সামলাচ্ছে? ওহ আ’ম সরি! তোমার ছেলে তো আছে ওখানে। আমি ভুলে গেছিলাম। যাই হোক, আমি আসছি। সিয়ু চলে আসো, উই আর গেটিং লেট!
আধভিক নিজের কথাগুলো বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। সিয়ারার বেশ খারাপ আগে আভাস বাবুর মুখটা দেখে। কিন্তু উনি কাজটাই এমন করেছেন যে সিয়ারার কিছু বলার নেই সেখানে। তবুও সিয়ারা এগিয়ে যায়, এগিয়ে গিয়ে বলে,
সিয়ারা: আসলে আজকে আবার পুরোনো কথা ওঠায় আভি একটু আপসেট ছিলো। তাই এমন বিহেভ করে ফেলেছে, আপনি কিছু মনে করবেন না আংকেল।
আভাস বাবু: না, না। আমি কিছু মনে করিনি। ভিকি বলেই হয়তো কখনও অসন্মান করে না আমাকে নাহলে আমার মত মানুষের সন্মান পাওয়ার কথা নয়। আমরা সন্মান করার যোগ্য নই। ছাড়ো এসব, তুমি যাও ওর সাথে।
সিয়ারা: একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে আংকেল। দেখবেন, আভি আপনাকে মন থেকে ক্ষমা করে দেবে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি।
আভাস বাবু: এমনটা হলে তো ভালোই হয়। আমি আর কদিন আছি? মৃত্যুর আগে যদি ক্ষমাটা পেয়ে যাই তাহলে এর থেকে ভালো কি বা হবে।
সিয়ারা: আংকেল এমন বলবেন না প্লিজ। আভি আপনাকে এখনও নিজের লোক মনে করে। ওর নিজের বলতে, পরিবার বলতে তো একমাত্র আপনিই আছেন বলুন?
আভাস বাবু: (হেসে সিয়ারার হাত দুটো ধরে) আমি চাই তুমি ওর পরিবার হয়ে ওঠো। ও তোমাকে আকড়ে ধরেই বাঁচতে চায়। তুমি থাকলে, আমার ছেলেটা ভালো থাকবে। আর আমার ছেলে আগলে রাখতে জানে নিজের সবটা দিয়ে তাই তুমিও কষ্ট পাবে না আমার ছেলের থেকে, খারাপ থাকবে না ওর কাছে। তোমরা যে একে অপরের পরিপূরক এটা আমি অনেক আগেই বুঝেছিলাম। ভিকি আমাকে যতটুকু সন্মান করছে, আমাকে যে ড্যাড বলে ডাকছে এতেই আমি অনেক খুশি। আমাকে নিয়ে এত ভেবো না মা, আমার যা প্রাপ্য আমি তাই পাবো।
আধভিক: সিয়ু!
সিয়ারার হাতটা ছেড়ে দেন আভাস বাবু। আধভিকের দিকে না ফিরেই এগিয়ে যান ওর ডেস্কের দিকে। সকলের আড়ালে নিজের চোখের জলটাও আড়াল করে নেন। সিয়ারাও কিছু না বলে বেরিয়ে যায় আধভিককে পাশ কাটিয়ে।
আধভিক: বয়স তো কম হলো না, আমার বউয়ের হাত ধরে কি করছিলে তুমি? (ভ্রূ কুঁচকে)
আভাস বাবু: এই এই! কি বলতে টা কি চাইছো তুমি হ্যাঁ? (আধভিকের দিকে ফিরে রেগে গিয়ে)
আধভিক: এটাই যে অনেকদিন তো হলো সিঙ্গেল আছো। আমার বউকে দেখে বিয়ে করার শখ জাগেনি তো আবার?
আভাস বাবু: ভিকি! আমি তোমার বাবা হই!
আধভিক: আমি কখন বললাম কাকা হও? যাই হোক, যখন তখন আমার বউয়ের কাছে গিয়ে সেন্টু খাও কেন? ও’কে কি পটানোর চেষ্টা করছো তুমি? ওসব করো না সময় মতো খাবার খাও, সেন্টু খেয়ে লাভ নেই। আমার বউ পটবে না এতো সহজে।
আভাস বাবু: তোমাকে তো আমি…
আধভিক হাসতে হাসতে ঝট করে দরজা বন্ধ করে দিলো আভাস বাবুকে তেড়ে আসতে দেখে। আভাস বাবু হাসেন আধভিকের কাজকর্মে। মনে মনে ভাবেন,
আভাস বাবু: (মনে মনে — আমি জানি, মুখে যাই বলিস না কেন আমাকে তুই ঠিকই ভালোবাসিস। তুই বলেই হয়তো পেরেছিস এতো কিছু হওয়ার পরেও আমার প্রতি কোনো অভিযোগ না করে আমার সাথে থেকে যেতে। এমন একটা মানুষকে আমি কষ্ট দিয়েছি ভাবতেই আমার নিজের উপর নিজের রাগ হয়। তাই জন্যেই তো ঠিক করেছিলাম আমি সেদিনই, নিজের জীবন দিয়ে হলেও তোমাকে আগলে রাখবো।)
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]’ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৫৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
অর্জুনের ফ্যাশন হাউজের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো আধভিক। সিয়ারা অসহায় মুখ করে একবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার আড় চোখে আধভিকের দিকে। এদিকে আধভিক মুচকি মুচকি হাসছে সিয়ারার অবস্থা দেখে। সিয়ারা আধভিকের দিকে ঘুরতেই আধভিক স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
সিয়ারা: বলছি শোনো না, তুমি চলে যাবে?
আধভিক: হ্যাঁ সিয়ু, আমার একটা ক্লাইন্টের সাথে মিটিং আছে। যেতে হবে আমাকে, লেট হচ্ছে আমার। কিন্তু তুমি কেন জিজ্ঞেস করছো? তোমাকে তো আগেই বললাম আমি।
সিয়ারা: না মানে…কিছু না। আসছি আমি।
সিয়ারা মুখটা গম্ভীর করে নেমে যেতে নিলেই আধভিক সিয়ারার হাত টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। তারপর ওর চোখে চোখ রেখে প্রথমে কপালে পরে ঠোঁটে গভীর ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
আধভিক: আমার মিটিং শেষ হতেই আমি তোমার কাছে চলে আসবো জান। তুমি গিয়ে তোমার বাকি কাজটুকু শেষ করো, ততক্ষনে আমি চলে আসবো। অর্জুনের সাথেও কথা বলতে হবে ফ্যাশন শো নিয়ে।
সিয়ারা: তাড়াতাড়ি আসবে তার মানে এই নয় যে রাশ ড্রাইভিং করবে। সাবধানে আসবে।
আধভিক: (হেসে) ওকে মেরি মা! যাও এবার। নাহলে তোমার নতুন বন্ধু তাঁর নতুন ডিজাইনারকে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পরবে।
সিয়ারা: (বাহুতে চাপর মেরে) সবসময় খালি মজা করে।
সিয়ারা নেমে যেতে গিয়েও নামে না। আধভিকের দিকে ফিরে ওর কলার ধরে নিজের সামনে টেনে আনে আর ওর দিকে এগোতে থাকে। আধভিকের ঠোঁটের দিকে এগোতে এগোতে আধভিকের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে ঝট করে সরে আসে আর বলে,
সিয়ারা: মজা করার শাস্তি!
বলেই সিয়ারা গাড়ি থেকে নেমে যায় আর আধভিক একটু চেঁচিয়ে বলে, “ইউ হ্যাভ টু পে ফর দিজ!” সিয়ারা পিছন ফিরে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাসতে হাসতে ভিতরে চলে যায়। সিয়ারা চলে গেলে আধভিকের মুখটা মলিন হয়ে যায়।
আধভিক: খুব তাড়াতাড়ি পুরোপুরি তোমাকে নিজের কাছে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে সিয়ু। আমি পারছি না আর তোমাকে ছাড়া থাকতে। (একটা নিশ্বাস ছেড়ে) খুব তাড়াতাড়ি!
আধভিক নিজের সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে। এদিকে সিয়ারা সবার প্রথম গিয়ে অর্জুনের সাথে দেখা করে নিজের জায়গায় চলে যায়।
সিয়ারা: দিয়াকে তো দেখলাম না ও কি তাহলে আসেনি নাকি স্টুডিওতে আছে? একবার স্টুডিওতে যাবো?
কথাটা ভাবতেই সিয়ারা দেখলো অর্জুনকে স্টুডিওর দিকে যেতে। সিয়ারাও পিছু পিছু স্টুডিওর দিকে চলে গেলো। রাস্তায় অর্জুনকে ডেকে নিয়ে বললো, ওর দিয়ারার সাথে দেখা করার আছে তাই ও’ও স্টুডিওতে যাচ্ছে। অর্জুন আর সিয়ারা তাই একসাথে স্টুডিওতে ঢুকলো আর দেখলো সামনে দেবাংশু দিয়ারার খুব কাছে দাঁড়িয়ে ওর চুল ঠিক করে দিচ্ছে এক হাতে ক্যামেরা নিয়ে। সিয়ারা মুচকি হাসলো ওদের অবস্থা দেখে কারণ দেবাংশুর নজর ও মনযোগ দিয়ারার চোখের দিকে, চুলের দিকে নয়। সিয়ারা একটু কেশে উঠলে দেবাংশু আর দিয়ারা একটু পিছিয়ে যায় কিন্তু দুজনেই স্বাভাবিক থাকে।
অর্জুন: দিয়া, আমার তোমার সাথে একটু কথা আছে। আমার কেবিনে চলো আমার সাথে।
দিয়ারা একবার দেবাংশুর দিকে তাকিয়ে নিজের দিদির দিকে তাকায় তারপর অর্জুনকে বলে,
দিয়ারা: কিন্তু আমি তো এখন…
দেবাংশু: আপনি যেতে পারেন মিস! আপনার ফটোশুট অলমোস্ট ডান। যা বাকি আছে ওটাতে বেশি সময় লাগবে না। বাকি মডেলদের এখনও বাকি আছে তাই আমি তাঁদেরটা কমপ্লিট করছি ততক্ষন।
অর্জুন: দ্যাটস গ্রেট! দিয়া, কাম উইথ মি।
দিয়ারা ধীরে ধীরে গুটি গুটি পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় একবার পিছন ফিরে দেবাংশুর দিকে তাকালো কিন্তু দেবাংশু নিজের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা দেখে দিয়ারা নিজের দিদির দিকে তাকালো। সিয়ারা দিয়ারাকে চোখ দিয়ে ভরসা দিতেই দিয়ারা বেরিয়ে গেলো অর্জুনের সাথে।
সিয়ারা: দেব, ঠিক আছিস তুই?
দেবাংশু: হ্যাঁ, ঠিক থাকবো না কেন? আগে ঠিক ছিলাম না বাট কালকে রাত থেকে ঠিক আছি। (হালকা হেসে)
সিয়ারা: তার মানে তোর আর দিয়ার মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে তাই তো? (খুশি হয়ে)
দেবাংশু: (হেসে) তোর বোনের যা জেদ, বাপ রে! আমার ভয় ভাগিয়ে ছেড়েছে।
সিয়ারা: (দেবাংশুর কাঁধে হাত রেখে) আমি তোকে বলেছিলাম না, একদিন ঠিক এমন কেউ আসবে তোর জীবনে যখন তুই ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হবি। তবে এই “কেউ” যে আমার বোন হবে তা জানা ছিল না। (হেসে)
দেবাংশু: আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে অতীতের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে, ভয় কাটিয়ে আমি দিয়ুর ভালোবাসার জালে আটকাবো, দিয়ুকে হারানোর ভয় পাবো। (হাসিমুখে)
সিয়ারা: দেব, আমি আভিকে সবটা জানিয়েছি তোদের ব্যাপারে আজকেই। তবে, ও আগে থেকেই তোর অতীতটা সম্পর্কে জানত। এইজন্যেই ও নিজেও এটা মানে যে তুই খুব স্ট্রং।
দেবাংশু শব্দবিহীন হেসে উঠলো সিয়ারার কথা শুনে। সিয়ারা দেবাংশুর হাসির কারণ বুঝতে পারলো না। হাসিমুখেই সিয়ারাকে বললো,
দেবাংশু: ও আমার অতীতটা না জানলে এতক্ষণে আমি রিহ্যাবে থাকতাম, স্ট্রং হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম না।
সিয়ারা: মানে? বুঝলাম না আমি।
দেবাংশু: সিয়া, আমি জানতাম ভিকি আমার অতীত সম্পর্কে জানে। শুধু কখনও এটা নিয়ে আলোচনা করিনি আমরা সামনা সামনি। আসলে ভিকি কখনও চায়নি যে আমরা নিজেদের অতীতটাকে মনে করি।
দেবাংশু নিজের ক্যামেরাটা রেখে থাই গ্লাসের দিকে এগিয়ে গেলো। বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
দেবাংশু: আসলে আমার উপর দিয়ে দুটো ঝড় গেছিলো একসাথে। তাই জন্যেই ভিকি মনে করে আমি স্ট্রং। কিন্তু ও যদি পাশে না থাকতো তাহলে আমি কখনওই স্ট্রং থাকতে পারতাম না। বিশাখা আণ্টি আমার কাছে আমার মায়ের থেকে কম কিছু ছিলো না। আমার মায়ের অভাবটা উনিই পূরণ করেছিলো আর আমার ড্যাড ভিকির বাবার অভাব। যখন প্রথম শুনেছিলাম বিশাখা আণ্টি নেই, কিছু বলার মত অবস্থা তে ছিলাম না। জানিস সিয়া, আমি যখন গেছিলাম ওদের বাড়ি তখন দেখছিলাম ভিকি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
সিয়ারা: ও কাঁদছিলো না?
দেবাংশু: না, আমি কাঁদছিলাম। আমি যখন দৌঁড়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন ও আমার দিকে মাথা উঠিয়ে হাসিমুখে বলেছিলো, “দেব, এখন থেকে আর আমি তোর সাথে হিংসে করবো না মায়ের আদর পাওয়ার জন্য। আর না ঠাম্মির বানানো নাড়ুর জন্য তোর সাথে ঝগড়া করবো। ড্যাড বললো, মা আর ঠাম্মি নাকি উঠবে না কখনও।” অবাক হয়ে গেছিলাম সেদিন। কীভাবে ভিকি এতটা শান্ত আছে? ওইটুকু বয়সে কেউ কীভাবে অতটা স্ট্রং থাকতে পারে ওরকম একটা মুহুর্তে?
সিয়ারা: এগুলো তো ও কখনো আমাকে বলেনি?
দেবাংশু: এগুলো ও কখনও বলে না কাওকে। এরপর যখন আমার মা চলে গেলো তখনও আমাকে এসে ভিকি জড়িয়ে ধরেছিল। সবসময় পাশে ছিলো আমার। তারপর যখন কয়েক মাসের মধ্যে আংকেল ও’কে বাইরে পাঠিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছিলো সেটা জানতে পেরে আমি ড্যাডকে বলেছিলাম আমিও যাবো ওর সাথে বাইরে। ড্যাড আপত্তি করেনি। যাওয়ার দিন ড্যাড যখন আমাকে আদর করছিলো তখন ভিকি আভাস আংকেলের দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলো, “আমি তোমার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম ড্যাড।” এতো কিছুর পরেও ভিকি কখনও আভাস আংকেলের প্রতি কোনো অভিযোগ করেনি।
সিয়ারা: হম, ক্ষমাও করতে পারেনি।
দেবাংশু: অতটা সহজ না ওর পক্ষে। আমি যখন এখানে এসে আভাস আংকেলের কাছে শুনলাম ভিকির অবস্থা, খুব অবাক হয়েছিলাম জানিস? ওকে কখনও আমি ভেঙে পরতে দেখিনি। না তো কখনও কাঁদতে দেখেছি। আর নেশা? ওইটা তো সবার প্রথম আমি শুরু করেছিলাম। তানিশা আমাকে সবার আগে ওসবে টেনে ছিলো। ভিকিই আমাকে আগলে রাখতো বাজে কোনো নেশার থেকে। তাই জন্যেই তো যখন জেনেছিলাম ও ড্রাগস নিয়েছে আমি রেগে গেছিলাম। পরে জানলাম তানিশা ইচ্ছা করে করেছে এসব।
সিয়ারা: তুই প্রথম শুরু করেছিলি? আভি তো আমাকে বললো যে তোরা একসাথে এসবে অ্যাডিক্টেড হয়েছিলি।
দেবাংশু: ভিকি আর অ্যাডিক্টেড? (হেসে) ও কখনও এসবে অ্যাডিক্টেড ছিলো না। জাস্ট সব কিছু ট্রাই করে দেখেছিল। কেন অ্যাডিক্টেড ছিলো না জানিস? কারণ ভিকির মনে হয় নেশা করলে ক্ষতগুলো আরো বেশি করে তাজা হয়ে ওঠে। ভুলে যাওয়ার বদলে আরও বেশি করে মনে পরে। অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়ছিলাম তো আমি। ভিকিই আমাকে ওসবের থেকে দূরে সরিয়ে আনে। বাট এখানে এসে যখন জানলাম ভিকি সারাক্ষণ নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখছে, খুব অবাক হয়েছিলাম।
সিয়ারা: এর মানে…
দেবাংশু: তোর জন্য! তোর জন্যেই ভিকি নিজেকে নেশায় ডুবিয়ে রেখেছিলো। তোকে ও কখনও ভোলার চেষ্টা করেনি সিয়া। ভিকির মতে, তুমি যাকে ভালোবাসো তাঁকে কখনও ভুলতে পারবে না কোনো কিছুর দ্বারা। ও তোকে ভালোবাসার মধ্যে সারাদিন মনে করলে, কষ্টের মাঝে সারারাত মনে করতো। জানিস? ভিকির কথার সত্যতা আমিও খুব ভালো ভাবে টের পেয়েছি এই কয়েকদিন। এক মিনিটের জন্যেও ভুলতে পারিনি দিয়ুর মুখটা। আগে যখন নেশা করেছিলাম তখন রাগ হতো আর তারপর ঘুমিয়ে পরতাম। কিন্তু ভিকি নেশা করতো না কারণ নেশা হতে না হতেই ওর সব ঘুম উড়ে যেত। শুধুমাত্র যখন…
সিয়ারা: যখন ড্রাগস নিয়েছিলো তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই ও ওটা নিতে চেয়েছিলো সব কিছু ভুলে থাকার জন্য। কিন্তু তারপর যখন তুই চলে গেলি তখন ও আর ছুঁয়েও দেখেনি ওসব।
দেবাংশু: হম। একটা কথা কি জানিস? আমরা কেউ স্ট্রং না। আমরা নিজেকে স্ট্রং প্রিটেন্ড করি। আমরা লোককে কোনো কিছু না বলে, না বুঝতে দিয়ে নিজের মনের মধ্যে সব কষ্ট, আঘাত চেপে রেখে হাসি মুখে অভিনয় করি যে, সব ঠিক আছে! আমি ভালো আছি! কোনো আঘাত আমাকে ভাঙতে পারবে না! (তাচ্ছিল্য হেসে) ভাঙবে কি করে? ভাঙা জিনিসকে কি বার বার ভাঙা যায়?
সিয়ারা: ঠিক বলেছিস। আজকালকার দিনে সবাই মুখোশ পরে আছে। কেউ ভালো মানুষের আর কেউ ভালো থাকার।
দেবাংশু: ভিকির কষ্ট হতো, ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতো কিন্তু কখনও প্রকাশ করেনি। কারণ তাহলে যে আমি ভেঙে পরবো। আমাকে স্ট্রং রাখার জন্য ও নিজের অনুভূতিগুলোকে নিজের মনের মাঝে দাবিয়ে রেখেছিলো বরাবর আর ও’কে দেখে দেখে আমি নিজেকে তৈরী করেছি। আমি যেমন আমার অতীত সম্পর্কে কাওকে কিছু টের পেতে দিইনা। তেমন ভিকিও কখনও নিজের অতীত তো দুর, নিজের আঘাতগুলোও প্রকাশ করে না। শুধু তোর থেকে পাওয়া আঘাতগুলো হয়তো ওর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আসলে নিজের কাছের মানুষকে দ্বিতীয়বার হারানোর যন্ত্রণাটা না ও নিতে পেরেছে আর না আমি। আমি তো তাও নিজেকে শেষ করতে বসেছিলাম, ভিকি কখনোই সেটা করতে যায়নি। কেন জানিস? ওর মনে হতো ও তোকে এক না একদিন ঠিক ফিরে পাবে। তুই ওর প্রাপ্য! ঠিক যেমন তুই মনে করতি।
সিয়ারা: আমাদের একে অপরের প্রতি এই বিশ্বাসটাই হয়তো আমাদেরকে আবার এক করেছে।
দেবাংশু: আর এটার পরীক্ষা তোদের বার বার দিতে হবে।
সিয়ারা: (অবাক হয়ে) মানে?
দেবাংশু: আমার মনে হয় যতটা সহজ ভাবে আমাদের চোখের সামনে সব কিছু ঘটছে। ততটাই কঠিন সবকিছু। আমি তোকে এতোগুলো কথা কেন বললাম জানিস? তুই হয়তো ভাবছিলি যে ভিকি স্ট্রং না। খুব সহজে ভেঙে পরে, নেশায় ডুবে নিজেকে কষ্ট দেয়, নিজের ক্ষতি করে। এগুলো শুধুই তোর জন্য সিয়া। ভিকি তোকে ভালোবাসে আর ও নিজের সবটুকু দিয়ে তোকে আগলে রাখতে চায়। যতক্ষণ তুই ওর সাথে আছিস ওর থেকে স্ট্রং কেউ নেই। আর যখন তুই ওর সাথে থাকবি না, তখন ওর থেকে দুর্বল কেউ হবে না। আর এটার সুযোগই হয়তো অনেকে নিতে চাইবে।
সিয়ারা: আর সুযোগটা নিতে গেলে আমাকে সরাতে চাইবে। (চমকে উঠে দেবাংশুর দিকে তাকিয়ে) তার মানে তুই বলতে চাইছিস ভিকির ক্ষতি করার জন্য কেউ আমাকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছিলো?
দেবাংশু: এক্সাকলি! এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে এগিয়ে চল। এক এক করে সব হিসেব দেখবি মিলতে শুরু করবে।
সিয়ারা: আমার সব প্রশ্নের উত্তর তো একজনের কাছেই আছে দেব।
দেবাংশু: আর তাঁকে তোর খুব সাবধানে রাখা উচিত।
সিয়ারা একটু ঘাবড়ে গিয়ে দেবাংশুর দিকে তাকালো। দেবাংশু সিয়ারাকে ভরসা দিয়ে বললো,
দেবাংশু: ভিকি জানে আণ্টি বাধ্য করেছিলো তোকে চলে যেতে?
সিয়ারা: ও’কে বলা হয়নি। দিয়া জানে। দার্জিলিং যাওয়ার আগে যখন দিয়ার সাথে দেখা হয়েছে তখনই ও’কে জানিয়েছিলাম।
দেবাংশু: ভিকি যদি জানতো দিয়ার থেকে তাহলে নিশ্চই তোর সাথে কথা বলতো এই নিয়ে। তার মানে ও জানে না। আর ওর না জানাটাই বেটার।
সিয়ারা: এমন করে কেন বলছিস?
দেবাংশু: ওই যে বললাম? ভিকি ভালোবেসে আগলে রাখতে জানে। ওর ভালোবাসাকে কেউ ওর থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করবে আর ও চুপ করে বসে থাকবে? যেই ভিকি কখনও কাঁদেনি, কখনও কোনো ইমোশানসকে দাম দেয়নি সে তোর জন্য এসব করেছে। ওর ইমোশানসগুলো শুধুমাত্র তোর সামনেই বাইরে আসে, অন্যদের কাছে ঠিক বিপরীতগুলো বাইরে আসবে। ভিকির ওই রূপটা কখনও দেখতে চাস না সিয়া, আই রিপিট কখনও না।
সিয়ারার মনে পরে গেলো তখনকার কথা যখন আধভিক প্রথম বলেছিলো ওর প্রেমিক রূপটা শুধু সিয়ারার জন্য। যেখানে ভালোবাসা আছে, পাগলামো আছে। অন্যদের জন্য সবসময়ই রাগ অ্যান্ড টাফ আর যাঁরা সিয়ারাকে অন্য নজরে দেখবে তাঁদের জন্য…
সিয়ারা নিজের চোখটা খুলে দেবাংশুকে বললো,
সিয়ারা: তোরা এমন ডুয়াল পার্সোনালিটি ক্যারি করিস কীভাবে বলবি? আপনজনের সামনে এক, বাইরের লোকের সামনে আরেক। কই আমরা তো এমন না? (বিরক্ত হয়ে)
দেবাংশু: তোরাও এমনই। তুই ছেড়ে দিবি ভিকির দিকে কেউ হাত বাড়ালে?
সিয়ারা আর কিছু উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। দেবাংশু হেসে বললো,
দেবাংশু: আমরা সবাই নিজের মানুষের কাছে আলাদা সিয়া। আমাদের একান্ত নিজের মানুষটা যখন সামনে থাকে তখন আমাদের মনে হয় আমরা যেটা কখনও কাওর কাছে প্রকাশ করতে পারি না সেটা তাঁর কাছে প্রকাশ করতে পারবো। তাঁর কাছে কোনো কিছু বলতে গেলে দুবার ভাবতে হবে না, সে বুঝে যাবে আমাদের। আর সেই নিজের মানুষটার দিকে কেউ হাত বাড়ালে তখন ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। (দাঁতে দাঁত চেপে)
সিয়ারা দেবাংশুকে রেগে যেতে দেখে হেসে বললো,
সিয়ারা: বাহবা! তুইও তো দেখছি কম যাস না কিছু। এটা কি সেই দেবাংশু গাঙ্গুলি যাঁকে আমি চিনতাম?
দেবাংশু: (হাসিমুখে) একদমই না। সেই দেবাংশু গাঙ্গুলি শুধু ব্রেইন ইউজ করতো, ব্রেইনের কথা শুনতো। এই দেবাংশু গাঙ্গুলি হার্টের কথা শোনে। হি ইজ ইন ব্যাডলি লাভ উইথ আ ওমেন! (চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ফেলে) আহ, আ ওমেন!
সিয়ারা: (হেসে) আমিও এটাই চাইছিলাম যে সবটা ঠিক হয়ে যাক তোদের মধ্যে।
দেবাংশু: আমি ভাবিনি ঠিক হবে বলে। আমি জানতাম না যে কোনো মেয়ে নিজের সবকিছু ভুলে ভালোবাসার মানুষকে এতটা বুঝতে পারে। আমার খারাপ ব্যবহারের পরেও দিয়ু ভেবেছে যে কেন আমি খারাপ ব্যবহার করেছি। কারণটা নিজেও বোঝার চেষ্টা করেছে আর বোঝার পর আমাকেও বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে যে, দূরে সরে গেলে আরও বেশি কষ্ট পাবো দুজনই। ট্রাস্ট মি, ও’কে নিজের কাছে রাখার জন্য আমি নিজের সবটুকু উজাড় করে ও’কে ভালোবাসবো।
সিয়ারা: আমি তো ভাবলাম তুই হয়তো রেগে গেছিস ওর উপর ও অর্জুনের সাথে কথা বলতে গেলো বলে।
দেবাংশু: ওহ ওটা? ওটা তো ইচ্ছা করে করলাম। (হেসে) দেখ না, এক্ষুনি তোর বোন আসবে। গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে, হাতের আঙুল মোচড়াতে মোচড়াতে বলবে, “অংশু! আমি যেতে চাইনি। আমি তাকিয়েছিলাম তুমি আমার দিকে তাকাওনি!”
সিয়ারা জোরে হেসে দেয় দেবাংশুর কথা শুনে। দেবাংশুও হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে,
সিয়ারা: আমার বোন তোকে তোর অতীতটা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারবে জানলে, আমি আগেই ও’কে পাঠিয়ে দিতাম তোর কাছে।
দেবাংশু: হম, ও’কে দেখার পরই আমি একটা অন্যরকম কিছু অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। আমার অতীতের আর কোনো প্রভাব আমার জীবনে, আমাদের সম্পর্কে আর পরবে না।
দেবাংশু আড় চোখে দেখলো দিয়া এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ও বললো,
দেবাংশু: আমার অতীতকে ঘাড় থেকে নামিয়ে, তোর বোন নিজে এখন আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে।
সিয়ারা একটু অবাক হয়ে গেলো দেবাংশুর কথায়। হঠাৎ করে এমন বলায় সিয়ারা ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই পিছন থেকে আওয়াজ এলো,
দিয়ারা: কি? আমি তোমার ঘাড়ে চেপে বসেছি? দাঁড়াও আজকেই ঘাড় মটকাবো তোমার। (দেবাংশুর দিকে তেড়ে গিয়ে)
দেবাংশু: আরে মিস? এসব আপনি কি বলছেন?
দিয়ারা: তোমার মিসের নিকুচি করেছে। তোমাকে তো আমি আজকে কুচি কুচি করবো।
দেবাংশু: (সিয়ারাকে সামনে ধরে) তোর বোন শাকচুন্নি হয়ে গেছে দেখ! আমার ঘাড় মটকে দেবে বলছে! যদিও সব সময়ই ও’কে শাকচুন্নিই লাগে মেক আপ করুক আর না করুক।
দিয়ারা: আআ! তোমার সব চুল ছিঁড়ে ফেলবো বলে দিলাম আমি। দাঁড়াও তুমি!!!
সিয়ারা হাসছে আর দেবাংশু, দিয়ারা ছুটোছুটি করছে এদিক থেকে ওদিক।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]