ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ৭

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব – ৭

ফয়সাল ছিলো ওদের ব্যাচের ফার্স্ট বয়। টিচার হবে সেই ব্যাপারে মোটামুটি সবাই শিউর ছিলো। এমনকি ম্যাক্সিমাম টিচার রাও ওকে অনেক পছন্দ করতো। ও যে ওর ব্যাচের ফার্স্ট সেটা আমি জানতে পেরেছি রিলেশনের ৭ মাস পরে। ওর বাসার ফিনানশিয়াল কন্ডিশন ভালো ছিলো না। আমি টিউশন করাতাম শুধুমাত্র ওকে হেল্প করার জন্য। বাসায় তো বলি নাই যে আমি টিউশন করাই। টানা ২ বছর টিউশন করে একটা টাকাও নিজের জন্যে খরচ করিনি। পুরো টাকা টাই ওর হাতে তুলে দিয়েছি। আর বলতাম সব সুদে আসলে নিয়ে নিবো সময় হলে।

কিন্তু কপালে না থাকলে যা হয় আরকি। একজন টিচার চাইতো না ও টিচার হোক। কারণ তার পছন্দের একটা মেয়ে ক্যানডিডেট ছিলো ওদের ব্যাচেরই। ইচ্ছে করে ওকে একটা ঝামেলায় ফাসিয়ে দেয়। খুব ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে ওকে অনেক হ্যারেসমেন্ট করে যেটা ও করেইনি। ওকে পানিশমেন্ট দেওয়া হয় যে ও এই ভার্সিটির টিচার হতে পারবে না।
মেজোভাইয়া কে ফোনে একসাথে অনেকগুলো কথা বলে থামলাম কিছুক্ষনের জন্য। ভাইয়া কিছু না বললেও আমি জানি আমার বলার জন্যে অপেক্ষা করছে।
তারপর ফয়সাল অনেক ডিপ্রেশনে পড়ে গিয়েছিল। ও ডিসিশন নিয়েছিলো যে এইখানে মাস্টার্স করবে না। ওকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে এইখানে মাস্টার্স করতে রাজি করালাম। বললাম যে আল্লাহ একটা না একটা ব্যবস্থা করবে। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো।
এরপরের কাহিনী তুমি জানো। আব্বু মারা গেলো, আমি বাসায় গেলাম এইতো।
-তাহলে সাব্বির কি চাইছে সেটাই তো চিন্তার বিষয়
-হুম।
– দেখা হয়েছে ফয়সালের সাথে?
-না আসলামই তো ২দিন হলো। আমি বের হই নাই রুম থেকে এখনো।
-সাব্বিরের সাথে সব ঠিকঠাক?
-হুম।
-মন খারাপ করিস না। কপালে যা আছে তাই হবে।
সাব্বির ঐ দিন এমনভাবে জোড় করলো, সাথে ফুপা ফুপুও। আমি চাইছিলাম আর কিছুদিন পরে হোক।
কিন্তু উনাদের জোড় জবরদস্তিতে পরেরদিনই দিতে হলো।
-হুম
-দেখ আমাকে ভুল বুঝিস নারে পাগলি। তুই ও তো জিবনে কিছু বলিস নাই। কিভাবে বুজবো বল।
আমি চুপচাপ। কি বলবো আমি!!
– সাবধানে থাকিস। আর কোন সমস্যা হলে সাব্বিরতো আছেই
– হুম। আছেইতো। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম।
-তোর তো ঐখানে মাস্টার্স সমস্যা হবে। কি প্ল্যান তোর?
– স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে যাওয়ার খুবভালো ভাবে ট্রাই করবো।
– হুম ভালো প্ল্যান। ঠিক আছে। ধৈর্য্য ধর, ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু হবে। তুই তো চেষ্টার ত্রুটি করিসনি।
-হুম
-আচ্ছা ভালো থাক। পরে কথা হবে।
ফোন কেটে দিয়ে ভাবছি সবাইকে কিভাবে বলবো কথাগুলো।
জেনি হা হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কাউকে যে কিছুই বলিনি এখনো।

-তুই, তুই….. আমার পাশে বসে ফুপিয়ে কেদে উঠলো জেনি।
অনেকক্ষন জড়িয়ে ধরে রাখলাম জেনিকে। এই একটামাত্র মানুষ যে কিনা আমার আর ফয়সালের রিলেশনশিপ এর শুরু থেকে লাস্ট পর্যন্ত ছিলো।
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে আমি হলে এসেছি। এই কয়দিনে না ফয়সাল না সাব্বির একজনও একটা ফোন দেয়নি আমাকে!! ফয়সালের ব্যাপার না হয় আলাদা। কিন্তু সাব্বির!! ওর ব্যাপারে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

-আর কয়দিন এইভাবে থাকবি রে মেহের!! নিজেকে কেন কস্ট দিচ্ছিস? ফয়সাল ভাইয়ার সাথে কথা বল। দেখ কি বলে উনি। আর সাব্বির ভাইয়ারও তো কোন খবর নেই। তুই তোর বাসায় মিথ্যা কেন বলছিস যে তোদের সব ঠিক আছে?
-এই কথা এখন বাসায় বললে আমার ছোট ফুপি আর মেজো ভাবি সবাইকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে। এমনিতেই আমাদের বোনদেরকে উনি দেখতে পারে না।
তার উপর যদি শুনে যে আমার রিলেশন ছিলো, ভাইয়াকে অনেক বেইজ্জতি করবে।
-তো এখন তুই কি করবি?
– সাব্বিরের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো, আর কি করবো বল। আচ্ছা আমার যে বিয়ে হয়ে গেছে সবাই জেনে গিয়েছে, নারে জেনি?
আমার অসহায় মুখটা দেখে ও কোন উত্তর দিলো না। ফ্রেন্ডদের না হয় কিছু না কিছু বলতে পারবো কিন্তু স্যারদের সামনে কিভাবে যাবো আমি!!

আরো ২দিন পার হলো আমি রুম থেকে বের হই না। ডিপার্টমেন্টে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব কিছু জেনির কাছে খবর পাই। এখনো কেউই জানে না আমদের কথা। রাতে জেনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা তুই কি জানতিস না যে ভাইয়া টিচার হিসেবে জয়েন করবে?
-না। আমি কিভাবে জানবো। তোরা যতদুর জানিস আমিও ততোদুরই জানি।
-এটা তো অনেক লেনথি প্রসেস। এমন না যে একদিনে হয়ে গিয়েছে। তুই কিচ্ছু টের পাসনি?
-নাহ। টের পেলে কি আর সাব্বিরের সাথে বিয়ে হয়!!
-তাও ঠিক।
-ফয়সাল জুনিয়রদের ক্লাস নিচ্ছে নারে?
-হুম। সব জুনিয়রদের মুখেই তো উনার খালি প্রশংসা। অনেক ভালো নাকি পড়াচ্ছে।
-ও

জানিসতো জেনি, আমার শশুর শাশুড়ী অনেক ভালো। অনেক বেশি ভালো। আব্বু আম্মুর পরে আমাদের ভাইবোনদেরকে একমাত্র এই মানুষদুটোই মন থেকে স্নেহ করে। কিন্তু ছোট ফুপির কথার পিঠে কিছু বলতে পারে না। হাজার হোক নিজের ছোট বোন তো। আমার বাবা তার এই দুই আদরের ছোট বোনকে নিজের কাছে রেখে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। ফুপিদের পছন্দমতো ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। সব থেকে বেশি আদর করতেন ছোট ফুপিকে। আর সেই ফুপুই সবথেকে বেশি কস্টটা দিয়েছিলেন।
আমি সেই কাহিনী পুনরায় ঘটাইতে চাইনি। ভাইবোনদের মধ্যে আমি সবার ছোট। আদরও পেয়েছি সবথেকে বেশি।

সেদিন বাসায় ফিরে না আসলে হয়তো আমাকে সবথেকে বেশি স্নেহ করা মেজোভাইয়া টাই কস্ট বেশি পেতো।
জেনি আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু বাকি সবাই কি চুপ থাকবে?

আমরা মানুষ সমাজ নিজের থেকে বেশি নিজেদের মান সম্মান কে আগলে রাখতে পছন্দ করি। যারা এই নিয়মের বাইরে যায় তারাই মনে হয় সুখি হয়!!

সাব্বির একটা ফোনও দেয়নি। বেয়াদ্দব একটা। আমি জিবনেও একে মাফ করবো না। কঠিন শীতের রাতে ওকে আমি পুকুরে ৩ ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখবো। ফাজিল একটা ছেলে। ওকে আবার আমার ভাত বেরেও খাওয়াতে হয়!! আবার টেবিলের নিচে দিয়ে পায়ে খোঁচাও মারে!! বান্দরামির একটা লিমিট থাকা উচিত। আচ্ছা আমি বসে বসে এর কথা ভাবছি কেন। মাথার ভিতর এবং বাইরে, দুই জায়গা থেকেই এই সাব্বির নামক পোকাটাকে বের করতে হবে।

এখনো মনে আছে সেই ১৩ বছর আগের কথা!!
যেদিন সকালে সাব্বির ভাইকে আমাদের বাড়ির পিছনে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বলে ছিলাম, ভাইয়া তোমাকে দেখলে বুকের ভিতরে কেমন কেমন জানি করে!!! বলেই হানড্রেড মিটার স্প্রিন্ট দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলাম সারাদিনের জন্যে। কারন ভাইয়ার উত্তর টা ছিলো জুতা চিনস? জুতা? তোর বুকের ব্যাথা জুতার বারি দিয়ে নামামু।
দাড়া মামিরে বলতেছি, তুই মেহনাজ আপুকে দেয়া চিঠি লুকাই লুকাই পড়স!!
কি ভয়াবহ কথা!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here