#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৩৩
(কপি করা নিষেধ)
সেই চঞ্চলা চপলা কিশোরী যেনো হঠাৎ করেই খুব বড় হয়ে গেলো।সবার সাথে কথা কমিয়ে দিলো।ঘরের এক কোণায় পড়ে রইলো।আধার রাতে খুঁজে ফিরলো তার অস্তিত্ব। ।কানে এই খবরটাও আসলো আহানকে জেলে নিয়ে যাওয়ার পর তার পরের দিনই ছাড়া পেয়ে যায়।এর দুদিন পরেই অবন্তীকে নিয়ে পালিয়ে যায়।ছায়া এইসব শুনে নিষ্প্রাণ হাসে।ছায়া যেনো ইচ্ছা করেই রিয়ার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।দেখতে দেখতেই যেমন আড়াই বছর কেটে যায়।নিষ্ঠুর সময় তার জীবনের রঙিন সময়গুলো কেড়ে নিলো খুবই নির্মমভাবে। সে ভীষণ মনোযোগী হয়ে উঠলো পড়াশোনায়। অ্যাডমিশন পরীক্ষা ঘনিয়ে আসলো।পালটে যায় অনেক কিছু।সেই সাথে পরিবর্তন আসে ছায়ার আচরনেও।দিন দিন যেনো মানসিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ছে।মাঝ রাতে উঠেই কান্নায় ভেঙে পড়ে।হাত কামড়ে কান্না থামায়।হাতে হয়ে যায় ক্ষত। সেই ক্ষত থেকে ছুপ ছুপ লালাভ রক্ত দেখা যায়।কখনো কখনো দেখতে পায় অরূপদা কাঁদোকাঁদো মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তখন ছায়া মলিন হাসে।মেডিকেল পরীক্ষা দিয়ে চান্সও পেয়ে যায় ছায়া। ছায়ার পরিবার মেয়ের রেজাল্ট শুনে খুব খুশি।কিন্তু ছায়া খুশি না।তার দুঃখের ভাগীদার কেউ হয়নি।তার খুশির ভাগীদার আজ সবাই।ছায়া নীরবে কাদে অরূপদা নেই আজ তাদের মধ্যে।সে যে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে।কিন্তু রেখে গিয়েছে অপার ভালোবাসা।এখন নিশ্চয়ই রেজাল্ট শুনার জন্য প্রথম কলটা অরূপদাই দিতো।ঢাকা থেকে ছুটে এসে উপহার দিতো।মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতো।সেই নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে যাওয়া মানুষটা নেই ভাবতেই বুক ভারী হয়।সব কিছু ঠিকঠাক করে ছায়া ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়।সেইখানে কি তার জন্য নতুন করে কিছু অপেক্ষা করছে?
…….
-এই ছায়া একটু হাসি দে। মুখটা এমন পাংশুটে করে রেখেছিস কেনো?আজ না আমাদের প্রথম দিন মেডিকেল কলেজের?
নীলা যেনো সব বিরক্তি ছায়ার উপর ঝেড়ে ফেললো।
ছায়া একবার নীলার দিকে তাকিয়ে সামনে গেইটের দিকে এগিয়ে যায়।গেইটের দিকে যেতেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে আচমকা ।পড়ে যেতে নিলেই কারো শীতল বলিষ্ঠ হাত ছায়ার উদর স্পর্শ করে।ছায়া শিউরে উঠে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করে সামনে দাঁড়ানো অফ হোয়াইট শার্ট পরিহিত এক সুর্দশন যুবককে ।
-মিস দেখে চলতে পারেন না?চোখ কোথায় থাকে?
এক হাতে ছায়াকে ধরে চোখের রোদ চশমাটি খুলতে খুলতে ব্যস্ত গলায় বললো এক যুবক।
ছায়া অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে তাকালেই সেই সুদর্শন যুবকটি ভ্রু কুচকে তাকায়।হঠাৎ করেই যেনো যুবকটির তীক্ষ্ণ চাহনি মিইয়ে গেলো।টের পেয়ে দ্রুত হাত আলগা করলো।
তখনই একজন এসে সেই যুবকটিকে ডেকে উঠে।কানে আসে একটি নির্মল কন্ঠ।
-অরন্য কোথায় তুই?ক্লাস শুরু হয়ে যাবে যে।
অরন্য এইবার রয়ে সয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-প্রাণ তুই যা আমি আসছি।
-হুয়াটস ইউর নেইম মিস?
অরন্যের হাত আলগা হতেই ছায়া নিজেকে চটজলদি ছাড়িয়ে গটগট পায়ে নীলাকে নিয়ে ক্লাসের দিকে রওনা হয়।একবারও পিছু ফিরে তাকায় না।
অরন্য যেনো তাজ্জব বনে যায় তার মনে অসহিষ্ণু ভাব উদয় হয়।এই মেয়ে তাকে উত্তর দেয় নি?অরন্য চৌধুরীকে?মেয়েরা তার সাথে কথা বলতে চায়।কিন্তু সে পাত্তা দেয় না।আজ একটা মেয়ে তাকে দেখেও না দেখে চলে গেলো?কে এই মেয়ে?অন্তত একটা ধন্যবাদ দিতো।সেটাও দেয় নি।
প্রাণ এসে অরন্যের কাধ চাপড়ে বলে,
-কিরে বেটা কই হারাইয়া গেলি? উমম একটা মেয়ের যাওয়ার দিকে এমনে কেন তাকাইয়া আছোস?সামথিং সামথিং? হু হু?
প্রাণ এইটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো।অরন্য তার দিকে নাক মুখ কুচকে তাকিয়ে বললো,
-উফফ বেটা তুই আর ঠিক হলি না।এমন কিছু না।মেয়েটা ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছিলো তাই ধরে ছিলাম।তাড়াহুড়োতে হয়ে গেলো আরকি।
-ওহো তাই বুঝি?তোর সামনে মেয়েরা কেঁদে কেটে সাতার কাটলেও তো তাকাস না তাহলে এই মেয়ে পড়ে গেলো নাকি কি করলো সেইটা কেন দেখছিস? তাও আবার নিজে থেকে কথা বলতে গিয়েছিস?হুয়ায়ায়ায়া
এইবার অরন্য বেশ বিরক্ত হলো।মেয়েটার উপর এমনিতেই চটে আছে।এইদকে প্রাণের বকবকানি। জাস্ট আনবিয়ারেবল।অরন্য কিছু না বলেই দপাদপ পা ফেলে ক্লাসে চলে গেলো।প্রাণ তার পিছু পিছু দৌঁড়ে যাচ্ছে।
-আরে ভাই দাঁড়া আমার জন্য।
মেডিকেল কলেজের ফটক পার হতেই একটা গলিপথ ঘাসে মুড়ানো। ক্যম্পাসে রয়েছে সুউচ্চ বিল্ডিং।বিল্ডিং এর আশপাশ ঘিরে রয়েছে হরেক রকমের বৃক্ষরাজি।কিছু দূরে গেলেই বসার বেঞ্চ।এর পাশে রয়েছে কৃষ্ণচূড়া গাছ যেনো জায়গাটির সৌন্দর্য বহুগুন বাড়িয়ে দিলো।বিশাল মাঠজুড়ে ঘাসের সমাহার।সেই ঘাসে দূর্বাফুলও দেখা যাচ্ছে।ছায়া আর নীলা কাসরুম খুঁজছে। কিন্তু তারা নতুন মাত্র তাই ক্লাস খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে।সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তারা ক্লাস দেখিয়ে দেয়।
ছায়া আর নীলা একসাথেই বসেছে পিছনের দিকে।পুরো ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীদের কথা বলার গুন গুন আওয়াজ।
-হ্যালো আমি মেঘা।আর তোমরা?
ছায়া আর নীলাকে উদ্দেশ্য করে তাদের সাথে বসা এক শ্যামময়ী মায়াবী মেয়ে বলে উঠলো।
নীলা হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-আমি নীলা।নাইস টু মিট ইউ।
এইবার মেঘা উৎসুক চোখে ছায়ার দিকে তাকালে ছায়া ম্লান হেসে বলে,
-আমি ছায়া।
-আমরা কি বন্ধু হতে পারি।তোমাদের আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
নীলা খুশিতে গদগদ হয়ে মেঘাকে বলে,
-অবশ্যই অবশ্যই।আমাদেরও তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে।
এইবার নীলা ছায়াকে ধরে একটু আগের ঘটনার জন্য।
-ছায়া তুই ঠিক করিসনি।অরন্য ভাইয়া তোকে হেল্প করেছে।একটা ধন্যবাদ দিতে পারতি।ভাইয়া নাম জিজ্ঞেস করেছে।নামটাও বললি না।ওরা এইবার ফাইনাল ইয়ারের।আমাদের সিনিয়র।
বেশ দাপুটে ওরা।যদি কিছু করে।একটা বিষয় খেয়াল করেছিস?আমরা এইবার জুনিয়র। কিন্তু আমাদের র্যাগিং হয়নি।সব অরন্য ভাইদের জন্য।ওদের ইয়া বড় গ্যাং আছে।অরন্য ভাইয়ার যোগ্যতা, কঠোর আর গম্ভীর ব্যক্তিত্বের জন্য যেমন সবাই সম্মান করে তেমন বেশ স্নেহভাজনও বটে।
মেঘার যেনো অরন্যের নাম শুনে খুশিতে চোখ চকচক করে উঠে।
-আরে তোমারা অরন্য চৌধুরীর কথা বলছো?ভাইয়া যে কি স্টাইলিশ। কি জোস বডি!জাস্ট ওয়াও! কি লুক যে দেয়!একবারে বুকে গিয়ে লাগে।আহা।সব মেয়েরা অরন্য ভাইয়ার পিছনে লাট্টু।
ছায়া সব শুনে গা ছাড়া ভাব নিয়ে।এরপর ভাবলেশহীনভাবে মেঘাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-অরন্য চৌধুরী কে জেনে আমি কি করবো?আমার এতো কিছু জেনে লাভ নেই।আর কোন ভয়ও নেই।
মেঘা আর নীলা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকলো ছায়ার দিকে।এই মেয়ে অরন্যকে দেখে ফিদা হয়নি? কি দিয়ে তৈরি এই মেয়ে।
…
টিফিন পিরিয়ডে ছায়া নীলা মেঘা ক্যান্টিনে আসলো।এইদকে অরন্য,প্রাণ,অভিক,শান্ত,স্নেহা,আনফাল আড্ডা দিচ্ছিলো।ছায়াকে আসতে দেখে অরন্য এইবার ছায়ার দিকে তাকালো বেশ শান্তভাবে।অরন্যের তাকানো দেখে অরন্যের সাথে সাথে তার বন্ধুরাও তাকালো।প্রাণ অরন্যের তাকানো দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো কারণ অরন্য সচরাচর মেয়েদের দিকে তাকায় না তেমন।অরন্য কি মেয়েটাকে পছন্দ করা শুরু করলো?মেয়েটার সব ইনফু বের করতে হবে।
অরন্য বেশ সূক্ষ্মভাবে সবটা অবলোকন করলো।
কিছু একটা ভেবে ছায়াকে ডাক দিলো,
-হ্যালো সকালের সেই গায়ে পড়া মিস?আপনাকেই বলছি?
ছায়া কিছুটা চমকে যায়।ছায়াকেই যে ডাকছে ছায়া বুঝতে পারলেও সাড়া দিলো না।
অরন্যের রাগ হলো জুনিয়র হয়ে সিনিয়রদের কোন সম্মান করছে না।আবার এতো ডাকার পরও সাড়া দিচ্ছে না।এইবার অরন্যের বন্ধু অভিক বলে উঠে,
-কাকে ডাকছিস অরন্য?একটা মেয়েকে ডাকছিস তুই?সিরিয়াসলি?
আনফালের গার্লফ্রেন্ড স্নেহা অরন্যকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিয়ে বলে,
-ভাই তুই কাকে ডাকছিস গায়ে পড়া মেয়ে বলে?আমাদেরও দেখিয়ে দে।
অরন্য কিছু বললো না আর। সোজা হেঁটে গেলো ছায়ার কাছে।ছায়া ক্যান্টিনের একটা চেয়ারে পিঠ ঘুরিয়ে বসে পড়েছিল।অরন্য ছায়ার সামনের একটা চেয়ার উপড়ে ফেলে দিয়ে বলে,
-আপনি তো দেখছি ভারি বেয়াদব মেয়ে।সিনিয়রদের সম্মান করতেই জানেন না।আর এতো করে ডাকছিলাম সাড়া দেন নি কেনো? হুয়াই?
ছায়া এইবার বেশ শান্ত নির্লীপ্ত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়িয়ে অরন্যকে বললো,
-আমাকে ডাকছিলেন?আমার নাম তো গায়ে পড়া মেয়ে না।আই হেভ আ স্পেসিফিক নেইম।ছায়া।ওকে?
অরন্য সকাল থেকেই বেশ অবাক হচ্ছে এই মেয়েকে দেখে।এইবার ভালো করে খেয়াল করলো মেয়েটাকে।মেয়েটা নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পড়ে এসেছে।চুল গুলো খোলা থাকলেও মাথার অর্ধেকটা জুড়ে উড়না দেওয়া।গায়ের রঙ ফর্শা, বেশ লম্বা।মেয়েটার চেহারাটা বেশ আদুরে।একাটা মায়া মায়া ভাব আছে।নাকের ডগায় ঘাম জমেছে যা মুক্তোর দানার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে।এইবার ঠোঁটের দিকে তাকিয়েই অরন্য ঢোক গিললো।
ছায়া অরন্যের মুখের উপর তুড়ি বাজাতেই অরন্যের হুশ আসে।
অরন্য এতোক্ষণ একটা মেয়েকে দেখছিলো?অবিশ্বাস্য।
ছায়া আর ক্যান্টিনে বসলো না।সে চলে গেলো ক্লাসে।
অরন্য এইবার আবারও অবাক হলো।মেয়েটা আবার কথার মাঝখান থেকে তাকে ইগনোর করে চলে গেলো।
অরন্য মনে মনে আওড়ালো,
-ছায়া?উহু ছায়াকরী। হুয়াট আ অ্যাটিচিউড গার্ল।আই লাইক ইট।
প্রাণ,অভিক,আনফাল,শান্ত আর স্নেহা এসে অরন্যকে নাড়া দিয়ে বলে,
-ভাই এইটা কি ছিলো?হুয়াট ওয়াজ দ্যাট।সারপ্রাইজিং।
অরন্য অনিমেষ তাকিয়ে থাকলো ছায়ার যাওয়ার পানে।
#চলবে #কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৩৪
(কপি করা নিষেধ)
…
-মিস আমরা র্যাগিং করি না।কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে করা লাগবে।
অরন্য অধরকোণে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটিয়ে ফিচেল গলায় বললো।
অরন্যের ব্যবহারে তার বন্ধুমহল অবাকের পর অবাক হচ্ছে।আজ অরন্যের সাথে তাদেরও অবাক হবার দিন।
অরন্যের পিছনে পড়ে থাকা মেয়েগুলোও যেন ছায়াকে হিংসা করছে।তাদের চোখে মুখে ক্ষীপ্ততা।
ছায়া মাত্রই ক্লাস শেষে কলেজ গেইট পেরিয়ে রিকশা নিতো।কিন্তু অরন্য তাকে যেতে না দিয়ে র্যাগিং করার কথা বলতে লাগলো।
ছায়া এইবার তীর্যক দৃষ্টিতে অরন্যকে পর্যবেক্ষণ করলো।গনগনে গলায় বললো,
-ওহ তাই?র্যাগিং করবেন?আমি যতটুকু জানি র্যাগিং হয় না এইখানে।আর আমি এইসব টলারেটও করবো না।
অরন্য ছায়ার নির্ভীকতা আর অপ্রতিরোধ্য সেই চাহনি দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলো।অরন্য নাকের ডগা ফুলায়।বিক্ষিপ্ত হয় মন।মেয়েটা ভয় পাচ্ছে না কেন?অন্যরা তো পায়।তবে তারও পাবার কথা।মেয়েটার সাহস আছে বলতে গেলে।এইবারও ছায়া বিচলিত না হয়েই অরন্যকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে অরন্য ত্রস্ত পায়ে পিছনে ফিরে ছায়ার হাত ধরে আটকে ফেলে মুহুর্তেই।
ছায়া ঘাড় ঘুরিয়ে অরন্যের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অগ্রাহ্যপূর্ণ কন্ঠে আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বলে,
-ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিটস।আপনি যেই হোন আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার।সিনিয়র আছেন সিনিয়রদের মতো থাকুন।একদম আমার কাছে ঘেসবেন না।হাত ছাড়ুন।
অরন্য বেশ অপমানিত বোধ করে এইটুকু মেয়ের কথায়।ফোঁস ফোঁস করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে অরন্য ছায়ার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে।কিন্তু তবুও মেয়েটার চোখে মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই।হাতের ব্যথায় উঁহ পর্যন্ত করছে না।
নীলা আর মেঘা ছায়া আর অরন্যকে লাগতে দেখে হকচকিয়ে যায়।ভীতি চোখে ফাঁকা ঢোক গিলে
প্রান আর অভিকের কাছে যায় দৌঁড়ে।
মেঘা রাগান্বিত হয়ে অভিককে বলে,
-আমরা জুনিয়র। আপনাদের উচিৎ আমাদের প্রোটেক্ট করা।কিন্তু আপনারা তো দেখছি হাতে চুরি পড়ে হাত গুটিয়ে বসে আছেন।
অভিক একবার মেঘাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিয়ে বিদ্রুপ করে বলে,
-জুনিয়রদেরও উচিৎ সিনিয়রদের রেসপেক্ট করা।কিন্তু আপনারা প্রথম দিন এসেই বেয়াদবি শুরু করেছেন।আমাদের থেকে এর থেকে বেশি কি আশা করছেন।এখনো অক্ষত আছেন শুকরিয়া আদায় করুন।
নীলা এইবার কাঁদোকাঁদো হয়ে প্রাণকে অনুরোধ করে,
-ভাইয়া প্লিজ ওদের আটকান।নইলে ওরা যেইভাবে একজন আরেকজনকে শাসিয়ে যাচ্ছে।কিছু একটা হয়ে গেলে অরন্য ভাইয়া কে বলুন ছায়াকে ছেড়ে দিতে।
প্রাণ এগিয়ে গিয়ে অরন্যকে ছাড়তে বললো।অরন্যের চোখে মুখে বিস্ময় আর ছায়ার চোখে মুখে অগ্নিচ্ছটা।
প্রাণ অরন্যকে ছাড়ায় ছায়ার থেকে।অরন্যকে টেনে নিয়ে আসতে গেলে অরন্যর চোখ যায় ছায়ার উপর সেই ধরে রাখা হাতটার দিকে।ছায়ার হাতটা একবারে লাল হয়ে আছে।কিন্তু সেই লাল হয়ে থাকা হাতটায় কিসের যেনো দাগ!কামড়ের দাগ যেনো কিছুদিন আগেরই করা।অরন্যের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।সেই সাথে প্রবল আগ্রহ মেয়েটিকে জানার।মেয়েটা এমন কেনো?ইন্টারেস্টিং!
-মিস আপনি কিন্তু বেঁচে যান নি আমার থেকে সাবধানে থাকবেন। কেমন!
ছায়া যেনো নিজের খেই হারাচ্ছে।তার কাছে এইসব আর তেমন ভয় লাগে না। একটা সময় লাগতো।এখন সে লড়াই করতে জানে।ছায়া অরন্যের কথা তাচ্ছিল্য করে নিজের নিজের ফ্লাটে রওনা হয়।
ছায়া চলে যেতেই অভিক অরন্যকে ইনভেস্টিগেট করা শুরু করে।
-দোস্ত আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।এইসব কেন করছিস?
অরন্যের বন্ধুমহল উৎসুক চোখে অরন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কিছু জানতে চাওয়ার আশায়।
-মেয়েটার চোখ মুখ দেখেছিস?দীপ্ততার গাম্ভীর্যে ভরা।মেয়েটার মধ্যে কেমন যেনো একটা রহস্য আছে।কি তেজ!আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে।অশোক ফুলের ন্যায় টকটকে তার লালাভ অগ্নিঝরা নাক।কি করে ছেড়ে দেই বলতো?
প্রাণ এইবার অরন্যের মুখের দিকে তাকায় জহুরি চোখে। কিছু ভেবে চলছে।অরন্যের মনে কি মেয়েটার জন্য কিছু চলছে?নইলে তো অরন্য শুধু একটা মেয়ের পিছনে লাগতে যাবে না।এইসব তার স্ট্যাটাসের সাথে যায় না।তার পিছনে মেয়েরা ঘুরলেও কখনো সেটা খুটিয়ে দেখে না।সেই জায়গায় যেই মেয়ে তাকে ইগনোর করছে প্রথম থেকে সেইটা কি শুধুই তার ইগো তে আঘাত করেছে নাকি অন্যকিছু? এইবার কি তবে অরন্যের মনেও বসন্তের রঙ লাগবে?
…
নীলা ফ্লাটে পৌঁছালেই নীলা খপ করে ছায়ার হাত ধরে।
নীলা বেশ হাসফাস করছে।
ছায়া জানতে চায় কেন এমন করছে নীলা।
-বান্ধবী কেন এমন করছিস? অরন্য ভাইয়া এখন থেকে তোকে কিছু বললে প্লিজ চুপ থাকিস।ভাইয়ার মুখে তর্ক করিস না।ভাইয়ারা এইখানে সিনিয়র প্লাস উনার বাবা একজন প্রফেসর। অরন্য ভাইয়া খুবই ভালো স্টুডেন্ট। সবাই উনাকে খুব ভালোবাসে।তাই উনার সাথে ঝামেলা করলে কেউই তোকে সাপোর্ট করতে যাবে না।সবাই বাজে নজরে দেখবে।একটু এডজাস্ট করে নে প্লিজ।
ছায়া নীলার কথা আমলে নিলো না।
-আমি কোন অন্যায় করছি না।যে যেমনটার যোগ্য তাই ফিরিয়ে দিচ্ছি।আর কে কি ভাবলো আমি কেয়ার করি না।
-ছায়া তুই চিনিস না ভাইয়াকে।ভাই খারাপ না।তবে রাগ থেকে মানুষ অনেক কিছু করে ফেলে।অরন্য ভাইয়া খুব রাগী কিন্তু বুঝা যায় না।শান্ত থাকে।একমাত্র প্রাণ ভাইয়া আর অভিক ভাইয়ার সাথেই কম রাগ দেখায়।কি দরকার ঝামেলা বাড়ানোর।শান্তিতে ক্লাস করে বাসায় চলে আসবো।আমি না তোর বান্ধবী প্লিজ প্লিজ আমার কথাটা রাখ।
ছায়া তার দৃষ্টি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে বলে,
-ঠিক আছে মানলাম।
এইটা বলেই মেয়েটা স্নিগ্ধ হাসে।নীলা ছায়ার হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা এতো সুন্দর করে হাসে কেনো?কারো নজর না লাগুক।মেয়েটার মুখ থেকে যাতে হাসি কখনো না সরে।
নীলার সাথে ছায়ার ভর্তির সময় পরিচয় হয়।তখন ছায়ার মা সাথে ছিলো।ছায়ার মা আর নীলার মা ভর্তির সময় একসাথে একটা ফ্লাট ভাড়া করে দেয়।মেয়ে একা একা থাকলে চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাবে।মেয়ের সাথে কেউ থাকলে চিন্তাটা একটু কমবে।
ছায়া ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেয়।বাসায় রান্নার মহিলা আছে।দুপুর আর রাতের জন্য রান্না করে দিয়ে যায়।তাই রান্নার ঝামেলা নেই।
খেয়ে একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ফোন বেজে উঠে।ছায়া মুখ বিকৃত করে।ফোনের দিকে তাকাতেই দেখে মীরা বেগম ফোন করেছেন।ছায়ার মুখ হয়ে উঠলো শক্ত,কঠোর।ফোনটা রিসিভ না করেই অফ করে দিলো ফোন।সে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো।চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকতেই হঠাৎ চোখ লেগে গেলো।ঘুম ভাঙলো কারো কান্নার আওয়াজে।ছায়া লেগে যাওয়া চোখ কষ্ট করে খুলে দেখে বিকেল হয়ে গিয়েছে।কে কাঁদছে বুঝার চেষ্টা করলো।সে নীলার রুমের দিকে অগ্রসর হলো।গিয়ে দেখে নীলা কাঁদছে। ল্যাপটপে কিছু একটা দেখছে।ছায়া হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে যায়।নীলার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
-কাঁদছিস কেনো নীলা?কি হয়েছে।
এইবার নীলা টিস্যু পেপার দিকে বেশ শব্দ করে ঘসে ঘসে নাক সাফ করলো।মুখটা আরো বেশি দুঃখী দুঃখী করে বললো,
-ছায়া তুই না ঘুমাচ্ছিলি তাই ডাকিনি।জানিস কি হয়েছে? ওহ আমি না বললে জানবি কিভাবে?একটা মুভি দেখছিলাম।যেই কষ্টের।
এইটা বলে আবার ন্যাকা কান্না শুরু করে।আবারো বলে,
-নায়িকাটা না পানিতে ডুবে মারা যায়।নায়কের কি কষ্ট লাগবে এর থেকে বেশি আমার লাগছে রে ছায়ু।
ছায়া এইসব শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খায়।আর নীলার দিকে টাসকি খেতে তাকিয়ে থাকে।
তখনই ইন্টারে পড়ুয়া বিজয় বাড়িওয়ালার ছেলে দরজায় নক করে।ছায়া একবার নীলার দিকে তাকিয়ে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
-আপু আম্মা পাঠিয়েছে বিরিয়ানি। আপনারা নতুন এসেছেন তাই আরকি।
ছায়া সৌজন্য হেসে জবাব দেয়,
-এইসবের কি দরকার ছিলো?আন্টি শুধু শুধু কষ্ট করলো।আমাদের দুপুরের খাবার খাওয়া হয়ে গিয়েছে।
সেই মুহুর্তে নীলা এসে দেখে বিজয়কে প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে।নীলা বিরিয়ানির প্লেট দেখে চট করে প্লেটটা নিয়ে নিলো।লোভনীয় কন্ঠে বললো,
-ওয়াও বিরিয়ানি!ভাইয়ু ভিতরে এসো।
বিজয় মুচকি হেসে বলে
-না আপু।তোমরা যেও।রিফা আপুর পরীক্ষা চলে তাই তোমাদের সাথে দেখা করতে আসেনি।দেখবে রিফাপু এসে সারাদিনই বসে থাকবে।
ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসে বিজয়।এরপর বিদায় জানিয়েই চলে যায়।
#চলবে #কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব৩৫
(কপি করা একেবারেই নিষেধ)
…
হসপিটালের ষষ্ঠ ফ্লোরের আশেপাশে হাহাকার আপনজনদের।মানুষ বেঁচে থাকলে কেউ এতো ভালোবাসে না যতোটা মৃত্যুর পর দেখায়।কিন্তু এই ভালোবাসাটা বেঁচে থাকাকালীন দেখানো দরকার ছিলো। হয়তো সেই মানুষটা নতুন করে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেতো।
নার্স একটি স্ট্রেচারে করে একটি লাশ আনছে মর্গের দিকে।এক ভদ্র মহিলা হাউমাউ করে কাঁদছে।ভদ্র মহিলাটির সাথেই অল্প বয়সী এক রমণী পাথরের ন্যায় মৃত ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে।অল্প শোকে কাতর তো গভীর শোকে পাথর ঠিক তেমন।
অরন্য প্রানের দিকে তাকিয়ে সাবলীল ভাবে বললো,
-ইটস সুইসাইড কেইস।আজ আমাদের ক্লাস আছে পোস্ট মর্টাম কীভাবে করে তার উপর।
প্রাণ মুখটা একটু ব্যথিত করে সায় জানালো।রোজই মানুষের মৃত্যু চোখের সামনে দেখতে ভালো লাগে না।অসুস্থ মানুষদের সাথে থাকতে থাকতে তার মনটাও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।একটা ট্যুর দিতে পারলে ভালো লাগতো।
…
-এই ছায়া একটু ষষ্ঠ ফ্লোরে যেতে পারবি আমার সাথে একটু দরকার ছিলো।
মেঘা ছায়াকে উদ্দেশ্য করে বললে ছায়া সায় জানায়।
ক্লাসে নিজের খাতা আর ব্যগটা রেখে ছায়া মেঘার সাথে সেইদিকে যায়।
ছায়া সিক্সথ ফ্লোরে যেতেই চোখ যায় সে রমণীর দিকে।ইশ ইশ কি বিষণ্ণতার ছাপ মেয়েটির চোখে মুখে।সে রমণীর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালেই চোখে পড়লো সাদা কাপড়ে মুড়ানো এক যুবককে।ছায়ার বুকের ভিতর মুচড় দেয়। এগিয়ে যায় সেইদিকে।ছায়াকে মর্গের দিকে যেতে দেখে মেঘা ছায়াকে ডাকলো।কিন্তু ছায়া প্রতুত্তর করলো না। ছায়া যেন তার অতীতে ফিরে গেলো।
-কি হয়েছে ছেলেটির?
ভদ্র মহিলাটি কান্নারত অবস্থায় ছায়ার দিকে তাকায়।ছায়ার গায়ে সাদা এপ্রোন দেখে মহিলাটি বলা শুরু করে,
-আমার একটা মাত্র পোলা মা।এই পোলাডাই সংসারের হাল ধরছিলো।আমাগো শেষ সম্বল।কিন্তু পোলাডার আয় তেমন একটা হইতো না।কিন্তু জিদ ধরলো বিয়া করবো।বিয়া করানির লাইগ্যা ট্যাহা লাগবো।এতো ট্যাহা আইবো কইত্তে?পোলার বাপে পোলাডারে জিংলা দিয়া বাইড়াইছে।কইছে বিয়া করুন যাইতো না অহন।পোলা রাগে জিদ্দে গলায় দড়ি দিছে।হের পছন্দের মাইয়ার নাকি বিয়া হইয়া যাইতাছেগা।এই মাইয়াডাই।কিন্তু মাইয়া বিয়া না কইরা পালাইয়া আইয়া পড়ছে।আমার পোলাডা অকালে মইরা গেলো গা।এহন আমাগোর কি হইবো?আমার মরণ হইলো না কেন এই দিন দেখবার আগে।
ভদ্র মহিলা কপাল চাপড়াতে লাগলো।মহিলার আহাজারিতে ছিলো অনুতাপ আর শোক।
ছায়া যেনো অরূপদাকে দেখতে পেলো। সে এলোমেলো পায়ে গিয়ে ছেলেটির পায়ের কাছে বসলো।ছায়ার দৃষ্টি হলো ঝাপসা।চোখে বিধুরতার ছাপ।
অরন্য এইদিকে আসতে গেলেই ছায়াকে দেখলো।অরন্যের সূক্ষ্ম দৃষ্টি এড়ালো না ছায়ার অস্বাভাবিক আচরণ। অরন্য ভাবলো ছেলেটির কোন আত্মীয় নয়তো।অরন্য নার্সকে ডেকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো ছায়া মৃতের কেউ না।অরন্য গভীর ভাবনায় ডুব দিলো।সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে সব দেখে নিলো।ছায়া এক ধ্যানে কি দেখছে?অস্ফুটস্বরে কিছু বলছে।ঠোঁটগুলো নড়ছে বাতাসের ঝাপটায় গোলাপের পাপড়ির ন্যায়।
মেঘা নিজেও বুঝলো না ছায়ার কি হয়েছে।ছায়াকে গিয়ে ধাক্কা দিতেই ছায়া মেঘার দিকে আধো আধো চোখ খোলা রেখে তাকায়।আদ্র আখি ঝাপটা দিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে,
-মেঘা তুই যা।আমার একটু কাজ আছে।
এই বলেই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় মেঘাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না।
অকস্মাৎ এমন কি হলো ছায়ার এইটা ভেবে অরন্য নিজেও গেলো পিছু।মেঘাও যাচ্ছিলো কিন্তু অরন্য যেতে নিষেধ করে।
ছায়া ছাদের এককোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।মুখ কি ভীষণ ম্লান হয়ে আছে।সে আজ তার অতীতের স্বরূপ দেখলো তার সামনে । ছায়ার যেনো ঘোর লাগে।শুনতে পায়,
-কোমল!
ছায়া বিবর্ণ চোখে তাকায়।
-অরূপদা?জানো আমাকে কেউ বুঝে না তোমার মতন করে।গভীর মমতায় আদ্র করে না।কেনো চলে গেলে?আমাকে কি সব বলা যেতো না?
ছায়া হঠাৎ করেই কান্নায় ভেঙে পড়ে।কান্না আটকায় হাতে মুখ চেপে।হাত কামড়ে দাঁত দিয়ে।
অরন্য কাছে আসলো না।দূর থেকে দেখলো এক রুদ্রযামিনীর অশ্রুবারিতে প্লাবিত হওয়া।কি যেনো বলছে।কারো কথা বলছে কি?সে ভাবলো মনে মনে,
-ইশশ মেয়েটার কি খুব দুঃখ?খুব বেশি?
মেয়েটার আচরণ স্বভাবিক না।সে কি মেন্টাল ডিসঅর্ডারের স্বীকার জীবনের কোন গভীর ক্ষত থেকে?
অরন্য ধীর পায়ে এগোলো।কিন্তু ছায়ার ঘোর কাটলো না।যেনো কোন মোহমায়াতে আচ্ছন্ন সে।
অরন্য ছায়ার দিকে না তাকিয়ে অদূরে আকাশের ধূসর মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
-যেনো মাঘের কুয়াশার ধূসর ধূম্রজালে আবৃত রহস্যময়ী।কবে পাবো তার দেখা?কবে পাবো দেখা?
কারো কণ্ঠধ্বনি শুনে ছায়ার হুশ আসে।ছায়ার চোখ দুটো হয় স্থির।পায়ে মৃদু ভর দিয়ে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ায়।টালমাটাল পায়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়।
অরন্য চোখ প্রশস্ত করে ছায়ার পানে।মেয়েটা কি চলে যাচ্ছে?
-ছায়াকরী বুঝি তার নামের মতোই বহুরূপী?
ছায়া থমকায় কিন্তু পিছু ফিরে না।
…
-ছায়া কি হয়েছিলো তোর?
মেঘার উদ্বিগ্নতা কিছুটা বুঝতে পারলো ছায়া।কিন্তু বিশ্লেষণ করলো না।
-তোর চোখ মুখ ফোলা ফোলা কেনো ছায়া? আবার হাতে দাগ করেছিস?ইশ কি অবস্থা হয়েছে।
নীলা ব্যাকুল হচ্ছে ছায়ার এই অবস্থায়।
ছায়ার নীরবতায় নীলা হতাশ হয়।মেয়েটা কি বুঝে না তার জন্য আমাদের চিন্তা হয়।কেনো এতো কষ্ট দেয় নিজেকে।সব ভুলে গেলে কি হয়?
ক্লাসে স্যার আসলে ছায়া,নীলা আর মেঘা ক্লাসে মনোযোগ দেয়।
সবাই উঠে স্যারকে সালাম দেয়।
-তোমাদের নবীনদের জন্য নবীনবরণের আয়োজন করা হবে আর ১ সপ্তাহ পর।তাই যারা যারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাম দিবে তার লিস্ট লিমা ম্যাডামের কাছে জমা দিও।আর তোমাদের মধ্যে কে কে স্বেচ্ছাসেবী হতে ইচ্ছুক?ক্লাস শেষে নাম দিয়ে যেও।এখন ক্লাসে মনোযোগ দাও।
শান্ত ক্লাসরুম মুহুর্তেই অশান্ত হয়ে উঠে।সবাই হৈ হৈ করে উঠে আনন্দে।
নীলা আর মেঘা হাত দিয়ে তালি দেয়া শুরু করলো খুশিতে।
খুশিতে টগবগ করে নীলা ছায়াকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
-ছায়া তুই কিসে নাম দিবি রে? আমি কিন্তু নাচে নাম দিবো। তুই কিছু একটা তে নাম দে বনু।
ছায়া নীলার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকায়।এই মেয়েটা যে কতো বকবক করে।বাচ্চাদের মতো আবদার করে বসে।না ও করতে পারে না।কি এক মহাজ্বালা!
-আমি কোন কিছুতে নাম দিব না নীলা। তুই আর মেঘা নাম দে।আমার আনইজি লাগে।
মেঘা ঠোঁট উলটে ছায়াকে এক হাতে জড়িয়ে বলে,
-ছায়া তুই জয়েন না করলে কেউ আমরা জয়েন করবো না।এইবার তুই বুঝে নে।আমাদের কথা একবার ভাববি না?
ছায়ার যেনো এইবার চিন্তায় পড়ে গেলো।লে একটায়ই নাজেহাল অবস্থা।এখন আবার আরেকটা আসলো। উফফ..ঠোঁট ফাক করে তপ্ত শ্বাস বের করে।কিন্তু যাই হোক ওরা আছে বলেই সে কিছুটা স্বস্তি পায়।তার বিষাদময় জীবনে খুশির খোরাক।
ছায়া এইবার ওদের দিকে গমগমে গলায় বললো,
-ঠিক আছে গানে নাম দিতে পারি।তোদের জন্য শুধু নাম দিচ্ছি মনে রাখবি।
ছায়া চোখ গুলো সরু করে ফেললো।
নীলা আর মেঘা এক সাথে হাই ফাইভ দেয় উৎফুল্লতার সাথে ছায়ার রাজি হয়ে যাওয়ার কথা শুনে।
ক্লাস শেষ হয়ে গেলে ওরা করিডোরে এসে দাঁড়ায়।ছায়া কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকায়।ফুল ফুটেছে।ছায়ার ইচ্ছে হলো একটু গাছটার নিচে বসে থাকতে।
-এই তোরা নাম দিয়ে আয়।সাথে আমারটাও দিস।আমি একটু ওইখানে যাচ্ছি।
এইটা বলেই সে হেঁটে হেঁটে সেই গাছের নিচের বেঞ্চটায় গিয়ে বসে।কৃষ্ণচূড়া গাছটি যেনো নীরবতায় সৌন্দর্য বিলাচ্ছে।গাছের সবুজপাতার ফাক ফোকর দিয়ে লাল গালিচার ন্যয় যেনো ফুলগুলো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।রাঙিয়ে তুলছে প্রকৃতি।গাছের উঁচু ডালে শালিক পাখি বসে কিচিরমিচির স্বরে গান গাইছে।ছায়া যেনো মনোযোগ দিয়ে কান পেতে সেই গান শুনছে।করিডোরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন সেই চিত্র মনের আখিতে বন্দী করলো।চৈত্রের তপ্ত দুপুরে যেনো প্রিয়তমা লালিমার আভা ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া ফুলের সাথে সমতালে।
প্রভাকরের তেজদীপ্ত অংশুতে গা বেয়ে স্বেদজল নিঃসৃত হচ্ছে।সেই জলে চুলগুলো লেপ্টে কপালের সাথে অরন্যের।সেই কাঠফাটা রোদে তার গলা ফেটে চৌচির সেই সাথে চৌচির তার এই অশান্ত মন।
#চলবে
(