#প্রেয়সী 🤎🥀(২৭)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৫২.
অডিটোরিয়ামে ফাটিয়ে প্রাকটিস চলছে। আমার সাথে আমার পেছন দাঁড়িয়ে ছয়জনে নাচ তুলছে। আমি সবার তাল ধরে দিচ্ছি। অনন্যা আপু আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে সব কিছুর তদারকি করছে। সাথে রাইও আছে। ঐদিকে কাজ করার বাহানায় রাহিয়ান ভাইয়াও আছেন। তবে কাছাকাছি নয়, একটু দূর থেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মুগ্ধ নয়নে দেখে চলেছেন আমায়। উনি ভেবেছিলেন এখানে থেকে উনি আমার মনোযোগ ন-ষ্ট করবেন। কিন্তু উল্টে আমিই যে উনার মনোযোগে বারবার ব্যা-ঘা-ত ঘটাবো তা হয়তো উনি কল্পনাতেও আনেননি।
নাচ তোলার মাঝেই আমার চোখ গেলো দরজার কাছে। কেউ আমায় ওখান থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখছেন। ভেতর থেকে তার চেহারা ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না। তাই আমি নাচ থামিয়েই উঁকি মা-র-লা-ম। কেশব দাঁড়িয়ে! আমাকে উঁকি মা-র-তে দেখেই মৃদু হাসলেন। দূর থেকেই হাত ইশারা করে বোঝালেন চমৎকার নাচছেন। আমি আঁড়চোখে রাহিয়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনিও আমার মতোই দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার মনে ভ-য় আর উনার চোখে রা-গ। এই হলো, এবার এক কে-লেং-কা-রী নিশ্চিত হবে।
উনি উঠলেন না চেয়ার ছেড়ে। নিজের রা-গ-টা-কে যথাসম্ভব কব্জায় রেখে আমার দিকে তাকালেন। নিশ্চয়ই আরেকদফা হু-কু-ম-জা-রি-র মতলব আঁটছেন। জীবনের এতো ধরাবাঁধা নিয়ম আমার পছন্দ না। তাই উনার চোখের ভাষা বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকলাম। উনাকে বা কেশবকে কাউকেই আর বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নাচ প্রাকটিসে মনোনিবেশ করলাম।
ঘন্টাখানিকের মাঝে প্রাকটিস শেষ করে রাইকে নিয়ে চলে এলাম ক্যানটিনে। ক্ষিদেয় রীতিমতো পেট জ্বা-লা-পো-ড়া করছে। এই মুহুর্তে পেটে কিছু না দিলে আর দেখতে হচ্ছে না। তাই একটু ভারী খাবারই অর্ডার করে বসলাম টেবিলে। রাই গাল ফুলিয়ে আছে। অনেক্ষন যাবৎ কিছু একটা বলার তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমি ওর কোনো কথাই শুনছিনা। এমনকি শোনার আগ্রহও দেখাচ্ছি না। তাই বেচারি না পেরে রা-গে দুঃখে গাল ফুলিয়ে রয়েছে। আমি ওর অসহায় মুখটা দেখে অবশেষে পারমিশন দিয়ে বললাম,
—-” বল কি সমস্যা? অনেক্ষন ধরে কি এমন চেপে আছিস পেটের ভেতর যে পেট এবার ফুলেফেঁপে উঠে ফেটে পড়ার উপক্রম?”
রাই ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বেশ আগ্রহের সাথে বলে উঠলো,
—-” আজ একটা হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেছি জানিস তো? হায়! কি যে সুন্দর দেখতে। উনাকে দেখতেই তো আমার চোখ রসগোল্লা। উনাকে দেখতেও অনেকটা রসগোল্লা টাইপ। ইচ্ছে করছিলো টুপ করে গিলে খেয়ে নিই।”
—-” ছিঃ তুই তো বহুত খারাপ? চোখের পর্দা কর বেদ্দপ! রূপ ভাইয়া তোর এই কান্ড দেখলে পরে তো আটা খেয়ে ম//রে যাবে।”
রাই মুখ কুঁচকে বলল,
—-” এভাবে কেন বলছিস। শুধু ভালোই তো লেগেছে! আর…”
—-” ভালো লেগেছে তাতেই রসগোল্লার মতো টুপ করে গিলে খেতে চাচ্ছিস! না জানি এর আগে পরে কিছু হলে কি করতিস!”
—-” আরে ইয়ার ট্রাস্ট মি…”
—-” হ্যালো গাইস! ক্যান আই জয়েন?”
পেছন থেকে দু’টো চেয়ার রেখেই কেশব দাঁড়িয়ে। কথাটা আমাদের উদ্দেশ্যেই ছোড়া। উনাকে দেখতেই রাইয়ের চোখ ছানাবড়া। ও এতক্ষণ যাবৎ কেশবের কথাই বলছিল। উনাকে হঠাৎ আবারও দেখতে পাবে তা হয়তো ভাবেনি। উত্তেজনার বসে আমার ডান হাতটা খামচে ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
—-” দোস্ত দিজ গাই!”
আমি বিরক্তভরা চোখে তাকালাম একবার রাইয়ের দিকে। কেশব অনুমতির অপেক্ষায় রইল না। ধীর গতিতে এগিয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারটাতেই বসলো। রাইয়ের এবার ফিট খাওয়ার পালা। চোখ জোড়া আলুর মতো গোল করে তাকিয়ে আছে কেশবের দিকে। আমি অস্বস্তি নিয়ে তাকাচ্ছি দুজনের দিকেই। কেশব মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
—-” ডিস্টার্ব করলাম?”
আমি জোরপূর্বক হাসলাম। কিছু বলব তার আগেই রাই আমাকে হেঁচকা টান মে/রে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
—-” ইয়ার কি ভয়েস!!”
আমি রাইয়ের দিকে কটমট চোখে তাকালাম। রাই চুপসে গেল। কেশব রাইয়ের চোর চোর বিহেভ দেখে বলল,
—-” আপনাদের মেই বি সত্যি ডিস্টার্ব করলাম নিধি। আম এক্সট্রিমলি সরি!”
আমি তড়িঘড়ি মাথা নাড়লাম। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,
—-” নাথিং লাইক দ্যাট। ও আসলে আপনাকে দেখে একটু বেশি এক্সাইটেড হয়ে পড়েছে।”
কেশব রাইয়ের দিকে তাকালো। মিষ্টি হেসে বলল,
—-” কেন কেন? আমাকে দেখতে কি কোনো হিরোদের মতো লাগছে হা?”
রাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
—-” তার থেকেও কম নয়।”
কেশব মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বলল,
—-” শুকরিয়া।”
রাই চোখ ঝাঁপটালো। ফর্মালিটির খাতিরে জিজ্ঞেস করল,
—-” আপনি কিছু খাবেন? কফি, বার্গার? অর্ডার করি?”
আমি ভাবলাম এই লোকও ফর্মালিটির খাতিরে বাঁধ সেধে বলল, নো থ্যাংক্স। কিন্তু সেরকম কিছু না বলে উল্টে হাসি মুখে বলল,
—-” আপনি যখন অফার করলেন তখন শিওর কিছু খাওয়া যায়!”
রাই বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে আমার দিকে তাকালো। বলল,
—-” আমি তাহলে অর্ডার করে আসছি।”
রাই উঠে যেতেই কেশব আমার দিকে পূর্নদৃষ্টিতে তাকালো। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টেনে বলল,
—-” আমি কিন্তু একটা কথা না বলে থাকতেই পারছিনা নিধি, ইউ আর রিয়েলি সাচ আ গুড ডান্সার। আমি তো মুগ্ধ!”
আমি আঁড়চোখে তাকালাম। ভদ্রতা দেখিয়ে ছোট্ট করে হেসে জবাব দিলাম,
—-” ধন্যবাদ।”
—-” আমি তোমায় যত দেখি ততই মুগ্ধ হই। আর কি কি গুন লুকিয়ে রেখেছো বলো তো?”
লোকটা প্রয়োজন ব্যতীত অধিক কথা বলছে। আমি কথার তাল ঘুরিয়ে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
—-” আপনি হঠাৎ আমাদের ভার্সিটিতে? এনি রিজনস?”
—-” বিশেষ কিছু নয়। শুনলাম তুমি এখানে আছো তাই…”
—-” মানে?”
—-” আব… তোমরা! আই মিন রাহিয়ানও তো এখানেই আছে। আমি এখান থেকেই ক্রস করছিলাম আর কি,তো ভাবলাম এ পথ ধরে যখন যাচ্ছি একবার না হয় তোমাদের দর্শন করে যাই।”
—-” ওহ আচ্ছা!”
—-” ডান্সটাকে পার্মানেন্টলি প্যাশন করে নেওয়ার ইচ্ছে আছে? নাকি এভাবেই?”
—-” না! সেরকম কিছুই না। জাস্ট এভাবেই!”
—-” তোমার ডান্স দেখে আমি সত্যি ফিদা নিধি। এই সুবাদে তোমাকে ছোট্ট একটা ট্রিট দিতে চাই! অনলি কফি ট্রিট। যদি তোমার মত থাকে? ক্যান ইউ জয়েন উইথ মি?”
আমি আঁড়চোখে তাকালাম। মুখের উপর না বলাটা অভদ্রতা! তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললাম,
—-” ভেবে দেখবো।”
কেশব বাঁকা ঠোঁটে হাসলেন। বললেন,
—-” শুকরিয়া! আম ওয়েটিং।”
আমি আর কথা বাড়লাম না। পানির বোতল খুলে পানি খেতে লাগলাম, এরই মধ্যে রাই এসে পড়ল। খানিকক্ষণের মধ্যে উনার খাবারও এসে গেলো। বাকি সময় টুকু রাই আর উনি কথা বলে গেলেন। আমি শুধু ভদ্রতা দেখিয়ে হু হা করলাম। লোকটার তাকানোর ধরন, কথা বলার ধরন কোনোটাই আমার পছন্দ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন উনি আসলে যা তা দেখান না। উনি যা নন তাই দেখান। ঘাপলা ঘাপলা গন্ধ হচ্ছে। এই প্রথমবার মনে হচ্ছে রাহিয়ান ভাইয়ার কথা মেনে নেওয়াই শ্রেয়। উনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখা উচিৎ।
কেশবের পাট চুকিয়ে অনন্যা আপুর ডাকে আবারও এসে হাজির হলাম অডিটোরিয়াম রুমে। নাচের শেষ ধাপ গুলো আমার তুলতে সহজ হলেও বাকিরা প্রায় হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ ধরে তাদের স্টেপ বোঝাতে বোঝাতে আপাতত ভীষণ চটে আছে অনন্যা আপু্। এখন শেষ ভরসা আমি। আমি তাদের স্টেপ বোঝাতে স্বার্থক হবো বলে আপুর ধারনা। আমি আপুর ভাবনার মুল্য রেখেই সবাইকে আবারও শেখাতে লাগলাম। সবাইকে হাতে কলমে বোঝাতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো রাহিয়ান ভাইয়ার কথা। উনি দূরে ঠিক আগের জায়গা নিয়েই বসে আছেন। বিশেষ আলোচনা হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। তবে মাঝেমধ্যে বিরতিও দেওয়া হচ্ছে কিন্তু উনি বিরতির মাঝেও আমাকে দেখছেন না। ভুল করেও একবার এদিকে তাকাচ্ছেন না। এমন ভাব নিয়ে আছেন যেন মনে হচ্ছে নিধি নামের কোনো প্রানীই পৃথিবীতে বাস করেনা। হলো টা কি? কোনো কারনে কি মেজাজ খুব কড়া উনার? তাই তো মনে হচ্ছে! আচ্ছা কেশবের ব্যাপারটা নিয়ে রে-গে নন তো? ইয়া খোদা! সহায় হও! যদি সত্যি এমন কিছু হয় তবে তো আমি শেষ।
৫৩.
হুতুমপেঁচার গাড়িতে দুনিয়ার সেরা অসহায়ের খেতাব নিয়ে বসে আছি। উনি হুতুমের মতো গাল ফুলিয়ে চোখ জোড়া একদিকেই আবদ্ধ করে গাড়ি চালাচ্ছেন। বাসায় ফিরছি। কিন্তু রোড তো অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে না উনি বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন । সেই থেকে মা-রা-ত্ম-ক পর্যায়ে রে-গে আছেন। তখন থেকে এখনও অব্দি অ থেকে আ পর্যন্ত কোনো শব্দই করেননি। ভ-য় হচ্ছে, কেননা কোনো ঝ-ড়ে-র পূর্বাভাস প্রথমে এমন থমথমেই হয়! আঁড়চোখে উনাকে দেখে চলেছি ঘন্টা খানিক হবে। রা-গী রা-গী লুকে উনাকে বেশ লাগছে দেখতে। ব্লু রঙের শার্টটাতে নিদারুন মানিয়েছে। রা-গে চোখে মুখে যেন লালচে রঙ উপচে পড়ছে। নাকের ডগা,চোখের সাদা অংশ, ঠোঁট, কপালের মাঝ খানে সব জায়গাতেই টগবগ করছে রা-গ। বাম হাতে একটা কালো বেল্টের ঘড়ি ছিলো। আমি কোমল স্বরে বলেছিলাম,
—-” আপনার ঘড়িটা খুব সুন্দর।”
ব্যস,এর প্রতিত্তোর ছিলো গাড়ির পেছনের সিট। উনি রা-গে কটমট করতে করতে হাত থেকে ঘড়িটা খুলেই ছুড়ে মা-র-লে/ন পেছনে! ভাগ্যিস, বাইরে ফেলেননি! অহসায় ঘড়িটা এখানে ওখানে বারি খেতে খেতে সিটের মাঝে আঁটকে গেলো। আর আমি? ভ-য়া-র্ত হরিণীর মতো বাঘের থাবা থেকে পালানোর পাল্টা পথ খুঁজছিলাম। কিন্তু আখেরে লাভ হওয়া আর কপালে জুটলো না। উনার চোখের গরম চাহনিতেই হাত,পা, মস্তিষ্ক সব ঠান্ডা করে লেপ্টে রইলাম সিটের সাথে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ? আর যে এভাবে চুপ করে থাকতে পারছিনা! পেটের মধ্যে কথারা শুধু আফসোসই ম//রে যাচ্ছে। কত কত কথা যে মিস হয়ে যাচ্ছে!
সমস্ত ভয়কে পাশে চাপিয়েই ঠোঁট উল্টে তাকালাম উনার দিকে। গলার স্বরটা অসহায়ত্বের চূড়ায় পৌঁছে নিয়ে বলে উঠলাম,
—-” আমি পানি খাবো প্লিজ! অনেক্ষন যাবৎ পানি পিপাসায় গলা শুঁকিয়ে কাঠের মতো খটখট করছে।”
উনি কিছু না বলেই আচমকা গাড়ির ব্রেক কষলেন। পরিস্থিতি কিছু আন্দাজ করার পূর্বেই সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে গেলাম আমি। যতক্ষণে সোজা হয়ে বসলাম ততক্ষণে উনি গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। হঠাৎ কিছু না বলেই আমার পাশের দরজাটা খুলে আমাকে হেঁচকা টেনে বের করে আনলেন। যা ঘটছে তার কিছুই আমার মস্তিষ্ক ধারন করতে সক্ষম হচ্ছে না!! আমি হেলতে দুলতে নিজেকে সামলে নিতেই, উনি আমাকে উনার রূপে এসে শক্ত করে গাড়ির দরজার সাথে চেপে ধরলেন। চোখের মাঝে আ-গু-নে-র ফুলকি গুলো নাচছে যেন। ভ-য়ে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল হাওয়া বইছে। আমি ঢোক গিললাম। কথা বলার জো তো নেই এখানে। বরং উনার হাতে কষিয়ে কয়েকটা থাপ্পড় খাওয়ার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া উত্তম।
—-” তোমাকে পৈপৈ করে বারন করার পরও তোমার আমার কথা শুনতে ইচ্ছে হয়না তাই না? তুমি তো ঠিকই করে নিয়েছো রাহিয়ান যা বলবে তা আমাকে বিনাবাক্যে অমান্য করতে হবে। করতে হবে মানে করতেই হবে। রাহিয়ান যদি বলে বামে হাঁটবে না তবে তোমার কাছে মনে হবে ডানে কাটা বিছিয়ে আছে অতএব আমাকে বামেই হাঁটতে হবে!”
উনার ঠান্ডা গলার আওয়াজে রাগের বহিঃপ্রকাশ বিন্দু মাত্র নেই। আমার বেশ সুবিধা হবে কথা বলতে। আমি মনে মনে খুশি হয়ে আসমান ছুঁয়ে কিছু বলতে যাবো তার মধ্যেই উনি আমার সমস্ত খুশিতে এক বালতি কাঁদা ছিটিয়ে ধাম করে বারি বসালেন গাড়ির উপর। আমি আঁতকে উঠে লেপ্টে গেলাম গাড়ির সাথে। ভ/য়া/র্ত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলাম। উনি নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরেই আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরলেন। আমরা দু’জনেই কাঁপছি, উনি কাঁপছেন রা-গে আর আমি কাঁপছি ভ-য়ে। উনি রা-গে-র বিশাল বিশাল কু-ন্ড-লী পাকিয়ে আমার দিকে ছুড়ে মে-রে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
—-” খুব শখ না কেশবের সাথে খেজুরে আলাপ করার। সেদিন থেকেই দেখছি ওর সাথে তোমার হেলেদুলে আলাপ। আমি তোমাকে বারন করেছি নিধি ওর সাথে তুমি কোনো কথা বলবেনা! ওর থেকে তুমি দূরত্ব বজায় রাখবে। কিন্তু না! তুমি আমার কথার তোয়াক্কা না করে ওর সাথে ক্যানটিনে গিয়ে একসাথে বসে খাবার খাচ্ছো। হেসে হেসে কথা বলছো! আচ্ছা তোমার সমস্যা কি বলো? তুমি কেন ওর সাথে কথা বলছো? ওকে তোমার ভালো লেগেছে? বিয়ে করবে ওকে? ইয়াপ, ভালো না লাগারও তো কারন নেই! হি লুক লাইক আ হিরো! এজ লাইক মেয়েদের স্বপ্নের নায়ক! তোমারও মেইবি তাই? তো যাও না ওর কাছে? কেন এসেছো আমার সাথে আলগা পিরিত দেখিয়ে কথা বলতে? কেন বসেছো আমার গাড়িতে? এখন তো তোমার ওর সাথে ঘোরার কথা। সে তো তোমাকে কফির জন্য ট্রিট দিতে চেয়েছে! গেলেনা কেন ওর সাথে? তোমার স্বপ্নের হিরোর সাথে? একটা কথা জানো তো? তোমাদের মতো মেয়েদের থেকে না এর থেকে বেশি আশা করাও বোকামো! কোনো একটা ছেলে এসে একটু হেসে হেসে কথা বলেছে কি? তোমরাও ফিদা হয়ে যাও! গায়ে পড়ে আলগা পিরিত শুরু করে দাও।”
কথা না বললেও বেশ বুঝতে পারলাম আমার গলা জড়িয়ে এসেছে৷ চোখ জোড়াও টলমল করছে পানিতে। জড়ানো গলায় ঢোক গিলে উনার চোখে চোখ রেখে বললাম,
—-” ম্ মানে! আপনার আমাকে এমন মেয়ে মনে হয় রাহিয়ান? আপনার মনে হয় আমি কোনো ছেলের সাথে নিৃ থেকে গিয়ে আলগা পিরিত করি! আপনি সবার সাথে..”
কথাটা শেষ হলো না আমার! তার পূর্বেই দিগুন রাগ নিয়ে তাকালেন আমার দিকে! আমার গলা থেমে গেলো ঠিক ওখানেই! উনি আমাকে নিজের সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বাতাসের গতি থামিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। আমি বোকার হদ্দ দাঁড়িয়ে রইলাম। দুই মিনিটের মাথায় রাস্তা টা পুরো ফাঁকা হয়ে গেলো। আমাদের গাড়িটা ব্যতীত আর কোনো গাড়িও ছিলো না৷ জনমানবশূন্য জায়গাটা। কাঠফাটা রোদের মধ্যে আমি এক অসহায় ব্যতীত দূর-দূরান্ত অব্দি একটা পাখিও দেখা যাচ্ছে না।
চোখ জোড়া আমার জ্ব-লে-পু-ড়ে যাচ্ছে। মানুষটার এতো কিসের রা-গ আমার উপর? খুব বিশ্রি ভাবে কান্না পাচ্ছে আমার। বার বার ফুঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে কান্নার বেগ চাপাতে। কিন্তু আমি কাঁদতে চাচ্ছি না! নিধি এতো সহজে কারোর জন্য চোখের জল ফেলেনা। অসম্ভব! যে পথ ধরে এলাম সে পথেই হাঁটা ধরলাম। সামনের পথ জানা নেই! তাই পেছনের পথ ধরে গেলেই কোনো কিছু ঠিকই পেয়ে যাবো!
হাঁটতে হাঁটতে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালাম। সময় ঠিক ৩ টার উপর স্থীর হয়ে আছে। আশেপাশে রোদের ভ্যাপসা গরম ব্যতীত কিছুই নেই। একটা ঠ্যালা গাড়িও চোখে পড়ছে না। চাতক পাখির মতো দৃষ্টি ঘুরিয়েও বিশেষ লাভ হলো না। পায়ে হেঁটে হেঁটে অবশেষে আবারও ভার্সিটির সামনে এসে পৌছলাম। আশেপাশে তাকাতে দেখি এখানেও কোনে রিক্সা নেই! এবার সত্যি ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে এর আগে কখনি পড়িনি আমি। আর এরকম একটা মানুষ জীবনে থাকলে এর থেকে ভালো পরিস্থিতি আশা করাও পা-প। উনার এতো রা-গ, এতো ধারালো কথা আমি কিছুতেই স-হ্য করবো না। অসম্ভব! আবারও হাঁটতে লাগলাম!
আমিও এতো সহজে হার মানার মেয়ে নই! উনার রা-গ, অভিমান সবই একদম ঠেসে ভরপুর। তবে উনারও বোঝা উচিৎ নিধিও কিছু কম যায় না! কেউ অযথাই নিধিকে ভুল বুঝে একশটা কথা শুনিয়ে যাবে আর নিধি সেটা মুখ বুঝে সহ্য করবে সেটা তো হতে পারেনা!
বাসার কলিং বেল চাপতেই তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে এসে দরজা খুলল রানি। দরজার এপাশে আমাকে দেখবে তা যেন ওর কাছে অকল্পনীয় ছিলো। খুশিতে উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরেই চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
—-” নিধি আফা আফনে আইসচেন বাড়িত। কদ্দিন আফনেরে দেখিনই আফা। আর যে কি খারাব লাগত কি খারাব লাগত কিতা কইতাম আর আফা। ডেইলি ডেইলি আফনে গো রুমেত গিয়া সব ঝাড়পোঁছ দিয়া রাইখা আহি। কবে আবার আফনেরা আইবেন হেই চিন্তায় মন খারাব কইরা বইসা থাকতাম আফা।”
আমি রানির মুখ চেয়ে ম্লান হাসলাম। ওর মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বললাম,
—-” আমিও তোকে খুব মিস করেছি পা-গ-লী। বাসার বাকিরা কোথায়? নিতু আপু, হিমেল ভাই, চাচা-চাচী?”
রানি আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমাকে বসতে বলে বলল,
—-“আফনে বহেন আগে আফনের পানি দেই! কয়ডা দিনে কেমনে করি শুগায় গেছেন আহারে! ঐবাড়িত কি আপনার যত্নআত্তি কেউ করে নাই?”
আমি হেসে ফেললাম। ব্যাগ আর ফোনটা পাশে রাখতে রাখতে বললাম,
—-” ও বাড়িতে আমার যে যত্নআত্তি হয়েছে তা মনে কর এই এত বছরেও নিজে করতে পারিনি! কি রে বললি না তো বাসার সবাই কোথায়?”
রানি পানি আনতে ছুটে গেলো। পানি নিয়ে এসে আমার পাশে বসতে বসতে বলল,
—-” হিমেল ভাইজান আর খালাম্মা-খালু দাওয়াতে গেছে কার বাড়িত জানি। নাম কইতে পারি না। আর নিতু আফা হের বন্ধুর বাড়িত গেছে। আইজকা মনে হয় কেউই ফিরব না!”
—-” বলিস কি? কবে ফিরবে তাহলে?”
—-” হেয়া তো কয়নাই। আমারে খালি কইয়া গেছে আমার থাহনের যদি বেশি সমস্যা হয় তালে জানি আই আর দাদীরে ফোন করায় আনি। এহন তো আর লাগতো না! আফনে আইসা গেছেন। এহন আই নিশ্চিন্ত।”
আমি ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বাসায় কেউ নেই। দুই এক দিনে আসবেও না! কিন্তু আজই তো বাবা আসবে। আর বাবার জন্য সব খাবার গুলোও তো রাঁধতে হবে। আমি একা একা কি করে সবটা সামলে রাঁধব!
—-” ও আফা কি ভাবেন?”
রানির ডাকে ভাবনার সুতো ছিঁড়ল আমার। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ম্লানমুখে বললাম,
—-” আর দুই ঘন্টা বাদে বাবার ফ্লাইট! বাবা দেশে ফিরছেন। আর আমি কাল বিকেলে বাবাকে বলেছি আমি তার জন্য সব পছন্দের খাবার গুলো রাঁধব। সেটাই ভাবছি! চাচী থাকলে আমার একটু সুবিধা হতো। কিন্তু এখন যে চাচীও নেই!”
রানি মুখ টিপে হাসলো। আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও বলল,
—-” এই নিয়া আফনের এতো চিন্তা? আরে আমি থাকতে আফনের কোনো চিন্তা করা লাগব এ যে অসম্ভব! হুনেন আফা আই হইলাম আফনের এসিস… এসএস… ঐ কি জানি কয়না?”
—-” এসিস্ট্যান্ট?”
—-” হ হ ঐডা! আমি আফনের এসিস্ট্যান্ট হইমু! ঠিকাছে?”
আমি হেসে উঠে বললাম,
—-” আচ্ছা ঠিকাছে। তুই থাক আমি চেঞ্জ করে আসছি। এসে দুজনে মিলে জমিয়ে রান্না করব কেমন?”
রানিও হেসে মাথা দুলালো। আমি ব্যাগ আর ফোন নিয়ে চলে এলাম নিজের রুমে। চেঞ্জ করে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ চোখ পড়ল আমার ডান হাতের মাঝে ছোট্ট তিলটা। তিলটা দেখতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। বেশ অনেকদিন পর আবারও এই তিলের দর্শন মিলল। তিলটাকে নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করবো এমন সময় বেজে উঠলো ফোনটা। গবেষণা মাঝপথেই বন্ধ করে ফোনটা হাতে তুলে দেখলাম আননোন নাম্বার! নিশ্চয়ই রাহিয়ান! মেজাজটা হঠাৎই বিগড়ে গেলো। উনার কল ধরার প্রশ্নই আসেনা। কলটা কেটে দিয়ে বড় খালামনির নাম্বারে টেক্সট করলাম,যেন বাবাকে নিয়ে সরাসরি আমাদের বাড়িতেই আসা হয়!
ম্যাসেজ সেন্ড হতেই ফোনটা সুইচঅফ করে দিলাম। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা ওখানেই ফেলে রেখে নীচে চলে গেলাম বাবার জন্য রান্না গুলো কমপ্লিট করতে।
#চলবে____________________
[ বিঃদ্রঃ ডক্টর আমাকে বলেছেন বেশি হলে এক ঘন্টা ফোন টিপতে। অথচ আমি জিনিয়াস কেবল একঘন্টা ফোনটাকে রেস্ট দেই🌚 ]#প্রেয়সী 🤎(২৮)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৫৪.
রাত ৯টা। রান্নার কাজ সব কমপ্লিট করেই এসে বসলাম আমার ছোট্ট ব্যালকনিতে। নিজের রুম, নিজের বিছানা, নিজের ব্যালকনি সব কিছুতেই যেন অন্যরকম শান্তি। এতোদিন ধরে ঐবাড়িতে পড়ে না থাকলেও আহামরি কিছু ঘটে যেত না। বরং ওমন র/গ/চ/টা মানুষের থেকে নিজের দূরত্ব ঠিকই বজায় রাখতে পারতাম। উনি অযথা আমার সাথে এমন ব্যবহার করবেন এটা আমি কিছুতেই মেনে নিবোনা। কেননা উনারও এবার বোঝা উচিত নিধির আত্মসম্মান বোধ সদাসর্বদা একটু বেশি।
দুপুরের ব্যাপারটা মনে পড়লে মনের মধ্যে এখনও এক অসহ্য য-ন্ত্র-ণা হচ্ছে। আমারই ভুল! সব কিছুতে নিজেকে এতোটা ছোট করে ফেলা কখনোই উচিৎ নয়। আগে নিজের আত্মসম্মান পরে অন্যকিছু।
—-” নিধি আফা আফনের কল আইছে। নিতু আফা কল দিছে?”
নীচতলা থেকে রানির মুখে নিতুর আপুর কলের কথা শুনতেই জলদি করে নীচে নেমে এলাম। কিন্তু আমার ফোনতো অফ! কিসে কল দিলো তবে?
—-” আমার ফোন তো অফ! তবে নিতু আপুর কল কি করে এলো?”
গলা উঁচিয়ে রানিকে এমন প্রশ্ন করতেই রান্নাঘর থেকে ওর জবাব এলো,
—-” খালুর ল্যান্ডলাইনে কল দিছে!”
চাচার ল্যান্ডফোনে কল দিয়েছে? অদ্ভুত!! নিতু আপু কি করে জানল আমি এ বাড়িতে আছি? মনের মধ্যে খানিক অস্বস্তি নিয়েই এগিয়ে গেলাম সোফার রুমে। রানিকে অযথা প্রশ্ন করে লাভ নেই। তার থেকে বরং নিজেই দেখে নিই। ধীরগতিতে ধাপ ফেলে প্রথমেই ল্যান্ডফোনের দিকে তাকালাম। ফোনটা স্বাভাবিক ভাবেই রাখা আছে। অন্যসময় কল এলে তো পাশে উঠিয়ে রাখা হয়। তবে কি কল কেটে দিলো?
—-” নীলাদ্রিতা?”
বেশি দূরে নয়। গুনে গুনে আমার থেকে ঠিক পাঁচ হাত দূরেই অপ্রত্যাশিত মানুষটা বসে আছেন। আমি তার দিকে তাকাতে তাকাতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হঠাৎ উনাকে আবিষ্কার করব ভাবতে পারিনি। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল দু’তিনবার। বুকে হাত চেপে ভ-য়া-র্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে ভালো করে তাকালাম। শুঁকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মনে হচ্ছে না দুপুরের পর থেকে এখনও অব্দি অন্য গ্রহণ করেছেন। বাসায় ফিরেছেন তাও মনে হচ্ছে না। দুপুরে যেই ড্রেসে ছিলেন এখনও সেই একই ড্রেসে আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো উনি এখানে কেন এসেছেন?
—-” আপনি?”
কন্ঠে ভারী বিরক্তির রেশ ঢেলে জিজ্ঞেস করলাম উনাকে। উনি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালেন। শুঁকনো মুখেই চমৎকার হাসলেন। উনার হাসিতে আমারও মনটা শীতল হয়ে উঠল। কিন্তু উনাকে বুঝতে দিলাম না। মুখের ভাব একই রাখলাম, বিরক্তিকর! উনি কিছু বলার প্রয়াস চালাচ্ছেন। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আচ্ছা উনি কি কোনো কারনে আমাকে সরি বলতে চাচ্ছেন? নাকি আমার মস্তিষ্ক একটু বেশি বেশি ভাবছে।
—-” রে-গে আছো আমার উপর?”
শোনো কথা? একগাদা কথা শুনিয়ে দিয়ে যে কিনা আমাকে একলা রেখে হুড়মুড় করে চলে গেলো তার উপর রে-গে থাকবো না তো কি খুশি হয়ে লুঙ্গি ডান্স মা-র-বো? সারা বাড়িতে খুশিতে পিঠেপুলির উৎসব করে বেড়াবো? ফালতু লোক একটা! ঢং করে আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে!
আমাকে একই ভাবে চুপ থাকতে দেখে উনি ধাপ ফেলে এগিয়ে এলেন কিছুটা। মুখে এখনও সেই চমৎকার হাসি। উনার মেয়েলি ধরনের চোখ জোড়া হঠাৎ চিকচিক করছে। ভারি পল্লব ঝুঁকিয়ে বারবার চোখও ঝাপটাচ্ছেন। হাত জোড়া এবার ঝুলিয়ে দাঁড়ালেন। সরি বলার জন্য খুব আটঘাট বেঁধে দাঁড়ালেন। কিন্তু উনার সরি বলার সুযোগ আর আমিই দিলাম না। গলা উঁচিয়ে রানিকে ডেকে উঠতেই উনি অস্বস্তিতে পড়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন। রানি ওড়নার আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
—-” হ আফা কন?”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে রানিকে দিলাম এক ধমক। রানি ধমক খেয়ে চমকে উঠে মুখ কালো করে ফেললো। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার রাহিয়ানের দিকে। মুখটাকে কালো করেই কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই আমি আবারও ধমকের সুরে বলে উঠলাম,
—-” তুই একজন বাইরের লোকের জন্য আমাকে মিথ্যে বললি? এতো সাহস বেড়ে গিয়েছে তোর হ্যাঁ? হ্যাঁ রে,তুই চিনিস এই লোককে?”
রানি মাথা নীচু করে না সূচক মাথা নাড়ল। আর যা দেখে আমার মেজাজটা আরও খানিক বিগড়ে গেলো। আমি পূর্বের ভঙ্গিমাতেই বলে উঠলাম,
—-” না চিনে বাসায় কেন ঢুকতে দিয়ছিস? এই শিক্ষা পাস এ বাড়ি থেকে?ছোট থেকে বড় হলি এই বাড়িতে, অথচ মিনিমাম নিয়ম রক্ষা করতে পারিস না? যাকে তাকে যখন তখন বাড়ি বয়ে নিয়ে আসছিস? তোকে আমি শেষবার বারন করে দিচ্ছি রানি, এর পরের বার যদি এমন আর করেছিস তো আমার চেয়ে বেশি খারাপ আর কেউ হবেনা। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে রানি, তুই একজন অপরিচিত লোককে বাসায় ঢুকিয়ে আবার আমাকেই মিথ্যে বলছিস? তোর এমন কাজ যদি চাচি ঘুনাক্ষরেও টের পায় ভাবতে পারছিস কতটা রে-গে যাবে চাচি?”
রানি ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আমার দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে বলল,
—-” আর কুনো দোষ নাই আফা! উনিই কইল আফনে হেতেরে চেনেন! খুব ভালা সম্পর্ক আফনে গো। আফনে নি রা-গ কইরা আছেন উনার প্রতি তাই….”
—-” তো? তাই বলে তুই যাকে তাকে বাসায় ঢুকতে দিবি? তুই বিশ্বাস কি করে করতে পারছিস এসব আমিতো সেটাই বুঝতে পারছিনা?”
—-” ছোরি আফা আই আর এমন কাম জীবনে করুম না! আফনে খালাম্মারে কিছু কইয়েননা আফা!”
—-” কথা কম বল আর যা এখান থেকে।”
রানি চলে যেতে লাগল। আমি ওকে আবারও থামিয়ে দিয়ে বললাম,
—-” শোন, একটা প্লেট নিয়ে অল্প কিছু বিরিয়ানী আর মুরগীর রোস্ট থেকে দুই টুকরো রোস্ট উঠিয়ে রাখ। আর টেবিলের পাশে কিছু টাকা আছে, টাকা গুলো নিয়ে মতি চাচার দোকানে চলে যা। বলবি দুটো কোঁক দিতে।”
রানি চোখের জল মুছে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো বটে। কিন্তু আমি আর তাকালাম না ওর দিকে। রাহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে রীতিমতো লোহার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই তার চমৎকার হাসি খানাও আর দেখলাম না। রানিকে বকতে সময় হয়তো সে হাসিরও অবসান ঘটেছে।
—-” তুমি অযথাই রানিকে বকাঝকা করলে! আসলে আমিই ওকে… আমি নিজেই বুঝতে পারিনি! আ’ইম সো সরি! আমি চলে যাচ্ছি। এন্ড যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু বলতে চাই! আ’ইম সরি নীলাদ্রিতা! দুপুরের ব্যাপারটার জন্য আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। প্রবলেমটা আসলে আমার নিজেরই। দ্যাট ওয়াজ মাই ফল্ট।”
কথা গুলো বলেই হাঁটা ধরলেন রাহিয়ান। আমি জায়গায় স্থির থেকেই কঠিন স্বরে বলে উঠলাম,
—-” আমি আপনাকে এখানে আসতে বলেছি নাকি এখন এখান থেকে যেতে বলেছি?”
উনি পেছন মুড়ে তাকালেন না। সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন,
—-” কোনোটাই বলোনি তবে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি, আমার এখানে আসাটা একদমই ঠিক হয়নি। তাতে আমি তোমাকে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছি।”
—-” সত্যি কথা বলতে, আপনি ঠিকই ধরেছেন। প্রবলেম আসলে আপনারই। আর সেটা হলো ওভার থিংকিং এর প্রবলেম।”
পেছন মুড়ে তাকালেন উনি। চোখমুখ থেকে অপরাধ বোধ টা উঠে গিয়ে একরাশ বিস্ময় ধরা দিচ্ছে। আমি দুই পা হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাকে ভালো করে আরেকবার দেখতে দেখতে বললাম,
—-” সিঁড়ি ভে-ঙে সোজা উপরে উঠে যান। হাতের ডানে গিয়ে দেখবেন পরপর তিনটা রুম। প্রথমটা বাবার আর তার পরের টা রান্নাঘর, আর তার পরেরটা… না জানলেও চলবে। প্রথম ঘরটা তে ঢুকে বামে গেলেই ওয়াশরুম পাবেন। গিয়ে চটপট ফ্রেশ হয়ে দুই মিনিট জিরিয়ে নিবেন ফ্যান ছেড়ে। দুঃখিত, এর জন্য যে আপনার রুমের মতো স্পেশালিটি এখানে পাবেননা। আমাদের গরীবের বাসায় এসি নেই। মাথার উপর ফ্যান আছে। ক-ষ্ট করে সেখানেই আপনাকে কিছুক্ষণ কাটাতে হবে। ঠিক পাঁচ মিনিট থেকে নীচে নেমে আসবেন। আপনার জন্য খাবার দিচ্ছি টেবিলে। মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়েছে। এখন এভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে জলদি চলে যান।”
উনি মাথা নীচু করে মুচকি হাসলেন। ডান হাতটা তুলে মাথা চুলকে মৃদুস্বরে বললেন,
—-” ভাবছি মাকে বলবো ছোট মনির মেয়েটাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। যদি নিজে থেকে রাজি হও তো ধুমধাম করে বিয়েটা সেরে ফেলব, অন্যথা বছর দুয়েকের জন্য তাকে নিয়ে দেশান্তর হবো।”
আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল তার কথায়। আমি মুখে ভেংচি কেটে বললাম,
—-” এতো শখ ভালো নয় মশাই! আমি আপনাকে বিয়ে করব এটা আপনি ভাবছেন কি করে হ্যাঁ?”
উনি এবার সাদা দাঁতের ঝলক দিয়ে হাসলেন। চমৎকার হাসি তার। চোখ দুটো সরু করে বললেন,
—-” বিয়ে না করতে চাইলে জো-র করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। দেন খুব ট-র্চা-র করবো! উঠতে বসতে ট-র্চা-র চলবে তখন।”
আমার ভ্রু জুগল কুঁচকে এলো তার কথায়। আমি এক ভ্রু উঁচিয়ে বললাম,
—-” আচ্ছা? তো আপনি কি ভাবছেন শুনি? বিয়ের পর আপনি আমাকে ট-র্চা-র করবেন আর আমি অবলা নারীর মতো সয়ে যাবো? আমিও আপনাকে ট-র্চা-র করব! আপনাকে আমি না খাইয়ে ট-র্চা-র করব। না রেঁধে না খাইয়ে ট-র্চা-র করব।”
উনি ফিক করে হেসে দিলেন। একটু এগিয়ে এসে আমার কোমরে হাত চেপে গভীর চোখে তাকালেন। ঠোঁটের কোনে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে মৃদুস্বরে বললেন,
—-” তবে কি স্বীকার করে নিচ্ছো বিয়েটা আমাকেই করবে?”
আমার টনক নড়তেই ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম তাকে। বুঝতে পারছি লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছি আমি। কোনো রকম উনার থেকে পালানোর বাহানায় বললাম,
—-” অসম্ভব! আমি আপনার মতো এমন একটা মানুষকে বিয়ে করব সে প্রশ্নই উঠেনা!”
উনি হেসে উঠলেন শব্দ করে। আমি তার সামনে থেকে দৌড়ে চলে আসতেই সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
—-” আমার বড় স্বাধ হয় নীলাদ্রিতা,
একবার তোমার নিঃশ্বাস আঁটকিয়ে দেখি।”
৫৫.
বাবা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমার টলমল করা চোখ জোড়া এই দৃশ্য যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে হাত ইশারা করে কাছে ডাকছে। কিন্তু আমি বাবার কাছে যেতে পারছিনা! আমার শরীর শ-ক্ত হয়ে জমে আছে। ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে বাবা। আর আমি বাবার থেকে সামান্যই দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আকাশে চাঁদ আর মেঘেদের লুকোচুরি খেলা চলছে। সাথে মিটমিট করে জ্ব-ল-ছে শতাধিক তাঁরা। বাবা সবসময় চাঁদের থেকেও তাঁরা বেশি পছন্দ করে। সবসময় বলে তোর মা ঐ তাঁরাদের সাথেই থাকে। তাই চাঁদের চেয়েও আমার তাঁরা বেশি পছন্দ।
ঘন্টা খানিক আগে একটা খবর এলো! বড় খালামনি রাহিয়ানকে কল করেছেন। বাবা নাকি আর নেই! হঠাৎ কিভাবে কি হয়ে গেলো কেউ কিছু বলতে পারছেনা। বাবার সুস্থ স্বাভাবিক শরীরটা নাকি হঠাৎই নিথর হয়ে গেলো। এই খবরে আমার বিশেষ ভাবাবেগ ঘটাতে পারলাম না। ঠিক ঠাহরেই উঠতে পারলাম না বড় খালামনি হঠাৎ এমন মজা কেন করছেন? বাবা আর নেই মানে? এটা কেমন মজা? তারা কি জানেনা, নিধি আর যাই হোক তার বাবাকে নিয়ে মজা সহ্য করতে পারেনা! আচ্ছা আমি কি এখন নীচে গিয়ে বড় খালামনিকে জিজ্ঞেস করবো, তিনি হঠাৎ এমন মজা কেন করলেন? আর বাবা যদি নাই থাকে তবে এই যে বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে! সেটা কি করে সম্ভব হয়? আমার কি জিজ্ঞেস করা উচিৎ? নাকি উচিৎ না?
—–” বাবা? ও বাবা? কি হয়েছে গো তোমার? ওখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো? আমার পাশে এসে দাঁড়াও না! দেখো না আজ আকাশে কত তাঁরাদের মেলা বসেছে? মাও এসেছে আজ! তোমার সাথে বুঝি কথা বলতে চায়? দেখো বাবা, ঐ যে তাঁরা টা? কিরকম করে জ্ব-ল-ছে দেখো? ঐ টা বুঝি মা তাই না বাবা? আচ্ছা বাবা! আমি যদি এখানে বসেই মাকে ডাকি, মা-কি শুনবে আমার ডাক? বুঝবে কি, তার নিধি তাকে ডাকছে? কথা বলবে আমার সাথে?”
বাবা মুচকি হাসছে আমায় দেখে। আমার বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠল। বাবার চুপ করে থাকাটা যেন আমাকে দু-ম-ড়ে-মু-চ-ড়ে দিচ্ছে! রা-গে দুঃখে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছে। বাবা কেন কিছু বলছে না আমাকে? আমিও যে পা-থ-রে-র মতো জমে আছি জায়গায়। বাবার কাছে এগিয়ে যেতে পারছিনা! আচ্ছা বাবার কি ক্ষিধে পেয়েছে?
—-” বাবা তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে? চলো খাবে চলো? আজ তো সব তোমার পছন্দের খাবার রেঁধেছি। তুমি কাল বললেনা? খেতে চাইলে যে? আমি তো আজ সব রেঁধেছি বাবা। জানো, আজ কিন্তু চাচির কোন হেল্প নেইনি। সব নিজের হাতে রেঁধেছি। রানি একটু আধটু কুটতে বাটতে সাহায্য করেছে। বাকি সব আমি একাই করেছি। চেখে দেখবেনা স্বাদ কেমন হলো? আমি জানি খারাপ হয়নি! বাবার জন্য রেঁধেছি খারাপ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কি বলো?”
কথা গুলো বলে নিজে নিজেই হেসে উঠলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি পা-গ-ল হয়ে গেছি। পা-গ-লে-র মতো করে হাসছি। এই মুহুর্তে আমার আশেপাশে কেউ থাকলে নিশ্চয়ই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলত,
—-” এই দেখ তোরা! এই মেয়েটা পা-গ-ল হয়ে গেছে। একদম পা-গ-লে-র মতো হাসছে!”
আমি মনের কথায় পাত্তা দিলাম না। নাকের ডগা লাল করে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এতক্ষণ হাঁটতে না পারা আমি হঠাৎ কি করে বাবার সামনে এসে দাঁড়াতে পারলাম তা আমায় ভাবালো না। আমি বাবার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাবা দেখতে কিন্তু আমার মতোই। শ্যামা উজ্জ্বল গায়ের রং। কিন্তু এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে যেন বাবার চেয়ে সুন্দর দেখতে মানুষ এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ইচ্ছে করছে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পারছিনা! খুব রা-গ হচ্ছে নিজের উপর। বাবা এতদিন পর সুস্থ হয়ে আমার কাছে ফিরল আর আমি কিনা বাবাকে একটা বারের জন্য জড়িয়ে ধরতে পারছিনা? মনে হচ্ছে আমার হাত পা যেন খ-সে পড়ছে শরীর থেকে। শরীরের মাংস গুলোতে অস্বাভাবিক ভাবে জ্বা-লা-পো-ড়া করছে। এক বি-দ-ঘু-টে গন্ধে বারবার গা গুলিয় উঠছে আমার! হঠাৎ বাবার দিকে চোখ পড়ল। বাবা আমার য-ন্ত্র-ণা দেখে হাসছে। দাঁত বের করে হাসছে। বাবার হাসি অদ্ভুত! ভ-য়ং-ক-র লাগছে। খুব ভ-য়ং-ক-র লাগছে। আচমকাই আমি শূন্যে ভেসে উঠলাম। আশপাশে কিছু ধরার জন্য হাত বাড়াতেই মাথায় খুব শ-ক্ত ভাবে আঘাত লাগল। ব্যা-থা-য় কুঁকড়ে গেলো আমার শরীর। জ্ঞান হারাতে বসেও অবচেতন মনটা বারবার বলে উঠছে, “আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি। আমার বাবা ঠিকাছে। আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি!
ঘরের আনাচে কানাচে ম-রা কান্না জুড়েছে মানুষ! আমি ঘুমচ্ছি না! কিন্তু কোনে এক ঘোরের মধ্যে আছি। ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছিনা! নিজের শরীরের ভারটা মনে হচ্ছে দশজন মানুষের চেয়েও বেশি। শরীর নাড়িয়ে নড়তেও পারছিনা! আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি মস্তিষ্ক ধারন করতে পারছে। কিন্তু মন বলছে সব ঠিকাছে। মাথার উপর কারোর শীতল হাতের ছোঁয়া পেয়ে মনে মনে হাসলাম! হাতটাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজেই বলতে লাগলাম,
—-” বাবা, এই মাঝরাতে আর কত রেডিও শুনবে বলোতো? দেখো কিভাবে মরা- কান্না জুড়েছে? শুনতে ভালো লাগছেনা বাবা! প্লিজ বন্ধ করো?”
আমার কথাটা শেষ হতেই কারা যেন হু হু করে কেঁদে উঠল। আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। রেডিওতে কাঁদলে সবটা এমন বাস্তব কেন মনে হবে? সবটা এতো জীবন্ত কেন লাগছে? আমার ঘোর তখনও কাটল না। চোখ খুলে আশেপাশে তাকালাম। কিন্তু ঘরের কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু কান্না গুলো এখনও বাজছে আমার কানে। দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলাম। বাবা রুমে নেই! রেডিও নেই! কিন্তু কাঁদছে টা কে?
ডানে বামে চোখ বুলাতেই দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ল। ঘড়ির কাঁটা চারটার উপর আঁটকে আছে। এখন কি বিকেল নাকি ভোর?
আচমকাই চোখের সামনে এক এক করে সব পরিচিত মুখ গুলো ভেসে উঠছে। রাই,রিম্মি আপু,নিতু আপু, ফাহিম ভাইও আছে দেখছি। ওরা কখন এলো? সবাই আমার পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। সবার চোখ মুখ অদ্ভুত ভাবে ফুলে আছে। হঠাৎ মনে হলো রাই আমার হাত ধরে আমার পাশেই বসে আছে। আরে ও না এক্ষনি ওখানে ছিলো?
কোত্থেকে রানি এসে হাজির হলো। আমায় রেখে বাকি সবার সাথে কথা বলছে। আমি ওর কথা শুনছি না! শুধু দেখছি ও বারবার ফুঁপিয়ে উঠছে। মেয়েটা অনেক কালো। আর এখন যেন আরও বেশি কালো লাগছে। রানি কথা শেষ করে একবার আমার দিকে তাকাল। আবার চলেও গেলো। রানি যেতেই রাই আর নিতু আপু আমার হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো। আমাকে নিয়েও কোথায় একটা যাচ্ছে তারা। পেছন পেছন আরও অনেক মানুষজন আসছে। সবাইকে আমি চিনিও না। আজ সবাই কাঁদছে। পরিবেশটা আমার খুব বিরক্ত লাগছে! আমি কেবল সবার কান্নাই দেখছি কিন্তু কারোর কথা শুনছিনা! বড় অদ্ভুত পরিবেশ। সিঁড়ি ভে-ঙে নীচে নামতেই আরও শতাধিক মুখ আবিস্কার করলাম। সবাই একটা সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছুকে ঘিরে বসে আছে। অনেকে কাঁদছে, অনেক তিলাওয়াত করছে। অনেকে আবার তছবিহ্ পড়ছে।
হাত ইশারা করে কে যেন ডাকছে আমায়! আমি তার দিকে তাকাতেই দেখলাম দেয়ালে টানানো ছবিটির অনুরূপ কেউ বসে আছে সাদা কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটির পাশে। মুখজুড়ে রয়েছে তার মায়াবী হাসি৷ আমি তাকে দেখতেই সে আবারও হাত ইশারায় ডাকল আমায়। আমি ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। সে মিষ্টি হেসে আমার দু’গালে হাত রেখে বলল,
—-” কি রে ক-ষ্ট হচ্ছে?”
—-” কে তুমি? আর হঠাৎ ক-ষ্ট হওয়ার কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?”
উনি হাসল। আমার কপালে আদর মাখানো ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,
—-” আমি তোর মা! আজ তোর বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি আমার সাথে করে। অভিমান রাখিস না মা। তোর বাবাই বড্ড জে-দ করেছিলো যাওয়ার জন্য! আমায় ছাড়া নাকি সে জীবন্ত লা-শে-র মতো হয়ে যাচ্ছে। তাই নিয়ে যাচ্ছি। তুইও তৈরি থাকিস! একদিন সময় করে তোকেও নিয়ে যাবো।”
বুকের ভেতর টা খা খা করে উঠল। আমি শক্ত করে সাদা কাফনের কাপড় টা চেপে ধরলাম। শরীরে যত শক্তি ছিলো সব মিলিয়েই চিৎকার করে বলে উঠলাম,
—-” আমি আমার বাবাকে কিছুতেই তোমার সাথে যেতে দিবো না। চলে যাও তুমি৷ দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। তুমি একজন স্বা-র্থ-প-র মহিলা। তুমি কখনোই আমাকে ভালোবাসোনি আর আজও ভালোবাসতে পারোনি! তুমি আজ আমার বাবাকেও আমার থেকে কেঁড়ে নিতে এসেছো! আমি যেতে দিবো না আমার বাবাকে! ছাড়ো, ছাড়ো আমাদের! আমার বাবাকে ধরবেনা তুমি! একদম ধরবেনা! আ..আমার বাবাকে প্লিজ ছেড়ে দাও! প্লিজ ছেড়ে দাও আমার বাবাকে! দেখো না মা, আমার যে বাবা ছাড়া আর কেউ নেই! আ..আআমার বাবা আমার থেকে হারিয়ে গেলে আমি কি করে বাঁচব? আমি যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো মা। আমার যে যাওয়ার মতো আর কেউ রইল না। ও মা, মা? শুনোনা, আমি ত..তোমার পায়ে পড়ি মা! প্লিজ আমার বাবাকে আমার থেকে আলাদা করে দিওনা! আমি বাবাকে ছাড়া এক দন্ডও বাঁচতে পারবো না মা! ও বাবা? বাবা? বাবা উঠো, উঠো তুমি? এভাবে কেন শুয়ে আছো? কেন শুইয়ে আছো? দেখো তোমার নিধি কিন্তু কাঁদছে বাবা! তোমার নিধির খুব ক-ষ্ট হচ্ছে! বাবা? ও বাবা? উঠছো না কেন? তুমি উঠে এই মহিলাকে বলে দাও তো, তুমি কিছুতেই উনার সাথে যাবেনা? তুমি আমার কাছে থাকবে? আমার সাথে থাকবে! সবসময় আমার সঙ্গে থাকবে। আমায় আগলে রাখবে! বাবা তুমিও যদি চলে যাও তবে আমার কি হবে? তোমার নিধি কি করে বাঁচবে! ও বাবা!! বাবা উঠো! উঠো বাবা উঠো, তোমার মিসেস খানকে জবাব দাও বাবা! কড়া জবাব দিয়ে বলো তুমি শুধু আমার কাছে থাকবে, তুমি উনার সাথে যাবে না! একদম যাবে না! বাবা উঠোওওও (চিৎকার করে)
আমার গলার স্বর আমি আর নিজেই শুনতে পেলাম না! গলা ভেঙে এখন শুধু ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ আসছে। নিজের কথা নিজেই শুনতে পাচ্ছি না। আশপাশের সবাই দেখছে আমায়। হয়তো খুব আফসোসও করছে,
—-” হায় রে, এই অ-ভা-গী-র কপালে তো বাপটাও আর রইলো না!”
#চলবে____________________
[ লিখতে গিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো😓💔 ]