মেঘভাঙা রৌদ্র পর্ব ৬

#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব- ৬
#লিখা:#Nilufar_Yasmin

রাত প্রায় বারো টা বাজতে চললো- ফোন দেয়া ঠিক হবেনা ভেবেও ফোন দিয়েই ফেলি- যাইহোক আজকে এর একটা শেষ হওয়া চাই, হয় এইদিক নইতো ওইদিক।

ওপাশে রিং হচ্ছে, কিন্তু অয়ন ফোন টা তুলছেনা! খানিকটা মন খারাপ করেই ফোন রেখে দেই। অমনি অয়ন ফোন ব্যাক করে। আর করেই বলে-

– সরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রিংটোন এর শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো; তা হঠাত ফোন দিলে যে!
– কেন দিতে পারিনা?
– তা পারো; কিন্তু কখনো তো নিজে থেকে দাওনা।
– হুম্ম দেই না কিন্তু আজ দরকারে দিয়েছি।
– বলো কি দরকার..
– আপনি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন?
– এই বিষয়ে কোন সন্দেহ আছে?
– আমি শুনতে চাই।
– হ্যাঁ।
– তাহলে আপনি আপনার পরিবার কে আমার পরিবারে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে আসতে বলুন।
– এখন?
– হ্যাঁ, তারা চাইলেই এই বিয়ে হবে৷ দরকারে আমাকে ঘরে তোলার দরকার নেই, রেজিষ্ট্রেশন করে রাখুক, আপনার একটা কাজের ব্যবস্থা হলেই না হয় তুলে নিবেন? তাতে আর কোন সমস্যা হবেনা।
– কিন্তু চাকরী না হওয়া অব্দি, আমিই বা আম্মু আব্বুকে কিভাবে বলবো? জাস্ট বিএসসি টা কমপ্লিট হওয়া অব্দি সময় দাও। আমি ঠিক একটা কাজের ব্যবস্থা করে ফেলবো।
– আচ্ছা, তাহলে আমার কিছু কথা আছে।
– কি?
– আমি আর পাঁচ টা সম্পর্কের মত সম্পর্ক কনটিনিউ করতে চাইনা। সবই হবে বিয়ের পর, আমাদের মাঝে স্বপ্ন থাকবে, তবে তারজন্য অপেক্ষা করতে হবে। যখন তখন মন চাইলেই দেখা করা যাবেনা। ফোন করা যাবে তবে তার ও লিমিট রেখে। পারবেন?
– হু, কি আর করা পারতেই হবে।
– ঠিক আছে, তবে ওই কথায় রইলো।

ফোন কেটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম, অনেকটা হালকা লাগছে। তবে তার সাথে ভয় ও লাগছে, জানিনা সামনে কি অপেক্ষা করছে। আমি কি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম? আচ্ছা সবকিছু কি আম্মুকে বলে দেওয়া ঠিক হবে? না থাক- আর কয়টা দিন বরং যাক তারপর না হয় বলবো।

কথা অনুযায়ী সবকিছু চললেও- মাঝে মাঝেই অয়নের অবুঝ পনা শুরু হয়ে যায়। হুট করে বলবে- ” নীলা তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, কাল তোমার কলেজে আসি প্লিজ?” আমি এটা সেটা বলে হাজার রকম ভাবে তখন ওকে বুঝাই। কখনো বুঝে আবার কখনো গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। কিন্তু এইভাবে কিছুদিন ভাল চললেও অয়নের মধ্যে কোথাও যেন একটা আক্ষেপ কাজ করা শুরু করে। অভিযোগের সুর তুলে কথা বলে- ‘ আমি নাকি সেকেলে মাইন্ডের। ওর ফ্রেন্ডদের প্রেমিকারা কত্তো মর্ডান! সোসাইটি বুঝে। আমি তো হিজাব ছাড়া বাইরে যাইনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সব বুঝতে পারি। এতে ওকে দোষ ও দেওয়া যায়না। কারণ ভালোবাসলে বর্তমানে এসবই স্বাভাবিক বরং আমিই অস্বাভাবিক! মনে মনে ভাবি আর তো মাত্র কয়টা দিন, বিয়ে হয়ে গেলে নিশ্চয়ই ওর সমস্ত অভিযোগ ঘুচে যাবে।

কিন্তু এরপর হঠাত ই আমার মনে হতে লাগলো, এইভাবে ওর সাথে রাতে কিংবা দিনে যখনই হোক গোপনে কথা বলা ঠিক না। কারণ ইসলামের বিধানে এই সম্পর্কে বর্ণিত আছে- ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যখন দুজন নারী-পুরুষ (গায়রে মাহরাম) নির্জনে আলাপ করে, তখন তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাদের মাঝে শয়তান উপস্থিত থাকে (খারাপ কাজের ওয়াসওয়াসা দেয়ার জন্য)।
(তিরমিযি,২১৬৫)। এছাড়া ও কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
যদি তোমরা (আল্লাহকে) ভয় পাও , তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।
(সুরা আহযাব, ৩২)। অর্থাৎ প্রয়োজনে গায়রে মাহরাম পুরুষের সঙ্গে কথা বললেও কর্কশ কন্ঠে কথা বলতে হবে। এটাই ইসলামি শরীয়াতের বিধান। তাই আমাদের অনেক বেশি সতর্ক থাকা উচিত। শরীয়াতের গন্ডির বাইরে গিয়ে কোন কাজ করলে তাতে অনিষ্ট থাকবেই!

কিন্তু অয়নকে এসব বললে ও ভুল বুঝে। ভাবে ওকে আমি বিশ্বাস করিনা। ওকে ভালোবাসিনা। ওর মনের গতি বুঝেই বলি-

– দেখো, এবার মনে হয় আমাদের ফ্যামিলিকে বলে দেওয়ার সময় হয়েছে।
– এখনি! আর কয়টা দিন সময় দাও- প্লিজ।
– কিন্তু কেন! তোমার তো সেমিষ্টার শেষ, এখন চাকরীর চেষ্টা করতে পারবে। তাছাড়া বললেই তো বিয়ে হয়ে গেলোনা। সব ঠিক হতে সময় লাগবে ততদিনে ইনশাআল্লাহ তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– নাহ এত তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়।
– মানে!
– আরেহ বুঝো না কেন? আমার একটা কাজের প্রসেসিং চলছে। আপাতত ওইটা নিয়েই ভাবছি, তাছাড়া তুমি আমিতো হারিয়ে যাচ্ছিনা। কাজ টা আগে হতে দাও- প্লিজ তুমি আমায় না বুঝলে কে বুঝবে বলো! সবকিছুতো তোমার জন্যই।
– হয়েছে আর বুঝাতে হবেনা। যতদিন তুমি না চাইবে আমি আর এই বিষয়ে কথা তুলবো না।
– রাগ করেনা পাগলি, একটু সময় দাও।

আমি মুখে কিছু না বলে ফোন কেটে দেই। কেন জানিনা ওর এমন আচরণে খুব খারাপ লাগে।

এর কয়েকদিন পরের কথা; পড়া শেষ করে ঘুমাতে যাবো অমনি অয়নের ফোন আসে-

– নীলা..
– হুম্মম বলো,
– একটা সুখবর আছে।

আমি ততক্ষণে ভেবে নিয়েছি হয়তো ওর পরিবারে আমার ব্যাপারে বলেছে, আমি খুশিতে বলি, – “কি”?

ও তখন আমাকে চমকে দিয়ে বললো –

– আমার স্কলারশিপ টা হয়ে গেছে। জানো আমার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিলো এটা। বিদেশে গিয়ে ডিগ্রী নিবো। কি যে ভাল্লাগছে তোমাকে বলে বুঝাতে পারবোনা, তুমিও নিশ্চয় খুশি হয়েছো?
– হ্যাঁ খুউ-ব।
– কংগ্রাচুলেশনস করবেনা?
– করবো তো- অনেক অনেক শুভ কামনা।

ওকে বলছি ঠিকই অথচ চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বললাম-

– তুমি চলে গেলে আমার কি হবে অয়ন?
– কি আবার হবে, আর আমি চলে যাচ্ছি কি আজীবনের জন্য? পাগলি কোথাকার। শুনো, আমি ফিরেই তোমার আমার ব্যাপারে আম্মুকে বলবো। তার আগে নিজের ক্যারিয়ার টা একটু গুছিয়ে নিই, সবই তো তোমার জন্য বুঝোনা? তাছাড়া আমাদের তো ফোনে কথা হবে! অস্থির হয়ো না প্লিজ। আচ্ছা, এখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ফোন রাখলাম। পরে কথা হবে।

ও ফোন রেখে দেয় কিন্তু আমি ভাবি অন্য কথা। ইদানীং এমনিতেই ও ব্যস্ততা দেখায়, বিদেশে গিয়ে যদি আরো ব্যস্ত হয়ে যায়। শুনেছি চোখের আড়ালে গিয়ে অনেকেই বদলে যায়, অয়ন ও যদি যায়, এই সম্পর্ককে তখন কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবো! মুখে যতই কঠিন হই না কেন, মনে মনে তো জানি ও আমার কতটা জুড়ে!

কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি আমার ধারণা কে সত্যি করে অয়ন ঠিক তাই হলো, যেমনটা ভেবেছিলাম। চলে যাওয়ার পর শুরুতে কয়েকদিন আমাকে ফোন দেয়। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে কমে গেলো। সপ্তাহে ছুটির দিনে খুব বেশি হলে ৪/৫ মিনিট কথা বলে। তাও খুব সাধারণ কথা। আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কিংবা আমাদের স্বপ্ন কিছুই যেন ওর মাথাতে নেই! একদিন খানিকটা রাগ করেই বলে ফেললাম –

– একটা সত্যি কথা বলবে?
– মিথ্যে বলতে যাবো কেন! বলো কি বলতে চাও।
– তুমি আর আমাকে ভালোবাসো না তাইনা?
– এমন উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসে কেন! বেকার বসে থাকলে এসবই মাথায় আসবে। শুনো এসব উল্টাপাল্টা ভাবনা বাদ দিয়ে লেখাপড়ায় মন দাও। নিজেকে সবকিছুতে জড়িয়ে রাখো।
– তাতে যদি তোমাকে ভুলে যাই তুমি খুশি হবে?
– শুনো? সারাদিন পর অনেক কষ্টে তোমাকে এই সময়টুকু বের করে ফোন দেই। কোথায় একটু ভালভাবে কথা বলবে তা নয়, আজাইরা প্যাঁচাল পাড়ো। মেয়েরা এসব ভাল পারে। তুমিও দেখি ওদের মত হয়ে যাচ্ছো! শুনো, তোমাকে আজ কয়েকটা কথা বলি- তুমি আসলে যেমন; তেমন মেয়েকে আর যাইহোক ভালোবাসা যায়না। বলতো কি দিয়েছো আমাকে? না একটু ঠিকমত কথা বলা যায়, না দেখা করা যায়! আজকাল মানুষ কতভাবে দেখা করে, তোমাকে বললে তোমার হাজার ট এক্সকিউজ। রাগ করোনা, আমার মনে হয় কি জানো? আমরা কেউ কারর উপযুক্ত নই, এটা ভালভাবে ভাবলেই বুঝবে। আশা করি এর বেশি তোমাকে বলে বোঝাতে হবেনা।

ওর কথা শুনে কি বলবো বুঝতে পারিনা। অনেক কিছুই বলার ছিলো সেসব যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে! শুধু কোনরকমে নিজেকে সামলিয়ে বললাম-

-সরি আমি বুঝিনিগো-ভুল হয়ে গেছে। আর এমন হবেনা। ভাল থেকো কেমন? রাখছি।

বলেই ফোনটা কেটে দেই। ভেবেছিলাম আম্মুকে আমাদের ব্যাপারটা বলবো, তবে তার আর দরকার পড়বেনা।

নিজেকে অনেকভাবে বুঝালাম, অনেক হয়েছে আর নয়। সবকিছুর আগে নিজের সম্মান। ওইটুকু চলে গেলে আর কিছুই থাকেনা! যে চায়না থাকতে তাকে জোর করে রাখার যুক্তি দেখিনা। তারচেয়ে বরং ও যেভাবে ভাল থাকে থাকুক। হয়তো এটা আল্লাহ স্বীকৃত ছিলো না কিংবা ভাগ্যে ছিল না বলেই ওকে হারালাম। আর এভাবেই নিজের মাঝের অভিযোগ টুকুকে মুক্তি দিলাম। এতে অয়ন ও হয়তো হাফ ছেড়ে বাঁচলো- কারণ এরপর আর ও কোনপ্রকারের যোগাযোগ করেনি। ব্যাস! একটা শুরু হওয়া গল্প পরিণত পাওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেলো!

কিন্তু অয়নকে হারানোর পর দুনিয়ার সবার উপর থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গেল, তাই মামা বা আত্মীয়স্বজনের নিয়ে আসা যেকোন বিয়ের প্রপোজালকে সরাসরি রিজেক্ট করে দিতে থাকি।

দেখতে দেখতে প্রায় তিন বছর কেটে যায়, এবং বিয়ের ব্যাপারে আমার এমন আচরণে আম্মু সহ সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। বিয়ে উপযুক্ত মেয়ে বিয়ের ব্যাপারে অনিহা দেখায় এটা চিন্তার ই কথা…!

এরপর ই মুলত আবিরের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ টা যায় এবং সবদিক ভেবে সিদ্ধান্তে আসি আর যাইহোক এবার আম্মুকে আমার স্বস্তি দেওয়া উচিত। একজনের জন্য তো সারাজীবন আমি আমার পরিবারকে কষ্ট দিতে পারিনা। সে অধিকার ও আমার নেই। কারণ এই কথা সত্যি যে, আমার জীবনে এই মানুষ গুলোর অবদান হাজার টা অয়ন দিয়েও পূরণ হবেনা।

সুতরাং পরেরদিন সকালে আমি নিজে গিয়ে আম্মুকে আমার মতামত জানিয়ে দেই- “বলে দেই- এই বিয়েতে আমার আপত্তি নেই।” শুনে আম্মু মামা দু’জনেই খুশি হয়, এবং তারপর ই ছেলে পক্ষের সাথে দেখাদেখির পর্ব শেষে মহা ধুমধামে বিয়েটা হয়ে যায়। ব্যাস! চলে আসলাম এই বাড়ির একমাত্র বউ হয়ে! আর আসার পর ই বড় চমক টা পেলাম। কি অয়ন এই বাড়ির ই ছেলে! এরচেয়ে বড় আশ্চর্য আর কি হতে পারে!

মেয়েগুলো এখনো গল্পগুজবে ব্যস্ত। আমি জড় বস্তুর ন্যায় বসে আছি। এমন সময় আরিবা এসে বললো- ‘ভাবি, আম্মু খাওয়ার জন্য ডাকছে। আমাকে নিয়ে যেতে বললো, তার আগে একটু ফ্রেশ হয়ে নিবে চলো।’

বলেই ও ওর রুমে নিয়ে গেলো, আমি ওয়াসরুমে গিয়ে অনেক্ক্ষণ চোখেমুখে পানি ছিটালাম। কেন জানিনা চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। শ্বশুর বাড়ির লোকজন দেখলে না জানি কি ভাবে! এরপর ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে আরিবার সাথে খাবার রুমে ঢুকতেই চমকে গেলাম- দেখলাম খাবার টেবিলে আবির বসে আছে!

#চলবে…

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here