#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#প্রথম_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ7
রাত প্রায় দুইটা ছুই ছুই। বেডের উপর অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে সৃজা। মাথাটা ভালো করে সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। মাত্র কিছু ঘন্টার মধ্যেই চেহারার রং কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মাথার কোকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বালিশের উপর ছড়িয়ে আছে। বেডের পাশে সৃজার এক হাত ধরে বসে আছে রুশা। কপালে তার চিন্তার ভাজ। রুশার থেকে কিছুটা দূরে সৃজার পায়ের দিকের অংশটায় দাড়িয়ে আছে রোহান। ওর চোখে মুখেও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রুশা সৃজার হাতের কব্জিতে আঙুল চেপে ধরে ওর পার্লস চেক করতে করতে রোহানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“এসব কীভাবে হলো রোহান ভাই? আপনি তো এখানে ছিলেন। আপনি দেখেন নি কিছু?”
রোহান মন খারাপ করে বলল,
–“আমি এখানে ছিলাম না ম্যাম। থাকলে কি আর এসব হতে দিতাম? দুপুরে স্যারের থেকে ছুটি নিয়ে একটা কাজে গিয়েছিলাম। কাজটা শেষ করে একটু আগে বাসায় ফিরে দেখি স্যারের গার্ডরা মেয়েটাকে বেল্ট দিয়ে মা*রছে। আর স্যার বসে বসে সেটা দেখছে। আমি ওদের বারন করতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু স্যার তার আগেই আমাকে চলে যেতে বললেন। তাই বাধ্য হয়ে আমি এত রাতে আপনাকে ফোন করলাম। নাহলে হয়ত ওরা এই বাচ্চা মেয়েটাকে মা*রতে মা*রতে আজকে মে*রেই ফেলত।”
কথাটা বলে রোহান একটা ভারি নিঃশ্বাস ছাড়ল। রুশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়াশ দরজা দিয়ে রুমের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে রোহানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“চব্বিশ ঘন্টা এখানকার নিউজ রুশাকে পাচার করার অপরাধে একদিন তোমার এর থেকেও খারাপ অবস্থা হবে রোহান। কথাটা তুমি মিলিয়ে নিও।”
বলতে বলতে ভিতরে এসে আয়াশ রোহানের পাশে দাড়াল। রোহান আয়াশের থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে শুকনো একটা ঢোক গিলল। রুশা সৃজার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বসা থেকে দাড়িয়ে গেল। এগিয়ে এসে আয়াশের সামনে দাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“তুই কি জীবনেও ভালো হতে পারবি না আয়াশ? সারা জীবন এরকম নির্দয় আর পাষাণ-ই থেকে যাবি?”
আয়াশ কিচ্ছু না বোঝার ভান করে বলল,
–“যাহ বাবা, আমি আবার কি করলাম?”
রুশা বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,
–“ড্রামা করিস না প্লিজ। তোর এসব ড্রামা দেখতে এখন আমার অসহ্য লাগে। বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে কেন মারলি বল তো? ওকে এভাবে মেরে তোর কি লাভ হল?”
আয়াশ নির্বিকারভাবে বলল,
–“লাভ-ক্ষতি কিছুই হয়নি। তবে দেখলি না, মা*র খেতে খেতে কি সুন্দর সব সত্যি কথা গুলো গড়গড় করে বলে দিল? এদের মতো টক্সিড ফ্যানদের মাঝে মাঝে এরকম শায়েস্তা করার ভীষন প্রয়োজন আছে। কারন মাঝে মাঝে এরকম দু-চার ঘা উত্তম মধ্যম খেলে অন্যদের স্টক করার শখ এদের সারাজীবনের মতো মিটে যাবে।”
আয়াশের কথা শুনে রুশার রাগ আর বিরক্তির মাত্রাটা তরতর করে বেড়ে গেল। ‘ও’ চোখ-মুখ কুচকে বলল,
–“প্লিজ ফালতু কথা বলিস না আয়াশ। তোর ফালতু কথা শোনার মতো মুডে আমি একদম নেই। অকারনে এত ছোট একটা মেয়েকে এভাবে জানো*য়ারের মতো মে*রে দাগ বানিয়ে দিয়েছিস। আর এখন আবার আমার সামনে দাড়িয়ে সেটা বলছিস! এরকম জঘন্য একটা অন্যায় করার পরেও তোর মধ্যে বিন্দুমাত্রও অনুশোচনা বোধ নেই, তাইনা?”
আয়াশ ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বলল,
–“না নেই। ‘ও’ আমাকে ফলো করছিল, আমার ওকে সন্দেহ হয়েছিল, তাই আমি ওকে মে*রেছি। এখানে আমি নিজের কোনো অন্যায় দেখতে পাচ্ছি না রুশ। আমার জায়গায় অন্যকেউ থাকলেও হয়ত এটাই করত।”
আয়াশের কথা শুনে রুশা কটমট করে ওর দিকে তাকাল। ওর ইচ্ছে করল কয়েকটা থাপ্পর মে*রে আয়াশের মুখের সবগুলো দাঁত মাটিতে ফেলে দিতে। কিন্তু ‘ও’ এরকম কিছুই করল না। রাগি দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও গিয়ে সৃজার পাশে ধপ করে বসে পড়ল।
আয়াশ সৃজাকে ওর বাংলোতে নিয়ে এসে পানির ছিটা দিয়ে সৃজার সেন্স ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তারপর সৃজাকে কয়েকবার “ওর পিছনে ফলো করার” কারন জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সৃজা লাগাতার সেই আগের এক কথাই বলে যাচ্ছিল। ওর মুখে বারবার মিথ্যা কথা শুনে আয়াশও রেগে গিয়েছিল। ওর মনে হয়েছিল সৃজা ওর ক্ষতি করার জন্যে ওর পিছু নিচ্ছিল। তাই আয়াশ ওর গার্ডদের সৃজাকে মারার জন্যে বলে। ওরা বেল্ট দিয়ে পাঁচ-ছয় বার আঘাত করতেই সৃজা কাঁদতে কাঁদতে সব সত্যিটা বলে দেয়। সেই মুহূর্তে রুশাও ওখানে এসে পৌছে যায়। সৃজার বলা কথা গুলো রুশা সবটাই শুনেছে। কিন্তু এখানে অস্বাভাবিক কিছুই দেখেনি। কারন সেদিন আয়াশের সাথে রুশাকে দেখে সবারই মনে হয়েছে রুশা আয়াশের গার্লফ্রেন্ড। তাই সৃজার আয়াশের গার্লফ্রেন্ডকে দেখার কিউরিসিটি নিয়ে আয়াশকে ফলো করাটা বেশ নরমাল ব্যাপার লেগেছে রুশার কাছে। কিন্তু সত্যিটা আগে না জেনেই আয়াশের সৃজাকে এভাবে টর্চার করার বিষয়টা রুশার মোটেও পছন্দ হয়নি।
আয়াশ, রুশা, রোহান বসে বসে সৃজার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছে। ওরা এখনো সৃজার নাম-ঠিকানা কিছুই জানে না। সৃজার সেন্স আসলে ওরা যাতে ওকে দ্রুত বাসায় পৌছে দিয়ে আসতে পারে তাই সবাই এখানেই বসে আছে। যদিও আয়াশ ঘুমানোর জন্যে কয়েকবার নিজের রুমে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রুশার ধমক খেয়ে বাধ্য হয়ে ওকেও এখানেই বসে থাকতে হয়েছে। হঠাৎ বাইরে থেকে শুট-আউটের শব্দ কানে ভেষে আসতেই রুশা, আয়াশ, রোহান চমকে উঠল। তিনজন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দ্রুত বসা থেকে উঠে দাড়াল। আয়াশ বাইরের দিকে যেতে যেতে রুশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“রুশ তুই এখানে থাক। আমি আর রোহান দেখছি কিসের সাউন্ড আসছে।”
বলেই আয়াশ বের হতে নিলেই রুশা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
–“না, আমিও তোদের সাথে যাব। ওয়েট!”
বলেই রুশা আয়াশের পিছু পিছু রুম থেকে বের হয়ে গেল। আয়াশ ওকে ধাক্কা দিয়ে রুমের মধ্যে ঢুকিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিল। রুশা লাগাতার কয়েকবার দরজায় নক করল। আয়াশ সেদিকে পাত্তা দিল না। রোহানকে নিয়ে দ্রুত নিচে চলে গেল। নিচে এসে শুনতে পেল কেউ অনবরত কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছে। আয়াশ এগিয়ে গিয়ে ড্রইংরুমের কাউচের পাশে রাখা ওয়ারড্রোপের ড্রয়ার খুলে নিজের পার্সনাল রিভলবার টা বের করল। তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে সামনের দিকে রিভলবার টা পয়েন্ট করল। সামনের ব্যাক্তিটি সেসবে পাত্তা না দিয়েই গটগট করে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। আয়াশ বাইরের দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখল ওর লোকরা সবাই হাতে-পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে শুয়ে শুয়ে কাৎরাচ্ছে। আয়াশ রেগে এগিয়ে গিয়ে এক হাত দিয়ে আগন্তুক ব্যক্তির শার্টের কলার চেপে ধরল। এতে সামনের ব্যক্তিটি আয়াশের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল। আয়াশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“তোর সাহস হলো কীভাবে আমার বাড়িতে ঢোকার? এই বাড়িতে ঢোকার অপরাধে এর আগে তোর সাথে কি হয়েছিল সেটা কি তুই ভুলে গেছিস?”
কথাটা বলার সাথে সাথে শান আয়াশের মুখের উপর একটা পাঞ্চ করল। আচমকা আক্রমনে আয়াশ সামনের দিকে কিছুটা ঝুকে পড়ল। শান বিকট স্বরে চেচিয়ে বলল,
–“না ভুলিনি। পুরনো কথা কিচ্ছু ভুলিনি আমি। কিন্তু তুই বোধহয় ভুলে গেছিস শান রায়জাদা কে। আর সে ঠিক কি কি করতে পারে। তাই হয়ত আজকে তুই এত বড় একটা কান্ড করার সাহস পেয়েছিস।”
আয়াশ সোজা হয়ে দাড়াল। নাকের নিচে গরম আর তরল কিছু একটা অনুভব করতেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাকের নিচের অংশটা মোছা দিল। তারপর হাতটাকে চোখের সামনে নিয়ে আসলো। দেখল, হাতে ব্লাড লেগে আছে। আয়াশ হিংস্র দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকাল। শান এগিয়ে এসে ওর হাতে থাকা রিভলবার টা আয়াশের কপালে ঠেকিয়ে বলল,
–“আমার বোন কোথায় আয়াশ? ওকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?”
শানের প্রশ্নে রোহান আর আয়াশ দুজনেই আকাশ থেকে পড়ল। আয়াশ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
–“তোর বোন কোথায় সেটা আমি কীভাবে জানব?”
শান কটমট করে বলল,
–“একদম নাটক করবি না আয়াশ। আমি জানি সুজি তোর কাছেই আছে। ওকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস তাড়াতাড়ি বল। নাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
আয়াশ ওর হাতে থাকা রিভলবার টাও শানের দিকে তাক করে বলল,
–“তোর বোনকে যদি আমি নিয়েও আসতাম তাহলেও এতক্ষণ ওকে বাঁচিয়ে রাখতাম না। নিয়ে আসার সাথে সাথে মে*রে মাটির নিচে পুতে ফেলতাম। কিন্তু সত্যি কথা এটাই আমি ওকে এখানে নিয়ে আসিনি।”
শান কড়া গলায় বলল,
–“তোর একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। আমি জানি সুজি এখানেই আছে। ওর ফোনের লাস্ট লোকেশন এই প্লেসেই দেখাচ্ছে। ওকে তাড়াতাড়ি বের করে দে। নাহলে কিন্তু…..”
শানকে পুরো কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আয়াশ উচ্চ স্বরে বলল,
–“নাহলে কিন্তু কি, হ্যাঁ? কি করবি তুই আমার? মে*রে ফেলবি? এত সাহস তোর? আমার বাড়িতে দাড়িয়ে আমাকেই হুমকি দিচ্ছিস?”
–“শান রায়জাদা কাউকে হুমকি দেয় না। কাজে করে দেখায়। দেখতে চাস আমি কি করতে পারি?”
কথাটা বলে শান রিভলবারের ট্রিগারে চাপ দিতে নিল, ঠিক তখনই রোহান কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এসে শান আর আয়াশের মাঝ বরাবর দাড়াল। তারপর পকেট থেকে ফাটা স্কিনের একটা ফোন বের করে শানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“স্যার দেখুন তো এই ফোনটা কি আপনার বোনের?”
শান আয়াশের কপাল থেকে রিভলবার টা নিচে নামিয়ে রোহানের হাতের দিকে তাকাল। আয়াশও ভ্রু কুচকে ফোনটার দিকে তাকাল। শান খপ করে রোহানের হাত থেকে ফোন টা নিজের হাতে নিয়ে উদগ্রীব হয়ে বলল,
–“এটা তুমি কোথায় পেলে?”
রোহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই উপর থেকে কারো চিৎকারের শব্দ শানের কানে ভেষে আসলো। ওটা যে সৃজার কণ্ঠস্বর সেটা বুঝতে শানের এক সেকেন্ডও সময় লাগল না। ‘ও’ আর এক মিনিটও ওখানে না দাড়িয়ে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ওর পিছনে পিছনে আয়াশ আর রোহানও দৌড় দিল। চিৎকারের শব্দ অনুসরণ করে একটা রুমের সামনে এসে থামল শান। রুমটা বাইর থেকে লক দেখে বিলম্ব না করেই শান দ্রুত রুমের দরজাটা খুলে ফেলল। এবং দেখল, সৃজা চেচাচ্ছে আর দরজার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু রুশা ওকে জাপটে ধরে ওকে শান্ত করার জন্যে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শান রুমের ভিতরে যেতেই সৃজা রুশার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে শানকে জড়িয়ে ধরল। ঘটনার আকষ্মিকতায় রোহান, আয়াশ আর রুশা তিনজনই থমকে গেল। সৃজা শানকে জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
–“আ-আমি এ-এখানে থাকব না ভ-ভাইয়া। আ-আয়াশ আমাকে ম-মেরে ফেলবে। ‘ও’ আ-আমাকে মেরেছে। ত-তুমি আমাকে ব-বাঁচাও।”
সৃজার কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে এক নাগাদে বলা কথা গুলো শুনে শান আশ্চর্যের চরম সীমানায় পৌছে গেল। কারন যে মেয়ে এতদিন আয়াশের সাথে দেখার করার জন্যে এত পাগলামি করেছে, সে মেয়ে কিনা আজকে আয়াশের ভয়ে এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছে? শানের এসব ভাবনার মধ্যেই রুশা অবাক কণ্ঠে বলল,
–“এই মেয়েটা আপনার বোন মিঃ রায়জাদা?”
রুশার প্রশ্ন শুনে শান অগ্নি দৃষ্টিতে রুশার দিকে তাকাল। সব জেনেও রুশা এরকম না জানার ভান ধরছে দেখে ওর ইচ্ছে করল রুশাকে খু*ন করে ফেলতে। শানের ধারনা রুশা আর ওর বিয়ের কথা শুনে আয়াশ রেগে সৃজাকে এখানে তুলে এনে টর্চার করেছে। তাই ‘ও’ রুশার প্রশ্নের কোনো অ্যান্সার না দিয়ে সৃজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বলল,
–“ভয় পাস না। আমি এসে গেছি তো। এখন কেউ তোর কিচ্ছু করতে পারবে না।”
আয়াশ এগিয়ে এসে বিদ্রুপের স্বরে বলল,
–“আরেহ বাহ, শান রায়জাদা আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না। আর তার বোন কিনা আমার বিশাল বড় ফ্যান। দারুন ব্যাপার তো। তবে যাই বলেন মিঃ রায়জাদা, আপনার বোন কিন্তু দেখতে মাসাআল্লাহ। যদি আগে জানতাম এটা আপনার বোন, তাহলে এতক্ষণে একে আমি…..”
এইটুকু বলেই বাঁকা হাসল আয়াশ। রুশা রাগে কটমট করে আয়াশের দিকে তাকাল। শান চোয়াল শক্ত করে হাতের আঙুল গুলো মুঠোবন্ধি করে ফেলল। ওর পুরো শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে। শান ওর চোখ জোড়া বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর কাউকে কিছু না বলে সৃজাকে কোলে তুলে নিয়ে হেঁটে দরজার সামনে এসে থেমে গেল। সৃজা শানের বুকে মুখ গুজে ভয়ে কাঁপছে। যাকে দেখার জন্যে ওর চোখ জোড়া এতদিন উদগ্রিব হয়ে থাকত। তার দিকে তাকাতেও ওর আজকে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। শান হালকা ঘাড় কাৎ করে আয়াশের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
–“কাজটা ঠিক করলেন না মিঃ দেওয়ান। আমাদের ঝামেলার মধ্যে আপনি আমার বোনকে টেনে এনে একদম ঠিক করেন নি। এর জন্যে ভবিষ্যতে আপনাকে পস্তাতে হবে।”
এইটুকু বলেই শান হনহন করে ওখান থেকে বের হয়ে গেল। শানের বলা ঠান্ডা স্বরের কথাটা শুনেও রুশার কলিজা কেঁপে উঠল। ওর মনে হচ্ছে এই একটা ঘটনার কারনে হয়ত দুই বছর আগে নিভে যাওয়া আগুনটা আবারও দাবা নলের রূপ নিয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে। রুশার ভাবনার মধ্যেই আয়াশ এগিয়ে এসে ওর কাধে এক হাত রেখে বলল,
–“যাই বলিস মেয়েটা কিন্তু দারুন দেখতে। যদি আগে জানতে পারতাম এটা শানের বোন, তাহলে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর আজকে আমি ওর সাথে একটা অঘটন ঘটিয়েই ফেলতাম।”
আয়াশ কথাটা বলার সাথে সাথে রুশা এক ঝটকায় ওর কাধ থেকে আয়াশের হাত সরিয়ে ফেলল। রুশার এমন কান্ডে আয়াশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। রুশা আয়াশের সামনে এসে দাড়িয়ে ঠাটিয়ে ওর গালে একটা চড় দিয়ে বলল,
–“যেই কান্ড অলরেডি ঘটিয়ে ফেলেছিস তারজন্যে শান রায়জাদা তোর পিছনে বো*ম বেধে তোকে রেলের সাথে ঝুলিয়ে না দিলেই হল। আল্লাহর কাছে বল যাতে সৃজনী ওনাকে সব সত্যিটা বলে দেয়। আর এসবের থেকে তুই নিস্তার পেয়ে যাস।”
কথাটা বলে রুশা হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আয়াশ গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে রুশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আর হঠাৎ করে রুশা শানের বোনকে সৃজনী বলায় ‘ও’ খানিকটা আশ্চর্যও হল। কারন শান এই রুমে এসে একবারও সৃজনীর নাম নেয়নি। তাহলে রুশা কীভাবে জানল আয়াশের বোনের নাম সৃজনী? প্রশ্নটা ক্ষনিকের জন্যে মাথার মধ্যে ঘুড়পাক খেলেও রোহানের কথা কানে আসতেই সেটা মস্তিষ্কের কোনো এক কোনায় চাপা পড়ে গেল। রোহান আয়াশের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
–“স্যার আমাদের গার্ডরা তো সবাই ইনজুরড হয়েছে। এখন ওদের কি করব?”
আয়াশ গাল থেকে হাত নামিয়ে কটাক্ষ করে বলল,
–“আমার মাথায় এনে রাখো। টাকা দিয়ে কতগুলো অপদার্থ পুষি আমি। একেক জন নাকি মস্ত বড় শার্প শুটার। অথচ আজকে একজন লোকের সাথে এরা এত গুলো লোক মিলেও পেরে উঠল না। সবগুলো গুলি খেয়ে ইনজুরড হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। যত্তসব ছাগলের দল!”
রোহান মিনমিন করে বলল,
–“ওদের কি দোষ স্যার? শান রায়জাদার শুট-আউটে এতটাই পারদর্শী যে ওনার রিভলবার হাতে নিয়ে শুট করা দেখলে মনে হবে, উনি খেলনা পিস্তল নিয়ে মজা করছেন।”
আয়াশ রোহানের দিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলল,
–“শাটআপ! ওদের সাথে সাথে শান তোমাকেও শুট করলে আমি আরো বেশি খুশী হতাম। ইউ ডাফার, তোমাকে কে বলেছিল ওই ফোনটা শানকে দেখাতে? কোথায় পেয়েছিলে তুমি ওই ফোনটা?”
রোহান মাথা নিচু করে বলল,
–“ওই আপুটা সেন্সলেস হওয়ার পর যখন ওনাকে কোলে করে উপরে নিয়ে এসেছিলাম। তখন ওটা ওনার জিন্সের পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম পরে ওনাকে ওটা দিয়ে দিব। তাই ওটা আমার পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। আর তখন আমি যদি শান স্যারকে ওই ফোনটা না দিতাম তাহলে এতক্ষণে উনি আপনাকে গুলি করে আপনার মাথার খুলি উড়িয়ে দিত। আপনার ভালোর জন্যেই তো ফোনটা ওনাকে দিয়েছিলাম স্যার।”
রোহানের কথা শুনে আয়াশ ওর দিকে কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বের হয়ে গেল। রোহান আয়াশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটে নিজেও বাইরের দিকে যাওয়ার জন্যে পাঁ বাড়াল।
_________________________
আয়াশের গার্ডদের হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে ফজরের আযানের একটু আগে হসপিটাল থেকে বের হলো রুশা। রাস্তায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। এখানে আসার সময় রোহান আর রুশা এম্বুলেন্সে করে এসেছে। রুশার গাড়িটা আয়াশের বাড়িতেই রয়ে গেছে। রুশা ভাবল ট্যাক্সি করে প্রথমে আয়াশের বাংলোতে যাবে। তারপর সেখান থেকে ওর গাড়িটা নিয়ে নিজের ফ্লাটে চলে যাবে। রোহান আপাতত হসপিটালেই রয়ে গেছে। সবার ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করছে। রুশার জামা-কাপড়ে ব্লাডে মাখামাখি হয়ে গেছে। তাই ‘ও’ এগুলো চেইঞ্জ করার জন্যে বাসায় যাচ্ছে। কারন একটু পরেই ওর আবার হসপিটালে ডিউটিতে আসতে হবে।
রুশার জামা-কাপড়ের এমন বেহাল অবস্থা দেখে ‘ও’ হসপিটালের পিছনের গেট থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু এখন ভোর রাত হওয়ায় এখানে কোনো গাড়িই দেখতে পেল না। বাধ্য হয়ে রুশা হসপিটালের সামনের গেটে যাওয়ার উদ্দ্যেশে পাঁ বাড়াল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড়ি এসে রুশার পাশে হার্ডলি ব্রেক করল। আকষ্মিক ঘটনায় রুশা হাঁটা বন্ধ করে দাড়িয়ে গেল। ‘ও’ কিছু বুঝে উঠার আগেই গাড়ির দরজা খুলে একজোড়া হাত বাইরে বেড়িয়ে আসলো। তারপর বিন্দুমাত্রও সময় ব্যয় না করে রুশাকে টেনে গাড়ির ভিতরে নিয়ে এসে দরজাটা লক করে দিল। ঘটনাটা রুশার বুঝে উঠতে উঠতে গাড়ি স্টার্ড হয়ে শা করে ছুট লাগাল কোনো এক অজানা গন্তব্যে।
সিটের উপরে বসে রুশা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে শানের দিকে। তখন ওকে নিয়ে আসা ব্যাক্তিটা আর কেউ না, স্বয়ং শান রায়জাদা। শানের চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ। রাগে ‘ও’ চোয়াল শক্ত করে সেলোটেপ দিয়ে রুশার পাঁ জোড়া বাঁধল। রুশা কিছু বলল না। গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে শানের কার্যকলাপ দেখতে লাগল। শান এবার এগিয়ে এসে রুশার হাত জোড়া পিছনের দিকে মুচড়ে ধরে হাত দুটোকে একসাথে করে সেলোটেপ দিয়ে বেঁধে নিল। নিরবতা কাটিয়ে রুশা বলল,
–“এসব কি করছেন, আর কেন করছেন? জানতে পারি?”
শান রুশার দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
–“জেনে কি করবেন? একটু পর তো সব নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।”
রুশা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“কি দেখতে পাব?”
শান কিছু না বলে রুশার দিকে খানিকটা ঝুকে ওর সাইডের গাড়ির দরজার লকটা খুলে দিল। সাথে সাথে বাইর থেকে শা শা করে বাতাস এসে গাড়ির মধ্যে ঢুকতে লাগল। রুশা চমকে উঠে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে শানের শরীরের সাথে লেগে বসল। শান পিছন থেকে এক হাত দিয়ে রুশার কোমড়ের অংশ পেচিয়ে ধরে বলল,
–“ভয় লাগছে ডাক্তার সাহেবা?”
রুশা কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলল,
–“না তো। ভয় লাগবে কেন?”
রুশার জবাব শুনে শান মোটেও খুশী হল না। ‘ও’ ঝট করে রুশার কোমড় থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে ফেলল। তারপর রুশাকে একটা ধাক্কা দিয়ে গাড়ির একদম সাইডে পাঠিয়ে দিল। রুশা ব্যালেন্স হারিয়ে বাইরের দিকে ঝুকে পড়ল। ঠিক সেই মুহূর্তে শান ওর এক হাত দিয়ে রুশার এক হাতের বাহু চেপে ধরল। রুশা এবার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“কি করছেন মিঃ রায়জাদা। তুলুন আমাকে এখান থেকে। নাহলে তো আমি নিচে পড়ে যাব।”
শান বাঁকা হেসে বলল,
–“আমিও তো সেটাই চাই।”
রুশা অবাক দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে রইল। শান রুশার বাহুতে জোরে চাপ দিয়ে বলল,
–“আপনার ওই প্রেমিকের জন্যে আমার বোনটা আজকে ছটফট করছে। ওই বাস্টার্ড টা আমার বোনটাকে জানো*য়ারের মতো মেরেছে। আর আপনি চোখের সামনে সবটা দেখেও ওকে আটকান নি। এতটা নির্দয় আপনি কি ভাবে হলেন ডাক্তার সাহেবা?”
রুশা বোঝানো ভঙ্গিতে বলল,
–“দেখুন মিঃ রায়জাদা আপনার ভুল হচ্ছে। আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন। আমাকে একটা বার সব এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দিন। আমি সবটা আপনাকে বলছি।”
শান রুশার কথা অগ্রাহ্য করে বলল,
–“আমি এখন আর কারো কোনো কথাই শুনতে চাই না। আপনারা সবাই মিলে যে ভুল করেছেন, তার শাস্তি তো আপনাদের পেতেই হবে। আমার বোন যেভাবে কষ্ট পেয়ে ছটফট করছে। আপনাকেও সেভাবে কষ্ট পেয়ে ছটফট করতে হবে ডাক্তার সাহেবা। গুড বাই! আশাকরি বেঁচে থাকলে আবারও আমাদের দেখা হবে। হ্যাব আ সেইফ জার্নি।”
কথাটা বলে শান রুশার বাহু থেকে হাত সরিয়ে নিল। সাথে সাথে রুশা গাড়ি থেকে ছিটকে রাস্তার উপরে পড়ে গেল। তারপর সেখান থেকে ছিটকে একদম রাস্তার পাশের শুকনো একটা ডোবার মধ্যে পড়ল। শান গাড়ির দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিয়ে সিটের সাথে হেলান বসে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়ে ছুটে চলল বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্য।
#চলবে…….