#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৫+১৬)
রাত সন্ধ্যার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,,
“” আজকের অভিনয়টা অনেক বেশিই কাঁচা। উঠবি নাকি আমি কোলে তুলে সায়নের কোলে বসিয়ে দিয়ে আসবো?””
সন্ধ্যা চট করে উঠে পড়লো। রাত মুচকি মুচকি হাঁসছে। সন্ধ্যা সেদিকে তাকিয়ে ভাবছে,
*যার বিয়ে তার খবর নাই,পাড়া পড়শির ঘুম নাই এবং উঠ ছেরি তোর বিয়ে* এই দুটো প্রবাদবাক্য যেন একমাত্র তার জন্যই গুনীজনরা আউড়িয়ে ছিলেন!
সন্ধ্যার ফ্যালফ্যালানি চাহনিটা বেশ উপভোগ করছে রাত। ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাঁসিটা আর ওখানে থাকতে চাচ্ছেনা,সন্ধ্যার উপর আচঁড়ে পড়তে চাচ্ছে। রাত সন্ধ্যার পাশে বসে পড়লো। ওর এলোমেলো চুলগুলো ঠিকঠাক করে দিতে দিতে বললো,,
“” তোর কি আমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে?? চাইলে বলতে পারিস।””
সন্ধ্যা ঘাড় বাকিয়ে তাকালো রাতের দিকে। কাঠ গলায় বললো,,
“” না।””
“” কি না? বিয়ে করবি না?””
“” তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা।””
“” সিউর?””
সন্ধ্যা নরম সুরে বললো,,
“” রাত ভাইয়া!””
“” শুনছি,বল!””
সন্ধ্যা রাতের দিকে মুখোমুখি হয়ে বসলো। চোখটা বন্ধ,চোখের পাতার অস্থিরতা,নিশ্বাসের দ্রুততা,নাকের পাতা কাঁপাকাঁপি নিয়ে হাতের দশ আঙুলের যুদ্ধ বাধিয়ে নিরবতা পালন করছে। রাতও কম কিসের? সেও পা দুটো ভাজ করে অনেকটা নামাজ আসনে বসেছে,নিজের দু’হাটুর উপর কনুই ভর করে দুগাল হাত দিয়ে বন্দী। চোখের পাতা শক্ত আঠায় দুধারে আটকিয়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সন্ধ্যার মুখের পানে। যাহা সে চায় তাহা পাওয়ার প্রবল ইচ্ছেশক্তি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললো। সন্ধ্যার নিবিড় নিশ্চুপতাকে ভেঙে দিয়ে বললো,,
**ওগো নিশ্চুপী,ভাঙো তোমার নিশ্চুপ!
অধিরতায় বধির আমি,চাইছি তোমার কথ্য রুপ!!**
সন্ধ্যা চট করে চোখ মেলে বললো,,
“” আমি বিয়ে করবোনা।””
রাত বেশ নিরাশ হয়ে বললো,,
“” তুই এই নাবোধক উক্তির জন্য এমন সাজে নিজেকে সজ্জিত করেছিলি?””
সন্ধ্যা ভ্রূ সংকুচিত করে বললো,,
“” আমি কখন সাজলাম?””
“” তুই একটা…””
“” কি?””
“” যাতা,যেটা দিয়ে পান পেষা হয়। তুই তোর চুমুপ্রেমীর সাথে বিদায় নেওয়ার সময় আমার কাছ থেকে একটা যাতা নিয়ে যাস।””
সন্ধ্যার ক্ষ্যাপা উত্তর,,
“” আমি যাতা দিয়ে কি করবো?””
“” সবাই যা করে তাই করবি,পিষবি,তবে পান নয়,তুই নিজেই ওটার ভেতর ঢুকে বসে থাকবি,আর সায়ন তোকে পিষবে।””
রাতের কথাতে সন্ধ্যা হতবাক। অবাক দৃষ্টি ছুড়তেই রাত বলে উঠলো,,
“” রেডি হয়ে আয়। শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই ভালো।””
রাত সন্ধ্যার কক্ষ ত্যাগ করার সাথে সাথে পেছন থেকে টাস করে একটা শব্দ এলো। শুধু রাগে ফাটতেই পারবি। বলতে পারবিনা। আমিও দেখবো কত ফাটতে পারিস। হুহ!
~~
দরজায় ধরাম ধরাম শব্দে সন্ধ্যা দুকান চেপে ধরে আছে। পারলে সে নিজের কানদুটোকে মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে। তাও সে এই খটখট শব্দ শুনতে চায়না। আল্লাহ্ যে কেন তাকে বধির বানালোনা। সন্ধ্যা আফসোসের নিশ্বাস ছাড়তে গিয়েই কানে এলো সায়নের কন্ঠ।
“” সন্ধ্যা দরজাটা খোল, প্লিজ!””
সন্ধ্যা ভেবেছিলো রাত তার দরজায় খটখট করছে। কিন্তু সায়নের কন্ঠ পেয়ে মনটা নেচে উঠেছে,খুশির ক্ষীণ আলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। পুরোটা নিতে হলে এখন তার সায়নকে প্রয়োজন। সন্ধ্যা কান ছেড়ে অনেকটা লাফিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। সময় নষ্ট না করে সায়নকে রুমের ভেতর টেনে এনে দরজায় খিল দিয়েছে।
“” সন্ধ্যা,বাড়িভর্তি মানুষ। আমার আম্মু-আব্বুও আছে। তুমি কি আমাকে নতুন কোনো লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছো?””
“”মানে কি? আপনি কি সত্যি সত্যি আমাকে বিয়ে করতে এসেছেন?””
“” বিয়ে আবার মিথ্যে মিথ্যে হয় নাকি? তবে তুমি ভুল কথা বলেছো। আমরা আজ বিয়ে করছিনা। আজ তো আংটিবদল হবে। কাল বিয়ে।””
সন্ধ্যা সায়নের দিকে গভীরদৃষ্টে চেয়ে আছে। সায়নের বক্তব্যে তার এখন কেমন রিয়েক্ট করা উচিত সেটাই ভাবছে। কিন্তু ভাবার এতো সময় কই? চট করে বলে উঠলো,,
“” আপনি দেখি আমার প্ল্যানে নিজে চেপে বসতে চাইছেন,সমস্যা কি আপনার??””
“” আমার তো কোনো সমস্যা নেই। তোমার সম্মতিতেই তো সব হচ্ছে।””
সন্ধ্যা এবার ধৈর্য্যের বাধ ছেড়ে কিছুটা জোর কন্ঠেই বললো,,
“” আমার সম্মতি মানে? আমি কখন আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছি?? এমন পাগলের প্রলেপ লেপছেন কেন?””
সায়ন সন্ধ্যার মুখের কাছে ঝুকে এসে মিহিসুরে বললো,,
“” পাগল সেতো অনেক আগেই হয়েছিলাম। প্রকাশ করতে পারলাম কই? রাতের জন্য আমার অব্যক্ত কথাটা মনের কোঠরেই রয়ে গিয়েছিলো।””
সন্ধ্যা সায়নের থেকে কিছুটা পিছিয়ে এসেছে। ছন্নছাড়া কন্ঠস্বর,,,
“” এসব আপনি কি বলছেন?””
সায়ন বেশ ভাবুক বিনয়ী নিয়ে বললো,,
“”ছোটবেলা থেকে রাতের সহিত আমার সাথেও তোমার বেশ ভাব ছিলো। দুরে থাকায় তোমার সাথে আমার সময়ের সম্পর্ক খুব অল্পই ছিলো। হাঁসিখেলার বন্ধুত্ব এগিয়ে যেতে থাকলেও রাতের মতো আমারও তোমার প্রতি এক আলাদা আকর্ষণ তৈরী হয়েছিলো। তখন রাত আর আমার বন্ধুত্ব সোনায়সোহাগা। তুমি আর আমি দুজনেই ওর দুকুল। রাত যেমন মনের সব খবরাখবর আমার কাছে এসে উগলাতো,তেমন আমিও। আর তখনি করে ফেলি ভুল। অবুঝ মনের তোমার প্রতি আমার অন্যরকম অনুভূতির কথা ওকে বলতে শুরু করি। অনুভূতিটার মানে আমি বুঝে উঠতে পারেনি কিন্তু রাত? ও ঠিক বুঝে নিয়েছিলো। অথচ দেখ,আমার দুজন কিন্তু একই বয়সে হেলেদুলে বেড়াচ্ছিলাম। তবুও যেটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি সেটা ও বুঝে ফেলে। আর সেখান থেকেই ওর সন্দেহ শুরু। তোমাকে আমার সাথে দেখলেই মুখকালো,মুখে কথা নেই,চোখ পাকিয়ে তাকানো। এক সময় আমার সাথে কথাবলা বন্ধ করা শুরু করে দিয়েছে। আমাকে আর আগের মতো নিজের সাথে বাসায় আনতে চায়না। আমি চলে এলেও নানা জিজ্ঞাসাবাদ। তারমধ্যেই এক ভুলবশত ঘটনা নিয়ে ও আমার উপর আক্রমণ চালিয়েছিলো। খুব বেশিই মেরেছিলো ও আমায়। কি দিয়ে মেরেছিলো জানো?””
সন্ধ্যার দিকে প্রশ্ন শুরু করে দিয়েই সায়ন নিজের শার্টের গলার কাছের দুটো বোতাম খুলে বুকের একপাশটা খুলে বললো,,
“” কাঁটাচামচ দিয়ে। দেখো এখনো কেমন দাগ কেটে আছে।””
সন্ধ্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সায়নের দিকে তাকালো। বুকের কাছটাতে চিকন তীরদাগের মতো কালচে দাগ। এমন নিষ্ঠুরতা উপভোগ করতে পারছেনা সন্ধ্যা। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে শক্ত করে চেপে আছে উপর পাতা দিয়ে নিচের পাতায়।
“” আমার এখন ওর উপর কোনো রাগ নেই,সেই ছোটবেলাতেই মিটে গিয়েছিলো। মিটবেনা কেন? আত্মার বন্ধু যদি নিজেই হসপিটালে নিয়ে নিজেই সরি সরি বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছিলো। এরপর থেকেই তোমার সাথে আমার দেখা সাক্ষাত বন্ধ। রাত মানা করেনি,আমি নিজেই বন্ধ করেছিলাম। কারণ তখন আমি এতটুকু বুঝেছিলাম ও তোমার উপর খুব বেশিই কর্তৃত্ব বিরাজ করতে শুরু করে দিয়েছে।””
“” আপনি এগুলো এখন কেন বলছেন?””
সায়ন শার্টের বোতামটা লাগাতে লাগাতে বললো,,
“” সেদিন তোমার জন্মদিনে আমি ইচ্ছে করে আসিনি। রাতের জোরাজুরিতে আসা। এত বছর পর তোমাকে দেখার পর সেই পুরনো অনুভতিটা হঠাৎ করেই আমাকে চেপে ধরেছে। রাত যেটা অবুঝকালে ধরতে পেরেছিলো সেটা আমি আজ বুঝতে পেরেছি। এমনি এমনি জেগে উঠেনি,তুমি যদি সেদিন আমায় বন্দীঘরে আটকে না রাখতে তাহলে হয়তো এমন উতলা হতাম না। সন্ধ্যা তোমার বুঝা উচিত ছিলো আমি রাত নয়,তাহলে কেন বাচ্চামী করলে? তুমি যখন বন্ধঘরে আমাকে শাসাচ্ছিলে,চোখ তুলে ধমকাচ্ছিলে,শেষে অনুরোধের হাত তুললে ঠিক তখন আমি তোমার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করো আমার ভেতরটা তখন তুমুলঝড়ে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছিলো। ভুল কিছু করার আহ্বান জানাচ্ছিলো,আমার শরীরে বয়ে যাওয়া শীতলের মাঝে জেগে উঠা গরম রক্ত! আর সেই ভুল থেকে বাঁচার জন্যই জোর করে বেড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি দিলে কই? রাত আর তুমি মিলে আমাকে আবার বন্দী করলে,কিছু পাওয়ার আশায়। জানিনা পাবো নাকি,কিন্তু যদি পেয়ে যায়? সেই উদ্দেশ্যেই এখন তোমার বাড়ি এসে হাজির হয়েছি। মনে রেখো,আমার দিক থেকে আমি পুরো রেডি,তোমাদের হ্যা’তে আমি হ্যা,আবার নাতেও না। কিন্তু ভুলবশতও যদি তোমার নামের পাশে আমার নাম বসে যায় তাহলে আমি ভুলে যাবো রাত আমার বন্ধু!””
সায়ন একদমে সবটা বলে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকাতেই শরীর ঝলসে যাওয়া উপক্রম। সন্ধ্যার মায়াবন্দী চোখদুটো এখন অগ্নিচক্ষুতে রুপান্তর হয়েছে। যে অগ্নির শিখা ঝড়ে পড়তে চাইছে। সায়নের বুকে হাশপাশ শুরু হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে সে পুড়ে যাওয়ার সময়টুকুও পাবেনা তারআগেই ঝরঝরা ছাই হয়ে বদ্ধরুমে উড়ে বেড়াবে। সায়ন শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় তড়িঘড়িতে বন্ধ দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো।
~~
“” রাত ভাইয়া! তুমি রান্নাঘরে কি করছো?””
সন্ধ্যার ডাকে রাত মিস্টি হাঁসি নিয়ে মধুরসুরে বললো,,
“” তোর বিয়ের মিস্টি সাজাচ্ছি। দেখ দেখ কত্ত মিস্টি এনেছি। আমাদের এখানের আলিবাবার দোকান থেকে আনা। একটু খেয়ে দেখবি?””
রাতের মিস্টিবুলি সন্ধ্যার কাছে তেতো হয়ে কান দিয়ে ফুড়ছে। গার্লফ্রেন্ডের বিয়েতে বয়ফ্রেন্ড মিস্টির ডালা সাজাচ্ছে। আহা! এই দৃশ্য দেখার আগে আমার চোখ চিলে কেন নিলোনা?? আচ্ছা চিলে কি আসলেই চোখ নিয়ে যায়?? আমি কি এখন চিলের অপেক্ষা করবো?? সন্ধ্যা নিজের ভাবনার ডালা গুড়িয়ে দিয়ে রাতের কাজকর্ম দেখছে। দুজনের সামনে বাহারী মিস্টি। গুড়ি সাইজ থেকে শুরু করে বুড়ি সাইজও আছে,কত শেইপ,কত রঙ মাখা আবার একটার মধ্যে আরেকটা ঢুকিয়ে কি আঁকাবাঁকা ডিজাইন। রাত একের পর এক মিস্টির প্যাকেট খুলছে আর নিজের রুচি দিয়ে সাজাচ্ছে,ঠোঁটে কি অমায়িক হাঁসি,চোখে কি মনোযোগ। যেন সে আজ মিস্টি সাজানোর কম্পিটিশনে নেমেছে। আজ ফার্স্ট প্রাইজটা সেই নিবে।
রাত মিস্টির শেষ প্যাকেটটা খুলতে যাবে অমনি সন্ধ্যা ওটা কেড়ে নিয়ে বললো,,
“” এতো মিস্টি কে খাবে?””
রাত সন্ধ্যার প্রশ্ন এড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাবে,তখনি সন্ধ্যা পথ আটকে দাড়ালো।
“” পথ আটকালি কেন?””
“” বিয়ে করবোনা।””
“” কেন?””
“” আরো পড়াশুনা করবো।””
“” বিয়ের পর করিস। সায়নের এ ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।””
“” তুমি আমাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছো,আমি কিন্তু তোমার নামে কেস করবো।””
“” কেন,আমি কি বাল্য বিয়ে দিচ্ছি?””
“” তা নয় তো কি? আমি তো এখনো বাচ্চা!””
রাত সন্ধ্যার হাত ধরে ওকে টেনে ড্রয়িংরুমের দিকে এগুচ্ছে। সোজা সায়নের পাশে বসিয়ে দিয়ে কানে কানে বললো,,
“” যে মেয়ে অন্য ছেলের কাছ থেকে চুমু পেয়ে লজ্জায় মরে যায় সে কখনোই বাচ্চা হতে পারেনা। এখান থেকে নড়চড় করলে কিন্তু আজ আংটির সাথে তোকেও বদল করে দিবো!””
সন্ধ্যা রাতের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলো। সায়ন পাশ থেকে বললো,,
“” আমি তোমাকে কোথায় চুমু খেয়েছিলাম?””
সন্ধ্যা সায়নের দিকে পুনরায় অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে দিতেই ও কিছুটা পাশে সরে গেলো। রাত সন্ধ্যার আম্মু রিমার উদ্দেশ্যে বললো,,,,
“” আম্মুকে দেখছিনা যে ফুপি!””
সায়নের আম্মু-আব্বুর পাশের সোফাটাতেই বসে ছিলেন রিমা আর সিকান্দার সাহেব। দুজনেই খোশগল্পে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ রাতের কন্ঠ পেয়ে রিমা বললেন,,
“” একটু আগেতো এখানেই ছিলো। মনে হয় রুমে আছে। দাড়া আমি ডেকে আনছি।””
রিমার দিকে হাতের ইশারায় বসতে বলে নিজেই আম্মুর রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে রাত। কিছুদুর এগিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাঁসি দিয়ে দ্রুত পা বাড়ালো।
কয়েক মিনিট পেরুতেই রাতের চিৎকারে সকলেই স্তব্ধ! একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে উঠে দাড়িয়েছে। রাতের আর্তনাদে সকলে অস্থির পা চালায় তিয়ামতীর রুমের দিকে।
সন্ধ্যা রুমে ঢুকে সরাসরি রাতের উদ্দেশ্যে বললো,,
“” রাত ভাইয়া! কি হয়েছে?””
সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তরে রাত সায়নকে বললো,,
“” আম্মুকে এখনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।””
~~
চল্লিশের কৌঠায় পা দেওয়া এক লাবন্যময়ী মহিলা ডক্টরের চেম্বারে বসে আছে রাত। মহিলাটি বেশ কিছুক্ষণ কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করলেন। রাত নিবিড় অপেক্ষায় আছে তার কন্ঠস্বরের। ডঃ সীমা চোখের চশমাটা খুলে রাতের দিকে তাকালেন। সামনে থাকা সকল কাগজপত্র পাশে রেখে মিহিসুরে বললেন,,
“” তিয়ামতী আমার খুব পছন্দের একজন পেশেন্ট, সাথে আমার প্রথম পেশেন্টও। আমি ওকে নিজের ছোট বোনের মতো এতদিন ট্রিটম্যান্ট করে এসেছি। কিন্তু একটায় আফসোস,ও কখনোই নিজের প্রতি খেয়ালি হলোনা। তোমার ব্যাপারে এতো সেনসেটিভ অথচ নিজের উপর!””
“” আম্মুর কি হয়েছে?””
ডঃসীমা স্বল্পশব্দে বললেন,,
“” আমি আমার সর্বস্বটা দিয়ে চেষ্টা করেছি ওর ভেতরের রোগটাকে ভেতরেই রাখতে। কিন্তু ও চায়নি সেজন্যই আজ এ অবস্থা।””
রাত ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,,
“” কি হয়েছে আম্মুর?””
“” এখনো কিছু হয়নি,তবে হতে বেশি সময় লাগবেনা৷ এভাবে যদি ট্রিটমেন্টের বাইরে চলে যায় তাহলে আমার হাতে করার মতো কিছু থাকবেনা। এমনও হতে পারে খুব শীঘ্রই আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবে।””
ডঃসীমার কথায় রাত হতাহত। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। ডঃ সীমা রাতের অবস্থা বুঝতে পেরে ওর কাছে এসে দাড়ালেন। কাধে আশ্বাসের হাত রেখে বললেন,,
“” তোমার আম্মু যদি না চায় সুস্থ থাকতে তাহলে আমরা কি করে তাকে সুস্থ রাখবো??””
~~
তিয়ামতীকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়েছে রাত। শারীরিক দুর্বলতার কারণে তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছিলো। সন্ধ্যা তিয়ামতীর পাশে বসতেই রাত বললো,,
“”সন্ধ্যা রুমে যা। আমার আম্মুর সাথে কথা আছে।””
“” আমার সামনে বললে কি সমস্যা?””
“” সন্ধ্যা প্লিজ!””
রাতের অনুনয়কে ফেলতে পারেনি সন্ধ্যা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুম ত্যাগ করেছে। তিয়ামতীর গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে দিলো রাত।
“”মুখটাকে এমন বানিয়ে রেখেছিস কেন,বাবা? এমন পাংশুটে চেহারায় তোকে একদম মানায়না।””
তিয়ামতীর ভালোবাসামাখা কথার বুলি গায়ে মাখেনি রাত। চক্ষু দর্শনেই পুরোরুমে চলছে অনুসন্ধান। এক পর্যায়ে পুরোরুমে ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
“” কিরে,কিছু বলছিস না কেন? এদিকে আয়,মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেই।””
এবারও রাত তিয়ামতীর ভালোবাসার ডাককে এড়িয়ে গেলো। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গিয়েছে এমন ভঙ্গিতেই তিয়ামতীর মাথার কাছে এসে দাড়িয়েছে। কোনো ইঙ্গিত ছাড়াই খাটের নিচে ঢুকে গেলো।
তিয়ামতী শোয়া থেকে উঠে অস্থির গলায় বললো,,
“” আরে কি করছিস,তুই? তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেলো?””
মিনিট পাঁচেক বাদেই রাত খাটের নিচ থেকে বের হলো। মায়ের দিকে শক্ত চাহনি নিয়ে বললো,,
“” আমি আজকেই সিজাত আংকেলের সাথে কথা বলছি। যত দ্রুত সম্ভব আমরা ইউকের ফ্লাইট ধরবো।””
রাতের মুখে আচমকা ইউকের নামটা শুনে সন্ধ্যার পিল চমকে উঠেছে। ক্ষীণস্বরে বললো,,
“” হঠাৎ?””
রাত সাথে সাথে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে বললো,,
“” তুমি তো তাই চাচ্ছিলে আম্মু!””
রাতের হাতে জড়ো হওয়া খোলা ট্যাবলেটগুলো দেখে তিয়ামতী অসহায়সুরে বললো,,
“” আমার ঔষধ খেতে ভালো লাগেনা তাই ফেলে দিয়েছি।””
রাত কথার পিঠে কিছু বললোনা। নিজের ফোনটা বের করে রিদের বন্ধু সিজাতের নাম্বার ডায়েল করে কানে ধরে আছে। অপরপাশ থেকে রিসিভ হলে রাত আংকেল বলে সম্বোধন করতেই তিয়ামতী ফোনটা টেনে নিয়ে ফেলে দিলো। কিছুটা জোর গলায় বললো,,
“” আমি কোথাও যাবোনা।””
“” তোমাকে যেতে হবে।””
“” তুই আমার সাথে তর্ক করছিস?””
“” হ্যা করছি। দরকার হলে জোরও খাটাবো। যে লোকটা বেঁচে আছে নাকি মরে গিয়েছে সেটা আজও জানতে পারলাম না তারজন্য আমি আমার মাকে হারাতে পারবোনা। আমরা ওখানে যাবো। আর ওখানেই তোমার ট্রিটমেন্ট হবে। আমি তোমার একটা কথাও শুনবোনা,আম্মু!””
তিয়ামতী কঠিন গলায় বললো,,
“” আমি আমার বাসা ছেড়ে কোথাও যাবোনা। কোথায়ও না।””
রাত নিজেকে স্বাভাবিক করে তিয়ামতীর পাশে বসলো।
“” আম্মু,এভাবে জানা অজানার মধ্যে থেকে তুমি নিজের ক্ষতি করছো। আমি সেটা হতে দিতে পারিনা।””
“” দরকার নেই। আমি এভাবেই থাকবো। আমি কোথাও যাবোনা। কোথাও না।””
রাত আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছেনা। রাগে চেচিয়ে উঠে বললো,,
“” তাহলে আমাকে কেন এনেছিলে পৃথিবীতে?? তোমার সবটা যদি তার নামেই থাকে তাহলে তোমাদের মাঝে আমাকে কেন আনলে?? অনাথের খাতায় আমার নাম লিখাতে?””
তিয়ামতী ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো রাতের বা গালে।
~~
রাতের আকাশে তারার মেলা বসলেও রাতের মন তখন বিষাদের মেলায় ভরপুর। কান্না করতে ইচ্ছে করছে তার চিৎকার করে কান্না!
“” রাত ভাইয়া!””
পেছন থেকে সন্ধ্যার কন্ঠ পেয়ে রাত একদম ভেঙে পড়েছে। পেছনে ঘুরেই সন্ধ্যাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ফুপিয়ে উঠলো। রাতের চোখের নোনা পানি সন্ধ্যার কাধের শেষাংশে গিয়ে পড়ছে। যা গড়িয়ে যাচ্ছে ওর পিঠ বেয়ে। সন্ধ্যা চোখটা বন্ধ করে আবার ডেকে উঠলো,,
“” রাত ভাইয়া!””
সন্ধ্যার ডাকে সাড়া না দিয়ে ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে রাত।
সন্ধ্যা কন্ঠ টেনে বললো,,
“” আমি সায়ন ভাইয়াকে বিয়ে করবো। আর সেটা কালকেই!””
চলবে
#ভালোবাসার_রাত
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৬)
পেছন থেকে সন্ধ্যার কন্ঠ পেয়ে রাত একদম ভেঙে পড়েছে। পেছনে ঘুরেই সন্ধ্যাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ফুপিয়ে উঠলো। রাতের চোখের নোনা পানি সন্ধ্যার কাধের শেষাংশে গিয়ে পড়ছে। যা গড়িয়ে যাচ্ছে ওর পিঠ বেয়ে। সন্ধ্যা চোখটা বন্ধ করে আবার ডেকে উঠলো,,
“” রাত ভাইয়া!””
সন্ধ্যার ডাকে সাড়া না দিয়ে ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে রাত।
সন্ধ্যা কন্ঠ টেনে বললো,,
“” আমি সায়ন ভাইয়াকে বিয়ে করবো। আর সেটা কালকেই!””
রাত শ্বাসরুদ্ধ চুপ। নিজের কেঁপে উঠা ফুপানিটাও থমকে রেখেছে। সন্ধ্যার পিঠে লেগে থাকা হাতের বাধনটা আলগা করছে ধীরগতিতে। সেভাবেই কিছু সেকেন্ড নিজের মধ্যে চলা সব গতিপরিধি নিশ্চল,নিস্তম্ভ,স্তম্ভিত করে রেখেছে। রাতের এমন অসার হয়ে যাওয়াটা যেন বুঝতে পেরেছে সন্ধ্যা। গলার মধ্যে কাটা বিধে থাকার যন্ত্রণা হচ্ছে তার৷ চোখের কোনে পানি চিকচিক করতে চাইছে। কিন্তু সে দিলে তো। নাকদিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাসে বুকটা ভেতর-বাহির উঠানামা করিয়ে দৃঢ়কন্ঠে বললো,,
“” বিয়েটা আমি কালকেই করতে চাই। সায়ন ভাইয়ার সাথে তুমি কথা বলবে নাকি আমি?””
রাত আর সন্ধ্যার স্পর্শে ডুবে থাকতে পারছেনা। চোখের পানিটা এতক্ষণে নিজের বাধে আটকে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণে কি এসেছে? নাকি সন্ধ্যার চোখে চোখ পড়লেই আবার তুমুলযুদ্ধে বাধ ভেঙে ফেলবে?? ভাঙলে ভাঙবে তবুও সে এখন সন্ধ্যার চোখে চোখ রাখবে। মেয়েটা চাইছে কি??
সন্ধ্যার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে রাত। চোখে নোনা তরলে টলমল,এখনো বাধটা ভাঙেনি,পুর্ণ চাঁদের স্নিগ্ধ জোসনা পুরোটাই পড়ছে সন্ধ্যার মুখে। রাতের অটলদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সামর্থ্য করে উঠতে পারছেনা সন্ধ্যা। নিজের চঞ্চলদৃষ্টি স্থির করতে বড্ডবেশি বাধ্যবাধকতায় ভুগছে।
“” আমার দিকে তাকা!””
রাতের ভারীকন্ঠস্বর সন্ধ্যার কানে নয়,বুকে শীতল ঝড় বয়িয়ে দিয়েছে। মানুষটাকে সে ছোট্টবেলা থেকে দেখে এসেছে,কখনো এমন করুণরুপী নয়। সবসময় হাঁসিমুখি,নাহয় চরম ছটফটানি। ছটফটানিটা তো তারজন্যই ছিলো। মাঝে মাঝে অভিমানির কৃশ ফিনফিনে ছায়াও সে চোখে ঠাউর করতে পেরেছিলো তবে সেটা নামমাত্রই। রাত কখনোই তা সন্ধ্যাকে বুঝতে দেয়নি। সেই মানুষটা আজ তার বুকে ঢলে পড়তে চাচ্ছে,চাপাকষ্টের নোনাপানি তার স্পর্শে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে অথচ সে?? সে কিনা নোনাপানির তিক্ততাকে প্রকট করে তুলেছে??
সন্ধ্যা এদিকওদিকে বিক্ষিপ্ত চাহনি নিয়ে বললো,,
“”আমি ছেলেমানুষি করছিনা রাত ভাইয়া। আঠারোবছরের যুবতী হয়ে কাকে বিয়ে করবো সে অধিকারটুকু আমার আছে। তোমারও তো তাই ইচ্ছে ছিলো। এখন আমারও সেই ইচ্ছে।””
সন্ধ্যা রাতের দিকে তাকালে ঠিক বুঝতো রাতের চোখে নোনাপানির বদলে অনল ঝড়ে পড়ছে। তবে সেই অনলের তেজটা খুবই ক্ষীণ। এই অনল তো তার তেজ পুরোটা রাতের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছে। রাত সন্ধ্যার মুখবিবর চেপে ধরেছে। সাথে সাথে সন্ধ্যা নিজের চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো। ডান হাত-বাহাত দু হাতেই পড়নের জামাটা খামচে আছে। রাত ওর বন্ধচোখের দিকে তাকিয়ে বললো,,
“” রুমে যা।””
“” তুমি যাবেনা?””
সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেনা রাত। কথা পেট ছেড়ে গলা বেয়ে আসছেনা। কন্ঠনালীটা কি তার অকেজো হয়ে পড়েছে?? হলেই তো ভালো। আজকাল খুব বেশিই বেড়ে উঠেছে তার কন্ঠনালী। নাহলে মায়ের সাথে সে কিভাবে চড়াগলায় চিৎকার করে উঠেছিলো?? যে ছেলে মায়ের সাথে এমন রূঢ়ভাবে কথা বলতে পারে তার কন্ঠনালী তাৎক্ষনিকভাবে ছিড়ে হাজার টুকরো হয়ে যাওয়া উচিত। তারটা কি এমনই হয়েছে?? নাহলে সে করে নিবে। কিন্তু কিভাবে??
“” আমার রুমে যেতে ভয় লাগছে। আমাকে একটু দিয়ে আসোনা!””
“” আসতে ভয় নেই যেতে ভয়??””
নিজের কন্ঠে নিজেই চম্কিত রাত। গলার স্বরটা এতোটা পাল্টে গিয়েছে কিভাবে??
“” রাত ভাইয়া,আমার ঘুম পাচ্ছে।””
“” তোকে ঘুমাতে মানা করেছে কে? যা গিয়ে শুয়ে পড়।””
“” বললাম যে ভয় লাগছে।””
“” তাহলে এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঘুমা!””
এমন শক্তকথা তো রাত তার সন্ধ্যাকে বলেনা। তাহলে কি এবার বুকটা খুব বেশি ক্ষত হয়ে গিয়েছে?? রেগে গিয়ে বলেছে নাকি অভিমানে??
বেশ কয়েক মিনিট পেরিয়ে গিয়েছে। রাত উল্টোঘুরে পিনপতন নিরবতায় মিশে যাচ্ছে,মাঝরাতের মৃদু বাতাসের ঝাপটা পড়ছে পুরো শরীরে। কেমন এক ঠান্ডা অনুভূতি। চাঁদের আলোয় রজনীর অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়ে সাদাকালোর হাঁট বসিয়েছে। সে হাঁটে কি সে একাই ক্রেতা? তাহলে বিক্রেতা কে? নাকি সে নিজেই ক্রেতা ও বিক্রেতার দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু কেনাবেচা হচ্ছে কি? চাঁদের আলো,নাকি সাদাকালো কষ্ট!
বাতাসের মৃদু বাতাসটা এখন অনেকটাই মচমচে হয়ে উঠেছে। ছাদের পাশেই আমগাছের পাতাগুলোর মড়মড়ে শব্দে রাতের কেনাবেচা বন্ধ। সন্ধ্যা কি চলে গিয়েছে?? রাত পাশ ফিরেই ফিক করে হেঁসে উঠে,,
“” পাগলিটা দেখি সত্যি সত্যি দাড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।””
রাত আর সময় নষ্ট করলোনা। কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিলো। সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে। ছাদে তার যাতায়াত খুব কম। খোলা আকাশের সৌন্দর্য সে নিজের বারান্দা থেকেই উপভোগ করে। কিন্তু যখন মনে হয় বারান্দার স্বল্প আয়তায় বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারছেনা তখনি ছাদে আসা হয়। সবার অগোচরে। তবে সে না চাইতেও তার পিছু পিছু সন্ধ্যার আগমন ঘটবেই। এই একটা কাজে রাত আজো অনভিজ্ঞ। এতকিছু সন্ধ্যার অগোচরে ঘটিয়ে আসছে অথচ ছাদযাত্রাটা সে কিছুতেই পারেনা।
রাত সন্ধ্যার ঘুমশ্রী মুখটার দিকে চেয়ে নিচুস্বরে বললো,,
“” এবার অন্যবারের মতো আমাকে বিরক্ত করতে আসিসনি। তাহলে কেন এসেছিলি? হৃদয়ক্ষরণ করতে??””
সন্ধ্যাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়েছে রাত। ফ্যানের সুইচটা অন করে,ড্রিমলাইটটাও জ্বালিয়ে দিয়েছে। রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলেও মনটা সায় দিচ্ছেনা। আঁখিটা চাইছে সন্ধ্যার ঘুমশ্রী আরেকটুখানি আঁখিবরণ করতে। রাত চরণ ফেলে সন্ধ্যার কাছে এগিয়ে এসেছে। মেঝেতে হাটু ভর করে বসলো। আজ এতো পিপাসা পাচ্ছে কেন রে স্বপ্নবধু?? নিজের ডানহাতটা সন্ধ্যার ললাটস্থলে স্পর্শ করতেই ও নড়ে উঠেছে। রাতের হাতটা টেনে নিচ্ছে সন্ধ্যা। গালস্পর্শে মেখে নিয়ে আবার গভীরঘুমের নিশ্বাস ছাড়ছে। রাতের ভিজে উঠা চোখটাকে স্বাভাবিকে আনতে চোখটা বন্ধ করে নিয়েছে,সাথে সাথে কল্পনার কচুবাক্য,
“” আমি সায়ন ভাইয়াকে বিয়ে করবো। আর সেটা কালকেই।””
রাত চট করে চোখের পাতার ঝাপটা খুলে ফেললো। কোনো ভাবনান্তরে না ঢুকে নিজের হাতটা হেচকা টানে সরিয়ে নিয়েছে। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পুর্বেই পা বাকিয়ে হাঁটা ধরলো।
~~
কথায় কথায় ভালোবাসি শব্দটা যেমন গতিতে ঝড়ের মতো পাহাড়ের চূড়ে উঠে, ঠিক তেমনি আবার মাটিতেও চলে আসে। উঠার কাজটা চলে পুর্ণ বয়সে আর নামার কাজটা চলে ঠিক তেমন গতিতেই পুর্ণতার ভার মানে বুড়ো বয়সে। এই বয়সটাই ভালোবাসি,চুমু দেওয়া,শরীরের স্পর্শ,বিভিন্ন অবাস্তব কথাতে প্রেম জাগেনা। অভ্যাসে জাগে। এই যেমন এখন রিমা সিকান্দার সাহেবের চোখের চশমাটা খুলে দিয়ে শরীরে চাদরটা ঠিকভাবে মেলে দিবে,তারপর নিজেও বালিশের ছোট্ট জায়গা দখলে মাথাটা রাখবে। এটা তার রোজ রাতের অভ্যাস। এখানেই তার প্রেম জাগে। একদিনও যদি সে এটা মিস করে তবে মনে হয় তার রাতের ঘুম হারাম। অথচ কাঁচা বয়সে স্বামীর জলদি ঘুমের জন্য কত রাতই না ঝগড়া করে পার করেছে! আর এখন? এখন সে চশমা খুলে দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে।
রিমা সিকান্দার সাহেবের চশমায় স্পর্শ করতেই উনি নড়ে উঠলেন। বন্ধ চোখটাও খুলে গিয়েছে। তবে এতে রিমার দোষ নেই। দরজায় কড়া পড়ার দোষ। রিমা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনটা বেজে পঁচিশ। ঘড়ি ছেড়ে সিকান্দার সাহেবের দিকে তাকালেন। দুজনেই চোখাচোখিতে ইশারায় ভাবছেন,এতো রাতে কে??
“” রাত,তোমার কি মাথায় সমস্যা হয়েছে? আই মিন মাথায় কোনো আঘাত পেয়েছিলে?””
সিকান্দার সাহেবের কথায় রাতের কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। মুখের ভাবে বুঝা যাচ্ছে,সে জানতো এমনি হবে। এতে বেশ নিরাশ হলেন সিকান্দার সাহেব। পাশ থেকে রিমা এসে রাতকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। স্নেহের হাতস্পর্শে বললেন,,,
“” তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন,বাবা? কিছু হলে আমাদের খুলে বল। জানিসনা,সন্ধ্যার মতো তোর কষ্টেও আমার বুক পুড়ে?””
রাতের স্থির দৃষ্টি মেঝেতে। নতজানু অবস্থায় নিচু স্বরে বললো,,
“” ফুপা,সবসময় তো আমার ইচ্ছেতেই সন্ধ্যার পথচলা,এবার নাহয়…””
সিকান্দার সাহেব হুংকার করে উঠলেন,,,
“” তাই বলে নিজের বিয়ে নিজেই ঠিক করে ফেলবে? বেশি বেড়ে গিয়েছে মেয়েটা। গালে দুটো সটাং সটাং পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে। আর সেটা তোমার হাত থেকে হলেই বেশি মানাত। দাড়াও ওর মাথা থেকে বাড়াবাড়ির ভুতটা এখনি নামিয়ে আসছি।””
সিকান্দার সাহেব রাতের কোনো ইশারা তোয়াক্কা না করেই হাঁটা ধরলেন। দরজার ধারে পৌছুতেই রাতের অনুরোধের সুর,,,
“” ফুপা প্লিজ! একটু শান্ত হোন।””
সিকান্দার সাহেব থামলেন,তবে ক্ষান্ত হলেননা। বুকে চলছে তখনো রাগের খুলকি। রাত বিছানা ছেড়ে ফুপার কাছে এসে বললো,,
“” সায়ন বর্তমানে সরকারীর দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মকর্তা। বেতন বেশ ভালো। প্রথম শ্রেণীতে যাওয়ার তোরজোর চলছে। হয়তো খুব শিঘ্রই চলেও যাবে। দেখতে শুনতেও বেশ ভালো। সেটা তোমরাও জানো। আর সবথেকে বড় কথা সায়ন সন্ধ্যাকে খুব পছন্দ করে আর সন্ধ্যা…””
“” তোকে ভালোবাসে।””
সিকান্দার সাহের রাতকে সবসময় তুমি সম্বোধন করলেও অতিরিক্ত রেগে গেলে তুইতে চলে যান। এটা রাতের জানা। তাই সে খুব ভালো করেই উনার রাগের গভীরতা মেপে নিয়েছে। নিজের কথাটা ওভাবে ছিনিয়ে নেওয়াতে রাগের খারাপ লাগেনি কিন্তু শেষাংশ ছিলো খুবই ক্ষতপুর্ণ। রাতও চোখের পলকের মতো উত্তর দিলো,,
“” ও আমাকে কখনোই বলেনি। তোমাদেরকেও বলেনি। তোমরা আমার দিকটা ভেবেই এমন ভেবে নিয়েছো।””
“” সায়নকে ভালোবাসে এটা নিশ্চয় বলেছে?””
সিকান্দার সাহেবের তাচ্ছিল্য প্রশ্নে রাত নিরব।
“” কি হলো বলেনি?””
“” বিয়ে করবে বলেছে।””
“” বাহ! খুব ভালো। ও বললো আর তুই বিয়ে দিবি বলে প্রতিজ্ঞাও করে ফেললি। আমাদেরকেও মানাতে চলে এসেছিস। অথচ কিছুদিন আগেও তুই ওর ছেলেমানুষিতে বিরক্ত হতি। তাহলে আজ কেন এতো সিরিয়াস দেখাচ্ছিস?””
“” কারণ এবার ওর চাওয়াতে কিছু ছিলো ফুপা। এটা ওর হুটহাট ভাবনা থেকে আসেনি। আমি ওর মুখ দেখেই বুঝেছি ও এই ব্যাপারে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে তবেই এই সিদ্ধান্তে এসেছে। ফুপা এটা ওর বাচ্চামী নয়!””
“” রাত আমি এই বিয়েতে সম্মতি দিবোনা।””
“” কেন দিবেনা?””
“” তুমি কি আমার কাছে কৈফত চাচ্ছো?””
“” না,ফুপা। অপরাধ নিচ্ছেন কেন? আমি কারণটা জানতে চাচ্ছি!””
“” আমি দিতে বাধ্য নই।””
ফুপার এমন কঠিন আচরণে বেশ অবাক হচ্ছে রাত। এই মানুষটার সরলতা সবসময় রাতকে ভাবিয়েছিলো। কিন্তু আজ এমন কঠিনরুপ বড্ড বেমানান ঠেকছে তার কাছে। রিমা সিকান্দার সাহেবের দিকে কিছু বলবে ভেবে এগুতেই উনি বলে উঠলেন,,
“” আমার মেয়ে,আমার ইচ্ছে। এখানে অন্যকারো হস্তক্ষেপ আমি মেনে নিবোনা।””
রাত চুপচাপ বেরিয়ে আসতে গিয়েও আবার থমকে গেলো। কিছুটা জোর নিয়েই বললো,,
“” আপনার মেয়ে বলেই আপনার কাছে অনুমোতি চেয়েছিলাম। বিয়ে তো হবেই। হোক সেটা বাড়ি অথবা কাজী অফিসে! আমিও দেখি কে আটকাতে আসে।””
রাত দ্রুতপদে চলে যেতেই রিমা শব্দ করে হেঁসে উঠলো। এতে সিকান্দার সাহেব বেশ বিরক্ত নিয়েই বললেন,
“” সেদিনের জন্ম নেওয়া পুচকি ছেলে আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি শাসিয়ে গেলো আর তুমি হাঁসছো?””
সিকান্দার সাহেব যেন দারুন একটা জোকস বললেন এমন ভাবসাবেই রিমা হাঁসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা।
“” সমস্যা কি তোমার?””
“” আমার ভাইয়ের সামনে গেলে তো তোমার হাঁটু কাঁপতো। আর তার ছেলের সামনে তোমার অদৃশ্য কাপুনি দেখেইতো হাঁসি পেল।””
“” আমি কাঁপলাম?””
“” এখনো তো কাঁপছো। এইযে নাকটা কেমন নড়েচড়ে উঠছে দেখ। বিশ্বাস নাহলে তুমি আয়নায় গিয়ে দেখতে পারো।””
সিকান্দার সাহেব সত্যি সত্যি আয়নার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে নাক খুটিয়ে দেখছে। রিমা আরেকদফা হেঁসে নিয়ে বললো,,
“”রাতের সাথে ভাব দেখাতে যেয়োনা। ওর কাজে তো বাধা দিতে পারবেনা শুধু শুধু উচু নাকটা নিচু হবে।””
“” সন্ধ্যাকে অন্য ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিবে আর আমি চুপ করে বসে থাকবো?””
রিমা রহস্যময়ী হাঁসি দিয়ে বললো,,
“” ভুলে যেওনা, রিদ ভাইয়ার ছেলে ও। দেখবে সন্ধ্যা চোখবুঝবে একজনকে দেখে,আর চোখ খুলে দেখবে আরেকজনকে!””
~~
দাদুর বালিশের নিচ থেকে নিঃশব্দে আলমারীর চাবিটা নিয়েছে রাত। আলমারীর ভেতরের ড্রয়ারটা খুলতেই চোখটা ঝলমলিয়ে উঠেছে। ড্রয়ারভর্তি এলোমেলো টাকা জমা পড়ে আছে,১ টাকার কয়েন থেকে শুরু করে হাজার টাকার নোটও আছে এতে। ড্রয়ারটা খুলে নিয়ে মেঝেতে বসে পড়েছে রাত। দাদুর দিকে তাকালো,লাইট জ্বালাবে ভেবেও ইচ্ছা বাদ। নিজের ফোনের লাইটটা জ্বালিয়ে নিয়েছে। বেশ আরাম করে বসে এলোমেলো টাকাগুলোকে সাজিয়ে নিচ্ছে পরপর। অন্যের টাকা নয় এগুলো,রাতের টাকা!হ্যা রাতের টাকা। দাদুর কাছে সে জমিয়েছিলো।
ছোটবেলা একবার এক বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলো রাতের পুরো ফ্যামিলি। বরাবরের মতো সন্ধ্যা রাতের হাতধরেই বিয়ের সাজ উপভোগ করছিলো,হঠাৎ সন্ধ্যা বলে উঠলো,,
“” রাত ভাইয়া,ঐ সাপ কাপড়টা আমারও চাই।””
রাত বিস্ময় নিয়ে বললো,,,
“” সাপ কাপড় কি?”
সন্ধ্যাও রাতের বিস্ময় কাটাতে বিয়ের কনের দিকে আঙুল ইশারায় বললো,,
“” ঐ যে ঐ আন্টিটাকে লাল সাপের মতো পেচিয়ে রেখেছে যে, ঐ কাপড়টা!””
রাত একগাল হেঁসে বলেছিলো,,
“” এটাকে বেনারশী বলে।””
“” যা খুশি তাই বলুক। সাপের মতো পেচিয়ে থাকে বলে সাপ কাপড়। তুমি এখন আমাকে কিনে দিবে নাকি বলো।””
“” আমার কাছে তো এখন টাকা নেই। বাড়ি যাই তারপর আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে দিবো।””
রাতের মন খারাপকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে সন্ধ্যা ঠোঁট উল্টিয়ে কান্না করে দিলো। অভিমানভর্তি মুখে বললো,,,
“” আমি চাইলে তোমার কাছে থাকেনা। লাগবে না আমার কিছু। থাকিনা তোমার সাথে,যাও।””
সন্ধ্যার রাগ ভাঙাতে আম্মুকে নিয়ে শাড়ী কিনেওছিলো রাত। কিন্তু সন্ধ্যা অভিমান দেখিয়ে সেটা আর নেয়নি। সেদিনের পর থেকে রাত সবসময় পকেটভর্তি টাকা রেখেছে কিন্তু কখনো প্রয়োজন পড়েনি।
রাত টাকাগুলো চোখের সামনে ধরে মনে মনে বললো,বিয়ে যেভাবেই হোক। তোকে তোর সাপ কাপড়ে পেচিয়েই কনে সাজাবো!
~~
রাতকে থাপ্পড় মারার পর থেকে তিয়ামতী এক অস্থিরতায় ভুগছে,সাথে চাপা কষ্টে বুক ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে। চোখে অন্ধকার নেমে আসার মতো। রাত শেষ হতে চললো অথচ অস্থিরতা কাটিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে পারছেনা সে। এ কেমন যন্ত্রণা?
তিয়ামতী বুকের হাসফাস কমাতে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নিলো। চোখে ঘুমের আধার নেমে আসতেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যেতেই তীক্ষ্ণ ভুরররররর ভুররররর শব্দ কানে বাজছে। এমন তীব্র সব্দে তিয়ামতী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। শব্দানুসারে পা চালিয়ে রান্নাঘরে এগুচ্ছে। অন্ধকারে কারো ছায়া দেখে তার চমকানো উচিত,কিন্তু সে ভয়ে চিৎকার না করে স্বাভাবিক গলায় বললো,,
“” লিদ ভাইয়া?””
তিয়ামতীর ডাকে রিদ ব্লেন্ডারের শব্দ বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকনা খুলে একটা গ্লাস নিয়ে তাতে তরল কিছু ঢাললো। তিয়ামতী কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললো,,
“” তুমি কি করছো?””
রিদের ব্যস্ত গলার উত্তর,,
“”সরবত বানাচ্ছি।””
“” সরবত?””
“” হুম,তোর ফেলে দেওয়া ঔষধের সরবত!””
চলবে