#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
১০.
রোশনি চমকে গিয়ে চটজলদি উঠে দাঁড়ায়। সামনে এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে পানির মধ্যে কি পড়লো।লেকের ধারে ফুল বিক্রি করছিল ছোট ছোট কয়েকটা ছেলে মেয়ে।মেহেনূর ওদের সাথে খুব খুশমেজাজে গল্প করছিল।কিন্তু হঠাৎ করেই পানিতে এমন ধড়াম করে শব্দ হওয়াতে ওউ চমকে উঠে।তাকিয়ে থেকে রোশনি লেকের একদম কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।তৎক্ষনাৎ হন্নে হয়ে ছুটে আসে মেহেনূর।উতলা কন্ঠে রোশনিকে বললো,
– ভাবী কি হয়েছে?
রোশনি নিজেও আশ্চর্য হয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর সামনেই ঘটনাটা ঘটলো কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সে টের পেলো না।মেহেনূরের প্রশ্নের প্রত্যুত্তর ও কিভাবে দিবে?রোশনির ভাবনার মধ্যেই পানির নিচ থেকে ভেসে উঠে অর্ক আর রাওনাফ।মেহেনূর রোশনি দুজনেই বেশ অবাক হয়।কিন্তু পর মুহূর্তেই রোশনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহেনূরের হাত ধরে ওখান থেকে নিয়ে চলে আসে।
ওখানে কি হলো?রোশনি ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?এইসবের কিছুই মেহেনূরের বোধগম্য হলো না।মেহেনূর বিস্মত কন্ঠে বললো,
– ভাবী ওরা পানিতে কি করছে?আর তুমি ওখান থেকে আমাকে নিয়ে চলে আসলে কেন?
প্রশ্নগুলো মেহেনূরের মনে আসবে এটাই স্বাভাবিক।ওর জায়গায় রোশনি থাকলেও হয়তো ওউ এই প্রশ্নটাই করতো।রোশনি একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বললো,
– অর্কের অগোচরে থাকা পনেরো বছরের পুরোনো কিন্তু সতেজ সত্যিটা আজ জেনে গেছে ও।তাই একটু ঝটকা তো লাগতেই পারে!যত রাগ,যত অভিমান,যত অভিযোগ আর যত দূরত্ব আছে সব গুছে যাক!ওদের নিজেদের মামলা নিজেরাই হ্যান্ডেল করুক না।শুধু শুধু ওদের মাঝখানে আমরা থেকে কি করবো?
মেহেনূর চুপ করে রইলো।অপরাধী না হয়েও দিনের পরে দিন ওর ভাইকে অপরাধের আগুনে ঝলসে যেতে দেখেছে ও।ওর ভাই নিঃসঙ্গতায় কাটিয়েছে অনেকগুলো বছর। তাই বলে ভাইয়ের প্রতি হওয়া অন্যায়ের জন্য অর্ককে প্রবলভাবে ঘৃণা করে নি ও।যতেষ্ট সম্মান আর শ্রদ্ধাই করেছে বরাবর।আজ যদি ভাইয়ের সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটিকে ফিরে পায় তবে ওর তাতে আপত্তি করার প্রশ্নই আসে না।মেহেনূর স্মিত হেসে পা বাড়ালো সামনের দিকে।ওকে অনুসরণ করে রোশনিও চললো পিছু পিছু।
লেক থেকে উঠে একটা বেঞ্চে এসে বসেছে অর্ক আর রাওনাফ।অর্ক রেগে গেলে চোখে অন্ধকার দেখে।কি করবে না করবে কোনো দিশ থাকে না।তখনও অর্ক রেগে গিয়েই রাওনাফকে কলার ধরে টেনে নিয়ে এসে লেকের পানিতে ঝাঁপ দেয়!থমথমে মুখে বসে আছে দুজনই।হুট করেই রাওনাফ শব্দ করে হেসে দেয়।রাওনাফের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায় অর্ক।রাওনাফ অর্ককে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখে হাসি রেখেই গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– মাথা ঠান্ডা হয়েছে?
মুখ ফিরিয়ে নেয় অর্ক।চাপা স্বরে বললো,
– পানিতে ঝাঁপ দিয়েও আগুন নেভাতে পারি নি!
প্রশস্ত কপাল কুচকে আসে রাওনাফের।মুখের হাসি মিলিয়ে যায় নিমিষেই।চাপা কষ্ট আর অদৃশ্য দাবানলে জ্বলে পুড়ে গেছে ওর হৃদয়টাও।চুপ করে রইলো রাওনাফ।অর্ক তেতে গিয়ে রাওনাফের কলার চেপে ধরে রক্তিম চোখে তাকিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
– এতদিন আমাকে বলিস নি কেন?
বিস্ফোরিত চোখে অর্কের দিকে রাওনাফ তাকিয়ে আছে।রাওনাফ ভেবেছিল অর্ক তখন মাথা গরম করে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পরেও হয়তো রাগ কমছিল না বলে রাগে ওকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেয়!কারণ এটা অর্কের রাগের বহিঃপ্রকাশ!ছোট বেলা থেকেই অর্ক রাওনাফের উপর রেগে গেলে এই কাজটা করে। আজকেও রেগে গিয়েই করেছে এটা তো শিওর কিন্তু কারণটা ভিন্ন!বুঝতে পারছে রাওনাফ। রাওনাফ একটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
– মানে?
অর্ক বাজখাঁই গলায় বললো,
– তোকে এত মহান হতে কে বলেছিল?আমি বলেছিলাম?
অর্কের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে রাওনাফ নির্বাক।বুঝতে পারছে অর্ক সব জেনে গেছে।তবে ওকে কে জানিয়েছে?মেহেনূর আর রোশনি ছাড়া তো এই সত্য আর কেউ জানে না।তবে কি রোশনি বলেছে?রাওনাফের কলার ছেড়ে দিয়ে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অর্ক।রাওনাফ থমকে গেছে।মস্তিষ্কের নিউরন গুলো বোধহয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।তবে হৃদপিণ্ডটা খুব দ্রুত লাফাচ্ছে।বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা করছে।চোখদুটো নিমিষেই ঘোলাটে হয়ে এসেছে।কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখলো অর্কের পিঠের উপর।অর্কের পরাণটা যেন হুহু করে উঠে।চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে রাওনাফের পিঠের মধ্যে।অর্ক ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,
– আমাকে সবটা বলিস নি কেন?
রাওনাফ অর্ককে সোজা করে দাঁড় করিয়ে চোখ মুছে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
– তখন বললেও কি তুই বিশ্বাস করতি? তুই যেটা দেখেছিস শুনেছিস সেটাই বিশ্বাস করেছিস।অবিশ্বাসের ঘা টা আর বাড়াতে চায় নি।তাই আর বলি নি!
অর্ক তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– অবিশ্বাস!ঠিকই বলেছিস!ওইদিন যদি তোর কথা শুনতাম,তোকে বিশ্বাস করতাম,তাহলে জীবনের পনেরোটা বছর এতটা বেরঙিন হতো না।এত বিষাদের কারণ হতো না!জীবনটা আরো রঙিন আরো প্রানবন্ত হতো!
রাওনাফ একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ধীর কন্ঠে বললো,
– দূরত্বের যে এত জ্বালা আগে জানলে মাটি কামড়ে তোর কাছেই পড়ে থাকতাম।হতাম একটু বেহায়া!তাতে কি,অন্তত চোখের দেখাটা তো দেখতে পারতাম।
রাওনাফ ওই ঘৃণ্য দিনগুলোকে আর মনে রাখতে চায় না।নতুন ভাবে নতুন রূপে আবার ওদের সোনালী দিনগুলোতে ফিরে যেতে চায়।অর্ককে এই টপিক থেকে বের করে আনতে বললো,
– যা হয়েছে হয়ে গেছে।তখন বয়স কম ছিল আবেগ ছিল বেশি।ভুলে যা সব।
ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে অর্কের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বললো,
– এখন বল তো রোশনিকে তোর কেমন লাগলো?
অর্ক একগাল হেঁসে বললো,
– খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে।খুব ভালোবাসে তোকে।তোকে খুব ভালো বুঝেও।আচ্ছা তুই ওকে কোথায় পেলি রে?
অর্কের জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি দেখে রাওনাফ মুখে বিরক্তির ছাপ ফেলে বললো,
– ডাস্টবিনে!
ভ্রু কুচকে আসে অর্কের।রাওনাফ গলার স্বর উঁচু করে কর্কশভাবে বললো,
– মেয়ে মানুষ কি রাস্তায় পড়ে থাকে যে গেলাম আর কুড়িয়ে নিয়ে আসলাম!
কথাটা শেষ করে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রাওনাফ।অর্ক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
– আরে ভাই তুই রাগ করছিস কেন।
– তো কি করবো?তুই এমনভাবে বললি যে মনে হয় আমি বোধহয় ওকে কুড়িয়েই পেয়েছি!
রাওনাফ মুখ ফুলিয়ে বলে কথাটা।অর্ক ফিক করে হেসে দেয়।রাওনাফ রাগী চোখে তাকাতেই হাসি থামিয়ে একটু সিরিয়াস মুখ করে বললো,
– ভাবীর সাথে তোর পরিচয় হয় কিভাবে?
এবার সন্তুষ্ট রাওনাফ।অর্কের কথার ভঙ্গি দেখে মুচকি হাসি দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– কানাডায় রোশনিদের বাড়ির অপজিটের বাড়িটাতেই আমরা থাকতাম।ওর বাবা মা অনেক আগেই কানাডায় সিটিজেনশীপ পেয়েছে।আমার হবু শ্বশুর ওইখানকার একটা টুরিজম ম্যানেজমেন্ট রিসোর্টের মালিক আর শাশুড়ি হাউজওয়াইফ।তাদের দুই সন্তানের মধ্যে রোশনিই বড় আর ওর ছোট এক ভাই আছে।ও মেহেনূরের সাথে পড়ে।দুজনের বাসা সামনা-সামনি হওয়া সত্ত্বেও আমি রোশনিকে কখনো দেখি নি।ইনফ্যাক্ট জানতামও না আমার বাসার সামনে কোনো অপ্সরা বাস করে।পড়াশোনা শেষ করে আমি যে কোম্পানিতে জয়েন করি রোশনিও ওই কোম্পানিতেই জব করতো।তখনই প্রথম পরিচয় হয়, কিন্তু কলিগ হিসেবেই।কথায় কথায় জানতে পারি আমাদের দুজনেরই বাসা একই এরিয়াতে।একদিন ওকে ড্রপ করতে গিয়ে আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম।খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় দুজনের। আস্তে আস্তে ওর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।অফিসে একসাথে যেতাম আসতাম।মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যেতাম দূরে কোথাও।আমার মনে হতে থাকে আমি ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছি ওর প্রতি।কিন্তু যার অতীতে ঘৃণ্য একটা ইতিহাস রয়েছে, মনের গহীনে লুক্কায়িত ঘা রয়েছে সে নিশ্চয় চাইবে না নতুন করে আর কোনো ঘা বাড়াতে।প্রেমের স্রোতের আবার গা ভাসাতে ভয় করতো।তাই নিজেকে ওর থেকে দূরে দূরেই রাখতাম।ইগ্নোর করতাম প্রতি পদে।হাল ছাড়ার মেয়ে রোশনি না।মেহেনূরের কাছ থেকে জেনে গিয়েছিল ওকে ইগ্নোর করার কারণ।আমাকে অবাক করে দিয়ে একদিন রোশনিই আমাকে প্রপোজ করে বসে।আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারি নি।কারণ ততদিনে আমিও ওকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম!কিন্তু তার থেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম এটা জেনে যে,রোশনি আমাকে আগে থেকেই চিনতো।অনেক আগে থেকেই আমাকে ভালোবাসতো।আমার বাহিরের গম্ভীরতা কঠোরতা দেখে ভয়ে কখনো সামনে আসে নি আর নিজের মনের কথা বলেও নি!পরিশেষে ভয়কে জয় করে তাহাতে আমাকে আসক্ত করে তবেই ছেড়েছে।
একনাগাড়ে বিরামহীন কথাগুলো বলে শেষ করেছে রাওনাফ।অর্ক শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রাওনাফের কথাই শুনছিল।দুজনের হুশ ফিরে মাগরিবের আজানের ধ্বনিতে।অর্ক স্মিত হেসে রাওনাফকে আবার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।রাওনাফও তাই করলো।শান্তি লাগছে খুব।পনেরোটা বছর পর একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে দুজনে।
পরনে থাকা ভেজা কাপড় নিয়েই দুই বন্ধু এতক্ষণ বসেছিল।ফলে ইতিমধ্যেই তার ইফেক্ট দুজনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।রাওনাফ অর্ক দুজনই হাঁচি দিতে দিতে চোখ মুখের বেহাল অবস্থা বানিয়ে ফেলেছে।মেহেনূর আর রোশনি ওদের অবস্থা দেখে শুধু মুখ টিপে হাসছে।ড্রাইভিং সিটে বসে আছে মেহেনূর।বাড়ি ফেরার পথে মেহেনূরই ড্রাইভ করছে।কারণ রাওনাফ আর অর্কের যে অবস্থা এই মুহূর্তে ওদের ড্রাইভ করতে দেওয়াটা একটু রিস্কই হয়ে যাবে। মেহেনূরও অনেক ভালো ড্রাইভ করে।মেহেনূরের বা পাশে বসে আছে রোশনি।পিছনের সিটে অর্ক আর রাওনাফ একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
চলবে……….#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
১১.
– তোদের দুজনেরই হঠাৎ করে এমন ঠান্ডা লেগে গেলো কি করে?বিকালে বাসা থেকে তো দিব্যি ভালো বের হয়েছিলি।
আয়েশা বেগম রোশনি আর রাওনাফকে ডিনারের জন্য উনাদের বাসায় নিয়ে এসেছে।সবাই ডিনার করতে একসাথে বসেছে মাত্র।অর্ক আর রাওনাফকে একনাগাড়ে হাঁচি আর নাক টানতে দেখে আকাশ সাহেব অর্ক আর রাওনাফ দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে কথাটা জিজ্ঞাস করলেন। দুজনেই চোর ধরা পড়ার মতো চোখ লুক্কাচ্ছে।অর্ক ওর বাবাকে কি বলবে বুঝতে পারছে না।কিছু একটা তো বলতে হবে।অর্ক মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– আসলে বাবা আমার মনে হচ্ছে গোসল করার সময় মাথায় পানিটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছিল।
আকাশ সাহেব আড়চোখে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
– আর তোমার?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রাওনাফ।এখন কি হবে?ও কি উত্তর দিবে?আমতা-আমতা করে গলা টেনে বললো,
– আমারো!
বিষম খেয়ে যায় অর্ক।আকাশ সাহেব অবাক হয়ে বললো,
– দুজনেরই একসাথে?
রাওনাফ নিরুত্তর।অর্ক রেগে রাওনাফের পেটে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বললো,
– বলার জন্য আর কোনো কারণ পেলি না শালা!এখন ঢেলা সামলা।
– আমি তোর শালা হলাম কবে?
– চুপ থাক,শালা!
আকাশ সাহেব বুঝতে পারছেন দুজনে মিলে কিছু একটা খিচুড়ি পাকিয়েছে।কিন্তু স্বীকার করতে চায় না।উনি শীতল কণ্ঠে বললো,
– বুঝতে পেরেছি!
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো অর্ক আর রাওনাফ।আকাশ সাহেব যে যুক্তি সংগত উত্তর না পেয়েও ওদের আর বেশি ঘাটে নি এটাই ওদের কাছে অনেক।
– মেহেনূর কোথায়?
আকাশ সাহেবের জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি অনুসরণ করে টেবিলে উপস্থিত অর্ক, রাওনাফ, রোশনিও তাকায় আয়েশা বেগমের দিকে।আয়েশা বেগম মলিন মুখে বললো,
– কত করে বললাম আসার জন্য। কিন্তু ও রাজি হলো না।বললো,ওর নাকি অনলাইন ক্লাস আছে দশটায়।
– ওহ!
আকাশ সাহেব আর কোনো প্রশ্ন না করে সবাইকে খেতে বললেন।সবাই খেতে শুরু করে।কিন্তু অর্কের কেমন জানি একটু খটকা লাগলো। রাতের দশটায় অনলাইন ক্লাস?খটকা লাগলেও এতটা মাথা না ঘামিয়ে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে।অর্ক রোশনিকে মেহেনূরদের বাসা অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসে।রাওনাফকে ও যেতে দেয় নি।রাওনাফ আজকে অর্কের সাথেই ঘুমাবে।অর্ক রোশনিকে দিয়ে এসে রাওনাফ আর ও শুয়ে পড়ে।দুজনেই অসুস্থ তাই ঘুমটা খুব তাড়াতাড়িই এসে ভর করেছে ওদের চোখে।
সকালে অর্ক আর রাওনাফের ঘুম ছেড়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।দরজার বাহিরে হট্টগোলের শব্দে ওদের ঘুম ভেঙে গেছে।অর্ক কপাল কুচকে দরজার দিকে তাকায়।কন্ঠগুলো ওর পরিচিত।রাওনাফ হয়তো চিনতে পারছে না।কিন্তু অর্কের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।গলা শুকিয়ে আসছে।এখন যদি দরজাটা গিয়ে না খুলে তাহলে এবার হয়তো দরজা ভেঙে ওদের মুখে এসে পড়বে।এক লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে অর্ক।শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।তারপর মুখে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– তোরা?
অর্ককে পাত্তা না দিয়ে ওকে ঠেলে হুড়মুড় করে ঘরের ভিতরে ঢুকলো দিহাদ,কলি,অয়ন আর তনিমা।যে যেমন পারছে ধুমধাম কিল ঘুষি মারছে অর্কের পিঠে।অর্ককে মারছে দেখে রাওনাফ তেতে গিয়ে ওদের বাধা দিতে দিতে বললো,
– কি হলো? তোমরা ওকে মারছো কেন?
যেইনা রাওনাফ মুখ খুললো ওমনি সবাই হামলে পড়লো ওর উপর।রাওনাফ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।ছেলেগুলো না হয় মারছেই কিন্তু এই মেয়ে দুটোও বাদ গেল না?অর্ক হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।রাওনাফ অবাকের সপ্তম আসমান বেধ করলো।ও এইবরকম বেদম মার খাচ্ছে আর অর্ক দাঁত বের করে হাসছে?রাওনাফ চোয়াল শক্ত করে এক ঝটকায় সবাইকে দূরে সড়িয়ে দিয়ে চিল্লিয়ে বললো,
– স্টপ ইট!কি শুরু করেছো তোমরা?আমাকে এইভাবে মারছো কেন?
দিহাদ এগিয়ে গিয়ে বললো,
– এই তুই আবার কথা বলছিস?এই ধর ওকে!
আবার সবাই রাওনাফের উপর হামলা করে।রাওনাফ ওদের এমন রিয়েক্ট করার কারণ বুঝতে পারছে না।তারউপর অর্ক ওইভাবে হাসছে।চরম বিরক্তিও লাগছে আবার রাগও হচ্ছে।রাওনাফ দাঁত কড়মড় করে অর্কের দিকে তাকায়।অর্ক রাওনাফের মুখ দেখে হাসি চেপে বললো,
– বেচারার সামনে বিয়ে!মেরে মেরে ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিবি নাকি?
অর্কের কথায় সবাই থেমে গিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।অয়ন হাতে তালি বাজিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– বাহ বাহ!এই মধ্যে বিয়েও ঠিক করে ফেললি?
রাওনাফ করুণ চোখে অর্কের দিকে তাকায়।এদের কথাবার্তা আর কর্মকাণ্ডে ও শুধু অবাকই হচ্ছে।কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছে না।অর্ক রাওনাফকে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– সত্যিই কি তুই ওদের চিনতে পারিস নি?
– না!
একরোখা উত্তর রাওনাফের।অর্ক জোর গলায় বললো,
– একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখ তো চিনতে পারিস কিনা।
রাওনাফ একটু খেয়াল করে দেখলো একজনের হাতে ছয়টা আঙুল,তার মানে এটা অয়ন!আরেকজনের কানের লতিতে কালো জন্ম দাগ টা অনেক দূর থেকেই ঝলঝল করছে,তার মানে এটা দিহাদ!তনিমার গাঢ় বাদামি চোখ!ছোট বেলায় তনিমাকে ক্যাট বলে ডাকতো অর্ক আর ও।অন্যজনের চোখে সেই আগের মোটা ফ্রেমে ভারী গ্লাসের চশমা,মানে ওটা কলি!বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে রাওনাফের মুখে।এক লাফে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দিহাদ আর অয়নকে জড়িয়ে ধরলো।ওরাও তাই করলো।একটু দূরে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তনিমা আর কলি।রাওনাফ স্মিত হেসে ওদের কাছে গিয়ে আলতো করে ওদেরকেও জড়িয়ে ধরলো।দিহাদ অভিমানী স্বরে বললো,
– এসেছিস কাল সকালে,একজনকে ফিরে পেয়েছিস বলে আমাদেরকে ভুলে গেলি?আমাদের জানালে কি তোদের পেটের ভাত হজম হতো না!
– আসলেই হজম হয় নি!তবে এখন তোদের হাতের কিল ঘুষি খেয়ে মনে হয় হজম হয়েছে!
কথাটা শেষ করে অর্ক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।অর্কের কথার মানে বুঝতে পেরে সবাই শব্দ করে হেসে দেয়।
__________________
মেহেনূর আর রোশনি ব্রেকফাস্ট করছিল।এর মধ্যেই আগমন ঘটে দিহাদদের।ওরা যখন সবাই রোশনির সাথে কথা বলছিল তখন সবাই রোশনির কথায় বেশ অবাক হচ্ছিলো।কারণ রোশনি সবাইকেই চিনে!সবার নাম ধরে কথা বলছিল।কলি বরাবরই একটু গম্ভীর টাইপের।কিন্তু বাকিরা এটা দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে যায় যে,রোশনির সাথে কলি খুব কম্ফোর্টেবল হয়েই কথা বলছে।ওদেরকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা পূর্বপরিচিত।কিছুক্ষণের মধ্যেই দিহাদরা এনজিওতে যাবে বলে মেহেনূরদের বাসা থেকে বেড়িয়ে আসে।রাওনাফ আর অর্ককে ওদের বাসা থেকে নিয়ে সবাই চলে যায় এনজিওতে।
– বউমা তোমার বাবা মা কবে আসবে?
রেনুফা বেগম রোশনির মাথায় তেল দিয়ে দিতে দিতে বললেন।রোশনি চোখ বন্ধ করে বসে ছিল।রেনুফা বেগমের হাতে জাদু আছে।ওর খুব আরাম লাগছিল।শাশুড়ির প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে ঝটপট বললো,
– কবে নাগাদ আসতে বলবো?
রেনুফা বেগম শান্ত কন্ঠে বললো,
– বিয়ের আগে ছেলে মেয়ে এক বাড়িতে থাকাটা সমাজ ভালো চোখে দেখে না মা।আমি চাই না আমার ছেলে আর ছেলের বউকে মানুষ খারাপ কথা বলুক।
– বাবা মাকে কবে আসতে হবে মা?
– আমার ছেলের বিয়ে বলে কথা।মহা ধুমধামে আমি আমার ছেলের বিয়ে দেবো।তোমার বাবা মাকে বলো খুব শীগ্রই চলে আসতে।
স্মিত হেসে আবার বললো,
– উনাদেরো তো মেয়ের বিয়ে।
রোশনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।মানে ও বলবে।মেহেনূর টম এন্ড জেরি দেখছে তার খিলখিল করে হাসছে।রেনুফা বেগম মেয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বললো,
– এই মেয়েটা সারাদিন এই টম এন্ড জেরি দেখে কি মজা পায় বলো তো বউমা?খাওয়া দাওয়াও ঠিক মতো করে না।
শাশুড়ির কথায় ফিক করে হেসে দিয়ে রোশনি বললো,
– আসলে মা,মেহেনূর প্রচুর কার্টুন পাগল।একবার যদি টম এন্ড জেরির এই চ্যানেল ওরবসামনে এসে পড়ে তাহলে তো আর কোনো কথায় নেই।রাওনাফ আর ও সারাদিন এই কার্টুন দেখেই কাটিয়ে দিতে পারে।এই টম এন্ড জেরি দেখে দেখেই যত বাদরামি শিখেছে ভাই বোন দুটো! আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কোনো এক সাক্ষাৎকারে মেবি বলেছিলেন তিনিও টম এন্ড জেরি দেখেন।এটা শুনার পর মেহেনূর কি বলে জানেন?
রেনুফা বেগম অবাক হয়ে বললো,
– কি বলে?
– বারাক ওবামার মতো একজন প্রেসিডেন্ট যদি সময় পেলে টম এন্ড জেরি দেখতে পারে তাহলে ও কেন দেখবে না।যারা জ্ঞানী তারাই নাকি কার্টুন দেখে!
– আমি ঠিক কথাই বলি ভাবী!
বউ শাশুড়ি দু’জনই চমকে উঠে মেহেনূরের দিকে তাকায়।ও ঘাড় ঘুরিয়ে উনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।মেহেনূর উনাদের কথা শুনতে পেরেছে।রোশনি হেসে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– জানি তো রাজকুমারী।
রেনুফা বেগম রোশনিকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।মেয়েটা সত্যিই সবাইকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপন করে নিতে পারে।সকালেই তার প্রমাণ পেয়েছেন তিনি।ভেবেছিলেন বিদেশে বড় হয়েছে আদব কায়দা কিছু জানে কিনা কে জানে?কিন্তু না,উনার ছেলে ওর যোগ্য মেয়েকেই খুঁজে নিয়েছে।তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে রোশনিকে বুকের সাথে আরেকটু চেপে ধরেন।রোশনিও পরম শান্তি মাথা রাখলো শাশুড়ির বুকে।
চলবে……..