#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৩৯
#সুলতানা_সিমা
মিটিং শেষ করে দিহান আর শাওন এসে গাড়িতে উঠল। এখন দুপুর দুইটা বাজে। ১০টায় মিটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ১০টায় মিটিং শুরু হয়নি। দিহান ড্রাইভিং সিটে বসেছে। শাওন মনে মনে খুশি হলো। ড্রাইভ করতে তাঁর মোটেও ভালো লাগেনা। কারণ ড্রাইভ করলে সে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে পারেনা। হেডফোন দিয়ে গান শুনলে, চোখ বন্ধ না করলে তাঁর ভালো লাগেনা। শাওন তাঁর মতোই গান শুনা শুরু করলো। গান শুনে শুনে সাথে সাথে গান গাইতে লাগলো।
just give me another change
Baby I’m close to you
Life for me is not the same
Girl i really need you tonight
Tell me the way you feel
Baby come close to me
Wish i can stay in your heart
Baby can you feel it
Believe me
Tell me what i can do
Baby can you feel it
Believe me
Tell me what’s going wrong
Now i down the road oh baby all alone
want you just by my side
Baby you come closer to me
I be feeling all right
Girl i can make you feel
Baby come close to me
Wish i can stay in your heart
Now I’m broken inside here [বাকিটা মনে নাই]
এইটুকু গেয়ে চোখ ভিজে এলো শাওনের। গত ছয় মাস থেকে সে মরার মতো বেঁচে আছে, যা তাঁর খুব কাছের মানুষও জানেনা। বুকের ভেতর চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে দিহানকে বললো।” দিহান আমরা আর এখানে কতদিন আছি রে?” দিহানের কোনো রেন্সপন্স নাই। শাওন দিহানের দিকে তাকিয়ে দেখলো দিহান মিটিমিটি হাসছে। শাওন কপাল কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে বলল” কিরে? মনে রং লেগেছে নাকি?” দিহান কিছু বললো না। শাওন বললো “দেখ ভাই ক্ষিধায় পেট চোঁ চোঁ করছে দয়া করে তাড়াতাড়ি রেস্তোরাঁয় চল। তোর হাসি দেখে আমার পেট ভরবে না।” দিহান গাড়ি থামালো। এখনো তাঁর ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে। শাওন আবার বললো “গাড়ি থামালি কেন ?” দিহান এবারও কিছু বললো না, গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। শাওন আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে। হটাৎ করে দিহানের হলোটা কী? দিহান একটু পরে আসলো। হাতে চকলেট, আইসক্রিম,চিপস,ললিপপ আরো অনেক কিছু নিয়ে এসেছে। দিহান গাড়িতে উঠে বসতেই শাওন বললো ” ওই আমাকে কোন দিক থেকে তোর কাছে মেয়ে বলে মনে হচ্ছে? এগুলা আমি খাবো? বাচ্চারা খায় এগুলা। ত্রিশে এসে এগুলা খেলে মানুষ আমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে।” দিহান আগের মতোই মুচকি হাসতেছে। যেন তাঁর মনে খুশির রং লেগেছে। হাতের প্যাকেটটা পিছনের সিটে রেখে ড্রাইভ করতে লাগলো। শাওন একেরপর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে দিহান কিছু বলছেনা, শুধু ফোনের মধ্যে থাকাচ্ছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। শাওন উঁকি দিয়ে দেখতে চাইলো, দিহান ফোন সাইডে রেখে দিলো। রাগে শাওন সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো। দিহান তাঁর গন্তব্যে পৌঁছে গিয়ে গাড়ি থামালো। শাওন খুব তেজ নিয়ে উঠে গাড়ি থেকে নামলো। নেমেই সে থম মেরে গেলো। দিহান রেস্তোরাঁয় আসেনি অন্যকোথাও এসেছে। দিহান তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এসে বললো”
_চল।
_কোথায়?
_ওই পিচ্চিটার নানু এই এড্রেস দিলো না?
_কীইইইইইইইই? তুই এই পিচ্চি মেয়ের বাড়িতে এসেছিস? আজ এড্রেস দিলো আর তুই আজই চলে আসলি?
_তুই না গেলে এখানে দাঁড়িয়ে থাক, আমি যাচ্ছি।
_দেখ দিহান আমার খুব ক্ষিধে লাগছে, আমি ভাত খাবো চল।” দিহান কিছু না বলে চলে গেলো। শাওন পিছু পিছু দৌঁড়ে এসে বলে ” আরে ভাই এটা তো ভাব, হতে পারে এই মেয়েটা এখনো স্কুল থেকে আসেনি, আমরা রাতে আসবনে আবার প্লিজ ভাই চল।” শাওনের কথা কানে নিলোনা দিহান। কলিং বেল দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কেউ এসে দরজা খুলে দিলোনা। দিহান আবার কলিং দিল এখনো কেউ খুলছে না। শাওন বলল “কেউ বাসায় নাই চল আমরা চলে যাই।” দিহান শুনলো না। আরও কয়েকবার কলিং দিলো। শাওন বার বার বলছে চল চলে যাই। যখনি দিহান শাওনের কথা শুনে চলে যেতে লাগলো, তখনই এসে দরজা খুলে দিলো অরিনের মামা। শাওনের ইচ্ছে হলো উনাকে পঁচা পানিতে চোবাতে। এতোক্ষণে দিহানকে ফিরে যেতে রাজি করলো, এখন উনি এসে দরজা খুলে দিলেন। রাগটা দমিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।
_আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?[দিহান]
_হুম। তোমরা,,,ঠিক ছিনলাম না।
উনি কথাটা শেষ করতে না করতেই, শাওন বলে উঠল”
_ওহ আমরা মনে হয় ভুল বাসায় চলে এসেছি, সরি আংকেল। দিহান চল।” দিহান পা দিয়ে শাওনের পায়ে গুঁতা দিলো। শাওন লাফিয়ে উঠল। অরিনের মামা জিজ্ঞাসুক চোখে তাকালেন। শাওন জোরপূর্বক হাসি দিলো। দিহান বলল”
_ওই যে আংকেল, সকালে আমাদের এড্রেস দিয়ে আসলেন। ” উনার মনে পড়তেই উনি বললেন” ও আচ্ছা আসো ভিতরে আসো। আমি ছাঁদে ছিলাম তাই লেট হলো। আসো।” ভিতরে গিয়ে সোফায় বসে দিহান চারদিকে তাকালো। ড্রয়িংরুমটা অনেক বড়সড়। দামি দামি ফার্নিচার দিয়ে সাজানো। খুব ভালো লাগলো দিহানের কাছে। যে ঘরটা গুছায়, তাঁর হাতে যাদু আছে। দিহান অজনিকে না দেখে বলল” আংকেল পিচ্চি কই?” সার্ভেন্ট চা দিয়ে গেলো। একটা ছোট পিরিচে মাত্র দুইবার বিস্কুট। উনি হাতের ইশারায় চা নিতে বললেন। দিহান চা নিলো, শাওন নিলোনা। দিহান চা খেতে খেতে দশবার জিজ্ঞেস করছে পিচ্চি কই। উনি কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পরে উপরে গিয়ে অজনিকে নিয়ে আসলেন তিনি। অজনিকে দেখে দিহানের বুকের আগুনটা নিভে গেলো। এতো ক্ষণ ধরে তাঁর বুক জ্বলে যাচ্ছিলো। এতো টান কেন এই বাচ্চাটার প্রতি সে বুঝতে পারেনা। দিহান অজনির দিকে হাত বাড়ালো, অজনি তাঁর নানুর দিকে তাকালো, উনি সম্মতি দিলেন। অজনি দিহানের কোলে এসে উঠল।
সবকিছু উলট পালট করে দেওয়ার পরে প্রবল ঘুর্ণিঝড় থেমে গেলে যেমন মানুষের মনে শান্তি আসে। ঠিক তেমনিই দিহানের মনে শান্তি ফিরে এসেছে। এতক্ষণ তাঁর মনে বয়ে চলা ঝড় মূহুর্তেই থেমে গেছে। মনের অনেক গভীরে সুখের স্পর্শ লাগলো। দিহান অজনির গালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ইচ্ছে করছে এই বাচ্চা মেয়েটাকে তাঁর কলিজায় ভরে রাখতে। কোমল গলায় বলল”
_নাম কী তোমার?
_অজনি।
_শুধুই অজনি?
_দিহা মালিয়াত অজনি।
_আচ্ছা তুমি জানো আমার নাম দিহান। তোমার সাথে আমার নামের কতো মিল দেখছো?” শাওন কিছু একটা ভেবে অজনিকে বলল”
_আচ্ছা তোমার আম্মুর নাম কী?
_সেটা জেনে আপনি কী করবেন?” ধারালো গলায় বললো অজনি। এইটুকু মেয়ের এমন কথায় টাসকি খায় দুজনই। শাওন বলল”
_এমনি জানতে চাইলাম আরকি। তুমিও আমার কাছে জানতে চাও আমার আম্মুর নাম কী।
_আমার জানার কোনো প্রয়োজন নাই তো আমি জানবো কেন?
_না মানে তোমার নানু ভাই তোমার আম্মুকে কী বলে ডাকে?
_মা বলে ডাকে।
_অন্য সবাই কী বলে ডাকে?
_চুপ করতো এতো প্রশ্ন করছিস কেন?” ধমকের স্বরে বলল দিহান। শাওন আর কিছু বলল না। দিহান অজনিকে নিজ হাতে আইসক্রিম খাইয়ে দিলো। অজনিকে পেয়ে যেন সে তাঁর জীবনের সব কষ্ট ভুলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে দিহান বললো ”
_অজনি তুমি আমার বন্ধু হবে।” অজনি চট করে দিহানের কোল থেকে নেমে গেলো। দিহান বলল “আমাকে বন্ধু বানাবে না?” অজনি না সূচক মাথা নাড়ালো। দিহান বলল” কেন?”
_আমার মাম্মাম বলেছে মাম্মাম ছাড়া কাউকে বন্ধু না বানাতে।
_কেন?
_মাম্মাম বলেছে বন্ধুরা খুব খারাপ হয়। ওরা ধোঁকা দেয়।” দিহানের বুকটা ধুক করে উঠল। শাওনের কপালে ভাঁজ পরল। ধোঁকা তো অরিন খেয়েছিলো লুপার থেকে। কেন জানি তাঁর মন বলছে এটা অরিন। শাওন দিহানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল” দিহান আমার মনে হচ্ছে এটা অরিনের মেয়ে।” দিহান কিছু বলল না। তাঁকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। অজনিকে আবার কোলে তোলে বলল” ঠিক আছে আমি তোমার বন্ধু হলাম না, তুমি আমার বন্ধু হও। তুমি তো কাউকে ধোঁকা দিবেনা।” অজনি কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বললো” আচ্ছা বন্ধু হবো। আমার সাথে আমার স্কুলে যেতে হবে।
_ওকে ডান। এবার বলোতো তোমার মাম্মামের নাম কী? কী করে সে?
_আমার মাম্মামের নাম ডাঃ,,,,,এইটুকু বলে থেমে গেলো অজনি। উৎসুক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে দিহান ও শাওন। অজনি তাঁর মায়ের নাম বলল না, শয়তানি করে বলল” ডঃ জুহা। আর আমার পাপার নাম ডঃ সুমিত।” নামটা শুনে শাওন দিহানের আশার প্রদীপ নিভে গেলো। ডঃ জুহা আর সুমিতকে কম বেশ সবাই চিনে। সাফল্য চিকিৎসক বলে উনাদের অনেকবার টিভি শো-তে দেখিয়েছে। শাওন জিহানকে ফিসফিসিয়ে বললো “ডঃ সুমিত তো এখনো বেঁচে আছেন, তাহলে অজনির নানু যে বললেন ওঁর বাবা নেই?” দিহানের মনেও এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে আপাতত কিছুই বললো না সে। অজনির নানু বসে বসে তাঁদের দেখছেন। এক কথায় তাঁদের পাহারা দিচ্ছেন।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে আসলো তাঁরা। বাইরে এসে শাওন বললো “এই লোকটা এতো কিপটা কেনো রে? এতোক্ষণ বসলাম খেয়ে যেতেও বললো না। শুধু চা আর বিস্কুট কেউ মেহমানকে খাওয়ায়? আর মাত্র দুইটা বিস্কুট? লাইক সিরিয়াসলি। আর দেখেছিস? যতক্ষণ আমরা বসেছিলাম খাটাসের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। যেন আমরা উনার নাতনিকে নিয়ে পালিয়ে যাবো।” শাওনের কথা বলা শেষ হতেই দেখলো তাঁর পাশে অজনির নানু দাঁড়িয়ে আছেন। উনার বড় বড় চোখ আর ইয়া মোটা গোফে পুরাই ডাকাত লুক হয়ে গেছে। শাওন শুকনো এক ঢোক গিলে তৎক্ষণাৎ বসে পড়লো। উনাকে দ্রুত হাতে সালাম করে বললো ” আংকেল আপনি এতো কষ্ট করে আর এগিয়ে দিতে এসেছেন কেন? আমরা যেতে পারবো।” উনি আগের ন্যায় চেয়ে আছেন। উনার চোখে স্পষ্ট সন্দেহ দেখা যাচ্ছে। দিহান উনাকে বলল” আংকেল কিছু মনে করবেন না। ওঁর মাথায় একটু সমস্যা আছে। কী বলতে কী বলে ফেলে নিজেই বুঝেনা। অনেক গুলা ছ্যাঁকা খেয়েছে তো,তাই ওঁর মাথায় গন্ডগোল ধরে গেছে।” শাওন রাগি লুকে তাকালো। দিহান শাওনকে একটা চোখ টিপ দিয়ে আবার উনাকে বলল” আমি জানি আংকেল আপনি আমাদের বলতে এসেছেন আমরা যেন আরেকদিন আসি। আমরা অবশ্যই আরেকদিন আসবো আংকেল। আরেকদিন না,আমরা প্রতিদিন আসবো। আজ তাহলে আসছি। বাই।” দিহান এসে গাড়িতে উঠল। শাওন অলরেডি গাড়িতে বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে। দিহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কিছুদূর এসে বলল” কী রে কুত্তার মতো মুখ বানিয়ে বসে আছিস কেন?” শাওন অগ্নিচোখে তাকালো। দিহান হাসলো। শাওনের পিঠে চাপড় দিতে দিতে বলল” মন খারাপ করিস না দোস্ত, আজ আমার খুশির দিন। ছোট এঞ্জেল টাকে কোলে নিয়ে যে সুখ পেয়েছি আমার পুরো জীবনের সুখ পাল্লায় নিলেও এ সুখের সমান হবেনা। কাল আবার আসবো ডক্টর জুহার কাছে। উনাকে বলে অজনিকে নিয়ে একদিন ঘুরতে যাবো। অজনি পাশে থাকলে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায় রে। এতো কম সময়ে কারো জন্য এত মায়া লাগেনি আমার,যতটা অজনির জন্য লেগেছে।” দিহানের কথায় শাওনের মন খারাপ উড়ে গেলো। আর যাইহোক দিহানের মলিন মুখে হাসির রেখা ফুটেছে এটাই বা কম কিসে?
___________________________________
নীলের অসয্য লাগছে। ইচ্ছে করছে সময়টা এখানে থামিয়ে দিতে। হোক সময়টা বিষাক্ত, তবু তো সে নিশ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু শামুর সাথে বিয়ে হলে যে তাঁর নিশ্বাস আটকে যাবে। মাকে কষ্ট দিতে পারেনা সে। মায়ের মলিন মুখ দেখলে তাঁর ভেতর পোড়ে যায়। কিন্তু সে যে কিছুতেই মানতে পারছেনা শামুকে। একটু আগে তাঁর মা তাঁকে বলে গেলেন পঁচিশ তারিখ তাঁর বিয়ে। এখন চলছে বারো তারিখ, তারমানে আরো বারো দিন পরেই তাঁর আর শামুর বিয়ে। এখন সে যদি তাঁর মাকে গিয়ে বলে আমি এ বিয়ে করবো না। তাহলে তাঁর মা কাঁদতে কাঁদতে নিজের অবস্থা বেহাল করে দিবেন। কিন্তু যদি শামুর পক্ষ থেকে না আসে তাহলে হয়তো এতোটা কষ্ট পাবেন না। হ্যাঁ এটাই করতে হবে। আপাতত নীলের মাথায় এর থেকে ভালো বুদ্ধি আসছে না।
নীল শামুর রুমে গেলো। শামুকে বলে দেখবে যদি শামু গিয়ে তাঁর মাকে বলে সে বিয়েতে রাজি না,তাহলে বিয়ে আটকে যাবে। আর তাঁর মাও কষ্ট পাবেন না। সে যদি বলে তাঁর মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন। লুপা বলেছে স্ট্রেস না নিতে। লুপার কথা মনে আসতেই লুপার কান্নার দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠল। কলিজা মুচড় দিয়ে উঠল নীলের। একটা মেয়ে তাঁকে এতো বছর ধরে ভালোবেসে আসছে। এতোদিন দূরে থাকার পরেও সে ভুলে যায়নি নীলকে। আর নীল কিনা পাষাণের মতো তাঁর দিকে চোখ তোলেও চায়নি?
নীল শামুর রুমে এসে নক করলো। শামু এসে দরজা খুলে দিলো। হলুদ রংয়ের সেলোয়ার-কামিজ পরেছে সে। ওড়নাটাও সুন্দর করে রাখা। ড্রেসাপটা নীলের ভালো লাগলো। শামু আঙুলে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে লজ্জায় মিটিমিটি হাসছে। দরজা ছেড়ে সাইড দিলো শামু। তাঁর চোখে মুখে লজ্জার আভা ফুটে ওঠেছে। নীল রুমে ঢুকে খাটে গিয়ে বসলো। কথাগুলা কীভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। শামু লজ্জায় লাল হয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নাই চুপচাপ বসে আছে দুজন। একজনের মনে চলছে যন্ত্রণার ঝড়, অন্যজনের মনে চলছে খুশির ঝড়। অনেকক্ষণ নিরবতায় কাটিয়ে কথার সূত্রপাত করলো নীল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল”
_ তোমাকে কিছু বলতে চাই শামু আশা করি বুঝবে তুমি।” শামু লজ্জায় সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালো। নীল বলল” শামু আম্মু চায় আমি তোমাকে বিয়ে করি। শুধু আম্মু না ফুপি তোমার আম্মুও সবাই চায়, কিন্তু,,,,,।”
_আমি জানি তুমি কী বলবে,বলতে হবেনা। আন্টি আমায় সব বলে দিছেন, আমার চলাফেরায় ঘাটতি আছে। পোশাকের দিকটা খেয়াল রাখতে বলেছেন। এগুলা তোমার পছন্দ না। আর তোমার পছন্দ মতো চলতে বলছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে, আর কোরআন পড়া সহীহ্ করতে। সব কিছুতে আমি রাজি আছি। আর আন্টি আজ সকালে আমাকে এই ড্রেস আর [হাত দেখিয়ে] এই বালা আর রিং পড়িয়ে দিছেন।” নীলের কথা পুরোটা না শুনে, তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে,এক দমে কথাগুলা বলে ফেলল শামু। নীল বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। তার মা এতোদূর চলে এসেছে? বালা আংটি সব পড়িয়ে দিছে? শামুকে আর কিছু না বলে দ্রুত পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো নীল। নিজের রুমে গিয়ে টাস করে দরজা লাগালো। ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। মায়েরা নাকি সন্তানের মুখ দেখলে মনের কথা বুঝে যায়। তার মা কী বুঝেনা তাঁর ভেতরটা পোড়ে যাচ্ছে? মাকে কষ্ট দিতে চায়না বলে সে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আর তাঁর মা কিনা নিজ হাতে তাঁর জীবনটা নরকে ঠেলে দিচ্ছেন? মন যাকে চায়না, তাঁর সাথে থাকা কী খুব সহজ? রাগে কষ্টে চোখ ভিজে এলো নীলের। সাহস নেই তাঁর মাকে কষ্ট দেওয়ার, উনার হাসি কেড়ে নেওয়ার। নয়তো এক্ষুনি সবকিছু থামিয়ে দিতো।
#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৪০
#সুলতানা_সিমা
এটা তোমার ভুল হয়েছে অজনি, তুমি কাউকে মিথ্যে বলবা কেন? তাও তোমার বাবার বয়সি কাউকে।” মায়ের ধমকে গাল ফুলিয়ে ফেলল অজনি। মেয়ের গোমড়া মুখ দেখে অরিনের খারাপ লাগলো। অজনিকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিলো। বাসায় আসতে না আসতেই তাঁর মেয়ে থাকে দুপুরের সবকিছু খোলে বলেছে। এটাও বলেছে সে তাঁর মায়ের নাম মিথ্যে বলেছে। অরিন অজনির চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল “যখন তুমি কাউকে মিথ্যে বলবে।আর তোমার মিথ্যেটা একদিন তাঁর কাছে ধরা পড়ে যাবে। তখন তোমার সত্যি কথা গুলাও সে মিথ্যে বলে এড়িয়ে যাবে। তাই কাউকে কখনো মিথ্যে বলতে নাই। বুঝেছো?” অজনি এখনো গাল ফুলিয়ে বসে আছে। অরিন অজনিকে খাটে রেখে কয়েকটা ব্যাগ বের করে আনলো। একটা ব্যাগ থেকে হোয়াইট গাউন বের করলো। একটা ছোট একটা বড়। আরেকটা থেকে ব্লু কালার ও আরেকটা থেকে সিলভার কালার। সব গুলায় একটা ছোট একটা বড়। মা মেয়ে সব সময় মেচিং করে সব কিছু পড়ে। অরিন অজনিকে বলল” নাউ চুজ করো।” অজনি চুপচাপ বসে থাকলো। অরিন বলল” কী হলো? বকা তো দেইনি তোমায়, রেগে আছো কেন?” অজনি এখনো চুপ। অরিন অজনিকে আবার কোলে নিলো। অজনির মাথা কাঁধে রেখে বলল “মন খারাপ করে থাকো কেন তুমি? তোমার মন খারাপ দেখলে আমার খুব কষ্ট হয় জানোনা?” অজনি মাথা তোলে অরিনকে বলল” মাম্মাম আমি তো মজা করেছিলাম।” অরিন মৃদু হাসলো। তাঁর মেয়ে স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে শিখে গেলেও, তাঁর এই পিচ্চি গলায় সব কথা গুলা অন্যরকম লাগে। স্পষ্ট হয়েও যেন স্পষ্ট না। আহ্লাদী মাথা কণ্ঠ। শুনতে অনেক ভালো লাগে । অজনি আবার বললো
_মাম্মাম ওই লোক না অনেএএএএএএক ভালো। আমাকে তোমার মতো করে আদর করে। জানো মাম্মাম, আমার উনাকে উনেএএএএক ভালো লেগেছে।
_ওকে তাহলে তোমার বার্থডেতে উনাকে দাওয়াত করা যায়, কী বলো?
_সত্যিইইইইই।
_হ্যাঁ তিন সত্যি।” অজনি অনেক খুশি হলো খুশিতে অরিনের গালে চুমু খেয়ে বলল” জানো মাম্মাম। ওই লোকটা না অনেক সুন্দর। সব থেকে বেশি সুন্দর।
_আচ্ছা তাই? এর থেকেও কিন্তু একজন সুন্দর মানুষ আছে।” অরিনের চোখে দিহানের চেহারা ভেসে উঠল” তাঁর হাসি,তাঁর কথা বলা,তাঁর দুষ্টুমি, তাঁর সেই ভয়ার্ত চেহারা, তাঁর রাগি লুক সব কিছুই আকৃষ্ট করার মতো। অনেক সুন্দর মানুষ সে।
_না গো মাম্মাম,তুমি দেখনি উনি বেশি সুন্দর। আমার মতো সুন্দর।
_হা হা হা। আচ্ছা তোমার মতো? আচ্ছা দেখা হলে দেখে নিবো কেমন সুন্দর। আসো এবার চুজ করো জামা। অজনি জামা চুজ করতে লাগলো। অরিন তাঁর মেয়ের দিকে তাকিয়ে মেয়ের কান্ড দেখতে লাগলো। অজনি আসলেই অনেক সুন্দর। একদম বাপের মতো সুন্দর হয়েছে। কে বলবে এটা অরিনের বাচ্চা? তাঁর বাবার গভীর চোখ, সেই সরু নাক, সেই গাল,সেই ঠোঁট। এমন কী বাপের গায়ের রংটাও পেয়েছে। দিহানের কথা মনে হতেই বুক ছিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো অরিনের। কতোদিন হয়ে গেলো সে তাঁর ভালোবাসার স্বামীর চোখে চোখ রাখেনা। যেন কত যুগ পেরিয়ে গেলো তাঁর স্বামীকে সে দেখেনা। ভিজে যাওয়া চোখটা খুব সাবধানে মুছে নিলো অরিন।
★
সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট না করেই দিহান গেলো অজনিদের বাসায়। শাওন জানেইনা দিহান যে চলে গেছে, সে এখনো ঘুমেই আছে। দিহান কলিংবেল দিতেই অজনির নানু এসে দরজা খুলে দিলেন। অজনি সোফায় বসে বসে ভিডিও গেইম করছিলো। দিহানকে দেখেই দৌঁড়ে এসে দিহানের কোলে উঠল। দিহান অজনিকে কোলে নিয়ে তাঁর গালে নাকে কপালে অনেক গুলা চুমু এঁকে দিলো। অজনিও কম কিসে সেও দিহানের মতো করে দিহানকে চুমু এঁকে দিলো। দিহান হেসে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরলো। অজনিও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে দিহানের গলায় মুখ লুকালো। কতো সুন্দর একটা দৃশ্য। এ যেন পৃথীবির সব থেকে সুখী বাবা আর সুখী মেয়ের ভালোবাসা। অরিনের মামার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ইচ্ছে করছে মূহুর্তটা ভিডিও করে রাখতে। অজনিকে নিজের মা আর উনার পরে কারও সাথে মিশতে দেখেননি তিনি। এতোটা খুশিতেও বোধহয় দেখেন নি কোনোদিন। দিহানকে বসতে বলে উনি কিচেনে গেলেন।একটা ট্রেতে করে ভেজিটেবল পাস্তা,ক্রিস্পি ফ্রাইড চিকেন,সেন্ডুয়েচ এনে দিহানকে দিলেন। সাথে কফিও আছে। দিহান এসব দেখে শাওনের কালকে বলা কথাটা মনে পড়ে গেল। আসলে উনি ততটা কিপ্টা না যতটা কিপ্টা তাঁরা ভেবেছিলো। আবার হতে পারে এগুলা তাঁদের রেস্টুরেন্ট থেকে এসেছে খাওয়ার মানুষ নেই তাই দিহানকে খেতে দিচ্ছে? মাথায় হাবিজাবি প্রশ্ন উঠতেই দিহান নিজেকে নিজে গালি দিলো। দিহান উনাকে বললো” আংকেল শুধু শুধু কেন কষ্ট করছেন,এসবের কোনো প্রয়োজন ছিলোনা। উনি মৃদু হেসে বললেন” ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমার মেয়ে, মানে অজনির মা নিজ হাতে এগুলা বানিয়েছে। হঠাৎ করে হসপিটাল থেকে একটা কল আসলো, তাই তাড়াহুড়া করে চলে গেলো। এখন আর এগুলা কে খাবে? তুমি যখন এসেছো আমরা সবাই মিলে খাই।” দিহান হাসলো। উনার কথাতে বা চেহারায় আজ কোনো রাগ নেই। দিহান পাস্তা হাতে নিয়ে আগে অজনির মুখে দিলো। অরিনের মামা বললেন” এই যে এতোকিছু বানানো হয়েছে, সব ওঁর জন্য বানানো। কাল ওঁর বার্থডে। তোমাদেরও দাওয়াত রইলো।
_অবশ্যই আসবো। দাওয়াত দিতে হবেনা।
_হা হা হা হা। তোমার সাথের জন আজ আসলো না যে?
_ও এখনো ঘুমে আছে। রাতে একটা প্রজেক্টের কাজে ঘুমাতে পারেনি।
_আরে তুমি শুধু ওকে খাওয়াচ্ছো কেন তুমিও খাও।
_খাবো আংকেল। আগে ওকে খাইয়েই নেই।” দিহান অজনিকে খাইয়ে সে শুধু একটা সেন্ডুয়েচ আর কফি খেলো। কিছুক্ষণ গল্প করে দিহান অজনিকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চাইলো। তাকে বিশ্বাস না হলে সাথে যেন উনিও আসেন সেটাও বললো। অরিনের মামা বললেন ” সমস্যা নেই তুমি একাই যাও। তবে যদি আমার মেয়ে তোমায় অনুমতি দেয় তো।” দিহান একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। ডক্টর জুহা যদি যেতে না দেন? অরিনের মামার থেকে নাম্বার নিয়ে সে ফোন দিলো। প্রথম দুইটা কল দেওয়ার পরে ধরলো না। তিনবারের বেলায় ফোন রিসিভ করে অরিন হ্যালো বলল। ফোনের ওপাশের কণ্ঠস্বর শুনে, দিহানের বুকের ভেতর ধুক করে উঠল। খুব চেনা একটা অনুভূতি তাঁর মনের বন্ধ ঘরে কড়া নাড়লো। আবারও হ্যালো বলে উঠে সে। দিহান নিজেকে সামলে বললো”
_হ্যা হ্যা হ্যালো। মিসেস জুহা।
কণ্ঠটা এসে অরিনের কলিজায় ধাক্কা দিলো। কেন জানি মনে হচ্ছে খুব চেনা কারও সাথে কথা বলছে সে।
_হ্যালো।
_জ জ জ্বি বলুন।
_আব,,,,আমি আপনার মেয়েকে নিয়ে একটু ঘুরতে যেতে চাই। আপনি যদি অনুমতি দিতেন।” অরিন কিছু বলতে গিয়েও তাঁর গলায় আটকে যাচ্ছে। এ কেমন অনুভুতি হচ্ছে তাঁর? দিহান আবারও বললো
_হ্যালো মিসেস জুহা।
_হুম।
_ আপনি হয়তো আমি যে কাল এসেছি তা শুনেছিলেন। আপনার মেয়েকে আমার মেয়ের মতোই দেখছি চিন্তা করবেন না। আমি কিডন্যাপার না।
_ওকে নিয়ে যান। সাথে ওঁর নানুকেও নিবেন। রাখছি।” অরিন ফোন রেখে ফুঁস করে দম ছাড়লো। কেমন জানি দম বন্ধ অনুভূতি হচ্ছিলো তাঁর।
।অজনিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো দিহান। সাথে তাঁর নানুও আছেন। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁয় আসে দিহান। শাওন জানায় আগামী ১৭ তারিখ এস আই গ্রুপ অফ কোম্পানিতে তাঁদের একটা প্রজেক্টের মিটিং। তাই ১৬ তারিখের মধ্যে সব কমপ্লিট করে তাঁদের দেশে ফিরতে হবে।
একটা অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে দিহান। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ দিহানের পিছন থেকে ছোট বাচ্চার গলা আওয়াজ আসলো ” where are you papa! please come to my life!” দিহান পিছন ফিরে তাকাতেই বাচ্চাটা দৌঁড় দিলো। দিহানও পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে, চিৎকার দিয়ে দাঁড়াতে বলছে কিন্তু তাঁর চিৎকার সে নিজেও শুনতে পাচ্ছেনা। কথা মনে হয় গলা দিয়ে বের হচ্ছে না। দিহান খুব দ্রুত দৌঁড়াতে চাচ্ছে, কিন্তু তাঁর পা যেন চলছেই না। হঠাৎ একটা বড় গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে মেয়েটা ছিঁটকে পড়লো রাস্তার পাশে। রক্তাক্ত দেহটা উল্টাতেই ভেসে উঠল অজনির মুখ। দিহান চিৎকার করে বলল “অজনিইইইইইই।”
লাফ দিয়ে উঠল দিহান। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। হার্ট খুব দ্রুত উঠানামা করছে। এ কেমন স্বপ্ন দেখেছে সে? শাওন লাইট অন করলো। দিহান পুরো ঘেমে গেছে। শাওন হন্তদন্ত হয়ে বলল” কী হয়েছে দিহান? বাজে স্বপ্ন দেখেছিস?” দিহান দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। তাঁর মাথা কাজ করছেনা। শাওন দিহানের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। দিহান ঢকঢক করে পানি খেয়ে শুয়ে পড়লো। দিহানের পৃথীবি থমকে আছে। অজনির রক্তাক্ত নিথর দেহটা বার বার চোখে ভেসে উঠছে। ফোন হাতে নিয়ে দিহান বারান্দায় আসলো। রাত তিনটা বাজে, এখন অজনির মাকে কল দেওয়া কী ঠিক হবে? দিহান একটা মেসেজ দিলো ” assalamualaikum! ojni kemon ache?” মেসেজ সেন্ড করে দিহানের মনে হলো এতরাতে মেসেজ দেওয়া বোকামি। আর ফোন দেওয়াটাও ঠিক হবেনা। কিন্তু অজনির খবর না জানলেও তাঁর ঘুম আসবে না। দিহান না পারতে কল দিয়েই দিলো। কয়েকবার কল দেওয়ার পরে কল রিসিভ করলো অরিন। ঘুমঘুম কণ্ঠে হ্যালো বললো। দিহানের মন আবারও চেনা সুখে জেগে উঠল। অরিন ছাড়া কোনো নারীর প্রতি তাঁর মন কখনো আকৃষ্ট হয়নি। এই প্রথম ফোনের ওপাশের নারীর কণ্ঠে সে আকৃষ্ট হলো। না না অরিন ছাড়া কারো প্রতি সে আকৃষ্ট হতে পারেনা। দিহান চট করে মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল”
_অজনি কী ঘুমাচ্ছে?
_জ্বি।
_ভালো আছে?
_জ্বি। আপনি এতোরাতে ফোন দিলেন যে?
_আসলে আমি অজনিকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তাই মনটা ছটফট করছে ওঁর খবর জানতে।
_জ্বি ভালো আছে সে। এখন রাখছি। আর হ্যাঁ কাল আমার অজনির পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। আপনিও আসবেন দাওয়াত রইলো।
_জ্বী অবশ্যই।
_বাই।”
অরিন ফোন রেখে দিলো। দিহান চিন্তিত মনে ভাবতে লাগলো। অজনির পাঁচ বছর পূর্ণ হবে কাল? অরিন পালিয়েছে পাঁচ বছর নয় মাস। এক কথায় ছয় বছর। তাহলে যদি অরিন এখনো তাঁর কাছে থাকতো তাহলে তাঁর বাচ্চাটাও অজনির সমান হতো। ভাবতেই বুক ভারি হয়ে এলো দিহানের। অরিন কই আছে কী করছে কেমন আছে সেটা তাঁর জানা নেই। শুধু জানে প্রতিটা মোনাজাতে সে অরিনকে ফিরে চায়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে দিহান ভাঙ্গা গলায় বললো” কই তুমি অরি? আর কতো শাস্তি দিবে আমায়? মরে যাচ্ছি আমি। প্লিজ ফিরে আসো না। এতই অভিমান করেছো যে এই ছয় বছরে আমাকে তোমার ছায়াটাও দেখাওনি। মনে পড়ে কী অরি? তুমি সেই বৃষ্টি জল টুকু একটা বোতলে করে আলমারিতে খুব যত্ন করে রাখছিলে? জানো অরি,এখনো এই জল আমি যত্ন করে রেখেছি। সব থাকবে অরি শুধু আমি থাকবো না। তুমি ফিরে আসবে অরি, একদিন না একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু ততদিনে তোমার দিহানের মৃত্যু চলে আসবে।” ডুকরে কেঁদে উঠল দিহান। প্রতিরাতেই সে অরিনের জন্য কাঁদে। যা অরিনের জানা নেই। অরিন যদি তাঁর কান্নাটা দেখতো তাহলে হয়তো পাগলের মতো ছুটে আসতো তাঁর কাছে। অরিনের অভাবে পোড়ে যাচ্ছে সে, তবুও সে চায়,অরিন যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক সুস্থ থাকুক । অজনির জন্য দিহানের বুকের ভেতর বার বার মুচড় দিয়ে উঠছে। ওয়াসরুমে গিয়ে অজু পড়ে এসে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়লো। অজনির জন্য আর অরিনের জন্য দোয়া করলো।
সারা রাত চলে গেলো দিহানের চোখের পাতা আর এক হলোনা। শুধু অপেক্ষা করে যাচ্ছে কখন সকাল হবে আর সে গিয়ে অজনিকে দেখবে। অপেক্ষা করতে করতে এক সময় তাঁর অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দিহান শাওন রেডি হয়ে বের হলো। হোয়াইট ব্লেজার,ব্ল্যাক জিন্স পড়েছে দিহান। শাওন অ্যাশ কালার ব্লেজার পড়েছে। দিহান আর শাওন আগে শপে গেলো। অনেকগুলা গিফট কিনলো দিহান। শাওন দিহানকে বলল” দিহান শুধু শুধু এতোগুলা টাকা নষ্ট করার মানে হয়? এসব কী করছিস? যা চোখে পড়ছে তাই কিনে নিচ্ছিস?
_থাম ভাই, আমি তোর মতো ওতো কিপ্টা না। তুই তো বিশ টাকার নোট দশ ভাগ করে দুই টাকা করে দান করিস।
_ওই আমি কবে কাকে দুইটাকা দান করলাম?
_ভুলে গেছিস সেদিন দৌঁড়ে দৌঁড়ে কী দোয়া করছিলি? দিছিস টাকা? একটা ফকিরকে দুইটাকার দশটা নোট?
দুইটা মেয়ে তখন দিহান আর শাওনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, দিহানের কথা শুনে কিঞ্চিৎ শব্দ করে হেসে উঠল তাঁরা। মেয়েগুলা একটু দূর যাওয়ার পরে দিহানকে শাওন এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো। দিহান হেসে হেসে বললো ” আহা লজ্জা লাগে,মেয়েদের সামনে ইজ্জতের ফালুদা হলে?” শাওন রাগে বলল” শালা তোকে তো পরে দেখে নিবো।
দিহান একটা টেডিবিয়ার কিনলো অজনির জন্য। কেনাকাটা শেষে চলে আসলো তাঁরা। অজনিদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে। সব কিছু নিয়ে দরজার সামনে আসলো তাঁরা। কলিংবেল বাজালো শাওন। দিহানের হাতে ইয়া মোটা টেডিবিয়ার আরও কয়েকটা গিফট বক্স। দরজা খুলে দিলেন অরিনের মামা। উনি বললেন” কী ব্যাপার এতো লেট হলো কেন? আসো আসো ভিতরে আসো।” দিহান আর শাওন ভিতরে ঢুকলো। ভিতরে ঢুকে দু কদম এগিয়েই থেমে গেলো দিহান। তাঁর পায়ের শিরা থেকে মাথার শিরা পর্যন্ত শীতল হয়ে গেলো। চোখ দুটো ছলছল হয়ে জ্বলতে লাগলো। হাতের সব কিছু পড়ে গেলো ফ্লোরে। অস্পষ্ট ঠোঁটে বলে উঠল, ”অরি।”
চলবে…..।
চলবে……..।