#সুখের_পাখি
৩৭
ইহান কটমট করে কতক্ষণ তনুর দিকে চেয়ে থাকল। বড্ড সাহস বেড়ে গেছে। মুখে মুখে কথা বলছে ইদানীং। একটা শিক্ষা তো দিতেই হবে। ওর এসব ছোটখাটো অপরাধ মাফ করে দিলেও হাসপাতালে তাকে দেখতে না যাওয়ার অপরাধ কিছুতেই ক্ষমার যোগ্য না। ইহান ভাবছে কীভাবে তনুকে একটু শায়েস্তা করা যায়। এখন সে হাঁটতে চলতে পারে না। তনুকে বেশি কিছু বললে তার সামনে থেকে চলে যাবে। সে ডাকলেও আর আসবে না। এমনিতেও তো আসে না। ইহান উঠে গিয়ে তনুকে বকতেও পারবে না।
তনু বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে এখনও ইহানকে দেখছে। মনে মনে ভাবছে, অ্যাক্সিডেন্ট করে হাত পা তো ভেঙেছেই সাথে মাথাটাও পুরোপুরি গেছে। তা নইলে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর এমন আজব আচরণ কেন করছে? কিছু না বলে ইহানের সামনে থেকে তনু চলে যেতেও পারছে না। বাধ্য হয়েই সে বলল,
–‘এখন কি যাব আমি? নাকি আরও কিছু বলবেন?’
ইহান এতক্ষণ মনে মনে কী ভেবেছে কে জানে। সে চট করে বলে বসল,
–‘অনেকদিন ধরে ঘরে বসে আছি। আমাকে একটু বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনো তো।’
কথাটা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তনুর। বলছে কি ইহান ভাই! সে কীভাবে বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনবে!
–‘আমি!’
–‘হ্যাঁ তুমি। কেন আমাকে বাইরে ঘুরিয়ে আনলে পাপ হবে নাকি তোমার?’
–‘পাপ হবে কেন?’
–‘তাহলে কথাটা শুনে ওরকম ভাবে আঁতকে উঠলে কেন? আমি নিশ্চয় তোমার কোলে উঠে যাব না। হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যাবে।’
–‘আমি পারব না।’
ইহান চোখ রাঙালো। বলল,
–‘এত বড় সাহস তোমার! আমার মুখের উপর না করছো।’
–‘ইহান ভাই, আমি মাত্র কলেজ থেকে ফিরেছি। এখনও ঘরে যাইনি। ড্রেস চেঞ্জ করিনি।’
–‘সব পরে করবে। আগে রোগী মানুষটাকে সাহায্য করে সাওয়াব কামাই করো। আমি দোয়া করে দিলে সাদাফ ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।’
শেষ বাক্যটা বলে ইহান তনুর রি-অ্যাকশন দেখার জন্য চেয়ে থাকল। সে জানে তনু সাদাফ ভাইকে ভালোবাসে না। বিয়েও করবে না। তনু করতে চাইলেও এখন আর ইহান তা হতে দিবে না। তবুও তনুকে চটানোর জন্য বলল। তনু আগুন চোখে ইহানকে দেখছে। পারলে সে কোনোকিছু দিয়ে বাড়ি মেরে ইহানের মাথা ফাটিয়ে দেয়। তনুর চেহারার প্রতিক্রিয়া দেখে ইহান খুব কষ্টে হাসি চেপে রাখল। মুখে কৃত্রিম গম্ভীরতা ফুটিয়ে বলল,
–‘আমি কি মা’কে ডেকে বলব তনু আমার কাজ করছে না?’
তনু অবাক গলায় বলল,
–‘এসবের মাঝে ফুপু আম্মাকে ডাকবেন কেন আপনি!’
–‘কারণ তুমি আমার কথা শুনছো না। আমি রোগী মানুষ। ডাক্তার আমাকে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছে। হাঁটাচলা করলে আমার জন্যই খারাপ হবে। আবার ঘরে বসে থেকেও আমি বোর হচ্ছি। তুমি এসব জেনেও আমাকে সাহায্য করছ না। মা’কে বলব না আমি?
হায় আল্লাহ! ইহান ভাই এখন আবার তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে দিয়েছে! ফুপু আম্মাকে ডাকার ধমক দিচ্ছে। অ্যাক্সিডেন্ট করে এ কোন ভীমরতিতে ধরল ইহান ভাইকে। তনুকে সে সহ্যই করতে পারত না। অথচ এখন নিজের সব কাজ তনুকে দিয়েই করায়। সুযোগ পেলে তাকে আর সাদাফ ভাইকে নিয়ে খোঁচা দিতেও ভুলে না। তনু বাধ্য হয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ইহানের কথা রাজি হলো।
তনু ভাবছে এবারই শেষ এর পর আর সে ইহানের কোন কথা শুনবে না। কিন্তু ইহান তো জানে এটাই শেষ না। শবে তো শুরু। ইহান সারাজীবন তনুকে এরকম ভাবে জ্বালানোর প্ল্যান করেছে।
সাদাফ তনুর সাথে একা কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। ইহানের অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে তনুর সাথে তার ভালো করে দু’টা কথাও হয়নি। তনু কোথায় থাকে খুঁজেই পায় না সে। কখন কলেজ যায়, কখন আসে কে জানে। আজ তনুকে সে পেয়ে গেল। সাদাফ তনুর ঘরের দিকে যাচ্ছিল। মাঝ পথেই তনুর দেখা মিলল। সাদাফ ওকে ডাকল,
–‘তনু!’
তনু দাঁড়াল। সাদাফ ভাই ডাকছে কেন? তনু যে বিয়েটা করবে না তা এবার বলে দেওয়া দরকার। আর কাউকে বলতে না পারুক ফুপু আম্মাকে তো বলতে পারবে। ফুপু আম্মা তাকে বুঝবে। আর যদি ফুপু আম্মা বিয়ে না করার কারণ জানতে চায় তাহলে বলবে অনার্স কমপ্লিট করে তারপর বিয়ে করবে।
সাদাফ তনুর সাথে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ওইদিন ওরকম ঘটনা না ঘটলে তনু আজ তার বউ থাকত। তখন সম্পর্কটা অন্য রকম থাকত। এখন অন্যরকম। একেই তো তনুর সাথে কথা বলতে গেলে সাদাফ নার্ভাস হয়ে পড়ে। তার উপর আবার বিয়েটা হতে হতেও হলো না।
–‘কোথায় যাচ্ছ?’
–‘কোথাও না। এদিকেই হাঁটছিলাম।’
–‘ওহ। কলেজে গিয়েছিলে আজ?’
–‘হ্যাঁ। দুপুরে ফিরলাম।’
সাদাফ বড় অস্বস্তির মাঝে পড়ে গেল। এত এত মেয়ে বান্ধবী ছিল তার। অথচ এখন তনুর মত সাধারণ একটা মেয়ের সাথে কথা বলতেও হাতের তালু ঘামছে।
ফুলি কাপড় ভিজিয়ে ইহানের পা মুছে দিচ্ছে। ব্যান্ডেজ ভিজে যাবে বলে ইহান গোসল করতে পারে না। করলেও শুধু মাথাটা ভিজায়। হাত, পায়ের ব্যান্ডেজ বাঁচিয়ে গোসল করতে তাকে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। ফুলি বকবক করতে করতে নিজের কাজ করে যাচ্ছে।
–‘ভাইজান, এইবার একটু হাঁটার চেষ্টা কইরেন। নইলে বইসা থাকতে থাকতে এমনিতেই হাত, পায়ে জং ধরে যাচ্ছে।’
আরও অনেক কথা বলছে ফুলি। কিন্তু ফুলির একটা কথাও ইহানের কানে ঢুকছে না। এই মুহূর্তে ইহানের চোখ সাদাফ ভাই আর তনুর উপর। ওরা দু’জন বেশ অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে। ইহানের রাগ হচ্ছে। জেলাস ফিল করছে। এত কিসের কথা হ্যাঁ! ইহান না পারছে তনুকে ডেকে নিয়ে আসতে। না পারছে ওদের দু’জনকে একসাথে দেখতে। হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল ইহান।
–‘ও মা গো! মেরে ফেললি রে ফুলি। মরে গেলাম। আমার ভাঙা পা ভেঙে ফেললি তুই। ও আল্লাহ! মরে গেলাম।’
ইহানের চিৎকারে ফুলি ভয় পেয়ে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ও। অবাক হয়ে হা করে ইহানের মুখের দিকে চেয়ে আছে ফুলি। তনু, সাদাফ দু’জনই ছুটে এলো। তনু সত্যি সত্যিই অনেক ভয় পেয়ে গেছে। সাদাফের সামনেই সে ইহানের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ওর পায়ে হাত দিয়ে বলল,
–‘কোথায় লেগেছে ইহান ভাই? বেশি ব্যথা পেয়েছেন? ফুলি আপা, তুমি যে কী করো না! কষ্ট হচ্ছে? ফুলি আপাও তো জেনে-বুঝে ব্যথা দেয়নি।’
ইহান তনুকে দেখতে দেখতে মনে মনে বলল,
–‘এখানটায় লেগেছে তনু। এইযে দেখো, ঠিক আমার বুকের মাঝখান টায়। আমার হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে দেখতে পাচ্ছ না তুমি।’
সাদাফও ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
–‘কী হয়েছে? কীভাবে লেগেছে?’
ফুলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
–‘আমি ইচ্ছে করে ভাইজানরে ব্যথা দেই নাই। সত্যি বলতাছি, আমি বুঝতে পারি নাই। আমার জন্য ভাইজান কষ্ট পাইতাছে। সব আমার দোষ।’
তনু ফুলিকে ধমক দিল,
–‘আহ ফুলি আপা! চুপ করবে তুমি! আমরা সবাই জানি তুমি কখনও ইচ্ছে করে ইহান ভাইকে কষ্ট দিবে না। তবুও কেন এসব বলছো?’
–‘তোর কোন দোষ নেই ফুলি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদিস না তো। চটকানা দেব। চোখ মুছ। আমি তোকে বকেছি, না মেরেছি?’
–‘আমার জন্যই তো…
ফোঁপাতে ফোপাঁতে ফুলি কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ইহান চোখ পাকিয়ে ওকে শান্ত করে দিল।
–‘আবার কথা বলে! আমাকে ঘরে দিয়ে আয়। আর আমার খিদে পেয়েছে। যা তাড়াতাড়ি নুডলস রান্না করে নিয়ে আয়। নুডলস খেতে মন চাইছে।’
–‘হুম।’
ফুলি ইহানকে নিয়ে চলে গেলে তনুও তার মতো চলে গেল। সাদাফ কতক্ষণ দাঁড়িয়েই রইল। ব্যাপারটা কী ঘটেছে বুঝতে চেষ্টা করছে ও।
ইহান যে চারদিন হাসপাতালে ছিল, প্রতিদিনই ওর বন্ধুরা এসে ওকে দেখে গেছে। বাড়িতে আসার পরেও দু’দিন এসেছে। আজও আসবে ওরা। সৌরভ কিছুক্ষণ আগে কল করেছিল। ইহান এখনও চায় না তনু তার বন্ধুদের সামনে পড়ুক। এই মেয়ের মাঝে কিছু আছে। যে একে দেখে সে-ই এর জন্য পাগল হয়ে যায়। সাদাফ ভাইকেই উদাহরণ দেওয়া যায়। ব্যাটা তুই তিন চার বছর বিদেশ থেকে এসেছিস। তুই বিয়ে করবি লাল,সাদা চুলের মেমসাহেবকে। তা না করে তুই দেশে ফিরে মায়ের চক্করে পড়ে তনুকে পছন্দ করে বসে আছিস। শুধু কি পছন্দ? রীতিমতো বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছিস। গলায় দড়ি দেওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছিস বলা যায়।
–‘ইহান ভাই, আপনি নাকি আমাকে ডেকেছেন?’
দরজার সামনে থেকে তনুর গলা পেয়ে ইহানের ভাবনায় ছেঁদ পড়ল। সে ফুলিকে দিয়ে তনুকে ডেকে পাঠিয়েছে।
–‘হুম, এসো।’
তনু ভেতরে এলো না। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
–‘কোন কাজ আছে?’
ইহানের রাগ উঠে গেল। তনু তার সামনে এলে এরকম ভাব করে যেন ইহান তার কেউ না। অথচ আগে তাকে নিয়ে কত পাগলামিই না করেছে। হুটহাট ঘরে চলে এসেছে। তাড়িয়ে দিলেও যায়নি। আর এখন ইচ্ছে করে সবসময় দূরে দূরে থাকছে।
–‘হ্যাঁ।’
–‘কী কাজ?’
–‘আমার মাথা ব্যথা করছে। মাথাটা একটু টিপে দাও।’
–‘আমি!’
–‘তোমাকেই তো বলছি। নাকি তনু নামের আমাদের বাড়িতে অন্য কেউ আছে।’
–‘আমি পারব না।’
–‘একশোবার পারবে।’
–‘বলেছি না পারব না।’
–‘আমি বলেছি না পারবে।’
–‘আমি ফুলি আপাকে ডেকে দিচ্ছি।’
–‘আমি তোমাকে বলেছি।’
–‘আপনি এরকম কেন? ঘাড়ত্যাড়া।’
–‘ঘাড়ত্যাড়ামি করতে বাধ্য করছো তুমি।’
–‘আমি আপনার আশেপাশে থাকি এটা তো আপনি পছন্দ করতেন না।’
–‘ভেতরে এসো।’
তনুরও রাগ হলো। তার কথার উত্তর না দিয়ে কেমন আদেশ করে যাচ্ছে। এই তনুকে কি ইহান ভাই এখনও সেই ক্লাস টেনে পড়া আবেগপ্রবণ তনু মনে করছে? তনু এখন বড় হয়েছে। আত্মসম্মান বোধ আছে তার। ইহান ভাইয়ের কাছে ছুটে গিয়েছিল সে। ইহান ভাই কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে। কঠিন গলায় তনু বলল,
–‘আমি আপনার কোন কাজ করতে পারব না ইহান ভাই।’
–‘প্লিজ তনু।’
অনুরোধের গলায় বলল ইহান। করুণ চাহনিতে তনুর চোখে চোখ রাখল। বেচারি তনু! যতই রাগ করুক। ইহান ভাইয়ের অনুরোধ ফেলার সামর্থ্য কোথায় আছে তার!
#সুখের_পাখি
৩৮
তনু আলতো হাতে ইহানের মাথা টিপে দিচ্ছে। সে মনে মনে মহা বিরক্ত হলেও ইহান আরামে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তার ঘুম এসে যাচ্ছে। কপালে তনুর তুলতুলে হাতের স্পর্শ পেয়ে তার সব ব্যথা দূর হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ রেখেই ইহান বলল,
–‘গান পারো তনু?’
তনু ভ্রু কুঁচকে কতক্ষণ চুপ করে থাকল। ইহান আবার বলল,
–‘পারো না?’
–‘না। গায়ক তো আপনি হবেন। আমি গান পারলে তো আমিও গায়িকা হতাম।’
–‘আরে গান তো সবাই পারে। কিন্তু সবার সুর ভালো না এই আরকি। একটা গান ধরো তো। যেমন পারো।’
–‘আমি গান পারি না। আর পারলেও এখন গাইব না।’
–‘আমি গাইলে শুনবে?’
–‘কানে তো আর হাত দিয়ে রাখতে পারব না। কারণ হাত দু’টো ব্যস্ত আছে।’
কথা নেই বার্তা নেই ইহান গান ধরলো। তনু যতই মুখে মুখে এসব কথা বলুক, ইহান ভাইয়ের গান শোনার জন্য সে পাগল। মানুষটার গলায় জাদু আছে। শুনতেই ইচ্ছে করে।
…ভালোবাসবো বাসবোরে বন্ধু তোমায় যতনে।
…আমার মনের ঘরে চাঁন্দের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে।
…পুষে রাখবো রাখবোরে বন্ধু তোমায় যতনে।
…ভালোবাসবো বাসবোরে বন্ধু তোমায় যতনে।
ইহান খালি গলায় গাইছে তবুও ঘোর লেগে যাচ্ছে। তনু চোখ বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে শুনছে।
…দুধে আলতা গায়ে বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা।
…আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না।
… আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম, মন তো আর মানে না।
… কাছে আইসো আইসোরে বন্ধু প্রেমের কারণে। ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে…
হঠাৎ তনুর রাগ হতে লাগলো। গানটা ইহান ভাই তাকে শোনানোর জন্য গাইছে। অথচ ইহান ভাই তনুকে পছন্দ করে না। এই গানের একটা কথাও ইহান ভাইয়ের সাথে যায় না। ইহান ভাই পাষাণ। তনুকে কতবার ফিরিয়ে দিয়েছে সে। গানটা ইহান ভাই অন্য কোন মেয়েকে কল্পনা করে গাইছে।
–‘আহ তনু! মেরে ফেলবে নাকি? এত জোরে দিচ্ছ কেন? মাথা তো ভেঙেই ফেলবে মনে হচ্ছে।’
তনু তার সব রাগ ইহানের মাথায় ঢাললো। নিজেকে শান্ত রাখতে পারল না সে। ইহান গান বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠল। তনু তার চুল টেনে তুলে নিচ্ছে। এই মেয়ে পাগল নাকি? ইহানের ব্যথা লাগবে এটাও ভাবছে না!
–‘কী করছো তনু? ধ্যান কোথায় তোমার?’
তনু ঝাঁঝালো গলায় বলল,
–‘এখন যাচ্ছি আমি।’
ইহান অবাক হয়ে বলল,
–‘কোথায় যাচ্ছ?’
–‘কোথায় যাচ্ছ মানে? আমাকে কি আপনার সেবা করার জন্য রাখা হয়েছে? আপনার কাজের লোক আমি?’
–‘হঠাৎ করে রেগে গেলে কেন বলো তো?’
–‘এমনি।’
–‘এমনি এমনি কেউ রাগ করে? কারণ তো একটা আছে।’
–‘আপনি জানেন, আপনি একটা মহা বদ লোক।’
–‘এইতো তুমি জানালে এখন।’
–‘আপনার মাথা না, আপনার গলা টিপে ধরা উচিত। একেবারে কাম খতম।’
ইহান গলা বাড়িয়ে দিল।
–‘নাও কাম খতম করে যাও।’
তনু গজগজ করতে করতে চলে যাচ্ছে। দরজার কাছে চলে গেলে ইহান ডাকল।
–‘তনু শোনো।’
–‘শুনব না।’
–‘আজ আমার ফ্রেন্ডসরা আসবে। ওরা বাড়িতে এলে তুমি আমার রুমে এসো না। সবচে ভালো হবে ঘর থেকেই বের হইয়ো না।’
দাঁড়িয়ে পড়ল তনু। পেছন ফিরে তীক্ষ্ণ চোখে ইহানের দিকে তাকাল। কিছুটা বিস্মিত গলায় বলল,
–‘কেন?’
–‘ওরা ভালো ছেলে না। মেয়ে দেখলেই লাইন মারতে চায়। সেদিন তোমাকে একবার দেখেছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল তুমি সিঙ্গেল কিনা।’
–‘এই ধরনের ছেলেদের সাথে আপনি মিশেন কেন?’
–‘মেশার আগে তো জানতাম না ওদের চরিত্রে গণ্ডগোল আছে।’
–‘এখন তো জানেন। তাহলে এখনও বন্ধুত্ব রেখেছেন কেন?
–‘বন্ধুত্ব ভেঙে দেওয়া কি সহজ কাজ!’
–‘না। তবুও… ওদের বাড়ি আসতে এলাউ করেন কেন?’
–‘কেউ তোমার বাড়ি আসতে চাইলে তুমি কি না করতে পারবে? তার উপর ওরা আবার তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড।’
–‘আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এত লুচ্চা না।’
কথাটা বলে মিতার কথা মনে পড়ে গেল। মিতা লুচ্চিও তো প্রথম দিন এবাড়িতে এসেই ইহান ভাইকে দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিল। মিতা মেয়ে হয়ে যদি এরকম কাজ করতে পারে তাহলে ইহান ভাইয়ের বন্ধু গুলো তো ছেলে।
–‘কী ভাবছো?’
–‘কিছু না।’
–‘ওরা এলে তুমি এদিকে আসবে না তো?’
–‘হু।’
ইহানের বন্ধুরা এসেই ওই দিনের মতো ডাকাডাকি শুরু করে দিল। ইহান নিচে নামতে পারল না। সাবিনা ওদের ইহানের ঘরে পাঠিয়ে দিল। ফুলিকে এসে বলল ওদের নাস্তা দিতে।
আরাফাত ইহানের পায়ে হালকা চাপড় মেরে বলল,
–‘হাঁটতে পারবি নাকি সারাজীবনের জন্য পঙ্গু?’
–‘শালা আমার এই অবস্থা নিয়েও মজা করছিস!’
নাফিজ ইহানের হুইলচেয়ারে বসে পড়ে বলল,
–‘সত্যিই অ্যাক্সিডেন্ট করেছিস? নাকি সব সাজানো?’
–‘তোদের মনে হয় নাটক করছি আমি?’
আরাফাত চটে উঠল,
–‘আমরা কিছু জানি না মনে করেছিস? সব জানি। মেয়েটার বিয়ে ভাঙতেই তুই ইচ্ছে করে এসব করেছিস।’
ইহান হতভম্ব হয়ে কতক্ষণ বন্ধুদের দিকে চেয়ে রইল। যে খবর কেউ জানে না তা ওরা জানলো কীভাবে? অবশ্য ইহান ইচ্ছে করে অ্যাক্সিডেন্ট করেনি। তবে ও যে তনুকে পছন্দ করে তা জানতে বাকি নেই।
সৌরভ বলল,
–‘তাই তো বলি, তোর কিছুই হলো না অথচ তোর ভাইয়ের বাইক ভাঙ্গারি হয়ে গেল! ওটা কটকটি ওয়ালারাও নিবে না। ভালোই প্রতিশোধ নিয়েছিস।’
–‘বাজে বকিস না। তোরা যা ভাবছিস ওরকম কিছুই না। প্রতিশোধ ফতিশোধের কথা কখনও মাথায় আসেনি আমার। অ্যাক্সিডেন্টটা সত্যিই ছিল। ডান হাতের হাড় ভেঙেছে। পা নিয়ে হাঁটতে পারছি না। আমার সুন্দর গায়েও অসংখ্য কাটাছেঁড়া হয়েছে।’
–‘বেঁচে আছিস শোকর কর। হাত পা এক দুইটা না থাকলেও কিচ্ছু এসে যায় না।'(আরাফাত)
–‘হ্যাঁ, শ্বাস চলছে এটাই অনেক।'(নাফিজ)
তখনই দরজার সামনে থেকে তনুর গলা শোনা গেল। আরাফাত, নাফিস,সৌরভ একজোটে দরজার দিকে ঘুরে তাকাল। ইহান হতবাক। তনু এসেছে নাকি? সে তনুকে না করেছিল। না করা স্বত্বেও তনু সোজা তার ঘরে চলে এসেছে! তনু কি জানে না ওরা এসেছে? খাবারের ট্রে হাতে তনু ভেতরে এসে ঢুকল। সবার উদেশ্যে সালাম দিয়ে টেবিলের উপর খাবার নামিয়ে রাখতে রাখতে একবার ইহানের দিকে তাকাল। খুব সামান্য সময়ের জন্য। তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিল। সৌরভ, নাফিজ, আরাফাত সমস্বরে সালামের জবাব দিল। ওরা তিন জনই ড্যাব ড্যাব করে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে।
ইহান রাগে কিড়মিড় করছে। ওর বন্ধুরা এসেছে এটা তনুর অজানা না৷ অজানা থাকলে খাবার নিয়ে আসতো না। ওরা এলে সব সময় ফুলি খাবার নিয়ে আসে। আজ তনু এসেছে। তার মানে সে জেনে-বুঝে ইচ্ছে করেই এসেছে। বোঝা যাচ্ছে ইহানের নিষেধ কানে নেয়নি তনু। এত সাহস ওর! ইহান একটু নরম কী হয়েছে তনু তো একেবারে মাথায় চড়ে বসেছে। আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। ইহান বিড়বিড় করে বলল,
–‘গাধা তিনটা শুধু বিদায় হোক। তারপর আমি তোমাকে দেখাচ্ছি মজা। আমার কথা অমান্য করছো তুমি! এত সাহস!’
তনু এক এক করে সব গুলো প্লেট টেবিলে ওদের সামনে সাজিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ও চলে যাবে নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে তা মুখ দেখে বোঝা গেল না। এই সময়টুকুতে তনু কোন কথা বলেনি। তনু চলে যাবে ভেবে সবার আগে আরাফাতই নীরবতা ভাঙল।
–‘কেমন আছো তনু?’
তনু মৃদু হেসে বলল,
–‘ভালো। আপনি?’
–‘ আমিও ভালো আছি। তুমি আমাদের চেনো?’
আগের বারের থেকেও মিষ্টি করে হাসল তনু। বলল,
–‘আপনারা ইহান ভাইয়ের বন্ধু।’
–‘হুম। তা তো বটেই। আমি আরাফাত।’ সৌরভের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ও সৌরভ।’ নাফিজকে দেখিয়ে বলল, ‘ও নাফিজ।’
ইহান না পারছে সহ্য করতে। না পারছে কিছু বলতে। তনু ওর বন্ধুদের সাথে এরকম রস লাগিয়ে কথা বলছে কেন? উদেশ্যটা কী ওর?
–‘আমরা আগেও দু’তিন বার ইহানকে দেখতে এসেছিলাম। তখন তো তোমাকে দেখিনি। কোথায় থাকো তুমি?’
–‘কীভাবে দেখবেন বলুন? ইহান ভাই তো আমাকে আপনাদের সামনে আসতে বারণ করে দিয়েছে।’
তনু বোম ফাটালো। তনু এরকম কোন কথা বলে বসবে ভাবতেই পারেনি ইহান। খুক খুক করে কাশতে লাগল সে৷ তনুর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? পাগলের মতো সব কথা ওদের সামনে বলে দিচ্ছে কেন?
ইহান কাশছে। তিন জোড়া চোখ একজোটে ওর দিকে তাকাল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ওকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে চাইলে। ওদের মুখের দিকে তাকাতেও ইহানের ভয় লাগছে। আজ কপালে খারাবি আছে। এমনিতেই হাত পা ভাঙা। আরাফাত সুর করে টেনে টেনে বলল,
–‘ও আচ্ছা, আমাদের সামনে আসতে তেমাকে ইহান ভাই না করেছে!’
নাফিজ দাঁতে দাঁত চেপে অদ্ভুত কায়দায় হেসে হেসে বলল,
–‘ইহান ভাইয়ের বারণে তুমি এতদিন আমাদের সামনে আসোনি!’
সৌরভ ইহানের চোখে চোখ রাখল। বলল,
–‘কিন্তু ইহান ভাই এই কাজ কেন করল? কেন তোমাকে আমাদের সামনে আসতে বারণ করল। আমরা কি খারাপ ছেলে?’
তনু চট করে বলে বসল,
–‘ইহান ভাই বলেছে আপনাদের নাকি চরিত্রে গণ্ডগোল আছে। মেয়ে দেখলেই লাইন মারতে চান।’
এর থেকে ইহানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও ভালো হতো। এরকম ধাক্কা খাওয়ার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। দ্বিগুণ জোরে কাশতে লাগল সে। আরাফাত, সৌরভ, নাফিজ আগুন চোখে ইহানকে দেখছে। পারলে এক্ষুনি ওরা ক্ষুদার্ত বাঘের মত ইহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তনুর সামনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখছে ওরা। তনু এই ঘর থেকে যাবার যা দেরি। ইহান বোকা বোকা চেহারায় তনুকে দেখল একবার। এই মেয়ের মাথা কি পুরোপুরি গেছে! এই কথাটাও বলে দিল! একে কী করতে মন চাইছে তার তা ইহান নিজেও বুঝতে পারছে না। পরক্ষণে অসহায় মুখে বন্ধুদের দিকে দেখল ও। ওদের হাবভাব দেখে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। ওরা যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তনু বলল,
–‘আমি এখন যাই, ভাইয়া?’
কেউ কিছু বলল না৷ তনু আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল। দরজার বাইরে গিয়ে বলল,
–‘এই কয়টা দিন অনেক জ্বালিয়েছেন আমাকে। এবার মজা বুঝুন। সব অত্যাচারের যোগ্য প্রতিশোধ নিতে পেরেছি।’
নিজের উপরই খুশি তনু। এত বড় একটা জিতে খুশিতে আত্মহারা। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে ঘরে চলে গেল।
আরাফাত অজগর সাপের মতো ফুঁসছে। নাফিজ দাঁত কিড়মিড় করে পারলে দাঁত ভেঙেই ফেলছে। সৌরভ আশেপাশে হাতের কাছে কিছু খুঁজছে।
–‘আমাদের চরিত্রে দোষ আছে? (আরাফাত)
–‘ক্যারেক্টার ভালো না আমাদের?(নাফিজ)
–‘আমাদের চরিত্রের ঠিক নেই। মেয়ে দেখলেই লাইন মারতে চাই?(সৌরভ)
–‘মাফ করে দে দোস্তরা। আমি অসুস্থ। একটা হাত অলরেডি ভাঙা। পা-টাও…
–‘শালা তোরে তো…
তিনজন একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইহান চেঁচিয়ে উঠল,
–‘দোস্ত সরি…
চলবে🌸
Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা
চলবে🍂
#জেরিন_আক্তার_নিপা