সূর্যাস্ত,পর্ব:৩

#সূর্যাস্ত
পর্ব- ৩

শ্রাবনী ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক কোথা থেকে শব্দ আসছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে তার মনে হচ্ছে বাঘটা নিশ্চিন্ত মনে কিছু খাচ্ছে। আর সেটা তার খুব কাছেই কোথাও। অনেকক্ষণ এক জায়গায় কাঁটা হয়ে বসে রইল শ্রাববী। বার বার মনে হতে লাগলো এই বুঝি ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল হিংস্র প্রাণীটা।

একসময় শব্দ থামলো। বাঘটা জোরে একবার হুঙ্কার দিল। কেঁপে উঠল শ্রাবনী। তাকে আরও কাঁপিয়ে দিতেই হয়তো বাঘটা তার কয়েক হাত দূর দিয়ে হেঁটে গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গেল। সে ঝোপঝাড় দিয়ে যথাসম্ভব গা ঢেকে রাখল। বাতাসের দিকও তার দিকেই। তাই বাঘটা তার শরীরের ঘ্রাণ পেল না।

বাঘ চলে যাওয়ার পর ঘন্টাখানেক সেখানেই বসে রইল শ্রাবনী। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে যেদিক থেকে শব্দ আসছিলো সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু আস্তে কি আর হাঁটা যায়! শীতের দিনের পড়ে যাওয়া শুকনো পাতাগুলো পায়ের নিচে পড়ে মড়মড় শব্দ হতে থাকলো। তবু সে যথাসম্ভব নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। জানে বাঘটা চলে গেছে তবুও ভয় যাচ্ছে না।

খানিকটা গোল ফাঁকা জায়গা। সেখানে কয়েকটা হাড়গোড় আর রক্তের চিহ্ন! শ্রাবনীর হৃৎপিন্ডটা যেন গলার কাছে উঠে এল! হাড়গুলে মানুষের। তাকে আরও নিশ্চিত করে দিল ছেড়া রক্তমাখা কাপড় আর পাশে পড়ে থাকা কুড়ালটা। কাঠ কাটতে এসেছিল বুঝি কেউ!

ধাতস্থ হতে বহু সময় লাগলো শ্রাবনীর। চোখদুটো তবু শুকনো তার। কেন যেন ভয়ানক উত্তেজনা কাজ করছে শরীরে। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর তার বহু কষ্টেও কান্না পায়নি। কি আশ্চর্য!

শ্রাবনী ঠান্ডা মাথায় ভাবলো এখন কী করা যায়। লোকালয়ে ফিরতে হলে তীরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে কখন লঞ্চের দেখা পাওয়া যায়। তবে তার লোকালয়ে ফেরার ইচ্ছে নেই। মানুষের মুখ দেখতেও অরুচি লাগে। শেষমেষ শ্রাবনী সিদ্ধান্ত নিল সে ঘর বানাবে। মাটির নিচে ঘর। ইন্টারনেটে দেখেছিলো উপজাতিদের এরকম ঘর বানাতে। একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী! কুড়ালটা তুলে নিল সে। এগিয়ে গেল সুবিধামতো জায়গার সন্ধানে।

পেট খালি থাকলে কাজ করা সম্ভব না। শ্রবনী আগে পেট ভরানোর চেষ্টা করল। সামনে পেয়ে একটা বনমোরগ ধরে ফেলল। সূর্যের তেজ ভালোই আছে। এর মধ্যে পাথরে পাথর ঘঁষে সে কেমন করে যেন আগুন জ্বালিয়ে ফেলল। খুশিতে জোরে চিৎকার দিয়ে ফেলল শ্রাবনী। দিয়েই আশেপাশে তাকালো। নাহ্ কেউ তার ঘাড়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ল না।

এবার বনমোরগটাকে আগুনে পুড়িয়ে নিল সে। এর মাঝে কোনদিকের পানি বেশি লবনাক্ত সেটা সে খুঁজে বের করেছে। পানি জমিয়ে রেখেছে একটা কুড়িয়ে পাওয়া বোতলে। কুড়ালটা ব্যবহার করে অতিকষ্টে মোরগটার চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে সেটা লবন পানিতে ভিজিয়ে আগুনে পোড়ালো শ্রাবনী।

খেতে বেশ ভালোই লাগলো তার। পেট শান্তি হওয়ার পর কাজে লেগে গেল। মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। অনেকখানি খোঁড়ার পর যখন সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল তখন বিকেল। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ঘাম মুছল শ্রাবনী। মোরগের বাকি অংশটা পুড়িয়ে খেয়ে নিল। তারপর গর্তের মধ্যে পাতা দিয়ে বিছানামতো বানালো। উপরে বড় গোলপাতা দিয়ে ছাউনি বানিয়ে নিল। সেটার ভেতর গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল সে। উপরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। জায়গাটা গরম আছে, সাথে জন্তুজানোয়ারও আসবে না সহজে। ক্লান্ত শরীরে ঘুম চলে এল দ্রুতই।

.
রোদ্দুর লঞ্চ থেকে নেমেই ভাবলো আজ রাতটা এখানেই বনের ভেতর কাটিয়ে দেবে। দারুণ একটা এডভেঞ্চার হবে তাতে। তাদের দেশে গহীন অরণ্য নেই। নইলে তিন গোয়েন্দার মতো আমাজানে থাকার অভিজ্ঞতা হয়ে যেতো। তবে তার মূল উদ্দেশ্য মন ভালো করা। শীতলরা গতকালই চলে গেছে। এখন সে হারিয়ে গেলে খোঁজার কেউ থাকবে না। কাউকে না বলেই সে গভীর জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। যদিও গার্ড বলেছে এদিকে বাঘ থাকার সম্ভাবনা আছে, তবু তার তেমন ভয়টয় হলো না। দেখা হোক না একবার মামার সাথে। ক্ষতি কী, বেশি হলে তার পেটেই যাবে।

সকালের সূ্র্যটা মিষ্টি কিরণ দিচ্ছে। মেঘেদের দিকে তাকিয়ে রোদ্দুর মনে করিয়ে দিল, “কিহে! ভুলে যাওনি তো তার কথা?”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here