চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ১৬

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ১৬

🍂🍂🍂

ঘড়ির কাঁটা রাত ৩ টায় ছুঁই ছুঁই। এ সময় গ্রাম থাকে নিস্তব্ধ, নিঝুম। ঝি ঝি পোকার আওয়াজটা প্রখর ভাবে কানে লাগছে। কপালে হাত রেখে বিছানায় শুয়ে আছে নুর। চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অবিরত। তখনকার দেখা ছবিগুলো বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। একটা ছবিতে অরণ্য শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে আর শুভ্রতা চোখ বন্ধ করে রেখেছে। একটা ছবিতে অরণ্য শুভ্রতার মাথায় এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার দিকেই চেয়ে আছে, আর শুভ্রতা! সেও তার মাথায় রাখা অরণ্যের হাতটা ধরে মুচকি হেসে তার দিকে চেয়ে আছে। একটা ছবিতে অরন্য আর শুভ্রতা পাশাপাশি চেয়ারে বসা, শুভ্রতা চোখ বন্ধ করে অরণ্যের কাধে মাথা রেখে বসে আছে। তার মন, মস্তিষ্ক কোনোভাবেই মানতে চাইছে না শুভ্রতা তার সাথে কিংবা বন্ধুমহলের কারো সাথেই খারাপ হোক এমন কিছু করবে। নুর উঠে বসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে ঘুমিয়ে থাকা উপমার দিকে তাকালো। মনে পড়লো নুর আর উপমার তখনকার সকল কথোপকথন…

🍂কয়েক ঘন্টা আগে🍂

~তুই আমাকে ওয়াদা কর… (নুর)

উপমা মাটি থেকে উঠে দাড়ালো। তটস্থ হয়ে বললো,
~কি?

নুর দু কদম এগিয়ে উপমার কাছে এসে দাঁড়ালো। ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
ওয়াদা কর তুই আমার পক্ষে, আমার সাথেই থাকবি। ওর পক্ষে যাবি না।

~তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? এখানে পক্ষ এলো কোথা থেকে? আমরা কি আলাদা? নুর! তুই ই না বলতি আমরা ছয় দেহ এক প্রাণ!

নুর তাচ্ছিল্যপূর্ণ এক হাসি দিলো। বললো,
ছিলাম? আমার মনে হয় না। কয়েকদিন আগে ও নিজেই বলেছে আমরা আলাদা, আমাদের স্বভাবে রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যবধান। আজ দেখেও নিলাম। আমরা সত্যিই আলাদা।

উপমা শুভ্রতার পক্ষ নিয়ে বললো,
আমি সিওর শুভি ঐভাবে বলেনি। বরং তোর মন মানসিকতা এখন এমন যে তুই সোজা, স্বাভাবিক কথাও অন্য ভাবে নিচ্ছিস।

নুর কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো উপমার দিকে। ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,
তুই এত কিছুর পরেও আমার পক্ষে, তোর বোনের পক্ষে না বলে ওই শুভ্রতার পক্ষে বলছিস?
~শুভ্রতা? ও এখন শুভ্রতা হয়ে গেলো? আগে তো শুভি ডাকতি। আচ্ছা নুর তোর কি একবারও শুভ্রতার ওপর বিশ্বাস করতে মন চাইছে না?

নুর চুপ রইলো। উপমার বুকটা ধক করে উঠলো। শেষ… তার বন্ধুমহল শেষ… এবার উপমার চোখ দিয়েও অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। নুরকে নিজের দিকে জোর করে ঘুরিয়ে বললো,
তোর কি এত বছরের বন্ধুত্বের প্রতি বিন্দু মাত্র ভরসা নেই? এই কি আমাদের বন্ধুত্ব? তবে লিপি,কেয়ার বন্ধুত্ত্ব আর আমাদের বন্ধুত্বে কি তফাৎ রইলো নুর? একটু মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাব। শুভ্রতা এমন না। আমার বিশ্বাস এদিকে কিছু না কিছু ঘাপলা আছে।

উপমা আবারো বললো,
তোকে এই ছবি গুলো কে দিয়েছে নুর? আমাকে বল। আমাদের মধ্যে তো এই পর্যন্ত কত সমস্যা হয়েছে। তাই বলে কি আমরা সম্পর্ক শেষ করেছি? প্রতিবারের মতো এইবারও আমরা ছয় বান্ধবী এক সাথে থাকলে সব সমস্যা সমাধান করতে পারবো। প্লীজ নুর! দোস্ত আমার পাগলামি করিস না।

নুর শান্ত দৃষ্টিতে একবার তাকালো উপমার দিকে।
~নিজেকে তৈরি রাখ উপ। আমাদের বন্ধুমহল অবশেষে ভাঙতে চললো।

নুর পা বাড়ালো সিড়ির দিকে। উপমা যেনো পাগল প্রায় হয়ে গেলো। হন্ত দন্ত হয়ে নুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,
দোস্ত! নুর! এসব কি বলছিস? আমাদের এত বছরের বন্ধুত্ত্ব এভাবে রাগের মাথায় শেষ করিস না। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাব। আমরা তো জানি আমাদের শুভি কেমন। ও এমন খারাপ কাজ কখনোই করবে না নুর।

নুর করুন দৃষ্টিতে তাকালো উপমার দিকে। তারও তো কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু অরণ্যর বেইমানি সে মানতে পারছে না। শুভ্রতা! কি করে পারলো সে? বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে বেস্ট ফ্রেন্ড এর ভালোবাসার মানুষটাকে কেড়ে নিলো? বুক কাপলো না? উপমার কান্নারত চেহারার দিকে আর তাকালো না নুর। চুপচাপ ঘরে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।

🍂এখন🍂

নুর উঠে অজু করে তাহাজ্জুদের নামাজে দাড়ালো। অশান্ত মনটাকে শান্ত করার উপায় আর তার কাছে নেই এখন। মোনাজাতে কান্নায় ভেংগে পড়লো সে। সে চায় না তার প্রিয় বন্ধুমহলটা এভাবে ভেঙে যাক।

🍂🍂🍂

শুভ্রতার বাড়ির মেইন দরজায় দাড়িয়ে আছে নুর, উপমা, রিদিতা আর রুপা। নুর উপমাকে বললো কলিং বেল বাজাতে। উপমা বিরক্তিতে ‘চ্”
শব্দ করে রিদিতার দিকে তাকালো। নুর চুপচাপ দাড়িয়ে ওদের দেখছিলো। সেদিনের কথার পর থেকে উপমা আগের থেকে অনেক বেশি চুপচাপ থাকে। নুরের কথায়ও বেশ বিরক্তবোধ করে। নুর ওর এই ব্যবহার গায়ে মাখায় না। তার মতে শুভ্রতার আসল রূপ জানতে পারলে সে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুললো রেনু। প্রতিবারের মতো রেনু আজ হাসলো না। চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ। ওদের দেখতেই রেনুর চোখে জল টলমল করতে লাগলো। রুপা কর্কশ গলায় প্রশ্ন করলো,
শুভ্রতা বাসায় আছে?

রেনু রুপার কথায় একটু না বরং অনেকটাই অবাক হলো। সে কখনোই ওদেরকে দেখেনি শুভ্রতাকে শুভ্রতা বলেই ডাকতে। সবসময় শুভি বলেই তো ডাকে ওরা। রুপা কঠিন গলায় আবার বললো,
কি হলো জবাব দিচ্ছো না কেনো?

রুপার ধমকে রেনু কিছুটা কেপে উঠলো। হাত উঠিয়ে শুভ্রতার ঘরের দিকটা দেখিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো,
আপামনি ঘরেই আছে।

ওরা জবাব পেতেই সিড়ি বেয়ে শুভ্রতার ঘরের কাছে চলে গেলো। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বেশ অনেকক্ষণ করাঘাত করার পর ভেতর থেকে কাচের ভাঙার শব্দ হলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই শুভ্রতা ঘরের দরজা খুললো। দরজা খুলে ই শুভ্রতা চোখ ডলতে ডলতে বললো,
কি সমস্যা তিলো? কতবার বলেছি আমাকে ডাকবি না। আমি মাকে দেখি তো!

~তিলো না। আমরা।

নুরের কথায় ফট করে চোখ মেলে তাকালো শুভ্রতা। চোখের সামনে বান্ধবীদের এতোদিন পর দেখেও নির্বোধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। রুপা শুভ্রতার ঘরে ঢুকতে চাইলে শুভ্রতা বাঁধা দিলো।

~নিচে গিয়ে বস। আমি আসছি।

এরপর রেনুকে ডেকে বললো নাস্তার ব্যবস্থা করতে। নুর এক ভ্রু উচিয়ে তাকালো। রোষপূর্ণ গলায় বললো,
কেনো? আগে তো ঘরেই বসতাম। আজ বাহিরে বসবো কেনো? আমরা ঘরেই বসবো।

শুভ্রতা হাসলো। তৎক্ষণাৎ দরজা ছেড়ে দাড়িয়ে বললো,
~আয়

নুর খেয়াল করলো শুভ্রতা ঠিক মতো তাকাতেও পারছে না। যেনো এখনি তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যাবে। গায়ে নীল রঙের একটা থ্রি পিছ, মাথার লম্বা চুলগুলো এলোমেলো যেনো অনেক দিন যাবত অযত্নে আছে, চোখের নিচেও কালচে দাগ বিদ্যমান। শুভ্রতা ঘরে এসে বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিলটার উপর থেকে ওষুধের পাতাটা নিয়ে দ্রুত ড্রয়ারে লুকালো। এরপর ঢুলতে ঢুলতে বললো,
তোরা বস, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

শুভ্রতা দাড়ালো না। দ্রুত চলে গেলো ওয়াশরুমে। নুররা ঘরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা ঘন্ধ তাদের নাকে লাগলো। কতদিন ধরে ঘর বন্ধ করে রেখেছে এই মেয়ে? ঘর এত অন্ধকার যে দিনের বেলায়ও শুভ্রতার ঘর দেখে রাত মনে হচ্ছে। রিদিতা দেয়াল হাতড়িয়ে লাইটের সুইচ খুঁজলো। লাইট জ্বালাতেই ওদের নজরে এলো ঘর পুরো এলোমেলো, ঘরে পর্দা লাগানোর কারণে ঘর এত অন্ধকার ছিল। নুর দেখলো বিছানার পাশে একটা কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। উপমা গিয়ে জানালা থেকে পর্দা সরাতেই রেনু ঘরে এলো নাস্তা নিয়ে। টেবিলের উপরে রেখে দ্রুত ঘরটা পরিষ্কার করতে শুরু করলো। নুর একটু আগে শুভ্রতার ড্রয়ারে রাখা ওষুধের পাতাটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। অর্ধেকের বেশি ওষুধই হয়তো খাওয়া শেষ। নুর গুগলে ওষুধটার সম্পর্কে সার্চ করতেই জানতে পারলো এটা ঘুমের ওষুধ। তিলোত্তমার আওয়াজ পেতেই নুর বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলো। রেনু ইতিমধ্যেই ঘর পরিষ্কার করে চলে গেছে। তিলোত্তমা নিজের ব্যাগটা শুভ্রতার পড়ার টেবিলের ওপর রেখে বললো,
তোরা এখানে? কখন এলি?
~তুই এখানে? (নুর)
~শুভির সাথে দেখা করতে এসেছি। (তিলোত্তমা)
~আমরাও কিছু প্রশ্নের জবাব নিতে এসেছি। (রুপা)
~জবাব? (তিলোত্তমা)

~আহ্! তিলো পর্দা লাগা। আমার চোখে লাগছে।

নুর দেখলো শুভ্রতা এই টুকু সময়ের মধ্যেই গোসল করে বেরিয়েছে। শুভ্রতার কথা শুনতেই তিলোত্তমা দ্রুত পর্দা লাগিয়ে দিলো। শুভ্রতা এতক্ষণে চোখে চেপে রাখা হাতটা নামালো। চোখ পিটপিট করে ওদের দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ যাবৎ। হঠাৎই দৌড়ে এসে নুরকে জড়িয়ে ধরে বললো,
তোরা এসেছিস? সত্যি এসেছিস? তোদের অনেক মিস করছিলাম আমি। অনেক কথা বলার আছে তোদের। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো জানিস।

নুরের এটাকে নাটক বলেই মনে হলো। তার রাগে, ঘৃণায় গা রি রি করছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতেই শুভ্রতা কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। চোখে ফুটে উঠেছে বিস্ময়।

~এভাবে ধাক্কা দিলি কেনো ওকে ঝাড়বাতি? আর একটু হলেই তো পড়ে যেতো।

তিলোত্তমার কথায় নুর কান দিলো না। কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুভ্রতার দিকে চেয়ে রইলো। আর শুভ্রতার স্থির দৃষ্টি নুরের হাতে থাকা ওষুধের পাতাটার দিকে। নুর একবার নিজের হাতের দিকে তাকালো। শুভ্রতা হাত থেকে নজর সরিয়ে নুরের দিকে তাকালো। নুর অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
অরণ্যের সাথে তোর কি সম্পর্ক শুভ্রতা?

শুভ্রতা প্রশ্নের জবাব দিলো না। হাত বাড়িয়ে বললো,
আমার ওষুধ দে। এটা ধরেছিস কেনো?

নুর হাতে থাকা ওষুধের পাতাটা মাটিতে ছুড়ে মারলো। তেজী গলায় বললো,
ওষুধ মাই ফুট! তুই আমার প্রশ্নের জবাব দে। অরণ্যের সাথে কি সম্পর্ক তোর?

শুভ্রতা কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
তোর চাহনী আজ জানার আগ্রহ থেকে বেশি সন্দেহ প্রকাশ করছে কেনো ঝাড়বাতি?
~অরণ্যের সাথে প্রেম করিস তুই? তুই জানিস না আমি ওকে ভালবাসি? আমার সাথে এমন বেইমানি না করলে হতো না?

শুভ্রতার ঠোঁটের হাসিটা উবে গেলো। তিলোত্তমা অবাক হয়ে বললো,
মাথা ঠিক আছে তোর? কি বলছিস এসব?

নুর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তিলোত্তমার দিকে। ছবি গুলো দেখলো তিলোত্তমাকে। তিলোত্তমা মনোযোগ দিয়ে দেখলো সেসব ছবি। ফোনটা শুভ্রতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নুরের উদ্দেশ্যে বললো,
তোর আচরণে আজ অবাক হলাম নুর। একটা ছবি দেখেই ধরে নিলি শুভ্রতার সাথে অরণ্য ভাইয়ার রিলেশন? ওর প্রতি তোর বিশ্বাস এই টুকুই? (তিলোত্তমা)
~প্রমাণ পাওয়ার পরও বিশ্বাস করবে না? ও কি বোকা নাকি? শুভ্রতা করতে পারলে ও জিজ্ঞেস করতে পারবে না? (রুপা)

তিলোত্তমা চোখ রাঙিয়ে ধমকে উঠে বললো,
আমি এই মুহূর্তে তোর সাথে কথা বলছিনা রুপ। নিজের উস্কানিমূলক কথা বন্ধ রাখ।

রুপা চোখ বড় বড় করে তাকালো। যেই মেয়েকে সে এত বছর যাবৎ শান্তশিষ্ট ভেবে এসেছে সেই মেয়ে আজ তাকে ধমক দিচ্ছে। তিলোত্তমার ধমকে সে ভয় পেয়ে দমে গেলো। উপমা আর রিদিতার দিকে চেয়ে দেখলো তারা দিব্যি বসে নাস্তা করছে আর ফোন গুতাচ্ছে যেনো এদিকে সব স্বাভাবিক। উপমার রুপার দিকে নজর পড়তেই বললো,
ভ্যাবলার মত ওখানে দাড়িয়ে থেকে শুভ্রতা বা তিলোত্তমার হাতে থাপ্পড় না খেতে চাইলে এদিকে এসে বস। চা খা।
~তোদের চিন্তা হচ্ছে না? আমাদের গ্রুপটা শেষ হয়ে যাবে।

উপমা তাচ্ছিল্য হাসি হেসে রুপার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
এই গ্রুপটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন তো মাত্র নজরে এলো।

অন্যদিকে শুভ্রতা এখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি এখনও ফোনেই স্থির। নুর কিছু বলার আগেই শুভ্রতা প্রশ্ন করলো,
অরণ্য ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে তোর?
~না
শুভ্রতা নুরের ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
~তার সাথে আগে ঠান্ডা মাথায় কথা বল তারপর আমি তোর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবো। যা জিজ্ঞেস করবি সব প্রশ্নের জবাব দিবো। আপাতত আমার মন মানসিকতা কোনোটাই ভালো নেই। তুই বাসায় যা, আমি তোর সঙ্গে পরে কথা বলবো।

নুর গেলো না। জিদ দেখিয়ে দাড়িয়েই রইলো। তাচ্ছিল্য করে বললো,
~ওই লোকের সাথে আমার কোনো কথা নেই। আমি আর এই জনমে ওই লোকের মুখও দেখতে চাই না। আর তোর কি আমাকে ভীতু মনে হয়? তোর রাগকে কি আমি ভয় পাই? যখন যা মন চায় তাই করবি। আর আমরা? আমরা বসে বসে দেখবো? আমাদের ইচ্ছা নেই? আমাদের রাগ নেই? (নুর)

শুভ্রতার দৃষ্টি শান্ত। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~আমি আমার ইচ্ছা তোদের ওপর চাপিয়েছি কখনো? আমি রাগের মাথায় তোদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি কখনো? আমার রাগ তোরা সহ্য করলে তোদের রাগ কি কখনোই আমি সহ্য করিনি নুর? আমি যে কখনোই তোদের খারাপ চাইবো না এই বিশ্বাসটুকুও কি আমি এতো বছরে অর্জন করতে পারিনি? (শুভ্রতা)

শেষ বাক্যটা শুভ্রতা কাতর কন্ঠে বললো। নুর জবাব দিলো না। মুখ ফিরিয়ে নিতেই শুভ্রতার চাহনীর পরিবর্তন হলো। শান্তভাবটা মুছে গিয়ে দেখা দিলো চাপা অভিমান আর রাগ। তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
~যারা আমাকে বিশ্বাস করে না তাদের কাছে জবাবদিহির কোনো মানেই হয় না। তুই যখন বুঝেই নিয়েছিস তোর বয়ফ্রেন্ড আর আমি প্রেম করছি তবে এখানে এসে আমার সাথে কথা বাড়াচ্ছিস কেনো? তাকে গিয়েই জিজ্ঞেস কর।

নুর অন্তিক আশ্চর্য হয়ে তাকালো। শুভ্রতার এমন কথা শুনে রাগটা এবার আকাশ ছুঁলো। এগিয়ে গিয়ে গায়ের সম্পূর্ণ জোর দিয়ে এক চর লাগলো শুভ্রতার গালে। শুভ্রতার দু কাধ শক্ত করে ধরে চিৎকার করে বললো,
~কেনো করলি এমন?

শুভ্রতা অস্বচ্ছ চোখে চেয়ে রইলো নুরের চোখের দিকে। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে তার। শুভ্রতার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়তেই নুরের হাত কিছুটা আলগা হয়ে এলো। আজ শুভ্রতার চোখের ভাষা বুঝতে পারছে না সে। নুরের কষ্ট হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে তবে সে এখন নিজেকে নরম দেখাতে চাইছে না, কোনো মতেই না। তিলোত্তমা এসে নুরকে শুভ্রতার থেকে দূরে সরালো। নিজের বান্ধবীদের এভাবে দেখবে তা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। রুপা, উপমা আর রিদিতাও অবাক হলো। দৌড়ে শুভ্রতার কাছে যেতে নিলেই ওদের হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলো। শুভ্রতা দু কদম পিছিয়ে গিয়ে টেবিলের পাশে চেয়ারটায় বসলো। তার চোখ মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যে। রাগে থর থর করে হাত কাপছে তার। ঠোঁটের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তটা সে ডান হাত দিয়ে মুছলো। হাতে লেগে থাকা রক্তের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে বার কয়েক লম্বা শ্বাস নিয়ে নুরের দিকে তাকালো। দাতে দাত চেপে বললো,
~আমি চাইছি না রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা কিছু বলতে। কাছের মানুষ গুলার সাথে লড়াইয়ের শক্তি আমার মধ্যে আর নেই নুর। আমি সত্যিই অনেক ক্লান্ত। প্লীজ আমার চোখের সামনে থেকে যা।

রুপা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
শুভি তুই কিন্তু নিজের লিমিট ক্রস করছিস। তুই নুরের সাথে মোটেও এমন বিহেভ করতে পারিস না।
~আমি কি করতে পারি আর কি পারি না তা অবশ্যই আমার আলাদা করে বলা লাগবে না রুপ।

শুভ্রতা নুরের দিকে উন্মত্ত হয়ে তাকালো। থমথমে গলায় বললো,
আমি কি বলছি শুনতে পাস নি! গেট আউট অফ মাই হাউজ! জাস্ট গেট লস্ট!!!

শুভ্রতা টেবিলে থাকা সমস্ত জিনিস ছুড়ে ফেললো মাটিতে। মুহূর্তেই ঘরময় জুড়ে ঝঙ্কার তুললো কাঁচ ভাঙার শব্দ। সারা ঘরের মাটিতে ছড়িয়ে গেলো কাচের টুকরোগুলো। নুর আঁতকে উঠলো। শুভ্রতা মাথা চেপে ধরে ধপ করে চেয়ারে বসলো। বিড়বিড় করে বললো,
তোরা কেউ আমার আপন না। আমার সামনে থেকে যাও সবাই। আমি কাউকে চাই না, কাউকেই না। দূরে যাও! চলে যাও!

নুর হতবাক, স্তম্ভিত, বিস্মিত। নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকে। আজকের শুভ্রতাকে সে চিনতে পারছে না, কোনো ভাবেই না। যে মানুষটাকে সে নিজের প্রিয় বান্ধবী বলেছিল, যাকে সে সবার থেকে ভালোভাবে চিনে বলে ঘুরে বেড়াতো আজ সেই বান্ধবীই তার কাছে সব থেকে অপরিচিত ঠেকছে। আজ থেকে এই মানুষটাকে চিনে না সে। সে নিজের মনকে শক্ত করলো। তীব্র রোষপূর্ণ গলায় জানালো,
আজ থেকে আমাদের বন্ধুত্ত্ব শেষ শুভ্রতা। এই মুহূর্ত থেকে না তুই আমাকে চিনিস আর না আমি তোকে চিনি।

শুভ্রতা মাথা তুলে বজ্রাহত দৃষ্টিতে তাকালো। চোখ মুখে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক। নুর ব্যাগ নিয়ে ওর ঘর থেকে বের হতেই দেখলো রেনু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ গুজে কাদঁছে। নুর এক পলক তার দিকে তাকালো মাত্র। এরপর হনহন করে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। পেছন পেছন দৌড়ে এলো শুভ্রতা। নুরকে আটকানোর জন্য উতলা হয়ে পড়লো,

~নুর? দোস্ত? আমি একা হয়ে যাবো। ডোন্ট! ডোন্ট গো প্লীজ ঝাড়বাতি!

~নুর! আমি সরি, নুর। আমি এখনই এক্সপ্লেনেশনস দিবো নুর। তোর সব প্রশ্নের জবাব দিবো নুর! প্লীজ যাস না।

~অরণ্য, অরণ্য ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে নুর। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। নুর তোরা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। প্লীজ ডোন্ট লীভ মী।

নুর থামলো না। মেইন দরজার সামনে আসতেই শুভ্রতা হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। নুরের ডান হাত টেনে কপালের সাথে চেপে ধরে বলল,
আমি যা বলেছি রাগের মাথায় বলেছি। তুই তো জানিস আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না। তাই তো একা থাকতে চাইছিলাম। আমি কখনোই আর এমন রাগারাগি করবো না। মা ও চলে গেছে। তোরা যাস না নুর। প্লীজ নুর আমি একা হয়ে যাবো। তুই তো জানিস তোদের শুভি একা থাকতে পারে না। আমি আর কিছুদিন একা থাকলে মরে যাবো নুর। প্লীজ যাস না।

নুর ঝারা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো। তিক্ততায় তার মন ভরে উঠেছে। এসব নাটকে সে আর গলবে না। অরণ্য বা শুভ্রতা কাউকেই আর চাই না তার। সে একাই ভালো থাকতে পারবে। বেরিয়ে এলো শুভ্রতার বাড়ি থেকে। একবার পেছন ফিরে দেখলোও না শুভ্রতার কান্নারত মুখটা। নুরের পেছন পেছন রুপাও বেরিয়ে এলো।
অন্যদিকে সিড়ির পাশে দাড়িয়ে সবটাই দেখলো তিলোত্তমা, উপমা আর রিদিতা। নুর চলে যেতেই জ্ঞান হারালো শুভ্রতা। এতদিনের মানসিক চাপ তার মস্তিষ্ক আর বহন করতে পারলো না। মাটিতে ঢলে পড়তেই সকলে দৌড়ে শুভ্রতার কাছে গেলো। তিলোত্তমা শুভ্রতার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
~আজকের কাজের জন্য তোর আফসোসের কুল থাকবে না নুর, ভীষণ রকম আফসোস করবি তুই। একদিন এমন ভাবেই দাহ হবে তোর চিত্তও। কি করে সহ্য করবি এই চিত্তদাহ? কি করে করবি তোর এই ভুলের প্রাশ্চিত্ত?
~~~
চলবে~
(গল্প দেরি করে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমার কয়েকদিন পর পরীক্ষা। পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায় লেখা হয়ে উঠছে না। রাত জেগে লিখলাম। ভুল ক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর হ্যাঁ! আমার জন্য দোয়া করবেন। হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here