#সুখের_পাখি
৪১
সাবিনা ভেবে পাচ্ছে না সে রাশেদা আপাকে কথাগুলো কীভাবে বলবে? কীভাবে বললে রাশেদা আপা তনুর উপর রাগ করবে না। নিজের ছেলের মন ভাঙতে দেখলে তনুর উপর থেকে রাশেদা আপার সব স্নেহ উঠে যাবে। তনুকে সে দু’চোখ দেখতে পারবে না। যা বলার ভেবেচিন্তে বলতে হবে।
সাবিনার এই কাজ সাদাফ সহজ করে দিল। ওদের বিয়ের কথা উঠলে সাদাফ সবার সামনে বলল,
–‘বিয়ে এখন হবে না। আমার কোন তাড়া নেই। তনু ওর মত পড়তে থাকুক। আমি এবার ফিরে যাই। ছুটিও আর কিছুদিনই বাকি আছে। পরের বার যখন আসবো তখন বিয়ে হবে।’
হঠাৎ ওর এই সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নিতে পারল না। এটা কেমন কথা! এতদিন তাহলে এই কথা বলেনি কেন? আজ হঠাৎ কোন কারণে সাদাফ এই কথা বলছে। রাশেদা ছেলের উপর রেগে গেল।
–‘এই কথা আজ বলছিস কেন? অতদিন কেন বলিসনি?’
–‘ভেবে দেখলাম এখন বিয়ে হলে পড়াশোনা থেকে তনুর মন উঠে যাবে। ও আগের মত পড়াশোনায় মন বসাতে পারবে না।’
সাদাফের তিন খালাই ওর উপর রাগান্বিত হয়ে নানান কথা বলতে শুরু করল। ওকে সব ভাবে বুঝিয়েও ব্যর্থ হলো ওরা। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে রেগেমেগে আর কিছু বললোই না। চুপ করে রইল।
তনু মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছে। তবে সবার সামনে প্রকাশ করতে পারছে না। সাদাফ ভাই চলে যাক। এটাই ভালো হবে। তনু কৃতজ্ঞ চোখে ফুপু আম্মাকে দেখছে। তার সমস্যার সমাধান ফুপু আম্মা এত সহজে বের করে ফেলেছে! সাদাফ ভাইকে নিশ্চয় ফুপু আম্মাই বলেছে। তাই সাদাফ ভাই এই কথা বলছে। যাক যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে। কেউ আর আসল কথা জানবে না। কারো মনও ভাঙবে না। সাদাফ ভাই নিশ্চয় দুই তিন বছর আগে আর ফিরবে না। ততদিন সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। সে খুশি খুশি মুখে সাদাফের কথা শুনছে।
–‘এখন বিয়ে হলেও তো আর তনু আমাদের বাসায় যাবে না। এখানেই থাকবে ও। আর ওর তো এখনও আঠারো বছর হয়নি। তাই এটাই ভালো হবে বিয়েটা আরো এক দু’বছর পরে হোক।’
রাশেদা সাদাফের কোনো কথা শুনতে পারছে না। গা জ্বলে যাচ্ছে ওর। এই ছেলেই তাকে ফোনে বলেছিল তনুকেই সে বিয়ে করতে চায়। এখন নাটক করছে।
–‘তোর যা ইচ্ছা তুই তা-ই কর। আমি আর কিছু বলব না। তোর মনের খুশি। আজকের পর থেকে তোর ব্যাপারে আমি আর কোন নাক গলাবো না।’
সাদাফ অসহায় মুখে মা’কে দেখছে। সত্য কথা সে মা’কে বলতে পারবে না। শুধু মা’কে কেন? কাউকেই বলতে পারবে না। তাহলে সবাই তনুকে ভুল বুঝবে। ওকে দোষবে। সাদাফ চায় না কেউ তনুকে দোষ দিক। তনুকে ঘৃণা করুক।
সাদাফ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ইহানের নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে। সবকিছু তার জন্যই হয়েছে। সাদাফ ভাইকে তার জন্যই আজ এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। ইহান সাদাফ ভাইয়ের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। গতকাল রাতে যখন তনু চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরই ইহানও ঘরে যাচ্ছিল। দরজার সামনে পা দিলে পেছন থেকে সাদাফ ভাইয়ের কন্ঠ কানে এলো।
–ইহান।’
ইহান তখনও বুঝতে পারেনি সাদাফ ভাই তনুকে ছাদ থেকে যেতে দেখেছে। এমনকি তনু তার সামনে পড়েছিল। তনুর সাথে কথাও বলেছে সে। ইহান দাঁড়াল। সাদাফ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে নিজেকে যথাসম্ভব সহজ রাখতে চেয়ে বলল,
–‘তুমি! ঘুমাওনি এখনও? বুঝেছি, তোমারও আমার মত ঘুম আসছে না।’
–‘হুম। কী করছিলি তুই?’
–‘কী আর করবো? ওই ঘুম না এলে রোজ যা করি। চাঁদ দেখছিলাম। দেখো আকাশে কত্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে।’
নার্ভাসনেসে ইহান বেশি কথাই বলে ফেলছে। যার কারণে সেটা সাদাফের চোখেও ধরা পড়ে গেল।
সাদাফ আলাপ করার মতই কথা চালিয়ে যাচ্ছে।
–‘তোর দিনকাল কেমন যাচ্ছে? মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিলি। ইঞ্জিনিয়ার হবি না৷ গানটানও তো ঠিক মত করতে দেখি না। তোর জীবনের লক্ষ কী? কিছু একটা তো করতে হবে ভাই। তা নাহলে কীভাবে চলবে? বিয়ে টিয়ে তো করবি কোনো সময়। বউ বাচ্চাকে খাওয়াবি কী?’
–‘হুম।’
সাদাফ ইহানের কাঁধে হাত রাখলো। মৃদু চাপ দিয়ে বলল,
–‘হু না। এবার লাইফে সিরিয়াস হ। বড় সিঙ্গার হ। নামডাক কামা।’
ইহান চুপ করে রইল। সাদাফ ভাই এই কথা গুলো বলার জন্য আসেনি। সে অন্য কিছু বলতে চায়। ওই কথাগুলো সহজভাবে বলার জন্যই আগে এসব কথা বলছে। দু’জনই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। ওরা চাঁদ দেখছে নাকি চাঁদের আশেপাশে ঘোরা খণ্ড খণ্ড মেঘগুলোকে উড়তে দেখছে কে জানে।
–‘তুই কাউকে ভালোবাসিস ইহান?’
দু’সেকেণ্ড ইহান কোন জবাব দিতে পারল না। সাদাফ ভাই এবার আসল কথা পেরেছে।
–‘ভালোবাসা!’
–‘হুম।’
ইহান অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কী বলবে সে? সরাসরি তনুর কথা বলে দিবে।
–‘তুমি তো জানোই সাদাফ ভাই।’
–‘ইহান, আমাকে তুই গাধা ভাবিস না। হ্যাঁ জানি। কিন্তু আমি এখন ওসব কথা তুলতে চাইছি না। পাস্ট ইজ পাস্ট। প্রেজেন্টে তুই কাউকে ভালোবাসিস?’
ইহান জবাব দিতে পারছে না দেখে সাদাফই বলল,
–‘তনু ভীষণ ভালো মেয়ে। হ্যাঁ, এখনও ছেলেমানুষ। ওর চরিত্র থেকে বাচ্চামি যায়নি। তবে মেয়েটা তোকে সত্যিই ভালোবাসে। তোর প্রতি ওর এই ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। ও তোকে যতটা চায় মন থেকেই চায়। ওর এই চাওয়াতে কোন দোষ নেই।’
কাতর গলায় ইহান বলল,
–‘সাদাফ আসলে…
–‘আমি সব জানি। তোকে কিছু বলতে হবে না। আমি কি তোর কাছে কোনো কৈফিয়ত চাইছি? চাইছি না তো? তাহলে তোকে প্যারা নিতে হবে না।’
–‘আমি তোমাকে আগেই বলতাম সাদাফ ভাই। কিন্তু তখন আমি নিজেই শিওর ছিলাম না।’
–‘তোর মন কী চায় এখন জানিস তো?’
–‘হু। তুমি কীভাবে জানলে?’
সাদাফ হাসলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘ওই চাঁদটাকে দেখছিস? ও আকাশের বুকে উঠলে যেমন কারো নজর এড়াবে না। সবার নজরে পড়বে, ঠিক তেমনই কাউকে ভালোবাসলে তা যতই লোকাবার চেষ্টা করবি ততই অন্যের চোখে ভাসবে। তোদের হাবভাব দেখেই আমার বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু আমি গাধা! দেখেও দেখতে চাইনি। বলা যায় ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছি।’
–‘তুমিও তো তনুকে ভালোবাসো।’
সাদাফ শব্দ করে হাসলো।
–‘ভালোবাসা আর তৈরি হলো কই? ওটা তো ভালোলাগা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। হ্যাঁ তবে তনুকে ভালোবাসার সুযোগ পেলে আমি তা কক্ষনো হাতছাড়া করতাম না।’
ইহান আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না। সাদাফ নিজেই বলে চলেছে,
–‘আমি মা’র কাছে তনুর কথা শুনি। তখন ভাবিনি প্রথম দেখাতেই তনুকে আমার ভালো লেগে যাবে। তনু আমার সাথে যতটা খোলামেলা ভাবে কথা বলতো, তোর সামনে ও ততটাই আড়ষ্ট বোধ করতো। তোকে সে আমার মত সাধারণ চোখে দেখে না বলেই হয়তো এরকমটা হতো। তবুও কেন যে তনু সবার কথাতে বিয়েতে রাজি হলো তা আজও আমার মাথায় ঢুকে না। যেদিন তনু আমার সাথে প্রথমবার বের হলো। সেদিনই তুই অসুস্থ হয়ে পড়িস। তোর নাকি বুকের ভেতর জ্বলছে। মাথা ফেটে যাচ্ছে। অথচ বাড়ি এসে আমরা তোকে একদম সুস্থ স্বাভাবিক দেখলাম। যেদিন ছোট খালামনি তনুকে নিয়ে বিয়ের শপিং করে, ওইদিন রাতে আমি তোকে তনুর ঘরের সামনে থেকে চলে আসতে দেখেছি। তুই গিয়েছিলি কিন্তু তনুর সাথে দেখা না করেই চলে এলি। তারপর বিয়ের দিন। আমি ভেবেছিলাম তুই নয়তো তনু একজন তো অন্তত মুখ ফুটে কিছু বলবি। কিন্তু তোরা সেদিনও কিছু বলিসনি। আমি সব বুঝেও বিয়ে করে নিতাম। কী করব বল? স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর তুই অ্যাক্সিডেন্ট করলি। টানা চারটা ঘন্টা তনু হাসপাতালে বসে তোর জন্য কেঁদেছে। সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম তনু তোকে কতটা চায়। তোকে ছাড়া ও বাঁচবে কিন্তু সে বাঁচায় প্রাণ থাকবে না। তোকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর তোর প্রতি তনুর যত্ন কে না দেখেছে! সেদিন রাতে খাবার টেবিলে তুই ওর হাত ধরলি। সেটাও আমার চোখ এড়ায়নি। আজ একটু আগে তনু তোর কাছ থেকে গেল। যাবার সময় আমার সামনে পড়ে যায় ও। আমাকে দেখে ভূতের মত ভয় পেয়েছে। আমি তনুকে কখনও সন্দেহ করিনি। ও আমাকে কখনও বলেনি ও আমাকে ভালোবাসে বা পছন্দ করে। যা ছিল তা আমার দিক থেকেই। তাই তনুকে আমি দোষ দিতে পারি না।’
–‘সাদাফ ভাই, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি নিজেই কেমন যেন নিজেকে বুঝতে পারি না। কী করা উচিত আমার ভেবে পাই না। ভেবেছিলাম তোমার সাথে বিয়ে হলে তনু সুখে থাকবে। তুমি আমার থেকেও ওকে বেশি ভালো রাখতে পারবে। আমার সব কথাই তো তুমি জানো। তনুর জন্য আমি টান অনুভব করতাম। কিন্তু সেটাকে ভালোবাসা নাম দেওয়া যায় কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। দ্বিতীয় বার কি ভালোবাসা যায়? ভালোবাসা তো জীবনে একবারই আসে। আর তা আমার জীবনে এসেও চলে গেছে।’
–‘তুই ভুল করছিস ইহান। কে বলেছে ভালোবাসা জীবনে একবার আসে? আমি তো বলবো বারবার আসে। দ্বিতীয় বার কেন? তৃতীয় বারও নতুন করে প্রেমে পড়া যায়। ভালোবাসলেই যে সবসময় মানুষটাকে পেতে হবে তেমন তো না। ধর তনুকে আমি ভালোই বেসেছি। এখন কি আমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করলে বউকে ভালোবাসবো না?’
–‘ তুমি আমাকে কথায় ভোলাতে চাইছ।’
–‘ আরে না রে! আচ্ছা তুই বল তো, তনুকে ছাড়া তুই ভালো থাকতে পারবি? ওকে না দেখলে তোর দিন ভালো কাটবে?’
–‘উঁহু।’
–‘তাহলে? এটাই তো ভালোবাসা রে পাগলা। তুই যদি এটাকে ভালোবাসা নাম দিতে না চাস তাহলে দিস না। তনুকে তোর ভালোবাসতে হবে না। তুই ওকে অভ্যাস বানিয়ে নে। ভালোবাসা চলে যায়। কিন্তু অভ্যাস সহজে যেতে চায় না।’
সাদাফ ভাইয়ের কথাগুলো এখনও ইহানের কাছে বাজছে। সাদাফ ভাই, যার সাথে ইহানের সেরকম অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কখনও গড়ে উঠেনি। সাদাফ ভাই আর আহান ভাইয়ের সম্পর্ক বন্ধুত্বের মতই ছিল। সেই সাদাফ ভাই কি-না তার জন্য এত বড় ত্যাগ স্বীকার করল! কাউকে কিচ্ছু জানতে না দিয়ে সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নিলো! সাদাফ ভাইয়ের ভালোবাসার প্রতিদান ইহান কীভাবে দিবে?
সেদিনই ফুপুরা সবাই চলে গেল। যাবার সময় সাদাফ শেষ বারের মত তনুর সাথে কথা বললো। তবে তনুকে কিছুই বুঝতে দেয়নি সে। তনুর মনে যেন কোন প্রশ্ন থেকে না যায় তাই সাদাফ তনুর সামনে সামান্য একটু মিথ্যা বললো।
–‘যাই তনু। ইনশাআল্লাহ, আবার কোনো একদিন আমাদের দেখা হবে। তখন আমাদের সম্পর্কটা অন্যরকম থাকবে। আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি। আর তাকেই বিয়ে করব। সেজন্য তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হলো। আমায় ক্ষমা কোরো কেমন?’
#সুখের_পাখি
৪২
তনু খুশিতে বাক-বাকুম করতে করতে ঘরে গিয়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। না থাক, মরা যাবে না। মরে গেলে তো সব শেষই। তনু বালিশ জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগলো।
–‘আমি এমনি এমনি কষ্ট পেয়ে মরছিলাম। যেখানে সাদাফ ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে সেখানে আমার প্যারা নেওয়ার কোন মানে ছিল! আমি বিয়ে করতে চাইলেও তো সে করতো না। মাঝ থেকে কয়টা দিন আমার জন্য অগ্নিপরীক্ষার মত গেল।’
তনু পা নাচাচ্ছে। গুনগুন করে গান গাইছে। সব সমস্যার সমাধান। এখন আর তার কোন চিন্তা নেই৷ সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে।
–‘আল্লাহ সাদাফ ভাইকে তুমি তার মনের মানুষের সাথে মিলিয়ে দিও। মানুষটা অনেক ভালো।’
কতক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে তনু উঠে পড়লো। ফুপুরা সবাই চলে গেছে। তনু ফুলি আপার সাথে কাজে হাত লাগাতে নিচে গেল। ফুলি বসার ঘরে বসে টিভি দেখছে। তনু গিয়ে ওর পাশে বসলো। আজ অনেক দিন পর আবার তনু ফুলি আপার সাথে নিজে থেকে গল্প করতে এসেছে।
–‘ফুলি আপা কী দেখছো?’
–‘নাটক।’
–‘কত নাটক দেখতে পারো তুমি? একটা মুভি টুভি লাগাও না। রোমান্টিক কোন মুভি।’
ফুলি চোখ বাঁকিয়ে তনুকে দেখল। মনে মনে বিরক্তও হলো। মেয়েটার বিয়ে ভেঙেছে এখনও একদিনও হয়নি। এখন ওকে এত খুশি লাগবে কেন? ওর তো এখন মন খারাপ হওয়া উচিত। কান্নাকাটি করা উচিত। বিয়ে ভেঙে যাওয়া কমখানি কথা নাকি? এই মেয়ে ওসব কিছুই না করে রোমান্টিক মুভি দেখতে চাইছে! এ কাঁদবে তো দূর। ওর মুখ দেখে মনেই হচ্ছে না ওর মনে কোন কষ্ট আছে। জীবনে এত বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে সে। ফুলি মনে মনে ভাবল,
–‘বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় কষ্টে মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে নাকি? কান্নাকাটি করছে না। মন খারাপ করছে না। এখানে এসে রোমান্টিক মুভি দেখতে। পাগল মেয়ে!’
–‘ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছ তুমি?’
–‘কী আর দেখমু? তোমারে দেখি।’
–‘কেন? আজ আমাকে নতুন দেখছ? নাকি আজ আমাকে অন্য দিনের থেকে সুন্দর লাগছে।’
–‘তনু তোমার মাথা ঠিক আছে?’
–‘ও মা! মাথা ঠিক থাকবে না কেন? আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে আমার মাথায় গোলমাল হয়েছে? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
–‘আজ অত বেশি কথা কাইতাছো কেন?’
–‘আমি তো সব সময়ই বেশি কথা বলি।’
–‘তোমার কষ্ট পাওয়া উচিত।’
–‘কেন?’
–‘আজই না বিয়ে ভাঙছে তোমার!’
তনু বড় করে হাই তুলে কাত হয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল।
–‘ও বাবা! বিয়ে ভেঙে গেলে মেয়েদের কষ্ট পেতে হয় নাকি? আমার কি এখন কান্না করা উচিত ফুলি আপা? কেঁদেকেটে চোখের পানি দিয়ে বন্যা বয়ে দেওয়া উচিত? নাকি বাড়িঘর ভাসিয়ে দেওয়া উচিত। তুমি যা বলবে তা-ই করব। তুমি বললে আমি এক্ষুনি চোখে কাঁচা মরিচ কচলে কান্না করা শুরু করে দিব। যতক্ষণ না আমার চোখের পানি দিয়ে ঘরবাড়ি ভেসে যাবে ততক্ষণ থামবো না। আর যদি থেমে যাই তাহলে তুমি আমাকে রান্নাঘর থেকে আরও মরিচ এনে দিবে, বুঝলে?’
ফুলি তনুর কথা শুনলো না। হাঁ করে তনুর কথাগুলো গিললো। চোখ কপালে উঠে গেছে ওর। এই মেয়ের হয়েছে কী? জ্বীন ভূত আছড় করে নাই তো? হ, জ্বীন ভূতই আছড় করছে। তাই তনু পাগলের মতো আবোলতাবোল বলছে। ফুলি ভয় পেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল,
–‘আম্মাজান! ও আম্মাজান! আইলেন না আপনে? ও আম্মাজান…
ভয় পেয়ে ফুলি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। তা শুনে তনু খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে সে। ফুলি আপা জব্বর ভয় পেয়েছে। ফুলি ওকে হাসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে আবার চেঁচাতে লাগল।
–‘ভাইজান! ও ভাইজান! আম্মাজান গো! আইসা দেখেন না, তনুরে ভূতে ধরছে। আল্লাহ গো বাঁচাও আমারে।’
ফুলি আপার মুখে ভূত কথাটা শুনে তনু ওকে আরও ভয় দেখাতে লাগল। জীবনে যত ভূতের মুভি দেখেছিল সবগুলো ভূতের অ্যাক্টিং করতে লাগল।
–‘ও ফুলি, ফুলিরে চিল্লাস ক্যান? আমারে তোর ভাল্লাগে না! পছন্দ হয় নাই। আমার লগে যাবি ফুলি? যাইবি নাকি ওই বড় তেঁতুল গাছের আগাম।’
–‘আম্মাজান…
সাবিনা আর ইহান আসতে আসতে তনু হাসি থামিয়ে একদম শান্ত হয়ে গেছে। ফুলি চোখ বড় বড় করে হাত নাড়িয়ে সবাইকে একটু আগের ঘটনাটা বলে যাচ্ছে। তনুও চুপ করে শুনছে আর মিটমিট করে হাসছে। ইহান শুনতে শুনতে কপাল কুঁচকে তনুকে দেখছে। সত্যিই তনু এরকম কিছু করেছে! কই এখন তো ওকে দেখে তেমন মনে হচ্ছে না।
সাবিনা সব শুনে তনুকে জিজ্ঞেস করল,
–‘তুই সত্যিই ফুলিকে ভয় দেখিয়েছিস তনু?’
–‘আমি! ফুলি আপাকে ভয় দেখিয়েছি! কখন? আমি তো ফুলি আপার চেচামেচি শুনে তোমাদের আসার একটু আগেই এলাম।’
–‘আম্মাজান তনু মিছা কথা কইতাছে।’
–‘ফুলি আপা, বানিয়ে বানিয়ে কেন ভূতের গল্প বলছো তুমি? আমি কখন তোমাকে ভয় দেখাতে এসেছিলাম!’
–‘আসোনি তুমি?’
–‘না।’
ফুলি কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে ওর।
–‘তাইলে তোমার রূপ ধইরা কে আসছিল আমার কাছে! আমার কাছে আইসা রোমান্টিক মুভি দেখতে চাইলো।’
তনু দু’পা এগিয়ে গিয়ে ফুলির কানে ফিসফিস করে বলল,
–‘ভূত পেত্নী নয়তো!’
সাবিনার যা বোঝার বুঝে গেছে। তনু ইচ্ছে করে ফুলির সাথে এরকম করছে। বিয়ে ভেঙে যাবার পর আজ কতগুলো দিন পর তনুটা এভাবে মন খুলে হাসছে দুষ্টুমি করছে। ওকে বিয়ে দিতে চাওয়াই সাবিনার ভুল ছিল। ইহান বুঝেও ফুলিকেই ধমক লাগালো।
–‘ ভূত প্রেত নিয়ে তোর এই বাড়াবাড়ি কিন্তু ওরা সহ্য করবে না। তুই ওদের নিয়ে মজা করবি আর ওরা কি তোকে ছেড়ে দিবে মনে করিস? হয় রাতের বেলা ছাদে নিয়ে তোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে। নয়তো তাল গাছের আগায় তোকে ঝুলতে দেখা যাবে।’
ফুলি এবার কেঁদেই ফেলবে। সাবিনা হাসি চেপে ইহানকে চোখ রাঙালো।
–‘ফুলিটাকে আর বিরক্ত করিস না তো তোরা। যার যার ঘরে যা। যা বলছি।’
সবাই চলে গেলে তনুও যাচ্ছিল। ইহান ওর হাত ধরে ফেললে তনু বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকায়। সাথে সাথে ইহান ওর হাত ছেড়ে দিল।
–‘ফুলিকে তুমি ইচ্ছে করে ভয় দেখাচ্ছিলে, তাই না?’
–‘জানেনই যখন তখন আবার জিজ্ঞেস করেন কেন।’
ইহানের সাথে তনুর একদম কথা বলতে ইচ্ছে করে না। অনেক দাম ওর। থাকুক ও ওর দাম নিয়ে। তনুরও কি দাম কম? যেচে পড়ে ভালোবাসার কথা অনেক বলেছে। আর না। তনু ইহানের সামনে থেকে চলে আসছিল। সে যেদিকে যায় ইহানও সেদিকে যায়। তনু ডানে যায়, ইহানও ডানে যায়। তনু পাশ কাটিয়ে বামে যায় ইহানও আবার সেদিকে যায়৷ বিরক্ত হয়ে তনু ইহানের মুখে দিকে চাইল। বলল,
–‘কী হয়েছে হ্যাঁ? এরকম করছেন কেন?’
–‘আমি আবার কী করলাম?’
–‘আমি যেদিকে যাচ্ছি আপনিও ওইদিকেই যাচ্ছেন কেন?’
–‘এই কথাটা তো আমিও তোমাকে বলতে পারি৷ আমি যেদিকে যাচ্ছি তুমিও সেদিকে কেন যাচ্ছ।’
–‘আজব তো!’
–‘সত্যিই আজব। এখন সরো আমাকে সাইড দাও।’
তনু নাক ফুলিয়ে দাঁত চেপে একপাশে সরে দাঁড়াল।
–‘নিন যান। জায়গা করে দিয়েছি। এবার আর এক মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকবেন না।’
তনুকে রাগাতে ইহানের মজা লাগছে। তনুটা এরকম কেন!
–‘ তুমি কি আমাকে আদেশ করছো! থাকব। আমি সারাদিন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। তোমার কোন সমস্যা? আমার বাড়ি। আমার মনের খুশি। যাব না আমি।’
–‘আচ্ছা, আপনাকে যেতে হবে না। থাকুন আপনি। সারাদিন সারারাত থাকুন। আমার কোন সমস্যা নেই। আপনার বাড়ি আপনার মনের খুশি। আমি গেলাম। আল্লাহ হাফেজ।’
এই বলে গটগট করে তনু চলে গেল। ইহান অবাক হয়ে চেয়ে রইল। পরমুহূর্তে হেসে ফেলল। ছোটখাটো বিষয় নিয়েও তনুকে রাগিয়ে দেওয়া যায়। বেচারি!
মিতা আর তনু কলেজের ক্যান্টিনে বসে আছে। বিয়েটা কীভাবে ভেঙেছে সেসব গল্প শোনাচ্ছে মিতাকে। তনুকে খুশি খুশি লাগলেও মিতার মুড অফ মনে হচ্ছে। মিতার উৎসাহ নেই দেখে তনু ওর হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
–‘কিরে, শুনছিস না।?’
–‘শুনছি বলে যা তুই।’
–‘আমাকে কিছুই করতে হয়নি। ফুপু আম্মাই যা করার করেছে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিতা বলল,
–‘সবাই তোর মত ভাগ্য নিয়ে দুনিয়ায় আসে না। তোর ফুপু তোর জন্য যতটা ভাবে অনেকের নিজের মা’ও ততটা ভাবে না।’
–‘দূর। কোন মা কি সন্তানের খারাপ চাইবে। তোর আজ কী হলো বল তো মিতা।’
–‘কিছু না। আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।’
–‘এখনই যাবি! সেদিন কতবার করে তোকে কল করলাম। কল তুললি না তুই।’
–‘ফোনটা এখন আমার কাছে নেই। আর কল করিস না।’
–‘নেই! কেন?’
মিতা কথা ঘুরিয়ে নিল। বলল,
–‘ওই ব্যাটা সাদাফের গার্লফ্রেন্ড ছিল?’
–‘যাবার সময় তো ওরকমই বলেছে।’
–‘তাহলে প্রথমে বলেনি কেন? আর গার্লফ্রেন্ড থাকতেও তোকে পটাতে চাইছিল কেন?’
–‘সেটাই তো আমারও প্রশ্ন। প্রথম সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন বলেছে গার্লফ্রেন্ড নেই। আর যদিও থাকে মানলাম সেটা আমার থেকে লুকিয়েছে। তাহলে মাঝ থেকে আমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছিল কেন?’
–‘আমার কী মনে হয় জানিস? ব্যাটা কারো জন্য তোকে সেক্রিফাইজ করেছে।’
–‘কার জন্য?’
–‘ইহান ছাড়া আর কে? আমার তো মনে হচ্ছে ইহানই বিয়েটা ভেঙেছে।’
–‘পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে তো ওকে! ইহান ভাই কিচ্ছু করেনি। করলে ফুপু আম্মা করেছে।’
–‘তুই বড় অবুঝ রে তনু।’
–‘আর তুই ভীষণ বুঝদার। ওই শয়তান বদের আমার বিয়ে ভাঙতে ঠেকা পড়েছে। আমাকে একটুও ভালোবাসে না ও। সেদিন আমাকে কুত্তার মতো তাড়িয়ে দিয়েছে। আস্ত একটা পাষাণ। ওর বুকের ভেতর মন নেই। আমাকে কষ্ট দেওয়ার সামান্যতম সুযোগ হাতছাড়া করে না ও। ও নাকি আবার আমার বিয়ে ভাঙছে। আমি মরে গেলেও ওর কিছু আসবে যাবে না বুঝলি।’
পুরোটা দিনের সমস্ত রাগ যখন তনু ইহানের শার্টের উপর ঝাড়ছিল তখন ইহান ওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল। তনু দু’হাতে ইহানের শার্ট চোখের সামনে ধরে আছে। চোখ মুখ কুঁচকে বলছে,
–‘মিতার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ও তো আর আপনাকে চিনে না, তাই ওসব কথা বলেছে। আপনি যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বদ তা তো আর ওর জানা নেই। আমি যদি পারতাম পাথর দিয়ে বাড়ি মেরে আপনার মাথা ফাটিয়ে ফেলতাম।’
–‘তাই নাকি!’
ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায় তনু। হাত থেকে শার্টটা নিচে পড়ে গেছে। ইহানকে দেখে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। ইহান ভাই তার কথা শুনে নিয়েছে! নিচে পড়ে থাকা শার্টের দিকে তাকাল তনু। আজ ওর চুরি ইহান ভাইয়ের কাছে ধরা পড়ে গেছে। তনু চুন্নি আজ হাতেনাতে ধরা খেয়েছে।
চলবে🍁
#জেরিন_আক্তার_নিপা