তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব ১৮+১৯+২০

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৮

” তূর্ণ ভাইয়া! আজ একটা সত্যি জানতে চাই। আমাদের বিয়ের পেছনে লুকায়িত সত্যিটা কি? কেন বিয়ে হলো আমাদের? সে রাতে এক্সাক্টলি কি হয়েছিল? ”

একসাথে এত প্রশ্ন! হতবিহ্বল হলো আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ!
.

আঁধার রজনী। সিঙ্গেল সোফায় বসে মোবাইল স্ক্রল করছিল তূর্ণ। সেসময় কক্ষে প্রবেশ করলো দুয়া। ওর হাতে প্লেট তাতে ফলমূল। মেয়েটা আপেল খেতে খেতে বিছানায় বসলো। তূর্ণ’র দিকে তাকিয়ে শুধালো,

” ফল খাবে? ”

মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওর দিকে তাকালো তূর্ণ।

” হুঁ? ফল? ”

” হাঁ। খাবে? ”

” দে। ”

দুয়া বসে থেকেই প্লেট বাড়িয়ে দিলো‌। তাতে খ্যাক করে উঠলো তূর্ণ।

” তুই কেমন বউ রে পুতলা? একশো গজ দূরে দাঁড়িয়ে পতিভক্তি দেখাচ্ছিস! কাছে আয়। ”

হাত বাড়িয়ে কাছে আহ্বান জানালো সে। অজানা অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে গেল। ক্ষীণ স্বরে বললো,

” এখানেই ঠিক আছি। ”

” আবার? স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করছিস? আল্লাহ্ পাপ দেবে। আয়। ”

কঠিন বাক্যে মেয়েটা মিইয়ে গেল। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। গুটিগুটি পায়ে প্লেট হাতে নিয়ে স্বামীর পানে অগ্রসর হলো। কাছে পৌঁছাতেই তূর্ণ বললো,

” বস। ”

সোফার হ্যান্ডেল ইশারা করে বসতে বললো। তাতে বেশ অবাক হলো দুয়া! তূর্ণ এসব কি বলছে! এতটা সন্নিকটে বসতে বলছে। তারা তো অন্য সবার মতো স্বাভাবিক দম্পতি নয়। এখনো দু’জনের মধ্যে যথেষ্ট দ্বিধা বিদ্যমান। তবুও এত কাছে বসতে বলছে! কেন? দ্বিধাদ্বন্দ্ব একপাশে রেখে দুয়া বসলো। সিঙ্গেল সোফার হ্যান্ডেলে। দু’জনার হাত প্রায় ছুঁই ছুঁই। ভেতরে ভেতরে কেমন ভিন্ন অনুভূতি ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। দুয়া আস্তে করে হাতে থাকা প্লেটটা বাড়িয়ে দিলো।

” ফল। ”

তূর্ণ মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই দু’টো শব্দে নিজের ইচ্ছে ব্যক্ত করলো।

” খাইয়ে দে।‌ ”

” হা! ” বিস্ময়ে অভিভূত দুয়া!

” তোর কানে কি আজকাল প্রবলেম দেখা দিয়েছে? একবার বললে শুনতে পাস না? বললাম খাইয়ে দে। ”

দুয়া আপত্তি পোষণ করতে গিয়েও করলো না। মানুষটা তার অর্ধাঙ্গ। একান্ত আপনজন। ধীরে ধীরে তার সনে স্বাভাবিক হতে হবে। সেটা না হয় এখন এই মুহুর্ত থেকেই আরম্ভ হোক! দুয়া হাতে এক পিস আপেল নিয়ে তূর্ণ’র মুখের কাছে ধরলো। হাতটি কেমন কম্পিত হচ্ছে। স্থির থাকতে নারাজ। তূর্ণ তা লক্ষ্য করে স্মিত হাসলো। মেয়েটির কবজি স্পর্শ করে হাতে থাকা আপেলে কা’মড় বসালো। কবজি ছুঁয়ে পুরুষালি হাত। দুয়া’র অনুভূতির দল আজ প্রজাপতির ন্যায় পাখনা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল। নাম না জানা অনুভূতিতে শিহরিত তনুমন। এ কেমন মন কেমনের অনুভূতি? এমনটি তো ইতঃপূর্বে উপলব্ধি হয়নি! মানুষটি তো তার বড্ড চেনা। তার সঙ্গ লাভে কেটেছে কত বর্ষ! অগণিত মুহূর্ত। কখনো তো এমনটি অনুভূত হয়নি! তবে আজ এ কি হচ্ছে হৃদয়ে! তূর্ণ সময় নিয়ে আস্তে ধীরে আপেল খাচ্ছে। এত ধীরগতিতে খাচ্ছে যেন মাছ খাচ্ছে। মাছে কাঁটা, তাড়াহুড়ো করলে গলায় বিঁধে যাবে। দুয়া তো অস্বস্তিতে কুপোকাত। পারছে না এখান থেকে পলায়ন করতে। হঠাৎ ওর মাথায় বুদ্ধি উদয় হলো। গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো স্বামীর। মিষ্টি মধুর কণ্ঠে ডেকে উঠলো,

” শুনছো? ”

” ইয়েস। ”

” একটা প্রশ্ন ছিল। করবো? ”

” ইয়েস। ”

খালি ইয়েস ইয়েস করছে। মন তো চাইছে! দুয়া মেজাজ স্বাভাবিক করে বললো,

” তূর্ণ ভাইয়া! আজ একটা সত্যি জানতে চাই। আমাদের বিয়ের পেছনে লুকায়িত সত্যিটা কি? কেন বিয়ে হলো আমাদের? সে রাতে এক্সাক্টলি কি হয়েছিল? ”

হঠাৎ এমন প্রশ্ন! সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল! ভাবতেও পারেনি তূর্ণ। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। চুপচাপ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তা দেখে দুয়া সোফায় প্লেট রেখে উঠে পড়লো। তূর্ণ’র পেছনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

” কি হলো? চুপ করে আছো কেন? বলো না ভাইয়া। আমি সত্যিটা জানতে চাই। কি হয়েছিল সে রাতে? ”

তূর্ণ গোলাকার টি টেবিলের ওপর মোবাইল রাখলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো তার মাইরা’র পানে। দুয়া ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

” বলো। ”

মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো তূর্ণ। আলতো করে দু হাতের আঁজলায় ভরে নিলো মায়াবী মুখখানি। নয়নে মিলিত হলো নয়ন।

” সে রাতে যা হয়েছিল টোটালি আনএক্সপেক্টেড ছিল। অন্যায় ছিল। আমি নিজেও এখনো কনফিউজড। বুঝতে পারছি না কি থেকে কি হলো‌। তবে চিন্তা করিস না পুতুল। ইনশাআল্লাহ্ সত্যিটা সামনে চলে আসবে। উন্মোচন হবে সব রহস্য। ততদিন পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধর। হুঁ? ”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মেয়েটি। তাতে সন্তুষ্ট হলো তূর্ণ। সম্মোহনী চাহনিতে তাকিয়ে রইলো খানিকটা সময় ধরে। দু’জনের চোখে চোখ পড়লো। হলো অব্যক্ত কত আলাপণ! কিয়ৎ বাদে মেয়েটার হুঁশ ফিরল। সম্মোহনী চাহনিতে অপ্রস্তুত হয়ে কপোল হতে হাত সরিয়ে নিলো। নিজেও কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। এতে ঘোর কেটে গেল তূর্ণ’র। সে গলা খাঁকারি দিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করে তোলার প্রয়াস চালালো। হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিমা করে দুয়া’র দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

” তখন কি বললি? ”

” কি বলেছি? কিসের কথা বলছো? ” জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে দুয়া।

” এরমধ্যেই ভুলে গেলি! কতটা ভুলোমনা রে তুই! তিন কবুল বলে বিয়ে করা পরাণের স্বামীকে শেষমেষ ভাইয়া বলে ডাকছিস! তোর চক্করে পড়ে আমার অনাগত বাবুরা তো জন্মের পর ওয়া ওয়া না করে মামা মামা করবে। স্টুপিড একটা। ”

বিস্ময়ে অভিভূত জাহিরাহ্ দুয়া! কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করতেও ভুলে গেল! এ কেমনতর কথা!

দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসুধা। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস। মূল ফটক পেরিয়ে চত্বরে প্রবেশ করলো শুভ্র রঙা গাড়িটি। বেশকিছু মেয়ে স্টুডেন্টের নজরে পড়লো তা। মুহুর্তের মধ্যেই হইচই পড়ে গেল তাদের মধ্যে। শত অপেক্ষার প্রহর শেষে গাড়ির দ্বার উন্মুক্ত করে বেরিয়ে এলো সুঠামদেহী সুশ্রী মানব। আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ! পড়নে তার কৃষ্ণবর্ণ শার্ট এবং প্যান্ট। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। খরশান চোয়াল মিঠি রৌদ্রে চকচক করছে। অধর কোলে সুক্ষ্ম হাসির রেখা। লালচে চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে রাখা। মসৃণ চুলগুলোয় হাত বুলাতে মরিয়া ভার্সিটির ওয়ান অফ দ্যা ব্রিলিয়ান্ট অ্যান্ড বিউটিফুল স্টুডেন্ট নিলাশা। মেয়েটি মোহাচ্ছন্ন চাহনিতে তাকিয়ে স্যারের পানে।

” হায় ম্যায় মা|র যাভা! স্যারকে যা লাগছে না! উফ্! ”

” আমি তো আবারো ক্রাশ খেলাম রে! ”

” একদম আগুন লাগছে! যে আগুনে দ গ্ধ হয়ে চলেছে আমার সারাটা অঙ্গন। ”

” ওই কেউ আদ্রিয়ান স্যারের সঙ্গে আমার সেটিং করিয়ে দে না! প্লিজ। ”

” স্যারকে রোজ ই চকলেট লাগে। একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। ইশ্! চকলেটটার বউ যে কোন ভাগ্যবতী হবে! ”

একঝাঁক ললনা বিমোহিত এক পুরুষে! তাদের মুখে কত কত সুমিষ্ট শব্দমালা! সেসব বরাবরের মতোই উপেক্ষা করে নিজ গন্তব্যে অগ্রসর হতে লাগলো আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ। কিন্তু তার অগোচরেই ঈর্ষার অনলে জ্বলেপু’ড়ে ছারখার হলো এক কোমল হৃদয়!

কক্ষ জুড়ে দুরন্ত পায়ে ছুটে চলেছে এক রমণী। যার হৃদয়ের অলিগলিতে জলন্ত অনল! একটুও স্বস্তি মিলছে না। কি করে যে মিলবে স্বস্তি! ভাবনা শেষ হতে না হতেই উদয় মহাশয়। ক্লান্ত বদন। শার্টের স্লিভ বোতাম খুলতে খুলতে কক্ষে প্রবেশ করছে। প্রবেশ করতে না করতেই ইনকাউন্টার! সোজা কোমল দু’টো হাত আঁকড়ে ধরলো শার্টের কলার! হিসহিসিয়ে বললো,

” শা* স্বামী! এত সেজেগুজে ভার্সিটিতে কি? হুঁ? মেয়েদের পড়াতে যাস নাকি হৃদয়হরণ করতে? আস্ত এক লু*চ্চা! মেয়েদের দেখেই রঙধনুর সাত রঙা ঢঙ শুরু হয়ে যায়? ব*জ্জাত ব্যা টা! তোকে তো আমি..! ”

হকচকিয়ে গেল তূর্ণ! আমতা আমতা করে বললো,

” দ দুয়া! কি হয়েছে! ত্ তুই তোকারি করছিস কেন? ”

” তুই তোকারি করছি কেন? জানিস না? জানিস তো শুধু লু*চ্চামি করতে। এইজন্যই প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফুসফুস ভুসভুস করে এক বোতল পারফিউম খরচা করা হয়! চুল সেট করতে লাগে এক ঘন্টা। শার্ট চুজ করতে আরো এক ঘন্টা। তোকে তো আমি.. ”

কলার ছেড়ে দু’টো হাত লালচে চুলগুলো আঁকড়ে ধরলো। টানতে টানতে দিশেহারা অবস্থা। এই বুঝি ছিঁড়ে গেল। উহ্ রে! ব্যথা!

” দুয়া! অ্যাই দুয়া! ”

পুরুষালি কণ্ঠস্বরে আকস্মিক সপ্তম আসমান ভেঙে টুপ করে ধরনীতে অবতীর্ণ হলো জাহিরাহ্ দুয়া! হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো সম্মুখে! তূর্ণ শার্ট খুলে উদোম দেহে দাঁড়িয়ে। আর সে এতটা দূরে! তার মানে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কি বি শ্রী স্বপ্ন! শেষমেষ বর তুড়ি বাজিয়ে স্বপ্ন হতে ফেরত আনলো! ছিঃ!

” আ আমি! ”

আমতা আমতা করছে মেয়েটা। তূর্ণ ভ্রু কুঁচকে বললো,

” হাঁ তুই। কোন জগতে চলে গেলি? হুঁশ ফিরলো? ”

দুয়া ভ্যাবাচাকা খেয়ে পাশ ফিরে দাঁড়ালো।

” হু হুঁশ ফিরেছে মানে কি? আমি কি বেহুঁশ? ”

” আল্লাহ্ নো’জ ওয়েল। ”

দুয়া ভেংচি কাটলো। বদ লোক একটা! স্বপ্নেই ঠিক ছিল। চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলা উচিত। সে এবার সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেললো,

” ভার্সিটিতে এত রঙচঙ করে যাওয়াটা কি আবশ্যক? ”

তূর্ণ তোয়ালে হাতে নিচ্ছিল। প্রশ্নটা শুনে থমকে গেল! সে কি ভুলভাল শুনছে! পিছু ঘুরে তাকালো তূর্ণ।

” আমায় বললি? ”

” এখানে তুমি ছাড়া কেইবা আছে? ”

তূর্ণ বক্র হেসে শুধালো,

” আমি রঙচঙ করে ভার্সিটি যাই? তা কেমন রঙ? ঠিকমতো দেখেছিস তো? ”

” অ অফকোর্স দেখেছি। ”

মেয়েটার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। তূর্ণ হাসিমুখে ওর পানে অগ্রসর হলো। আড়চোখে তা লক্ষ্য করে দুয়া হতবাক! এসব কি কাণ্ড!

” ত্ তুমি এভাবে এগিয়ে আসছো কেন? ”

” বউ পিছিয়ে যাচ্ছে বলে। ” অধর কোলে বক্র হাসির রেখা।

মেয়েটা এমন অপ্রত্যাশিত কাণ্ডে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেছে। পেছাতে পেছাতে একসময় পৃষ্ঠদেশ ঠেকলো সমতল দেয়ালে। তূর্ণ এসে থামলো সন্নিকটে।‌ খুবই সন্নিকটে। দু’জনার কায়া প্রায় ছুঁই ছুঁই। অস্বস্তিতে ডুবন্ত মেয়েটা বাম পাশ হতে সরে যাওয়ার প্রয়াস চালালো। কিন্তু আফসোস! পুরুষালি শক্তপোক্ত ডান হাতটি ঠেকে দেয়ালে। ওকে বন্দিনী করে ফেলেছে বাহুডোরে। দুয়া ভীত চোখে তাকালো স্বামীর পানে। চোখে চোখ মিলিত হলো। তূর্ণ’র অধরে মোহনীয় হাসি। চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ। আস্তে করে মাইরা’র পানে আরেকটু ঝুঁকে গেল মানুষটি। ইচ্ছাকৃতভাবে নির্গত তপ্ত শ্বাস আড়ছে পড়ছে কাঁধে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো মেয়েটি। শিহরিত হয়ে আঁকড়ে ধরলো পোশাকের একাংশ। সে মুহূর্তে ওর কর্ণ কুহরে অধর ঠেকিয়ে মানুষটি ফিসফিসিয়ে শুধালো,

” আর ইউ জেলাস মিসেস জাহিরাহ্ দুয়া? ”

কর্ণে পুরুষালি স্বর! আরেকটু গুটিয়ে গেল মেয়েটি। ওকে আরেকদফা নাস্তানাবুদ করতে চোখেমুখে আলতো করে ফুঁ দিলো তূর্ণ। যাতে নাজেহাল দুয়া’র কোমল হৃদয়। নিঃশব্দে হাসলো তূর্ণ। ঘোর লাগানো স্বরে স্বীকারোক্তি পেশ করলো,

” আই লাইক ইট। ”

‘ ছায়াবিথী ‘ এর লিভিং রুমে উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ নিজাম সাহেবের দিকে। সোফায় উনি এবং তাসলিমা পাশাপাশি বসে। নিজাম সাহেব সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন,

” আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৯

” আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী শুক্রবার তূর্ণ আর দুয়া’র রিসিপশন পার্টি হবে। ”

হঠাৎ এমন বৃহৎ সিদ্ধান্ত! পরিবারের সদস্যরা নিজাম সাহেবের কথায় কিছুটা অবাক হলো বটে।

” আব্বু সত্যিই পার্টি হবে! ” উৎফুল্ল কণ্ঠে শুধালো তৃষা।

” হাঁ। শুক্রবার রিসিপশন হবে। সেই অনুযায়ী তোমরা প্রিপারেশন নেয়া শুরু করো। শপিং করা লাগলে করে ফেলো। আমি পার্টি অর্গানাইজারের সঙ্গে কথা বলছি। ”

পুত্র ও পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে নিজাম সাহেব বললেন,

” তূর্ণ। দুয়া। তোমরা প্রিপারেশন নিতে থাকো। একান্ত পরিচিত কাদেরকে ইনভাইট করতে হবে লিস্ট করে নাজমুলকে দিয়ো‌। ও ইনভিটিশেন পাঠিয়ে দেবে। ”

তূর্ণ বাবার সিদ্ধান্তে প্রসন্ন হলো।

” থ্যাংকস আব্বু। আশা করি এবার সকলের মুখ বন্ধ হবে। ”

” হুঁ। ” মুচকি হেসে সম্মতি জানালেন নিজাম সাহেব।

নিশি ফিসফিস করে ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তৃষাকে প্রশ্ন করলো,

” তূর্ণ ভাইয়া কি বললো রে? ঠিক বুঝলাম না। কাদের মুখ বন্ধ করার কথা বলছে? ”

তৃষাও ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো,

” আরে ওই যে কূচুটি মার্কা কিছু আত্মীয়-স্বজন আছে না? সারা বছর খবর নেই। সিজনাল উদয় হয়। তাদের কথাই বলছে।‌ তারা হুট করে কিভাবে যেন ভাইয়ার বিয়ের খবর পেয়েছে। এখন দিন নাই রাত নাই ফোন করে চলেছে। কেউ কেউ তো বাজে কথাও বলছে। ভাইয়া, দুয়া’র চরিত্র অবধি চলে গেছে। ”

নিশি নাকমুখ কুঁচকে বললো,

” ইয়াক! এসব হচ্ছে আজকাল? ”

তৃষা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তাসলিমা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা তূর্ণ এবং দুয়া’র পানে তাকিয়ে বললেন,

” তূর্ণ তুমি শপিং করা শুরু করে দাও। দরকার পড়লে বন্ধুদের সাথে নিয়ে যাও। আর দুয়া? তুমি আমাদের সাথে যাবো। আগামীকাল তো ক্লাস নেই তাই না? ”

দুয়া না সূচক মাথা নাড়ল।

” ঠিক আছে। কাল আমরা শপিং যাচ্ছি। রেডি থেকো। ”

দুয়া তূর্ণ’র পানে তাকালো। চোখাচোখি হলো দু’জনার। অর্ধাঙ্গ চোখের ইশারায় অনুমতি প্রদান করলো। দুয়া মিষ্টি হেসে শাশুড়ি মা’কে বললো,

” ঠিক আছে। ”

তিমিরাবৃত রজনী। কক্ষজুড়ে পায়চারি করে চলেছে তূর্ণ। একবার টাফটেড বেঞ্চে বসছে তো আরেকবার সিঙ্গেল সোফায়। স্বস্তি মিলছে না হৃদয়ে। সমস্ত অস্বস্তির মূলে ওই অবাধ্য মাইরা। কত বড় সাহস তার? প্রিয়তম স্বামীকে না জানিয়ে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জানানোর প্রয়োজন বোধ অবধি করছে না! হাউ ডেয়ার শি! এমনটা চলতে থাকলে তো সুখময় সংসার লাটে উঠবে! চরম অবাধ্য হয়ে উঠবে সে নারী। উঁহু। এ তো হতে পারে না। এর একটা যথাযথ বিহিত করা দরকার। নইলে সাড়ে সর্বনাশ হবে। হুম। ঠোঁট গোলাকার করে তপ্ত শ্বাস ফেললো তূর্ণ। গিয়ে বসলো বিছানায়। হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে দেহ এলিয়ে দিলো। বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটি নিলো হাতে। কন্টাক্ট লিস্টে গিয়ে ফটাফট কাঙ্ক্ষিত নম্বর বের করলো। কল আইকন ক্লিক করে ফোন করলো সেই একান্ত মানুষের পানে। কল বেজে চলেছে। বাজতে বাজতে কেটেও গেল! কত্ত বড় দুঃসাহস! একে তো..! দ্বিতীয়বার কেটে গিয়ে তৃতীয়বার কল রিসিভ হলো।

” হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম। ”

খ্যাক করে উঠলো তূর্ণ। গমগমে স্বরে সালামের জবাব দিয়ে বললো,

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। পৃথিবীতে আছেন নাকি মঙ্গলে? কল রিসিভ করতে এতক্ষণ লাগে? ”

ধমকে উঠলো তূর্ণ। ওপাশে থাকা মানবী ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। কান হতে মোবাইল সরিয়ে দেখলো কলার আইডি সঠিক ই। মানে আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ ই কল করেছে। দুয়া কানে ফোন ঠেকিয়ে সুমিষ্ট স্বরে বললো,

” রাগ করেছো? ”

” একদম নয়। যে রাগ ভাঙানোর জন্য জনগণ নেই সে রাগ আসবে কি করে? নি|র্দয় মহিলা কোথাকার। ”

” আমি মহিলা! বিশ বছরের ছোট্ট একটা পুতুল কন্যাকে তুমি মহিলা বলতে পারলে? ”

দুয়া’র সে কি হৃদয় নিংড়ানো প্রশ্ন! তূর্ণ কাঠিন্য মিশ্রিত স্বরে বললো,

” অফকোর্স পারলাম? তোর মতো মহিলার মাথায় গোবর ছাড়া আছেটা কি? স্বামীর মন পর্যন্ত জুগিয়ে চলতে পারিস না। ”

পুরুষালি কণ্ঠটি একটু অভিমান মিশ্রিত লাগলো কি? অবুঝ দুয়া প্রশ্ন করেই বসলো,

” আমি আবার কি করলাম? ”

” এই জন্য। এই জন্য পোলাপাইন বিয়ে করতে নেই। কিচ্ছু বোঝে না। বোঝেনা সে বোঝেনা। ”

দুয়া অবাক কণ্ঠে বললো,

” রাতদুপুরে তোমার অরিজিৎ সিংয়ের ‘ বোঝেনা সে বোঝেনা ‘ মনে পড়ছে? তুমি এসব কি বলছো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ”

ওপাশ থেকে চরমভাবে ধমকে উঠলো।

” চুপ কর গাঁধী। স্বামীর মন বোঝে না। আবার ড্যাং ড্যাং করে বিয়ে করে নিয়েছে! বে”দ্দপ! ”

এতগুলো ধমক শুনে মেয়েটা কষ্ট পেল। কিন্তু কষ্টগুলো এক পাশে জমা রেখে সে ভাবনায় লিপ্ত হলো। আসলে হয়েছে টা কি? স্বামী মহাশয় রাতদুপুরে কল করে খ্যাক খ্যাক করছে কেন? সমস্যা কোথায়? উম্! ভাবতে না ভাবতেই সমাধান হাজির। ইয়েস এটাই বোধহয়। দুয়া এবার মেকি হেসে অতি সুমধুর কণ্ঠে শুধালো,

” আমি না বলে বাসায় এসেছি বলে রাগ করেছো? ”

ওপাশে নীরবতা! নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে দুয়া আরো মধুর কণ্ঠে সুরে সুরে বললো,

” লক্ষ্মী সোনা রাগ করে না। লা লা লা। ”

বজ্রকণ্ঠে এক ধমক! হাত ফসকে মোবাইল পড়তে গিয়েও পড়লো না। কোনোমতে ক্যাচ ধরতে সক্ষম হলো মেয়েটা। তবে কর্ণ যুগল? নষ্ট হলো বুঝি। এখনো তব্দ খেয়ে আছে। দুয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে ডান কানে কনিষ্ঠ আঙুল ঢুকিয়ে দিলো। গুঁতোগুতি করে বুঝতে পারলো কান বেচারা বেঁচে আছে। টপকে যায়নি। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল দুয়া। পুনরায় কানে ফোন ঠেকিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,

” তুমি কি গো হাঁ? এভাবে কেউ বকে? আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ কানটা তো আরেকটু হলেই ইন্না লিল্লাহ হতো! ”

তূর্ণ বেচারা ফেঁসে গেছে ভালোমতোই। বউটা এত মিষ্টি করে কথা বলছে সে তো পারছে না মিষ্টি ভেবে টুপ করে গিলে নিতে! আহা! এত মিষ্টিমধুর স্বরে কেউ বরের সাথে কথা বলে? সামনাসামনি থাকলে নাহয় কাজে দিতো। বউটা তো এখন বাপের বাড়ি। কত দূরে! অত দূরে বসে মিষ্টি মিষ্টি আলাপ করলে তার ফায়দা টা কোথায় হুঁ? সে তো এখানে তেঁতো মুখে বসে। অন্যায় এ। ভারী অন্যায়। তূর্ণ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” বাপের বাড়ি বসে মধুমাখা বাক্য ছাড়ছিস? সাহস থাকলে আমার সামনে আয়। বুঝিয়ে দেবো মধুর বাক্যের অ্যাকশন-রিয়েকশন কি! ”

দুয়া আমতা আমতা করে বললো,

” রাগ করো না।‌ আ আমি কাল ই চলে আসবো তো। ডিরেক্ট রিসিপশনে দেখা হচ্ছে ইনশাআল্লাহ্। ”

” অসম্ভব। কাল সূর্য ওঠার আগেভাগেই আমার বউকে আমি বাড়ি চাই। নইলে..! ”

” ইহ্! বললেই হলো? অত সকাল সকাল আমি আসতে পারবো না। এমন ভাব করছো তুমি মস্ত বড় বউ পা’গলা। বউ ছাড়া রাতে ঘুম আসবে না। ”

ওপাশ হতে তৎক্ষণাৎ জবাব,

” অফকোর্স আসবে না। বউ হলো বিবাহিত পুরুষের পার্সোনাল কোলবালিশ। তাকে ছাড়া ঘুম হয় নাকি? ”

দুয়া লাজুক হেসে ভেংচি কাটলো।

” ঢং। ”

তূর্ণ বক্র হেসে বললো,

” বাড়ি আসেন মিসেস। রঙঢঙ কত প্রকার ও কি কি হাতেকলমে বুঝিয়ে দেবো। ”

লাজে রাঙা মেয়েটি মোবাইল হাতে শুয়ে পড়লো। মোলায়েম স্বরে শুধালো,

” রাগ কমেছে তোমার? ”

” উম্! বোধহয় কমেছে। বউ এত আদুরে গলায় তোতাপাখির মতো বলতে থাকলে রাগ করে থাকা যায়? ”

লাজুক হাসলো দুয়া। তূর্ণ মুচকি হেসে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। বাম হাতটি মাথার তলে। দু পা সোজাসুজি করে রাখা। স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত দু বাড়ির দু কক্ষে দুষ্টু-মিষ্টি ফোনালাপে মগ্ন কপোত-কপোতী। অনেকটা সময় জুড়ে কথা হলো। এক পর্যায়ে পুরুষালি কণ্ঠে শোনা গেল এক আদেশ বাক্য,

” আমাকে না জানিয়ে ওই বাড়ি যাওয়া! শাস্তিস্বরূপ আজ রাত আমার তরে। ফোনালাপে কাটবে সারারাত।”

তমসায় আচ্ছাদিত রজনী। জমকালো আয়োজন কনভেনশন সেন্টার জুড়ে। লাইট পিঙ্ক বৃহদাকার আকর্ষণীয় সোফা। সোফার পেছনে অর্ধ বৃত্তাকার ফুলেল আয়োজন। লাল ও গোলাপী রঙা গোলাপ ফুলে মোড়ানো অর্ধ বৃত্তটি। সোফার দুই পার্শ্বে বিশালাকার ফুলের ব্যুকে। রঙবেরঙের কৃত্রিম আলোয় উজ্জ্বল চারিপাশ। অতিথিদের আগমনে মুখরিত পরিবেশ। তূর্ণ ও বন্ধুমহল এক পাশে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতায় লিপ্ত। রাজীব দাঁত কেলিয়ে হাসলো,

” কি মাম্মাহ্? বিয়া করবা না করবা না। শেষমেষ খালাতো বোন যখন বউ? ”

সশব্দে হেসে উঠলো বন্ধুরা। তূর্ণ মুখ কুঁচকে বললো,

” ফালতু ট্যাগ লাগানো বন্ধ কর। ও জন্মের সময় শুধু আমার খালাতো বোন ছিল। বড় হতে হতে হবু বউ হয়ে গেছে। ”

দানিশ মিথ্যা মিথ্যা হাততালি দিয়ে উঠলো।

” বাহ্! চমৎকার! তুমি তো মিয়া খাঁটি লু*চ্চা। পিচ্চি বুইনটারে লইয়া এসব ভাবো! ছ্যা ছ্যা ছ্যা। খালাতো ভাই নামক ক*লঙ্ক তুমি। ”

” কারেকশন। আমি কখনো ওকে আমার বোন হিসেবে পরিচয় দিছি? দিইনি তো। তাহলে এত কিসের ক্যাচাল? খামোখা দুর্গন্ধ ছড়াস না তো। ”

হাত নাড়িয়ে দুর্গন্ধ সরানোর ভান করলো সে। মনিকা হেসে বললো,

” বন্ধু দুর্গন্ধ তো একটু ছড়াবেই। আফটার অল খালাতো বোন যখন বউ। হা হা হা। ”

সবাই মিলে হেসে উঠলো। নিশাদ বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বললো,

” শা* বিয়া কইরা ফেললি অথচ বন্ধুদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না? সোজা রিসিপশনের দাওয়াত? ”

দিবা বললো,

” তা-ও কপাল। ও যে আমাদের কোলে ভাতিজা ভাতিজি তুলে দিয়ে বিয়ের খবর দেয়নি তা ই তো বহুত বড় কথা। নইলে ও যে একপিস! ও আল্লাহ্! ”

দিবা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনিকা সম্মতি পোষণ করে বললো,

” এটা আস্ত এক খা টা শ। বউটারে জ্বালিয়ে না মা”রে আবার। ”

টগর কিছু বলবার পূর্বেই রাজীব দুষ্টু হেসে বললো,

” জ্বালিয়ে মা”রবে কেন? আদর সোহাগে মা”রবে। আফটার অল আটাশ বছরের জমানো সংযম! একসঙ্গে ফাটবে কিনা! ”

তূর্ণ ভাবলেশহীন ভাবে বললো,

” কারেক্ট বলেছিস। বহু বছরের অপেক্ষার অবসান হলো। বউও আমার বড় হয়ে গেছে। এখন শুধু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সুসংবাদ পাবি। আর আমাদের স্পেস দিয়ে ভাতিজা ভাতিজি নিয়ে ঘুরতে যাবি। ”

মনিকা ভেংচি কেটে বললো,

” ইহ্! শখ কত! ”

ওদের হাসিঠাট্টা ভঙ্গ হলো এক লহমায়। তূর্ণ’র দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো এন্ট্রেন্সে। হাসিখুশি মুখখানা পরিবর্তিত হলো মুগ্ধতায়! তার পানে অগ্রসর হচ্ছে মায়াময়ী মাইরা! মাশাআল্লাহ্! সে কি রূপের বহর! চক্ষু ফেরানো দায়। মাইরা’র পড়নে ওয়াইন কালার জর্জেট কুর্তি লেহেঙ্গা। আকর্ষণীয় কারুকার্য খচিত লেহেঙ্গার দোপাট্টায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হীরার ন্যায় পাথর। পাড়ে সোনালী সুতোর ভারী কাজ‌। দোপাট্টাটির অন্তরালে ম্যাচিং হিজাব। হিজাবের উপরিভাগে শোভা পাচ্ছে আকর্ষণীয় কারুকার্য খচিত দোপাট্টাটি। দোপাট্টার একাংশ কাঁধ ছড়িয়ে নেমে এসেছে। আবৃত করে রেখেছে দেহের উপরিভাগ। সিঁথি বরাবর গোল্ড প্লেটেড ব্রাইডাল গোলাকার টিকলি। মুখশ্রীতে কৃত্রিম প্রসাধনীর ছোঁয়া। দু হাতে একজোড়া গোল্ড প্লেটেড বালা। কোমল দু হাতে অঙ্কিত মেহেদী। হাতের উল্টো পিঠে কুন্দন রিং। বাঁ হাতে ছোট্ট পার্স। সাজ সম্পন্ন। তাতেই অবর্ণনীয় মোহনীয় লাগছে! বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে রইলো তূর্ণ। ভুলে গেল জাগতিক সকল ভাবনা।

দুয়া’র দু পাশে দাঁড়িয়ে তানজিনা এবং নিশি। দু’জনে ওর দু বাহু স্পর্শ করে পরম যতনে আগলে নিয়ে আসছে। দুয়া আলতো করে মায়াবী দু চোখ তুলে তাকালো। দৃষ্টিগোচর হলো অর্ধাঙ্গের অবয়ব। ডাস্টি রোজ কালার ব্লেজার স্যুট পড়নে তার। ব্লেজারের অন্তরালে ওয়েস্ট কোট। নিম্নে শুভ্র রঙা শার্ট। গলায় টাই বন্ধনী। বাঁ হাতে ব্র্যান্ডেড রিস্ট ওয়াচ। লালচে চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। পায়ে ম্যাচিং শু। অতীব সুদর্শন লাগছে! অবাধ্য নয়ন জোড়া বারংবার চলে যাচ্ছে তার পানে। ইশ্! কি লজ্জা!

তূর্ণ’র বাঁ হাতে সফট ড্রিংকস এর গ্লাস। ডান হাত গলিয়ে রাখা প্যান্টের পকেটে। আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে মানুষটি। যার পানে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষিত হয়ে চলেছে মেয়েটির কোমল হৃদয়। বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি দ্রুতবেগে স্পন্দিত হচ্ছে। সে স্পন্দন অন্য কারোর কর্ণ কুহরে পৌঁছালো বুঝি! লাজে রাঙা মেয়েটি দৃষ্টি নত করে নিলো। তাকে নিয়ে তূর্ণ’র পাশে দাঁড় করালো তানজিনা। তূর্ণ এখনো অপলক চাহনিতে তাকিয়ে। দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটির মায়াময় মুখ জুড়ে। তা অনুধাবন করে মেয়েটি লজ্জায় আরো জড়োসড়ো হলো। তূর্ণ’র কর্ণ কুহরে বন্ধু টগর ফিসফিসিয়ে বললো,

” দোস্ত কন্ট্রোল ইয়্যরসেল্ফ। সবাই দেখছে কিন্তু। হায় কি প্রেম! ”

স্মিত হেসে তার মাইরা হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তূর্ণ। টগরের পানে তাকাতেই টগর চোখ টিপে দিলো।
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২০

” এ কেমন অবিচার দুয়া? নিজে তো আমার বিয়েতে পেটপুরে খেলি। অথচ নিজের বিয়েতে নো দাওয়াত? ”

দুয়া তার মা-বাবার সাথে কথা বলছিল। তখনই কর্ণ কুহরে পৌঁছালো পরিচিতি কণ্ঠ। খুশিমনে পিছু ঘুরে তাকালো সে। উৎফুল্ল হয়ে দ্রুত পায়ে ছুটলো। আলিঙ্গন করলো তার মামাতো বোন সিনথিপু’কে।

” আপু! কতদিন পর দেখা! ”

খুশিতে মেয়েটার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। সিনথিয়া হাসিমুখে ওকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো। দুয়া আপুকে ছেড়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো।

” আপু কেমন আছো বলো? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? ”

” বোন আমার! আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আর হ্যাঁ আসতেও কোনো অসুবিধা হয়নি। এবার দেখি দেখি আমার বোনটাকে একটু ভালো করে দেখি। ”

সিনথিয়া পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ছোট বোনের পানে। এতে র’ক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির মায়াবী মুখশ্রীতে।

” মাশাআল্লাহ্! বোনটাকে কি সুন্দর লাগছে! ”

পাশে এসে দাঁড়ালো তানজিনা।

” একদম। এজন্যই তো তূর্ণ ভায়া চোখই সরাতে পারছে না। ”

তানজিনা চোখের ইশারায় দেখিয়ে দিলো তূর্ণ’কে। মশাই অতিথিদের সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে বারবার এদিকে তাকাচ্ছে। সে কি মোহাচ্ছন্ন চাহনি! দুয়া আড়চোখে তা লক্ষ্য করে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সিনথিয়া দুষ্টু হেসে বললো,

” হায়! বিয়ের একমাস হতে না হতেই কি জাদু করিলা বনু? ”

” উফ্ আপু। ”

লাজে রাঙা মেয়েটি দুষ্টুমি আর নিতে পারছে না। বারবার দৃষ্টি অবনত হয়ে আসছে। তা লক্ষ্য করে তানজিনা এবং সিনথিয়া একত্রে হেসে উঠলো।
.

” দ্যাখো দ্যাখো। কুকাম করে আবার ঢাকঢোল পিটিয়ে রিসিপশন করছে! ”

” বিয়ে তো হয়নি। এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকছে। বোঝেন না? ”

” বুঝবো না কেন? এসব বড়লোকি দরবার। খুব জানা আছে। ”

” হাঁ। হুটহাট আকাম কুকাম করে বসবে। এরপর টাকার গরম দেখিয়ে সবটা ধামাচাপা দেবে। ”

” ছিঃ! মনে হয় এতদিন লিভ ইনে ছিল। এখন ঢঙ করে সবটা প্রকাশ্যে আনছে। ”

” ছিঃ। ”

অনুষ্ঠানে আগত দুই নারী নিজেদের মধ্যে কটূক্তি করতে ব্যস্ত। তারা তো জানেও না তাদের এই নোং রা বাক্য কারোর কোমল হৃদয়ে শূiলের ন্যায় বি দ্ধ হচ্ছে। র-ক্তাক্ত করে তুলছে অন্তঃপুর। নোনাজল জমায়েত হয়ে চলেছে অক্ষিকোলে। দুয়া যখন মনে মনে বিiধ্বস্ত ঠিক তখনই বিপদের সঙ্গী রূপে হাজির হলো আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ! মেয়েটির কোমল হাত আঁকড়ে ধরে নিয়ে গেল সে-ই কুচুটি কাকিমাদের পানে।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জনে। তূর্ণ’র হাতটি আলতো করে স্পর্শ করলো সঙ্গিনীর কটিদেশ। সেথায় হাত রেখে অধিকারের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। সহসা চমকালো মেয়েটি! শিরশির করে উঠলো গাত্র। আস্তে করে অবনত হলো লালাভ মুখখানি। তূর্ণ গমগমে স্বরে আন্টিদের উদ্দেশ্যে বললো,

” আন্টি’স! আমরা লিভ ইনে ছিলাম নাকি কাজিন, আপনারা জানলেন কি করে? নিজেদের হাই পাওয়ারি চোখ দুটোকে সিসি ক্যামেরা হিসেবে পেছনে লাগিয়ে রেখেছিলেন বুঝি? তাহলে তো বলতে হবে সিসি ক্যামেরা নষ্ট। গণ্ডগোল আছে। ভুলভাল দেখে। আমি সাজেস্ট করবো আপনারা ড. মাহমুদুর রহমানকে দেখান। হি ইজ অ্যান আই স্টেশালিস্ট।। চোখের বেশ ভালো ট্রিটমেন্ট করেন। কখনো কখনো রোগাক্রান্ত চোখ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করেও ফেলেন। বুঝলেন? আপনারা দ্রুত তার শরনাপন্ন হন। উপকার হবে। আপনার এবং পার্শ্ববর্তী দশজনের। ঠিক আছে? এনজয় দ্যা পার্টি। ”

অতি ভদ্র স্বরে অপমান বুঝি একেই বলে! আন্টি দু’জন ভোঁতা মুখে অপমান সহ্য করে নিলো। তূর্ণ গা জ্বালানো হাসি উপহার দিয়ে একান্ত সঙ্গিনীর হাতটি ধরে সেথা হতে প্রস্থান করলো। আর দুয়া! চলন্ত পথে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো স্বামীর নামক একান্ত মানুষটির পানে। মানুষটি কি সুন্দর করে তার প্রয়োজনে সান্নিধ্য দিলো। তাকে বুদ্ধিমত্তার সহিত আগলে নিলো! এমন পুরুষ ই তো সকল নারীর কাম্য! মোহনীয় দ্যুতি ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির মুখশ্রীতে! কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে একজন র ক্ত চক্ষুতে এসব দেখতে পেলো। শক্ত হলো চোয়াল। মুষ্ঠিমেয় হলো ডান হাত।
.

রিসিপশন পার্টি সুষ্ঠু রূপে চলমান। হাসিখুশিতে অতিবাহিত হচ্ছে মুহুর্ত। তূর্ণ এবং দুয়া পাশাপাশি স্টেজে দাঁড়িয়ে। আগত অতিথিরা একে একে এসে ওদের শুভকামনা জানাচ্ছে এবং নতুন জীবনের জন্য দোয়া করে দিচ্ছে। সাথে উপহার সামগ্রী তো রয়েছেই। দুয়া হাসিমুখে একজন নারী অতিথির থেকে উপহার গ্রহণ করছিল হঠাৎ নজর পড়লো সামান্য দূরে। সেথায় সাজেদা দাঁড়িয়ে।

” ফুপি! ”

দুয়া প্রসন্ন বদনে তার দিকে অগ্রসর হতে যাচ্ছিল। কিন্তু তা আর হলো না। সাজেদা তার প্রিয় ভাতিজিকে লক্ষ্য করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। সেথা হতে সরে গেল তৎক্ষণাৎ। জাবির এবং দুয়া দুজনেই এতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। জাবির দ্রুত মায়ের পিছু নিলো। আর দুয়া’র নেত্রপল্লব গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রু। তূর্ণ তা লক্ষ্য করে অতিথিদের এক্সকিউজ জানিয়ে সহধর্মিণীর পাশে এসে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে শুধালো কি হয়েছে। দুয়া নিজেকে সামলিয়ে মুচকি হাসলো। জানালো কিছুই হয়নি। তবুও প্রসন্ন হতে পারলো না তূর্ণ। মনে হলো কিছু তো হয়েছে।
.

সাজেদা এক কোণে এসে দাঁড়ালেন। ওনার আবেগপূর্ণ চেহারা মুহুর্তেই ক্ষো ভে পরিবর্তিত হলো। শক্ত হলো চোয়াল। যেই না পেছনে ছেলের উপস্থিতি টের পেলেন অমনি স্বাভাবিক রূপ ধারণ করলেন। ছলছল করতে লাগলো নয়ন জোড়া। জাবির সম্মুখে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

” মা! কি হয়েছে তোমার? তুমি এভাবে চলে এলে কেন? দুয়া কি ভাবলো বলো তো। ”

সাজেদা ন্যা কা ভাব নিয়ে আবেগী কণ্ঠে বললেন,

” আমি কি করতাম বল? সইতে পারছিলাম না এত আনন্দ ফূর্তি। এসব তো তোর আর দুয়া’র হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। আমি মানতে পারছি না যে। ওই তূর্ণ’কে সহ্য হয় না। দেখলেই.. ”

” প্লিজ মা। এমনটা বলো না। ”

” কেন বলবো না? হাঁ? ওরা দুজনে বিয়ে করে মাখোমাখো প্রেম করছে। মাঝখান দিয়ে আমার ছেলেটা বিরহে কাতর হয়ে যাচ্ছে। মা হয়ে আমি এসব সহ্য করতে পারছি না। অসহ্য লাগছে সবটা। ”

একজন অতিথি ফোনে কথা বলতে বলতে পাশে এসে দাঁড়াতেই তাদের কথোপকথনে বাঁধা পড়লো। জাবির মিহি স্বরে বললো,

” এসব কথা এখন থাক মা। চলো মামার সাথে দেখা করবে। ”

মা’কে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই জাবির মায়ের হাতটি ধরলো। হাত ধরে সাজ্জাদ সাহেবের পানে অগ্রসর হতে লাগলো।
.

দুয়া ওর বন্ধুমহলের সঙ্গে খুনসুটি করছিল। এক পর্যায়ে দুয়া বললো,

” এক্সকিউজ মি! তোরা কথা বল। আমি আসছি। ”

দুয়া ওদের থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালো নিরালায়। সকলের দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গেল মেয়েটি। যেই না লেডিস ওয়াশরুমে প্রবেশ করবে অমনি শক্তপোক্ত পুরুষালি একজোড়া হাত ওকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরলো। আকস্মিক কাণ্ডে ভড়কে গেল মেয়েটি! ভীত চাহনিতে তাকিয়ে দেখতে পেল রুমান! ওর কোমল দু’টো হাত দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে।

” আ আপনি! আপনি এখানে কি করছেন? হাত ছাড়ুন। এ কেমন ধরনের অসiভ্যতা? ”

হাত দু’টো ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো দুয়া। তাতে আরো ক্ষু ব্ধ হলো রুমান। হিসহিসিয়ে উঠলো,

” হুঁশ। একটাও কথা না। ছলনাময়ী! তোর কত বড় দুঃসাহস! আমাকে ডিচ করে বিয়ে করে নিয়েছিস? ”

দুয়া হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কঠিন স্বরে বললো,

” একদম বাজে বলবেন না। এখানে ডিচ আসছে কোথা থেকে? আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম ছিল নাকি ভালোবাসা? ডিচ বলছেন কোন লজিকে? হাত ছাড়ুন বলছি। অস’ভ্য লোক। ”

” আমি অস’ভ্য! তাহলে সভ্য কে! তোর জামাই? ”

এক ঝটকায় দু হাত ছাড়িয়ে নিলো দুয়া। ডান হাতে বাম হাতের কব্জি ডলতে ডলতে বললো,

” ফালতু কথা বন্ধ করুন। আপনি এখানে আসলেন কি করে? হাঁ? এখানে এসে ড্রামা করছেন? সসম্মানে চলে যান। এখানে কিন্তু আমি একা নই। সব্বাই আছে। সো সাবধান। ”

দুয়া ভেবেছিল ওর হুমকিতে বুঝি সামান্য হলেও কাজ হবে। সেথা হতে প্রস্থান করবে রুমান। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। তড়িৎ ওর ডান হাতটি বাম হাত দিয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরলো রুমান। ডান হাতে আঁকড়ে ধরলো চোয়াল। এতটাই শক্ত করে চেপে ধরেছে যে প্রচুর যন্ত্রণা হচ্ছে। গালের চামড়ায় বুঝি দাঁত লেগে যাবে!

” আমাকে হু*মকি দিচ্ছিস তুই? ভয় দেখাচ্ছিস? ভয় পাই নাকি? তোর মতো মেয়েরা এই রুমান শিকদারের বিছানায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। আমার এক ইশারায় ওরা নিজেকে বিলিয়ে দেয়। সেখানে তুই কিনা দেমাগ দেখাচ্ছিস? সাতটা মাস ধরে তোর পেছনে ঘুরঘুর করছি কি এইদিন দেখার জন্য? তোর ওই কুলা* ভাইয়ের ধমকি সহ্য করেছি এসব দেখার জন্য? হুঁ? ”

চোয়ালের ব্যথায় মেয়েটির নেত্রপল্লব সিক্ত হলো। বাম হাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগলো চোয়াল হতে পুরুষালি হাত সরানোর। কিছু বলতে অবধি পারছে না সে। রাগে ক্ষো’ভে রুমান আরো শক্ত করে চোয়াল চেপে ধরলো। দেয়ালে চেপে ধরা হাতটি সরিয়ে শক্ত করে খামচে ধরলো মেয়েটির কোমর। অ*শ্লীল ভঙ্গিতে সেথায় হাত রেখে বলে উঠলো,

” এখানে? এখানে ছুঁয়েছে না ওই শ*তান? ওর ছোঁয়া ভালো লাগে আর আমি ধরলেই দোষ? আমি তো ভেবেছিলাম তুই সতী সাবিত্রী। কিন্তু না? তুই তো পঁচা পুকুরে গা ভাসানো বে**! খালাতো ভাইয়ের সাথে যে কিনা… ”

আর বলতে পারলো না রুমান। ডান হাতে ওর গালে প্রগাঢ় রূপে চ ড় মে”রে দিলো মেয়েটি। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। অশ্রু ভেজা কণ্ঠে ধিক্কার জানালো,

” ছিঃ! ”

মেয়েটি আর কিছু বলতে পারছিল না। লজ্জা-অপমানে কণ্ঠনালী বুঝি অবরুদ্ধ! কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত পায়ে সেথা হতে ছুটলো দুয়া। ওয়াশরুমের ফাঁকা শুনশান এরিয়া ত্যাগ করার পূর্বেই পেছন হতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো রুমান। শক্ত হাতে ওর হিজাবে আবৃত কেশ পেছন হতে আঁকড়ে ধরতে উদ্যত হলো। কিন্তু সর্বশেষ মুহূর্তে ঘটলো মিরাকল! আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ’র শক্তপোক্ত হাতটি আঁকড়ে ধরলো রুমানের নোংরা হাতটি। রুমান কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই গালে জোরসে এক ঘু ষি! মাটিতে ছিটকে পড়লো রুমান। ক্রন্দনরত মাইরা’কে দ্রুততম ভঙ্গিতে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো তূর্ণ। ভরসাযোগ্য মানুষটির বক্ষপটে মুখ লুকিয়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে লাগলো দুয়া। এতক্ষণে পেল কাছের মানুষটির সান্নিধ্য। এতগুলো নোংরা বাক্যে জর্জরিত মেয়েটি দু হাতে স্বামীর পৃষ্ঠদেশ খামচে ধরলো। কাঁদতে লাগলো অবিরাম। যে ক্রন্দন ধ্বনি দিশেহারা করে তুলছে একান্ত মানুষটির অন্তঃস্থল। ধ্বং স করে দিতে ইচ্ছে করছে সবটুকু। র|ক্তিম চাহনিতে নোংরা মানসিকতার মানুষটির দিকে তাকালো তূর্ণ। নিজেকে বহু কষ্টে সংযত করলো পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে। ডান হাতে আদুরে সঙ্গিনীকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম হতে। বাহির হতে ওয়াশরুম বদ্ধ করে দ্রুততার সহিত মোবাইলে কাউকে মেসেজ সেন্ড করলো। অতঃপর লালাভ চাহনিতে বদ্ধ দরজার পানে তাকিয়ে আরো হিং”স্র রূপ জাগ্রত হতে চাইলো। কিন্তু না! বুকে লেপ্টে থাকা আদুরে রমণীর পানে তাকিয়ে চক্ষু জোড়া মুদিত করে নিলো তূর্ণ। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করবার প্রয়াস চালিয়ে গেল।

তমস্র নিশি। বিছানার নরম গদিতে পাশাপাশি শুয়ে দু’জনে। ওপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে অশ্রুত্যাগ করে চলেছে মেয়েটি। সেই কখন থেকে কাঁদছে। থামছেই না। সে কি বুঝতে পারছে না তার ক্রন্দন ধ্বনি একজনের বুকে ছু রি বিদ্ধ করে চলেছে! বুকের মধ্যিখানে ভেঙ্গে চৌচির প্রায়। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। দিশেহারা তূর্ণ শক্ত হাতে দুয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। হঠাৎ কাণ্ডে থমকে গেল মেয়েটি। অশ্রুসজল নয়নে তাকালো স্বামীর পানে। তূর্ণ লাল বর্ণ চোখে ওর দিকে তাকালো। হাহাকার করে উঠলো অন্তঃপুরে। তার উপস্থিতিতে এ কি হাল হয়েছে মাইরা’র! এ যে বড্ড যন্ত্রণার! অসহনীয়! শুকনো ঢোক গিললো তূর্ণ। আলতো হাসার চেষ্টা করে মেয়েটির দু কপোলে লেপ্টে থাকা নোনাজল মুছে দিতে লাগলো। সে কি আদুরে স্পর্শ! যেন একটু রূক্ষ হলেই ব্যথা পাবে তার মাইরা! তাই তো অতীব আলতো ছোঁয়ায় নোনাজল মুছে দিলো সে। দুয়া চক্ষু মুদিত করে অনুভব করতে লাগলো যত্নশীল সে ছোঁয়া! তূর্ণ আস্তে আস্তে করে এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলো। কানের পিঠে গুঁজে দিল কিছু চুল। আদুরে কণ্ঠে বললো,

” কাঁদে না দুয়া। সব ঠিক হয়ে গেছে তো। এই যে তুমি আমার কাছে। নিরাপদে আছো তো।‌ বলো নিরাপদে আছো না? ”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মেয়েটি। কেমন মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তূর্ণ মুচকি হেসে বললো,

” এই তো। আমার বউটা আমার কাছেই আছে। আর কোনো ভয় নেই। এখানে কোনো বাজে লোকের ছায়া অবধি নেই। শুধু তুমি আর আমি। তাই না? ”

দুয়া অস্ফুট স্বরে মাথা নাড়িয়ে বললো, ” হুঁ। ”

” গুড। এবার চুপটি করে আমার বুকে আসো তো। এখানটায় মাথা রেখে শুয়ে পড়ো। এটি হলো তোমার সবচেয়ে ভরসাযোগ্য স্থান। যখনই ভয় পাবে, খুব কষ্ট হবে, কাঁদতে ইচ্ছে করবে- ব্যাস এখানটায় চলে আসবে মাইরা। আমি কিচ্ছুটি বলবো না। শুধু নীরবে আগলে নেবো তোমায়। এখানে একবার মাথা রেখে দেখোই না! সমস্ত দুঃখকষ্ট-ভয় এক লহমায় ফুরুৎ। ”

নিজের বক্ষপটে আসার আহ্বান জানালো আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ! সম্মোহিত এর ন্যায় তাকিয়ে রইল দুয়া।

চলবে.
চলবে.

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here