আগুন ঝরার দিনে পর্ব -১০

#আগুন_ঝরার_দিনে
#পর্ব_১০

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। দীপা বারান্দায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে যে তার শাড়ি চুল সব ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে তার ভ্রুঁক্ষেপ নাই। দীপার বাবা এসে আজ ছেলেটাকে নিয়ে গেছে। ক’দিন সে নানা বাড়িতে থাকবে ।ছেলেটা তার নানা, নানুর ভীষন ভক্ত। মা ছাড়া তার চলবে তবে নানা নানী ছাড়া তার চলবে না। দীপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ভাগ্যটাই আসলে খারাপ। কারো একছত্র ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য তার কোনো দিনও নেই। এই যেমন নিজের একমাত্র সন্তান সে-ও নাকি দীপাকে বাদ দিয়ে তারা নানা নানুকে ভালোবাসে। ছোট বেলাতেও দীপার মনে হত, দীপার বাবা মা বোধ হয় তার চেয়ে বেশী তাদের বড় মেয়েকে ভালোবাসে। এসব নিয়ে দীপার মনে একটা লুকোনো কষ্ট থাকলেও একটু বড় হবার পর দীপা নিজেকে বোঝাতো এই ভেবে যে, যার সাথে তার বিয়ে হবে সেই মানুষটা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসবে।

শুরুর ক’টা বছর এমনটাই মনে হয়েছিল। আশফাকের সাথে তার সময়গুলো অদ্ভুত রোমান্টিকতার মধ্যে দিয়ে কেটে যাচ্ছিল। তবে ধীরে ধীরে সব কিছু বদলে গেল। আশফাক তার ব্যাংকের জবটা ছেড়ে দিয়ে ভার্সিটিতে জয়েন করল। অসম্ভব মেধাবী ছিল বলে ভার্সিটিতে জয়েন করার পর খুব সহজেই তার প্রমোশন হয়ে গেল। অবাক হলেও সত্যি, ভার্সিটিতে জয়েন করার পর আশফাকের চেহারাটারও যেন পরিবর্তন হলো। আগেও সে হ্যান্ডসাম ছিল তবে তার চেহারার মাঝে কী যেন ছিল না যার কারনে তার চেহারাটা সবাইকে আকৃষ্ট করত না। কিন্তু আশফাকের চেহারায় সেই “ছিল না” ভাবটা ভার্সিটিতে জয়েন করার পর কীভাবে যেন কেটে গেলো। দীপা অনেক ভেবে বের করেছে, আসলে একটা ভালো প্রফেশন, নিজের জবের প্রতি চূড়ান্ত রকমের ভালো লাগা একজন মানুষকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। আশফাকের ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছিল। ব্যাংকের চাকরিটা সে বাধ্য হয়ে করত। বরাবরই তার ভার্সিটিতে পড়ানোর স্বপ্ন। ওদের ক্লাসে যে ছেলেটা ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট হয়েছিল সেই ছেলেটারই আসলে ভার্সিটির এই চাকরিটা করার কথা ছিল। তবে সেই ছেলেটা চাকরিতে জয়েন করার কয়েক মাসের মধ্যে দেশের বাইরে একটা স্কলারশীপ পাওয়ায় সে চাকরি ছেড়ে চলে যায় আর তারপরেই চাকরিটা হয় আশফাকের।

দীপার মাঝে মাঝে মনে হয়, আশফাকের এই চাকরি হওয়াটাই তাদের সম্পর্কের জন্যে কাল হলো। নিত্য নতুন মেয়েদের, সহজ বাংলায় বলা যায় নিত্য নতুন ছাত্রীদের ফোন, ম্যাসেজ আশফাককে আমুলে বদলে দিল। এই বদলে যাওয়াটা তবুও মেনে নেয়ার মত ছিল তবে ক’দিন যাবত যা ঘটছে সেগুলো কিছুতেই মেনে নেয়ার মত নয়। আশফাকের মোবাইল এখন পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা। স্বাভাবিকভাবেই এই পাসওয়ার্ড দীপা জানে না। আগে কখনো এমনটা হয়নি। এর আগে ফোন লক করার প্রয়োজন কখনো আশফাকের পড়েনি। এছাড়াও আশফাকের এখন রোজ ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়। দীপা এসব পরিবর্তন গুলো খুব ভালো মতই টের পাচ্ছে। সব কিছু বোঝার পর কষ্টে তার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কোনো মেয়েই চাইবে না তার এত দিনের সাজানো গোছানো সংসারটা ভেঙ্গে যাক। দীপাও এর ব্যতিক্রম নয়। সে যে কোনো মূল্যে তার এই সংসারটা বাঁচাতে চায়। তাই এবার সে অনেক ঠান্ডা মাথায় কাজ করছে। অহেতুক আশফাকের সাথে ঝামেলা করছে না। কারন সে খুব ভালো মতই জানে এবারের ব্যাপারটা অনেক জটিল। সে কোনো পাগলামী করলে, ঝামেলা করলে হিতে বিপরীত হবে।

দীপা বারান্দা থেকে এসে ভেজা শাড়িটা পাল্টালো। ভেজা চুলগুলিও ভালো মত আঁচড়ালো। অনেক দিন হলো আশফাক তার কাছাকাছি আসে না। এর মাঝে যে দু একবার এসেছে সেটাও দীপার আগ্রহের কারনেই এসেছে। এই মুহূর্তে দীপার নিজের প্রতি খুব করুণা হলো। আজকেও সে আশফাকের জন্য নিজেকে সাজাচ্ছে। তবে এমনটা হবার কথা ছিল না। স্বাভাবিক ভাবে পুরুষেরাই নারীদের কাছাকাছি আসে, তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের বিশেষ ভাবে কামনা করে। নিজের ভাবনায় দীপার আবারও খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বর্তমানে সে আসলে আশফাকের কাছে কোনো নারী নয়। সে এখন আশফাকের কাছে তার বিয়ে করা বউ। যার জায়গা আপাতত আশফাকের সাজানো এই সংসারে। তার হৃদয়ে যার কোনো ঠাঁয় নেই। দীপার এসব এলোমেলো ভাবনার মাঝে কলিংবেল বাজল। আশফাক এসেছে। দীপা দরজাটা খুলল। দীপা খেয়াল করল, অন্যদিনের মত আজকেও আশফাকের শরীর দিয়ে অচেনা পারফিউমের গন্ধ ভুরভুর করে আসছে। দীপা সব বুঝেও স্বাভাবিক রইল।

নরম গলায় বলল, এত দেরী হলো যে? এক্সট্রা ক্লাস ছিল বুঝি?

আশফাক এক কথায় উওর দিল, হ্যাঁ।

দীপা আবারো বলল, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার গুছাচ্ছি।

চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আশফাক জিজ্ঞেস করল, বাবু কই?

– বাবা আজ বিকেলে এসে ওকে নিয়ে গেছে।

– হঠাৎ? কোনো অকেশন আছে নাকি?

– তোমার ছেলের নানুর বাড়িতে যাবার আবার কোনো অকেশন লাগে নাকি? আর কোনো অকেশন থাকলে তুমি যেতে না? আমি যেতাম না?

আশফাক আর কথা বাড়ালো না। সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেল।

অনেকদিন পর সেই বিয়ের শুরুর দিনগুলোর মত আশফাক আর দীপা মুখোমুখি খেতে বসেছে। আজকাল ছেলেটাকে খাইয়ে দীপা যখন খেতে বসে ততক্ষণে আশফাকের খাওয়া হয়ে যায়। সারাদিন পর রাতের এই একবেলা খাওয়াটায় আশফাকের বাড়িতে খাওয়া হয়। এদিকে ছেলেটাও অনেকক্ষণ ধরে ঝামেলা করে খায়। আশফাকের আর ততক্ষণ পর্যন্ত দীপার জন্যে অপেক্ষা করার ধৈর্য্য থাকে না। সে একাই রাতের খাবারটা খেয়ে নেয়। এতদিন পর দীপার সাথে খেতে বসে আশফাকের মনে হলো, কাজটা ঠিক হয়নি। মেয়েটা সারাদিন বাসায় একা থাকে। সে না থাকলে তার সংসারটা এত চমৎকার ভাবে সাজানো গোছানো থাকত না। তার বাসায় যারাই বেড়াতে আসে তারাই তার সাজানো গোছানো সংসার দেখে মুগ্ধ হয়। এসব কিছুর সব কৃতিত্ব দীপার একার। সে কখনোয় এসব কাজে দীপাকে সাহায্য করেনি। মাসে মাসে এক গোছা টাকা দিয়ে আর মাঝে মাঝে বাজার করার মধ্যে দিয়েই সে তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এমনকি আশফাকের বাবা মাও তাদের পুত্রবধূর উপর সন্তুষ্ট যা কিনা এই বাঙালি সমাজে বিরল। ধরতে গেলে, দীপার একটাই সমস্যা। আর তা হলো, তার প্রচন্ড রাগ আর সে খুব ঝগড়াটে এবং সন্দেহবাতিক। যদিও রুহীর ব্যাপারটা নিয়ে সে বোধহয় এখনো কিছু আঁচ করতে পারেনি। আঁচ করতে পারলে তার খবর ছিল। আশফাকের ভাবনার মাঝে দীপা তার প্লেটে আরেক টুকরো বড় মাছ তুলে দিল। দীপা আজ বোয়াল মাছের দোপেঁয়াজা করেছে। আশফাক খেয়াল করল, আজ টেবিলের সব খাবার তার পছন্দের। আশফাক মনোযোগ দিয়ে দীপাকেও খেয়াল করল। দীপাকে বেশ শুকনো দেখাচ্ছে। চোখের নীচেও ঘন কালো দাগ পড়েছে যেন অনেক রাত সে আরাম করে ঘুমায়নি। এমনিতে দীপা তার সৌন্দর্য্যের ব্যাপারে খুব সচেতন। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে দীপা নিয়মিত রূপচর্চা করে। সেই দীপার চেহারার এই অবস্থা দেখে আশফাক বেশ অবাক হলো। তার মনে হলো, দীপার শরীর খারাপ করেনি তো?

আশফাক চিন্তিত গলায় বলল, তোমার শরীর ঠিক আছে দীপা?

দীপা তার থালায় মাখানো ভাত খুঁটতে খুঁটতে বলল, আমার শরীরের আবার কী হবে? আমি ঠিক আছি।

– তোমাকে দেখতে খুব শুকনো লাগছে। তাছাড়া তোমার চোখের নীচেও ঘন কালো দাগ পড়েছে। রাতে ভালো ঘুম হয় না তোমার? কোনো কিছু নিয়ে কি খুব দুশ্চিন্তা করছো?

আশফাকের কথা শুনে দীপা নিজেকে আর সামলাতে পারলো না । সে এই মুহূর্তে আশফাকের সামনে নিজের দুর্বলতার কথা কোনোভাবেই প্রকাশ করতে চায়নি। সে কোনো ভাবেই আশফাককে বোঝাতে চায়নি আশফাকের গোপন প্রনয়ের কথা সে খুব ভালো মতই আঁচ করতে পেরেছে। কিন্তু দীপা নিজের কাছে হেরে গেলো। সে এঁটো হাতেই আশফাকের উপরে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আশফাককে কামড়িয়ে, খামচিয়ে প্রায় ক্ষতবিক্ষত করে বলল, কীভাবে পারলে তুমি? বোলো, তুমি কীভাবে পারলে? কারো সাথে সর্ম্পকে জড়ানোর আগে একবারও আমার কথা ভাবলে না তুমি? তোমার সন্তানের কথা তুমি একবারও ভাবলে না? কীভাবে পারলে তুমি আশফাক? কীভাবে?

“চলবে”

আমার লেখা পড়তে ভালো লাগলে ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আমার থ্রিলার উপন্যাস “ত্ন” বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি, বুকমার্ক, প্রজ্ঞা, ধী ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে। “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here