সূর্যাস্ত,পর্ব:৪+৫

#সূর্যাস্ত
পর্ব- ৪

সকাল সকাল উঠে শ্রাবনী কাজ শুরু করলো। আগুন জ্বালানোতে খাবার যোগাড় করতে বেশি সমস্যা হয় না। দুপুরের মধ্যে কাজ অনেকখানি এগিয়ে গেল। আট ফুট দৈর্ঘ্য, পাঁচ ফুট প্রস্থ আর সাত ফুট গভীর একটা গর্ত খুড়ে ফেলল। গর্তের ভেতর মাটি দিয়েই একটা উচু বেড তৈরি করল ঘুমানোর জন্য, একটা সোফা, একটা টেবিল বানালো। দেয়ালে ছোট ছোট খোপ বানালো আলো জ্বালিয়ে রাখার জন্য।

তার কাজ শেষ হলো সন্ধ্যায়। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। শরীরে এতটুকুন শক্তি নেই। এত পরিশ্রম জীবনে করেনি সে। বাড়িতেও কাজ করতে হতো। মা মারা যাওয়ার পর বাড়ির সব কাজ সেই করেছে। কিন্তু সেটা কখনোই এত পরিশ্রমের ছিল না। শ্রাবনী খুব বেশি ভাবতেও পারলো না। ঘুমিয়ে পড়ল দ্রুতই।

.
রোদ্দুর ভারী ব্যাগ কাঁধে সারাদিন ঘুরেছে। রাতে শীত লাগছে প্রচন্ড। দুটো সুবিধামতো গাছ খুঁজে নিয়ে হ্যামক ঝুলিয়ে নিল তাতে। মোটা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। নিশুতি রাতে ভয়ানক সব প্রানীর ডাকে বার বার কেঁপে কেঁপে উঠলেও বেশ লাগছিলো তার। এই তো জীবন।

সকালে ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। রোদ্দুর উঠে কিছু শুকনো খাবার আর চা বানিয়ে খেল। তারপর আবার রওনা দিল অন্যদিকে। তার কিছুদিন বনে বনে ঘোরার ইচ্ছে আছে।

.
দুপুরের দিকে শ্রাবনীর ঘর তৈরি একদম শেষ হলো। ঘরের ফাঁকা জায়গার উপরে কতগুলো চিকন গাছের ডাল বিছিয়ে দিয়েছে। গাছগুলো সম্ভবত ঝড়ে ভেঙে পড়েছিল। খুঁজে পেয়ে কাজে লাগিয়েছে। গাছগুলোর ওপর পাতা ছড়িয়ে তার উপরে কাদামাটির লেপ দিয়েছে। সেগুলো শুকানোর পর সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছে শুকনো পাতা। বাইরে থেকে এখন বোঝা সম্ভব না ভেতরে কিছু আছে। শুধু একপাশে সামান্য ফাঁকা রেখেছে ভেতরে ঢোকার জন্য। সেখান থেকে সিঁড়ির মতো কেটেছে। বলতে গেলে দারুণ একটা ঘর হয়েছে। শ্রাবনীর মনটা এত খুশি হলো যে তার ইচ্ছে করলো সারাজীবন এখানেই থেকে যেতে।

রাতের খাবার সারলো একটা ছোট্ট হরিণের বাচ্চা দিয়ে। এখানে বাঁচতে হলে মায়া করা চলবে না, বুঝে গেছে শ্রাবনী। রাত যদিও হয়নি এখনো, আলো কিছু সময় বাকি। শ্রাবনী নিজের ঘরে চলে গেল। মাটির খাটের ওপর নরম পাতার বিছানা করেছে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো তার নানান কথা।

চারদিকে অদ্ভূত রকমের নিস্তব্ধতা। নাগরিক কোলাহলের চিহ্নমাত্র নেই৷ শুধু অজস্র পাখির ডাক, বানরের কিচকিচ, কখনো বা অন্য জন্তুর অচেনা সব ডাক। প্রকৃতি তার সমস্ত স্নিগ্ধতা ঢেলে সাজিয়েছে এই জায়গা। এই বাতাসে নিঃশ্বাস নিলেও সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়৷ প্রশান্তিতে ভরে যায় বুক।

হুট করে ধাম করে একটা শব্দ হলো। শ্রাবনী তাকিয়ে দেখল তার ঘরে ঢোকার গুপ্ত দরজাটা দিয়ে কেউ ভেরতে পড়েছে। অজান্তেই পা দিয়েছে হয়তো। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো যে পড়েছে সে দেখতে মানুষের মতো। একটা ছেলে!

ছেলেটা সিঁড়ি দিয়ে বেকায়দাভাবে পড়ে নিচে পা মুঁচড়ে বসে আছে। ভীষণ ব্যথা পেয়েছে হয়তো। কিন্তু শ্রাবনী কিছু বলা বা করার সাহস পাচ্ছে না। বরফের মতো জমে গেছে এক জায়গায়৷ তার মনে হচ্ছে সামনের জন মানুষ না, অন্যকিছু। এই বনে মানুষ আসবে কী করে?

ছেলেটা গুঙ্গিয়ে উঠল। ভয়ার্ত চোখে তাকালো শ্রাবনীর দিকে। বলল, “তুমি কি মানুষ?”

শ্রাবনীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তার ঘরে এসে তাকেই জিজ্ঞেস করছে সে মানুষ কি না। তবে কি ভূতপ্রেত হবে? বলল, “কী মনে হয়?”

“শাখিনী!”

“হোয়াট?”

“মাটির নিচে থাকে যে। শাকচুন্নীর বোন।”

“ফাজলামো করার জায়গা পান না?”

“ফাজলামো করব কেন? আপনি সত্যি শাখিনী কি না জানতে চাইছি।”

শ্রাবনী হতাশ গলায় বলল, “আমি মানুষ!”

“তাহলে একা একা এখানে কী করছেন? উপরে থাকলেও একটা কথা ছিল। মাটির নিচে আলোটালো জ্বালিয়ে ঘর বানিয়ে ফেলেছেন। দারুণ তো!” ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখল ছেলেটা।

শ্রাবনী বলল, “আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই এসেছি। এটা আমার ঘর। আপনি বের হন এখান থেকে।”

“অতিথিকে কেউ এভাবে বের করে দেয় নাকি?”

“অযাচিত অতিথিদের আমি রাখি না। তার উপর ছেলেমানুষকে তো নয়ই।”

“কেন ছেলেমানুষের কি বড় বড় দাঁত থাকে? কামড়ে দেবে?”

শ্রাবনী তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “দাঁত না থাকলেও তারা পশুর চেয়ে হিংস্র। পুরুষমানুষের চেয়ে আমি একটা বনের জন্তুকে বেশি বিশ্বাস করি।”

ছেলেটা অবাক হয়ে তাকালো শ্রাবনীর দিকে। শ্রাবনী কঠিন গলায় বলল, “আপনি ভালোয় ভালোয় বিদায় হবেন নাকি অন্য ব্যবস্থা নেব?”

“যাব। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি।আপনার ক্ষতি করব না। সত্যি বলছি।”

শ্রাবনী তাকালো ছেলেটার দিকে। চোখদুটো ভীষণ সুন্দর। সুদর্শন ছেলেটা। ঠোঁটে ঝুলে থাকা মুচকি হাসিটার জন্য মানুষটাকে একদম নির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে। শ্রাবনী এবার নরম হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

“ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে। আপনার গর্তের মুখে পা দিয়ে ভূপতিত হলাম!”

“সেটা না। আমি জিজ্ঞেস করেছি এত রাতে জঙ্গলে কী করছেন?”

“এডভেঞ্চারের শখ জেগেছিল। তারচেয়ে বড় কথা ভালো লাগছিলো না মানুষজন। একা থাকার জন্য মূলত এখানে আসা। কিন্তু আপনি একা একটা মেয়ে এখানে কেমন করে এলেন? আর এসব কী? আপনি কি আশেপাশের এলাকার? এদিকে আরো মানুষজন থাকে নাকি?”

“আমি একাই থাকি। এখন আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। অন্যসময় বলব।”

“ঠিক আছে। আমি রোদ্দুর। আপনি?”

“শ্রাবনী।”

“সুন্দর নাম।”

“জি। আপনার কথা শেষ হয়ে গিয়ে থাকলে এখন যেতে পারেন। আমি ঘুমুব। অতিথি আপ্যায়ন করার মতো খাবার আমার কাছে নেই।”

রোদ্দুর মুখ শুকনো করে বলল, “আমি আজ রাতটা আপনার বাড়িতে থাকতে পারি?”

শ্রাবনী আপাদমস্তক জ্বলে উঠে বলল, “ভালোমতো কথা বলেছি বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? আমি কিছুতেই আপনাকে থাকতে দেব না। আর এখানে অত জায়গাও নেই। বের হন আপনি।”

“হুহ! যাচ্ছি। আবার দিনে আসব।”

“আবার না আসলে খুশি হব।”

রোদ্দুর হাসলো। হেঁটে সিঁড়ির কাছে গিয়ে বলল, “আমি বরং এদিকেই থাকি। উপরে। হ্যামক টানিয়ে শুয়ে থাকব। একা একা বনে থাকতে ভয়ই করে। আপনি কী করে আছেন!”

“ভয় করলে বাড়ি ফিরতে পারেন।”

“সে সময় হলে ফিরব।”

পুরোপুরি বের হওয়ার আগে রোদ্দুর বলল, “বেঁচে থাকলে দেখা হবে।”

শ্রাবনী কিছু বলল না। তার কেন যেন কান্না পাচ্ছে। সে ক্লান্ত। তার কোনে বন্ধু নেই। ছেলেটা কি সত্যি ভালো? সে কি তার বন্ধু হবে? নাকি অন্যদের মতো সুযোগ খুঁজবে গায়ে হাত দেয়ার?”

একটু পর শ্রাবনী বাইরে মাথা বের করে দেখল রোদ্দুর সেখানেই হ্যামক টানিয়ে শুয়েছে। একটা হাত কপালের ওপর দিয়ে রেখেছে। ঘুমিয়ে গেছে নাকি?

ক’দিন পরিশ্রম করে শোয়ার সাথে সাথেই ঘুম আসতো শ্রাবনীর। আজ আসছে না। কী যেন ভাবতে ভাবতে তন্দ্রামতো চলে আসছিলো, হঠাৎ বাইরে জোরে শব্দ শুনে তন্দ্রা টুটে গেল। বাঘের ডাক!
(চলবে)

#সূর্যাস্ত
পর্ব- ৫

শ্রাবনী ভয়ে ভয়ে মাথা বের করলো। সাবধানে তাকালো চারদিকে। চাঁদনী রাত। গাছের ফাঁকে ফাঁকে জ্যেৎস্না এসে আলোকিত করে রেখেছে জায়গাটা। তবু চারদিকে কুয়াশার মেঘে সবকিছু রহস্যময় লাগছে। বাঘের আওয়াজ থেকে থেকে আসছে। একটু পরেই মামার দেখা মিলল। সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে একদম ওপরে। ক্রমে গর্জন করে যাচ্ছে। গাছের মগডালে আবছা চোখে পড়ছে কালো মূর্তিমান অবতারটিকে। তিনি আর কেউ নন, জনাব রোদ্দুর।

শ্রাবনী ঢোক গিলল। সারা শরীর ঘেমে গেছে। বুকের কাঁপুনি এত দ্রুত কোনোদিন হয়নি! তার খবর বাঘমামা পয়নি। পেলে এখুনি এগিয়ে আসবে এদিকে। এটা যাবে কখন? আদৌ যাবে? নাকি জলজ্যান্ত ছেলেটাকে চোখের সামনে মরতে দেখতে হবে? ভয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলো সে। রোদ্দুরকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। প্রাণভয়ে মানুষের কি ভয়ানক অবস্থা হয়!

শ্রাবনী অপেক্ষা করতে থাকলো। একবার ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়, আবার মাথা তোলে। বাঘটা একসময় গর্জন থামিয়ে আয়েশ করে বসল। এক না একসময় শিকার নামবে। তখন দেখা যাবে। এটাই সেই বাঘটা নয়তো যেটা সেই কাঠুরেকে খেয়েছিল? শুনেছে মানুষের মাংসের স্বাদ পাওয়া বাঘ বার বার মানুষ শিকার করতে চায়। কী হবে তবে?

থ্রিলার সিনেমার দৃশ্যের মতো মনে হতে লাগলো পুরো ব্যাপারটা। একেকটা মুহূর্ত যেন বছরের সমান! এই শ্বাপদসঙ্কুল জায়গায় সাধ করে কেউ ঘুরতে আসে! এই ছেলে এত পাগল কেন?

রাত গভীর থেকে গভীরতর হলো। বাঘটা উঠে দাঁড়ালো হঠাৎ। শ্রাবনী ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলল। শব্দ হলো বোধহয় একটু…ফিরে তাকালো বাঘটা। বাতাস উল্টোদিকে বইছে বলে হয়তো গন্ধ পেল না। মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে সাবধানী গতিতে এগিয়ে চলল সামনে। শিকারের আশা কি হারালো তবে?

না, কিছুক্ষণ পরেই বোঝা গেল ঘটনা। প্রচন্ড দাপাদাপির শব্দ ভেসে এলো। শ্রাবনীর জান যায় যায় অবস্থা। রোদ্দুর এখনো গাছে। তবে বাঘটা কিসের সাথে এমন করছে? একটু পরেই বাঘটা শ্রাবনীর প্রায় কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। মুখে একটা ছোটখাটো মৃতপ্রায় প্রানী ঝুলিয়ে। প্রানীটা কী অন্ধকারে বোঝা গেল না। হরিণ হতে পারে, আবার শিয়াল কুকুটও হতে পারে। যেটাই হোক, আপাতত সেটাই তাকে আর রোদ্দুরকে হয়তো বাঁচিয়ে দিল।

দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। বাঘটা চোখের আড়াল হওয়ার সাথে সাথে শ্রাবনী গর্ত থেকে বের হয়ে এল। দ্রুত ইশারা করলো রোদ্দুরকে নেমে আসতে। রোদ্দুর নেমে এল তড়িৎগতিতে। শ্রাবনী তাকে টেনে নিয়ে গেল তার ঘরের দিকে। গর্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেও চলে গেল ভেতরে। এদিকে শব্দ পেয়ে বাঘমামা ফিরে এসেছে। নিচ থেকে তারা শুনছে ওপরের তর্জন গর্জন। তবে এতটুকুই স্বস্তি, বাঘ তাদের পর্যন্ত সহসা পৌঁছুতে পারবে না।

রোদ্দুরের শরীর কাঁপছে। ভয়ানক ভয় পেয়েছে সে। শ্রাবনী শক্ত করে ধরল তার হাতদুটো। ঠোঁট, চোখের পাতা পর্যন্ত যেন থরথর করছে। শ্রাবনী রোদ্দুরকে টেনে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিল। রোদ্দুরের কম্বল বাইরেই রয়ে গেছে। সেটা পরে উদ্ধার করা যাবে। ভাগ্যিস ব্যাগটা শেষে একটানে নিয়ে এসেছিল। সেটাতে পাওয়া কয়েকটা কাপড় চাপিয়ে দিল রোদ্দুরের গায়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো আস্তে আস্তে।

রোদ্দুর ঘুমিয়ে পড়ল বেশ কিছুক্ষণ পর। কাজের ক্লান্তির সাথে রাতজাগা ক্লান্তি নিয়ে বসে রইল শ্রাবনী। তার ঘুমটুম পাচ্ছে না। সে অপলক তাকিয়ে আছে রোদ্দুরের দিকে। কি সুন্দর নিষ্পাপ মুখটা। দেয়ালের খোপের নিচটাতে গর্তমতো করে সেখানে কিছু শুকনো কাঠ রেখে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। বার বার উষ্কে দিলে বেশ আলো আলো হয় ঘরটা। এত কাছ থেকে সে কোনোদিন কোনো পুরুষকে দেখেনি। কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে তার। মায়া হচ্ছে বড্ড!

.
রোদ্দুরের ঘুম ভাঙলো কিচকিচ শব্দে। কিসের শব্দ সে জানে না। কোথায় আছে তাও বুঝতে পারছে না। নিজেকে সে আবিষ্কার করলো একটা বদ্ধ কুঠুরিতে। আবছা আলো চারদিকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখল তার মাথার কাছে হেলান দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে একটা মেয়ে। দারুণ মায়াবী মুখ। আর ভীষণ ক্লান্ত। রোদ্দুরের মনে পড়ল সব। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল বুক থেকে। এই মেয়ে তাকে গতরাতে উদ্ধার করেছিল। সে এখন মেয়েটাকে উদ্ধার করবে। যদিও জানে না এই মেয়ে কোন গ্যাড়াকলে ফেঁসে আছে।

রোদ্দুর উঠে বসল সাবধানে। শ্রাবনীর ঘুম ভেঙেছে। উঠেই সে প্রথমে বলল, “ক্ষুধা লেগেছে।”

রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, “কী খাবে?”

“পরোটা।”

রোদ্দুর অবাক হয়ে বলল, “পরোটা পাব কই?”

“বানিয়ে দাও।”

“কীভাবে বানাবো?”

“পারো না নাকি? আটা দিয়ে বানিয়ে তেলে ভাজতে হয়। আর সাথে ডিমভাজি করবে। বেশি করে মরিচ কুঁচি দিয়ে। কেমন?”

রোদ্দুর ঠিক বুঝতে পারল না মেয়েটা কি পাগল টাগল হয়ে গেছে? সে বেকুবের মতো বসে রইল। খানিক্ষন পর শ্রাবনী চোখ খুলে তার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, “গেলে না এখনো?”

রোদ্দুর শ্রাবনীকে টেনে তুলে তাকে বিছানায় উঠিয়ে বসিয়ে দিল। দুই কাঁধ ধরে ঝাকি দিয়ে বলল, “কী হয়েছে তোমার? মাথা ঠিক আছে?”

শ্রাবনী খিলখিল করে হেসে বলল, “ভয় পেলে নাকি?”

রোদ্দুর মুখ গোমড়া করে বলল, “মজা করছিলে?”

“না তো কী!” শ্রাবনীর হাসি আর থামে না। এক পর্যায়ে হাসি চেপে পেটে হাত দিয়ে বলল, “সত্যি ক্ষুধা লেগেছে। জানো, বাড়িতে থাকতে এমনও হয়েছে টানা চার পাঁচদিন কিছুই খাইনি। তবু ক্ষুধা লাগতো না। খাওয়ার কথা ভাবলে অভক্তি চলে আসতো। আজ কয়েকদিন ধরে না খেয়ে থাকতেই পারছি না। কেন এমন হলো বলোতো?”

“সেটা বলতে পরব তখনই যখন জানতে পারব বাড়িতে তোমার সাথে কী হয়েছিল।”

শ্রাবনী কয়েক মুহূর্ত রোদ্দুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আরেকদিন বলব।”

রোদ্দুর জোর করল না। বলল, “বাঘটা এখনো আছে নাকি?”

“দেখে আসছি।”

.
বাঘ ছিল না উপরে। সম্ভবত পেটপুরে খেয়ে ঘুম দিয়েছে। দুজনে বের হয়ে ঘুরে ঘুরে খাবার জোগাড় করে ফেলল। গতকাল বাঘের ফেলে যাওয়া হাড়গোড় আর রক্তের দাগ দেখতে পেল ঝোপের পাশে।

ওদের খাবার হলো বনমোরগের ফ্রাই আর রোদ্দুরের আনা কফি। দুটো কাপ না থাকায় একটাতেই ভাগাভাগি করে খেল দুজন।

ততক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে। ছোট্ট দিনের শেষে সূর্যটা কোমল আলো ছড়াচ্ছে। রোদ্দুর বলল, “শ্রাবনী, জানো আমি জীবনে অনেক মেয়ের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি। কিন্তু আমার কোনোদিন এমন চমৎকার লাগেনি।”

শ্রাবনী ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও মুখে বলল, “কারন কারও সাথে জঙ্গল বসে এরকম আজব অভিজ্ঞতা হয়নি যে!”

“উহু ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। অভিজ্ঞতার সাথে ভালোলাগার কোনো সম্পর্ক নেই।”

“তাহলে ভালোলাগর সম্পর্ক কিসের সাথে?”

“শুনবে?”

“হু।”

“বোর হবে না তো? আমি খুব খারাপ লোকচার দেই।”

“আরে সমস্যা নেই। বলতে থাকো।”

রোদ্দুর উঠে দাঁড়ালো। গায়ের জ্যাকেটটা আরেকটু জড়িয়ে নিল ভালো করে। হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে আকাশের দিকে মুখ করে বলল, “ভালো লাগার সংগাটা একেকসময় একেক রকম। ছোটবেলায় একটা খেলনা বা খাবার পেলেই ভালো লাগতো। নতুন নতুন গাড়ি, বল আর চকলেট। একটু বড় হলে জামাকাপড় আর স্পোর্টসের দিকে আকর্ষন হলো। আবার জন্মদিনের গিফট হিসেবে বই, ভিডিও গেমস পেয়ে দারুণ খুশি হতাম। আরেকটু বড় হয়ে সেসবের মোহ হারালাম, তৈরি হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষন। সেটা বয়ঃসন্ধিকালে সবারই হয়। নারীসঙ্গ জীবনে অনেক পেয়ছি আমি। স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত। বহু দিন, বহু রাত কতো প্রেমিকাদের হাত ধরে চট্টগ্রামের পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটেছি বলতেও পারব না। অথচ সেসব মোহ ছাড়া কিচ্ছু নয়। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি। সাময়িক ভালোলাগা কখনে আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।
আর সেই পর্যন্ত…”

রোদ্দুর কথাটা শেষ করতে পারলো না। শ্রাবনী বলে উঠল, “তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমি তোমার আত্মা স্পর্শ করে ফেলেছি?” কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল শ্রাবনী। অতিকষ্টে হাসি থামালো। বলতে গেলে রোদ্দুরের গরম চোখের সামনে হাসি থামাতে বাধ্য হলো।

রোদ্দুর সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “একটা সময় ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। কিছুই ভালো লাগছিল না। পৃথিবীর প্রতিটা জিনিসের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসছিলো। এক রুটিনবাঁধা জীবনে পুরোপুরি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সবচেয়ে বিরক্ত ছিলাম মেয়েদের প্রতি। ন্যাকা ন্যাকা কথাবার্তা আর কান্নাকাটির উপর ভয়ানক অনাসক্তি তৈরি হয়েছিল। তারপর এখানে এসে হুট করে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমি অন্যরকম নারীরূপ চিনতে পারলাম। যে ভয়ানক পরিস্থিতিতেও কাঁদে না। একা একা নিজের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারে। কঠিন অবস্থায়ও শক্ত থাকতে পারে। তোমার মতো চমৎকার একটা মেয়ের সাথে কিছু কাটানো সময় চমৎকার হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? সত্যি বলতে আমি এরকম আগে কখনো দেখিনি…”

শ্রাবনী লজ্জা পেল। গালদুটো ঈষৎ লালচে হয়ে উঠল। তবে সে নিজের অনুভূতিকে পাত্তা না দিয়ে বলল, “সবাই একরমক হবে না সেটাই স্বাভাবিক। সবসময় যাদের দেখা যায় তারাই কি সব? পর্দায় আড়ালেও অনেক মেয়ে, অনেক অদেখা রূপ, অনেক অদেখা বিশেষত্ব থেকে যায়। অথচ সামনে থাকা কিছু মেয়েদের সাথে সবার তুলনা করে তাদের চূড়ান্ত অপমান করা হয়। দিনশেষে ফেলে দেয়া হয় আস্তাকুঁড়ে। একসময় তারাও তাদের বিশেষত্ব ভুলে সাধারন পাঁচটা মেয়ে হয়ে সমাজে পড়ে থাকে।”

রোদ্দুর কিছু বলল না। তার শ্রাবনীর কথা শুনতে ভালো লাগে। মেয়েটা যেন কুয়াশায় ঘেরা একটা চরিত্র। তার বলা প্রতিটা শব্দ একেকটা অস্ত্র। রোদ্দুরের হঠাৎ খেয়াল হলো শ্রাবনীর গায়ে একটা পাতলা জ্যাকেট। সে অবাক হয়ে বলল, “এটা পরে এই শীতে আছ কেমন করে?”

শ্রাবনী একটু হেসে বলল, “অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“বেশিদিন যে এখানে থাকোনি তা বোঝাই যায়। অভ্যাস হয়নি, তুমি কষ্ট পাচ্ছ।”

“মোটেও না।” ঠোঁট উল্টালো শ্রাবনী।

রোদ্দুর ব্যাগ থেকে সোয়েটার বের করে শ্রাবনীর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল, “খুলে ফেলো না প্লিজ।”

শ্রাবনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমরা একে অপরকে তুমি তুমি করে বলছি কেন?”

“কারন আমরা বন্ধু হয়ে গেছি। এতক্ষণে খেয়াল করলে এটা?”

শ্রাবনী একটু লজ্জা পেয়ে গেল। আবার বলল, “আমারও ভীষণ ভালো লাগছে রোদ্দুর। আমি শেষ কবে এত হেসেছি বলতে পারব না।”

রোদ্দুর শ্রাবনীর চোখের দিকে তাকালো। একটা আলো আছে ভেতরে। সন্ধ্যার মরে আসা সূর্যের আবছা কিরণেও সেই আলোটা একটুও ম্লান হয়নি। বহু রহস্য লুকিয়ে আছে আলোর পেছনে। আর আছে একগাদা ঐশ্বর্য!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here