#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৬
নিঝুম কে দেখতে পেয়েই পেছন থেকে ডাক দিলো তানিশা। নিঝুম দাঁড়িয়ে গেল। একগাল হেসে পেছনে ফিরে বলল, “কেমন আছো?
“ভালোই আছি।
“তাই তো ভালো থাকার ব্যবস্থা তো আমিই করে দিলাম।
তানিশা হাসল। খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, “কেন? তোমার কি মনে হয়, আহনাফ কে তুমি আমার থেকে কেড়ে নিতে পারতে?
“সেটা আমার স্বভাব নয় তানিশা। আমি যাকে ভালোবাসি, তাকেই পেতে চাই। কিন্তু তোমার জন্য শুভকামনা, কারণ আহনাফের জীবনে এখন আর কেউ নেই।
“আমিও নেই!
এই বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল তানিশা। কয়েক দিন ধরেই দীর্ঘক্ষণ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক কি বলা যায় তার মাথাতেই আসছে না। এদের ভালোবাসা টা কেন এমন? কখনো কি ঠিক হবে না এটা? তানিশা হঠাৎ শব্দ করে হেসে বলল, “আহনাফ যদি তোমায় পেয়ে খুশি থাকতো তাহলে ও আমার কষ্ট লাগতো না নিঝুম, আহনাফ ভালো থাকলেই আমার ভালো লাগে!”
বলা মাত্র হেঁটে চলে গেল তানিশা। নিঝুম নিশ্চুপ! আহনাফ কে বলেছিল তানিশা কে নিয়ে একবার ভেবে দেখতে, সত্যিই কি সে ভেবেছিলো! তানিশা আনমনে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনে ফিরে তাকিয়ে দেখল আহনাফ এদিকেই আসছে। দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল তার। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। কেন এই মানুষটিকে দেখলে এখনো তার বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা করে, কেন এই মানুষটিকে এতোটা ভালোবাসে সে। কেন পারে না নতুন ভাবে কিছু শুরু করতে, কেন?
আহনাফ তার দিকে ফিরতেই চোখ সরিয়ে নিল সে। আবারো হাঁটা শুরু করল সে। দু’জনেই পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল। কিছুদূর যেতেই আহনাফ দাঁড়িয়ে ডাক দিল, “তানিশা!
থমকে গেল তানিশা। দ্রুত পিছন ফিরল সে। আহনাফ বলে উঠল, “তোমার জুতার ফিতে খুলে আছে?”
তানিশা নিজের পায়ের কাছে লক্ষ্য করল। সত্যিই তো ফিতে খুলে আছে, কখন খুলল এগুলো। সামনে ফিরতেই দেখল, আহনাফ আর দাঁড়িয়ে নেই। চলে গেছে, কেন গেল? আরেকটু থাকলেও তো পারতো। জুতার ফিতার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, “বাঁধবে না সে এগুলো। খুলেই পরে থাক। এভাবেই দেখতে ভালো লাগছে। যদি কখনো আবারো আহনাফের সামনে পরে, তখনও কি সে বলবে, “জুতোর ফিতে গুলো বাধো! নাহলে হাঁটতে গিয়ে যে পড়ে যাবে।” বলবে কখনো, বলবে না হয়তো!”
——
এক্সামের সময় এসে গেছে, পরিক্ষার প্রিপারেশন নেওয়া শুরুও করে দিয়েছে সবাই। মাথায় হাত রেখে বসে আছে নিঝুম! তার যে কিছুই পড়া হয় নি। সারাদিন ছোটাছুটি আর ঘুরেই তো সময় পায় না সে। বই নিয়ে বসবে কখন? লাইব্রেরিতে বসে বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছে। কখন পড়বে এসব, কখন শেষ করবে এসব পড়া। হাতে তো আর কয়েকদিন, এ কয়েকদিনে কি সত্যিই শেষ হবে এসব। পরিক্ষার কথা ভাবলে পড়তে ইচ্ছে করে কিন্তু পড়া দেখলেই যে তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। ঠিক কোখান থেকে পড়া শুরু করবে সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছে না। বই টা ধপাস করে বন্ধ করে চোখ বুজে বলে উঠল, “রেখে দে নিঝুম, তোকে দ্বারা আর পড়াশোনা হবে না।”
“কেন? কি হয়েছে?
নিঝুম চোখ মেলে তাকাল। আহনাফ দাঁড়ানো তার সামনেই। পাশের চেয়ায়টায় বসে পড়ল সে। নিঝুম হামি ছেড়ে বলল, “২০ দিন পর এক্সাম!
“তো, পড়াশোনা করো।
“সেটাই তো পারছি না।
“পারছো না কেন?
“কি পড়তে হবে সেটাই তো জানি না।
“নিঝুম তুমি মজা করছো?
“একদম না।
আহনাফ শব্দ করে শ্বাস ফেলল। নিঝুম বইতে মুখ গুজে বলল, “জানেন আমার আব্বু একজন স্কুল টিচার!
“তবুও তোমার এই হাল।
“আহনাফ আমার পড়তে ইচ্ছে করে না।
“এখনো না।
“না না এখন তো করছে, কিন্তু বই দেখেই যে মাথা ঘুরছে। এতো পড়া পড়বো কিভাবে?
আহনাফ বইটা হাতে তুলে নিল। নিঝুমের দিকে ফিরে বলল, “আমার কাছে কিছু নোট আছে, সেগুলো পড়লে তোমার কমন পড়তে পারে।
নিঝুমের চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠল। সে দ্রুত বলে উঠল, “পাশ করবো তো!
“কমন পড়লে পাশ করবে না কেন?
“এই আহনাফ, আপনি আমায় নোট গুলো দিবেন!
“আচ্ছা দেবো!
হঠাৎ মুখে অন্ধকার নেমে এলো নিঝুমের। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি হলো?
“ওই নোট গুলো তো ইফারও লাগবে, আপনি আমায় দিলে কি করে হবে?
“তুমি ইফা কে নিজের মতো মনে করো নাকি?
“না,না! ইফা তো খুব ভালো পড়াশোনায়।
“হ্যাঁ সেটাই, ওর নোট ও নিজেই বানিয়ে ফেলে। তোমার মতো বসে থাকে না। আমি কাল নোট গুলো নিয়ে আসবো!
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় আহনাফ। নিঝুম একগাল হেসে বলল , “আহনাফ আপনি জানেন, আপনি কতো ভালো!
আহনাফ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বললে, “বেস্ট বেস্ট ফ্রেন্ড!
“সুপার বেস্ট ফ্রেন্ড!
দুজনেই হঠাৎ জোরে হেসে উঠে, অতঃপর আবার দুজনেই চুপ হয়ে যায়। হয়তো তারা ভুলেই গেছিলো তারা লাইব্রেরীতে দাঁড়িয়ে।
দুদিন পর, ক্লাস শেষ করে আহনাফ সবে বের হয়েছে। অমনি নিঝুম পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলে, “আহনাফ, আহনাফ!
আহনাফ দাঁড়িয়ে গেল। নিঝুম সামনে দাঁড়িয়ে হাফাচ্ছে। আহনাফ জিজ্ঞেস করে, “শান্ত কে খুজছো?
নিঝুম মাথা নেড়ে না বলে, তবুও আহনাফ বলে উঠে, “ও বোধহয় ক্যান্টিনের দিকে গেল।
“আমার আপনাকেই দরকার ছিল আহনাফ।
“আমাকে!
“হ্যাঁ ( অতঃপর বড় বড় শ্বাস ফেলে বলল ) আহনাফ আপনি আমার টিউটর হবেন।
“মানে?
“আমায় টিউশন করাবেন। তাহলে দেখবেন আমি এবার পরিক্ষায় পাশ করে যাবো।
আহনাফ দুই হাত বাহুতে গুঁজে বলল, “তুমি শান্ত কে বলো, ও তো খুব ভালো স্টুডেন্ট! হ্যাঁ হয়তো সারাদিন ঘুরাঘুরি করে, তবে তোমায় খুব ভালো পড়াবে।
নিঝুম ভাবনায় পড়ে গেল। অশান্ত তাকে টিউশন পড়াবে। তার কল্পনার জগতে যা ছিল তা ভেবেই লজ্জায় তার গাল দুটো লাল হয়ে গেল। দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, “না না অসম্ভব! উনি আমাকে পড়াতে পারবেন না। আহনাফ আপনি প্লিজ!
আহনাফ হাসল। প্যান্টের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, “ফি কতো দেবে?
“আপনি যা চাইবেন!
“যা চাইবো।
“এই না না, মানে। আহনাফ!
“প্রতিজ্ঞা করো, নেক্সট টাইম ভালো করে পড়বে। আমি কিন্তু এরপরেও তোমায় আর নোট দিবো না। তাই এখনি বলো, এরপর থেকে খুব ভালো করে পড়বে।
“হ্যাঁ হ্যাঁ একদম। তা আপনি সত্যিই আমাকে পড়াবেন তো। কখন আসবো পড়তে?
“সেটা আমি তোমাকে জানিয়ে দেবো। বিকেলে ফ্রি আছো তো।
“একদম!
“আচ্ছা!
আহনাফ বেরিয়ে গেল। নিঝুম খুশিতে নাচতে নাচতে গেল ক্যান্টিনের দিকে। এরপর থেকে এমন আর কখনো করবে না। ভুলেও না। পরিক্ষার আগেই সব পড়া শেষ করে ফেলবে। যেভাবেই হোক শেষ করবে। হুঁহ!
ক্যান্টিনে এসে খুঁজতে লাগল অশান্ত কে, শান্ত হাত নেড়ে বলে উঠল, “এই চশমিশ!
নিঝুম হাত উঠিয়ে জোরে জোরে নেড়ে বলল, “এই অশান্ত!” তার আওয়াজে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে গেল। শান্ত হাসছে, একনাগাড়ে সবাই দেখে যাচ্ছে অশান্ত আর চশমিশ কে।
——
বিকালে নিঝুমের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে আহনাফ। নিঝুম একগাদা বই হাতে নিয়ে বের হয়ে এলো। আহনাফ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কোনমতে বইগুলো গাড়িতে রেখে বলল, “চলুন!
“একদিনে এতো গুলো বই পড়বে তুমি?
নিঝুম মাথা চুলকাতে চুলকাতে হেসে বলল, “না মানে?
“থাক রাখো তোমার মানে? চলো বসো। দেরি হচ্ছে!
“আচ্ছা আচ্ছা!
গাড়িতে বসলো দুজন। আহনাফ গাড়ি স্টার্ট দিল। নিঝুম গাড়িতে বসে বসেও পড়ছে। পড়াশোনার ব্যাপারে সত্যি অনেকটা সিরিয়াস হয়ে গেছে সে। জ্যামে আটকে আছে গাড়ি, নিঝুম এখনো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। আহনাফ মুখ ফিরে তাকাল তার দিকে। নিঝুমের চুলগুলো একটা পেন্সিল দিয়ে খোঁপা করা। খোঁপা বোধহয় এখনি খুলে পড়ে যাবে। এছাড়া নিঝুমের ঠোঁটের মাঝে একটা কলম। কলম টা হাতে নিয়ে, চোখ বন্ধ করে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়া মুখস্থ করছে সে। আহনাফ হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার দৃষ্টি এবার বাইরে, জ্যাম ছাড়ল। আহনাফ আবারো গাড়ি স্টার্ট দিল। নিঝুম দ্বিতীয় বার চুলের খোঁপা করতে করতে বলল, “আহনাফ আমরা কোথায় যাচ্ছি?
“শান্ত’র বাসায়।
“অশান্তর বাসায়? কিন্তু কেন? একটা ভালো লাইব্রেরিতে গেলেই তো হতো। ওখানে কেন?
“শান্ত ও নাকি আমাদের সাথে পড়বে, এছাড়া ওর বাসাটাও ভালো। কেউ নেই বিরক্ত করার মতো। নিরব, নিস্তব্ধ। কেন?
নিঝুম দু ঠোঁট কামড়ে দৃষ্টি বাইরে সরাল। অশান্ত থাকতে আর কে আছে বিরক্ত করার মতো। আহনাফ আবারো বলে উঠল, “এতো কি ভাবছো, সেখানে তো তুমি আর আনকমফোর্টেবল ফিল করবে না, তাই না!
নিঝুম মাথা দুলাতে থাকে। অশান্ত থাকতে আর কে আছে আনকমফোর্টেবল ফিল করার মতো।
——–
তিন সোফার তিন দিকে বসে আছে তিনজন। অমি আর মিনি দুজনেই দৌড়াদৌড়ি করছে। মিনি এখন অনেকটা সুস্থ। তার গলায় একটা ঘন্টাও ঝোলানো হয়েছে। মিনি দৌড়াতেই সেটা টুং টুং শব্দ করে। তার সাথে যোগ হয়েছে অমি’র ঘন্টাও।
নিঝুম এদিকে, তার বিপরীতে’ই শান্ত। দুজনের মাঝে বসে আছে আহনাফ, সে খুব মনোযোগ দিয়েই পড়ছে। নিঝুম খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না অশান্ত’র জন্য। সে গালে হাত দিয়ে বসে বসে দেখছে তার চশমিশ কে। নিঝুম তার দিকে ফিরতেই শান্ত তার ভ্রু নাচিয়ে মুখ ভেংচি কাটে। নিঝুম ঠোঁট কামড়ে বইটা মুখের সামনে নিয়ে বসে থাকে। যেই না বইয়ের থেকে উঁকি দিয়ে এদিক তাকায় অমনি শান্ত তাকে চোখ টিপ দেয়। নিঝুম রেগে ধপাস করে বইটা টেবিলে রাখে। আহনাফ হতচকিয়ে বলে উঠে, “কি হলো?
“পড়তে পারছি না আমি।
“কেন?
নিঝুম ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শান্ত’র দিকে। আহনাফ শান্ত’র দিকে কলম ছুঁড়ে মেরে বলল, “প্রেম রেখে পড়তে বোস!
“😒
নিঝুম রেগে বলে উঠল, “আহনাফ, কাল আর আমরা এখানে আসবো না। লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়বো।
“ঠিক বলেছো!
শান্ত বই হাতে নিয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, পড়ছি পড়ছি!
নিঝুমও বই হাতে নিল। এবার সে ঘুরে বসল উল্টোদিকে। তার কার্যকলাপ দেখে আহনাফ আর শান্ত মুখ টিপে হাসল।
পরদিন আবারো আহনাফ আর নিঝুম শান্ত’র বাসাতেই উপস্থিত। তবে এরা তারা দুজন একা এলো না, তার সাথে সাথে আহিম, তিথি, তানিশা, দিয়া, রিয়া, আফিন কেও সাথে নিয়ে এলো। শান্ত দরজা খুলে হতভম্ব! একে একে সবাই ঢুকেই যাচ্ছে ঘরের ভেতর। নিঝুম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত কে চোখ টিপ মে’রে বলল, “নিন, এবার করুন আমায় জ্বালাতন।
শান্ত মুখটা ফ্যাকাশে করে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। বসার ঘরে একেক জন একেক দিকে বসে আছে। আহিম খানিকক্ষণ পর পরই তিথি কে খোঁচা মারছে। তিথিও পাল্টা জবাব দিছে। হয়তো প্রেমে পড়বার কথাটা তার মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছে। এদিকে রিয়া আফিনের একদিকে তার উপর হেলান দিয়ে বসে পড়ছে। কি রোমান্টিক! এটাকে বলে প্রেম, কিন্তু এই প্রেম কি নিঝুম কে বোঝানো উচিত! সে সোফার উপর বসে মিনি কে কোলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। শান্ত এবারও তাকিয়ে আছে তার দিকে। দিয়া তাকে চিমটি মে’,রে বলল, “এক্সাম ওর একার না, তোরও! ঠিকমতো পড়তে বস!
কথাটা একটু আস্তে বলায় শুধু আহনাফ আর তানিশার কানেই গেল। তারা মুখ টিপে হাসতে লাগল। শান্ত রেগে গিয়ে গতকাল যেভাবে নিঝুম উল্টো করে বসে পড়ছিল সেও সেভাবে বসে পড়ল। নিঝুম চোখ বাঁকিয়ে অশান্ত কে একটিবার দেখল। অতঃপর আবারো পড়ায় মনোযোগ দিল। মাঝখানে যখন সবাই বিরতি নিল, নিঝুম তখন মিনির সাথে খেলায় ব্যস্ত। অমি মিয়াও মিয়াও করে ডাকছে মিনি কে। নিঝুম কিছুতেই তাকে যেতে দেবে না। অমি দৌড়ে চলে গেল। মিনিও হঠাৎ দৌড়ে এলো তার পিছন পিছন। নিঝুমও তার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগল। এসে পৌঁছাল শান্ত’র বেলকনিতে! নিঝুম ততোক্ষণে মিনি কে হাতের নাগালে পেয়ে কোলে তুলে নিল। বকতে লাগল তাকে, “তোমাকে আমি কতোবার বারণ করেছি এই অমি’র সাথে চলতে না। তুমি জানো ও কতো বাজে বিড়াল। ওর সাথে থেকে থেকে তুমিও খারাপ হয়ে যাচ্ছ!”
বলেই সামনে যেতে ধপ করে ধাক্কা খেলো শান্ত’র সাথে। নিঝুম ভ্যাবাছেকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। মিনি এর মাঝে দৌড়ে চলে গেল। নিঝুম হা হয়ে গেল। শান্ত দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “মিনিও জানে, ওকে কোথায় যেতে হবে।
“মানে!
“মানে কিছু না, তুমি কতো বোকা তুমি জানো?
“হয়তো আপনি ভুলে গেছেন অশান্ত, আপনি মাথামোটা!
শান্ত হাসল। নিঝুম কে নিজের দুই বাহুতে আটকে রেখে বলল, “জড়িয়ে ধরো তো আমায়!
“কোন খুশিতে?
“আজব, একটু জড়িয়ে ধরবে, এতে এতো বাহানার কি আছে?
“অযথা ধরতে যাবো কেন?
“দুটো আইসক্রিম পাবে!
কথাটা বলামাত্র নিঝুম ধপ করে শান্ত কে জড়িয়ে ধরল। শান্ত খানিকটা চমকে উঠে বলল, “আমায় ভালোবাসো না আইসক্রিম কে!
“দুটোই তবে আইসক্রিম কে এক চিমটি বেশি ভালোবাসি!
শান্ত চোয়াল শক্ত করে নিল। নিঝুম মুখটা উঁচু করে বলল, “অশান্ত একটা আইসক্রিম!
“ফ্রিজে আছে!
কথাটা হয়তো শেষ হতে দেরি ছিল, কিন্তু নিঝুমের ছুটে যাওয়াতে না। সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শান্ত প্রথমে খানিকটা হতবাক হলেও দ্রুত তা সামলে উঠল। হয়তো সে ভুলেই গেছিল নিঝুম আর সবার মতো না। সে খানিকটা আলাদা, একটু চঞ্চল! আর নিঝুমের চঞ্চলতার প্রেমেই পড়েছিল সে। মিনি আর অমির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল সে। দুজনেই সামনের চেয়ারটায় বসে চাঁদ দেখছে। বাহ! চাঁদটা তো আজ ভারী সুন্দর!
#চলবে….
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৭
এক্সাম শেষে আজ বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। ভার্সিটি অফ, এ”কদিন ঘরে শুয়ে বসেই কাটিয়ে দিল নিঝুম। এখন বেশ করে আয়োজন করা হচ্ছে ঘুমানোর জন্য। নিঝুম ড্রেস চেঞ্জ করে একটা বড় টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে এলো। চুল গুলো বেনী করা শেষ করে উঠে দাঁড়াল।অমনি ফোনটা বেজে উঠলো তার। আহনাফ’র নামটা ভেসে উঠছে ফোনের ক্রিনে। রাত কম হয় নি, এতো রাতে আহনাফের ফোন। নিঝুম ফোনটা রিসিভ করে কিছু বলবার আগেই আহনাফ বলে উঠল, “নিচে নামো!
“এতো রাতে!
“তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
“কিই?
নিঝুম জানালা দিয়ে উঁকি মারল। আহনাফ দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। নিঝুম হা হয়ে গেল। সে ভুল দেখছে না তো। চোখের চশমা টা মুছে আবারো পড়ল। না ঠিকই দেখছে, এতো রাতে আহনাফ এখানে কি করছে!
কোনভাবে লুকিয়ে বের হলো নিঝুম। হিনা আছে বলে আজ এতো সাহস যোগাতে পারল। মেয়েটা বুদ্ধিমতী! সবকিছু সামলে নিতে পারবে। নিঝুম কে দেখতে পেয়েই একগাল হাসল আহনাফ। নিঝুম বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “আপনি এতো রাতে এখানে?
গাড়ির দরজা খুলে বলল,
“গাড়িতে বসো!
“কেন?
“ঘুরতে যাবো।
“আহনাফ এতো রাতে?
“তো কি? দেখো আজ রাতটাও কতো সুন্দর! চাঁদ দেখেছো!
“আহনাফ আজ জোৎস্না! রাত তো সুন্দর হবেই।
“তুমি জানো এসব!
“জানবো না কেন?
আহনাফ কিঞ্চিত হাসল। মাথার দুপাশে দুটো বেনী ঝুলছে তার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঘুমানোর বেশ জোড়ালো প্রস্তুতি চলছে। চাঁদের এই আলোয় নিঝুম কে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তার কাছে। এদিকে নিঝুম হামি ছেড়ে বলল, “আহনাফ আমার বেশ ঘুম পাচ্ছে।
“এতো সুন্দর রাতে তুমি কি ঘুরতে যাবে না। ঘুমাতে তো আরো পারবে, এই রাত কি আর আসবে।
“কিন্তু আহনাফ!
আহনাফ আর দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করল না। নিঝুম কে জোর করেই গাড়িতে বসাল। নিঝুম বলে উঠল, “কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?
“ফুচকা খেতে!
“এতো রাতে ফুচকার দোকান কে খুলে বসে আছে।
“না থাকলে খুলবো।
নিঝুম চোখ বাকালো। বলে উঠল, “আহনাফ আপনি ঠিক আছেন তো, জ্বর টর আসেনি তো আবার।
“না একদম ঠিক আছি, হঠাৎ করে আজ ইচ্ছা করল ঘুরতে, তাই তোমাকে আনলাম।
নিঝুম হাসল। আহনাফ এসে গাড়ি স্টার্ট করল। নিঝুম ফোন হাতে তুলে বলল, “অশান্ত কেও ফোন করে বলি আমাদের সাথে আসতে।
“না না!
“কেন?
আহনাফ খানিকক্ষণ ভনিতা করে বলল, “আমরা বরং ওকে গিয়ে ওর বাসা থেকে নিয়ে আসি।
“হ্যাঁ খুব ভালো হবে, অশান্ত খুব চমকে যাবে।
“বেশ হবে বলো!
নিঝুম মাথা দুলাল। রাস্তায় তেমন কোন জ্যাম না থাকায় ভালোই চলছিল। খানিকক্ষণ পথ আসবার পর নিঝুম বাইরে তাকাল। তার খেয়াল হলো, এটা তো অশান্ত’র বাসার রাস্তা নয়। চট করেই বলে উঠল সেই কথা। আহনাফ হেসে বলল, “এখানে একটা কাজ আছে।
“কি কাজ!
ততোক্ষণে গাড়ি থামিয়ে দিল আহনাফ। নিঝুম খানিকটা অবাক হলো। আশপাশ তাকিয়ে দেখল, “এতো একটা পার্কের মতো মনে হচ্ছে। আহনাফ গাড়ি থেকে নেমে বলল, “নামো, বলছি!
“আমরা কোথায় আহনাফ!
চট করেই নিঝুমের হাত ধরে নিল আহনাফ। বলে উঠল, “আজকের ডেট টা এরপর থেকে সবসময় মনে রাখবে।
“কেন?
“দরকার আছে!
বলামাত্র নিঝুমের হাত ধরে এগিয়ে গেল সে। কিছুদূর আসার পর’ই নিঝুম কে ছেড়ে দিল। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাল। তার মুখটা এবার আরো গম্ভীর হয়ে গেল। পার্কের এই মাঝের অংশ টুকু লাইটিং করা। আলো জ্বলছে চারদিকে। কয়েকজন একসাথে কথা বলার আওয়াজ আসছে। চোখের চশমা ঠিক করে সামনে তাকাল নিঝুম। এতো অশান্ত দাঁড়িয়ে, তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আরো কয়েকজন। আহিমের সাথে চোখাচোখি হলো নিঝুমের। আচ্ছা কিছু একটা কি হচ্ছে এখানে!
অশান্ত ফিরল। নিঝুম কে দেখতে পেয়ে অনেকটা অবাক সে। সামনে এগিয়ে আসছে অশান্ত, নিঝুম অবাক চোখে তাকাল আহনাফের দিকে। আহনাফ বলে উঠল, “হ্যাপি বার্থডে বলো!
“আজ অশান্ত’র জন্মদিন!
“হ্যাঁ।
“আপনি আমায় এখন বলেছেন!
“যা বলছি তাই বলো। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে!
অশান্ত এগিয়ে আসছে। নিঝুম হঠাৎ বলে উঠল, “হ্যাপি বার্থডে অশান্ত!
শান্ত থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার চোখে মুখে বিস্ময়! দ্রুত তা সামলে বলল, “তুমি জানতে!
নিঝুম দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, “হুম! একটু আগেই জানলাম, আহনাফ বলেছে!
শান্ত মুখ ফিরল। আহনাফ হেসে সামনে এগিয়ে চলে গেল। নিঝুম ছুটে এসে বলল, “অশান্ত আজ সত্যি আপনার জন্মদিন!
“উইস করবার পর জিজ্ঞেস করছো?
“তবে আপনি আমায় বললেন না যে!
“সব কথা বলতে হয় না!
ওমনি পেছন থেকে আওয়াজ এলো। কেক কাটার জন্য ডেকে যাচ্ছে সবাই। শান্ত নিঝুমের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “চলো!
সবাই অপেক্ষা করছে, দিয়া একটু উঁচু গলায় বলল, “বাহ এ কাকে দেখছি?
রিয়া হেসে বলল, “ও থাকবে না, এই আশাই বা করলি কি করে?
“কিন্তু ও এলো কি করে?
নীলাভ্র বলে উঠল, “আহনাফ এনেছে!
বলমাত্র কিঞ্চিত হাসল নিঝুম কে দেখে। আজ অনেকদিন পর দেখছে তাকে। আহনাফের পাশে দাঁড়ান ইফা চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। আজকের দিনটাতেও এই মেয়েটার আসার দরকার ছিল। কেন এলো ও? আজ না এলেই কি হতো না।
তানিশা বলে উঠল, “হয়েছে হয়েছে, এই কথা থাক এবার। শান্ত জলদি কেক কাট। দাড়োয়ানের থেকে আধ ঘন্টার পারমিশন নিয়েছি। একটু পর’ই এসে বলবে বের হও সবাই। তোমাদের সময় শেষ!
আহিম চোখ ছোট ছোট করে বলল, “এজন্যই বলেছিলাম একটা পার্টি সেটার বুক করতে।
তানিশা আর আহনাফ একসাথেই বলে উঠল, “এই চাঁদের আলোয়…, বলামাত্র দু’জনেই থেমে গেল। চোখাচোখি হলো দুজনের, আহনাফ চোখ সরিয়ে নিল। তানিশা হেসে বলল, “এতো সুন্দর চাঁদের আলো দেখতে পারছিস আর চারপাশটা দেখলি কি রকম, একটু ইউনিক টাইপের তাই নাহ। এরকম টা তোকে দিত পার্টির লোক!
আফিন বলে উঠল,”আচ্ছা আচ্ছা তোরা থাম। শান্ত জলদি কেক কাট!
শান্ত হেসে কেক কাটলো। কেক’র প্রথম বাইট বরাবরের মতো খেলো আহনাফ! এরপর একে একে, তানিশা, নীলাভ্র, রিয়া, দিয়া, আফিন, আহিম আর ইফা। সর্বশেষে কেক’র পিস টা এনে তুলে দেওয়া হলো নিঝুমের মুখের সামনে। নিঝুম হেসে কেক’র পিস টা হাতে নিয়ে শান্ত’র মুখে দিয়ে বলল, “হ্যাপি বার্থডে অশান্ত! শান্ত কিঞ্চিত হাসল।
ওদের দুজনকে রেখে বাকি সবাই উধাও। নিঝুম বেছে বেছে ইফার মুখটাই দেখেছিল। কেমন অস্থির হয়ে ছিল মেয়েটা। চোখ মুখ কঠিন করে ছিল। আচ্ছা ইফার সাথে আরো একবার কি তার কথা বলা উচিত। শীতল হাতের ছোঁয়া মনোযোগ বদলে দিল নিঝুমের। চেয়ে দেখল, অশান্ত তার হাত দুটো ধরে আছে। নিঝুম হাসল, অশান্ত বলে উঠল, “চলো তোমায় পৌঁছে দিই।
“হ্যাপি বার্থডে অশান্ত!
শান্ত হাসল, নিঝুম মুখটা উঁচু করে বলল , “আপনার গিফট আনতে পারি নি অশান্ত!
“তুমিই তো আস্ত একটা গিফট!
নিঝুম লজ্জা মাখা মুখে হেসে ফেলল। শান্ত কিঞ্চিত হেসে হিচকে টানল নিঝুম কে। নিঝুমের গলা জড়িয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, “নাও গিফট নিয়ে নিলাম!
“এখন তাহলে রির্টান গিফট দিন!
শান্ত ঠোঁট কামড়ে হাসল। নিঝুম এক ধাক্কা দিয়ে শান্ত কে সরিয়ে বলল, “আমি মোটেও সেই কথা বলি নি।
“হ্যা তোমার তো ওই এক জিনিস, আইসক্রিম!
নিঝুম চোখ বাকাল। অশান্ত’র পিছনে বরাবর আকাশে চাঁদ টা দেখা যাচ্ছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাঁদ’টা আজ ভারী সুন্দর!
শান্ত ঘুরে চাঁদের দিকে তাকালো। তার ইচ্ছে ছিল, দুজন বসে এভাবে চাঁদ দেখার। আজ কি সেটা সম্ভব হবে! কি জানি? হুট করে এসে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরল নিঝুম কে। তার ঘাড়ে থিতুনি রেখে বলল , “আজকের রাতটা ভারী সুন্দর চশমিশ, কেন জানো?
“জোৎস্না বলে!
“উঁহু, আমার কাছে তুমি আছো বলে। তুমি আমার সাথে থাকলে প্রতিটা রাত’ই আমার কাছে ভারী সুন্দর!
নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসল। আহিম ওদিক থেকে চেঁচিয়ে বলল, “প্রেম নিবেদন শেষ হলে এবার বাসায় চলা যাক! না হলে মানুষ তোদের চোর ভেবে পি*টাতে আসবে!
আহিমের কথায় হাসির রোল পড়ে গেল সবার মাঝে। নিঝুম আর শান্ত’র কানে বোধহয় কথাটা পৌঁছায় নি। নিঝুম এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে আর শান্ত নিঝুমের দিকে। হ্যাঁ , এটা সত্যি! তাদের কখনো একসাথে বসে চাঁদ দেখা হবে না। কারণ শান্ত নিঝুম কে ছেড়ে কখনোই ওই দূর আকাশের চাঁদ দেখবে না।
——-
ভার্সিটি খুলবে আর দুদিন পর। ঘড়িতে এখন বিকাল ৩ টা বাজে। হঠাৎ এই সময় কে জানি কলিং বেল বাজাচ্ছে। শান্ত ঠিক মনে করতে পারল না, কারো কি আসার কথা ছিল। কলিং বেল’র শব্দ অমি আর মিনি কে বড্ড বিরক্ত করছে। তাদের মাঝে আজ সকালেই খুব ঝগড়া হয়েছে। শান্ত’র ঘুম ভেঙেছিল তাদের ঝগড়াতেই। সে কি মারা*মারি! মানুষের মারা*মারি থামানোর পদ্ধতি জানা আছে শান্ত’র , কিন্তু বিড়ালের ঝগড়া থামাবে কি করে? দুজন দুদিকে বসে ঘুমাচ্ছে, অমিও ফিরে তাকাচ্ছে না মিনি’র দিকে তো মিনিও কি কম যায়। আচ্ছা ওদের ঝগড়া কতোদিন টিকে!
রান্নার কাজের জন্য যে আন্টিকে রাখা হয়েছে সে এসেছে আজ তিনদিন পর। আরেকজন যে ছিল সে এসেছে ৭ দিন পর। শান্ত’র বিরক্ত লাগলেও কিছু বলার নেই। কেন জানি কিছু বলতে পারে না সে। দু’জনেই তাকে বাবা বলে ডেকে যেন মায়া লাগিয়ে দিয়েছে। সকালের সেই আন্টি এসে জামাকাপড় আর ঘর পরিষ্কার দিয়ে গেছে। এখন যে এসেছে তার কাজ হচ্ছে রান্না করা। যদিও যে রান্না করে সে দুদিন পর আসলেও সমস্যা নেই। একজন মানুষের একদিনের রান্না দুদিনও খেয়ে কাটাতে পারে। কিন্তু ঘর অপরিষ্কার থাকলে শান্ত’র অসহ্য লাগে। অমি আর মিনি কে আজ গোসল করানো হয়েছে। বেচারা আন্টিকে কাম’ড় আর খা’মচি মে’রে অস্থির করে তুলেছে। এদের নখ কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। রান্না হচ্ছে, ক্ষুধায় অশান্ত’র অসহ্য লাগছে, এসময় কেউ এসেছে শুনেও আরো বিরক্ত লাগছে। এক গাদা বিরক্তি নিয়েই দরজা খুলতেই একটা গোলাপ তার সামনে ধরে একগাল হেসে নিঝুম বলে উঠল, “শুভ জন্মদিন অশান্ত!”
শান্ত হা হয়ে তাকিয়ে আছে। নিঝুম, এখন, এই অসময়! বিরক্তি লাগার পরিবর্তে কেন জানি তার খুশিই লাগছে। বিরক্তি ছাপ দ্রুত মুখ থেকে সরে গেল। নিঝুম ছুটে এসে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল তাকে। খুশির উপর খুশি ! কিন্তু যেই না জড়িয়ে ধরতে যাবে অমনি আন্টি এসে চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল। অস্বস্তিতে পড়ে অশান্ত জড়িয়ে ধরার বদলে নিঝুম কে সরিয়ে আনল। নিঝুম হতবুদ্ধি’র মতো চেয়ে রইল! শান্ত হেসে বলল, “তুমি এসময়!
“আপনি কি বিরক্ত হলেন অশান্ত! দেখুন আমি আপনার জন্য গোলাপও এনেছি!
শান্ত দাঁত চেপে বলল,
“আস্তে বলো, ঘরে আন্টি আছে।
নিঝুম মুখ ফিরিয়ে তাকাল। একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছে, তিনি পান চাবাচ্ছেন। পানের রসে তার ঠোঁট সব লাল হয়ে গেছে। তিনি সরে এলেন রান্না ঘরে! নিঝুম ফিসফিসিয়ে বলল, “এনি কে ?
“আন্টি, রান্না করে দিয়ে যান আমার জন্য।
“আগে কখনো তো দেখি নি!
“রোজ রোজ তো আসে না, দেখবে কি করে?
“তাহলে এখন কি আমি চলে যাবো!
“না দরকার নেই, রান্না বোধহয় হয়েই গেছে। আরেকটু পর তিনি চলে যাবে। কিন্তু তুমি হঠাৎ!
“আপনার জন্য গিফট নিয়ে এলাম।
“গিফট!
“হুম! ( হাতের ব্যাগ টা নাচিয়ে বলল )
“কি আছে এতে?
“কেক তবে বানানো না!
“মানে?
নিঝুম ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“মানে এই হলো যে আম্মু আমায় তার রান্না ঘরে ঢুকতে বারণ করে দিয়েছে। তাই আমি চলে এলাম এখানে।ভাবলাম আপনার সামনে বসেই কেক টা বানিয়ে ফেলি। দারুন না আইডিয়া!
“হুম দারুন!
“জানেন তো অশান্ত…
কথা শেষ করবার আগেই আন্টি বলে উঠল, “বাবা শান্ত!
“জি আন্টি?
“পুঁইশাক দিয়ে ইলিশ মাছ করেছি, ডাল আর করলা ভাজি। আর কিছু করে দেবো। মেহমান এসেছে…
হুট করে নিঝুম বলে উঠল, “নাহ আন্টি, আমি খেয়েই এসেছি। আর কিছু করবার দরকার নেই!
“আচ্ছা!
বলেই নিঝুমের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি। নিঝুমের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি এবার গেলেন বাসন ধুতে। শান্ত জিহ্ব ভিজিয়ে বলল, “তুমি বসো এখানে আর আমি…
নিঝুম শান্ত’র হাত ধরে ধপ করে বসিয়ে বলল, “আমি কেন? আপনিও বসুন!
শান্ত হতচকিয়ে গেল। আন্টি কিছুক্ষণ পর পরই এখানে কেমন করে জানি তাকাচ্ছেন। তার তাকানোতেও অস্বস্তি! নিশ্চয়ই তিনি অন্যদের ঘরে গিয়ে বলবেন না, “ওই ঘরেতে যে ছেলেটা একা থাকে, তার সাথে দেখা করতে হুট করেই একটা মেয়ে চলে এলো। মেয়েটা এসেই তাকে জড়িয়ে ধরল. হাত ধরে একসাথে বসতে বলল, মেয়েটার শরম লজ্জা কিছুই নেই!” বলবে কি এসব, না বোধহয় বলবে না। কিন্তু শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে ভালো করেই জানে, তাদের অভ্যাস গল্প করা, আর গল্পটা এবার তাকে নিয়েই হবে,যা তারা আরেকটু বানিয়ে বলবে। এদিকে নিঝুম ফুলটা সামনে রেখে শান্ত’র চুলে হাত দিয়ে বলল, “আপনার চুলের এই হাল কেন অশান্ত!
“কিছু না, ওই শুয়ে ছিলাম!
“মিনি কোথায়?
“ঘরে!
বলামাত্র শান্ত চুপ হয়ে গেল। নিঝুমও দৌড়ে তার রুমের দিকে গেল। কিন্তু শান্ত গেলো না, সে বসেই রইল। আন্টি যেভাবে নিঝুম কে যেতে দেখল, যেন তিনি মহাবিরক্ত! এসময় কোন ভাবেই শান্ত’র উঠা সাজে না। গল্প না হয় আর নাই বানালো।
মিনি কে কোলে করে নিঝুম বেরিয়ে এলো। তার মুখটা হাসি হাসি! শান্ত অলপক দৃষ্টিতে সেই হাসির সৌন্দর্য দেখছিলো। হঠাৎ আন্টির আওয়াজ পেয়েই ভ্যাবাছেকা খেয়ে উঠল সে। আন্টি’র কাজ শেষ, তিনি চলে যাচ্ছেন। শান্ত উঠে দরজা বন্ধ করবার আগ অবদি তিনি চোখ বাঁকিয়ে নিঝুম কে দেখে যাচ্ছিলেন। কে জানে কি কি ভাবছিলেন তিনি। আন্টি যেতেই নিঝুম মুখ ভেংচি কেটে বলে উঠল, “কি অদ্ভুত ভাবে দেখছিলো আমায়, মনে হচ্ছিল আমি কোন ভিন্ন গ্রহের প্রাণী!
শান্ত হাসল। নিঝুম মিনি কে রেখে প্যাকেটা নিয়ে আগালো রান্না ঘরের দিকে। এই মাত্র আন্টির পরিষ্কার করা রান্না ঘরের হাল যে বেহাল হবে শান্ত তা বেশ বুঝতে পারছে। তবুও কিছু বলছে না নিঝুম কে। করুক না সে কি করতে চায়, যা করছে সে তো ভালোবেসেই করছে। নিঝুম বলে উঠল, “অশান্ত আমি কিন্তু চকলেট কেক বানাচ্ছি!
শান্ত গোলাপ টা হাতে নিয়ে বলল, “আগে কখনো কেক বানিয়েছো!
“বানিয়েছিলাম একবার, কিন্তু!
“কিন্তু?
“আসলে আমি কেক এ চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছিলাম!
শান্ত চোখ বড় বড় করে বলল, “লবণ!
“হ্যাঁ মানে বাবা ছাড়া আর কেউ খায় নি, কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। আজ আমি চিনিই এনেছি, একদম দেখে খেয়ে এনেছি!
“সেদিন দেখো নি!
“না আসলে মানে অনেক কাহিনী বাদ দিন অশান্ত!
“আচ্ছা যাও বাদ দিলাম, কিন্তু আমায় বলো তো তুমি এতো কিপ্টা কেন?
“কিপ্টা!
“একটা গোলাপ আনলে!
“অশান্ত এখন দুপুর হয়ে গেছে, কোন দোকান’ই খোলা ছিল না। যাও একটা ছিল সেখানে এই গোলাপের চেয়ে সুন্দর আর কোন গোলাপ’ই ছিল না। আর আপনি কি জানেন না, প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যেকার ভালোবাসার বন্ধন হচ্ছে একটি গোলাপ!
“একটি গোলাপ? কিভাবে?
“আপনি কখনো কোন উপন্যাসে পড়েছেন নায়ক একগাদা গোলাপ নিয়ে প্রেম নিবেদন করতে, না কখনো না। সবাই একটি গোলাপ দিয়েই প্রেম নিবেদন করতো।
“কিন্তু তুমি তো আমার প্রেম নিবেদন করোনি!
নিঝুম ডিম ফাটিয়ে বলল, “আপনি করেছিলেন!
শান্ত হাসল, জবাব দিল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, নিঝুমের কাজ! ওর কাজের কোন ঠিকঠিকানা নেই। ময়দা রাখতে গিয়ে ফেলে দিল, চিনি দেবার আগে তিনবার খেয়ে দেখল চিনিই কি না, শেষে খানিকটা লবণ দিতেও ভুলে গেল!
শান্ত হাসছে! নিঝুমের গালে ময়দা লেগে আছে। শান্ত এগিয়ে এসে টিস্যু দিয়ে নিঝুমের গাল মুছে দিল। নিঝুম এবার সবকিছু ব্লেন্ডার দিয়ে মিক্স করছে। শান্ত হুট করেই পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরল নিঝুম কে। নিঝুম কেঁপে উঠল। হাত থেকে ব্লেন্ডারটা পড়ে যেতেই নিল, তার আগেই শান্ত ধরে ফেলল। নিঝুমের হাতের উপর হাত রেখে বাটিটা ধরে রাখল। নিঝুম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত এখন একদম কাছে, অনেকটাই কাছে। তার ভারী নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পড়ছে তার গালে। নিঝুম ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। মুখ তুলে একবার তাকাচ্ছে শান্ত’র দিকে। শান্ত তার দিকে ফিরতেই চট করে চোখ নামিয়ে ফেলল সে। চশমার আড়াল থেকে এতো সামনে থেকে অশান্ত কে দেখতে একদম অন্যরকম লাগছে।অশান্ত গায়ে এক ধরণের গন্ধ আছে, গন্ধ টা তার বেশ চেনা। কেন জানি খুব লজ্জা লাগছে, লজ্জায় তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। লাল গাল হেসে যাচ্ছে। নাক ঘামতে শুরু করেছে। নিঝুম অস্বস্তিতে পড়ে একটু সরে আসতে চাইলেই শান্ত তাকে আটকে দিল। সে ঠোঁট কামড়ে দাড়িয়ে রইল। অশান্ত বলল, “এই নাও হয়ে গেছে। এবার বেক করতে হবে!
“কিন্তু আগে দেখতে হবে তো, মিষ্টি ঠিক আছে কি না?
“ওহ তাই তো!
নিঝুম চামচ দিয়ে খানিকটা মিশ্রণ উঠিয়ে শান্ত’র দিকে বাড়িয়ে দিল। শান্ত খানিকটা মুখে দিয়ে বলল, “হাম মোটামুটি!
“মোটামুটি কেন? মিষ্টি কি ঠিক হয় নি!
শান্ত হাসল, হেসে হুট করেই চশমিসের গালে চুমু খেয়ে বলল, “এবার ঠিক আছে! চশমিশ লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
কেক বেক হতে এখনো অনেকক্ষণ লাগবে। অমি কে দেখে মনে হচ্ছে সে এসেছে মিনির রাগ ভাঙাতে। যে করেই হোক, এই রাগ ভাঙাতে হবে। নিঝুম ফ্রিজ থেকে একটা জুসের প্যাকেট বের করতে গিয়ে আইসক্রিমের বাটি পেয়ে গেল। এবার জুস ছেড়ে সে আইসক্রিমেই হাত দিল। আইসক্রিম পেয়ে খুশিতে তার চোখ চকচক করছে। শান্ত দূর থেকে তাকে দেখে হাসল। আইসক্রিম তার এতো পছন্দ না, কিন্তু এখন তার ফ্রিজে প্রায় তিন চার ফ্লেভারের আইসক্রিম! সবগুলোই নিঝুমের জন্য। নিঝুম রান্না ঘরে দাঁড়িয়েই আইসক্রিম খেয়ে যাচ্ছে। শান্ত রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। আইসক্রিম খাবার ইচ্ছা না থাকলেও নিঝুমের থেকে খানিকটা চাইল। নিঝুম চট করেই চোখ ঘুরিয়ে বলল, “না!
“না মানে?
“না মানে না, দেবো না?
“এটা আমার ফ্রিজের আইসক্রিম।
“কিন্তু এখন আমার হাতে, আর আপনি তো আইসক্রিম খান না অশান্ত!
“তো কি আজ খেয়ে দেখবো!
বলেই হাত থেকে বাটিটা কেড়ে নিল। নিঝুম চোখ বাঁকিয়ে আছে, অশান্ত তাকে ইচ্ছে করে জ্বালাচ্ছে এটা সে জানে। শান্ত একটা চামচ হাতে খানিকটা খেয়ে বলল, “বাহ দারুন তো!
নিঝুম দ্রুত কেড়ে নিয়ে বলল, “আইসক্রিম খেতে দারুন’ই হয়।
“আরেকটু দেবে না!
“না?
“ওই এতো বড় এক বাটি আইসক্রিম তুমি একা খাবে।
“পারবো খেতে।
“মোটেও না, শেষে গলা বসে আছে। অনেক খেয়েছ আবার পরে!
কিন্তু নিঝুম তা মানতে মোটেও রাজি নয়। সে আইসক্রিমের বাটিটা পেছনে লুকিয়ে রেখে পিছনে চলে গেল। শান্ত অমনি তার হাত ধরে আটকে দিল তাকে। পেছন থেকে আইসক্রিমের বাটিটা বের করে রাখল এপাশে। নিঝুম ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।শান্ত অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছে দিল হাত দিয়ে। শান্ত’র হাতের শীতল ছোঁয়া পেয়েই নিঝুম আঁতকে উঠল। তার শরীর কেমন অসাড় হয়ে গেল। চোখের পাতা ফেলছে বার বার। শান্ত এখন তার মাঝেই নেই। তার চোখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, অশান্ত’র চোখ জোড়া যে একদম স্থিয় হয়ে আছে তার দিকে। নিঝুম শুকনো ঢোক গিলল। শান্ত তার কানে চুল গুলো গুঁজে দিল। কানের নিচে হাত রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল তার ঠোঁটের দিকে। অমনি নিঝুম বলে উঠল, “অশান্ত!
হতচকিয়ে উঠল শান্ত! নিঝুম কাঁপছে, তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। গাল দুটো অসম্ভব লাল, লজ্জায় তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না চশমিশ! শান্ত মৃদুস্বরে বলল, “হুঁ!
“আমমমমমম..
“বলো!
“আমার খুব লজ্জা লাগছে, তাকাতে পারছি না আপনার দিকে।
মিনমিনিয়ে কথাটা বলল নিঝুম। শান্ত হাসল। সে একটু পেছন গিয়ে ঝুঁকে নিঝুম কে দেখবার চেষ্টা করল। নিঝুম দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেলল। শান্ত হেসে বলল, “আমায় অনুভব করো তো তুমি!
নিঝুম অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে চোখ তুলে তাকাল। শান্ত কিঞ্চিত হেসে বলল, “তবে অনুভব করো আমায়, অনুভব করো এই সময়টাকে।
কথাখানা বলে নিঝুমের চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলল। সবকিছুই এবার ঝাপসা! নিঝুম প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিছু দেখবার তবে সম্ভব হচ্ছে না। হঠাৎ কোন শীতল ছোঁয়া পেয়ে আঁতকে উঠল সে। শান্ত তার দুটো ঠোঁটে চট করে চুমু খেয়ে পেছন ফিরে গেছে। নিঝুমের ঠোঁট জোড়া এখনো কাঁপছে, বড্ড নেশা লেগে যাচ্ছে তার। হঠাৎ করেই কাছে এসে আবারো আঁকড়ে ধরল ঠোঁট দুটো কে! নিঝুম ঘাবড়ে গেল। আঁকড়ে ধরল অশান্ত কে!
খানিকক্ষণ পর শান্ত নিঝুমের থিতুনি হাত রেখে তার চোখ দুটির দিকে তাকাল। অসম্ভব সুন্দর এই চোখজোড়া! চশমার আড়াল থেকে আরো কাছাকাছি আরো সুন্দর লাগছে। নিঝুম চোখের পাতা বড্ড নড়ছে। শান্ত’র প্রতিটা নিঃশ্বাস পড়ছে তার মুখের উপর। শান্ত ধীর স্বরে বলে উঠল, “বাহ এই চোখজোড়া যে বড্ড সুন্দর!” নিঝুম কিঞ্চিত হাসল, লজ্জা মাখা হাসি! শান্ত তার অনেকটা কাছে , অথচ শান্ত কে দেখতে পারছে না সে। তবে অনুভব করতে পারছে। এই অনুভবের তীব্রতা অনেকখানি! সারাজীবন মনে থাকবে তার এমন অনুভূতির কথা। চোখে দেখতে না পেয়ে সে যা অনুভব করছে এটা হয়তো চোখে দেখতে পেয়ে করতে পারতো না!
#চলবে….