#আলো_আঁধার [১২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
হাসপাতালে আলোর লিজার সাথে দেখা হয়ে গেল। আলো লিজাকে দেখেও এড়িয়ে যেতে চাইছিল৷ কিন্তু লিজাই তাকে দেখে নিজে থেকে কথা বলতে আসে। আলোর সাথে লিজা যা করেছে তারপর আর ওর সাথে কথা বলার আলোর কোন ইচ্ছে নেই। তবুও লিজার ডাকে দাঁড়াতে হলো তাকে। লিজা পেছন থেকে ডেকে ছুটে আসছে। আলো বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকাল।
-“আলো! তুমি কেমন আছো?”
তাচ্ছিল্যভরে আলো হাসল।
-“আপনি যেমন দেখতে চেয়েছিলেন।”
-“এখন তুমি কার কাছে আছো?”
-“তা জেনে কী করবেন? ওখানে গিয়েও আমার কলঙ্কের কথা সবাইকে জানাবেন?”
-“আলো এমন করে বলো না। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।’
এবার হেসে ফেলল আলো।
-“বাহ! তাতে আমার লাভটা কী হলো? আপনি আপনার ভুল বোঝাতে আমার জীবনটা কি আবার আগের মত হয়ে যাবে?”
লিজাকে সত্যিই অনুতপ্ত দেখাচ্ছে। তার চোখে জল।
-“আমি জানি তোমার জীবন আবার আগের মত হবে না। তবুও আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।”
-“আপনার কোন কথা শুনতে চাই না আমি।”
আলো চলে যেতে নিলে লিজা ওর হাত ধরে ফেলল,
-“তোমার হাতে ধরি। কথাগুলো শোনো প্লিজ।”
-“কী কথা বলার আছে আপনার আর?”
লিজা ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে দেখল। গলা খাদে নামিয়ে জানতে চাইল,
-“তোমার সাথে কে এসেছে?”
-“আমার এক বন্ধুর মা।”
স্বস্তির শ্বাস নিল লিজা।
-“দীপ্ত আসেনি।”
কপাল কুঁচকে উঠল আলোর। দীপ্তর নাম সে মুখে নেয়নি। দীপ্তর কাছে সে আছে এটাও বলেনি। তাহলে ভাবী জানল কীভাবে? ওর তো দীপ্তর কথা জানার কথা না।
-“দীপ্তকে আপনি কীভাবে চিনেন?”
-“বলছি। আজ তোমাকে সব বলব। তার আগে তুমি আমার সাথে আসো।”
লিজা আলোকে একটা খালি কামরায় নিয়ে গেল।
-“আজ আমরা হাসপাতালে কেন এসেছি জানো? নাসিরকে নিয়ে। ওর অবস্থা ভালো না আলো। বাঁচবে কি মরবে ডাক্তাররাও বলতে পারছেন না।”
আলোর কোন ভাবান্তর হলো না। হবার কথাও না। এই লোকের প্রতি তার কোন টান নেই এখন।
-“নাসিরের এই অবস্থা কে করেছে জানো? দীপ্ত।”
আলো লিজার একটা কথাও বিশ্বাস করতে পারছে না। লিজা আবার নতুন কোন চাল চালছে।
ঝাঁঝালো গলায় সে বলল,
-“আমি বিশ্বাস করি না। আপনি এইবারও মিথ্যা বলছেন। আমার ভালো আপনার সহ্য হয়না। সব সময় আমার কাছের মানুষ গুলোকে আপনি দূরে সরিয়ে দিতে চান।”
-“দোহাই আলো। এবার আমার কথা বিশ্বাস করো। আমি একটুও মিথ্যা বলছি না। শুধু নাসির কেন, দীপ্ত আমার সাথেও যা করেছে তা কোন মানুষ অন্য একজন মানুষের সাথে করতে পারে না।”
লিজা ওর হাত পা দেখাল।
-“দেখো। জানো এসব কিসের দাগ? দীপ্ত আমাকে একটা রাত অন্ধকার ঘরে ইঁদুরের মাঝে ছেড়ে গিয়েছিল। তোমার সাথে অন্যায় করার ওটা আমার শাস্তি। নাসিরকেও দীপ্তই কিডন্যাপ করেছে। দীপ্ত শুধু আমাদের সাথেই এমন করেনি। তোমার সাথে যা যা হয়েছে সব দীপ্তই প্ল্যান ছিল।”
-“কেন মিথ্যে বলছেন! এসব করে আপনি কি পান?”
-“মিথ্যা না আলো। দীপ্ত যেমন দেখায় সে তেমন না। ওর আসল রূপ দেখেছি আমি। তোমার সাথে যা করেছি তা অন্যায়, পাপ। আমি আমার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। তাই তো সাহস করে তোমাকে কথাগুলো বলতে পারছি। ওই দীপ্ত মানুষ না। আস্ত একটা অমানুষ। তোমাকে পাওয়ার জন্য ও প্ল্যান করে তোমার নামে ওসব কথা উঠানোর জন্য আমাকে টাকা দিয়েছে। আমি লোভে পড়ে অনেক বড় পাপ করেছি। আজ যদি দীপ্ত জানতে পারে আমি তোমাকে সবকিছু বলে দিয়েছি, তাহলে ও হয়তো আমাকে আর বাঁচতে দিবে না। তবুও মরার আগে একটা ভালো কাজ করতে পেরেছি বলে আমি শান্তি পাব। তোমার আসল অপরাধী আমরা না আলো। আসল অপরাধী তো ওই দীপ্ত। ও তোমার চোখে ভালো থেকে তোমার আড়ালে তোমাকে নিয়েই ষড়যন্ত্র করেছে। দীপ্ত ভালো লোক নয় আলো।”
আলো কী বলবে? কী করবে সে? কথাগুলো বিশ্বাস করবে? লিজা ভাবী সত্যি বলছে? মিথ্যা বলে তার লাভ কী? তার চোখে ভয়, গলায় আতঙ্ক। এই মুহূর্তে মিথ্যে বলছে না সে। তাহলে দীপ্ত সত্যিই খারাপ লোক! তার এই অবস্থার পেছনে দীপ্ত দায়ী!
-“দীপ্ত তার স্বার্থের জন্য খুনও করতে পারে। বোন তুমি হয়তো আমাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি মন থেকে তোমার ভালো চাই। মানুষ তো আর সব সময় একরকম থাকে না। সেদিন অন্ধকার ঘরে একগাদা ইঁদুরের মাঝে থেকে বুঝতে পেরেছি, ভুল লোকের সঙ্গ দিলে শাস্তি তো পেতেই হবে। আমি যদি ওইদিন মরে যেতাম তাহলে তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও পেতাম না। দীপ্ত আমাকে এই শর্তে ছেড়েছে যে, আমি যেন জীবনেও ওর সামনে না আসি। তোমাকে কিছু না জানাই।”
লিজা কাঁদছে। আলো পাথর হয়ে চেয়ে আছে। কিছু বুঝতে পারছে না সে।
-“অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে মরছিলাম আমি। রাতে ঘুমাতে পারি না। আমার লোভ, হিংসাই আমাকে খেয়েছে। কীভাবে তোমার সাথে এত জঘন্য কাজ করতে পারলাম আমি! আমি তো একজন মেয়ে। তোমার সন্তান যে আমাদেরই বংশের রক্ত। সে তো এখনও দুনিয়াতেই আসেনি। তাকেও ছাড়িনি আমি। হয়তো নিজে কখনও মা হতে পারব না বলেই তোমার উপর এত হিংসা ছিল। তোমার বাচ্চা হলে সবাই ওকে আদর করত। আমার তো কখনও বাচ্চা হবে না। সবাই তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে। আমাকে কথা শোনাবে।”
লিজা কান্নার কারণে কথা বলতে পারছে না। আলোর চোখ দিয়ে পানি না বেরুলেও ওর চোখ দু’টো ভীষণ জ্বালা করছে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কী হচ্ছে এসব তার সাথে? জীবন তার সাথে এতটা নাটকীয়তা কেন করছে?
-“তুমি ওই লোকটার থেকে দূরে চলে যাও। ওর কাছে থাকলে তুমি ভালো থাকবে না। ওই পাগল দীপ্ত তোমার সন্তানেরও ক্ষতি করে দিতে পারে।”
অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না আলো। শরীরে একটু শক্তিও পাচ্ছে না। যাকেই সে বিশ্বাস করে সে-ই তার বিশ্বাস ভাঙে। তাকে একজন মানুষ না ভেবে পুতুল ভেবে খেলা করে।
-“একটা কথা জানেন ভাবী। পৃথিবীতে একটা মেয়েই আরেকটা মেয়ের সবচে বড় শত্রু। জাতিতে আমরা এক হলেও। কেউ কারো সুখ দেখতে পারি না। অন্যের ভালো দেখলে নিজের অপূর্ণতার কথা মনে করে হিংসা করি। আপনাকে চোখের সামনে দেখতেও আমার ঘৃণা লাগছে। কীভাবে পারলেন আমার সাথে এমন করতে! নিজের সন্তান ছিল না। আমার বাচ্চাটাকে আদর করে নিজের কাছে রাখলে আমি কি না করতাম? আপনি তো ওর বড়মা হতেন।”
___________________________
-“শুভ্র রাহা আমার ফোনে কল করেছে। তুমি নাকি ওর কল তুলছো না।”
শুভ্র রেডি হতে হতে মায়ের দিকে তাকাল।
-“তুমি রাহাকে এখনো বলোনি কেন মা?”
-“চট করে তো ওসব কথা বলে ফেলা যায় না। সঠিক সময় বুঝে বলতে হবে। মেয়েটা হয়তো বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে বসে আছে।”
শুভ্র চুপ করে রইল।
-“তুমি ওকে বিয়ে না করো। বন্ধুত্ব তো রাখবে নাকি? কল তুলছো না কেন? হাই হ্যালো তো বলতেই পারো।”
-“হুম।”
-“হুম না। তুমি ওর সাথে কথা বোলো। হুট করে কথা বলা বন্ধ করে দিলে মেয়েটা সামলে নিতে পারবে না।”
-“সরি মা।” অপরাধী গলায় সরি বলল শুভ্র। মিসেস আমিনা ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলেন,
-“সরি কেন?”
-“আমি নিজের মনকে বুঝতে পারি না মা। এতদূর এগিয়ে এসে এখন পিছিয়ে যাচ্ছি। আমার আগেই না করা উচিত ছিল। তাহলে দুই পরিবারের সম্পর্কও ঠিক থাকত। রাহাকে কষ্টও পেতে হতো না।”
-“মন সায় না দিলে তুমি কী করবে? এটা ভালো করেছ যে বিয়ে হওয়ার আগেই মনের কথা বুঝতে পেরেছ। বাপের মত বিয়ের চৌদ্দ বছর পর বুঝোনি।”
-“বাবাকে তুমি কখনও ক্ষমা করতে পারবে না,তাই না?”
-“তুমি চাও আমি ক্ষমা করে দেই?”
-“না। ”
-“তাহলে? ”
-“উনাকে আমিও ঘৃণা করি। তোমাকে কষ্ট দিয়ে চলে গেছেন উনি। নিজের একমাত্র ছেলের কথাও ভাবেননি।”
-“থাক, ওসব কথা বাদ দাও। তুমি আমার সাথে ছিলে আর কিছু চাই না আমি। তোমাকে যে আমি একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি এতেই আমার স্বার্থকতা। বাবার মত হওনি তুমি। আশাকরি ভবিষ্যতে যাকে বিয়ে করবে তাকে ভালোবাসবে ও সম্মান দিবে।”
-“হুম।”
-“এখন হাসপাতালে যাও। নিজের ডিউটি মিস দিও না।”
-“তুমিও কি কোথাও বেরুচ্ছ?”
-“হ্যাঁ। ঢাকা যাব একটু। কাজ আছে।”
-“একা যাবে?”
-“না৷ ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি।”
________________________
আলো হাসপাতাল থেকে দীপ্তর মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে৷ কোথায় যাবে জানে না সে। তবে এই শহরে এই মানুষ গুলোর মাঝে আর থাকবে না। দীপ্তকে সে নিজের বন্ধু ভেবেছিল। বিশ্বাস করেছিল। সেই দীপ্তও তাকে এভাবে ঠকাল! সবকিছু দীপ্তই করেছে। নিজেই ক্ষত দিয়ে নিজেই মলম লাগিয়েছে! জীবনে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে সে? কখনও আর কোন মানুষের উপর ভরসা করতে পারবে। সবাইকেই তো এখন দুমুখো সাপ মনে হতে থাকবে।
-“আল্লাহ আমাকে এমন পরীক্ষায় কেন ফেলো তুমি? আমি কী অন্যায় করেছি? এই এত বড় পৃথিবীতে আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। যাকেই আমি বিশ্বাস করি, সে-ই আমাকে ধোঁকা দেয়৷ ঠকতে ঠকতে জীবনের প্রতি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। আর সহ্য করতে পারছি না। এই জীবন নিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।”
চলবে___