#সূর্যাস্ত
পর্ব-৮
শ্রাবণী মাথা বের করে দেখল আজ রোদ উঠেছে। কাছেপিঠে বাঘের দেখা নেই। সে ওপরে উঠে কিছু লাকড়ি আর পানি নিয়ে এলো। আজকের দিনটা বাকি গুঁইসাপ খেয়ে কাটিয়ে দেয়া যাবে। রোদ্দুরের এখনো হালকা জ্বর৷ সে ঘুমাচ্ছে।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল দুপুরের দিকে। রোদ্দুর উঠে বসে বলল, “ক্ষুধা লেগেছে।”
শ্রাবনী মাংস পুড়িয়ে রেখেছিল। সেটাই দিল। খাওয়ার পর রোদ্দুর যদিও বমি করে ফেলে দিল সব। শ্রাবনীর মনে হলো জ্বরের মুখে ভালো কিছু না খেলে ঠিক হবে না৷ ফলটল হলে কত ভালো হতো। কিন্তু এই জঙ্গলে ফল পাবে কোথায়!
অবশ্য সেসবের তেমন প্রয়োজন পড়ল না। রোদ্দুরের আর জ্বর বাড়ল না৷ সন্ধ্যার দিকে মনে হলো সে ঠিক হয়ে এসেছে। উঠে বসে রইল। শ্রাবনীও বসে আছে। আপাতত বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। সন্ধ্যা পরপর দূর থেকে কয়েকবার বাঘের ডাক শুনে ফেলেছে। এই এলাকাটা মোটেও নিরাপদ নয়।
রোদ্দুর বলল, “আমাদের এখান থেকে সরে যেতে হবে দ্রুত।”
“আমিও তাই ভাবছিলাম।” শ্রাবনী মাথা চুলকে বলল। তার চুলগুলো না আচড়ে, না ধুয়ে ভয়ানক জটা হয়ে গেছে। মুখও ধোয়া হয় না ঠিকমতো। শীতের দিনে ঠোঁট ফেটে চেহারা রুক্ষ হয়ে গেছে। তবু তার মুখটা দেখতে রোদ্দুরের খুব ভালো লাগে কেন যেন৷ চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় শুধু। তার বোধহয় পুতুল পুতুল মেয়ে পছন্দ নয়, একটু কঠিন ধরনের মেয়েই পছন্দ ছিল৷ এজন্য তার কারো সাথে সম্পর্ক টেকেনি৷ কিন্তু এই মেয়েটা তো বিবাহিতা। ডিভোর্স হয়েছে কি না তাও ভেঙে বলেনি। নিজের সম্পর্কে কিছুই বলতে চায় না।
সে শ্রাবনীর চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বলল, “কাল খুব ভোরে আমরা সব গুছিয়ে রওনা দেব। বাঘটা গতকাল এসেছিল দক্ষিণ থেকে। আমরা উত্তরের দিলে রওনা দেব। এখান থেকে যতটা পারা যায় সরে যেতে হবে।”
“খারাপ লাগছে। এত কষ্ট করে ঘরটা বানিয়েছি।”
রোদ্দুর একটু যেন খোঁচা দিতেই বলল, “আসল ঘর ছেড়ে আসতে কষ্ট লাগেনি, এটা ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে!”
শ্রাবনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার কোনোদিন কোনো ঘর ছিল না।”
“মানে?”
“বাদ দিন। লোকালয় পেলে আমি চলে যাবেন তো?”
“তা তো যাবই। এই প্রেশার নেয়া যাচ্ছে না। কেন তুমি যাবে না?”
“হয়তো। জানি না। আমার জীবনটা বড় অনিশ্চিত।”
“আমাকে তুমি সব খুলে বলতে পারো শ্রাবনী।”
“বলব সময় হলে। এখন চলুন একটু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।”
“এই বিদঘুটে জিনিসটা আর খেতে ইচ্ছে করছে না। জ্বরে মুখ এমনিতেই তেঁতো!”
“একটু খান। নইলে কাল হাঁটতে পারবেন না।”
দুজন কোনোরকম খাবার মুখে গুঁজে শুয়ে পড়ল। ঘরটা আজ আলো হয়ে আছে আগুন জ্বালানোতে। তবে বেশি আগুন জ্বাললে ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসে। রান্নার সময় তাই ঘরের দরজার দিকটা শ্রাবনী খুলে দেয় রিস্ক নিয়ে হলেও। শুয়ে পড়বে বলে আগুনে লাকড়ি অল্প দিয়েছে। একটু একটু পুড়লে ধোঁয়া কম হয়।
সে চোখ বুজে অনেকক্ষণ শুয়েও ঘুম আনতে পারল না৷ পাশ ফিরে দেখল রোদ্দুর তার দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে। শ্রাবনী গায়ের কাপড় টেনে ঠিক করল। রোদ্দুর বোধহয় লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। শ্রাবনীর হঠাৎ ভীষণ ইচ্ছে হলো রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরতে। একটু কাঁদতে ওর বুকে মাথা রেখে। পৃথিবীর আঘাতে সে ভুলতে বসেছে তার একটা কোমল মন আছে যে ভালোবাসা চায়৷
________________________
সকাল হতেই তারা রওনা হলো উত্তর দিকে। এদিকে যত যাচ্ছে শুকনো কমে কাদামাটি তত বাড়ছে। শ্বাসমূলের ঘনত্ব এত বেশি যে হাঁটা দায়। একটু পরপর নালা পার হতে হচ্ছে। তার ওপর সকাল থেকে কিছু না খাওয়ায় তাদের গতি ধীরে ধীরে কমছে। অনেকখানি যাওয়ার পর শ্রাবনী বসে পড়ল, “একটু জিরিয়ে নেই।”
“হুম।” রোদ্দুরও পাশে বসল হাত পা ছড়িয়ে। তাদের সামনে খাল। খালের অপর পাড়ে দুটো হরিণ পানি খাচ্ছে আপন মনে।
রোদ্দুর বলল, “কী সুন্দর তাই না?”
শ্রাবনী হেসে বলল, “আমার তো ওদের ধরে খেয়ে নিতে মন চাইছে।”
“তুমি নিষ্ঠুর একদম।”
শ্রাবনী প্রথমে হাসলেও একটু পর গম্ভীর হয়ে গেল। স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে পারল না দু’জন আর। আবার উঠে হাঁটা ধরল সামনে। একটু পর জোয়ারের পানি এসে প্লাবিত করে দিল বনটা। ওরা সে সময়টা গাছের ওপর বসে রইল। বিষন্ন প্রকৃতি বিলাস করছে যেন! রোদ্দুর এর মাঝে গাছের মোটা ডালে কায়দা করে পাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে ফেলল। ভারি ভালো লাগল কফিটুকু খেতে।
জোয়ারের পানি যখন সরে গেল, তখন দেখা গেল কাদাপানিতে অনেকগুলো মাছ। শ্রাবনীর মুখে হাসি একান ওকান হয়ে গেল। তবে মাছ ধরার কায়দা কারোই জানা নেই। তাই পিচ্ছিল মাছ কাদার মধ্যে ধরতে গিয়ে তারা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠল। ঘেমে একাকার হয়ে মাছ রাঁধতে বসল।
অবশেষে সব কষ্ট সার্থক হলো মাছগুলো খেতে পেরে। গত দু’দিন গুঁইসাপ খেয়ে মুখে যে অরুচি ধরে গিয়েছিল সেটা মাছের নরম মাংসে কেটে গেল। তৃপ্তি নিয়ে খেল দুজন। তারপর আবার হাঁটতে লাগল খালের পাড় ধরে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু