#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৬।
পৃথার ভয়ার্ত মুখটা দেখে অর্ণবের বেশ মজা লাগছে। তাই সে পৃথাকে আরেকটু ভয় দেখানোর জন্য তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে। পৃথা তখন তার চোখ মুখ আরো কুঁচকে ফেলে। অর্ণব তার টি শার্টের বোতাম দুটো খুলতেই পৃথা চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘আরে, কী শুরু করেছেন?’
পৃথা লাফ দিয়ে উঠে বসে। ঢোক গিলে বলে,
‘আমি এখন এসবের জন্য প্রস্তুত না।’
অর্ণব মুচকি হেসে পৃথার বালিশে শুয়ে বলে,
‘তা, প্রস্তুতি নিতে কয়দিন লাগবে?’
‘অনেকদিন।’
‘উঁহু, বেশি সময় তো দেওয়া যাবে না। সর্বোচ্চ দু’দিন। এর মাঝেই ভালো ভাবে প্রস্তুতি নাও।’
‘বললেই হলো নাকি, দু’দিন? আপনাকে আমি ভালো করে চিনি না, আগে কোনো সম্পর্কও ছিল না। হুট করেই আজ বিয়ে হয়ে গিয়েছে। না আমি এসবের জন্য এখন মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম, আর না শারিরীক ভাবে। দু’দিন কোনো সময় হলো নাকি? কমসে কম আমার এক মাস লাগবে।’
অর্ণব জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলে,
‘এক মাস কেন, এক বছর নাও। তারপর যখন আমি বুড়ো হয়ে যাব, তারপর এসে আমাকে বলো, কেমন?’
পৃথা ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
‘আচ্ছা।’
অর্ণব সরু চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর পৃথাকে বলে,
‘তাহলে আর জেগে থেকে কী করবে? ঘুমাও এখন।’
পৃথাও মুচকি হেসে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে।
,
বিয়ের পর প্রথম সকাল। সূর্য যেন তার সমস্ত তেজ তাদের শোয়ার ঘরে ঢেলে দিচ্ছে। পৃথার ঘুম ছুটে যায়। গলায় হাত দিয়ে দেখে ঘামছে সে। ফ্যান চললেও বাতাস খুব একটা লাগছে না। পাশে তাকিয়ে দেখে, অর্ণব নেই। সে আস্তে আস্তে উঠে বসল। দিনের আলোয় তাদের রুমটা যেন অন্যরকম লাগছে। মাথার পাশে যে জানলাটা সেটার সামনে দিকে একটু জায়গা আছে। সেখানে বেশ কয়টা ফুল গাছ রাখা। এই ফুলগুলো তার প্রিয়। রোদে যেন এগুলো আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। কী চমৎকার হাসছে তারা! তার নিচেই রোদের আলোয় যে ছায়া তৈরি হয়েছে সেখানে গাছগুলোর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। এই বাড়ির সবকিছু এত দৃষ্টিনন্দন কেন? চারদিকে কেবল, সুন্দর আর সুন্দর।
সেসব ভাবতে ভাবতেই পৃথা ঘড়ির দিকে তাকাল। বারোটা বাজে। অনেক ঘুমিয়েছে আজ সে। মনে পড়ল, বাবা নিশ্চয়ই ঐদিকে এতক্ষণে হুলস্থুল শুরু করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই দারোয়ান মামাকেও অনেক বকবেন, উনি ঠিক মতো পাহারা দিতে পারেননি বলে। খালাকেও হয়তো কথা শোনাবেন। ইশ, তার জন্য নিরহ মানুষগুলোও কত বকা শুনবেন। পৃথার খারাপ লাগে। তবে কিছু করারও নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে দু হাত দিয়ে চুলে একটা খোঁপা করে। তারপর উঠে ওয়াশরুমে যায়, ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে এসে পৃথা অর্ণবকে খোঁজে। সে রুমে নেই, কোথায় গেল? রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের কাছে যেতেই দেখল, অর্ণব রান্না করছে। পৃথা চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে লাগল, সে কী কী করছে। এক চুলায়, পরোটা ভাজছে। আর অন্যটাতে ভাত বসিয়েছে। একবার সে পরোটা উল্টাচ্ছে তো আরেকবার সে ভাতটা চামুচ দিয়ে নাড়ছে। পৃথার তো নিজেকে এখন বেশ ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। আজকাল এমন ছেলে পাওয়া যায় নাকি? কী সুন্দর সে ঘরের সব কাজ করতে পারে।
পৃথা তখন খুশি হয়ে পেছন থেকে অর্ণবকে ফ্লাইং-কিস দেয়। অর্ণব তৎক্ষণাৎ বলে উঠে,
‘এসব উড়ন্ত জিনিসে আমার হবে না, আমাকে কিছু দিতে হলে সরাসরি এসে দিতে হবে।’
পৃথা বড়ো বড়ো চোখ করে বলে,
‘এই আপনার কি পেছনেও দুইটা চোখ আছে নাকি?’
অর্ণব হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, তুমি জানো না?’
পৃথা তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘মজা করবেন না তো।’
‘মজা করব কেন? আমার সত্যিই পেছনে দুইটা চোখ আছে, আমি কিন্তু পেছনের সবকিছু দেখি।’
পৃথা ভেংচি দিয়ে বলে,
‘এএ, আমাকে বাচ্চা পেয়েছেন তো, যে যা বলবেন তাই বিশ্বাস করব।’
অর্ণব হেসে বলে,
‘হ্যাঁ তো, বুড়ো বাচ্চা।’
পৃথা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকায়। অর্ণব বলে,
‘তোমার ডিম আর ব্রেড রেডি। যাও রুমে গিয়ে বসো, আমি নিয়ে আসছি।’
‘আমি যে সকালে ডিম আর ব্রেড খাই, সেটা আপনাকে কে বলল?’
‘কেউ বলেনি, এমনিই জানি।’
‘হু জানি, রুহার থেকে সব জেনেছেন।’
অর্ণব তার দিকে চেয়ে বলে,
‘হ্যাঁ, এবার রুমে গিয়ে বসো। আমি খাবার নিয়ে আসছি।’
‘কিন্তু, পরোটা কার জন্য?’
‘আমার।’
‘আমি খাব না?’
‘তোমার জন্যও বানিয়েছি।’
পৃথা হেসে বলল,
‘আচ্ছা।’
,
নাস্তা শেষ করে অর্ণব বলল,
‘এখন শরীর কেমন তোমার?’
‘আগের থেকে একটু ভালো। ডাক্তার দেখিয়ে ছিলাম আমি। একটা টেস্টও করেছি। কিন্তু, রিপোর্টটা আর আনা হলো না।’
‘কোন হসপিটাল তুমি বলো, আমি গিয়ে নিয়ে আসব।’
‘আমাকেও সাথে নিয়েন তাহলে।’
‘না, তোমাকে নিয়ে এখন বেরুনো সেইফ হবে না। তোমার বাবা নিশ্চয়ই এখন তোমাকে তন্য তন্য করে খুঁজছেন। এই সময় বাসায় থাকাই ভালো। বাইরে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর আপাতত তুমি অন্য একটা সিম ব্যবহার করো। পরে যদি সব ঠিকঠাক হয়, তোমার আগের সিমটা না হয় আবার আমি তুলে দিব।’
‘সিমটা তো রাখলেই পারতেন, ভেঙে ফেলার কী দরকার ছিল?’
‘না ভাঙলে, তোমার বাবা আমাদের লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলতেন।’
‘ওহহ।’
‘ঠিক আছে তাহলে, তুমি চুপচাপ এখন বাসায় বসে থাক। আমি বাইরে যাচ্ছি। বেশিক্ষণ লাগবে না, চলে আসব।’
‘আচ্ছা।’
‘আর কেউ ধাক্কালে একদম দরজা খুলবে না, চাচা আসলেও না। বলবে, আমি বাসায় নেই, আমি এলে উনি যেন আসে।’
‘ঠিক আছে।’
‘আর শুনো, রান্নাঘরে যাওয়ার দরকার নেই। ভাত রান্না করে ফেলেছি, এসে তরকারি রান্না করব। চুপচাপ এই রুমে বসে থাকবে। এদিক ওদিক কোথাও যাবে না। আর সাবধানে ওয়াশরুমে যাবে। অবশ্যই সেন্ডেল ইউজ করবে। সেন্ডেলগুলো ভালো, স্লিপ কাটে না। আর হ্যাঁ, শরীর যদি একটুও খারাপ লাগে সঙ্গে সঙ্গে আমায় কল দিবে। এই যে এই বাটি টা দেখছ? বমি হলে এখানেই করবে, দৌঁড়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার নেই, স্লিপ খেয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পানির বোতলও এখানে রাখা আছে। আর ঐ ড্রয়ারে চিপস, বিস্কিট, আচার সহ বিভিন্ন শুকনো খাবার আছে, খিদে পেলে ওখান থেকে খাবে। রান্নাঘরে গিয়ে কিছু বানিয়ে খাওয়ার দরকার নেই। গ্যাস নেই, সিলিন্ডার ইউজ করতে না পারলে আরো বিপদ। তাই যা যা বলেছি তা যেন সব মনে থাকে। একটুও যেন আমার কথার নড়চড় না হয়। বুঝতে পেরেছ?’
পৃথা বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে বলে,
‘মনে হচ্ছে যেন একটা বাচ্চাকে একা বাসায় রেখে যাচ্ছে। এত কিছু কেন বলছেন? আর এসব বল, বোতল কেন? আমি কি গিয়ে আনতে পারব না নাকি? কী যে করছেন আপনি? যেন, আমি কিছুই বুঝিনা, কিছুই জানিনা। আপনি নিশ্চিন্তে যান তো, আমি একদম ভালো ভাবে থাকতে পারব। এত ভয় পেতে হবে না, একা থেকে আমার অভ্যাস আছে।’
অর্ণব নিশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবে,
‘ভয় কী আর এমনি এমনি করি? এখন যে তুমি আর একা নও। তোমার ভেতর যে আমার ছোট্ট প্রাণটাও আছে। তোমাদের জন্য যে আমার বড্ড দুশ্চিন্তা হয়।’
‘কী হলো? যান। আমি থাকতে পারব তো।’
‘আচ্ছা, যা যা বলেছি মনে রেখ। আমি কিছুক্ষণের মাঝেই আবার চলে আসব। দরজাটা আটকে দিয়ে যাও।’
অর্ণব বেরিয়ে যাওয়ার পর, পৃথা একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বিছানায় বসে। তারপর তার ফোনে অর্ণবের দেওয়া পুরাতন সিম কার্ডটা ঢোকায়। ডায়েলে গিয়ে রুহার নাম্বার টা লিখতেই সে দেখে স্ক্রিনে রুহার নামটা শো করছে। সে অবাক হয়, এই সিমে আগে থেকেই রুহার নাম্বার কী করে সেইভ করা? সে সারার নাম্বার লিখে, দেখে সেটাও সেইভ করা। এমনকি নিলয়ের নাম্বারটাও। কিছুক্ষণের জন্য ব্যাপারটা খুব চিন্তায় ফেলে দেয় তাকে। পরে হঠাৎ মনে হয়, হয়তো অর্ণব’ই তার সুবিধার জন্য ওদের নাম্বার গুলো এই সিমে সেইভ করে দিয়ে গেছে। এটা ভেবে সে মনে মনে খুশি হয়। আর এই ভেবে মনে শান্তি লাগে যে, অর্ণবকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা নিয়ে তার কোনো ভুল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে তো, সে জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন ভালো মানুষকে পেয়েছে।
চলবে…..#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭।
অর্ণব বাইরে গিয়েছে আধঘন্টা হয়ে গিয়েছে। পৃথার আর একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না। রুহার সাথেও খুব একটা কথা বলতে পারেনি, মেয়েটা ক্লাসে আছে তাই। এভাবে একা একা কতক্ষণ বসে থাকা যায়? বাসায় তো খালার সাথেই গল্প করতে করতে পুরোদিন চলে যেত তার। ঐদিকের কী অবস্থা সেটাও বুঝতে পারছে না। বাবার জন্যও মন খারাপ হচ্ছে। আর যাই হোক, মানুষটা তো তার বাবা। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই তো তাকে এভাবে আগলে রেখেছে, তার জন্য কখনো দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তাও করেনি। মানুষটা এখন নিশ্চয়ই খুব অস্থির হয়ে উঠেছে, নিশ্চয়ই দিক বেদিক ছোটাছুটি করে তাকে খুঁজছে। আচ্ছা, বাবা কি কখনো তাদের এই বিয়েটা মেনে নিবেন? একবার বাবাকে বলে দেখবে? এমনও তো হতে পারে যে, বাবা তার সুখের কথা ভেবে মেনে নিলেন। পৃথা ফোনটা হাতে নেয়। বাবার নাম্বারটা কি-পেডে টাইপ করে। কল দিতে গিয়েও থেমে যায়। দ্বিধায় পড়ে যায়। এখনই কি বাবার সাথে যোগাযোগ করাটা ঠিক হবে? কয়দিন পর বললে ভালো হয় না? নিজের মনকে নানাবিধ প্রশ্ন করে সে ব্যস্ত করে তুলছে। তার এতসব প্রশ্নের জবাব মেলাতে গিয়ে হয়তো তার মস্তিষ্ক এবার ক্লান্ত। সে নিজেও ক্লান্ত। তাই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রুমের মধ্যে রাখা লম্বা আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। শরীরে খুব একটা পরিবর্তন না আসলেও তার পেটের চর্মিটা খানিক বেড়েছে হয়তো। সে পেটে হাত রেখে মনে মনে বলে,
‘খাওয়া দাওয়া একটু কমাতে হবে, নয়তো পেট আরো বড়ো হয়ে যাবে।’
সে রুম থেকে বেরিয়ে বসার রুমে যায়। সেখানে একখানা সোফা পাতা। পাশেই ছোট্ট একটা ফুলের টব। দেয়াল জুড়ে কিছু ছবির ফ্রেম। দেয়ালের কোণে একটা ঘন্টা লাগানো। তার নিচে দুলছে দু’টো নামের অক্ষর। সে কাছে গিয়ে দেখল, একটা ইংরেজির “পি” অক্ষর আর অন্যটা “এ”। পৃথা বুঝতে পারে এ দিয়ে অর্ণব আর পি দিয়ে নিশ্চয়ই তার আগের বউয়ের নাম। সে তাই টান দিয়ে পি অক্ষর টা খুলে ফেলে। সেটা বাইরে ছুড়ে ফেলতে নিয়েও থেমে যায়। পরে মনে পড়ে পি দিয়ে তো তারও নাম, “পৃথা।” থাক না, তাহলে এটা। পৃথা আবার সেটা জায়গা মতো ঝুলিয়ে দেয়। সেই রুমের জানলা দিয়ে বাইরের রাস্তাটা দেখা যায়। পৃথা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তাকিয়ে দেখে কাঠফাটা রৌদ্দুর। সেই রোদের পানে চাইলে চোখও যেন ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। সে পর্দা টান দিয়ে জানলার সামনে থেকে সরে আসে। আর কোনো রুম নেই। একটা বসার রুম, একটা শোয়ার রুম আর একটা ছোট্ট রান্নাঘর। একটা ছোট্ট বেলকনি দিলে ভালো হতো।
পৃথা ঘুরে ফিরে আবার বিছানায় গিয়ে বসে। একটু অন্যরকম লাগে তার। এই যে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, সে এখন একজনের বউ এটা নিয়ে তার মধ্যে কোনো উত্তেজনায় নেই। যেন এসব কিছু খুব পুরোনো। যেন আগেও এই সময়গুলো তার জীবনে এসেছিল। সবকিছু কেমন যেন চেনা চেনা লাগে।
পৃথা ভাবে হয়তো তার মাথায় কোনো সমস্যা হচ্ছে। প্যারালাইসিস থেকে ফিরে আসার পর থেকেই তার মাঝে মধ্যেই এমন লাগে। মনে হয় যেন একটা ঘটনাই তার জীবনে আবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ কী যেন একটা ঘুরে। কিছু ছাপসা ছবি, ছাপসা মুখ। কোনোভাবেই এই জিনিসগুলোকে সে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারে না। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তার। এসব ঘটনা খুলে বলতে হবে।
তার ভাবনার মাঝেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। পৃথা দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কে?’
‘খুলো, আমি?’
‘আমি কে?’
‘আরে আমি, অর্ণব।’
‘অর্ণব কে? আমি অর্ণব নামের কাউকে চিনি না।’
‘পৃথা, মজা না করে খুলোতো। গরম লাগছে খুব।’
পৃথা দরজাটা হালকা ফাঁক করে বলে,
‘আপনার গরম লাগছে তো এখানে কী করছেন? বরফের দেশে যান, হিমালয়ে। দেখবেন, চারদিকে খালি ঠান্ডা আর ঠান্ডা।’
অর্ণব তাকে ধাক্কা দিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে বলে,
‘আচ্ছা, হানিমুনে তোমাকে নিয়ে না হয় হিমালয়েই যাব।’
‘কে আপনার সাথে হানিমুনে যাচ্ছে শুনি?’
‘কেন, তুমি?’
‘জীবনেও না।’
‘ঠিক আছে, তাহলে আমার আগের বউকে নিয়ে যাব।’
এই বলে অর্ণব নিজের রুমে চলে যায়। পৃথা তার পেছন পেছন গিয়ে বলে,
‘আচ্ছা, আপনার আগের বউয়ের নাম কী?’
‘কেন? ওর নাম জেনে তুমি কী করবে?’
‘আরে, বলুন না।’
‘ঐ তো, পুওওও পুলি।’
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘পুলি? পুলি আবার কেমন নাম?’
‘কেমন নাম আবার, খুব সুন্দর নাম। নামটা শুনলেই তো কেমন মিষ্টি মিষ্টি একটা ফিলিংস আসে। তোমার নামে তো ঐ ফিলিংস জীবনেও আসবে না।’
পৃথা নাক মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘আসা লাগবে না। আপনার মিষ্টি ফিলিংস দিয়ে কি আমি মিষ্টি রেঁধে খাব? যতসব ঢং। নাম শুনলে নাকি আবার মিষ্টি মিষ্টি ফিলিংস আসে।’
অর্ণব গায়ের শার্টটা খুলে একটা টি শার্ট পরে। তারপর বিছানায় বসে একটা গন্ধ শুঁকার ভাব নিয়ে বলে,
‘কেমন যেন একটু পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছ, পৃথা?’
পৃথা চেতে গিয়ে বলে,
‘না, পাচ্ছি না। আমার নাকে আপনার মতো এতকিছুর গন্ধ লাগে না।’
সে বিরক্ত হয়ে অর্ণবের পাশে গিয়ে বসল। তারপর আবার বলল,
‘আমার রিপোর্ট এনেছেন?’
অর্ণব একটু থতমত খেয়ে বলল,
‘রিপোর্ট? আসলে আমি হসপিটালে গিয়েছিলাম। তোমার ডক্টরের সাথেও আমার কথা হয়েছে। উনি নিজেই রিপোর্ট দেখে বলেছেন, সবকিছু নাকি নরমাল। কোনো সমস্যা নেই।’
‘কই, দেখি রিপোর্টটা?’
‘ঐটা তো দেয়নি। উনার কাছেই রয়ে গেছে।’
‘ওমা, আপনি রিপোর্ট আনবেন না? রিপোর্ট কি কেউ ডাক্তারের কাছে রেখে আসে নাকি?’
‘আসলে খেয়াল ছিল না। তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি তো।’
‘এত কিসের তাড়া ছিল আপনার, শুনি? সামান্য রিপোর্টটাও মনে করে আনতে পারলেন না?’
অর্ণব মুচকি হেসে বলল,
‘তাড়া থাকবে না আবার। বাসায় এমন সুন্দরী বউ ফেলে গিয়েছি, তার জন্য মনটা অস্থির অস্থির করছিল না, তাই তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি। এমন একটা সুন্দরী বউ থাকলে কারোর কি আর অন্যকিছুর প্রতি মনোযোগ থাকে, বলো?’
‘হয়েছে হয়েছে, আর এত কথা ঘুরাতে হবে না। আপনি যে ভুলোমনা এবার সেটা স্বীকার করুন।’
‘আচ্ছা ম্যাডাম। আপনি যখন বলছেন, তখন না হয় স্বীকার করেই নিলাম।’
‘হু, এভাবে আমি যখন যা বলব, সব স্বীকার করে নিবেন। যাকগে সেসব। বলুন, দুপুরে কী খাবেন? আমি রান্না করব।’
‘না, তোমার রান্না করতে হবে না। আমি মুরগী নিয়ে এসেছি। আমিই কেটে রান্না করতে পারব।’
পৃথা তেঁতো মুখে বলল,
‘কেন, আমি কেন রান্না করতে পারব না? এটা আমারও সংসার, আমারও রান্নাবান্না সবকিছু করতে হবে। আপনি কেন করবেন এসব? আপনি বাইরে কাজ করবেন। আমি শুনেছিলাম আপনি নাকি একটা প্রাইভেট কম্পানিতে জব করেন, কই আপনি দেখি অফিসে যান না?’
‘বিয়ের পর দিন বউ রেখে কে অফিসে যায় শুনি? আর এই কয়দিন আমি এমনিতেও অফিসে যাব না। ছুটি নিয়েছি কিছুদিনের জন্য।’
‘কেন?’
অর্ণব তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
‘বউয়ের সাথে হানিমুন করার জন্য। তা বউ কোথায় হানিমুনে যাবে?’
‘আমি যেখানে বলব, আপনি সেখানে নিয়ে যাবেন?’
‘হু, বলো।’
‘তাহলে, কক্সবাজার নিয়ে চলুন।’
অর্ণব তখন মুখ ফসকে বলে ফেলে,
‘একবার কক্সবাজার গিয়ে যা করেছ, তোমাকে আমি আর ভুলেও সেখানে নিয়ে যাব না।’
পৃথা ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘আমি আপনার সাথে কখন কক্সবাজার গেলাম? কী বলছেন আপনি?’
পৃথার কথায় এবার টনক নড়ল অর্ণবের। উফফ, ভুল কথা বলে ফেলেছে। সে হেসে কথা কাটাতে বলে,
‘না মানে, আসলে আমি কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তুমি আর আমি কক্সবাজার গিয়েছি। সেখানে গিয়ে তুমি আমাকে খুব জ্বালাচ্ছো। সারাক্ষণ বিচে গিয়ে পানিতে ভিজছিলে, আমার কথা একদমই শুনছিলে না। পরে হঠাৎ একদিন ভিজতে গিয়ে পানির বেশি গভীরে চলে যাও। ঢেউ এর বেগে তখন আর তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারো না, পড়ে যাও। আমি তখন তোমার হাতের বাইরে। দৌড়ে তোমার কাছে যেতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু পানির স্রোতে খুব একটা আগাতে পারছিলাম না। ঐদিকে তুমি পানিতে নাকানিচুবানি খাচ্ছো। আর গলা ফাটিয়ে অর্ণব করে চেঁচাচ্ছ। তোমার সেই চেঁচানোর সুরে আবার বুকটা ধরফর করছিল তখন। মনে হচ্ছিল, তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলছি। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, জানতো। তাই এখন তোমার কক্সবাজার যাওয়ার কথাটা শুনে স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল। তোমার চিৎকারের শব্দটা আমার কানে এখনও ভাসছে, পৃথা।’
পৃথা আলতো করে তার হাত অর্ণবের গালে ছুঁয়ে বলল,
‘এত ভয় পান কেন আপনি? আমি হারিয়ে গেলে কী হবে?’
অর্ণব জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘এবার একদম মরে যাব।’
অর্ণবের চোখ মুখ দেখে পৃথার যেন খুব মায়া হলো। সে জড়িয়ে ধরল তাকে। নরম সুরে বলল,
‘আমি আপনার কাছ থেকে কখনো হারাব না। কখনোই না।’
‘সত্যি তো?’
‘একদম সত্যি।’
অর্ণবও তাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেয়। আজ অনেকদিন পর যেন তার বুকের দহন কমেছে। তার তৃষ্ণার্ত মন আজ পরিতৃপ্ত হয়েছে। সে চোখ বুজে পৃথার শরীরের ঘ্রাণ নেয়। এই ঘ্রাণটা যে বড্ড মোহনীয়, বড্ড ক্লান্ত করে তাকে। বড্ড বেশি…
চলবে…