সূর্যাস্ত,পর্ব:৬+৭

#সূ্র্যাস্ত
পর্ব- ৬

রাত পৌনে আটটা বাজে। দুজন আগুন জ্বালিয়ে মুখেমুখি বসে আছে। হালকা শীতের হাওয়ার ঝাপটা শরীর শীতল করে দিচ্ছে। কত কত জন্তুত ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। একটা কান্নার মতো শব্দ শোনা যাচ্ছে। কে জানে কিসের! শ্রাবনী বলল, “হায়েনার কান্না হয়তো।”

রোদ্দুর হেসে বলল, “হায়েনা কাঁদে?”

“জানি না। বললাম কারন মনে হলো হঠাৎ।”

রোদ্দুর কিছু না বলে হাসলো। ঘড়ি দেখে বলল, ” সেই কখন রাত হয়েছে। এখনো আটটা বাজেনি।”

“তো কী? আমার রাতই ভালো লাগে।”

“এত সাহস কোথায় পাও?”

“সত্যি শুনতে চাও?”

“হ্যাঁ বলো।”

“বিশ্বাস করবে না হয়তো।”

“আরে বলো!”

“আমার মৃত্যুভয় নেই বললেই চলে।”

শ্রাবণীর ঠান্ডা গলা শুনে রোদ্দুরের হঠাৎ কেমন গা শিরশির করে উঠল৷ এ আবার কেমন কথা! মায়াও হলো প্রচন্ড। জিজ্ঞেস করল, “কেন শ্রাবণী?”

শ্রাবনী মৃদু হেসে বলল, “পিছুটান নেই তাই।”

“তাই বলে এই বয়সে…” রোদ্দুরের অদ্ভূত লাগছে।

“আসলে কী বলো তো, আমি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করি। আর ভয় তখনই পেতাম যখন কিছু হারানোর ভয় থাকত। যেহেতু নেই তাই যা হবে হোক, ব্যাপার না। তবে বাঁচতে সবাই ভালোবাসে। আমিও। তাই বলে ভয়ে কুঁকড়ে বাঁচতে চাই না।”

“ব্রেভো!”

“তুমিও তো সাহসী।”

“তোমার মতো নই। চলো ঘরে যাই। যে কোনো সময় টাইগার বাবাজি চলে আসবে। তখন আর রক্ষা থাকবে না।”

শ্রাবনী রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার ঘরে দুজনের জায়গা হবে না। তাছাড়া আমি তোমার সাথে সেফ থাকব তেমন কোনো গ্যারেন্টি নেই।”

রোদ্দুর ভীষণ আহত হলো কথাটা শুনে। সে শ্রাবনীর থেকে এরকম কথা আশা করেনি কোনোভাবে। ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সহজ গলায় সে বলল, “তুমি একটু আগে বলেছিলে আমরা বন্ধু। সত্যি বন্ধু ভাবলে এমনটা বলতে পারতে না। ধন্যবাদ। তোমার সাথে থাকার কোনে মানে হয় না। আমি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে নেব।”

রোদ্দুর উঠে দাঁড়ালো। শ্রাবনী কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। অতটা ভাবেনি। এখন মনে হচ্ছে খুব ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু রোদ্দুরকে সে কী বলে আটকাবে? তার মুখে কিছুই এল না। চুপচাপ বসে রইল। অভিমান জমতে শুরু করল। একটা কথা বলাতে এরকম রিয়েক্ট করার মানে কী? চলেই যাবে একেবারে?

রোদ্দুর সত্যি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলল। শ্রাবনীর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল৷ এই মেয়ে কী ভাবে তার কোনো ঠিক নেই।

শ্রাবনী অনেক চেষ্টার পর বলল, ” বন্ধু আমি তোমাকে মানি। তুমি আজ রাতটা আমার ঘরে থাকো। আমি বাইরে থাকব। এভাবে রাতের বেলা তুমি কোথায় যাবে? শেষমেশ বিপদে পড়বে।”

“তুমি ভুলে যাচ্ছ শ্রাবনী, আমি একা থাকতে এসেছি। তোমার ভরসায় আসিনি। বিপদে পড়লে সেটার মোকাবিলা একাই করব।”

রোদ্দুর চলে গেল। চোখের আড়াল হওয়ার সাথে সাথে শ্রাবনী কেঁদে ফেলল। এত খারাপ লাগছে! তার নিজের দোষে এরকমটা হলো। তার কপালটাই খারাপ। তারচেয়েও খারাপ মুখের ভাষা। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে গেলো সে। কতক্ষণ এভাবে ছিল জানে না, মুখ তুলে চোখ মুছে দেখল রোদ্দুর তার সামনে বসে আছে। মুখ টিপে হাসছে। কি সুন্দর লাগছে তাকে! আগুনের আলোয় মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। চোখে চাপা দ্যুতি। শ্রাবনীর মনটা ভরে গেল।

তবে সে দারুণ লজ্জা পেল। আবারও হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফেলল। এই ছেলে কখন এসেছে? রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, “আরও কাঁদা বাকি আছে? পয়তাল্লিশ মিনিট একটানা কেঁদেছ।”

“তুমি আবার ফিরে এলে কেন?”

“আমার লাকি ব্যান্ডটা তোমার ঘরে ফেলে গিয়েছিলাম। সেটা নিতে এসেছি। এসে দেখি এই অবস্থা!”

“ওহ।”

“এসে কি ভুল করে ফেলেছি?”

শ্রাবনী কিছু বলল না। সে তখনো মুখ ঢেকেই রেখেছে।
রোদ্দুর শ্রাবনীর দিকে ঝুকে বলল, “চলে যাব?”

শ্রাবনী তাড়াতাড়ি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “না, যেও না।”

“ঘুমুব কোথায়?”

“আমার ঘরেই।”

“সেফ থাকবে তো?”

শ্রাবনী থমথমে মুখে বলল, “বেশি কথা বলবে না ছেলে, আমারটা আমি বুঝব।”

.
সকালের মিষ্টি রোদে বসে আছে দুজনে। চারপাশে পাখির কলকাকলি। মাত্রই খাওয়া সেরেছে তারা। কী এক পাখির ডিম পেয়েছে সেটার অমলেট, রোদ্দুরের আনা দুটো আপেল আর কফি। শীতের দিন বলে বাতাস হিম ধরানো। দু’একটা খরগোশ এদিকে এসে আবার ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। চমৎকার একটা সকাল।

রোদ্দুর বলল, “বাড়িতে থাকলে কী করতে এ সময়?”

শ্রাবনী জবাব না দিয়ে বলল, “তুমি কী করতে?”

“আমি কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমোতাম।”

“চাকরি বাকরি করো না?”

“আপাতত করছি না, তবে একটা চাকরি হওয়ার কথা। দেখি।”

“ওহ।”

“যাই বলো না কেন, এই রোদটার তুলনা হয় না।”

“হ্যাঁ।”

“তুমি বাড়িতে থাকলে কী করতে বললে না?”

শ্রাবনী একটু হেসে মাথা নিচু করে বলল, “নাস্তা বানাতাম।”

“বাড়িতে সব কাজ করতে?”

“হ্যাঁ। আর কেউ নেই করার।”

রোদ্দুর হুট করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি বিয়ে হয়েছে শ্রাবনী? স্বামীর সাথে ঝগড়া করে পালিয়ে এসেছ?”

শ্রাবনীর ভীষণ হাসি পেল কথার ধরণে। সে কোনোরকম হাসি চেপে রোদ্দুরের দিকে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রোদ্দুর অধৈর্য হয়ে বলল, “বললে না?”

শ্রাবনী ইচ্ছে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের দিলে তাকালো।

রোদ্দুর বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল, “তুমি আগে বলোনি কেন তুমি বিবাহিতা?”

“তোমার হঠাৎ একথা কেন মনে হলো?”

“ওইযে বললে সব কাজ করতে। তাই ভাবলাম হয়তো বিয়ে হয়েছে, সংসারের সব তুমিই করো।”

শ্রাবনী কৌতুকের স্বরে জিজ্ঞেস করল, “বললে কী হতো আর না বলেই বা কী হয়েছে?”

“কিছু না।”

শ্রাবনী দেখল রোদ্দুরের কপালে ভাঁজ পড়েছে। বেচারা কষ্টই পেল। শ্রাবনীর ব্যাপারটা যেমন ভালো লাগলো, তেমনি ভয়ও হতে লাগলো। যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে তো? রোদ্দুর কি তাকে পছন্দ করে? বা তারচেয়ে বেশি কিছু? শ্রাবনী চোখ ঘুরিয়ে নিল। এসব ভাবলে চলবে না তার। যে জীবনে অভ্যস্ত হয়েছে সেটা মানিয়ে নেবে সে। জঙ্গলে থাকতে না পারলে লোকালয়ে কোথাও চলে যাবে। দরকার হলে লোকের বাড়িতে কাজ করে খাবে। তবুও মায়ায় জড়াবে না কোনো। জীবনে এক মায়া করতে গিয়ে সে বুঝেছে পৃথিবীর প্রানীগুলো বড় স্বার্থপর। কেউই নিজের সুবিধাটা ছেড়ে অন্যের কথা ভাবে না। আর তার বিরস জীবনে সে অন্য কাউকে জড়াবে না। রোদ্দুরের মতো ভালো ছেলেকে তো নয়ই।

শ্রাবনীর ভাবনার রেশ কাটলে সে সামনে তাকালো। রোদ্দুর নেই। তার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। পুরু হয়ে থাকা শুকনো পাতার স্তুপের ওপর দিয়ে সে অস্থিরভাবে হাঁটছে। শ্রাবনীর কেমন নিরাপত্তা বোধ হয় রোদ্দুর আশেপাশে থাকলে। মনে হয় সারাক্ষণ মানুষটা তার সাথে থাকলে পৃথিবীর অন্যকিছু ভাবতে হবে না। সে তাকে আগলে আগলে রাখবে।

তবে শ্রাবনী স্বার্থপর হবে না। সে রোদ্দুরের জীবনেও প্রবেশ করবে না। মনে মনে শ্রাবনী ঠিক করে ফেলল সে রোদ্দুরকে এটাও বলবে না যে সে বিবাহিত নয়।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#সূর্যাস্ত
পর্ব-৭

আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। সকাল থেকে ঘন কুয়াশা চারদিক ঘিরে রেখেছে। অনেকটা বেলা হয়ে এলেও যখন সূর্যের দেখা পাওয়া গেল না, তখন ওরা বুঝতে পারল আজকের দিনটা এমনই কাটবে। পশুপাখিরাও নিস্তেজ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনিতে হয়তো বনে সাপের যন্ত্রণায় ঘোরা যেত না, শীতের দিন বলে রক্ষা। বেশিরভাগ সাপেরা পেটপুরে খেয়ে শীতনিদ্রায় মগ্ন। আজ পাখিও ডাকছে কম। সব মিলিয়ে কেমন মন খারাপ করা দৃশ্য।

রোদ্দুর-শ্রাবনী আগুন জ্বালিয়ে তার সামনে মুখোমুখি বসেছে। কথাবার্তা বলছে না তেমন। শ্রাবনীর গলা খসখস করছে। বেশ কিছুদিন ধরেই লবণ পানি খেতে হচ্ছে। সত্যিকার পানির স্বাদ ভুলতে বসেছে যেন! এই পানি খেয়ে আবার অসুখ না বেঁধে যায়! যদিও পুরোপুরি লবণাক্ত না, হালকা। তবু অস্বস্তি হয়।

হঠাৎ আশেপাশের পাখির ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে গেল। একটা পোকাও আর শব্দ করছে না৷ আবার বাঘের উপস্থিতি? শ্রাবনী স্তব্ধ হয়ে চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে কোনোমতে তাকাল। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোদ্দুর তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সামনে। তারপর ঠেলে উঠিয়ে দিল গাছে। ওরা গাছে ওঠার মিনিটখানেকের মধ্যেই সেই বাঘটাকে দেখা গেল সেখানে। বরাত জোরে গতবার বেঁচে গেছে, এবারও একেবারে মুখে পড়েনি। কিন্তু পড়তে তো হবে একসময়৷ এই গহীন জঙ্গলে যার রাজত্ব তার সাথেই লড়ে কতদিন বাঁচতে পারবে ওরা? তরচেয়ে ভালো করে বললে কতক্ষণ বাঁচবে?

বাঘটা কিন্তু এবার গেল না। একেবারে গাঁট হয়ে বসে রইল গাছের নিচটাতে। গাছে ওঠারও চেষ্টা করেছিল, কিন্তু খাড়া গাছ হওয়ায় সুবিধা করতে পারেনি।

বসে থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে গেল। কিন্তু ভয়ে নড়তে পারল না। একটু নড়লেই বাঘটা তেড়ে আসতে চায়! পুরোটা দিন এভাবেই কাটল। জীবন হাতে নিয়ে বসে রইল দু’জন। ক্ষুধায় শরীর ভীষণ দুর্বল। আজ সকালে তেমন কিছু পেটে পড়েনি। রোদ্দুরের স্টকে বিস্কুট ছিল, তাই খেয়েছে। এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই ওদের কাছে।

রাত যখন হয়ে এসেছে, দিনের শেষ আলোটুকু নিভে গেছে, চারদিকে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুয়াশায় ছেয়ে গেছে বন। বাঘটাকেও ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না। শুধু ভারী নিঃশ্বাসের মৃদু গর্জন শোনা যাচ্ছে। শ্রাবনী রোদ্দুরের হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। দু’জনেই দু্র্বল, মনোবল ভেঙে গেছে। আসন্ন মৃত্যুর জন্য এক প্রকার প্রস্তুত। রোদ্দুর ফিসফিসিয়ে বলল, “আচ্ছা আমরা তো এক গাছ থেকে আরেক গাছে যেতে পারি চাইলে!”

“এই অন্ধকারে!”

“আগেই ব্যাপারটা মাথায় এসেছিল, কিন্তু তাহলে তো বাঘটাও সাথে সাথে যেত। লাভের লাভ কিছু হতো না। এখন বাঘটাকে দেখো, ঝিমিয়ে পড়েছে। আমরা আস্তে আস্তে চলে গেলে টের পাবে না।”

“শব্দ না করে কেমন করে যাব? আর এভাবে কতদূরই বা যাব!”

বেশিদূর যেতে হবে না৷ কয়েকটা গাছ পার হলেই নিচে নেমে দৌড় দেব৷ তোমার ঘর পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলে আর চিন্তা নেই। বাঘ ঢুকতে পারবে না সেখানে।”

“কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না!”

“আমি আলো থাকতে ভালোমতো দেখে রেখেছি কোন ডাল থেকে কোন ডালে যাওয়া যাবে। তুমি শুধু শক্ত করে আমাকে ধরে সাথে সাথে আসতে থাকো।”

“ঠিক আছে।” শ্রাবনী যদিও জানে এভাবে হবে না তবু মৃদু আশা নিয়ে এগিয়ে গেল। এভাবে বসে থাকলে এমনিতেই একটু পর দুর্বল হয়ে নিচে পড়ে মরতে হবে।

রোদ্দুর যতটা সহজ ভেবেছিল ব্যাপারটা ততটাই কঠিন। গাছগুলো একটা অন্যটার সাথে জড়িয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু চিকন ডালগুলোই বেশি ছড়িয়েছে। সেই ডাল দুজনের ভার নিতে পারবে না৷ রোদ্দুর আগে গেল। ততক্ষণে চাঁদের হালকা আলো দেখা দিয়েছে। অন্ধকার চোখে সয়ে এসেছে। শ্রাবনী যথাসম্ভব নিঃশব্দে রোদ্দুরের পিছু পিছু গেল। তবু পাতার খসখস হয়েই গেল। ডালে ডালে বাড়ি খেয়ে শব্দ হলো। বাঘটা একবার ডাকল শুধু। বোধহয় কল্পনাও করেনি ওপরে অন্যরকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে!

একটা গাছ পেরিয়ে ওদের মনোবল একটু বাড়ল। ধীরে ধীরে আরেকটা গাছ পার হলো। তারপর আরেকটা৷ এবারের গাছটা থেকে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ওরা এখন বাঘের থেকে প্রায় চৌদ্দ পনেরো ফুট দূরে গেছে। এই গাছ থেকে শ্রাবনীর ঘরের দূরত্ব মাত্র কয়েক হাত। ঝাপ দিয়ে ওরা নামার সাথে সাথে লাফিয়ে এলো বাঘটাও। এক সেকেন্ডের জন্য ওরা ঘরটার সরু ফোকর দিয়ে শরীর গলিয়ে দিতে পারল। বাঘটা শুধু রোদ্দুরের একপাটি জুতো কামড়ে ধরতে পারল।

ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্যান্য দিন কাঠকুটো জড়ো করে আলো জ্বালায় ওরা। আজ সেটা হয়নি। বাইরে তবু জ্যেৎস্নালোক ছিল, এখানে গাঢ় মিশমিশে আঁধার ওদের গ্রাস করতে আসছে যেন!

পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ওরা। বুকের ভেতর এখনো ধুকপুক করছে। একে অপরের হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। নিচে নামতেই আরেকটা শব্দ ওদের কানে এলো। কেমন ফোঁসফোঁস ধরনের শব্দ। ঠিক সাপের নয়, একটু অন্যরকম। গভীর স্বর। কিন্তু ওরা ঠিক বুঝতে পারল ভিতরে অন্যকিছু আছে। কী সেটা? শেয়াল? নিশ্চিত গর্ত পেয়ে ঢুকেছে। কামড়ে দেবে না তো?

রোদ্দুরের কাছে দেশলাই ছিল। কিছু শুকনো লাকড়িও জড়ো করা ছিল ঘরে। হাতড়ে সেগুলো খুঁজে বের করে জ্বালিয়ে ফেলল সে। আলো জ্বলে উঠতেই জিনিসটাকে দেখে আঁতকে উঠল দু’জন। শ্রাবনী লাফিয়ে উঠে রোদ্দুরের হাতটা খামচে ধরল। ঠিক এই জিনিসটাকে ও ভীষণ ভয় পায়!

_________________________

শ্রাবনীর বিছানার ওপর আরামসে শুয়ে আছে একটা প্রামাণ সাইজের গুঁইসাপ। কমোডো ড্রাগন বলে এগুলোকে। পেটমোটা সবুজাভ শরীরের বিচ্ছিরি দেখতে প্রানীটা এই মুহুর্তে লেজ নাড়াচ্ছে আর ওদের দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে চাইছে। ওরা দুজন আর গুঁইসাপটা একদম মুখোমুখি। বাইরে বাঘ। যাওয়ার জায়গা নেই কোনোদিকে। এত অসহায় বোধহয় একটু আগে গাছের ওপর থাকতেও ছিল না।

ওপরে বাঘের তর্জন গর্জন জানিয়ে দিল সে এখনো সেখানেই আছে। আচ্ছা গুঁইসাপটাকে বের করা যায় না কোনোভাবে? হয়তো যেত, যদি ঘরটা বড় হতো। এত ছোট জায়গার মধ্যে কিছু করতে গেলে হতাহতের সম্ভাবনা অনেক বেশি। শ্রাবনীর মনে হলো তারা আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না। স্বল্প আলোতে রোদ্দুরের মুখটা একবার দেখার চেষ্টা করল সে। এই একমাত্র মানুষ যার জন্য তার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি মায়া হচ্ছে! পৃথিবীতে আরও কিছুদিন বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে!

শ্রাবনী যখন ধরেই নিয়েছে সব শেষ, তখন রোদ্দুর ভীষণ সাহসের একটা কাজ করে ফেলল। একটা লাঠি দাঁড় করানো ছিল ঘরে। খুব মজবুত নয়, মোটামুটি আত্মরক্ষার জন্য আনা। গতকাল রোদ্দুরই নিয়ে এসেছিল সেটা। শ্রাবনীকে দিয়ে বলেছিল, “কোনোভাবে যদি তোমার নিজের জন্য আমাকে বিপজ্জনক মনে হয়, তো এটা দিয়ে মেরে ফেইলো।”

সেই লাঠি এভাবে কাজে লাগবে কে জানত! রোদ্দুর ঝটপট সেটা টেনে নিয়ে গুঁইসাপের মাথায় ধাম করে কয়েকটা বাড়ি দিল পরপর। গুঁইসাপটাও কম যায় না। লাফিয়ে এলো প্রায়৷ কামড়ে দিতে নিল রোদ্দুরের হাত। রোদ্দুর পিছিয়ে গেল বলে লাগল না। কিন্তু গুঁইসাপটা ঘুরে গিয়ে লেজ দিয়ে প্রচন্ড বাড়ি দিল রোদ্দুরের পায়ে। একেবারে হাড়ে গিয়ে লাগল যেন! ব্যথাটা চামড়া জ্বালিয়ে দিল একেবারে। কিন্তু সেটাকে আপাতত পাত্তা না দিয়ে রোদ্দুর তার হাতের লাঠিটা দিয়ে আরও কয়েকটা মোক্ষম আঘাত করল গুঁইসাপের গায়ে। এক পর্যায়ে লাঠিটা দু’টুকরো হয়ে গেল।

রোদ্দুর হাপাচ্ছে। গুঁইসাপটাও নিস্তেজ। হয়তো মরে গেছে। রক্ত বের হচ্ছে ওটার শরীর থেকে। বিনা যুদ্ধে মরেনি যদিও। রোদ্দুরের পায়ে আরও দুটো লেজের বাড়ি লেগেছে। বসে পড়েছে সে। এমনিতেই সারাদিনের না খাওয়া। শ্রাবনী এখনো ভীত চোখে একবার রোদ্দুররের দিকে, একবার সাপটার দিকে তাকাচ্ছে! খন্ডযুদ্ধে সে নীরব দর্শক ছিল, তবে তারও স্নায়ুতে ভয়াবহ চাপ পড়েছে। সেও বসে পড়ল।

একটু পর খেয়াল করল রোদ্দুরের পা থেকেও রক্ত বের হচ্ছে, হালকা নীল জিন্সের ওপর কালচে ছোপ বড় হচ্ছে। রোদ্দুরের ব্যাগটা ঘরের ভেতরেই ছিল। শ্রাবনীকে প্রথমদিন দেখিয়েছিল সেখানে ফার্স্ট এইড আছে। সে নিজেই রোদ্দুরের পা টেনে নিল। প্যান্ট গুটিয়ে কিছুদূর তুলতেই প্রথম আঘাতটা চোখে পড়ল। দগদগে আঘাতটা লালচে রক্তের ধারায় বিভৎস দেখাচ্ছে! শ্রাবনী সেখানটা এন্টিসেপ্টিক দিয়ে মুছে ব্যান্ডেজ করে দিল। কোনোদিন এই কাজ করেনি বলে বেশ বেগ পেতে হলো। রোদ্দুর ততক্ষণে দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজেছে। বোধহয় বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কথা বলার ক্ষমতা নেই। শ্রাবনী ওর তিনটা আঘাতের জায়গাই পরিষ্কার করে দিল। গুঁইসাপটা কী করা যায় এবার সেই চিন্তা করতে লাগল। ওপরে উঠিয়ে দিলে বাঘের মুখে তাকেও পড়তে হবে। এটাকে সাথে নিয়ে বিশ্রামও করা যাবে না। একেবারে তার বিছানার ওপর মরেছে!

হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এলো তার। যদিও ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে তবুও একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী? এই মুহূর্তে এরচেয়ে ভালো বুদ্ধি বোধহয় আর হতে পারে না। তবে রোদ্দুরকে একবার জিজ্ঞেস করে নিলে ভালো হয়। সে রোদ্দুরকে ধীরে ধীরে ডাকল, “শোনো না! একটা জরুরি কথা৷ শুধু শুনে হ্যাঁ না বলবে।”

“বলো শ্রাবনী, শুনছি।”

“গুঁইসাপটা কেটে ওটার মাংস খেলে হয় না? আমাদের কাছে খাওয়ার আর কিছু নেই।”

এমনিতে কথাটা শুনলে হয়তো রোদ্দুর বমি করে দিত। কিন্তু এই মুহূর্তে শরীরের কাহিল অবস্থায় প্রচন্ড ক্ষুধায় তাকে যদি এনাকোন্ডার মাংস খেতে দেয়া হয়, সে বোধহয় খেয়ে নেবে। বলল, “হবে না কেন? এটাকে ফেলে দেয়া বরং বোকার মতো কাজ হবে।”

শ্রাবনী গুঁইসাপের কিছুটা চামড়া প্রথমে ছাড়াল। এই শ্রাবনীই কিছুদিন আগেও প্রানীহত্যার বিরোধী ছিল। আজ পরিস্থিতি কী না করাচ্ছে! চামড়াটা এত মোটা! শ্রাবনী শীতের মধ্যেও ঘেমে একাকার হয়ে গেল। পিঠের দিকের কিছু অংশে চামড়া ছাড়িয়ে মাংস বের করল। সেগুলো ছোট টুকরো করে ঘরের মাঝামাঝি আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিল। তার আগে একটু লবণ পানিতে ভিজিয়ে নিল যাতে রক্তটা পরিষ্কার হয় আর জিনিসটা খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ঘরে পানি আগেই ছিল, রোদ্দুরের আনা এক বোতল আর শ্রাবনীর কুড়িয়ে পাওয়া দুই বোতল ভর্তি।

দুজনে ডিনার সেরে নিল গুঁইসাপের মাংস দিয়ে। সেটা খেতে যদিও জঘন্য, তবে প্রচন্ড ক্ষুধার মুখে অতটাও বিস্বাদ লাগল না।

খাওয়ার ওর গুঁইসাপের বাকি অংশ একধারে পাতা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখল শ্রাবনী। রক্ত এতক্ষণে মাটি শুঁষে নিয়েছে। কালচে রক্তের ওপর রোদ্দুরের একটা শার্ট বিছিয়ে দিয়ে ওকে শুইয়ে দিল। নিজে কোনোমতে ছোট্ট সোফাটায় জায়গা করে নিল।

রাতে শ্রাবনীর ঘুম ভাঙল গোঙ্গানির শব্দে। প্রথমটায় ওর বুকটা ধড়াস করে উঠলেও পরে বুঝতে পারল শব্দটা রোদ্দুর করছে। সে কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিতেই বুঝল রোদ্দুরের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ভুলভাল বকছে ছেলেটা। আগুন নিভে গেছে। ঘরে আগুন জ্বালানোর মতো আর লাকড়ি অবশিষ্ট নেই। বাইরে যাওয়ারও সাহস হলো না। আঁধারেই সে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে রোদ্দুরের ফার্স্ট এইড বক্স থেকে পাওয়া জ্বরের ঔষধ খুঁজে খাইয়ে দিল তাকে। তারপর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিল।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here