কুয়াশা মন পর্ব ১১

#কুয়াশা মন

পর্ব ১১…

“আমিই আপনাকে ভুল বুঝেছি। বুঝিনি আপনার স্বভাবের পেছনের এসব গোপন কথা। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনার স্থলে থাকলে নিশ্চয় এমনটাই হতো।”
“তোমার ক্ষমার দরকার নেই আমার কাছে। আমাকে তুমিও ভুল বুঝবে না এতেই বেশ। সত্য বলতে তোমাদের কাউকেই আমার ভালো লাগে না। নিজ স্বার্থে এসেছিলে, নিজ স্বার্থের জন্য আছ, থাকবে। কখনও কারও আপন হওয়ার সৌভাগ্য হারিয়ে ফেলেছি, এই হলো কথা।”
“শুনুন, আপনি হয়তো ভাবেন, আমি প্রতিটা সময় আপনার পিছে লেগেছি। আপনাকে ফাঁসিয়ে নিজের জন্যে জায়গা করতে চেয়েছি। আমি আবারও বলব এসব সত্য নয়। আপনি আবারও ভাবতে পারেন আমি মিথ্যে বলছি। তবু নিজ সাফাই গাওয়ার অধিকার সকলের আছে। আপনি অহেতুক আমাকে আর আমার বাবার সম্বন্ধে খারাপ কথা বলেছেন। বাবা কখনওই আমাকে আপনার পিছে লাগতে বলেননি। হ্যাঁ, বাবা একসময় চাইতেন, আপনাদের সাথে প্রতিপত্তির দিক থেকে বরাবরি করতে। কিন্তু বাবা এতো নিম্ন মানসিকতার লোক নন। আমাকে কোনোকিছুর জন্য উদ্বুদ্ধ করেননি।”
“তাহলে?” তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুড়লেন।
“আসলে এর অন্তর্নিহিতে কিছু কথা আছে।” আমি কানের সামনে আসা চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে অন্যদিকে ফিরে বললাম, “আমার একটি ডায়েরি আছে, যেখানে আমি আমার মনের কথা সকলই লিখি। আপনাকে নিয়েও অনেক কিছু লিখি।”
“কী লিখো?”
“কখনও এসব কথা আপনাকে বলব তা আমি ভাবিনি। আমাদের নিয়ে পালন করা আপনার ঘৃণা দূর করার জন্যই বলতে হচ্ছে। আমি আমার ডায়েরিটিতে আমার মনের কোনো কথাই বাদ দিই না, সবই লিপিবদ্ধ করি। আমি যখন পনেরো বছরের, তখন থেকেই… আপনাকে পছন্দ করি।” শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বললাম, “কিন্তু একথা আমি কাউকে কখনও জানাইনি। সবাই ভাববে, আমি ফুফাতো এক ভাইয়াকে নিয়ে আজেবাজে ভাবছি। কিন্তু এমনটা নয়। আমার মনে কখন আপনি জায়গা করে নিয়েছেন আমি স্বয়ং টের পাইনি। আপনার কথা ডায়েরিতে প্রচুর লিখি। বড় ভাইয়ার বিয়ের সময় আপনার সাথে ধাক্কা খাওয়ার সময় মুক্তা আমাদের দেখেছিল। আমরা তখন অনেকদিন পর একে অপরের সাথে দেখা করার সত্ত্বেও কথা বলিনি দেখে তার কিছুটা সন্দেহ হলো। আমি পরে বললামও যে, আমাদের মাঝে নিত্য-নতুন কোনো ঝগড়া বাঁধেনি। পুরনো দশ-বারোটার মতোই। কিন্তু সে আমাকে আতঙ্কিত করে দিয়ে বলল, সে আমার অজান্তেই আমার ডায়েরি পড়ে ফেলেছে। আমাদের মাঝে কী হয়েছে, কী না, সবগুলোই সে জেনে ফেলেছে।
আমি ওসব কথাই লিখেছিলাম, আমাদের একসময় একা বাসায় একসাথে থাকার কারণে আমার হাতের আঁচড় দেখে ফুফার আপনাকে ভুল বুঝার কথা সবই। মুক্তা এসব পড়ে ওর মনে কী উদয় হয়েছে বা কোন ধারণার ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে কিছুই বুঝে উঠিনি। ক্লাব থেকে আসার সময় আপনার সাথে একা আসার সুযোগ করে দেওয়ার ফন্দিটাই ধরুন! ও এমনটা করবে তা আমার কল্পনাতীত ছিল। আমাদের বিয়েটাতেও আমার বিশেষ মত ছিল না। আমি তাকে বলেছিলাম, ওর কিছুই করার দরকার নেই। নিয়তি যা চায় তাই হবে। কিন্তু সে বিয়ের পর ভাবীর জায়গায় বান্ধবী হিসেবে আমাকে পাওয়ার লোভে ওইসব করে ফেলেছে আমার অজ্ঞাতসারেই। আমাকে যখন এসে এসব কথা সে বলেছে, আমার খুবই খারাপ লেগেছিল আপনার সাথে এতো বড় অন্যায় হয়েছে দেখে। আমি যদি জানতাম, আপনি আপনার সকল চাহিদার বলি দিয়ে বিয়েটা জোর করে করছেন, তবে আমি এই বিয়েতে মতই দিতাম না।”
“কথাগুলো আমার জানা আছে।” তিনি গম্ভীরতর হয়ে বললেন, “মুক্তা বাবাকে সবই বলেছিল। আমি তালাকের কথা তোলে রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে বাবা আনতে যাওয়ার পর আমাকে সবই বিস্তারিতভাবে খুলে বলেছিলেন। তোমার মধ্যে আগের মায়ের ছবি না দেখার অনুরোধ করায় আমি চলে এলাম বাবার কথায়। তালাক আর দিলাম না। যদি আগের মায়ের মতো হয়েও থাকো, তবে বিশেষ কিছু আমার আসে যায় না। তুমি স্বার্থ চাও, স্বার্থ পাবে। আমিও নিজেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকব। এই উদ্দেশ্যে তালাক না দিয়ে তোমাকেই দূরে থাকতে বলেছিলাম। আমার মনে এখন বাবার বিয়োগের শোক ছাড়া আর কোনো অনুভূতিই নেই। কারও জন্য ঘৃণাও পুষি না। তোমার মনের কথা সত্য কি মিথ্যা তা আমি বিশ্লেষণ করতে পারব না। তবে তোমাকে ভালোবাসতেও দ্বিধা আর বাধা আছে। আমার দ্বারা সম্ভব নয়। যেমনটা আছি, তেমনটাই থাকতে চাই। মনটা জুড়ে কাউকে ঠাঁই দেয়া সম্ভব নয়। তাই বলছি, দূরত্ব বজায় রাখবে আমার কাছ থেকে।
বাবা চলে যাওয়ায় একদম ভেঙে পড়েছি। মনটা আজ খুব খাঁ খাঁ করছে। তাই বাধ্য হয়েই তোমাকে সবকিছু শেয়ার করলাম। আর সম্ভব নয়। যতই কথা বলব, মায়ায় জড়িয়ে পড়ব। আমাকে একা থাকতে দাও। এখানে, এই বেলকনিতেই চাঁদের আলোয় রাতটা কাটিয়ে দিতে চাই।”
“আমারও ঘুম হবে না। আপনাকে আমি বিরক্ত করব না। আমি এখানে থাকতে পারি না কি?”
উনি কোনো উত্তর করলেন না। আমি নীরবে বসে রইলাম। “আচ্ছা , একটি কথা বলব? বাবা আপনার আর বড় ভাইয়ার মাঝে কাকে বেশি বিশ্বাস আর পছন্দ করতেন?”
কথাটা উনি শোনার সময় দেখলাম, উনার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। কেমন অদ্ভুত এক চাহনি!
“জানো, এই প্রশ্নটা হুবহু বাবাকে শেষবারের মতো করেছিলাম। তিনি উত্তরে কী বলেছিলেন জানো? ‘আমি যাকে বিশ্বাস করি আর বেশি ভালোবাসি, সে নিঃসন্দেহে আমাকেও সেরূপ ভালবাসে।’ আমি তখনও বাবার উত্তরটা বুঝলাম না। তারপর উনি আরেকটু বিশদভাবে বললেন, ‘দেখবি স্বচক্ষেই, আমি মারা যাওয়ার পর আমার মিহির আর মঈন এর মাঝে যে বছরখানেক পার হয়ে গেলেও আমার শোকে কাতর থাকবে, আমায় বারংবার মনে করবে সে-ই হবে আমার আসল ভালোবাসার ধন।'” উনি ঢুকরে কেঁদে উঠলেন, “আমি সবসময় একটা শিক্ষা পেয়ে এসেছি, মানুষ যাকে বেশি ভালোবাসে তাকেই সবচেয়ে বেশি বকাঝকা দেয়, মারধর করে। আমি ছোট থেকে দেখে এসেছি, প্রহার সকল বাবা ভাইয়াকেই করতেন। এইজন্য আমি সবসময় ভেবেছি, একটু বেশি ভালোবাসেন হয়তো মঈন ভাইয়াকেই। আর এই খেয়ালেই বাবাকে প্রশ্নটি করেছিলাম। উত্তরটা আমি ফেলনার মতো ফেলে দিয়েছিলাম স্মৃতি থেকে। আজ মনে পড়ল, বুঝলাম এখন, বাবা কাকে বেশি ভালোবাসতেন। উনার অতৃপ্ত মনই আজও আমায় মনে করে বলে আমি উনাকে এতো মনে করি। এতো কষ্ট পাই।”
উনি মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে সজোরে কেঁদে ফেললেন। যদিও বা আজ প্রথম উনাকে কাঁদতে দেখেছি, আমার কিন্তু খারাপ লাগছে না। কাঁদলে তাঁরই বুক হালকা হবে। আমি বাধা দিলাম না। তবু পাশেই বসে আছি ভেবে তাঁর কাঁদে হাত রেখে একটু সান্ত্বনা দিলাম। নিজেকে সংযত করে জলভর্তি চোখে একবার উনি আমার দিকে তাকালেন। “তুমি.. তোমাকে ধন্যবাদ।” কথা তাঁর জড়িয়ে যাচ্ছে। “আমাকে প্রশ্নটা না করলে, অনে.. অনেক কিছুই অজানা রয়ে যেত। আর তুমি কেন কাঁদছ?”
উনার কান্না দেখে কখন বাবার স্মৃতিতে নিজেই গাল ভিজিয়ে ফেললাম, টেরই পেলাম না। “উনি কি শুধু আপনারই বাবা? আমার কিছু হতেন না?”
“তাও ঠিক।”
কান্না মুছে মৃদুভাবে হাসলাম আমি। উনি আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর অস্ফুটভাবে কী যেন বললেন। আমি উনাকে দেখে থাকার একপ্রকার ঘোরে থাকায় আন্দাজ করতে পারিনি। “কিছু বলেছিলেন?”
“না, কিছু না।” আমার দিক থেকে নজর সরালেন। আমি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে হচ্ছিল, উনি বলেছিলেন, ‘তুমি এতো সুন্দর কেন?’ এমনটা বলেছিলেন? না, মনে হচ্ছে না আমার। আমি এর পর কিছুক্ষণ বসে থেকে উনাকে রুমে নিয়ে এলাম।
সকালে যখন তিনি ঘুম থেকে উঠলেন, তখন মনের মধ্যে একপ্রকার উত্তেজনা কাজ করছিল। এই নিয়ে যে, আমার জীবন নতুন করে মোড় নেবে। এটি হলো আমার সুখের আরম্ভিকের সকাল। নতুন এক সকাল। আমি খুব ভোরে উঠে গিয়েছিলাম। উনি নিত্য প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন। আমি ভেবেছিলাম, কালরাত হয়তো আমরা খুব পাশে এসেছি। একে অপরের হৃদয়ে প্রবেশ করেছি। আমি তাঁর কুয়াশা মনকে ভেদ করেছি আর সে মনের কোথাও না কোথাও আমাকে ঠাঁই দিয়েছে সে। কিন্তু ভাবনা সব মাটিতে পরিণত হতে লাগল। কোনো ভাবান্তরই ঘটেনি লক্ষ করছি। সে প্রতিদিনের মতোই ওঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নিউজপেপার নিয়ে বসল। আমার সাথে প্রতিদিনের মতো একটু কথাও বলল না। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম, কালরাতের পর থেকে উনার মৌনতা না ভাঙলেও আমাকে বন্ধুর মতো করে দেখবেন। সব ভাবনাই ভেস্তে গেল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। সে বিছানার একপাশে মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছে। আমার ঘুম হবে না দেখে ডায়েরিতেই লিখছি।

সামিরা ডায়েরি রেখে একবার রুম থেকে বাহিরে গেল। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ বেজেছে। তার বাবা এতো তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরেন না। সামিরার কেন যেন মিহিরকে একবার খুব করে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে কোনো পাষাণ নয়। হতে হয়েছে পরিস্থিতির দোষে, একথা সামিরা ডায়েরি পড়ে ভালোই বুঝেছে। সে গিয়ে সোফায় অনেকক্ষণ ম্যাগাজিন নিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পার হতেই কলিং বেল বেজে উঠল। বুয়া দরজা খুলতে যাওয়ার সময় সামিরাকে সোফায় দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। কারণ তাকে রুমের বাইরে তেমন একটা সাধারণত দেখা যায় না। তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল মুছলেন। সামিরা তার বাবাকে পছন্দ করে না, দরজা খুললে চোখাচোখি হয়ে পড়বে ভেবে মন কেমন যেন করছে। তিনি দরজা খুলে দিলেন।
আজ মিহির বেশ তাড়াতাড়িই ফিরে এলো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছিল। পেছনে ফিরে একবার দেখল। সামিরা! আজ কতদিন পরই না আলোয় তার মুখ দেখা হলো। প্রতিরাত সামিরাকে দেখে বাতি নেভানো অন্ধকার রুমে ঘুমোতে। তাহলে সে কি এসময় প্রতিদিন এখানে বসে? মিহির ক্ষণিকের জন্য সামিরাকে দেখল। অবিকল তার মা। টানা টানা চোখ, চিকন চিবুক, গোল না আবার লম্বাটেও নয় এমন মুখখানা, টকটকে লাল একজোড়া ঠোঁট, এলোমেলো চুল। কিশোরী হওয়ার পর সে লম্বা হয়েছে, গায়ের রঙ আরও উজ্জ্বল হয়েছে। সামিরাকে ক্লান্ত তবে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখল মিহির। যেন দেখাই শেষ হচ্ছে না। মিহির চোখ ফিরিয়ে নিতেই সামিরা ম্যাগাজিনের ওপর থেকে আড়িপেতে মিহিরকে দেখল একটু। কত ক্লান্তই না লাগছে! চোখগুলো বুজা, নিমীলিত। চেহারার চমক একপ্রকার হারিয়ে গেছে। ডায়েরির সাবিহার বর্ণনার নয় এই মিহির নিশ্চয়। সাবিহার ভালোবাসা কিছুটা অপূর্ব ছিল সামিরা যতটুকু বুঝে। চেহারায় অসাধারণ উজ্জ্বলতা, চেহারায় কোনো ক্লান্তির ভাব নেই, হাসলে যেন প্রতিটা মেয়ে গোটা পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে শুধু তাকেই চেয়ে থাকবে।
সামিরার কাছে এখন তেমনটা মনে হচ্ছে না। তাঁর বয়স বেড়েছে, অবসাদ বেড়েছে। তাছাড়া বেড়েছে একাকীত্ব। আচ্ছা, তিনি কি কখনও মায়ের কথা ভাবেন? তাকে মনে করেন?
মিহির টাইয়ের গলার দিকে একটু ঢিল করে রুমে ঢুকে পড়ল। সামিরার সাথে কথা বললে নিশ্চয় উত্তর আশানুরূপ পাবে না। পরিকল্পনা আঁটতে লাগল, আজকে তাড়াতাড়ি ফেরায় সামিরাকে একটু মন ভরে দেখতে পেরেছে, সেহেতু প্রতিদিন এই সময়ে বাসায় ফিরে এলে সামিরাকে আলোয় একটু-আধটু দেখতে পারবে সে।
সামিরা ম্যাগাজিন রেখে চলে এলো। তার উদ্দেশ্য ম্যাগাজিন পড়া ছিল না, যা দেখতে চেয়েছিল দেখেছে। মিহিরকে দেখেছে সে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here