#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_08
#Writer_NOVA
টেবিলের সামনে এসে হারিকেনের আলোটা কমিয়ে দিলো। নিঃশব্দে চেয়ারে বসে খাতা-কলম নিয়ে চিঠি লেখা শুরু করলো। বাইরে পোকামাকড়ের শব্দ ভেসে আসছে। নিকেষ কালো আঁধারে স্তব্ধ হয়ে আছে চারিপাশ। মাঝে মাঝে বাদুড়ের ডাক ভেসে আসছে। থমথমে পরিবেশে তার পাশে এসে দাঁড়ালো কলি বেগম। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি করো?’
‘চিঠি লিখি।’
‘কারে? ফুলের কাছে?’
‘হ্যাঁ, মেয়েটার কতদিন ধরে খবর নেই।’
‘গিয়া একবার দেইখা আইবেন?’
‘মন চাইছিলো একবার গিয়ে দেখে আসতে। কিন্তু কিভাবে যাই বলো? বহু বছর ধরে যেই বাড়িতে পা রাখি না হুট করে কিভাবে যাই?’
‘তোমার মাইয়া তুমি দেখতে যাইবা, সমস্যা কি?’
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মনোয়ার সর্দার বললো,
‘আমারো মন কাঁদে ওর জন্য। বড় আদরের মেয়ে। কতদিন ধরে দেখি না।’
কলি বেগম কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনোয়ার হাত চালিয়ে মেয়ের কাছে চিঠি লিখলেন। বাড়ির পাশের নারিকেল গাছে বসে একটা পেঁচা একঘেয়ে সুরে ডাকছে। রাতের নিস্তব্ধতা চিড়তে তার ডাকই যথেষ্ট। অল্প আলোয় স্বামীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। যৌবনে বেশ শক্ত, সামর্থ্য ছিলেন।বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর কম ঝড়-ঝাপটা যায়নি। তবুও কলি বেগমের হাত ছাড়েনি। বিশাল ঘর ছেড়ে বেছে নিয়েছেন সাধারণ জীবন যাপন। প্রতিটা প্রতিকূল অবস্থায় স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন।
‘যাও গিয়ে ঘুমিয়ে থাকো।’
‘তুমি ঘুমাইবা না?’
‘লেখা শেষ করি।’
‘আমিও তাইলে থাকি।’
‘পাপড়ি, বৃন্ত কি ঘুমিয়েছে?’
‘হো।’
‘তাহলে তুমি ঘুমাও গিয়ে।’
কলি বেগম সরলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে চিঠি লেখা দেখতে লাগলো। যদিও সে কিছু বুঝতে পারছিলো না।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হাতের বাম দিকে হাঁটতে লাগলো ফুল। পূর্ব পাশের কামরায় গেলো। হাতে থাকা খামটা আনোয়ার সর্দারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘চাচা নাও তোমার চিঠি।’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকিয়ে হাতে থাকা বইটা উল্টে বললো,
‘কার চিঠি?’
‘অভি ভাইয়ের।’
‘অভি চিঠি পাডাইছে?’
‘হুম অনেক আগে পাঠিয়েছিলো। আমার তোমাকে দিতে মন নেই।’
‘আইচ্ছা রাখ। আর ঝুমুররে দিয়া এক কাপ চা পাডায় দিছ। মাথাটা ঝিম মা’ইরা রইছে।’
‘আজকে ইউনিয়ন পরিষদে যাবা না?’
‘না তেমন কাম নাই। যাইয়া লাভ নাই।’
ফুল দৃষ্টি নামিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি বই পড়ো তুমি?’
‘সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী উপন্যাস।’
‘আমাকে একদিন দিয়ো তো। পড়ে দেখবোনি।’
‘তুই বই পড়োস?’
‘না পড়া হয় না। প্রচ্ছেদটা দেখে ভালো লাগলো।’
‘আমার তাঁকেই তো থাকে। নিয়া পড়তে পারোস না?’
‘সময় হয় না।’
আনোয়ার সর্দার বই সোজা করে পড়ায় মন দিলো। ফুল কিছু দূর গিয়ে আবার ফেরত এলো। ফুলকে ফেরত আসতে দেখে আনোয়ার সর্দার বললো,
‘কিছু কবি?’
‘হ্যাঁ, চাচী আর দাদী দু’জন বাড়িতে নেই আজকে।’
আনোয়ার সর্দার ভ্রু কুঁচকে ফুলের দিকে তাকালো। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কই গেছে?’
‘চাচীর বাপের বাড়ি। আপনের কোন শালার বউ নাকি অসুস্থ তারে দেখতে।’
বিকেলের আলোয় চেয়ারম্যান বাড়িটাকে অন্য রকম লাগে। মনে হয় সব জায়গায় হলুদাভ আলো জ্বালিয়ে রেখেছে কেউ। বাড়ির উত্তর পাশে ছোট খুপরির মতো একটা ঘর আছে। সেখানে রান্নার কাঠ, পাতা, পাটকাঠির স্তুপ। ফুল, ঝুমুর ওড়নায় বেধে সেখান থেকে চেলাকাঠ বের করতে লেগে পরলো।
‘এত্তগুলা নিতে পারবা না। কম কইরা নাও ফুল।’
‘আরে পারবো সমস্যা নেই।’
‘সাবধানে নিয়ো। চলার (চেলাকাঠ) খোঁচা খাইবা।’
‘তুমি বেশি ভাবছো। কিছু হবে না।’
কাঠের খোঁচায় হাত-পায়ে ব্যাথা না পেলেও ফুলের জামার সাথে বেধে চিড়চিড় শব্দ করে এক কোণা ছিঁড়ে গেলো।
‘আমার নতুন জামা! দুদিন পরলাম মাত্র!’
চিৎকার করে উঠলো ফুল। জামার অংশটা হাতে নিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে ঝুমুরের দিকে তাকালো।
‘আমি আগেই কইলাম। এহন সরো। আর কাম করতে হইবো না তোমার।’
‘ধূর, মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।’
কামরার সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে উত্তরের ঘরের সবকিছু দৃষ্টি গোচর হয়। আনোয়ার সর্দার সেখানে দাঁড়িয়ে ভাতিজি সকল কথাই শুনলেন ও দেখলেন।
সন্ধ্যার পর শুভ যখন বাড়ি ফিরলো তখন আনোয়ার সর্দার ফুল, ঝুমুরের সাথে বসে পুরনো দিনের কথার ঝুলি খুলে বসেছে। সাথে চা-বিস্কুট তো আছেই। বাবাকে দেখে শুভ দাঁড়ালো না। ধুপধাপ পা ফেলে নিজের কামরায় চলে গেলো। কামরায় এসে ধুপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো শুভ। মাথাটা ভার হয়ে আছে। এই ভাড় হওয়া কিসের লক্ষ্মণ তা শুভ জানে। ঠান্ডা বাবাজী দরজায় কড়া নাড়ছে। যেকোনো সময় এসে হাজির হবে।
‘তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।’
বাবার কন্ঠস্বর শুনে মাথা হালকা উঁচিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালো শুভ। গলা ঝেড়ে বললো,
‘স্বয়ং চেয়ারম্যান সাহেব আমার কামরায়। কাহিনি কি?’
শুভর কথায় রুষ্ট হলেন আনোয়ার সর্দার। তবে মুখে প্রকাশ করলেন না। থমথমে মুখ করে বললো,
‘মুখে লাগাম দে।’
‘লাগাম আমার কোন কালে ছিলো না। তাই নতুন করে দিতে পারবো না।’
আনোয়ার সর্দার ধমকে উঠল,
‘শুভ!’
শুভ আগের ন্যায় মাথা বালিশে হেলিয়ে বললো,
‘কন, হুনতাছি।’
‘আমি তোর লগে ঝামেলা করতে আহি নাই।’
‘আমিও ঝামেলার মুডে নাই।’
আনোয়ার সর্দার দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। ছোট ছেলেটা তার বখে গেছে। কোন কথা শুনে না। শাসন করলে উল্টো বেশি ত্যাড়ামি করে। বাপ-ছেলের সম্পর্ক ভালো ছিলো না কখনো। বড় হওয়ার সাথে সাথে যতটুকু অবশিষ্ট ছিলো তাতেও ফাটল ধরেছে বহু আগে। তার ছেলেটা বেপরোয়া হয়ে গেছেন। কারো কথা শুনে না। এতে আনোয়ার সর্দারের আফসোসের শেষ নেই।
‘কি কইবেন জলদী কন।’
‘ফুলরে নিয়া একটু বাজারে যাইস তো।’
শুভ উঠে বসে কপাল ভাজ করে ফেললো। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কেন?’
‘ওর দুইডা সেলোয়ার-কামিজ কিইন্না দিবি।’
‘আজকে যাইতে পারমু না। কালকে যামুনে।’
‘তোর যহন মন চাই যাইস।’
আনোয়ার সর্দার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে টাকা বের করে শুভর দিকে এগিয়ে দিলো। টাকা দেখে শুভ চোখের পাতা নাচিয়ে বললো,
‘টেকা কেন?’
‘ওরে জামা-কাপড় কিইন্না দিবি টেকা লাগবো না?’
শুভ স্মিত হেসে তাচ্ছিল্যের সুর টেনে বললো,
‘শুভর দিনকাল এতো খারাপ হই নাই যে আপনের থিকা টেকা নিতে হইবো।’
ছেলের কটাক্ষে মাথাটা দপ করে ধরে গেলো। পকেটে টাকাটা রেখে হনহনিয়ে ছেলের কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো।
‘আয় তিতি, আয়! সন্ধ্যা হইয়া গেলো। খোয়ারে ডুকোস না কেন তোরা?’
ঝুমুর বিরক্তি প্রকাশ করলো। ফুল বারান্দায় বসে ঝুমুরের কান্ড দেখে হাসছে।
‘তোমাকে দেখে আজ মুরগী পালিয়েছে ঝুমুর আপা।’
‘হেইডাই দেখতাছি। আমার লগে শয়তানি শুরু করছে। একটু পর আজান দিবো। দেহো তো কেমন শুরু করছে।’
‘তুমি ঐদিক দিয়ে তাড়া দাও। আমি এদিক দিয়ে দেখছি।’
সিমেন্টের বেদি থেকে উঠে বাইরের দিকে যাওয়ার পথ ধরতেই পেছন থেকে শুভ ডাকলো।
‘কইতরির মা!’
ফুল শুভর দিকে ঘুরে বললো,
‘হুম বলো।’
‘একটু এদিকে আয় তো।’
ফুল বাইরের দিকে তাকিয়ে জোরে চেচিয়ে ঝুমুরকে বললো,
‘তুমি মুরগীগুলোকে খোয়ারে ঢুকাও ঝুমুর আপা। আমি একটু পর আসছি।’
শুভ হাত মুঠ করে চুলগুলোকে টেনে ধরলো। মাথাটা জব্বর ধরেছে। ফুলকে খেঁকিয়ে বললো,
‘কিছু কইছি আমি।’
‘হুম চলো।’
শুভর পিছু পিছু ফুল হাঁটা ধরলো। নিজের কামরায় গিয়ে শুভ খাটের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। শুভর কান্ড না বুঝে ফুল চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
‘দাঁড়ায় রইছোত কেন? এদিকে আয়।’
চেচিয়ে বললো শুভ। ফুল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে শিউরের পাশে দাঁড়ালো। এক চোখ খুলে শুভ বললো,
‘আমার মাথাটা একটু টিপে দে তো। অনেক ধরছে।’
শুভর কথায় ফুল ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কি করবে তার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কিছু বলার আগে শুভ আবারো ধমকে উঠলো।
#চলবে
এই সপ্তাহ অনিয়মিত গল্প দিবো। ফুপাতো ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা😌। একটু মানিয়ে নিয়েন।