ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ৮

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব – ৮

পরেরদিন সুপারভাইজার ম্যামের ফোন পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডিপার্টমেন্টে গেলাম। ম্যামের চেম্বারের আগের রুমটার বাইরের নেম প্লেটে চোখ পরতেই পা আর চলছে না আমার!!!

Md Faysal Ahmed
Lecture, Department of Aquaculture

৫ বছর ধরে একসাথে যে সপ্নটা আমি আর ফয়সাল মিলে দেখেছিলাম সেটা সত্যি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সপ্ন দেখা মানুষদুটো আর একসাথে নেই।

ভাগ্যিস রুমটা তালা দেয়া বাইরে থেকে। না হলে তো এখনই দেখা হয়ে যেতো, হয়তো!!

ম্যামের রুমে যেয়ে ভেতরে ঢুকার পারমিশন চাওয়ার আগেই ম্যাম বলে উঠলেন, আরে মেহের যে, এসো এসো, বসো। তারপর কি খবর তোমার।
আমি নিচের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছি।
-আমি জেনির কাছে সব শুনেছি। এইখানে তো তোমার কোন ফল্ট আমি দেখছি না। সে এখন আমাদের কলিগ হয়ে গিয়েছে। তাকে তো এখন কিছু জিগ্যেসও করা যাবে না।
-দরকার নেই ম্যাম। আপনি আমার জন্যে এতোটুকু করতে চেয়েছেন সেটাই অনেক বেশি ম্যাম।
-ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, তোমার কাজিন আই মিন তোমার হাসবেন্ড এর ব্যাপারে জিগ্যেস করি?
-সিউর ম্যাম।
-কি করে ও।
-চিটাগং মেডিকেল থেকে পাশ করেছে ম্যাম। এখন এফসিপিএস পার্ট ওয়ান এ ভর্তি হয়েছে। এই মাসেই ঢাকা শিফট হয়ে যাবে।
– খুব ভালো। মন খারাপ করে না মেহের। কার ভাগ্যে আল্লাহ কি লিখে রেখেছে আমরা কেউই জানি না। আর লাইফ পার্টনার তো আমরা চাইলেও সিলেক্ট করতে পারি না। মানুষের কথায় কান দিও না। তোমাকে সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে ব্রেভ গার্ল হিসেবেই জানি।
-জি ম্যাম
-রিসার্চ টা ভালো মতো শেষ কর। আর কারোরটার কথা জানি না বাট তোমার পেপার পাব্লিকেশন করার জন্য যত ধরনের হেল্প তোমার লাগবে আমি করবো। কাজের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দাও। দেখবে সবাই তখন ফয়সালের কথা ভুলে যাবে।
-জি ম্যাম
-আর ফয়সাল যদি কোন ঝামেলা করার ট্রাই করে সোজা আমার কাছে আসবে। মনে থাকবে?
-হেসে দিয়ে বললাম, জি ম্যাম
– অকে।তাহলে কাল থেকে ল্যাবে কাজ শুরু করে দাও।
অকে ম্যাম বলে বের হয়ে এলাম চেম্বার থেকে। কিন্তু বলা যতটা সহজ, বাস্তবে কি এতোটাই আসলে?

কারণ ফয়সালের রিসার্চ এখনো শেষ হয়নি তো।
ল্যাবে তো দেখা হবেই ওর সাথে। এতোটা মনের জোর কি আছে আমার?

ম্যামের চেম্বার থেকে বের হয়ে দেখি ফয়সালের রুমের দরজা খোলা!!!
বুকের ভেতর এমন লাগছে কেন!! চোখ বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে এসে লিফটে ঢুকে পরলাম।
আজকে না হয় দেখা হয়নি। কিন্তু অন্যদিন কি করবো!!!

আরো ২দিন পর ল্যাবে গেলাম। ইতোমধ্যে সব স্যার ম্যাম স্টাফরা জেনে গেছে আমার বিয়ের কথা।
ল্যাবে ঢুকে দেখি ল্যাব এটেনডেন্ট দিদি ছাড়া কেউ নেই।
দিদিকে দেখে শুকনা একটা হাসি দিলাম। দিদিও প্রতিউত্তরে একটা হাসি দিলেন। অন্যদিন হলে দিদির সাথে কথার ঝুরি মেলে দিতাম। চুপচাপ নিজের কাজ করতে শুরু করি।

ঠিকভাবে কোন কাজই করতে পারছি না, যেটা আমার সাথে কখনোই যায় না।সব কাজ সুন্দর করে গুছিয়ে করতে পারতাম বলে স্যার, ম্যাম ল্যাবের স্টাফ সবাই আমাকে খুব পছন্দ করতো।

পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখি দিদি দাঁড়িয়ে আছে।
-মা রে, মন খারাপ করে কি হবে বলো। নিজের জীবন আগে। কোন হেল্প লাগলে বলো?
– না দিদি ঠিক আছি আমি।
– এতোদিন ধরে এখানে আছো তুমি, তোমাকে খুব ভালোই চিনি। যেটা হয়েছে, সেটা হয়তো ভালোর জন্যেই হয়েছে। আর ম্যাডামই কেমন, এখনি তোমাকে কাজ করতে বলছে কেনো
– না দিদি, আসলে কাজে থাকলে হয়তো ভালো থাকবো তাই। আপনি যান, পারবো আমি।
– একটু পর থার্ড ইয়ারের ক্লাস হবে এইখানে।
– আচ্ছা সমস্যা নাই, এক কোনায় আমার কাজ আমি কর‍তে পারবো।
-আপু ফয়সাল স্যারের ক্লাস।
-ও।
আর কিছু না বলে তারাতাড়ি কাজ করতে শুরু করি। যেভাবেই হোক ক্লাস শুরু করার আগে বের হতে হবে।
কিন্তু ভাগ্য বলে একটা কথা আছে।
সব জুনিয়র গুলো হুরমুর করে ঢুকে গেলো!!
লাস্ট পারসন টাকে দেখে গলায় মনে হচ্ছে সব আটকে গেছে।

ফয়সাল ঢুকতেই আমি কি করবো সব ভুলে গিয়েছি!!
ওদের দিকে উল্টো হয়ে সেইফটি ক্যাবিনেট এর দিকে বসে আছি।

সেই ভরাট গলার স্বর!! মাথা, কান সব ভোঁ ভোঁ
করছে।
-ঐ আপুটাকে চিনো তোমরা?
– জি স্যার। আমদের উড বি ম্যাম।
পোলাপানের চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেলাম
-না। সে এখন মিসেস সাব্বির। তার পছন্দের মানুষের সাথেই তার বিয়ে হয়েছে।
সব পিন ড্রপ সাইলেন্ট হয়ে গেলো!! মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পরে যাবো আমি!! টলতে টলতে বের হচ্ছি,
” মেহের তুমি ঠিক আছো? তোমার হাসবেন্ড কে ফোন করবো?”
ছুরি দিয়ে আঘাত করে লবন ছিটে দিবে কি না জিগ্যেস করছে।

রুমে এসে শুয়ে পরলাম ভীষণ কান্না আসছে, ভীষণ।
সারা শরিরে কাঁপুনি উঠে গিয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে!!!

জেনি ছুটে এসে জিগ্যেস করলো, মেহের কি হয়েছে তোর? আল্লাহ,জর দেখি অনেক!! গায়ের উপর কাথা জরিয়ে দিল আমার।
-মেহের কাদতেছিস তুই!!!!!!!
কি হয়েছে বল আমায়?
কান্নার আর কাপুনির চোটে মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। আমাকে জাপটে ধরে বসে আছে জেনি। এই মেয়েটা না থাকলে হয়তো মরেই যেতাম আমি!!

ফোন বাজতেই জেনি দেখে সাব্বির ফোন দিয়েছে!!
আমি তখন কথা বলার অবস্থায় নেই।
ও ফোন রিসিভ করলো
-আমি আজকে রাতের ট্রেনে চলে যাচ্ছি ঢাকায়।
-ভাইয়া আমি জেনি। মেহেরের রুমমেট। মেহেরের অনেক জ্বর ভাইয়া। সাথে সারা শরিরে কাপুনি।
-কখন থেকে?
-সকালেও তো ভালো ছিলো। ল্যাবে গিয়েছিল। ওখান থেকে আসতেই দেখি এই অবস্থা।
– ও আচ্ছা।ঠিক আছে ওকে বইলো আমি চলে যাচ্ছি। বলেই ফোন কেটে দিলো!!!!

জেনি অবাক হয়ে একবার ফোনের দিকে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, তুই এই সব জানোয়ার দের মাঝে বেচে থাকবি কিভাবে? চলে যা এইখান থেকে।

চোখ মেলতেই অচেনা একটা রুমে নিজেকে আবিস্কার করলাম। আশে পাশে তাকিয়ে এটা যে হাসপাতাল বুঝতে পারলাম। কিন্তু কেউ নেই কেনো?

উঠে বসার চেষ্টা করতেই, পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো, হুম আর অসুস্থ হওয়ার নাটক করতে থাক। তাহলে আমারও আর এখান থেকে যাওয়া হবে না। আর আমি এইখানে থেকে থেকে তোর নষ্টামি দেখি। এইতো চাস তুই, তাই না?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here