#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ১৭
🍂🍂🍂
সকাল ৫ টা ৩০ মিনিট। মন মরা হয়ে ছাদে বসে আছে নুর। সকালের আকাশ দেখছিলো এতক্ষণ যাবত। শুভ্রতার বাড়ি থেকে এসেছে আজ দুইদিন। এই দুইদিন অরণ্য অনেকবার কল দিয়েছে। শুভ্রতা কাল রাতেও অনেকবার কল দিয়েছে। সে ধরেনি। ওদের কথা ভাবলেই মনটা বিষিয়ে ওঠে। বিরক্ত হয়ে ফোন সাইলেন্ট করে বেশ অবহেলাসহিত ফোনটাকে এক কোণে ফেলে রেখেছে। চোখের সামনে ফোন থাকলেই রিসিভ করতে মন চাইবে তাই এই পদক্ষেপ। নিতা হন্ত দন্ত হয়ে ছাদে ছুটে এলো। কর্কশ গলায় বললো,
এতো সকালে ছাদে কি করিস তুই? খুঁজতে খুঁজতে আমার জান শেষ।
নুর আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। বললো,
কেনো কি হয়েছে? এতো সকালে আমাকে খুজছো কেনো?
নিতা নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
তিলোত্তমা কল দিয়েছিলো। খুব জরুরী নাকি। দ্রুত কল কর, এত সকালে কল করেছে নিশ্চয় জরুরী কিছু। আর হ্যাঁ! তোর ফোন কোথায় থাকে? সময় মতো কল দিলে যদি তোকে পাওয়াই না যায় তাহলে ফোন ব্যবহার করিস কেনো? আজই বেচেঁ দিবো তোর ওই ফোন নামের ক্যালকুলেটরটাকে।
নুর বিরক্তি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। তিলোত্তমা বেশ ভালোই চাল চেলেছে দেখছি। মা এর নাম্বার এ কল দিলে যে তার কথা বলতেই হবে তা তার বন্ধুমহলের সকলেরই জানা। অগত্যা নুরের ফোনটা নিতে হলো। নিতা ঘুমের অজুহাত দিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন। নুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটার দিকে তাকালো। সে কল ব্যাক করলো না। মিনিট তিনেকের মধ্যেই তিলোত্তমার কল এলো। নুর ফট করেই কল রিসিভ করলো না, একটু অপেক্ষা করালো তাকে। ফোনটা কানে রাখতেই তিলোত্তমার কান্নার আওয়াজ। নুর বিচলিত হয়েও যেনো হলো না। চুপ করে বসে রইলো। তাড়া দিয়ে বললো না “কল করেছিস কেনো?”। মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো তিলোত্তমার কথা। তিলোত্তমা কাদতে কাদতে বললো,
দোস্ত! শুভ্রতা সুইসাইড করেছে। অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। তুই দ্রুত আয়।
নুর কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। ছাদের মেঝেতে উবু হয়ে শুয়ে পড়লো। থুতনির নিচে বাম হাত রেখে ডান হাতে ফোন কানে রেখে পা দুলাতে দুলাতে বললো,
সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। আজ দেখেও নিলাম। কি সুন্দর মিথ্যা বলতে শিখে গেছিস রে তিলো।
ওপাশ থেকে তিলোত্তমার অবাক কণ্ঠস্বর,
আমি মিথ্যা বলছি? তোর মনে হচ্ছে আমি নাটক করছি?
~তিলো! তিলো! তিলো! অরণ্য থাকতে আবার আমার কি প্রয়োজন? আমি অবশ্যই ডাক্তার না। আর ওকে নিশ্চয়ই অরণ্যের হাসপাতালে নিয়ে গেছিস?
~ নুর? ওর অবস্থা সত্যিই খুব ক্রিটিক্যাল।
~মরে যাক। এসব আমার দেখার বিষয় না। চিটার, বাটপার মরে গেলেও আফসোস নেই।
~নুর?
~হোয়াট নুর? সকাল সকাল কল করে আর এমন বিরক্ত করবি না। আমি এখন ঘুমাবো। রাখছি।
কল কেটে দিলো নুর। চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। বাম হাতটা মাথার নিচে রাখলো। চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস নিলো। ইদানিং প্রাণভরে শ্বাস নিতে এত কষ্ট হয়। বাতাসে যেনো বিষাক্ত কিছু মিশে আছে। তার ভালো লাগছে না কিছুই। তিলোত্তমার কথায় বিশ্বাস করেনি নুর। শুভ্রতাকে সে চেনে। নিজের ইচ্ছা, রাগ, জিদ পূরণ করতে সে যেকোনো কিছু করতেই প্রস্তুত। নুর জানে তিলোত্তমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে সে আর অরণ্য নুরকে কল করিয়েছে। নুর বিশ্বাস করে ওখানে গেলেই দেখতো শুভ্রতা অক্ষত অবস্থায় বসে খিল খিল করে হাসছে। যে করেই হোক সে নুরের অভিমান ভাঙ্গাতো। এই একটা কাজ খুব ভালো পারে শুভ্রতা, নিজের প্রিয় মানুষগুলোর রাগ ভাঙ্গাতে। কিন্তু এবার তো সে অভিমান করে নেই। তার মনে কষ্ট পেয়েছে সে, এই দুঃখ কেউই মুছতে পারবে না, কখনোই না।
🍂🍂🍂
সোফায় বসে টিভি দেখছে নুর। বাড়িতে কেউ নেই সে একাই। মা কিছু কিনবে বলে বেরিয়েছেন। ঘণ্টা দুয়েক হবে। কলিং বেল বাজতেই নুর উঠে দাড়ালো। দরজা খুলতেই নিতা হাতের ব্যাগটা নুরকে ধরিয়ে সোফায় এসে বসলো। নুর ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে এসে মায়ের জন্য বানিয়ে রাখা শরবতের গ্লাসটা এনে তার মাকে দিলো। নিতা এক টানে সম্পূর্ণ শরবতটা খেলো। নুর মায়ের পাশে বসে আবার টিভি দেখায় মনোযোগ দিতেই তার মা বলে উঠলো,
~আজ শপে শুভ্রতার সাথে দেখা হয়েছিল।
নুরের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখতে পেলেন না নিতা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
~তোর ওর সাথে কথা হয় না? বান্ধবীর খোঁজ খবর রাখিস না নাকি?
নুর টিভি বন্ধ করে মায়ের দিকে তাকালে তিনি আবার বললেন,
~মেয়েটার কি হাল হয়েছে জানিস? আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গিয়েছে, চোখের নিচে কালো দাগ, চেহারায় আগের মতো সেই চঞ্চলতা আর উজ্জ্বল নেই, হাসিটাও যেনো জোরপূর্বক, মুখটা কেমন মলিন হয়ে ছিলো। আমার তো দেখেই কেমন মায়া হচ্ছিলো।
নুরের এসব কথা শুনতে মন চাইলো না। বিরক্ত অনুভব করলো। টেবিলের ওপর থেকে গ্লাসটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাটা ধরলো সে।
~এই গরমের মধ্যে এত ভারী ব্যাগ নিয়ে হেঁটে এসেছো। নিশ্চয় তুমি টায়ার্ড। যাও রেস্ট নাও।
নিতা ঘুরে তাকালেন নুরের দিকে। বললেন,
শুভ্রতা থাকতে আমায় হেঁটে আসতে দিবে? আগে কখনো দিয়েছে নাকি? ওর গাড়িতে করে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে।
নুর থমকালো। মায়ের দিকে ঘুরে অবাক স্বরে বললো,
শুভ্রতা এসেছিলো?
নিতা মাথা ঝাঁকালেন। হাসি দিয়ে বললেন,
কখনো এমন হয়েছে যে ওর সাথে রাস্তায় দেখা হলো আর ও বাড়িতে পৌঁছে দেয় নি?
~তবে প্রতিবারের মতো এবার বাসার ভেতরে এলো না কেনো?
নুরের প্রশ্নে তার হাসি কেমন যেনো মিলিয়ে গেলো। ভাবনায় পড়ে গেলেন সে। চুপ করে বসে রইলেন কিছু মুহূর্ত। নুরও জবাবের আশায় চেয়ে রইলেন তার দিকে। কিছুক্ষণ ভাবার পর তিনি নুরের দিকে তাকালেন,
~হয়তো যে কারণে তুই ভার্সিটিতে যাস না।
নুর চোখ বড়বড় করে মায়ের দিকে তাকালো। সে এখনও তার মা কে কিছুই জানায়নি। সে চায় না তার মা তার বন্ধু বান্ধবদের ঘৃনা করুক। সে জানতে চাইলো,
~শুভি কি তোমাকে কিছু বলেছে?
তিনি মাথা নাড়ালেন।
~শুভ্রতার কি কিছু বলার ছিল?
~না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম আর কি।
~তুই ভার্সিটিতে যাস না কেনো? পরীক্ষার তো আর মাত্র কয়েকদিন বাকি।
~কাল থেকে যাবো…
নিতা মেয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। শুভ্রতা চুপ থাকলেও রেনুর থেকে সব শুনেছে সে। শুভ্রতা চুপ করাতে চাইলেও তার জন্য চেয়েও চুপ করাতে পারেনি। তিনি কারো পক্ষেই না। শুভ্রতা নিজ থেকেই যাওয়ার আগে বলেছে,
~আপনি যে সব জানেন তা ওকে প্লীজ বলতে যাবেন না। আমি চাই আপনি এই ব্যাপারে শুধুমাত্র একজন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করুন। বাকি যা হবে আল্লাহ ভরসা।
তিনি মাথা দুলিয়ে সায় দিতেই চলে গেলো শুভ্রতা। শুভ্রতার গাড়িটা যত পর্যন্ত দৃষ্টি সীমানায় ছিলো তিনি দেখে গেছেন। প্রথম থেকেই মেয়েটা তার বেশ প্রিয় ছিলো। এখনও যেনো মায়াটা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। তিনি আকাশের দিকে চেয়ে শুধু এই দোয়াই করেছেন আল্লাহ্ যেনো সব দ্রুত ঠিক করে দেন।
🍂🍂🍂
নুর ভার্সিটিতে প্রবেশ করতেই দেখা মিললো শুভ্রতার। সে দূরে দাড়িয়ে তিলোত্তমা আর শ্রেয়ার সাথে কথা বলছে। চোখে মুখে গাম্ভীর্য ভাব বিদ্যমান। নুরকে দেখতেই রিদিতা, রুপা আর উপমা তার কাছে এলো। নুর এক দৃষ্টিতে শুভ্রতার দিকেই চেয়ে রইলো। মায়ের বর্ণনা একদম মিলে যাচ্ছে তার সাথে। তার জানতে ইচ্ছে হলো শুভ্রতা অসুস্থ কি না। শুভ্রতার সাথে নুরের চোখাচোখি হতেই শুভ্রতা মুচকি হাসলো। নুরের কাছে আসতে নিলেই তিলোত্তমা ওর হাত টেনে ধরলো। তিলোত্তমা রাগী দৃষ্টিতে কিছু একটা বলছে শুভ্রতাকে। শুভ্রতাও ভ্রু কুচকে কিছু বলছে। অতঃপর নুরের দিকে একবার করুন চোখে চেয়ে ক্লাসের দিকে চলে গেলো শুভ্রতা। শুভ্রতা যেতেই তিলোত্তমা আর শ্রেয়া দাড়িয়ে কথা বলতে লাগলো। নুর ওদের কাছে যেতেই তিলোত্তমার মুখভঙ্গির পরিবর্তন ঘটলো। গম্ভীর হলো তার চাহনী। তিলোত্তমাকে এতোটা রাগী আর গম্ভীর কখনোই দেখেনি সে। নুর মৃদু হেসে জানতে চাইলো,
কেমন আছিস তিলো?
~আলহামদুলিল্লাহ্।
নুর কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। এলোমেলো ভাবে এদিক সেদিক চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,
শুভি কি অসুস্থ?
~চিটার, বাটপারের খবর নিয়ে তোমার কি কাজ?
শ্রেয়ার জবাবে কপাল কুঁচকে তাকালো নুর। রুপা এগিয়ে এসে শ্রেয়ার সামনে দাঁড়ালো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
~কিরে তিলো? শ্রেয়াকে চামচা হিসেবে হায়ার করেছিস আর আমাদের বললিও না!
তিলোত্তমা বাঁকা হেসে বললো,
তুইও যে নুরের চামচাগিরি শুরু করেছিস তাও তো তুই আমাকে বলিস নি।
রুপা তেতে উঠে তিলোত্তমার দিকে আঙুল তাক করে কিছু বলতে নিতেই তিলোত্তমা তার আঙুল মুচড়ে ধরলো। রুপা আর্তনাদ করে উঠতেই তিলোত্তমা রুপার গাল শক্ত করে চেপে ধরে রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি মানে এই না যে সবসময় মুখ বুঁজে দেখে যাবো। নেক্সট টাইম আঙ্গুল তুলে কিছু বলতে আসলে হাত আর আস্ত থাকবে না বলে রাখছি। নুরের মতো আমি তোকে অন্ধবিশ্বাস করি না। তুই যে মীরজাফরের কাতারের মানুষ তা অন্য কারো না হলেও আমার জানা আছে।
তিলোত্তমা ঝাড়া মেরে ওর হাত ছেড়ে দিতেই রুপা ন্যাকা কান্না করে উঠলো,
~নুর, উপ, রিদি? তোরা কিছু বলছিস না কেনো?
রিদিতা বা উপমা কারোর মধ্যেই তেমন ভাবান্তর হলো না। তারা ফোন নিয়েই ব্যস্ত। নুর চোখ গরম করে তাকালো তিলোত্তমার দিকে।
~নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া মারামারি করছিস কেনো তিলো? (নুর)
~শুরুটা কে করেছিলো? (তিলোত্তমা)
নুর রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তিলোত্তমার চোখের দিকে। তাতে তিলোত্তমার দৃষ্টি নত হলো না। তার চোখে চোখে রেখেই তিলোত্তমা অকপটে বলতে লাগলো,
একটা সময় চাইতাম আমি তোর মতো হতে। অজানা কারণেই বন্ধুমহলের মধ্যে শুভ্রতার সব থেকে প্রিয় বান্ধবী ছিলি তুই। আজও তুইই। অথচ দেখ ওর অবস্থা ক্রিটিক্যাল শুনেও তুই ওকে দেখতে গেলি না উল্টো ওর মৃত্যু কামনা করলি। দেখিস এর আফসোস তোর সারাজীবন করবি। আমি এখন আর তোর মতো হতে চাই না। নাহয় দেখা যাবে তোর মতো স্বার্থপর হয়ে আমিও ওকে ছেড়ে যাচ্ছি, কাদাচ্ছি।
~তুই এখনও ওর পক্ষেই থাকতে চাইছিস? এতো কিছুর পরও ওকে ছাড়ছিস না কেনো তুই? একদম প্রথম থেকেই ওর ছায়ার মতো ওর সাথে থেকেছিস। মাত্রই তো বললি এতো কিছুর পরও আমি ওর প্রিয় বান্ধবী। তবুও তুই থাকছিস কেনো? ছেড়ে দে ওকে। যার কাছে তোর মূল্য নেই। (নুর)
তিলোত্তমা হেসে উঠলো। তাচ্ছিল্য করে বললো,
~আজও বুঝলি না তুই ওকে। তুই ওর প্রিয় বান্ধবী হলেও উপমা, রিদিতা, আমি, রূপা আমরাও ওর কাছের বান্ধবীই ছিলাম, আছি। তুই একান্তই ওর বান্ধবী ছিলি না, আমরাও ছিলাম। তুই প্রিয় ছিলি বলে এই না যে ও আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। এই সম্পূর্ণ বন্ধুমহলটাকে ও সমান ভাবেই ভালোবাসতো।
নুর চুপ রইলো। রিদিতা আর উপমা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। তাদের মন আর কাদে না রুপা বা নুরের জন্য। তিলোত্তমা সেদিন ওদেরও কল করেছিল। তারা শুভ্রতার কাছে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শুভ্রতাকে করা ওয়াদার জন্য তার বা রিদিতার কারোরই সাহস হয়নি ওর কাছে যাওয়ার। দূর থেকেই শুভ্রতার খোঁজখবর নেয় তারা। শুভ্রতা কসম না দিলে তারা জানা সত্ত্বেও কখনো এই দুজনের পক্ষে থাকতো না। দাতে দাত চিপে রুপার সামনে থাকে সে। নয়তো কবেই রুপাকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতো সে। কিন্তু শুভ্রতা এদিকেও তাদের হাত বেধে রেখেছে। তিলোত্তমা দু কদম এগিয়ে নুর আর রুপার সামনে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে রুপার চোখের দিকে চেয়ে বললো,
~মীরজাফরও তোর থেকে বহুগুণে ভালো জানিস? তার ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একবার হলেও তার হৃদয় কেপেছিল। কিন্তু তোর? তোরা তো তার থেকেও অধম। আদৌ তোদের চিত্ত বলতে কিছু আছে কি না আমার সন্দেহ হয়।
তিলোত্তমার কথায় নুরের রাগ হলো। যেখানে ধোঁকা শুভ্রতা দিয়েছে সেখানে সে কেনো এসব কথা শুনছে? রুপার সাথেও খারাপ ব্যবহার করছে কারণ? রূপা তার পক্ষে? নুর দু হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে দাড়িয়ে রইলো। রাগে গজগজ করতে করতে তিলোত্তমার দিকে তাকালো। তিলোত্তমা নুরের মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে আগের জায়গায় এসে দাঁড়ালো। রুপার দিকে চেয়ে দেখলো রুপার চোখ ছলছল করছে। এই চোখের পানি তিলোত্তমার মনে একটু হলেও শান্তি এনে দিলো। সে চাইছে ওরা কাদুক, নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আফসোস করুক। রুপা দৃষ্টি নত করে দাড়িয়ে রইলো। তিলোত্তমা দেখলো শুভ্রতা ওদের অপেক্ষা করতে করতে হাপিয়ে ওদের জন্য দ্বিতীয় তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তিলোত্তমা তাকাতেই সে হাত নাড়িয়ে ওকে ডাকলো। তিলোত্তমা হাসলো। তিলোত্তমাকে হাসতে দেখে নুরও সেদিকে তাকালো। তিলোত্তমা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্রতার দিকে ইশারা করে নুরের উদ্দেশ্যে বললো,
~মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি ওর সাথেই থাকবো। যা কিছুই হোক না কেনো আমি ওর ছায়া হয়েই সাথে থাকবো। শুভ্রতার কাছে মাফ চাইলে হয়তো ও খুব সহজেই তোদের মাফ করে দিবে। কিন্তু আমি… আমি তিলোত্তমা তোদের দুজনকে কখনোই মাফ করবো না, কখনো না।
তিলোত্তমা চলে যেতেই শ্রেয়াও পিছু পিছু যেতে নিলো। নুর বললো,
আহাদ ভাইয়ের সাথে পালানোর সময় আমি তোমাকে সাহায্য করেছিলাম শ্রেয়া। আজ তুমি আমার বিপক্ষে দাড়িয়ে কথা বলছো?
শ্রেয়া দাড়ালো। নুরের উদ্দেশ্যে বললো,
আহাদের সাথে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তোমাদের উপকার কখনোই ভুলবোনা। কিন্তু আমি শুভ্রতার সাথে আছি, থাকবো। আমার বিয়ে নিয়ে আসলে ও যা সহ্য করেছে তা তোমরা কেউই সহ্য করোনি। এই ব্যাপারে হয়তো জানোও না।
রুপার দিকে চেয়ে বললো,
আমি আর যাই হই নেমক হারাম না।
শ্রেয়া চলে যেতেই রুপা চেচিয়ে উঠলো। নুরের উদ্দেশ্যে বললো,
কিছু বললি না? এতো কথা শুনালো আর তোরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলি?
রিদিতা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
তোর দোষে তুই কথা শুনেছিস। আমি উপও তো এখানে দাড়িয়ে, কই আমাদের তো কিছু বললো না। আগ বাড়িয়ে লাগতে গেলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
রুপা অবাক হয়ে তাকালো উপমার দিকে। এই মানুষগুলোই তো আগে একে ওপরের জন্য জান দিয়ে দিতো আর আজ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছে। কি ই বা বলবে? এটা তো আর বাহিরের মানুষের সাথে হওয়া ঝামেলা না। নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব।
~তিলোত্তমা আর শ্রেয়াও তো শুভ্রতার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে। তোরা আমার পক্ষ নিলি না কেনো তবে? (নুর)
উপমা আর রিদিতা জবাব দিলো না। ক্লাসে চলে গেলো। নুর দাতে দাত চেপে দাড়িয়ে রইলো। বন্ধুদের এমন পরিবর্তন মানতে কষ্ট হচ্ছে তার। ক্লাস না করেই আবারো বাসায় চলে আসতে চাইলে রুপা যেতে দিলো না। জোর করে ক্লাসে নিয়ে গেলো। ক্লাসে গিয়ে দেখলো শুভ্রতা, তিলোত্তমা আর শ্রেয়া আলাদা বসে আছে। কয়েক বেঞ্চ দূরে উপমা আর রিদিতা। নুর বুঝলো রিদিতা আর উপমা কোনো এক কারণে রেগে আছে। নুরের কানে এলো ক্লাসের অনেকেই ওদের আলাদা বসতে দেখে ওদের ব্যাপারে ফিসফিস করে কথা বলছে। নুর বুঝলো রিদিতা আর উপমার রাগের কারণ। সে সামনের দিকে বসে থাকা শুভ্রতার দিকে তাকালো। ক্লাসের কারো কথায় তার ভাবান্তর দেখা দিচ্ছে না। হয়তো সে শুনতেই পায়নি। শুনলে এতক্ষণ এ কিছু একটা কড়া জবাব সে দিতোই। শুভ্রতা আর যাই হোক চুপ করে থাকার মেয়ে না। শুভ্রতাকে চুপ দেখে নিজেও চুপ করে বসে রইলো নুর। সে ভাবলো ক্লাস শেষে শুভ্রতার সাথে কথা বলবে। হয়তো তারই কোথাও ভুল হচ্ছে। শুভ্রতার রাগের সাথে তো সে পরিচিত। শুভ্রতা তো তার কথাতেই রেগে গেছিলো। সে নাহয় একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতো। সে সব ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে নিবে আজ।
______________________________
ক্লাস শেষ হতেই উঠে দাড়ালো নুর। দেখলো শুভ্রতা ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেছে। দৌড়ে শুভ্রতার পিছু পিছু আসলেও, বাইরে আসতেই তার পা দুটো যেনো জমে গেলো। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কপোত কপোতীকে দেখতেই তার মাথা ঘুরিয়ে এলো। ঠোঁট চেপে দাড়িয়ে সামনের মানুষ দুটোর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। নুর দেখলো অরণ্য রাগী চাহনী নিক্ষেপ করে কিছু একটা বলছে। আর শুভ্রতা করুন চোখে চেয়ে আছে। নুরের চোখে পানি জমা হলো। সে তো ভেবে নিয়েছিলো ওসব ছবি এডিটেড ছিল, ভ্রম ছিল। তবে আজ অরণ্য শুভ্রতার সাথে এখানে কি করছে? তার আর কিছু জানার ইচ্ছে রইলো না। শুভ্রতা সেদিন মিথ্যা বলেছে। অরণ্যের সাথে তার সম্পর্ক নেই এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। মিথ্যা না হলে আজ অরণ্য এখানে কি করছে? অরণ্যের সাথে চোখাচোখি হতেই শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নুর। অরণ্য তীব্র অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নুরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ভালোবাসার মানুষটার উপেক্ষা সহ্য করার মতো ক্ষমতা কি সবার হয়? হয় না। নুর কোনো মতে কান্না আটকে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলো।
________________________________
নুর বাড়িতে এসেই সোজা মায়ের ঘরে গেলো। ঘরে এসে দেখলো তিনি জায়নামাজে বসে তসবি গুনছে। নুর গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। চোখ দিয়ে অবিরত অশ্রু ঝরছে। নিতা মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। কি হয়েছে জানতে চাইলে নুর শুধু এই টুকুই বললো “বাড়ি যাবো। এ শহরে আমার দম আটকে আসছে”। নিতা অনেক জিজ্ঞেস করলেও জানতে পারেনি নুরের কান্নার কারণ। রাতে স্বামীকে কল দিয়ে জানালেন নিতা। তিনি কোনো রকমে নুরকে বোঝালেন অন্তত পরীক্ষাটা যেনো দেয়। বাবার বুঝানোতে নুর রাজি হলো। পরীক্ষা ছাড়া আর ভার্সিটিতে যায়নি নুর। উপমা, রিদিতা, রুপাদের সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দিলো। পরিবারে কোনো অনুষ্ঠান হলে উপমার সাথে দেখা হয়। এইতো এক বছর আগে উপমার এনগেজমেন্ট হলো। সেদিন শুভ্রতাও এসেছিলো। কিন্তু কথা বলেনি নুর। শুভ্রতা দুয়েকবার চেষ্টা করার পরও যখন সে কথা বললো না তখন তিলোত্তমা এসে শুভ্রতাকে নিয়ে গেলো। আর আসেনি শুভ্রতা। সময়ের সাথে সাথে নুরের দুঃখটাও কেমন সয়ে গেলো। এখন আর আগের মতো কান্না করতে করতে নির্ঘুম রাত পার করে না সে। তবে মাঝে মাঝে ভালোবাসার মানুষ আর প্রিয় বন্ধুমহলটাকে হারানোর আফসোসে বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।
~~~
চলবে~
(পরীক্ষার চিন্তায় লেখা হয়ে উঠছিলো না। লেখার পরেও মনে হচ্ছিলো মনমতো হয়নি, সুন্দর হয়নি। এখনও সম্পূর্ণ মন মতো হয়েছে কিনা দ্বিধায় আছি। অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। এখন থেকে রেগুলার গল্প দিবো ইন শাহ্ আল্লাহ। কালকের পর্বে একটা ধামাকা আছে। অপেক্ষা করবেন… হ্যাপি রিডিং~)