#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৯
“তবে…. তাকে আমি একদা বাবা বলে জানতাম।”
কথাটা স্পর্শী কর্ণধারে এসে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র নয়ন জোড়া বড় হয়ে এলো তার। দৃষ্টি ভর্তি বিস্ময় নিয়ে তাকালো নির্বাণের পানে। কথাটা তার ঠিক মত বোধগম্য হলো না বিধায় সে অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করল, “জানতাম মানে?”
নির্বাণ সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত কন্ঠেই বলল, “বাবা ছিলেন উনি আমার। তবে এখন আর নেই।”
স্পর্শী স্থির হলো, অতি শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। প্রশ্ন করল না আর একটিও। মৌন রইলো। কেন জানি তার মনে হলো এখন এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা মানে নির্বাণকে কষ্ট দেওয়া। তবে স্পর্শীর বিশ্বাস নির্বাণ তাকে এই সম্পর্কে নিজ থেকেই বলবে, তাই হতো মনে কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও প্লাটা প্রশ্ন করলো না সে।
নির্বাণও কোন প্রকার টু শব্দ করল না। আপনমনে গাড়ি চালিয়ে গেল। মুহূর্তেই পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে উঠল। মিনিট কয়েক নীরবে কেটে যেতেই হঠাৎ গাড়ি থামলো। স্পর্শী চারদিকে চোখ বুলাতেই বুঝতে পারল তারা এসে পড়েছে৷ নির্বাণ আগে নিজের সিটবেল খুলে দ্রুত বেরিয়ে এলো, সামনে দিয়ে ঘুরে স্পর্শীর কাছে এসে দরজা খুলে তাকে ধরে নামতে সাহায্য করল। রোদের তাপটা আজ যেন একটু বেশি। হঠাৎ রোদের সংস্পর্শে আসায় তাপের তেজ সহ্য করতে পারলো না স্পর্শী৷ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল সে। নির্বাণ স্পর্শীর অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠল, “টান লেগেছে? ব্যথা করছে পেটে?”
স্পর্শী পিটপিটিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলো। স্মিত মুখে বলল, “না! হঠাৎ রোদের আলো চোখে পড়ায় সহ্য করতে পারিনি৷”
কথাটা শোনামাত্র নির্বাণ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, “আচ্ছা। তুমি এদিক আসো।”
কথাটা বলে সে স্পর্শীকে ভালো মত নিজের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে নিল। এমন ভাবে স্পর্শীকে দাঁড় করালো যাতে তার সুঠাম দেহের সম্পূর্ণ ছাঁয়াটুকু স্পর্শীর ক্ষুদ্রতর দেহটাকে আড়াল করতে সক্ষম হয়। এবং সেটা হলোও। তীব্র উত্তাপের মাঝে কিঞ্চিৎ আরাম অনুভব করায় স্পর্শী ভালো মত তাকালো। নির্বাণের কর্মকাণ্ড দেখে তার ঠোঁটের কোণ মৃদু প্রসারিত হলো। মাঝে মধ্যে মানুষটার কাজ এমন যে মুগ্ধ না হয়ে পারাই যায় না। নির্বাণ খুব যত্নসহকারে স্পর্শীকে ধরলো অতঃপর আস্তে আস্তে ভিতরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে৷
__________
ক্লান্ত সায়াহ্নের প্রহর শেষে কালো চাদরে আচ্ছাদিত হলো সমস্ত নগরী। কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের এলোমেলো চলাচল দক্ষিনা অনিলের দোলে। ঝিম ধরা পরিবেশ। ইফতার, নামাজ সেরে যার যার রুমে বসে অবসন্ন সময় কাটাছে সকলে। আচমকাই খোলা জানালা হতে এক মুঠো শৈথিল্য বাতাস হুড়মুড় করে ঢুকলো, তপ্ত পরিবেশটা শীতল করে দিয়ে আবার একই রাস্তা দিয়ে ফুড়ুৎ করে পালালো। স্পর্শী নিধির সাথে কথা বলতে বলতেই একবার বারান্দার দিকে তাকালো। মিনিট দশেক হলো নির্বাণ বারান্দায় গিয়েছে, এখনো আসেনি। স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো। নির্বাণকে দেখার জন্য উঠতে চাইলো কিন্তু ফোনে কথা বলছে বলে আর গেল না। মিনিট কয়েক অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল।
নিধির সাথে কথা গিয়ে শেষ হলো আরও মিনিট পাঁচেক পড়। নির্বাণ তখনও রুমে আসেনি বলে স্পর্শী মোবাইল মাথার বালিশের পাশে রেখে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো, ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। নির্বাণ চুপটি মেরে বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত দৃষ্টি তার আকাশের অভ্যন্তরে। স্পর্শী দরজার সামনে এসেই স্থিরচিত্তে দাঁড়ালো।
সকালে তখন বাসায় আসার পর থেকেই নির্বাণ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। দরকার ব্যতীত বেশি একটা কথা বলে নি, রুম থেকেও বের হয়নি। স্পর্শী নির্বাণকে স্পেস দিতে চেয়েছিল তাই বিষয়টা ঘাটায়নি। স্পর্শী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো, “কি করছেন?”
নির্বাণ চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। স্পর্শী বারান্দার সামনে দেখে সত্বর এগিয়ে এলো। শাসনের কন্ঠে বলল, “তুমি উঠে এসেছ কেন? কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিতে।”
“আরেহ আমি ঠিক আছি। এতটা অক্ষম হয়ে যাই নি যে ঘরের মধ্যেই এদিক-সেদিক চলাফেরা করতে পারবো না।”
নির্বাণ চোখ পাকিয়ে তাকালো, “বেশি বুঝো তুমি। চল ভিতরে।”
স্পর্শী আবদারের সুরে বলল, “বসি এখানটায় কিছুক্ষন?”
নির্বাণ একবার কড়া কন্ঠে ‘না’ করতে গিয়েও করতে পারলো না। পৃথিবীর সকল মানুষের মুখের উপর সে ‘না’ বলতে পারলেও এই এক নারীকে সে কিছুতেই ‘না’ বলতে পারে না। এমনটা কি আদৌ হওয়ার কথা ছিল? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। খুব সন্তর্পণে স্পর্শীর হাতটা ধরে বলল, “আচ্ছা আসো।”
কথাটা বলে নির্বাণ বারান্দার একপাশে রাখা ছোট বেতের মোড়াতে স্পর্শীকে বসিয়ে দিল। নিজেও একটা মোড়া টেনে স্পর্শীর পাশে বসলো। আলতো হাতে স্পর্শীর মুখের সামনে পড়ে থাকা এক গাছি চুল কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে কন্ঠস্বর নিচু করে বলে, “যতদিন না পুরোপুরি ঠিক হচ্ছো ততদিন এভাবে হাটা চলার চেষ্টা করবে না। হয় আমাকে ডাক দিবে, না-হয় মা বা স্পৃহাকে ডাকবে।”
স্পর্শী মাথা দোলালো। আবছা অন্ধকারে নির্বাণ প্রত্যুত্তরে কি রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ তা বোঝা গেল না। তাই স্পর্শী নির্বাণের বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করবে কি-না এ নিয়ে দ্বিধায় পরে গেল। কিয়ৎক্ষণ নিভৃতে কেটে যেতেই নির্বাণ বলে উঠল, “কি প্রশ্ন করতে চাচ্ছ করে ফেলো। আমাকে প্রশ্ন করতে জড়তা কিসের তোমার?”
নির্বাণের কথায় স্পর্শী মুহূর্তে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, “না মানে তেমন কিছু না…”
“সকালের ব্যাপারে জানতে চাইছো তাই তো?”
স্পর্শী কিছুটা সংকোচবোধ করলো তাই প্রত্যুত্তরে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল। নির্বাণ স্পর্শীকে চুপ থাকতে দেখে নিচু কন্ঠে বলতে শুরু করলো,
“ছোট থাকতে আট-দশটা ফ্যামিলির মতই হ্যাপি ফ্যামিলি ছিল আমাদের। যদিও ডা.মোহাম্মদ সাইয়্যেদ মানে আমার বাবাকে তেমন একটা কাছে পাইনি আমি আর নাহিদ। পেশায় তিনি সার্জন ছিলেন, তো সে সুবাদে বেশির ভাগ সময়ই তিনি ঢাকার বাহিরে যাওয়া-আসা করতে হতো তার। তার জন্য রাত-দিন ছিল না যখন ডাক পড়ত তখনই ছুটে যেত। ছোট থেকে দেখে আসায় বিষয়টা আমাদেরও সয়ে গিয়েছিল। কখনো এসব নিয়ে বাসায় ঝগড়া বিবেধ লাগেনি। তবে নাহিদের হওয়ার বেশ কয়েকবছর পর থেকেই দেখতাম বাবা-মায়ের মাঝে বেশ মন-মালিন্য চলে। বাবা ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হলে সপ্তাহেও ফিরে না। মাসে হাতে গণা দুই-তিনবার ফিরে, এমন এক অবস্থা৷ আর মাস শেষে টাকা-টা ঠিক পাঠিয়ে দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করে ফেলতেন। আমার দুই ভাই ছোট থেকেই বাবাকে তেমন কাছে পায়নি তাই তার প্রতি আমাদের এতটা টান ছিল না। তার বাসায় থাকা না থাকা আমাদের জন্য একই ছিল। মা-ই আমাদের সকল দেখাশোনা করতেন।
অতঃপর আমার যখন আঠারো আর নাহিদের বারো বছর তখন ডা.সাইয়্যেদ তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঘরে উঠেন। মা এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে, তারা আরও তিন বছর আগেই বিয়ে করেছেন আর সম্পর্ক ছিল বহু পূর্ব থেকেই এবং ডা.সাইয়্যেদ এতদিন লুকিয়েই সংসারও করে এসেছেন। এখন তিনি মাকে ডিভোর্স দিতে চান, দ্বিতীয় পক্ষের সাথে থাকতে চান তাই তিনি তাকে ঘরে তুলেছেন। এ সংসার আর তিনি চান না। মা তখন ভেঙে পড়লেও শুধু একটা প্রশ্ন করেছিল, ‘এইটাই তার শেষ কথা কি-না?’ তিনি উত্তর হ্যাঁ-তেই দিয়েছিলেন। এরপর মা আমাদের কাছে এসে কোন ভণিতা না করে পুরো বিষয় খুলে বলে আর জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা কার সাথে থাকতে চাই?’ দুই ভাই আমরা মা-কে বেছে নেই। ব্যস, এরপর এক কাপড়েই মা আমাদের নিয়ে সেই ঘর ছাড়েন এবং ফোন করে নানাজানকে সব জানায়। নানাজান তখনই বড় মামাকে পাঠায় মাকে নিতে। এরপর আরও অনেক কাহিনী। তাদের ডিভোর্স ফাইল হয়, আমাদের কাস্টাডির জন্য এপ্লাই করা হয়। সব এখানে মা নানাজান আর মামার সাহায্যে নিজ উদ্যোগেই করেন। ডা.সাইয়্যেদও এগুলোই চাচ্ছিলেন যার জন্য সব ঝামেলাবিহীন শেষ হয়ে যায়। আমাদের কাস্টাডিও সহজে মা পেয়ে যায়। কারণ ডা.সাইয়্যেদ আমাদের এভাবেও চাননি। এরপর থেকেই আমাদের আলাদা পথ চলা। মা নিজের মত জীবন গুছিয়ে নিলেন, মামাদের সাথে ব্যবসায় যোগ দিলেন। আমাদের পড়াশোনাও তিনি চালিয়ে নিয়ে গেলেন। বলতে মা-ই আমাদের পুরো পৃথিবী ছিল। আর আমাকে বা নাহিদকে কেউ বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে এইটাই বলতাম আমাদের বাবা মৃত বা নেই।”
এতটুকু বলে নির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর আবার বলতে শুরু করে, “সেই ঘটনার বছর খানিক পর ডা.সাইয়্যেদ আমাদের কাছে আসেন এবং ফিরে যাওয়ার অনেক অনুরোধ করেন। কারণ তার দ্বিতীয় স্ত্রী নাকি তখন বাসা থেকে কয়েক ভুড়ি স্বর্ণ আর টাকা নিয়ে পালাতক। খোঁজ নেই কোন। যার দরুণ আজ সে আমাদের কাছে ফিরেছে। কিন্তু তার প্রতি আমাদের ক্ষোভ,ঘৃণা এত ছিল যে তিনি বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। আর না কোনদিন পেরেছে।”
কথা শেষে নির্বাণ স্পর্শীর পানে তাকালো। স্পর্শী মাথা নত করে বসে আছে। বলার মত কোন ভাষা নেই তার কাছে। কি বাই বলবে? এখনকার দিনে এরূপ ঘটনার অভাব নেই সমাজে। এক দম্পতির বিচ্ছেদ যে কতটা ভয়াবহ তা শুধু তাদের সন্তানদের কথা শুনে এবং অবস্থান বিবেচনা করেই বোঝা যায়। স্পর্শীকে চুপ থাকতে দেখে নির্বাণ ধীরগতিতে স্পর্শীর একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, “এইটা ভাবার প্রয়োজন নেই আমি তোমার থেকে সত্যিটা লুকিয়েছি বা কিছু৷ এই ঘটনাটা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকলেও এইটা আমাকে প্রদর্শন করে না আমি কেমন বা আমার চরিত্র কেমন। তাই বিষয়টা কখনো গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়নি, বলাও হয়নি। আজ মনে হলো বিষয়টা তোমার জানার প্রয়োজন তাই জানালাম। নাহলে ভবিষ্যতে এ নিয়ে সমস্যা হলে হতেও পারে।”
স্পর্শী নরম সুরে বলল, “না সমস্যা নেই।”
নির্বাণ এইবার কণ্ঠস্বর ভারী করে বলল, “আজ আমি তোমার থেকে দুটো কথা চাই। দিবে?”
“দেওয়ার আমি চেষ্টা করব।”
“কথাটা আমি আগেও বলেছি তোমায় তবুও আজ আবার বলছি, কখনো আমার মাকে কষ্ট দিও না। আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু আমার মায়ের কষ্টটা না৷ তিনি আমাদের বড় করতে গিয়ে অনেক সহ্য করেছেন, মানুষের কটুকথা শুনেছেন, যা হয়তো বলারও উর্ধ্বে।”
স্পর্শী আশ্বস্ত কন্ঠে বলল, “আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো যাতে মা কখনো আমার দ্বারা কষ্ট না পান। চিন্তা করবেন না।”
“হু! আর শেষ এই কথাটাই চাই, কখনো আমাকে মিথ্যা বলবে না বা এমন কথা লুকাবে না যা তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস ভাঙ্গে৷ মনে রেখ, আমার বিশ্বাস যদি একবার ভাঙ্গে তাহলে দ্বিতীয় কোন সুযোগ নেই।”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩০
“হু! আর শেষ একটা কথাটাই চাই, কখনো আমাকে মিথ্যা বলবে না বা এমন কিছু লুকাবে না যা তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস ভাঙ্গে৷ মনে রেখ, আমার বিশ্বাস যদি একবার ভাঙ্গে তাহলে দ্বিতীয় কোন সুযোগ নেই।”
কথাটা বলে নির্বাণ হাতের মুঠোয় পুড়ে রাখা স্পর্শীর কোমল হাতটির উল্টো পিঠে আলতোভাবে নিজের অধর ছোঁয়াল। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “আমার কিন্তু ভরসা আছে তোমার প্রতি, কখনো এই ভরসা ভাঙতে দিও না।”
নির্বাণের কথা স্পর্শী কর্ণগোচর হওয়া মাত্র প্রথমেই রুদ্রের ব্যাপারটা তার স্মৃতি দুয়ারে এসে কড়া নাড়লো৷ রুদ্রের কথা একেবারেই নির্বাণকে জানানো হয়নি, বলা হয়নি বিয়ের আগে তার একটা সম্পর্কে ছিল এবং সেটার সাথে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও তার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ওই ঘটনার বদলতেই তো আজ তার এবং নির্বাণের ভাগ্য একে অপরের সাথে সম্পূর্ণরূপে জুড়ে গিয়েছে৷ হঠাৎ স্পর্শীর ভাবনায় এলো,” বিষয়টা কি সে লুকাচ্ছে? নিজের অজান্তেই ঠকাচ্ছে সে নির্বাণকে? তার সবটা জানার তো অধিকার আছে নির্বাণের। কিন্তু রুদ্রের কথা জানার পর তার প্বার্শ-প্রতিক্রিয়া ঠিক কি হবে? বিষয়টা কি সে ভালোভাবে নিবে? নাকি ওকে ভুল বুঝবে?”
সব ভাবনা এবং প্রশ্নের পরিশেষে মন ও মস্তিষ্ক একটাই উত্তর দিল নির্বাণকে সবটা সত্যি বলে দিতে৷ স্পর্শী ঠিক করলো এখনই সে রুদ্রের কথা তাকে বলে দিবে। মনের মাঝে কিঞ্চিৎ সাহস জুগিয়ে স্পর্শী আঁধারের মাঝেই চোখ তুলে তাকালো নির্বাণের চোখের দিকে, “আমি..”
নিজের কথা শেষ করার আগেই নির্বাণ বলে উঠে, “পরে কথা বল। ভিতরে চল এখন,রেস্টের প্রয়োজন তোমার।”
“আমি ঠিক আছি নির্বাণ।”
মুহূর্তেই নির্বাণের কন্ঠ ভারী শুনালো, “বেশি বুঝতে বলা হয়নি তোমায়। টিচার আমি নাকি তুমি?”
স্পর্শী অভিমানী সুরে বলে,”সবসময় টিচাররা ঠিক হয় কে বলেছে? অনেক সময় স্টুডেন্টরাই টিচারদের থেকে বেশি ভালো জানে।”
নির্বাণ ভ্রু কুঁচকালো, “তাহলে বলতে চাইছো আমার চেয়ে তুমি বেশি জানো?”
স্পর্শী ভাব নিয়ে বলল, “আবার জিগায়।”
নির্বাণ কিঞ্চিৎ হাসলো, “তাই নাকি? তাহলে Organic Reaction Mechanism এর ডেফিনিশনটা বলো তো দেখি। পুরো ব্যাখ্যা সহ বলবে কিন্তু।”
প্রশ্নটা শোনামাত্র স্পর্শীর মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করে। খুব মনের চেষ্টা করেও সে অরগ্যানিক এর ডেফিনিশনটা ঠিক-ঠাক মনে করতে পারলো না। যতটুকু মনে পড়লো খালি ততোটুকুই বলার ক্ষুদ্র চেষ্টা করলো, “A reaction mechanism is a formalized description…”
এতটুক বলেই সে আটকে গেল, বলতে পারলো না আর। নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ তারপর? পরেও বল।”
স্পর্শী কিছু বলল না, চুপ বনে গেল। সব চ্যাপ্টার সে ভালোমত আয়ত্ত করতে পারলেও এই একটা চ্যাপ্টারেই সে বার বার আটকে যায়। যার দরুন পরীক্ষায়ও সে এখান থেকে প্রশ্ন আসলে স্কিপ করার চেষ্টা করে। আর এই সম্পর্কে নির্বাণ অবগত বলেই সে ইচ্ছে করেই এখান থেকে প্রশ্ন করেছে। ক্ষণেই স্পর্শীর রাগ হলো নির্বাণের প্রতি। অন্য কোন ডেফিনিশন দিলে কি হতো? আত্মহত্যা করতো নাকি ওরা?
আকস্মিক নির্বাণ বলে উঠল, “যে নাকি নিজের পড়াই ঠিকমতো জানেনা সে নাকি আবার আমার চেয়ে বেশি জানে। হাও ফানি!”
স্পর্শী রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “আপনি খারাপ, জঘন্যতম খারাপ। জানেন আমি এই চ্যাপ্টারে ভালো নই, তাও এখান থেকেই প্রশ্নটা করেছেন।”
“টিচারদের ধর্মই স্টুডেন্টদের দূর্বল পয়েন্টে আঘাত করার। নাহলে তারা জীবনেও কোনকিছু শিখবে না।”
স্পর্শী নাক ফুলালো, “টিচারদের আরও একটা ধর্ম আছে, তারা যেখানে সেখানেই পড়া নিয়ে বসে পড়ে। আমি যে অসুস্থ একজন মানুষ সেদিকে কি কারো খেয়াল আছে? একটা অসুস্থ ব্যক্তিকে পড়া নিয়ে এভাবে বুলি করছেন আপনি, এইটা কি ঠিক?”
“এই না তুমি ঠিক ছিলে?”
“কই? আমি তো শুরু থেকেই অসুস্থ৷ বেডরেস্ট দরকার আমার। রুমে চলেন৷ চলেন! চলেন!”
নির্বাণ স্মিত মুখে তাকালো। স্পর্শীর হাতটা ধরে বলল, “ড্রামেবাজ একটা। চল ভিতরে।”
_______________
স্পৃহা টেবিলে বসে বায়োলজির বইটা খুলে চোখ বুলাচ্ছে আর বিরবির করে পড়ছে। মাঝে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো খাতায় নোট করে নিচ্ছে। এডমিশন টেস্টে আর মাত্র একমাস সময় আছে। পড়ার গতি এখন না ধরলে শেষে দিয়ে সুবিধা করা দায় হয়ে যাবে। পার্শিয়া ওর টেবিলের উপর-ই বসে আরাম করে ঝিমুচ্ছে। মাঝে মধ্যে স্পৃহার মনোযোগ নিজের দিকে নেওয়ার জন্য মৃদু শব্দ করে উঠছে। স্পৃহা একবার সেদিকে তাকিয়ে দুই-এক ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছে। পড়ার এক পর্যায়ে স্পৃহার মুঠোফোন বেজে উঠে। স্পৃহা মোবাইলের দিকে তাকায় একবার, অপরিচিত নাম্বার দেখে কলটা কেটে পুনরায় বইয়ের পাতায় দৃষ্টি স্থির করে। সেকেন্ড কয়েক যেতেই আবার ফোনটা বেজে উঠে। স্পৃহা সাধারণত অপরিচিত কল ধরে না যার দরুণ আজও সে ধরলো না। পরপর তিনবার কল আসার পর স্পৃহা ফোনটা ধরলো। দরকারী কল হবে ভেবে, নাহলে এতবার কেউ কল দেয় না। ফোনটা রিসিভ করে প্রথমে সালাম দিল সে। অতঃপর জিজ্ঞেস করলো, “জি কে বলছেন?”
অপরপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। স্পৃহা কয়েকবার হ্যালো,হ্যালো করলো কিন্তু লাভ হলো না। অবশেষে অপরপাশ থেকে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে স্পৃহা ফোন কেটে দিল। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে ফোনটা আবার বাজতে শুরু করলো। স্পৃহা কল রিসিভ করে কথা বলতে চাইলো ঠিকই কিন্তু অপরপাশ থেকে এইবারও প্রত্যুত্তর এলো না৷ মাঝে মধ্যে শুধু ঝি ঝি শব্দ শোনা গেল। হয়তো নেট সমস্যা বা অন্যকিছু। তবে পর পর দুইবার একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হওয়া শেষে স্পৃহার মেজাজ চটে যায়। সে রোষানল কন্ঠে বলে, “কে ভাই আপনি? বার বার ফোন দিয়ে জ্বালাচ্ছেন কেন? আরেকবার যদি ফোন করেছেন তাহলে খবর আছে আপনার। ভুলেও যাতে পরবর্তীতে আপনার কল না আসে আমার ফোনে। যতসব আজাইরা পাবলিক।”
কথাটা বলে কলটা কেটে দিল স্পৃহা। অতঃপর ফোন সাইলেন্ট করে বিছানায় ফেলে রাখলো। পড়ায় আর মন বসাতে না পেরে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
এদিকে অপরপ্রান্ত হতে স্পৃহার কথাগুলো শুনে কেউ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে, দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। অবস্থা এমন না পারছে সইতে, না পারছে কিছু বলতে।
_______________
সকাল হতেই নির্বাণ স্পর্শীকে বই নিয়ে বসিয়ে রেখেছে। গতকাল রাতে ঠিকঠাক ডেফিনিশন বলতে না পারায় আজ নির্বাণ নিজ দায়িত্বেই ‘Organic Reaction Mechanism’ চ্যাপ্টারটা পড়িয়ে দিচ্ছে। স্পর্শী পড়তে না চাইলেও নির্বাণ তাকে এই বলে বসিয়ে রেখেছে যে, “তুমি না ঠিক আছো? তাহলে পড়তে সমস্যা কোথায়? অবসর সময় কাজে লাগাতে শিখো।”
নিজের কথার প্যাঁচে বিশ্রিভাবে ফেঁসে যাওয়ায় স্পর্শী রা-ও করতে পারছে না। কোনমতে দাঁতে দাঁত চেপে নির্বাণের কথা শুনছে আর পড়া গিলছে। নিজের ভাগ্যের উপর নিজেরই এখন কান্না আসছে তার। কেন যে সে একজন টিচারকে বিয়ে করতে গেল। টিচার জামাই যে এত ভয়ঙ্কর হয় আগে জানলে ভুলেও বিয়ের পীড়িতে বসত না সে৷ কখনো না। স্পর্শী যখন নিজের চিন্তা-ভাবনায় মশগুল তখন নির্বাণ গলা উঁচিয়ে বলে উঠে, “কোথায় মনোযোগ তোমার? সিম্পল একটা জিনিস এতক্ষণ ধরে বুঝাচ্ছি, তুমি খেয়াল এই করছ না। একটু মনোযোগ দাও, পেরে যাবে। এইটা অনেক ইজি একটা টপিক।”
স্পর্শী মনে মনে ব্যঙ্গাত্মক করলো কথাটা, “হাহ! ইজি একটা টপিক। আপনি টিচার মানুষ ভাই, আপনার কাছে কঠিন লাগবে কোনটা? সবই তো ডাল-ভাত আপনার জন্য, আর যত জগাখিচুড়ি,বিরিয়ানি,কাচ্চি আমার জন্য।”
কিন্তু মনের কথা আর প্রকাশ করলো না। মুখে বলল অন্য কথা, “দেখুন! আপনার গুণ ও মেধা বেশি বলে এই না, সবাই আপনার মতই হবে। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সব দেয় না। আমার আপনার মত এত গুণ বা মেধা নাই। হুহ!”
কথাটা বলেই বা দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো স্পর্শী৷ দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকালো জানালার বাহিরে বিস্তৃত আকাশের পানে৷ স্পর্শীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবটি তা দেখে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। বলল, “তোমার কি মনে হয়? সৃষ্টিকর্তা আমায় সব গুণ আর মেধা একসাথে দিয়ে তারপর পাঠিয়েছে?”
স্পর্শী না তাকিয়েই অকপটে বলে উঠলো, “অবশ্যই!”
নির্বাণ এইবার ঠোঁট কামড়ে হাসলো৷ বলল, “তোমার কথায় ভুল আছে তা কি তুমি জানো? আল্লাহ কখনোই কাউকে কম বা বেশি দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠায়নি৷ যদি পাঠাতো তাহলে তা জন্মের পরই চিহ্নিত করা যেত।”
স্পর্শী ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকালো। কিছু বলার আগেই নির্বাণের হাসার ভঙ্গিমা দেখে একটু থমকালো। পরক্ষনেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলল, “কি বলতে চান আপনি?”
“এইটাই যে, গুণ আর মেধা সবার মাঝেই আছে, শুধু শ্রেণিভেদ তাদের ধরণ ভিন্ন ভিন্ন। মানুষের যেই বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি, তাতেই সে পারদর্শী। এছাড়া, প্র্যাকটিসের ও ব্যপার-স্যাপার আছে। যেকোন বিষয়টির উপর যে যত প্র্যাকটিস করবে সে তাতে তত ভালো করে দেখাবে। সবাই কোন না কোন দিক দিয়ে বেস্ট, কেউ গানে বা নাচে, তো কেউবা পড়ালেখা বা খেলাধুলায়। গুণ ও মেধা সবার মধ্যেই আছে, এখন এইটা তোমার উপর ডিপেন্ড করে তুমি সেটা কিভাবে কাজে লাগাবে।”
কথাটা শুনে শুনে চুপটি মেরে বসে রইলো। কথাগুলো যে শতভাগ সত্য তা সে জানে কিন্তু সে তো আর স্বীকার যাওয়ার মত মেয়ে না। তাই বিরবির করে বলে উঠলো, “নাহিদ ভাইয়া ঠিকই বলে, মাস্টারগিরি না করে আপনি থাকতে পারেন না। আচ্ছা, এত চিন্তা-ভাবনা নিয়ে ঘুমায় কিভাবে মানুষটা? আমি হলে তো নির্ঘাত ঘুমের মাঝেই স্ট্রোক করতাম।”
বিরবির করে কথাগুলো বললেও নির্বাণ ঠিকই সেটা শুনে ফেলল। সে দাঁড়ানো থেকে স্পর্শীর দিকে হালকা ঝুঁকে পড়ে, তার মুখের উপর পড়ে থাকা এক গাছি চুল আলতো হাতে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে দুরন্তপনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“আমি কিন্তু শুধু ঘুমাতে না, আরও অনেক কিছু করতে জানি। প্রেকটিক্যালি দেখাবো?”
কথাটার অর্থ প্রথমে স্পর্শীর বোধগম্য না-হলেও পরবর্তীতে নির্বাণের ঠোঁটের কোনে খেলা করা দুষ্টু হাসি আর দৃষ্টির ধারে নিষিদ্ধ ইশারাটা উপলব্ধি করতে পেরে তার কান গরম হয়ে আসে। নরম গাল দু’টির মাঝে খেলে উঠে রক্তিম বর্ণ। সে পাশে থাকা বালিশটা তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে লজ্জালু কন্ঠে বলে উঠে, “নির্লজ্জ, বেহায়া মানুষ একটা।”
নির্বাম উড়ন্ত বালিশটা একহাত দিয়ে ধরে নিজের বুকে গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ায়। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে উঠে,”কিছু মানুষের কাছে নির্লজ্জ, বেহায়া না হলে দুনিয়া চলবে কিভাবে?”
স্পর্শী আর প্রত্যুত্তর করলো না, নিভৃতেই হাতে থাকা বইটি মুখের উপর তুলে নিয়ে নিজের রক্তিমা মুখটি লুকালো৷ পরক্ষনেই এমন ভাণ করলো যেন এখন বই পড়া ব্যতীত দ্বিতীয় কোন কর্ম এই পৃথিবীতে নেই। নির্বাণ তা দেখে মুচকি হাসলো, “আচ্ছা আমি একটু আসছি। তুমি পড়। আমি আসতে আসতে যেন এতটুকু শেষ হয় তোমার।
কথাটা শুনে স্পর্শী কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বালিশটা বিছানার এককোনে রেখে সপ্তর্পণে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। নির্বাণ বেরিয়ে যেতেই স্পর্শী লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে, যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে সে। ঠোঁটের কোনে তখনও তার লাজুক হাসি। কিয়ৎক্ষণ আপনভাবনায় সময় গড়িয়ে যেতে ক্ষণেই তার কালকে বলা নির্বাণের কথাগুলো পড়ে। সেই সাথে অতীতের কিছু পাতা চোখের সামনে ভেসে উঠে। হাসিটা মিইয়ে যায় তখনই, তিক্ত হয়ে যায় মূহুর্তটা। সে মলিন দৃষ্টিতে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠে, “আমি কি আদৌ মানুষটার যোগ্য? অতীতটা এখনো না বলে ঠকাচ্ছি না তো তাকে?”
#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩১
প্রখর অনিলের দোলে আঁধারিয়া আকাশে এদিক-সেদিক ভেসে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণমেঘের ভেলা৷ সবুজবর্ণ পাতাগুলোর কাগজী গায়ে বাতাসের দল আঁচড় কাঁটতেই মড়মড় শব্দ করে কুঁকড়ে উঠছে তারা৷ চারদিকে ধুলোবালি মিশে একাকার। মেঘ-বর্ষণের প্রতিক্ষায় ছত্রভঙ্গ নগরী। জানালার ঝারে অকৃত্রিম আলোর ছটা এসে হানা দিতেই নির্বাণ দৃষ্টি সেদিক গেল। একপলক তাকিয়ে পুনরায় ল্যাপটপের স্ক্রিনে নজর দিল৷ দক্ষ দ্রুতগামী হাত বিচরণ করতে শুরু করলো কি-বোর্ডেরের উপর। অসম্পূর্ণ ই-মেইলটি পূর্ণ করতে ব্যস্ত সে। স্পর্শী বিছানায় হেলান দিয়েই সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো,কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। ধীরে ধীরে কি-বোর্ডের উপর থেকে তার হাতের গতি কমলো এবং একসময় স্থির হলো। স্পর্শী দৃষ্টি সরালো, মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে ভাবা কথাগুলো আরেকবার গুছিয়ে নিল। নিম্নস্বরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কাজ কি শেষ হয়েছে?”
নির্বাণ পিছন ঘুরে তাকালো, “হ্যাঁ প্রায় শেষ। এডিট করে জাস্ট সেন্ড করাই বাকি এখন। কেন?”
স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, “কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।”
নির্বাণ ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে ফাইলটা সেভ করতে করতে বলল, “হুন বল।”
“কথাটা দরকারী নির্বাণ।”
জোর গলায় বলল স্পর্শী। নির্বাণ ভ্রু কিছুটা সংকীর্ণ হলো, সে স্থিরচিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো স্পর্শীর মুখ পানে, “আচ্ছা, দাঁড়াও।”
কথাটা বলে হাতের কাজটা সেরে ল্যাপটপটা অফ করে দিল নির্বাণ। পূর্ণ দৃষ্টিতে স্থাপন করলো স্পর্শীর দিক। স্পর্শী একটু নড়েচড়ে বসলো, সত্য বলার সাহসটুকু জুগিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো, “আমার অতীত আপনার অজানা জানি। কখনো বলা হয়নি আপনাকে এ সম্পর্কে। কিন্তু আমার অতীতের কয়েকটা বিষয় সম্পর্কে আপনার জানা অতি জরুরি। কারণ আমি চাচ্ছি না সামনে গিয়ে এইটা আপনি বাহির কারো থেকে জানুন বা এ বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের মাঝে কোন প্রকার ঝামেলা সৃষ্টি হোক। তাই আগেই আমি সবটা আপনার কাছে তুলে ধরতে চাইছি।”
নির্বাণের ভ্রু পুনরায় সংকীর্ণ হয়ে এলো, “কি বলতে চাইছো বল।”
স্পর্শী লম্বা নিঃশ্বাস নিল, “বিয়ের আগে আমি একটা রিলেশনশিপে ছিলাম এবং সেই রিলেশনের মেয়াদসীমা ছিল দুই থেকে তিনমাস। সম্পর্কটার বয়সসীমা কম হলেও এটি আমার জীবনের সাথে অনেক বাজেভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। বলতে, পরোক্ষভাবে আমার বিয়ে করার পিছনেও এই সম্পর্কটাই কারণ ছিল।”
নির্বাণ অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকালো, কোন শব্দ উচ্চারণ করলো না মুখে। নির্বাণকে নীরব থাকতে দেখে স্পর্শী মাথা নুয়ে নিল, থুতনি গিয়ে ঠেকলো গলার কাছে। বলতে শুরু করলো সে, “আমার ফ্রেন্ড নন্দিতার বয়ফ্রেন্ডের বন্ধু ছিল সে। রুদ্র নাম তার। নন্দিতার একবার তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবে বলে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানেই রুদ্রের সাথে প্রথম পরিচয় আমার। কথায় কথায় জানতে পারি আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে, মাস্টার্স কমপ্লিট করছে সে। তো সেদিনের পর থেকেই আমাদের টুকটাক কথা শুরু এবং ছয়মাসের মাথায় সে আমাকে প্রাপোস করে। আমি প্রথমে না করলেও ফ্রেন্ডরা বুঝায় যে ছেলে হিসাবে নাকি সে ভালো। নন্দিতাও আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে রুদ্র আমাকে অনেক ভালোবাসে, সে আমাকে ভালো রাখবে। এদিকে রুদ্রও আমার পিছনে একবার হাত ধুঁয়ে পড়েই ছিল। অতঃপর আমিও শেষে তাকে হ্যাঁ বলে দেই। তার প্রতি আমার ফিলিংস ছিল বা সে আমার দূর্বলতা ছিল এমন না, ফ্রেন্ডদের কথায় তাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই সম্পর্কটার শুরু৷ আমি তাকে নিয়ে বা রিলেশন নিয়ে কখনো সিরিয়স ছিলাম না। কেন যেন তার প্রতি আমি টান অনুভব করতাম না। তাজ সবসময়ই চেষ্টা করেতাম দূরত্ব মেনে চলাফেরা করার। এমনেও হাত ধরা,কথায় কথায় গায়ে হাত দেওয়া, কাছাকাছি আসা এসব আমার কোনকালেই পছন্দ ছিল না তাই রুদ্রকে এইসব করতেই আগেই মানা করেছিলাম। সেও তখন আমার কথায় রাজি ছিল। দেড় মাস ভালোয় ভালোয় এই কেটে গিয়েছিল সময় কিন্তু সমস্যা শুরু হয় এরপরে। রুদ্র কেমন যেন বদলে যায়, কাছে আসার চেষ্টা করতে থাকে। তখন সবকিছু সর্বশেষ অপ্রীতিকর প্রস্তাব দিতেও পিছ-পা হয় না। ওর এমন আচরণে আমি বিরক্তি হয়ে গিয়ে শেষে ব্রেকাপের কথা বলি। তখন সে কিছুটা দমে গিয়ে আমার কাছে মাফ চায় এবং বলে সে আর এমন আর কখনো করবে না। প্রায় সপ্তাহ খানেক আমার পিছে লেগেছিল সে এবং শেষে আমিও আরেকটা সুযোগ দিয়েছিলাম। প্রথম কয়েক সপ্তাহ ভালো গেলেও শেষে একদিন রুদ্র আমায় এক নির্জন জায়গায় ডাক দেয়। জায়গায়টা আমার বাসা থেকে প্রায় ঘন্টাখানেকের দূরত্বে হওয়ায় আমি রাজি হয়নি, পাশের একটা পার্কেই ওকে বলি দেখা করতে। রুদ্র প্রথমে নাকচ করলেও পরবর্তীতে আসে এবং সেখানেই আমার সামনে একটা কু-প্রস্তাব রেখে দেয়। যা ছিল অতি মাত্রায় জঘন্য। আমি ওর মুখের উপর না বলে চলে আসতে নিলে সে আমার হাত টেনে ধরে এবং…….”
কথাটা শেষ না করেই স্পর্শী থেমে যায়। নয়ন জোড়ায় তখন তার আগ্নেয়গিরির ভয়ংকর উত্তাপ। কিয়দংশ সময় শব্দহীন থেকে স্পর্শী পুনরায় বলে উঠে, “এবং আমার সাথে জোড়াজুড়ি করা শুরু করে। পার্কে তেমন মানুষ না হলেও আশে-পাশে অল্পসংখ্যক মানুষ থাকায় তেমন জোড় দিতে পারেনি। আর আমি সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে চিল্লাতে থাকি, আমার আওয়াজ শুনে মানুষ জড়ো হলেই রুদ্র আমার হাত ছেড়ে দেয়। তখন আমি শুধু ওকে একটা থাপ্পড় মেরে তৎক্ষনাৎ সকল সম্পর্ক শেষ করে দৌড়ে চলে আসি। বাসায় এসে আগেই সকল জায়গায় থেকে ওকে ব্লক করে দেই৷ রাগে আমার শরীর তখন রি রি করে কাঁপছিল। না পারছিলাম কিছু বলতে, না পারছিলাম সইতে৷ বাসায় কেউ জানতো না আমার এই সম্পর্কের কথা, একমাত্র সামান্ত আপু বাদে৷ কিন্তু তখন আপু নেটওয়ার্কের বাহিরে ছিল বিধায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর বন্ধুদের জানিয়েছিলাম। নিজের রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ আমার জন্য দায় হয়ে পড়েছিল।
নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ তো হচ্ছিলই না, তার উপর ঘটনাটা বার বার তাড়া দিচ্ছিল আমায়। এদিকে, সেই ঘটনার কয়েকদিন আগেই লতিফ আঙ্কেল আমার বিয়ের জন্য একটি সম্বন্ধ এনেছিল। পাত্র হিসাবে সেই ছেলেকেই বাবা-মার অনেক মনে ধরে যায় এবং আমাকে সেই সম্বন্ধে রাজি হয়ে যেতে বলে। আমি যখন রুমে বসে রাগে ফুঁসছিলাম তখনই মা আবার আসেন আমায় বিয়ের কথা বলতে৷ মাকে দেখে তখন আমার রাগ না বরং গিল্টি ফিল হচ্ছিল কারণ আমি তাদের ভরসা ভেঙ্গে ছিলাম। তাদের কিছু না বলে এমন এক সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম যেখানে কি-না সেদিন হয়তো আমার সর্বনাশ নিশ্চিত ছিল। নিজের গায়ে কলঙ্ক লাগতো তো লাগতো, বাবা-মাও অসম্মানিত হতো। সমাজে আমাদের অবস্থানই বদলে যেত। ঘটনার আকস্মিকতায়, ক্রোধে,ক্ষোভে,অনুশোচনা,বিমূঢ়টায় তখনই আমি পাত্রের কোন খোঁজখবর না নিয়ে, ছবি না দেখেই মাকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দেই। এরপরের ঘটনাগুলো খুব তো দ্রুতই হয়েছিল তাই বেশি ডিটেইলসে আর বলছি না। ছোট করে বলছি, আমি হ্যাঁ বলার সপ্তাহখানেকের মধ্যে কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে পাত্রপক্ষ এলো আমায় দেখতে। সেখানেই প্রথম দেখা হয় আপনার সাথে এবং ঘটনাক্রমে কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়।”
সবটা বলে স্পর্শী দম নেয়। সত্যটা বলার পর তার মনটা এখন হালকা হালকা লাগছে। সে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে নির্বাণের দিকে তাকায়। নির্বাণ তখনও স্থিরচিত্তে বসে আছে, তার মধ্যে কোনপ্রকার হেলদোল দেখা দিল না। স্পর্শীর মনে এবার ভীতি কাজ করতে শুরু করলো, “নির্বাণ কিছু বলছে না কেন? সে কি আমাকে ভুল বুঝলো? বিষয়টা আমি বেশি আগোছালো করে ফেললাম?” কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস আর জুগাতে পারলো না স্পর্শী।
বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টির আবির্ভাব। শীতল পানির বড় বড় ফোঁটা হানা দিচ্ছে দক্ষিণা জানালার ধারে৷ মাঝে মধ্যে মেঘরাজ নিজের শক্তি প্রদর্শন করতে গর্জে উঠছে, অলৌকিক দ্যুতি ছড়াচ্ছে ঘনীভূত মেঘের অন্তরালে। জানালার অপরপ্রান্তে প্রকৃতির তান্ডব চললেও, তার এপ্রান্তের পরিবেশ প্রচন্ড নিভৃতে,নৈঃশব্দ্যে ঘেরা।
কিয়ৎক্ষণ পর গম্ভীর পরিবেশটা ভেঙে নির্বাণ বলে উঠে, “তার সাথে কি তোমার এখনো যোগাযোগ আছে?”
“না নেই।” স্পর্শীর নিম্ন কন্ঠের উত্তর।
“রাস্তা-ঘাটে বা ভার্সিটিতে বিরক্ত করে তোমায়?”
স্পর্শী দৃষ্টি তুলে একপলক নির্বাণের দিকে তাকালো, “প্রথম দিকে একটু করেছে তবে এখন আর করে না।”
“ওই ছেলেটার সকল ইনফরমেশন আমাকে দিও তো।”
“সেটা দিয়ে আপনি কি করবেন?”
“দরকার আছে।”
নির্বাণের শীতল কন্ঠে বাণী শুনে স্পর্শীর মন ক্ষুণ্ণ হলো। সে মুখ ছোট করে বলে, “আচ্ছা।”
সে ভেবেই নিল নির্বাণ তার প্রতি রাগান্বিত। হয়তো সত্যটা দেরিতে বলেছে বলে অথবা অন্য কারণও হতে পারে। তবুও স্পর্শী ক্ষুদ্র চেষ্টা করলো বিষয়টা স্পষ্ট করার, “আপনার সাথে আমার সম্পর্ক প্রথম দিকে এত সহজ ছিল না, সে সাথে আমি সম্পর্কটার ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চিত ছিলাম তাই আগে আপনাকে কথাগুলো জানানো প্রয়োজনবোধ করিনি। কিন্তু এখন আপনি আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন, আমার সম্পর্কে প্রত্যেকটা কথা আপনার জানার অধিকার আছে তাই সত্যটা লুকালাম না৷ এখন আপনার মনে যদি আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় কোন ধারণা থাকে তাহলে বলতে পারেন।”
স্পর্শীর কথা শুনে নির্বাণ একমুহূর্তের জন্য নিঃশব্দ রইলো। অতঃপর বলল, “যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ একান্ত আমি, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার অতীত নিয়ে আমার মনে কোন ভাবনা নেই। এখন তুমি যদি অতীত নিয়ে ভাবো তাহলে বলব, অতীতে তোমার গায়ে কলঙ্ক লাগলেও আমার জন্য এখন তুমি যা আছো তাই থাকতে। কোন পরিবর্তন আসতো না তোমার প্রতি আমার আচরণে৷ তাই এসব নিয়ে ভেবো না৷ আমি আছি, আমি থাকব আজীবন৷”
কথাটা বলেই নির্বাণ স্পর্শীর সান্নিধ্যে এসে তার কপালে অঁধর ছুঁয়ে দিয়ে তার চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দেয়। স্পর্শী আকস্মিক নির্বাণকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলো, নিভৃতেই মুখ গুঁজলো তার বুকে। দুইজনের মাঝে চলল নীরব কথপোকথন। যা কি-না বর্ণ,অক্ষর,শব্দহীন হয়েও বুঝলো দুইজনেই। সম্পর্কের মানটা যেন বৃদ্ধি পেল এখানেই৷
দুইজনের মনের এক জায়গায় হলেও, নির্বাণের চোখের ভাষা ছিল অন্য। কিছুটা শুক্র, অনলপ্রভ মিশ্রিত। যেটা কি-না স্পর্শী ধরতেই পারলো না।
#চলবে