শ্রাবণ রাতের বর্ষণ পর্ব ১

‘শ্রাবণ রাতের বর্ষণ❤’- ০১ এবং (সূচনা পর্ব)
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
___________________

তৃতীয়বারের মতো বিয়ের আসরে বসে আছে রুদ্র। চোখে-মুখে বিরক্তি তার। দুই বৌ রেখে আবারও আরেকটা বিয়ে করার মোটেও ইচ্ছে ছিল না তার। একমাত্র নিজের মায়ের কারনেই বাধ্য হয়েছে সে। কোনোমতে বিয়ের কার্যক্রম শেষ করেই রুদ্র বেড়িয়ে যান বিয়ের উৎসব মূখর পরিবেশ থেকে। রাজপ্রাসাদের মূখ্য দরজার কাছে এসেই নিজ মন্ত্রীকে কঠর আদেশ দেন যেন সবাই এ মুহুর্তেই নিজেদের ঘোড়া, শিকার করার অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়। সম্রাট রুদ্রদীপ শিকার করতে চান দূরবর্তী জঙ্গল থেকে চিত্রাহরিণ। তবে মন্ত্রী আপত্যি প্রকাশ করেন। রুদ্রদীপের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে সম্মান জানান তাকে। নিচু কণ্ঠে বলে উঠেন,

— “বেয়াদবি নিবেন না সম্রাট রুদ্রদীপ। আপনার কিছু মুহুর্ত হয়েছে বিবাহের, এখনই কিভাবে শিকার করতে__!”

চোখে অসীম রাগ নিয়ে মন্ত্রীর পানে তাকালেন রুদ্র। মন্ত্রী নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভয়ে চুপসে যান। ক্ষমা চান তৎক্ষণাৎ। রুদ্র কঠর কণ্ঠে বলে উঠেন,

— “আইন্দা এমন ভুল করার স্পর্ধা করবেন না মন্ত্রী। তা নাহলে আপনার গর্দান উড়িয়ে দিতে সময় লাগবে না আমার।”

মন্ত্রী ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে দাঁড়ালো। সম্রাট রুদ্র তার রাজকীয় ভাব নিয়ে শিকারের পোশাক পরিধান করে নিলেন। প্রায় সাথে সাথেই নিজ ঘোড়ায় চড়ে বসলেন উনি। তার সাথে সাথে অন্যান্য সৈনিকরাও ঘোড়ায় বসে পড়ল। এবং সম্রাট রুদ্রদীপের অনুগমন করতে লাগলো জঙ্গলের পথের দিকে।

_____________________

রাজা সম্রান্তের অগ্রে(সামনে) মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভা। রাজা সম্রান্তের দিকে একবার চেয়ে আবারও মাথা নিচু করে ফেললেন চন্দ্রা। অসীম সাহস নিয়ে বহুক্ষণের প্রতিক্ষার অবসন ঘটিয়ে বলেই ফেললেন,

— “পিতা, আমি শিকারে যেতে চাই আপনাদের সাথে।”

— “কিন্তু তোমার এখনও বয়স হয় নি চন্দ্রা মা।”

চন্দ্রপ্রভা বুক ফুলিয়ে বলে উঠলেন,

— “আপনি ভুল বলছেন পিতা। আমার ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। আমি শিকার করার জন্য এখন পরিপূর্ণ। এবং আমি দেখিয়ে দেবো আমি শিকার করতে পারি এবং আমার যথাযথ বয়সও হয়েছে।”

রাজা সম্রান্ত হেসে উঠলেন। নিজের সিংহাসন থেকে উঠে চন্দ্রপ্রভার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন উনি। চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,

— “তাহলে দেখাও তোমার যোগ্যতা! তৈরি হয়ে নাও। তুমিও যাচ্ছো আমাদের সাথে শিকারে।”

চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল চন্দ্রার। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল শিকারের পোশাক পরিধান করতে। তা দেখে রাজা সম্রান্ত আবারও হাসলেন। তবে রাণী রূপা বিরক্ত হলেন। রাজা সম্রান্তের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন,

— “চন্দ্রাকে শিকারে পাঠানো কি এখন উচিত?”

রাজা সম্রান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

— “উচিত-অনুচিত ভাববার সময় নেই এখন রূপা। মেয়েটাকে একজন উপযুক্ত রাণী হওয়া শেখাতে হবে। কেননা আমার পর চন্দ্রাই হবে এখানকার রাণী।”

______________________

ইতোমধ্যে সবাই জঙ্গলের নিকটে পৌঁছে গেছে। সকল ঘোড়া দাঁড় করিয়ে রাজা সম্রান্ত রাজকুমারী চন্দ্রাকে বলে উঠেন,

— “তুমি তৈরি তো? আগে গিয়ে তোমাকেই বাকি শিকার করতে হবে। আমরা এখানেই অপেক্ষা করব তোমার৷ এবং তোমার সাথে শিকার করতে যাবেন আমার তিনজন বিশ্বস্ত সৈনিক।”

চন্দ্রপ্রভা আপত্যি জানিয়ে বললেন,

— “পিতা, আমি একাই যেতে পারবো। ওদের সঙ্গ প্রয়োজন নেই আমার।”

রাজা সম্রান্ত কঠর দৃষ্টিতে তাকালেন এবার। চন্দ্রা মাথা নিচু করে বলে উঠলেন,

— “ক্ষমা করবেন পিতা। আমি আপনার কথায় সম্মত।”

রাজা সম্রান্ত নিজের রাগ দমালেন তৎক্ষণাৎ। তিনজন সৈনিককে পাঠালেন রাজকুমারীর সঙ্গে শিকার করতে। আর তাদের অপেক্ষায় ঘোড়ায় বসে রইলেন জঙ্গলের মূখ্য পথে।

এদিকে চন্দ্রপ্রভা আগে আগে হাঁটছেন এবং তার পেছনে পেছনে হাঁটছে সৈনিকগণ। যাতে মারাত্তক রকমের বিরক্ত রাজকুমারী। তাদের নিয়ে শিকার করতে মোটেও পারবেন না তিনি। তার পক্ষে অসম্ভব এটা। অত্যন্ত অসম্ভব! ভেবেই মস্তিষ্কে একটা বুদ্ধি এঁটে নিলেন চন্দ্রা। কৌশলে সৈনিকদের আগে হাঁটতে বলে নিজে তাদের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন। একপর্যায়ে তিনজন সৈনিকের আগোচড়েই ধীর পদে অন্য পথে হাঁটতে লাগলেন রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভা। ক্ষাণিকবাদ পর কানে কোনো জন্তুর দৌঁড়ানোর শব্দ এলো। চন্দ্রার ঠিক পেছন থেকেই শব্দটা আসছে। পিঠের তূণীর থেকে তীর নিয়ে ধনুকে বসিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলেন চন্দ্রা। জন্তুর দৌঁড়ানোর শব্দ কানের অতি নিকটে আসতেই পেছনে ফিরে প্রায় সাথে সাথেই তীর ছুঁড়ে মারলেন জন্তুটির দিকে। তবে চন্দ্রা ব্যর্থ হলেন। জন্তুটির শরীরে তীরটি লাগার বদলে তার পেছনে ধনুক নিয়ে ছুটতে থাকা অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষের হাতের বাহুতে বিঁধে যায় তীরটি। এতে ভয় পেয়ে যান চন্দ্রা। লোকটি একবার অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই দৃষ্টি শান্ত করে ফেললো সে। হাতের বাহু থেকে এক টানে তীরটি বের করে ছুঁড়ে মারলো স্থলে। সাথে সাথে ঝরঝর করে বাহু বেয়ে গড়িয়ে পরল রক্ত। তাতে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই লোকটির। সে ধীর পদে এগিয়ে এলো চন্দ্রার দিকে। চন্দ্রা ভয়ে ভয়ে পেছাতে পেছাতে পিঠ ঠেকে গেল গাছের সাথে। সেই সুযোগে লোকটি চন্দ্রার একদম নিকটে এসে দাঁড়ালো। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চন্দ্রার চিবুক ধরে মুখটা উঁচু করল। সাথে সাথে কেঁপে উঠল চন্দ্রা। ভয় পেল অনেকটাই। বারবার শুকনো ঢোক গিলছে সে। লোকটি কিছু বলতে নেবে তার আগেই চন্দ্রা বলে উঠে,

— “আ_আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। জন্তুটিকে মারতে গিয়ে ভূলে__! ক্ষমা করবেন আমায়।”

চন্দ্রার কথায় বিশেষ ভ্রুক্ষেপ করল না লোকটি। নিজের কঠর কণ্ঠে বলে উঠল,

— “নাম কি তোমার?”

জবাব দিলেন না চন্দ্রা। এতে রেগে গেল লোকটি। ধমকে বলে উঠল,

— “নাম কি?”

— “চ__চন্দ্রা। চন্দ্রপ্রভা।”

তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চন্দ্রার দিকে তাকালো লোকটি। আগের নেয় বলে উঠল,

— “আমি সিংহদীপ সম্রাজ্যের সম্রাট রুদ্রদীপ।”

একটু থেমে আবারও বলে উঠলেন রুদ্রদীপ,

— “কোন রাজ্যের তুমি?”

— “কূ__কূঞ্জনরাজ্যের রাজ_কুমারী আমি।”

বাঁকা হাসলেন রুদ্রদীপ। নিজের বুড়ো আঙ্গুল চন্দ্রার গালে আলতো করে বুলাতে শুরু করলেন। কেঁপে কেঁপে উঠলেন চন্দ্রা। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললেন তিনি। মনে মনে ভাবতে লাগলেন- ‘লোকটির কি আঘাতে যন্ত্রণা হচ্ছে না? এত স্বাভাবিক কিভাবে উনি?’ ভাবনার মাঝেই চন্দ্রপ্রভার আত্মরক্ষাকারী তিনজন সৈনিক এসে হাজির। রাজকুমারীকে রুদ্রের সাথে দেখে ক্ষাণিকটা ভড়কে যান তারা। তিনজন সৈনিকের মধ্যে একজন তলোয়াড় নিয়ে সম্রাট রুদ্রদীপের নিকটে এগোতেই রুদ্র তার কোমড়ের তলোয়াড় বের করে হাওয়ার গতিতে সৈনিকটির গর্দান উড়িয়ে দেন। সাথে সাথে তার দেহ লুটিয়ে পরে মাটিতে। তার একটু দূরেই পরে আছে সৈনিকটির গর্দান কাঁটা মুখমন্ডল। চন্দ্রা মাত্রই চোখ খুলেছিলেন। চোখ খুলে এমন দৃশ্য দেখে মৃদু চিৎকার করে গাছের সাথে আরেকটু ঢেবে দাঁড়ান তিনি। ভয়ে চোখ থেকে জল বের হচ্ছে তার। তা দেখে বাঁকা হাসলেন রুদ্রদীপ। নিজের তলোয়াড় অবশিষ্ট সৈনিকদের গর্দানে রেখে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠেন,

— “সম্রাট রুদ্রদীপের সামনে তলোয়াড় ওঠানোর দূঃসাহস করবে না কখনও। নাহলে এর পরিণাম এই মৃত সৈনিকের মতোই হবে।”

পরপরই তলোয়াড়ে লেগে থাকা রক্ত রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভার পোশাকে মুছতে মুছতে শান্ত স্বরে বলে উঠেন,

— “আমাদের আবারও দেখা হবে রাজকুমারী। তখন তোমাকে নিজের কাছ থেকে যেতে দেবো না আমি। নিজের অন্ধকার রাজ্যের বন্দী রাণী করে রাখবো। এবং তা খুব শীগ্রই!”

_______________চলবে_______________
Ishanur Tasmia

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here