অন্তহীন পর্ব -২৫+২৬

#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

সায়াহ্নের প্রহর কিন্তু বৃষ্টি থামলো না। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ার জন্য বাবার বাড়িতে যাওয়া হয়নি চৈতির। সেই দুপুর থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। প্রকৃতি শীতল, শান্ত, স্নিগ্ধ।ঠান্ডা বাতাস বইছে। শীত শীত অনুভব হচ্ছে। রেদোয়ান চৌধুরীর সাথে বসে বসে গল্প করছে চৈতি। রেদোয়ান চৌধুরী তাকে বড় বড় কথা সাহিত্যিকদের গল্প বলছেন। তাদের জীবনের কাহিনী খুব মন দিয়ে শুনছে চৈতি। ধরিত্রী তখন সাঁঝবেলার বর্ষণে সতেজ হচ্ছে। রাস্তার খাদ গুলো জলে পরিপূর্ণ। ভেজা নগরীর লাল নীল হলুদ রঙের লাইটের আলো শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।চন্দ্রিমার অস্তিত্ব বিহীন অন্তরীক্ষ আজ অসুন্দর মনে হচ্ছে রিক্ত প্রেমিকের কাছে। কিশোরী বউয়ের আবদার মেটাতে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় প্রহন। এই বৃষ্টির মধ্যে নাকি তার ভীষণ ফুচকা খেতে মন চাইছে। মিসেস ইয়াসমিন বাড়িতেই বানিয়ে দিতেন কিন্তু তেঁতুল ছিল না।যার জন্য প্রহন কে বৃষ্টির মধ্যে ফুচকা আনতে যেতে হচ্ছে। পিচ্চি বউয়ের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখা যায় নাকি!
রেদোয়ান চৌধুরী চৈতির দিকে তাকিয়ে বললেন,”গল্প পড়তে ভালো লাগে?”
চৈতি হাস্যউজ্জ্বল মুখে উত্তর দিলো,”অনেক বেশি।”
মিসেস ইয়াসমিন রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন”হ্যাঁ বানাও তোমার মতই উপন্যাস পাগল বানিয়ে তুলো। বাস্তবতা ছেড়ে সারাদিন শুধু কল্পনায় ডুবে থাকুক।”
মিসেস ইয়াসমিন এর এমন কথায় বিরক্ত হলেন রেদোয়ান চৌধুরী। বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলে উঠলেন,”দেখো ইয়াসমিন, আমার উপন্যাস পড়া নিয়ে তোমার থেকে এই সব কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। বিয়ের পরের দিন থেকেই যে তুমি আমার বই পড়ার পেছনে লেগেছো এখনো ছাড়োনি। আমার বই পড়া নিয়ে সব সময় তোমার সমস্যা ছিল,আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।”
মিসেস ইয়াসমিন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জোর পূর্বক হেসে বললেন,”যে মানুষ টা তার প্রিয় মানুষের থেকে একটু সময় চায় কিন্তু পায় না সে মানুষটাই জানে প্রিয় মানুষটা থেকে সামান্য সময়টুকু পেলে মনের ভেতর কতটা শান্তি লাগে। অথচ সেই বিয়ের পর থেকেই তুমি যখনই একটু ফ্রী ছিলা তখনই উপন্যাসের বই নিয়ে বসতে। আমার জন্য তোমার সময় ছিল না কখনো।আর এখন ও নেই।”
মিসেস ইয়াসমিন আর রেদোয়ান চৌধুরীর কথা গুলো চুপচাপ শুনে যাচ্ছে চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে তার মনে হলো,’প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া এক টুকরো সময় ও কারো কাছে অনেক দামি।’
রেদোয়ান চৌধুরী ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে তাকিয়ে আছেন।৩০ বছরের সংসারে মিসেস ইয়াসমিন এর কাছ থেকে এই একটা কথা শুনতে শুনতে তা মুখস্থ করে ফেলেছেন রেদোয়ান চৌধুরী। তিনি মিসেস ইয়াসমিন কে বলে উঠলেন,”শুনো ইয়াসমিন, এই কথা টা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।আর এটা শুনতে ও এখন আর আনন্দ লাগে না। তুমি বরং রুমে যাও। রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নতুন কিছু চিন্তা করো।”
রেদোয়ান চৌধুরীর এহেন কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো চৈতি। চৈতির হাসি দেখে মিসেস ইয়াসমিন এবং রেদোয়ান চৌধুরী ও হেসে উঠলেন।
মিসেস ইয়াসমিন এর ফোন বেজে উঠলো।স্ক্রিনে প্রহনের নাম্বার ভেসে আছে।হাসি মুখে কল রিসিভ করলেন তিনি। ওপাশ থেকে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথে মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি। ফোনের ওপাশ থেকে অচেনা একটা কন্ঠ ভেসে ওঠে,”এই মোবাইল এর মালিক মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছেন।আপনারা দ্রুত আসুন।”
কথা টা কর্ণপাত হতেই অধর থেকে হাসির রেখা মিলিয়ে যায়। বুকের ভেতর কেপে ওঠে।হাত থেকে মোবাইল টা পড়ে যেতে নিলে চৈতি ধরে ফেলে। মিসেস ইয়াসমিন এর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে।আৎকে উঠে চৈতি সাথে রেদোয়ান চৌধুরী ও।
মোবাইল এর ওপাশ থেকে লোক টা হসপিটালের নাম বলে দিয়েছে।লাইন কেটে গেছে। রেদোয়ান চৌধুরী মিসেস ইয়াসমিন এর কাঁধ ঝাঁকিয়ে অস্থির কন্ঠে বলে উঠেন,”কী হয়েছে ইয়াসমিন? উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
মিসেস ইয়াসমিন কাঁপা গলায় বললেন,”প্রহনের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে কেঁপে উঠলেন রেদোয়ান চৌধুরী। ছিটকে সরে গেল চৈতি। নিজের কান কে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।কী শুনলো এটা?
রেদোয়ান চৌধুরী মিসেস ইয়াসমিন আর চৈতির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,”এখন এমন শক খেয়ে কান্না করার সময় না। জলদি চলো হসপিটালে।
বৃষ্টির ভিতর কোনো ছাতা ছাড়া ছুটছেন তারা। বাড়ির গেইট পেরিয়ে রাস্তায় নামতেই ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহন কে দেখে থমকে গেল সবাই। প্রহন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রহন কে এমন সুস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গিয়ে প্রহন কে জড়িয়ে ধরলো চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন ও প্রহনের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রহন হাতের ফুচকার প্যাকেটটা রেদোয়ান চৌধুরীর হাতে দিয়ে বললো,”কী হয়েছে? তোমরা এই বৃষ্টির মধ্যে ছাতা ছাড়া বাইরে আসছো কেন?”
চৈতি কাঁদছে প্রহনের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”তুমি ঠিক আছো আব্বু? কিছু হয়নি তো তোমার?”
প্রহন বুঝতে না পেরে বললো,”কী হবে আমার? কিছু হয়নি তো।”রেদোয়ান চৌধুরী মিসেস ইয়াসমিন এর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,”ছেলে একদম ঠিক আছে। তুমি ভেতরে চলো তো।”মিসেস ইয়াসমিন কে নিয়ে চলে গেলেন রেদোয়ান চৌধুরী। চৈতি এখনো প্রহন কে জড়িয়ে ধরে আছে। চৈতির চোখের পানিতে প্রহনের টিশার্ট ভিজে গেছে অনেকটাই। প্রহন এক হাত দিয়ে চৈতি কে জড়িয়ে ধরে বললো,”কী হয়েছে বউ? এমন করে কান্না করছো কেন?”
কান্নার কারণে কথা বলতে পারছে না চৈতি। প্রহন চৈতি কে নিজের থেকে সরিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,”ভিজে গেছো পুরো। ভেতরে চলো।”
———
সোফায় বসে প্রহন মিসেস ইয়াসমিন এবং রেদোয়ান চৌধুরী। চৈতি রুমে ড্রেস চেঞ্জ করছে। মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে তাকিয়ে প্রহন বললো,”কী হয়েছিল যার জন্য এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাচ্ছিলে তোমরা?”
মিসেস ইয়াসমিন বললেন,”তোমার নাম্বার থেকে কল আসছিল যে, তোমার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চোখ গোল গোল করে তাকালো প্রহন।কন্ঠে এক রাশ বিষ্ময় নিয়ে বলে উঠলো,”কীহ আমি এক্সিডেন্ট করেছি আমি জানি না।”
পাশ থেকে রেদোয়ান চৌধুরী বললেন,”কিন্তু কল টা তো তোমার ফোন থেকেই আসছে।”
বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো প্রহন। পকেট হাতড়ে দেখলো মোবাইল নেই। বিষয় টা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। সোফায় বসতে বসতে বললো,”মোবাইল তো চুড়ি হয়ে গেছে। আর নয়তো কোথাও পড়ে গিয়েছিল। অন্য কেউ পেয়েছে হয়তো তার এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
মিসেস ইয়াসমিন কপালে হাত রাখলেন। প্রহন রেদোয়ান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,”কোন হসপিটালে আছে বলেছে কিছু? আমার তো মোবাইল টা আনতে যেতে হবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে। তার চেয়ে ও বড় কথা অনেকেরই নাম্বার সেভ করা আছে।”
মিসেস ইয়াসমিন ধীর কন্ঠে হসপিটালের নাম বললেন। প্রহন তখনই যেতে চাইলে যেতে দিলেন না তিনি।ভয় কাটেনি এখনো।”সকালে নিতে যাবে”কড়া গলায় কথা টা বলে দিলেন তিনি। প্রহন আর মায়ের কথার অবাধ্য হলো না। বাড়ির সবার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে সে। তবে এই একটা কথা ভেবে ভীষণ ভালো লাগছে তার যে তার পরিবার তাকিয়ে নিয়ে কত চিন্তা করে। রুমে চলে গেল প্রহন। চৈতি বিছানার উপর পা ভাঁজ করে বাবু হয়ে বসে আছে।চুল থেকে পানি পড়ছে। মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।মন খারাপি হাওয়া ছুঁয়ে গেছে তাকে। চোখের কোনে এখনো পানি চিকচিক করছে। সেই সময় মিসেস ইয়াসমিন এর মুখে কথাটা শোনার পর এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল কলিজা টা কেউ টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। প্রহন দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল চৈতির দিকে। বিছানার উপর তোয়ালে রাখা। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছিয়ে দিয়ে চৈতির সামনাসামনি বসলো। চৈতি নিমেষহীন দৃষ্টিতে প্রহনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রহন চৈতির মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আচ্ছা তখন কার কথা যদি সত্যি হতো আর আমি যদি মরে যেতাম আমার কথা মনে পড়তো তোমার?”
কথাটা বলার দেরী প্রহনের বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠার দেরি হলো না চৈতির। হঠাৎ প্রহন বুকের ভেতর ব্যাথা অনুভব করলো।ব্যাথায় কাতর না হয়ে মুচকি হেসে চৈতির চুলের উপর চুমু খেলো। মেয়েটা তাকে কামড়াচ্ছে আর বিড়বিড় করছে,”আপনাকে ছেড়ে আমি একদম মরে যাবো।”
#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৬
#স্নিগ্ধা_আফরিন

শহর জুড়ে হিমেল পরশ, রাতের উষ্ণতার পারদ ক্রমাগত নিম্নমুখী।বাইরে ঠান্ডা হলে ও ঘুমন্ত মানবির উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে লোমশ বুকে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করে জানান দিচ্ছে ১টার ঘরে এসেছে সে। নগরীর কলোহল নেই এই গভীর রজনীতে।মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ির হর্নের আওয়াজ যেনো ঝংকার দিয়ে উঠছে নিস্তব্ধ পরিবেশে।রাত জাগা পাখি গুলো ডাকছে। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায় চৈতির। ঘুম ভাঙ্গতেই রাত জাগা পেঁচার ডাক কর্ণপাত হতেই গা ভারী হয়ে এলো যেনো। বুকের ভেতরে ও কেঁপে উঠলো। অদ্ভুত রকমের পাখির ডাকটাকে ভীষণ ভয় পায় চৈতি। ছোট বেলায় শুনে ছিলো,এই পাখি ডাকলে নাকি আপন কেউ মারা যায়। যদি ও এটা যুক্তিহীন গ্রাম্য প্রচলিত কথা।রাত জাগা পাখির কাজই তো রাতে ডাকা। কিন্তু এই ডাকটা শুনলে কেন জানি শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে।
ভয়ে প্রহনের পিঠে খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দেয় চৈতি। চৈতির খামচে ধরার কারণে প্রহন ঘুমঘুম কন্ঠে বলে উঠে,”আছি তো আমি।ভয় পাচ্ছো কেন? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”
চৈতি উত্তর দিলো না। চোখ থেকে ঘুম পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। প্রহন চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,”ঘুমিয়ে পড়ো।ভয় পাচ্ছো কেন? কিচ্ছু হবে না।সব ঠিক আছে।”
ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে এক অন্যরকম শান্তি লাগে মনের গহীনে যখন কিছু না বললেও কেউ একজন বুঝে যায়। চৈতি প্রহনের কাছ থেকে সরে গেল। দূর থেকে আশা পাখির ডাকটাও নেই এখন। দূরে সরে গিয়ে পাশ ফিরে শুতেই কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে চৈতির পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,”দূর সরে থাকার জন্য এত দূর থেকে আসিনি।”
______________
একটা সুন্দর সকাল। দুই দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হবার পর আজ অম্বরে আদিত্যর দেখা মেলেছে।টানা দিন দুই নীরদের সাথে লুকোচুরি খেলে আজ ধরিত্রীতে তেজ ছড়াতে পেরে ক্ষান্ত হলো সূর্য।গাছ গাছালি সতেজ, ছাদের উপর থেকে পুষ্পের মিষ্টি সৌরভে মৌ মৌ করছে চারপাশ।মুক্ত আকাশে পাখা মেলে উড়ছে স্বাধীন পাখিরা।
ঘুম থেকে উঠেই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে চৈতি। সরদার সাহেব ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন আটটা বাজার আগেই যেনো পৌঁছে যায়।
সকালের নাস্তা টা করে যাওয়ার জন্য নিষেধ করেছেন তিনি। এমন অদ্ভুত মানুষ ও হয়?হয়তো হয় এই যে যেমন সরদার সাহেব।
ব্যাগের চেইন টেনে দেয়াল ঘড়ির দিকে এক পলক তাকালো চৈতি।৬টা বেজে ৪৫ মিনিট। প্রহন তৈরি হয়ে বিছানায় বসে বসে ভ্রু কুঁচকে চৈতির কাজ করা দেখছে। মেয়েটা আজকে ও শাড়ি পড়েছে। কলাপাতা রঙের শাড়িটার পার গোলাপি রঙের। প্রহন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রমনীর দিকে। নিজের মনে নিজেই বলে উঠে,”ভাবা যায় এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে আমি রাজিই ছিলাম না।অথচ আজ এই মেয়েকে ছেড়ে থাকতে ও আমার দম আটকে আসে।”
মিসেস ইয়াসমিন হাতে করে একটা গয়নার বাক্স নিয়ে আসলেন প্রহনের রুমে। বিছানার উপর বাক্সটা রেখে চৈতির হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন।মোটা মোটা দুটো বালা পরিয়ে দেন চৈতির হাতে।কানে বড় দুল দিতে পারে না দেখে মাঝারি সাইজের দুল পরিয়ে দিলেন। গলায় সাধারণ ডিজাইনের হার পরিয়ে দিয়ে চৈতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন মিসেস ইয়াসমিন। চৈতির ডান হাতের কণে আঙ্গুলটাতে হালকা কামড় দিয়ে বললেন,”কারো নজর না লাগুক।”
মায়ের কথা শুনে প্রহন বলে,”পেত্নীর উপর আবার কোন পেত্নীর নজর পড়বে বলো?”
প্রহনের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় চৈতি। কোমরে দুই হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আমাকে পেত্নীর মতোন লাগে কোন দিক থেকে?”
প্রহন ঠাট্টার স্বরে বলে,”সব দিক থেকেই পেত্নীর মতো লাগে।পেত্নী সুন্দরী।”
বলেই হেসে উঠে প্রহন। তার হাসির সাথে যোগ দেন মিসেস ইয়াসমিন ও। চৈতি দুই জনের দিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। উদ্দেশ্যে রেদোয়ান চৌধুরীর কাছে বিচার দেওয়া।
‍”আচ্ছা মতন বকা না খাওয়ালে হবে না। আমাকে পেত্নী বলা বিচার দিবো আব্বু কে।”বিড় বিড় করতে করতে রেদোয়ান চৌধুরীর রুমের সামনে চলে গেল চৈতি। রেদোয়ান চৌধুরী হাতে ঘড়ি পড়ছিলেন। দরজার সামনে চৈতি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে ভেতরে ডাক দিলেন। চৈতি কে গাল ফুলিয়ে থাকতে দেখে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”আমার মাটার কী হয়েছে?”
চৈতি রেদোয়ান চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে অভিযোগি কন্ঠে বললো,”আপনার ছেলে আমাকে পেত্নী বলেছে। তার কথা শুনে ভালো মা কিছু না বলে হাসছে।”চৈতির এহেন কথায় রেদোয়ান চৌধুরী হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারছেন না। চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”তুই প্রহনকে শাখামৃগ বলে দিবি। তাহলে শোধ বোধ হয়ে যাবে।”
চৈতি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,”শাখামৃগ টা আবার কী?”
রেদোয়ান চৌধুরী কপাল চাপড়ালেন। সত্যি বলতে শাখামৃগর অর্থ তিনি নিজেও জানেন না।
.
সরদার সাহেবের বাড়িতে যাওয়ার পথে হসপিটাল থেকে নিজের মোবাইল টা নিয়ে আসে প্রহন। পেশেন্ট এর অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো।তার কাছ থেকেই প্রহন জানতে পারে আসলে তার মোবাইল টা চুরি করা হয়েছিল খুব সতর্ক ভাবে।চুরি করে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়েই কভার ভ্যানের ধাক্কায় আহত হয়ে যায় মহান মোবাইল চোর। প্রহন এই কথা শুনে চোরের উদ্দেশ্যে বলেছিল,”আরো আরো করো চুরি।চুরি করে দৌড়ে যাওয়ার সময় গাড়ির ধাক্কায় পটল তুলতে চলে যাও।হাত পা সব ঠিক আছে আল্লাহ সব কিছু ঠিক করেই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তাহলে কাজ করে খাইলে কী হয়?”
প্রহনের কথা শুনে প্রত্যত্তরে চোর মহাশয় বলেছিল,”প্রেমিকার জন্মদিন আজ। তাকে একটা দামী মোবাইল গিফট করতে চেয়ে ছিলাম। আমার কাছে এত টাকা ছিল না তাই চুরি করতে বাধ্য হয়েছি।”
ছেলেটার ভাগ্য ভালো ছিল যে সে অসুস্থ ছিল।তা না হলে এতক্ষণে গালে হাত দিয়ে মুখের ভেতরের দাঁত খুঁজতে হতো।
চুরি করা মোবাইল প্রেমিকা কে গিফট করে মহান প্রেমিক হতো ভাবা যায় এটা?এরাই তো সত্যি কারের প্রেমিক। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোবাইল চুরি করে পালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়ে হসপিটালে পরে থাকে।
প্রহন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে,”তা যার জন্য আমার মোবাইল চুরি করলা সেকি আসছে তোমারে দেখতে?”
পাশ থেকে ছেলেটার এক বন্ধু বলে,”ও মরলেও নাকি ওর প্রেমিকার কিছু যায় আসে না।”
আহারে ভালোবাসা।কেউ একজন তাকে খুশি করতে মোবাইল চুরি করে দৌড়ে পালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়ে মরতে মরতে বাঁচলো আর সে বলে কিনা ছেলেটা মরলে ও তার কিছুই যায় আসে না। অদ্ভুত!
প্রহনের মায়া হলো ছেলেটার জন্য।দেখে ভদ্র ঘরের ছেলেই মনে হয়। ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”এখন ও অনেক সময় আছে ছোট ভাই। সত্যি কারের ভালোবাসা চিনতে শিখো।”

হসপিটালের কাহিনীটাই চৈতি কে বলছিলো প্রহন। চৈতির সামনেই বসে ছিল প্রহন। আচমকা চৈতি প্রহন কে জড়িয়ে ধরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”আমি সত্যি কারের ভালোবাসা পেয়েছি।চিনতে ও শিখে গেছি।”
প্রহন মুচকি হাসে।অধর জুড়ে হাসির রেখা টেনেই বলে,”দিন দিন তুমি বেশিই জড়িয়ে ধরছো চৈতি।হুট হাট করে এতো জড়িয়ে ধরছো কেন? লজ্জা করে না একটা পুরুষ কে এমনে হুট করে জড়িয়ে ধরতে।”

শার্টের উপরেই প্রহনের বুকের উপর কামড় বসায় চৈতি।আরো একটু জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পদকে আমি যখনই মন চাইবে জড়িয়ে ধরবো। তাঁতে আপনার কী?”

হাসলো প্রহন।আলতো করে চৈতির কপালে অধর ছুঁয়েই বলে “আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো?চালাক হয়েছো দেখছি।”

চৈতি প্রহনের কাছ থেকে দূরে সরে গেল।জুনাইদা ডাকছেন। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,”এই পর্যন্ত কয়বার আমার কপালে চুমু খেলেন বলেন তো?”

প্রহন মুচকি হেসে উত্তর দিলো,”দুই বার।”

“মিথ্যেবাদী। পাঁচ ছয়বার তো দিয়েছেন।”
চৈতির কথা শুনে অবাক হলো প্রহন। শুধু দুই বারই চৈতির জানতে দিয়েছে। প্রহন অবাক হয়ে বললো,”তুমি কি জানো?”
চৈতি মুচকি হেসে বললো,”কপাল,গাল গুলো তো আমারই।”

#চলবে,,,,,
চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here