প্রেম পড়শী পর্ব -০৬

#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_৬ (শাস্তি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

মোহ বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখল—রুমা রূশীকে চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে, আর রূশী মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মোহ এসে সোজা রুমার সামনে বসে পড়ল।
গম্ভীর গলায় বলল,
-“মনিমা, একটু কথা আছে।”

রুমা রূশীর চুলে হাত চালাতে চালাতেই বলল,
-“তা বল।”
-“সিরিয়াস কথা।”
-“বল, শুনছি।”
-“রূশীকে ছাড়ো, তারপর বলছি।”

রুমা রূশীকে ছেড়ে দিলো। রূশী ছাড় পেয়ে উঠে দাঁড়াল। মোহর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“বাঁচিয়ে দিলে গো, মোহদি।”

রূশী দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। রুমা মোহকে দেখে বলল,
-“চুলে তেল নিস না কতদিন? আয় দিয়ে দিই।”
-“পরে দেবো, আমার কথা শোনো আগে।”
-“বল।”
-“আব্বুর এই ঘটনার ব্যাপারে জানতে?”

মোহর কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে রুমা বলল,
-“একটা বর্ণও জানা ছিল না। তোর আব্বু ভীষণ চাপা স্বভাবের, ছোটো থেকেই তার গোপন বিষয়, গোপন ছিল। কেউ জানতে পারত না।”

মোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুমা আবার বলল,
-“ওদের সাথে তোর কথা হয়েছে?”
-“হয়নি।”
-“বাচ্চারা?”
-“ছোটোটা আগে-পিছে ঘুরঘুর করে।”
-“তোর সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করে?”
-“করে না।”
-“আমি সকালে গেছিলাম একবার, তুই তখন বাড়ি ছিলি না।”
-“আমি ভার্সিটিতে গেছিলাম, মনিমা।”
-“গেছিস তবে! যাক, একটা কাজের কাজ করেছিস। দেখ মা, একটা কথা বলি তোকে। জীবন কখনই থেমে থাকে না। আবার একাধারে চলেও না। হোঁচট খাবি, উঠে দাঁড়াবি। তোর ভিত্তি হব আমরা, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাটা তোকেই আগে করতে হবে। আজ শেফা থাকলে কি এসব সহ্য করতে পারত, বল?”

মোহ নতমুখী হয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,
-“আম্মুর অনুপস্থিতিতে এখন আর আমার মনে শোক নেই। আমিই সহ্য করতে পারছি না, আম্মুর অবস্থা তো চিন্তাও করা যাবে না।”
-“মা, তুই বুদ্ধিমতী। বলি কী, তোর আব্বুর কাছে সোজাসুজি জিজ্ঞেস কর সবটা। তোকে খুব ভালোবাসে। কী এমন বাধ্যবাধকতা ছিল যে আরেকটা বিয়ে করে নিতে হলো! তোর জানা দরকার।”

মোহ দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে-সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়তেই মোহ বলে উঠল,
-“তোমার কি মনে হয়—আমি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি?”
-“করেছিস?”
-“করেছি।”
-“কী বলল?”
-“সে ভেবে দেখল—আমাকে দেওয়ার মতো কোনো যুক্তিপূর্ণ জবাব তার কাছে নেই। তাই চুপ ছিল।”
-“মোহ! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু আছে। আমরা জানি না।”
-“যেখানে যা খুশি থাকুক, মনিমা। আমি কেবল এটাই মানতে পারছি না, আমার আব্বু আমারই আম্মুকে ঠকিয়েছে। সে অস্বীকার করতে পারবে—ওই বউ তার না? কিংবা বাচ্চাগুলো কি আকাশ থেকে টপকেছে?”

রুমা মলিন হেসে বলল,
-“যা তুই চাইবি, তা হবে না। তাই হবে, যা স্রষ্টা চাইবে। বিশ্বাস রাখ, যা হবে ভালোই হবে।”
-“মনিমা, আমি কি ক’দিন এবাড়িতে থাকতে পারি?”
-“এভাবে বলার কী আছে? আগে থাকিসনি?”
-“আগে ছিলাম, কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন।”
-“খুলে বলবি?”
-“আব্বুর মুখোমুখি হতে পারছি না। রাগ লাগছে। খারাপ ব্যবহার করে ফেলতে পারি, বড়ো-সড়ো ঝামেলা পাকাতে পারি। এজন্য থাকতে চাইছি।”
-“আচ্ছা, থাকিস।”
-“মনিমা, শোনো!”
-“তুমি কি বড়ো আব্বুকে একবার জিজ্ঞেস করবে—এ-ব্যাপারে কিছু জানে কি না?”
-“কাল রাতেই এই নিয়ে এ-বাড়িতে আলাপ হয়েছিল।”
-“কী আলাপ?”
-“কেউ জানে না কিছুই।”
-“মনিমা, আমার ভালো লাগছে না।”
-“এদিকে আয়, চুলে তেল দিয়ে দিই।”

মোহ রুমার সামনে ফেলা ছোট্ট মোড়াটিতে বসে পড়ল। রুমা চুলে তেল মালিশ করতে লাগল। মোহ হুট করেই বলল,
-“আম্মু যদি থাকত, তবে কি খুব ক্ষতি হতো? আচ্ছা, কী এমন হতো?”

রুমার হাত থমকে গেল। থেমে থেমে বলল,
-“তোর বাড়িতে ধ্বংসলীলার আসর মজত।”

_____
বোন-জামাইয়ের বাড়িতে আদর-যত্নে কমতি পায়নি শিহাব। ফেরার সময় আবার একগাদা শপিং করে পাঠানো হয়েছে সাথে। খুশিমনে শিহাব ট্যাক্সিতে করে বাড়ি ফিরছিল।

সন্ধ্যার একটু পর পর..
হুট করেই ট্যাক্সি ড্রাইভার ব্রেক কষে। শিহাব মুখ কুঁচকে দুটো খিস্তি ছুড়ল তৎক্ষণাৎ। ড্রাইভার ভড়কে সামনে তাকিয়ে রয়। সচকিত ভঙ্গিতে তাকাল শিহাব নিজেও।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক’জন ছেলেপুলে এসে শিহাবকে পেছন থেকে বের করে ইচ্ছেমতো পেটাতে থাকে। শিহাবের মস্তিষ্ক তখন নিজেকে প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত।

পেটাতে পেটাতে শিহাবের তখন আধমরা অবস্থা। নিজেকে বাঁচানোর জন্য যে খানিকটা শক্তির প্রয়োজন, তা-ও অবশিষ্ট নেই। একটি স্থানও বাদ নেই, যেখানে আঘাত পড়েনি। একটু আগ অবধিও সে সবার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল,
-“ছেড়ে দাও।”

কেউ তাকে ছাড়েনি। আর এখন সে বলার অবস্থাতেই নেই। জান যখন যায় যায় অবস্থা, তখন ঠিক কিছুটা দূরে স্থির রাখা গাড়িটা থেকে এক শক্তপোক্ত কাঠামোর পুরুষ বেরিয়ে এলো। এক-পা এক-পা করে বড্ড ধীরপায়ে শিহাবের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ইশারায় বাকিদের সরতে বলল।

সবাই এক ইশারায় পিছিয়ে গেল। শিহাব হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তা দেখে রঙ্গন হাসল। এক-হাঁটু ভাজ করে তার সামনে বসে পড়ল। হাতের দু-আঙ্গুলের সাহায্যে গালটা ধরে এদিক-ওদিক নাড়িয়ে বলল,
-“মরন এসেছে?”

আধো-অন্ধকারে নিভু নিভু চোখে মাক্স পরিহিত রঙ্গনের শিকারীর ন্যায় জ্বলজ্বলে চোখদুটো দেখে শিহাব আৎকে উঠল। কিছু বলল না, কেবল চোখের আকৃতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ বড়ো-সড়ো হয়ে এলো। রঙ্গন খুবই হিংস্রতার সাথে হাসল। ছুরির মতো ধারালো আওয়াজে বলল,
-“আমি জীবনে প্রাণীহত্যা করিনি। তোরটা দিয়েই শুরু করি? কী বলিস?”

শিহাব মাথা নাড়িয়ে না বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। রঙ্গন সেই দু-আঙ্গুলের চাপটা আরও দৃঢ় করল। শক্ত গলায় বলল,
-“যা, কালেমা পড়।”

অদ্ভুত বিষয়—শিহাব সত্যি সত্যিই কালেমা পড়া শুরু করে দিলো। রঙ্গন একটা চাকু নিল, ফিসফিসিয়ে শুধাল,
-“কোন হাতে ছুঁয়েছিস বল তো?”

চাকুর মাথা ডান হাতের তালুতে ঠেকিয়ে বলল,
-“এই হাতে?”

তারপর সেখানে জোরে চাপ প্রয়োগ করল। চাকু ডেবে যাওয়ায় রক্তপাত হতে লাগল, আবারও চিৎকার করে উঠল শিহাব। রঙ্গনের মজা লাগছে। আরও ফিসফিস করে বলল,
-“কেটে দিই?”

শিহাব মনে মনে নিজের মৃত্যুকামনা করছে। রঙ্গন উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। শিহাবকে তার খুবই হিংস্র মৃত্যু দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোথাও এক জায়গায় এসে আটকে পড়ছে। ফিরে যেতে যেতে ছেলেদের মাঝে একজনকে ইশারা করে কাছে ডাকল।

ছেলেটার নাম সুহান। সে এগিয়ে এসে বলল,
-“ভাই, এটাকে কি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেবো?”
-“না, এর এত সহজ মৃত্যু চাই না।”
-“তবে হসপিটালে এডমিট করিয়ে আসি? নয়তো এখনই টপকে যাবে।”
-“সুহান, তোমার কি মনে হয় আবর্জনার পিছে টাকা খরচ করার মতো আমার অঢেল পয়সা হয়েছে?”

থতমত খেয়ে সুহান বলল,
-“কী করব তাহলে, ভাই?”
-“এর বাড়ির দরজার সামনে ফেলে চলে আসো। কই মাছের জান হারামির, আগের বার তো মারতেই চেয়েছিলাম, মরেনি। এবারও বেঁচে থাকবে।”

শিহাব জ্ঞান হারিয়েছে। সুহান বাকি ছেলেদের সঙ্গে করে শিহাবকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে তুলল। তারপর রওয়ানা হলো।

ট্যাক্সির ড্রাইভার ট্যাক্সির ভেতরে বসে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে কাঁপছিল। রঙ্গন তার দিকে এগিয়ে এলো। ড্রাইভিং সিটের জানালার দু’পাশে হাত রেখে সামান্য ঝুঁকে দাঁড়াল। ড্রাইভারের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। ভয়ে কাঁপছে।

রঙ্গন পকেট থেকে হাজার টাকার নোটের একটা বান্ডেল সেদিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
-“মুখ বন্ধ থাকবে তো?”

ড্রাইভার কাঁপা কাঁপা হাতে বান্ডেলটা ধরে নিল। মাথা নেড়ে বলল,
-“কাউরে কমু না।”

হেসে দিয়ে রঙ্গন বলল,
-“মনে যাতে থাকে। আমি দুই ক্যাটাগরির পুরুষদের সহ্য করতে পারি না। এক—যাদের নজর যে-কোনো নারীতে আটকে যায়, আর দুই—কথার খেলাপ করে। খানিকক্ষণ আগের ঘটনা দেখেছ?”

ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল ড্রাইভার। রঙ্গন বলল,
-“ভুলে যাও। নয়তো একই পরিণতি তোমারও হবে।”

রঙ্গন চলে এলো সেখান থেকে। নিজের গাড়িতে এসে, স্টার্ট দিলো। বেশ কিছুটা দূরে এসে এক নির্জন ব্রিজের পাশে ব্রেক কষল। গায়ের শার্টে খানিকটা রক্ত লেগেছে। গাড়িতে সবসময় এক্সট্রা কাপড় রাখে রঙ্গন। বৃষ্টি বা যে-কোনো সমস্যাতে কাজে লেগে যায়।
ব্যাকসিটে গিয়ে শার্টটা চেঞ্জ করে নিল। মাত্র খোলা শার্টটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়ির ফলস নেমপ্লেটটাও খুলে নিল। এরপর দুটো ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে নিচে ফেলে দিলো।
বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে তাজা, শীতল হাওয়া খেতে লাগল। ওষ্ঠকোণে তার তাচ্ছিল্যের হাসি। দুনিয়াতে সব পাপের শাস্তি হয় না। এই-যে, মাত্র যেই কাজটা সে করে এলো! এগুলো কেউ জানতেই পারবে না। যদি সেই ছয়বছর আগের মতো সর্বসম্মুখে প্রতিবাদের মিছিল করত, দ্রোহী পায়ে অন্যায়কে পিষতে চাইত; তবে জেল হতো অনিবার্য। সে-সময় পরিবারের আদরের ছেলে বলে পার পেয়ে গিয়েছিল।

_____
রঙ্গনের ফিরতে ফিরতে রাত হলো। নিজের রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল—মোহ কিছু আঁকিবুঁকি করছে। এই অসময়ে মোহকে নিজের রুমে দেখে সে অবাক হলো। বিস্মিত কণ্ঠে শুধাল,
-“তুমি? এখানে?”

মোহ আঁকিবুঁকি থামাল না, হাত চলতেই থাকল, সামান্য তাকালও না। কেবল জবাবে বলল,
-“এখানে এলে কি আমার ওপর তেনারা ভর করবে?”
-“একটু সোজা জবাব কি তোমার থেকে আশা করা যায় না?”
-“জি না।”

মোহ এবার তাকাল রঙ্গনের দিকে। হুট করেই নরম মুখটা শক্ত হলো, কোমল আওয়াজটা হলো গম্ভীর,
-“রঙ্গন, তুমি কি অন্যত্র ঝুঁকেছ?”

চলবে..
শব্দ-সংখ্যা: ১৪৫০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here