চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ২২

0
562

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ২২

🍂🍂🍂

ফ্লোরে মাথা রেখে বিছানায় পা তুলে শুয়ে ফোন টিপছে শুভ্রতা। পাশেই গালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে রেনু। উৎসুক কণ্ঠে বললো,

~আপামনি জানেন আজকে আপনার জন্য একটা বিয়ার প্রস্তাব আইছিল। খালাম্মা আমারে পোলার ছবি দেখাইছে।

শুভ্রতা ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আড়চোখে একবার রেনুর দিকে তাকালো। তারপর পুনরায় ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,

~তারপর?

~পোলাডা অনেক সুন্দর। কিন্তু…

বার বার কথার মধ্যে বিরতি নেওয়াতে শুভ্রতা এবার বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। শুভ্রতাকে বিরক্ত হতে দেখে রেনু ফটাফট বলে উঠে,

~কিন্তু দেখতে কেমন জানি লুচ্চা লুচ্চা। আমার ভালো লাগে নাই।

~আম্মুকে বলেছো এই কথা?

~হ, খালাম্মা রে কইছি।

~আম্মু কিছু বলেনি?

~দৌড়ানি দিছে (মিনমিন করে বললো রেনু)

শুভ্রতা রেনুর দিকে কিছুক্ষন ঠোঁট চেপে চেয়ে রইলো। থমথমে গলায় বললো,

এক কাপ কফি বানিয়ে দিবে রেনু আপা? মাথা ব্যাথা করছে।

রেনু তৎক্ষণাৎ কফি বানানোর জন্য উঠে দাড়ালো। দরজা পর্যন্ত আসতেই শুনতে পেলো শুভ্রতার প্রাণখোলা হাসির আওয়াজ। রেনু আড়াল থেকে উকি দিয়ে দেখলো শুভ্রতা পেট চেপে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে হাসছে। আর রেনুর কথা আওরাচ্ছে,

~পোলাডা দেখতে সুন্দর কিন্তু কেমন জানি লুচ্চা লুচ্চা। সিরিয়াসলি!!!

শুভ্রতার হাসি দেখে রেনুও বেশ খুশি হলো। এই বাড়িতে আসার আগে অনেকের মুখেই শুনেছে ঢাকার মেয়েরা অনেকটাই রাগী, বেয়াদব স্বভাবের হয়, কাজের লোকদের সাথেও নাকি অনেক বাজে আচরণ করে। তাদের কথায় রেনু এ বাড়িতে আসার আগে অনেক ভয়ে ছিল। তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শুভ্রতা যদি সত্যিই খারাপ হয় তবে তার থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে। কাজ ছেড়ে দিলে তার থাকার শেষ জায়গাও হারাবে। কিন্তু আসার পর দেখলো শুভ্রতা তাদের বর্ণনার একদম বিপরীত স্বভাবের। এক মাত্র তার মা এবং রেনুকেই তুমি বলে সম্বোধন করে শুভ্রতা। বন্ধুমহল বাদে অন্য কাউকে কখনো তুই করে ডাকতে দেখেনি সে। ছোট বড় সবাইকেই আপনি বলে সম্বোধন করে, সম্মান করে। কারো প্রতি রাগ হলেও চুপ করে বসে থাকে। রেনুর ইচ্ছে করছে তাদের গিয়ে বলে আসতে,

~আমার শুভ্রতা আপামনি একদমই বেয়াদব না। খারাপ আচরণ শুধু তারাই পায় যারা এই আচরণের যোগ্য। সে তো রাগ হলেও খারাপ ব্যবহার করে না।

রেনু শুনেছে সবাই বলে শুভ্রতা ভীষণ রাগী। রেনুর তা বিশ্বাস হয় না। ১১ বছর হয়েছে সে এই বাড়িতে এসেছে। কখনোই দেখেনি শুভ্রতাকে রাগের বশে চিল্লাফাল্লা করতে। বিরক্ত হতে, গম্ভীর চাহনি নিক্ষেপ করতে অনেকবার দেখেছে তাকে। তবে রাগ করে খারাপ আচরণ করতে কখনোই দেখেনি সে। না নিজের সাথে, না অন্যকারো সাথে।

উমা শুভ্রতার ঘরের কাছে এসে দেখলো রেনু উকি দিয়ে শুভ্রতার ঘরে কিছু একটা দেখছে। উমা ধীর পায়ে রেনুর পাশে দাড়িয়ে নিজেও উকি দিয়ে দেখলো শুভ্রতাকে। মিহি কণ্ঠে বললো,

~শুভ্রতার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখলেই মনে অনেক শান্তি অনুভব হয় তাই না রে রেনু?

রেনু আনমনেই সায় দিয়ে বললো,

হ, দোয়া করি আপামনি সবসময় এমন হাসিখুশি থাউক।

পেছনে ঘুরে উমাকে দেখতেই সে এক প্রকার লাফিয়ে উঠলো। উমাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এখনই যেনো তার প্রাণ পাখিটা টাটা বায় বায় বলে উড়াল দিচ্ছিলো। রেনুর লাফে উমাও বেশ ভয় পেয়ে যায়। কপট রাগী চাহনী নিক্ষেপ করে বলে,

~বাঁদরের মত সবসময় এতো লাফাস কেনো? তোকে আর শুভ্রতাকে যখনই দেখি তিড়িং বিড়িং করে ঘুরে বেড়াতেই দেখা যায়। যা নিজের কাজে যা!

রেনু গাল ফুলিয়ে বিড়বিড় করতে করতে যেতে লাগলো,

~এই বয়সে তিড়িং বিড়িং না করলে কি এক ঠেং কবরে গেলে করমু?
~কি বিড়বিড় করিস?
~যাইতাছি তো!

রেনু যেতেই উমা মুচকি হাসলেন। সারাদিন বাড়ি মাতিয়ে রাখে এই দুই মেয়ে। শুভ্রতাকে যে রেনু উদ্ভট কিছু বলে হাসিয়েছে তাও তার বেশ জানা আছে। অকারণেই তো রেনু এই বাড়ির সবার প্রিয় লোক নয়।
____________________________________

~এই সাদা বুড়ি কি করিস?

শুভ্রতার মাথায় গাট্টা মেরে সোফায় বসতে বসতে বললো অরণ্য। শুভ্রতা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে মাথায় হাত ডলতে ডলতে বললো,

আপনার আমাকে দেখলেই মাথায় মারতে মন চায় কেনো জঙ্গল ভাইয়া? আপনি নিউরোসার্জন বলে কি এইভাবে মানুষের মাথায় মেরে মেরে রোগী বাড়ান নাকি?

~তুই ফের আমাকে জঙ্গল বললি?

~আপনিও তো আমাকে সাদা বুড়ি বলেছেন।

~তোকে তো…

বলেই শুভ্রতার চুল টেনে ধরলো অরণ্য। শুভ্রতাও অরণ্যের চুল টেনে ধরলো। এদের দুজনের চুল টানাটানি দেখে কপাল চাপড়ালো অনিকা,

~আরে পাগলের দল! তোদের দেখা হলেই মারামারি করা জরুরি?

~এই জঙ্গল ভাইয়া আজ আবার আমাকে সাদা বুড়ি বলেছে মামী। একে তো আজ আমি ছাড়বো না। টাকলা করে তবেই দম নিবো। (শুভ্রতা)
~আমাকে এই সাদা বুড়ি আজ আবারো জঙ্গল বলে ডেকেছে মা। একে আমিও আজ ছাড়বো না।(অরণ্য)

ভাই বোনের চুলাচুলিতে তিনি পড়লেন বিপাকে। এরা এক হলেই যেনো কুরুক্ষেত্র বেধে যায়। তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন এতো চুল টানাটানির পরও এদের মাথায় এমন গুচ্ছ চুল কি করে রয়েছে?

~আমার চুল ছাড় শুভ্রতা।
~আপনি ছাড়ুন আগে।
~তুই ছাড়!
~আপনি ছাড়ুন!

মারামারির এক পর্যায়ে অরন্য বললো,
~আচ্ছা যা, দুইজনে এক সাথে ছাড়বো।
~ঠিকাছে।
~এক!
~দুই!
~তিন!

~ছাড়লি না কেনো?
~আপনিও তো ছাড়েন নি।

শুরু হলো এদের আবারো মারামারি। মারামারি শেষে পরে নিজেরাই মাথা ব্যাথা করছে বলে চিল্লাফাল্লা করে বড়দের কাছে বকা খাবে। তারপর মাথা ব্যাথা হওয়ার দোষ একেওপরকে দিয়ে আবারো শুরু করে যুদ্ধ। এ তাদের নিত্য কাহিনী। ওদের ঝগড়ায় আর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলো না তারা। অনিকা আর উমা ওদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিজ নিজ মতই গল্প করতে লাগলো।
________________________________

~রেনু আপা এক কাপ চা!!!!
~রেনু আপা কফি!!!!

রেনু হতাশ চোখে অরণ্য আর শুভ্রতার দিকে তাকালো। এক সাথে দুজন চা কফি চায়। একজনকে আগে দিলেই অপরজন গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। রেনু দুই চুলায় চা কফি এক সাথে বানিয়েই শুভ্রতা আর অরণ্যের হাতে দেয়। অরণ্য আর শুভ্রতা টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে রেনুর হাত থেকে কাপ নেয়। এক চুমুক দিতেই দুজনই বিষম খায়।

~এটা কফি নাকি শরবত?
~এটা চা নাকি নিমপাতার রস?

রেনু নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাথে সাথেই সরি বললো। সে শুভ্রতাকে কফির জায়গায় চা আর অরণ্যকে চায়ের জায়গায় কফি ধরিয়ে দিয়েছে। শুভ্রতা চোখ মুখ কুচকে বললো,

~এই শরবত কেউ খায়! ছি! কি টেস্ট!
~এই তিতাপানি কে খায়? ওয়াক থু! মুখের টেস্টের তেরোটা বেজে গেলো।

~ছরি! ছরি! আপামনি আর ভাইজান। আমি আবার বানাইয়া নিয়া আইতাছি। ২ মিনিট সময় দেন। (রেনু)

~তার প্রয়োজন নেই রেনু আপা। (অরণ্য)
~বসো আমাদের সাথে কার্টুন দেখো। (শুভ্রতা)

রেনু খুশি হয়ে মাটিতে বসলেই শুভ্রতা বলে উঠলো,

~সোফায় বসলে গুনাহ হয় না রেনু আপা। উঠে বসো।
রেনু শুভ্রতার ব্যবহারে বেশ খুশি হলো। শুভ্রতার পাশে বসে অরণ্য আর শুভ্রতার মতই মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখতে লাগলো।
__________________________________

~এই শুভ্রতা শুন! (অনিকা)

শুভ্রতা আড়চোখে একবার মামীর দিকে তাকালো। পুনরায় বইয়ে মুখ গুজে বসে রইলো। তার বেশ জানা আছে তার মামী এখন কি কথা বলতে এসেছে। শুভ্রতার এমনভাবে বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে বসে রইলো যেনো বই থেকে দৃষ্টি সরালেই দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে তার দায়িত্ব এখন বইয়ে মুখ গুজে বসে থাকা।

~আরে শুন না!

শুভ্রতা এবারও চুপ রইলো। অনিকা বিরক্ত হয়ে শুভ্রতা মুখের সামনের থেকে বই সরাতে চাইলো। শুভ্রতা বই শক্ত হাতে টেনে ধরলো। দীর্ঘ কয়েক মিনিট বই টানাটানি করার পর যখন দেখলো শুভ্রতা বই ছাড়ছেই না তখন হতাশ হয়ে পুনরায় উমার ঘরে চলে এলো। মামী যেতেই শুভ্রতা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বইটা আগের জায়গায় রেখে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমাতে গেলো। অন্যদিকে,

~শুভ্রতার সাথে কথা হয়েছে?

উমার প্রশ্নে অনিকা মাথা নাড়ালো। উমা হতাশ হয়ে অনিকার পাশে বসলো। কণ্ঠে হতাশার রেশ টেনে বললো,

দেখলে আপা এই মেয়ে বিয়ের কথা বলতে গেলেই কেমন বেঁকে বসে? মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। কতদিন বাঁচি তার ঠিক আছে? সব বাবা মা ই তো মৃত্যুর আগে চায় তার মেয়েকে সুখের সংসার করতে দেখতে। আমার মেয়েটা বুঝতেই চায় না।

~চিন্তা করো না ভাবি। শুভ্রতা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। আমি অরণ্য আর অর্ণবকে বলবো ওরা যেনো ওকে বুঝায়। ওরা বললে ঠিক বুঝবে।

উমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এই মেয়ে যেই জেদী! আদৌ ওদের কথা মানবে কিনা তা নিয়ে বেশ দ্বিধায় আছেন তিনি। তবুও একবার চেষ্টা করে দেখবেন তিনি।

🍂🍂🍂

সকালে নাস্তার সময় বারবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে শুভ্রতা। বুঝাই যাচ্ছে মা তার আজ বেশ ক্ষেপে আছে। শুভ্রতা ফিসফিস করে বাবাকে বললো,

~মিস্টার আবসার আপনার বিবিজান আজ রণচন্ডি আবতারে ঘুরছে কেনো? ঝগড়া টগড়া করেছেন নাকি?

~আজ আমার জন্য না আপনার জন্য রেগে আছেন আমার বিবিজান। সকাল থেকে এইপর্যন্ত অনেকগুলা ধমক খেয়েছি আপনার জন্য।

শুভ্রতার মতই ফিসফিসিয়ে বললেন আবসার। শুভ্রতা বিজ্ঞদের মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
~আমি আবার কি করলাম?

~কাল আপনার মামী আপনার সাথে বিয়ের কথা বলতে যাওয়ায় যে বিদ্যাসাগরের ভং ধরে বই নিয়ে বসে ছিলেন। মনে নেই?

শুভ্রতা জিভ কাটলো। আড় চোখে মায়ের দিকে চেয়ে দেখলো সে রাগী দৃষ্টিতে ওদের দিকেই চেয়ে আছে। শুভ্রতা গলা খাঁকারি দিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো,

~আম্মু! আজ না তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।

~খবরদার আমাকে আর মা বলবি না। কালকে বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে বসেছিলি না? এখনও বই নিয়েই বসে থাক আর তোর ওই বইকেই মা ডাকবি। আমি তোর মা না।

~আচ্ছা খালাম্মা।

শুভ্রতার কথায় উমা ফুঁসে উঠলেন। আবসার আর রেনু ঠোঁট চেপে হাসছেন। উমা ওদের দিকে তাকাতেই ওরা সাথে সাথে মুখভঙ্গি পাল্টে গম্ভীর ভাব নিয়ে নড়েচড়ে বসলেন। শুভ্রতা আবার বললো,

~খালাম্মা আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছি। আপনার কিছু লাগলে বলেন। আসার সময় নিয়ে আসবো।

উমা তরকারির চামচ হাতে নিয়ে বললেন,

~দাড়া! আজ তোর একদিন কি আমার এক দিন।

শুভ্রতা হেসে ব্যাগ আর জুতা কোনোমতে হাতে নিয়েই দৌড় লাগালো। আবারো এসে দরজা দিয়ে উকি মেরে* বললো,

ও খালাম্মাআআ! ভার্সিটি যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রাখবেন। আসছি, খালাম্মাআআআ!!!

~তোকে তো!!!

শুভ্রতা হেসে চলে গেলো। শুভ্রতা যেতেই উমা হাসলো। মেয়েটার প্রতি রাগ করেও থাকা যায় না। কোনো না কোনো ভাবে হাসিয়েই ফেলবে। অন্য মায়েদের মত রাগ করে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে যে মেয়েকে মানাবে তাও মেয়ের কার্যকলাপের জন্য করে উঠতে পারেন না তিনি।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here