#নীল_দিগন্তে
পর্ব-০৮
লেখা – নীলাদ্রি নীরা
পুষ্প একদিন ক্যাম্পাসে একা একা বসেছিলো। সকাল থেকে পুষ্পর সব কেমন যেন লাগছে। কেমন একটা অস্থিরতা। এরকমটা কেন হচ্ছে? সকালের ব্যাপারটায়? সকালে পুষ্প ঘুম থেকে জেগে দেখে ওর একটা হাত দিয়ে রাজীবকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছিল মাঝখানে কোলবালিশ থাকা সত্বেও। কি লজ্জার ব্যাপার। ভাগ্যিস রাজীব সেটা টের পায়নি। আনমনে কথাগুলো ভাবছিলো পুষ্প। ও লক্ষ্য করলো নওশিন আর রুমা একটা লোকের সাথে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটা কে হতে পারে?
-” পুষ্প! রাইট?”
পুষ্প তাকিয়ে দেখলো লোকটা ওর সামনে দাড়িয়ে। আর নওশিন, রুমা ওর পাশে এসে দাড়িয়েছে। রুমা কেমন করে যেন লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করছে সাথে পুষ্পকেও। ওর চোখে কেবল সন্দেহ। পুষ্প বলল,
-” জ্বি”
-” আপনার সাথে আমার একটু দরকার ছিলো। দরকার বলতে কিছু কথা আপনাকে বলতাম। আপনার কি সময় হবে?”
-” হবে কিন্তু আমাকে কি বলবেন আপনি? আপনি কে?”
-” আমি সৌরভ। আপনার সাথে আমার একবার দেখা হয়েছিলো।”
-” মনে পড়ছে না।”
সৌরভ মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো। মুখে বলল,
-” ম্যাম আপনি কি সময় দিতে পারবেন একটু? বিষয়টা আমার জন্যে খুব জরুরি। প্লিজ?”
পুষ্প বলল,
-” ওকে ”
-” আমরা আশেপাশে কোন কফিশপে গিয়ে বসি?”
-” কফিশপে যাবো না, এখানে বলুন।”
সৌরভ হতাশ হয়ে বলল,
-” আসলে একটু পার্সোনাল বিষয় বুঝতেই পারছেন।”
পুষ্প বিরক্তের শেষ নেই। এই আপদ আবার কোথা থেকে নাজিল হলো? আর কি পার্সোনাল বিষয় বলবে? পুষ্প বলল,
-” চলুন”
রুমার সন্দেহ আরও প্রবল হলো। সে তাকিয়ে আছে পুষ্প আর সৌরভ নামে আগন্তক লোকটার যাওয়ার দিকে। ব্যাপারটা কি হচ্ছে সেটা তার জানতে হবে।
.
-” কি খাবেন? অর্ডার কি দিবো?”
-” এক্সকিউজ মি! আমি আপনার সাথে খেতে আসিনি।”
সৌরভের খুব হাসি পাচ্ছে। দুই বোন দুই প্রান্তের মানুষ হলেও দুজনের কিছু কিছু দিকে খুব মিলে। সৌরভ স্মিত হেসে বলল,
-” সেটা আমিও জানি। কিন্তু যেহেতু এখানে আমরা এসেছি কিছু তো খেতেই হবে। রেস্টুরেন্ট তো শুধু শুধু আমাদের বসতে দিবে না তাই না? ”
পুষ্প ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্য অর্ডার করল। সৌরভের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এখন ঠিক আছে?”
সৌরভ হাসলো। হেসে ওর নিজের জন্যও খাবার অর্ডার করলো। পুষ্প বলল,
-” আপনার কথা শুরু করুন।
-” থ্যাংকস ফর ইউর কাইন্ড ম্যাম। আর আমি তোমাকে আপনি করে বলতে পারছি না তার কারন তুমি আমার যথেষ্ট ছোট। ওকে?”
পুষ্প চুপ করে আছে ওর দৃষ্টি একদম কর্নারের টেবিলটার দিকে। একটা মেয়ে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে। পড়নে বাদামী টপস, ব্ল্যাক জিন্স। এটা যে রুমা সেটা পুষ্প একদম শিওর এই গেটআপেই একটু আগে আজকে রুমাকে দেখেছে। রুমা এখানে কেন এভাবে বসে আছে? সৌরভ বলতে শুরু করলো,
-” রাত্রির সাথে আমার পরিচয় আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু থেকে। রাত্রি তখন সবে ইন্টারে ভর্তি হয়েছে। আমি একদিন কলেজে যাই প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। গিয়ে দেখি কলেজে তখন নবীন বরন অনুষ্ঠান ছিলো। স্যারের সাথে কথা বলে চলে আসছিলাম তখন আমার নজর গেলো বেবি পিংক কুর্তি আর হোয়াইট উড়না, প্যান্ট পড়া একটা মেয়ের দিকে। সে দ্রুত পায়ে হেটে যাচ্ছে অডিটোরিয়ামের দিকে। তার ভ্রু কুচকানো। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। সত্যি বলতে তার এই বিরক্ত চেহারাটাতেই আমি আটকে যাই। সেখান থেকেই আমি ধপাস করে পড়ে গেলাম। এরপরের ঘটনা গুলো তোমাকে বলছি না। যাস্ট বলি রাত্রির সৌন্দর্য্যের চেয়েও ওর আচার আচরণ, লাইফস্টাইল, ওর থিংকিং ক্যাপাবিলিটি, এগুলোই আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেসব বাদ। রিসেন্ট যেটা হলো, তুমি তো জানো, রাত্রির বাবার ঘটনা? আমি নিজেই ওই রিপোর্টটা করি। রাত্রিকে আমি যখন ওর বাবার সব দুর্নীতির কথা বললাম, রাত্রি খুব মনযোগ দিয়ে শুনলো। এবং সাথেসাথেই সে ব্যাপারটা হজম করে ফেললো। অন্য কোনো মেয়ে হলে বয়ফ্রেন্ডের কাছে বাবার সম্পর্কে এমন কিছু শুনে কিছুতেই নিজেকে ঠিক করতে পারতো না। আমি খেয়াল করলাম রাত্রি খুব আয়েশ করে পিজ্জা খাচ্ছে আর বলছে, খুব ইয়াম্মি তাই না সৌরভ? রাত্রির এমন ব্যবহারে আমি অবাক হইনি। কারণ এই পাঁচ বছরে আমি রাত্রিকে খুব ভালো করে স্টাডি করে ফেলেছি।”
সৌরভ একটু থামলো। আবার বলতে শুরু করল,
-“সেদিনই রাত্রি আমাকে বলল, বিয়ে করব আমরা। আমরা বিয়ে করি সেদিনই। আমাদের বিয়ের সাক্ষী ছিল আমার বন্ধুরা। বিয়ের পর ও বললো, আমরা যেহেতু বিয়ে করেছি আমরা লিভ টুগেদার করতে পারি। আমাদের বাসর ও করতে হবে। আমি খানিকটা বিচলিত হলাম। রাত্রি কোনো অবুঝ মেয়ে না। ও সবকিছু প্ল্যান অনুযায়ী করে। কিন্তু রাত্রির মুখে লিভ টুগেদার, বাসর এসব কথা আমি মানতে পারছিলাম না। হ্যা আমারও ফিজিক্যাল নীড আছে। তার মানে এই না যে আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে রাত্রির সাথে লিভ টুগেদার করব। আমি অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে বাসায় পাঠালাম। সারাদিন, সারারাত চলে গেল ও আমার ফোন রিসিভ করছে না। আমি দুশ্চিন্তায় কাজেও মন দিতে পারছি না। পরেরদিন ও সেইম। ওর কোনো খুঁজ নেই। রাতের ৯টার দিকে রাত্রি আমার বাসায় হাজির। আমি ব্যাচেলর বাসায় থাকি। বাসায় পরে এ নিয়ে বড়সড় ঝামেলা হয়। রাত্রিকে কিছুতেই আমি ফেরাতে পারিনি। ও আমার সাথে থাকবেই। ওইদিন রাতটা আমরা একসাথে ছিলাম ইভেন আমরা ফিজিক্যালি ইনভলভ হই।”
সৌরভ আবার থামলো। পুষ্পকে সবকিছু ডিটেইলস এ বলতে ওর আনইজি ফীল হচ্ছে। কিন্তু একমাত্র পুষ্পই পারে এই বিষয়টা সমাধান করতে। সৌরভ আবারও বলতে লাগলো,
-” এতটুকু পর্যন্ত ঠিকই ছিলো। আমি নিজেও ভেবে নিয়েছিলাম যে আমাদের সম্পর্কটা আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতোই হবে। আমরা একসময় একসাথে থাকবো। কিন্তু পরেরদিন সকাল বেলা আমি উঠে দেখি রাত্রি পাশে নেই। আমি আমার বাসার অন্য ছেলেদের জিজ্ঞেস করলাম ওরা বললো জানে না। একজন বললো, সকালে দেখেছে মেইন দরজা খোলা ছিল। আমার বুঝতে বাকী নেই রাত্রি চলে গিয়েছে। রুমে এসে ফোন হাতে নিতে গেলেই দেখলাম ফোনের নিচে একটা ভাজ করা ছোট কাগজ। সেখানে লিখা, ” এত অনেস্ট সেজে লাভ কি হলো সৌরভ? থলের বিড়াল ঠিকই বের হয়ে আসলো তো? বাই দ্যা ওয়ে, থ্যাংকস ফর লাস্ট নাইট। আই উইল নেভার ফরগেট দ্যাট।” এটা দেখে আমি যতটা না অবাক হয়েছি তারচেয়ে আমার খারাপ লেগেছে রাত্রি আমার সম্পর্কে একটা বাজে ধারণা পুষিয়ে রেখেছে। আই ডোন্ট নো হোয়াই। আমি এমন কিছুই করিনি। আর রাত্রির সাথে কেন কোনো মেয়ের সাথে আমি সামনে বা আড়ালে অসভ্যতাও যেখানে করিনি সেখানে অনেস্ট সাজার কথা আসবে কেন? ওইদিন থেকে রাত্রির ফোন অফ। আমি অনেক যোগাযোগ করতে চেষ্টা করি কিন্তু লাভ হয়নি। ওর এক ক্লাসমেটের সুবাদে জানতে পারি রাত্রিরা তোমাদের বাসায় আছে। তারপরও আমি যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি। বাট রাত্রি আমাকে এভয়ড করেই গিয়েছে। গতকালকে রাত্রি আমাকে একটা রেজিস্ট্রি করে চিঠি পাঠায় আমার অফিসের ঠিকানায়। আমি চাই তুমি চিঠিটা পড়। প্লিজ পুষ্প”
এই বলে সৌরভ পকেট থেকে একটা খাম পুষ্পর দিকে এগিয়ে দিলো। পুষ্প যন্ত্রের মতো খামটা নিয়ে সেটা খুলল।
”
প্রিয় স্বামী,
আচ্ছা তুমি আমার স্বামী সৌরভ? ইশ কি লজ্জার কথা। আচ্ছা আমি এটা কেন বিশ্বাস করতে পারি না বলতে পারো? আমার শুধু মনে হয়, আমরা এখনও গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড। আমাদের মধ্যে কিছুই হয় নি। সত্যি কি আমাদের মধ্যে কিছু হয়েছে সৌরভ? মনে করো কিছুই হয়নি। তাতে তোমাদের জন্য ভালো হবে। তোমাদের বলছি সেটার কারণ কি তুমি বুঝতে পেরেছো?
ওগো রিপোর্টার, আমি একটা বিরাট প্ল্যান করেছি জানো! আমি সিঙ্গেল মাদার হবো। একদম ছোট মামীর মতো। তবে আমি অবশ্যই আমার মেয়েকে নিজের মতো করে গড়ে তুলব। মামীর মত মারধর আর বকাঝকা করব না। মামী তো নিজে সুখে থাকতে পারে নি তাই মেয়েটাকেও সুখে থাকতে দিবে না। সাইকো মহিলা। আমি উনাকে শিক্ষা দিব কিভাবে নিজের জীবন শেষ করে দিয়েও সন্তানকে আগলে রাখতে হয়। আমি, আমার মা আর আমার মেয়ে নিয়ে একটা সুখের সংসার হবে। ভাবছো তো মেয়ে কোথা থেকে আসবে? আমি বলবো না তোমাকে। তোমার সাথে আমার ভীষণ রাগ। তুমি খুব খারাপ।
জানো তো, তোমার সুন্দরী তানিয়া হক নামের সেই কলিগকে আমি আচ্ছামত কথা শুনিয়েছি। সে কেন অন্যমেয়ের হাজবেন্ডের পিছনে পড়ে থাকবে? সে কি তোমার কাছাকাছি আসার ট্রাই করে এখনও? আর শোনো, তুমি যতই ন্যাকামি করো না কেন, তোমাদের ডলাডলির খবর আমার খুব জানা। তুমি সায় না দিলে কেন সে তোমার গায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চাইবে হুম? তুমি তো জানো না পাখি আমি তোমার অগোচরে গান সেট করে দিয়েছি। ঠুস করে শ্যুট করবো তোমাকে বুঝেছ? খুব তো বলেছিলে আমি ছাড়া তুমি অন্য মেয়ের দিকে তাকাও না। জানি জানি। এজন্যই তো তানিয়া হককে এলাও করছো। হুহ …
আর খবরদার তুমি পিজ্জা হাটের ডেলিভারি বয় সেজে মামার বাসায় আসবে না। আই হেইট পিজ্জা। আমার লাইফস্টাইল বদলে গিয়েছে সৌরভ। সব বদলে দিয়েছি আমি। ওগো রিপোর্টার তুমি কি এখন ওই গানটা গাইবে,
সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে
সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলে…
ইতি
তোমার সুইট কুইন
পুষ্প চিঠিটা আবার ভাজ করে খামে ভরে সৌরভের দিকে এগিয়ে দিলো। পুষ্পর ইচ্ছে হচ্ছে রাত্রিকে গুলি করে মেরে ফেলতে। এতবড় দুঃসাহস ওর হয় কিভাবে? আর এই রিপোর্টার ব্যাটাও তো কম যায় না। খুব সুন্দর করে নিজেকে সাধু বানিয়ে দিচ্ছে। হুহ
পুষ্পর চুপ করা দেখে সৌরভ বললো,
-” আমি কি করবো বলতে পারো পুষ্প? রাত্রি সন্দেহের বশে এরকম করছে। ও আমার সাথে একবার এটা নিয়ে সামনাসামনি কথা বলতে পারতো। ট্রাস্ট মি, তানিয়া আমাকে পছন্দ করে সেটা বুঝতে পেরেই ওকে আমি রাত্রির কথা বলে দিয়েছি। তানিয়াও সরে গিয়েছে। তবু কেন রাত্রি এরকম করছে আমি জানি না। রাত্রির এমন পাগলামি আমি আর নিতে পারছি না। আই রিয়্যালি ওয়ান্ট হার। আমি ওকে হারাতে চাই না।”
পুষ্প বলল,
-” মি. সৌরভ আমি কাউকে অত সহজে বিশ্বাস করতে পারি না বুঝলেন। রাত্রির কাছ থেকেও শুনা লাগবে। তারপর দেখি কি করা যায়।”
সৌরভ বলল,
-” অবশ্যই। তোমার হেল্পটা আমার দরকার। ”
-” আমার এখন উঠতে হবে। ভালো থাকবেন।”
পুষ্প চলে গেল। সৌরভ এর নিজেকে অনেকটাই হালকা লাগছে। রাত্রিটা ওকে পাগল বানিয়ে ছাড়ছে একদম।
.
রাজীব ভাবছে নিউজটা প্রথমে কাকে জানানো উচিত? বাবাকে নাকি মাকে? নাকি পুষ্পকে? বউ আগে নাকি বাবা-মা? রাজীব কল করলো বাবাকে। মশিউর রহমান পেপার পড়ছিলেন। কলটা রিসিভ করেই বললেন,
-” হ্যালো! ”
রাজীব বললো,
-” বাবা তুমি কি ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে মাকে ডাকবে?”
-” কেন?”
-” তোমাদের দুজনকেই একসাথে একটা খবর জানতে হবে।”
-” একসাথে? গুড! ডাকছি তোর মা কে।”
মশিউর রহমান ডাকলেন, সোহেলী! এই সোহেলী!
চলবে….