অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -২৮+২৯

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

গোসল দিয়ে জামা কাপড় কাঁচতে গিয়েই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। তার পরীক্ষা চলছে। আগে পরীক্ষা এলেই মা বলতেন,
-“তোর কাজ করতে হবে না। পড়ায় মন দে।”
পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মুখে খাবার তুলে দিয়ে যেতেন। রান্নাঘর থেকে হাঁক ছেড়ে বলতেন,
-“গোসল দিয়ে জামা-কাপড় রেখে দে। আমি ধুয়ে রাখবো। তুই পড়তে বস।”

মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই দু-চোখ ফেটে অশ্রু গড়ালো। জামাকাপড় ধুয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো। কলিং বেলের শব্দ শুনে তরী দৌঁড়ে গিয়ে দেখলো বাবা দরজা খুলে দিয়েছেন। তিয়াসের বাবা আর মা হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলেন। হাতে ফল-মূলের অভাব নেই, সাথে মিষ্টির প্যাকেট। সোফায় বসতে দেওয়া হলো উনাদের। চাচি তরীকে টে*নে কাছে বসালেন। মুখে হাত দিয়ে আফসোস করলেন,
-“মেয়েটা শুকিয়ে কেমন কাঠ হয়ে গিয়েছে। এবার মেয়েটাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।”

তরীর ভেতরে ভয় ঢুকলো। ভড়কে গেল সে। তিয়াসের বাবা গলা ঝেড়ে বললেন,
-“রুবিনার মৃ*ত্য*র কারণে বিয়ের তারিখ পিছিয়ে গেল। এখন তো আর সমস্যা নেই। কাল নাহয় বিয়েটা হয়ে গেল। তরী আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া করবে। পরে তিয়াস আসলে অনুষ্ঠান হবে।”

তরীর বাবার চেহারা থমথমে। তরী চোয়াল কঠিন করে নিলো। আজ সে চুপ করে থাকবেনা। মিঠু বাসায় ছিল। সবার আলাপ-আলোচনার মাঝখানেই তার উপস্থিতি ঘটলো। তাচ্ছিল্য হেসে বিদ্রুপ করে বলল,
-“যারা আমাদের দুঃসময়ে পাশে থাকেনি, তাদের কাছে আমার বোন নিরাপদে থাকবে? আমি কিছুতেই এই বিয়ে মানবোনা।”

বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন,
-“মিঠু, বড়োদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানোনা?”

-“আমি খা*রা*প কিছু তো বলিনি। যা সত্যি সেটাই বললাম।”

তরী চাচির পাশ থেকে উঠে পড়ল। অনড় গলায় বলল,
-“আমি বিয়ে করবো না, বাবা। তিয়াস ভাইয়াকে ছোটো থেকেই ভাই হিসেবে জেনে এসেছি আমি।”

তিয়াসের মা-বাবা দুজনেরই চোখমুখ শক্ত। অপমানিত বোধ করলেন উনারা। তিয়াসের বাবা বললেন,
-“তিয়াস তোমার আপন ভাই নয়।”

অতঃপর তরীর বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তুই কিছু বলছিস না কেন?”

তরীর বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“এই ব্যাপারে পরে কথা বলি আমরা!”

তিয়াসের বাবা গর্জে উঠলেন।
-“তুই কি আমাদের এড়িয়ে যেতে চাইছিস? ছেলে-মেয়ে দুটো আমাদের মুখের উপর বে*য়া*দ*বে*র মতো কথা বলছে। তুই কিছুই বলছিস না?”

মিঠু অল্প বয়সি ছেলে। মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। মাথার রগ ধপধপ করে উঠলো৷ রুক্ষ গলায় বলল,
-“বে*য়া*দ*ব*কে ঘরের বউ বানানোর এত ইচ্ছে কেন, আপনাদের?”

বড়ো ভাইকে সম্মান করলেও মনের মাঝে কিছু তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে তরীর বাবার। তবুও বাবা মিঠুকে ধমক দিলেন। যতোই হোক সে বে*য়া*দ*বি করছে।
-“মিঠু! ঘরে যা।”

ঘাড়ত্যাড়া মিঠু দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
-“আমি তো ভুল কিছু বলিনি বাবা। আমাদের ভাইবোনকে বে*য়া*দ*ব বলে আবার কিভাবে আমার বোনকে চাচ্ছে? মায়ের অসুস্থতার সময় হাসপাতালে দৌঁড়ঝাপের সময় পাশে ছিল? অথচ তারা আমাদের আপনজন, আমাদের রক্ত। তখন পাশে ছিল দূরের মানুষগুলো। যাদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই, তবুও আপনজনের মতো মাকে নিয়ে তোমার সাথে দৌঁড়েছে। তখন তো আমাদের নামমাত্র আপনজনরা কাজের দোহাই দিয়ে সরে পড়েছে।”

বাবা আবার ধমক দিলেন।
-“মিঠু তোকে যেতে বলেছি।”

তরীও ঘরের পথে পা বাড়াতে গিয়ে আরেকবার বলে গেল,
-“আমি কিছুতেই তিয়াস ভাইকে বিয়ে করবোনা।”

থামতে হলো তিয়াসের বাবার কথায়।
-“তো কাকে বিয়ে করবে? ওই ছেলেকে? দুদিন পাশে ছিল বলে সে আপন হয়ে গেল? না-কি তলে তলে প্রেম চলছে?”

তরী ঠান্ডা গলায় বলল,
-“আমি আপনাদের সাথে বে*য়া*দ*বি করতে চাইনা চাচা-চাচি। আমি কী করছি না করছি সেটা দেখার জন্য আমার বাবা আছেন। শাসনের জন্যও আমার বাবা যথেষ্ট।”

তরী আর থামলোনা। চলে গেল ঘরের ভেতর। তরীর বাবা নিশ্চুপ বসে রইলেন। স্ত্রী যাওয়ার পর থেকেই কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিয়াসের বাবা-মা উনার নত মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মিঠু জোর গলায় বলল,
-“আপনাদের ফল, মিষ্টি নিয়ে যান।”

তিয়াসের বাবা রাগে থরথর করে কাঁপছেন। আবার ফেরত এসে সব নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তরীর বাবার উদ্দেশ্য বলে গেলেন,
-“কেমন ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিবি, আমিও একবার দেখতে চাই।”

এবারও কিছুই বললেন না তরীর বাবা। দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট সব জায়গায়, আত্মীয়রাও উঠেপড়ে লেগেছেন উনাকে বিয়ে করাতে। তিনি চাইছেন না বিয়ে করতে। কিছু মানুষের যুক্তিও ভুল নয়, তরী আপাতত সংসার সামলাবে। কিন্তু কতদিন? তাকে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে বিদায় দিতে হবে। তখন ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে দুটোকে কে দেখবে? যদি বিয়ে করেনও তাদের কথা ভেবে, তবে ওই নতুন নারী যদি তার ছেলেমেয়েদের কাছে টা*ন*তে না পারে? উনার আড়ালে-আবডালে যদি অরুকে অত্যাচারিত হতে হয়! মিঠু নাহয় সারাদিন বাইরে বাইরেই কাটালো। সে সন্ধ্যা ছাড়া বাসায় খুব কমই থাকে। অরুকে তো বাসায় থাকতে হবে। এসব ভেবেই শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। সোফায় শরীর এলিয়ে চোখ বুজে রইলেন। কোথায় হারিয়ে গেল এই একরোখা মানুষটির তেজ, জেদ! যার দাপটে স্ত্রী, সন্তান কেঁপে উঠতো, মানুষ কথা বলতে একশবার ভাবতো!

★★★

তরীর পরীক্ষা শেষ হলো অনেকদিন হয়েছে। মায়ের মৃ*ত্যু*র চারটি মাস গড়িয়ে গেল। সংসারের ভার এখন তার কাঁধে। চাচা-চাচির সাথে অদৃশ্য রেষারেষি চলছে তাদের। তরী বাবার অবস্থা দেখেই মাহমুদের কথা বলার সাহস পায়না। সে আগের তরী নেই। ধীরে ধীরে বদলেছে সব। মায়ের মৃ*ত্যু নরম মেয়েটাকে শক্ত বানিয়ে দিয়েছে। অরু এখনো মাকে মনে করে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। তরী টের পেয়ে সে ও কাঁদে। আশেপাশের মানুষজন বাবাকে বিয়ে করার জন্য বলছে এগুলো তরীর কানে আসলেও সে নির্লিপ্ত রইলো। বাবা যখন বিয়ে করতে চাইবেন কিংবা বলবেন তখন সে কথা বলবে। যেখানে বাবা চুপ সেখানে তার কথা বলাটা বেমানান।

★★★

মাহমুদ কয়েকদিন ধরেই তরীকে দেখছেনা। তরীর পরীক্ষা শেষ হওয়াতে ভার্সিটি আসা-যাওয়া বন্ধ। সংসারের ভারে দু-দন্ড জিরোবার ফুরসত নেই মেয়েটার। সকাল থেকেই মাহমুদের মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে একবার তরীকে দেখার জন্য। তাদের বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়। তরী এখন একা থাকবে বাসায়। অরুকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। তরীর ব্যস্ততা আকাশ ছুঁই ছুঁই। ফোনকলেও পাওয়া যাচ্ছে না মেয়েটাকে। হয়তো ফোন চেইক করার সময় পায়নি৷ মাহমুদ সহজে মেজাজ গরম করেনা বলেই হয়তো এতটা শান্ত আছে। নয়তো ফোন না ধরার অপরাধে তরীর উপর ভীষণ রেগে থাকতো। এখন আছে কেবল অস্থিরতা। তার ব্যাকুল মনকে শান্ত করতেই তরীর ফোন এলো। রিনরিনে কন্ঠ কানে ঝংকার তুললো। বুকের উথাল-পাতাল ঢেউ থামিয়ে দিতে এই মেয়েটিই যথেষ্ট৷ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে অনিমন্ত্রিত ভাবে তাদের এই প্রেম। মাহমুদ ভাবেনি সেদিনের মেয়েটার প্রতি একটু একটু ভালোলাগা প্রেমের জোয়ার বইয়ে দিবে। তুলবে প্রেমের তরঙ্গ। সৃষ্টি হবে বিশাল এক নদী। তটিনীতে ভেসে যাবে সে। এখন ভ*য় পরিস্থিতির কারণে তাদের প্রেমনদী না শুকিয়ে যায়। তরী হবে তার একমাত্র খেয়াতরী! এই মেয়েটাকে ছাড়ার কথা মাথাতেই আনতে পারেনা মাহমুদ। এবার তরীর বাবার কাছে যদি সবচেয়ে বেহায়া ছেলে হতে হয়, তাও হবে মাহমুদ। তরীর জন্য সব করা যায়। তরী হ্যালো বলেই থেমে গেল। মাহমুদ ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। দেহে বয়ে গেল শীতল শ্রোত। অন্যসব প্রেমিকের মতো সে তার উৎকণ্ঠা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে জানেনা। মাহমুদ বেশ খানেক সময় নিয়ে অভিযোগ করলো,
-“কোথায় ছিলে, তরী। সকাল থেকে একবারও কি আমায় মনে পড়েনি?”

ওপাশ থেকে তরীর ক্লান্ত স্বর ভেসে এল।
-“পড়েছে। কাজ করছিলাম বলে সময় পাইনি।”

-“তুমি কেমন আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছো, তরী! আমার ভ*য় তোমাকে নিয়ে। তুমি কখনো আমায় ছেড়ে যেও না। আমি আমার চোখে আমাদের মতো দু-জোড়া মাহমুদ তরীর বিচ্ছেদ দেখেছি, তরী। তারাও একে এপরকে ধরে রাখার জন্য আমাদের মতো লুকিয়ে বিয়ে করিয়ে নিয়েছিল। মেয়ে দুটোর সাথে একই ঘটনা ঘটেছে। বাবা মা ভ*য় দেখিয়ে ডি*ভো*র্স করিয়ে নিয়েছে। তুমি কখনো এমন করো না তরী! আমি এটা মানতে পারবোনা।”

মাহমুদের কাতর গলায় অনুরোধ ঝরে পড়লো।
অস্থিরতায় ক্রমশ পায়চারি করছে সে। যার ধপ ধপ শব্দ স্পষ্ট। ওপাশ থেকে তরী শান্ত স্বরে বলল,
-“আপনি শান্ত হয়ে বসুন। ভ*য় আমারও আছে। আমিও পারবোনা আপনাকে ছেড়ে থাকতে। বাবার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমি ভ*য় পাচ্ছি এই মুহূর্তে বাবাকে জানাতে। আল্লাহ ভরসা, আমি জানি আল্লাহ ভালো কিছুই করবেন।”

-“যেই ভালোতে বিচ্ছেদ লেখা, সেই ভালো আমি চাইনা তরী।”

তরী নিশ্চুপ। তার দিক থেকে কোনরূপ শব্দ এলোনা। ভেসে এলো কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। মাহমুদ ছটফটিয়ে উঠে বলল,
-“কথা বলছো না কেন, তরী?”

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তরীর জবাব এলো,
-“আমিও আপনাকে চাই, মাহমুদ। তবে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে নয়।”

অরুর কথা শোনা যাচ্ছে।
-“হয়েছে?”

মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো,
-“অরু কী বলছে?”

-“হোম ওয়ার্ক করছে। সেটাই দেখাচ্ছে আমায়।”
তরীর জবাব শুনে মাহমুদ বলল,
-“ওর কাছে ফোন দাও তো।”

অরু ছোটো ছোটো বুলি আওড়ালো,
-“কে বলছেন?”

মাহমুদ হাসলো। বলল,
-“আমি ওই বুড়ো লোক বলছি। শীঘ্রই তোমায় নিতে আসবো আমি।”

অরু তেতে উঠলো,
-“অ*স*ভ্য বুড়োলোক। আমি কি তোমায় বিয়ে করবো? কক্ষনো না। আমাদের বাসায় একবার এসে দেখো। ঠ্যাং ভেঙে দেবো।”

মাহমুদ হো হো করে হেসে ফেললো। বহুদিন পর আগের অরুকে ফিরে পেল। মেয়েটা আগের তুলনায় বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। আজ আবার আগের রূপে ফিরে তাকে কেমন হু*ম*কি দিলো! মাহমুদ গম্ভীর স্বরে বলল,
-“আমি আজই আসবো। তোমায় কে বাঁচাবে আমি দেখবো।”

-“জ্বালিয়ে দেবো তোমায়। সেই ছাঁই দিয়ে দাঁত মাজবো আমি।”

তরীর খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসছে। দুজনের কথপোকথন সে বেশ উপভোগ করছে, তা বোঝা যাচ্ছে। মাহমুদ তৃপ্ত হলো। বহুদিন পর তরীও এমন প্রাণ খুলে হাসলো। মাহমুদ অরুকে জবাব দিল,
-“আমি খুব ভ*য় পেয়েছি, ম্যাডাম। আমার ভুল হয়ছে। প্লিজ আমায় জ্বালিয়ে মা*র*বে*ন না!”

অরু ভাব দেখিয়ে বলল,
-“মনে থাকে যেন।”

অতঃপর তরীর হাতে ফোন দিয়ে দিল। তরী হাসছে নিঃসংকোচে। মাহমুদ ও হাসছে।

★★★

স্কুল থেকে ফিরছে রামি আর মিঠু। এখন প্রকৃতিতে শীতের আমেজ বিদ্যমান। তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাচ্ছে স্কুল। দুটো মেয়ে মুখে একগাদা মেকাপ করে কোথাও যাচ্ছে। যা অতিরিক্ত মনে হচ্ছে। রামি মিঠুকে খোঁচা দিয়ে বলল,
-“দেখ দেখ। আমাদের আপুরা চাঁদের মতো উজ্জ্বল হতে গিয়ে সূর্যের মতো উত্তাপ ঢালছে, দ্বিতীবার তাকানোর ইচ্ছে হবেনা।”

মিঠু তাকালো একবার। রামির কথায় প্রথমে চুপ রইলো, অতঃপর হেসে লুটোপুটি খেলো। সাথে রামিও যোগ দিল। হাসির শব্দ এতটা বেশি ছিল যে, অনেকেই তাকালো তাদের দিকে। মেয়ে দুটো কেমন বাঁকা চোখে তাকালো। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, তাদের উদ্দেশ্য করেই হাসছে। একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছো কেন?”

রামি বলল,
-“মেটাকাটাপ বিটেশি হিটয়ে গিটিয়েটে।”

রামির কথা না বুঝে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মেয়ে দুটো। মিঠু, রামি হাসতে হাসতে একজন অপরজনের গায়ে ঢলে পড়ছে। “মেকাপ বেশি হয়ে গিয়েছে“ কথাটা নির্ঘাত বুঝেনি মেয়ে দুটো। নয়লে জুতো পড়তো তাদের দুই বন্ধুর গালে।

★★★

তরী ছাদে কাপড় শুকাতে গেল। একজন ভাড়াটিয়া আন্টি তাকে দাঁড়াতে বলল। তিনি ওর বাবার ব্যাপারে কথা তুললেন।
-“তোমার বাবার বিয়ে করা উচিত। তুমি কয়েকদিন পর পরের ঘরে চলে যাবে। তখন সবকিছু কে সামলাবে বলো? সবটা তুমি নিজেই চিন্তা করে দেখ।”

তরী কষ্ট পেলেও মুখে প্রকাশ করলোনা। শুধু শক্ত গলায় বলল,
-“আমার বাবা যদি বিয়ে করতে চান, তবে আমি কখনোই বাঁধা দেবো না।”

অতঃপর ধপধপ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো।

#চলবে………#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বারান্দার শীতল হাওয়া শরীরে শিরশিরে অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। একহাতে অপরহাতে ঘষে চলেছে তরী। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল, অথচ তাদের সম্পর্কের উন্নতি হলোনা। তরীর প্রেমে ব্যাকুল মাহমুদ একটিবার দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। বাবা বাসায় থাকেন না বললেই চলে। তরী ঠিক করলো অরুকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার পথে একবার দেখা করবে মাহমুদের সাথে। বারান্দা ছেড়ে ছুটে এলো ঘরে। মুঠোফোন হাতে তুলে চিরপরিচিত নাম্বারে ডায়াল করলো। খানিক সময়ের মাঝেই রিসিভ হলো। শোনা গেল গভীর সেই কন্ঠস্বর।
-“তরী!”

তরী চুপটি করে শুনলো। জবাব দিলোনা। ছোট্ট এই ডাকে যেন হৃদয় নিংড়ানো সবটুকু ভালোবাসা প্রকাশ পায়। তরী আবার শুনতে চায় তার নাম।
নিরবতার অবসান ঘটলো না দেখে মাহমুদ ফের ডাকলো,
-“তরী!”

তরী চোখ বুজলো। অতঃপর অনুরাগী স্বরে জবাব দিলো,
-“হুঁ।”

-“কথা বলছো না যে?”

-“শুনছি।”
তরীর ছোট্ট জবাবে মাহমুদ শুধালো,
-“কি শুনছো?”

-“আপনাকে।”
তরীর প্রেমময় স্বরকে উপেক্ষা করলো মাহমুদ। নিচুস্বরে বলল,
-“পরে কথা বলছি। ক্লাসে আছি আমি।”

তরীকে বলার সুযোগ না দিয়েই মাহমুদ খট করে লাইন কে*টে দিল।
তড়িৎ বার্তা পাঠালো তরী।
❝ছুটি নিন। অরুকে নিতে যাবো, তখন দেখা করবো আপনার সাথে।❞

ফোন রেখে কাজে লেগে পড়লো তরী।

★★★

মাহমুদ ফোনের স্ক্রিনে ভেসে আসা বার্তা পড়লো। তার ঠোঁটের কোন প্রসারিত হলো। বহুল আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি যেন আজ পেতে চলেছে! চোখেমুখে লেগে আছে নজরকাড়া নিটোল হাসি।

ছাত্র-ছাত্রীরা ফিসফাস করছে মাহমুদকে নিয়ে। যার কিছু কিছু মাহমুদের কর্ণধারের বাড়ি খাচ্ছে।

-“হ্যাঁ স্যার নিশ্চয়ই প্রেম করে। দেখলিনা কিভাবে কথা বলেছে। আবার মিটিমিটি হাসছে।”

অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লো মাহমুদ। দ্রুত ফোন পকেটে ঢুকিয়ে গলা পরিষ্কার করে একটু কঠোর হলো। অথচ কঠোরতা তার স্বভাবের সাথে যায় না। এতেও যেন তার বিব্রতভাব কাটছেনা। হুট করেই ক্লাস থেকে বিনা বার্তায় বেরিয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক বাইরে ঘুরেফিরে নিজেকে ধাতস্থ করে ক্লাসে ফিরলো।
ক্লাস শেষ হতেই ইমার্জেন্সি বলে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গেল মাহমুদ। রিকশায় চড়ে অরুর স্কুলের সামনে এসে থামলো। এখনো স্কুল ছুটি হতে ত্রিশ মিনিট বাকি। শীতের নরম রোদ মিষ্টি ভালোলাগার জন্ম দিচ্ছে। ঠিক ত্রিশ মিনিট নয়,গুণে গুণে পঁচিশ মিনিট যেতেই তরীর অবয়ব দেখা গেল। মাহমুদের হৃদয় শীতল হলো যেন। তরী এসে রিকশা থেকে নামলো।
কিছুক্ষণ যেতেই স্কুল ছুটি হলো। একে একে বাচ্চারা গেইট দিয়ে বেরিয়ে আসছে। অরু তরীকে দেখেই ছুটে এসে ছোটো ছোটো হাত দুটো দিয়ে কোমর আঁকড়ে ধরলো। তরী অরুর কাঁধ থেকে ব্যাগ খুলে নিল। হুট করেই পেছন থেকে কেউ কোলে তুলে নেওয়াতে ভড়কে গেল অরু। কোলে চড়ে দেখলো মাহমুদ। এতক্ষণ তাকে নজরে আসেনি। অরু গাল ফোলালো। নেমে যেতে চাইলো কোল থেকে। মাহমুদ আদুরে স্বরে বলল,
-“অরু পাখি কি আমার সাথে কথা বলবে না?”

অরু ফুলো ফুলো গালে, পিটপিট চোখে তাকিয়ে বলল,
-“নাহ্!”

-“আমার দো*ষ কোথায়?”

-“তুমি আমাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছো কেন?”

মাহমুদ অপরাধী চোখে তাকালো। বলল,
-“সেখান থেকে আমার কলেজ দূরে হয়ে যায় যে।”

তবুও অরুর রাগ কমলোনা। মাহমুদ ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার রাগ ভাঙাতে। বলল,
-“আচ্ছা কী করলে রা*গ কমবে? চকলেট? চিপস? নাকি অন্যকিছু?”

অরু আড় চোখে তাকালো। তার রাগ একটু একটু কমছে বোধহয়। তবুও চুপ করে রইলো। মাহমুদ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“কী খাবে?”

এবার কথা বলল অরু। ফুলকো ফুলকো গাল দুটো স্বাভাবিক হয়েছে। তবুও একটু ভাব ধরে চিপস, চকলেট দেখিয়ে দিয়ে বলল,
-“এগুলো নেবো।”
মাহমুদ নিঃশব্দে হেসে কিনে দিল। তাকে কোলে নিয়ে তরীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।

রিকশায় চড়ে মাহমুদ বলল,
-“চলুন মামা।”

মৃদুমন্দ বাতাসে সামনের ছোটো চুলগুলো বেশ বিরক্ত করছে তরীকে। মাহমুদ একহাতে সেগুলো সরিয়ে দিল। অরু তার চিপস, চকলেট নিয়েই ব্যস্ত। তরী বা মাহমুদ পাশ ফিরে তাকালে হয়তো তাদের সর্ব*নাশ দেখতে পেত।

★★★

ফুটপাতের ভ্যানে একজন লোক জামাকাপড় বিক্রি করছেন। মিঠুর অত রাখঢাক নেই। যখন যেখানে যা পছন্দ হয়,নিঃসংকোচে কিনে নেয়। রাতে ট্রাউজার পরে ঘুমাতে আরাম পাওয়া যায়। মিঠু ধরে দেখলো ট্রাউজার ভালোই আছে। দামাদামি করার পর ভ্যানের লোকটি বললেন,
-“আরো বিশ টাকা বাড়তি দিন।”

মিঠু বলল,
-“এই দামে দিলে দিন। না দিলে আমি যাচ্ছি। আপনার লস হলে দিতে হবেনা।”

লোকটি বললেন,
-“আর দশ টাকা বাড়তি দিন। কথা বাড়িয়েন না।”

মিঠু বলল,
-“আপনি যদি বলেন ’ ফ্রি-তে তোমার পিঠ চুলকে দেব’
তবুও আমি দশ টাকা বাড়তি দেব না।”

শেষমেশ নিজের ঠিক করা দামেই ট্রাউজার কিনে সামনে এগোলো দুই বন্ধু। রামি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিঠুর কাজ দেখলো। সে হেসে কুটিকুটি। বলল,
-“আমি তোর পিঠ চুলকে দেব। আমাকে দশ টাকা দে। তুই না জমিদারের বংশধর? তাহলে এত ছ্যাঁচড়ামো করলি কেন?”

মিঠু ভাবলেশহীনভাবে বলল,
-“যদি ছ্যাঁচড়ামি করতাম, তাহলে আরো কম দামে নিতে পারতাম।”

রামি বলল,
-“তুই এক কাজ কর। ভালো ইনকাম হবে। ছ্যাঁচড়ামো কোর্স সেন্টার খুলে ফেল। সবাই তোর কাছ থেকে শিখবে ছ্যাঁচড়ামো কিভাবে করতে হয়।”

-“বুদ্ধি ভালো দিয়েছিস।”

রামি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-“এই খুশিতে আমাকে ট্রিট দে।”

রামি পকেটে হাত দিল। একশ টাকার নোট বেরিয়ে এসেছে। টাকাটা পকেটে রেখে আফসোসের সুরে বলল,
-“পকেটে দুই টাকা নেই বলে তোকে ট্রিট দেওয়ার মতো রিস্ক নিতে পারলামনা।”

মিঠু বলল,
-“তুই আসলেই ছ্যাঁচড়া।”

এতে মিঠুর খুব একটা এসে গেল না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে এগিয়ে গেল। হঠাৎই থেমে গেল। চোখদুটো লাল হয়ে এলো। একটু একটু পানি জমছে। রামি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। তাদের বয়সি একটি ছেলে মায়ের বয়সি একজনের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করছে। সাথে ভদ্রমহিলা হেসে উঠে কানমলা দিচ্ছেন। মিঠুর কাঁধে হাত রাখলো রামি। সংবিৎ ফিরতেই শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিলো মিঠু। রামির উদেশ্যে বলল,
-“চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। রামির কাছে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন শব্দ বা বাক্য নেই। সেও আর কথা বাড়ালোনা। সামনে এগিয়ে গেল। মুহুর্তের হাসিহাসি বন্ধুত্বের মাঝে কালো মেঘ জমলো। হৈ-হুল্লোড় থেমে নিস্তব্ধ হলো সবকিছু।

★★★

বাবা বাড়ি ফেরার পর থেকেই থমথমে মুখে বসে আছেন। কোন কথা বলছেন না তরীর সাথে। তরী যাই জিজ্ঞেস করছে, জবাব পাচ্ছে না। আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“কী হয়েছে বাবা। আমি কোন দো*ষ করেছি? এভাবে চুপ করে আছো কেন?”

বাবা আরো গম্ভীর হলেন। তরীর ভেতরে ত্রাসের রাজত্ব। বড়ো কোন দোষ না করলে বাবা এমন চুপচাপ থাকেন না তাদের সাথে। তরী অস্ফুট স্বরে আরেকবার ভয়ে ভয়ে ডাকলো,
-“বাবা!”

বাবা অরুকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“স্কুল ছুটির পর কোথায় গিয়েছিলে, মা?”

অরু মাহমুদের কথা বলে দিল। তরী ঢোক গিললো। বাবার যা জানার তা জানা হয়ে গেল। তার মানে তিনি মিথ্যে শোনেননি। তিয়াসের বাবাই আজ কল দিয়ে উনাকে ডেকে তরীর ব্যাপারে কথা বললেন।
মাহমুদের সাথে দেখা ঘটনা রংচঙ মিশিয়ে বাড়িয়ে বললেন। অপমানিত হলেন তরীর বাবা। থমথমে ভাব নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মেয়েকে ছোটো থেকে যেভাবে দেখে এসেছেন তা যেন এক পলকেই মিথ্যে হয়ে গেল।
এবার ভয়ার্ত তরীর মুখোমুখি হলেন। কঠিন স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
-“কতদিনের সম্পর্ক?”

তরী মাথা নিচু করে আছে। বাবা হুংকার ছাড়লেন,
-“প্রশ্ন করেছি আমি।”

কেঁপে উঠলো তরী। কন্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো। ভয়ে মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারিত হচ্ছেনা। থরথর করে হাত পা কাঁপছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে সত্যিটা বলার। বাবা আবারও ধমকে উঠলেন। তরী হুট করেই বলে ফেললো,
-“আমরা বিয়ে করে ফেলেছি বাবা।”

তরীর বাবা থমকে গেলেন। এতক্ষণের তেজ মলিন হয়ে এলো। শরীরের ভর ছেড়ে দিলেন। তরীর কথাটুকু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। শান্ত গলায় একবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“কবে বিয়ে করলি?”

তরী কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দিল,
-“যেদিন চাচা-চাচি আংটি পরিয়ে গিয়েছেন, সেদিন।”

বাবা আর কিছুই বললেন না। মেয়ের এত অধঃপতন মেনে নিতে পারলেন না। শুধু বললেন,
-“চলে যেও তোমার ঠিকানায়। আমার অনুমতি ছাড়া যখন বিয়ে করতে পেরেছো, তখন সংসারও করতে পার। আমি বাঁধা দেবো না।”

বাবার শান্ত কথায় স্পষ্ট রাগ, অভিমান খুঁজে পেল তরী। একবার ডাকলো,
-“বাবা!”

-“পারলে আজই চলে যাও।”
কথাটুকু বলেই বাবা চলে গেলেন।
যদি বিয়ের ব্যাপারটা সামনে না আসতো, তবে মাহমুদ -তরীর জন্য সবটা সহজ হতো। বাবাও হয়তো মেনে নিতেন। তরীর বাবার কষ্টটা হলো তাদের অমতে তখনই কেন মেয়ে বিয়ে করলো? তিয়াসের বাবার কাছে ছোটো হলেন তিনি। বাবার এই অভিমান না তরীকে বাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়!

তরী ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বাবা রাতে আর খেলেন না। সকালে তরীকে যেতেও বললেন না, কথাও বললেন না। সোজা না খেয়ে বেরিয়ে গেলেন।

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here