#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৫
সোহান কী আমার সাথে নাটক করল? কারণ ক্যালেন্ডার টা হাতে নিতেই কিছু ছবি মেঝেতে পড়ল। মনে হয়েছিল ছবিগুলো হয়তো সোহানের কোনো গোপন ছবি যেগুলো ক্যালেন্ডারে এভাবে রেখেছে। প্রথমে এমন কথাটায় মনে চলে এসেছিল। ক্যালেন্ডার হাতে নিতেই ছবিগুলো উল্টো হয়ে পড়েছিল তাই। পরক্ষণেই অবিশ্বাসের চাদর টা মন থেকে সরে গেল, যখন ছবি গুলো মেঝে থেকে তুলে উল্টো করে ধরে নিজের চেহারাটায় দেখলাম। ছবিগুলো বেশ পুরনো নবম,দশম শ্রেণী এবং কলেজে থাকা অবস্থায় তুলা। ৮-১০ টা ছবি তুলে রাখা আছে। প্রতিটি ছবির পেছনে সেদিনের ঘটে যাওয়া কাহিনি ছোট করে বর্ণণা করা আছে। বেশ ভালোই লাগল বিষয়টা দেখে। অন্তত কেউ একজন তো আমাকে ভালোবাসে। তার মনের গহীনে তো অপ্সরা নামটা রয়েছে। আমি চুপ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ছবিগুলো যথাস্থানে রেখে খাটের কোণে এসে বসলাম। ভেতরটা বেশ প্রশান্তি লাগছে। মনটাতেও বেশ স্বস্তি লাগছে। নিজের জীবনের মোড় হয়তো ঘুরবে। হয়তো এত দিনের কষ্ট সব সুখ হয়ে পরিণতি পাবে আবার না ও পেতে পারে। তবে নিজেকে সেভাবেই গড়ে নিয়েছি যাতে করে ভালো খারাপ যাই হোক মেনে নিব আমি। অরন্যকে একটু একটু মনে পড়লে ও সেটা দমিয়ে নিচ্ছিলাম বারবার। অরন্যের শাস্তি কামনা করেছিলাম তবে মৃত্যু না। সৃষ্টি কর্তার লীলা ছিল ভিন্ন তাই সে আজ ওপারে। দোয়া করি সে যেন জান্নাতবাসী হয়।
বেশ কিছুক্ষণ একা বসে রইলাম। টুকটুকিরও পাত্তা নেই। একা বসে থাকতে তেমন ভালো লাগছে না। টুকটুকিকে খুঁজে বের করে ওর সাথে একটু সময় কাটালে মনটা সিক্ত হবে। তাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার দিকে পা বাড়াতেই লক্ষ্য করলাম সোহানের মা এসেছে। সোহানের মা আমার দিকে তাকিয়ে বেশ হালকা গলায় বলল
– একটু বসো ঐখানে, কথা আছে।
মনের ভেতরটা হালকা কম্পিত হলো। মনে হলো উনি বলবেন, এ বিয়েতে উনি রাজি না কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে উনি বলে উঠলেন
– তোমার মা বাবার সাথে কথা বললাম উনারা সন্ধ্যায় আসবেন। আর আজকেই তোমার আর সোহানের বিয়ে দিতে চাই। অনেক ঝামেলা গেল আর নতুন কোনো ঝামেলা হওয়ার আগেই সব শেষ করতে চাই। একটা অনুগ্রহ রাখবে শুধু, আমার ছন্নছাড়া ছেলেকে ছেড়ে কখনও কোথায় যেও না। ওর জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে দিও। বড় ছেলের পরিণতি যেন ছোট ছেলের না হয়।
উনার কথা শুনে আমি চাপা কন্ঠে জবাব দিলাম
– আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না আমি এমন কিছুই করব না যাতে করে সোহান কষ্ট পায়। আর আমি সোহানকে ততটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করব যতটুকুতে সে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারে। না পাওয়ার যন্ত্রণা কত প্রখর আমি জানি। এমন কিছু হবে না। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
– এখন থেকে মা ডেকো। আর একটু তৈরী হও। সন্ধ্যায় কাজী আসবে বিয়ে পড়াতে। একটু তো নিজেকে গুছাও সাজগোজ করো। কাউকে আপাতত বলতে চাচ্ছি না বিয়ের ব্যাপারটা। বিয়ে হওয়ার পর সবাইকে জানাব।
আমি লজ্জা মাখা মুখে মাথা নেড়ে গেলাম। আড়চোখে দরজায় তাকিয়ে দেখলাম সোহান দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সোহানের হাসি দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম। মা সোহানের উপস্থিতি টের পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। সোহান এবার আমার কাছে আসলো। আমি সোহানের দিকে তাকালাম। এ প্রথম ওর দিকে তাকাতে বেশ লজ্জা লাগছে। ওর উপর খবরদারি করতে লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি সত্যিই নতুন বউ। সোহান আমার অবস্থা দেখে আমার হাতটা ধরে তার কাছে এনে বলল
– আজ একটু সুন্দর করে সাজবি। সরি সাজবে। তোকে যেন সরি তোমাকে হবে। তোমাকে যেন পরীর মতো লাগে। কপালে লাল টিপ দিবি। ধুর তুমি করে ডাকতে পারব না তুই করেই ডাকব কেমন।
আমি মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বললাম আচ্ছা। সোহান আমার হাতটা টেনে তার কাছে আনল। টকুটকি এর মধ্যে উপস্থিত হতেই সোহান হাতটা ছেড়ে দিল। আমি টুকটুকিকে কোলে নিয়ে সোহানের কানে কানে বললাম
– আমিও তোরে ভালোবাসি।
বলেই রুম থেকে প্রস্থান নিলাম। টুকটুকির সাথে কিছুক্ষণ খেলে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। তারপর গোসল করতে গেলাম। ভালো করে গোসল করলাম। চুলগুলো বেশ যত্ন করে শ্যাম্পু করেছি। আজকে অনেক ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে যন্ত্রণার পর যেন স্বস্তি মিলছে। নিজেকে বেশ পরিপাটি করে ফেললাম।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। বাবা, মা সবাই আসলো। মা আমার কাছে এসে বলল
– মারে অভিমান করেছিলাম তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ক্ষমা করে দিস। তোরে আল্লাহ দু হাত ভরে দিছে। সোহানের মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। আল্লাহ তোকে তাই দিছে।
বাবাও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল
– ক্ষমা করে দিস তোকে ভুল বুঝার জন্য।
তাদের প্রতি রাগটা বেশিক্ষণ করতে পারলাম না। ভাই আর ভাবী এসেও ক্ষমা চেয়ে নিল। একটা বিয়ে যেন সমস্ত পরিস্থিতি পরিবর্তন করে দিল। অথচ এরাই গতকাল পর্যন্ত আমার মুখ দেখতে চায়নি। কষ্টটা চেপে গেলাম শুধু। কাজী আসলো। দুই পরিাবর একসাথে বসলো। আমি আজ লাল বেনারসি পরেছি। হাতে লাল চুড়ি। কপালে লাল টিপ। যে সাজটা সাজতে চেয়েছিলাম চার বছর আগে কিন্তু ব্যর্থতার গ্লানি সেদিন আটকে দিয়েছিল সব। আজকে সে একই সাজটা সেজেছি। যেন অনেক কষ্টের পর প্রাপ্তি।
কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করল। আমাকে কবুল বলতে বলল। কবুল বলার সময় বেশ জোর গলায় কবুল বললাম। তিনবার কবুল বলেই কেঁদে দিলাম। আজকে আমি নতুন জীবনে পা দিয়েছি। একজনের সন্তান আমার পেটে আরেকজনের বউ আমি হব। কেউ না জানুক আমি আর সোহান সবটা জানি। সোহানও কবুল বলল। দুজনের সুখ চেয়ে মোনাজাতের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হলো।
বিয়ের পর আমাকে নিয়ে বসানো হলো সোহানের রুমে। মা,বাবা রাতের খাবার খেয়ে বাসায় চলে গেল। যাওয়ার আগে আমাকে মন ভরে দোয়া করে গেল। টুকটুকি বেশ কয়েকবার রুমে এসে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে গেল। মা কয়েকবার রুমে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে কী না। আমি মাথা নেড়ে না করলাম। অথচ সোহানের পাত্তা নেই। যার জন্য বসে আছি সে কই। ঘড়ির কাটায় রাত এগারটা বাজে। এখনও সোহান আসলো না৷ বেশ রাগ লাগছে ওর উপর। বিড়বিড় করে সোহানকে বকতে লাগলাম। এর মধ্যেই সোহানের আগমণ ঘটল। হাতে খাবারের প্লেট। আমার পাশে এসে বসে বলল
– বিড়বিড় করে আমাকেই বকছিস তাই না?
– তো কী করব? তোকে বকব না তো আদর করব?
সোহান খাবারের প্লেটটা বিছানার পাশে রেখে আমার কানের কাছে এসে বলল
– আমি তোর স্বামী ভুলে যাস না। আমাকে বকবি কেন আদর করবি।
আমি সেহানের কথা শুনে একটু জোরেই হেসে দিলাম। ও আমার হাসি দেখে গাল টেনে বলল
– এবার খা। এখনও তো খাসনি। পেটে একজন না খেয়ে আছে সেটার খবর কী আছে।
আমি সেহানের চোখের দিকে তাকালাম। এত ভালোবাসা আর মায়া এ চোখে। সত্যি বলতে সুপার হিরো আছে। তবে তাদের সংখ্যা কম। আর এ অল্প সংখ্যার মধ্যে সেহান একজন যে কী না নিরদ্বিধায় সবটা মনে নিয়েছে। তার ভালোবাসার কাছে সব হেরে গেছে। আমি সেহানকে নম্র সুরে বললাম
– তুই খাওয়ায়ে দে। নাহয় খাব না।
সোহান প্লেটে ভাত মাখতে মাখতে বলল
– হা কর খাইয়ে দিই। আরেকটা সুখবর দিই।
আমি মুখে ভাত নিয়ে চিবুতে চিবুতে বললাম
– কী?
– কালকে নাফিসার সাথে জেলে দেখা করার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের বিয়ের খবরটা ওকে দিব।
– এতকিছুর দরকার কী ছিল?
– তোর কষ্টটা দেখেছে তোর সুখটা যেন দেখে তাই। আমি তোকে আর কষ্ট পেতে দিব না।
আমি খাবার চিবুতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম এ মানুষটা বুঝে আমি কিসে ভালো থাকব। বলার আগেই যেন সব বুঝে ফেলে। আমি সোহানের কাঁধে মাথাটা রেখে বললাম
– আর খাব না।
সোহান হালকা ধমক দিয়ে বলল
– এখনি সব শেষ করবি।
আমি কাঁধ থেকে মাথা তুলে বললাম
– তুই খেয়েছিস।
– তোকে খাইয়ে খাব।
– টুকটুকি কোথায়?
– মায়ের সাথে।
– এখানে নিয়ে আয়।
– আজকে আনতে চাচ্ছি না। আমি অনেক রোমান্টিক সেটা তো তোকে বুঝাতে হবে। টুকটুকিকে এনে সে বুঝানোতে ব্যাগরা দিতে চাই না।
সোহানের কথাটা শুনেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। সোহান ভাতের ধলা মুখে দিতে লাগল আমি খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষে অবশিষ্ট যেটুকু প্লেটে ছিল সেটা সোহান খেয়ে নিল।
তারপর সোহান ঠিক আমার পাশে এসেই শুয়ে আমার মাথাটা তার হাতে রাখল। আমার কানের কাছে এসে বলল
– তুই খুশি তো?
আমি হালকা করে তার কানের কাছে গিয়ে বললাম
– অনেক খুশি।
পরদিন সকালে উঠেই সোহানকে নিয়ে নাফিসাকে দেখতে গেলাম। যাওয়ার পথে কেন জানি না আমার মনে হলো আমি অরন্যকে দেখেছি। তবে মনের ভুল বা মানসিক রোগ থেকেও সেটা হতে পারে। কারণ সারাদিন একই চিন্তা মানসিক ভাবে আহত করে তুলে। আর সে মরে গেছে তাকে দেখার তো প্রশ্নই আসে না।
নাফিসার কাছে যেতেই সে আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো। আমি কিছু বলে উঠার আগেই সে গড় গড় করে কয়েকটা কথা বলল যা শুনে আমি নতুন রহস্যের গন্ধ পেলাম। সে সাথে মনে প্রশ্ন জাগল আদৌ কী অরন্য মরেছে? নাকি পুরোটা একটা ফাঁদ। কারণ নাফিসা বলল
#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৬
কারণ নাফিসা বলল
– অপ্সরা বিশ্বাস করো আমি অরন্যকে খুন করিনি। আমি ওকে কেন খুন করতে যাব। অরন্য আমাকে কাবিনের ৩০ লাখ টাকাও দিয়ে দিছে৷ আর সবচেয়ে বড় কথা ও কোথায় ছিল সেটাই তো আমি জানতাম না। আমাকে কে ফাঁসিয়েছে জানি না। আমার হাতের ছাপেই বা কীভাবে গেল বুঝতে পারছি না৷ আমি এতটা নির্দয় না যে অরন্যকে মেরে ফেলব। অরন্যের সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা নেই। সেদিন সালমানের সাথে আমার রাস্তায় দেখা হয়৷ তার সাথে ঝামেলা হয়, বেশ কথা কাটাকাটি হয়ে আমি বাসায় চলে আসি।
সালমান রাতে কয়েকবার কল দেয়। আমি আর ধরিনি। রাতেই সালমান লন্ডন চলে যায়। আর অরন্যের লাশও পরদিন পাওয়া যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম সালমান খুন করেছে তবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলতেছে অরন্যের খুন হয়েছে সকাল দিকে। তখন সালমানের উপর আমার সন্দেহ চলে যায়। কারণ সালমান রাতের ফ্লাইটেই লন্ডনে চলে গিয়েছিল। তবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। যে জায়গায় আমি অরন্যের খোঁজ খবরেই পাচ্ছিলাম না সেখানে আমি অরন্যকে খুন করব কীভাবে? সালমানকে টেক্সট করেছিলাম৷ সে উত্তরে বলল আমাকে আর কোনো সাহায্য সে করবে না। সে আর কোনোদিন দেশে আসবে না। তারও ধারণা আমিই অরন্যকে খুন করেছি। আমি একা হয়ে পরি। আমি জানি না আমার হাতের ছাপ অরন্যের গলায় কী করে গেল। অপ্সরা আমার যা শাস্তি হওয়ার তো হবে৷ হয়তো এটা প্রমাণ করতেও পারব না আমি অরন্যকে খুন করিনি তবুও তোমাকে বললাম। কারণ শাস্তি হওয়ার আগে একটা মানুষ অন্তত জানুক আমি তাকে খুন করেনি।
আমি নাফিসার কথা শুনে একটু তীক্ষ্ণ গলায় বললাম
– সত্যিই কী খুন করো নি? নাকি কোনো নাটক করছো?
– অপ্সরা আমার শাস্তি যা হওয়ার সেটা নির্ধারিত হয়েই আছে। এখন নাটক করে লাভ নেই। তোমার বন্ধু আমি না যে এসব বললে তুমি আমাকে সত্য উদঘাটনে সাহায্য করবে তবুও বলছি কারণ মনের শান্তির জন্য। আমি নিজেও জানতাম না অরন্য কোথায় ছিল। আমি আবারও বলছি অরন্যকে আমি খুন করেনি। আমাকে কেউ এ নোংরা খেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। কেন জানি না মাঝে মাঝে তোমাকেও সন্দেহ হয়।
নাফিসার এ দোটানা বলে দিচ্ছে সে অরন্যকে খুন করেনি৷ নাহয় সন্দেহের তীর আমার দিকে ছুড়ত না। একটা মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন সে এমন অনেক কিছুই ভাবে। তবে এটা নাফিসার নাটকও হতে পারে। আবার মনে হচ্ছে আমি অরন্যের মতো কাউকে দেখলাম তাহলে সেটা কে ছিল? সেটা কী আদৌ আমার কল্পনা ছিল নাকি কোনো বাস্তবতা। সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। নাফিসাকে হালকা গলায় বললাম
– তুমি একজন মানুষের গলায় হাত না দিলে তো ছাপ পাওয়ার কথা না। সেটা কী করে সম্ভব?
নাফিসা পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল
– আমিও সেটার মানে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার হাতের ছাপ কী করে গেল। আমি তো এতটা জঘন্য না। একটা ছেলেকে খুন করে তার শরীর এসিড দিয়ে পুড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত করব। সত্যিই আমি জানি না।
বেশ অবাক সুরে বললাম
– অরন্যের লাশ কী এসিড দিয়ে পুরানো অবস্থায় ছিল?
নাফিসা ভাঙ্গা গলায় বলল
– আমি লাশ দেখেনি৷ তবে বলা হয়েছে আমি নাকি অরন্যকে গলা টিপে মেরে লাশ গুম করার জন্য পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছি। জানি না কে করেছে এমন। তবে আমাকে যে মুখ্য গুটি বানিয়ে চাল চেলেছে সেটা বুঝতে পারছি৷ পুলিশ নাকি ব্যাপারটা অদন্ত করছে৷ তবে তাদের উপর আমার কোনো ভরসা নেই। তদন্ত করার পরও হয়তো আমাকেই দোষী বলবে৷ আমাকেই শাস্তি দিবে। আচ্ছা তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসেছো কেন?
নাফিসার কথাগুলো শুনার পর আমার বিয়ের সংবাদটা ওকে দিতে পারলাম না। কেন জানি মনে হচ্ছে নাফিসা যা বলছে সত্যি। হয়তো অরন্য মরেনি৷ হয়তো মরেছে তবে সেটার দোষ নাফিসার না৷ তাই এ মুহুর্তে নাফিসাকে বিয়ের সংবাদ দিতে গেলে অনেকটা কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো হয়ে যাবে। তাই নাফিসাকে ব্যাপারটা চেপে গেলাম। তেমন কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম
– তুমি থাকো। আমি আসছি। পরে কথা হবে। হয়তো দেখা করার সুযোগ আর হবে না। এসেছিলাম এমনিতেই।
কথাটা বলেই চলে আসলাম। হাজারটা প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। নাফিসার সাথে দেখা করতে আমি একা গিয়েছিলাম। সোহান বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে বের হতে দেখেই বলল
– এত দেরি হলো কেন বের হতে? আরেকটু হলে তো চিন্তায় পড়ে যেতাম।
– কিসের চিন্তা শুনি? নাফিসা তো জেলের মধ্যে থেকে আমাকে কিছু করবে না৷ চল বাসায় যাওয়া যাক।
– তুই কী ডিস্টার্ব কোনো বিষয় নিয়ে?
আমি সেহানের দিকে তাকিয়ে তার হাতটা ধরে বললাম
– নাহ! তেমন কিছু না। চল গাড়িতে উঠা যাক। অনেক দিন আইসক্রিম খাওয়া হয় না৷ চল আমাদের কলেজের সামনের দোকানটা থেকে আইসক্রিম খেয়ে আসি।
সোহান আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে হেসে দিয়ে বলল
– তোর কী মনে হয় এত বছর পরও সে দোকান আছে? কবেই সে দোকান ভেঙ্গে গেছে। চল একটা রেস্টুরেন্টে বসি৷ সেখানে গিয়ে আইসক্রিম খাব নে।
– চল তাহলে।
বলেই গাড়িতে উঠলাম। আমি সামনের সিটে হেলান দিয়ে বসলাম। সোহান গাড়ি চালাচ্ছে। আমি হুট করে সোহানকে বললাম
– আমার কেন জানি মনে হচ্ছে নাফিসা অরন্যকে খুন করেনি৷ তার কথা শুনে এমনেই মনে হচ্ছে। আর আসার সময়ও কেন জানি না মনে হলো অরন্যকে রাস্তায় দেখেছি। আমি যে শার্ট টা অরন্যকে গিফট দিয়েছিলাম সে শার্ট টা পরেই রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল।
আমার কথা শুনে সোহান হুট করে গাড়িটা ব্রেক কষল। গাড়িটা থামাতেই আমি ওর দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল
– এসব কী আবোল তাবোল বলতেছিস? সকালে অরন্যকে তুই কীভাবে দেখবি৷ একটা মৃত ব্যক্তি কী ফিরে আসা সম্ভব? আর নাফিসা তো মিথ্যাও বলতে পারে। আমরা কী সবাইকে চিনি? মানুষকে চেনা কী এত সহজ? এত কাহিনির পর ও এখনও মানুষ চিনলি না। আর তোকে একটা মানসিক ডাক্তার দেখাতে হবে। অরন্যের ভূত তোর মাথায় চেপেছে এটা নামাতে হবে৷ আর অপ্সরা আমি তোর স্বামী। আমার সামনে প্রাক্তনকে নিয়ে বললে আমার হিংসা হয়। একটু তো বুঝবি।
– সোহান মশকরা করিস না। আমি কেন জানি না বিষয়টাতে নাফিসা কে দোষ দিতে পারছি না। কোনো রহস্য তো লুকিয়ে আছেই। অরন্যকে ঘিরে এমন কিছু আছে যেটা আমি বা তুই জানি না।
– আমার বাল আছে। তোর এসব প্যাচাল থামাবি? আজকেই তোকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ঠিক মতো কাউন্সিলিং করলে ঠিক হয়ে যাবে সব।
বেশ রাগী গলায় উত্তর দিলাম
– তোর কী আমাকে পাগল মনে হয়?
সোহান আমার গালটা টেনে তার কাছে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল
– তোকে আমার পাগলি মনে হয়। মানসিক ডাক্তার শুধু পাগলদের দেখায় না। এই যে তুই মৃত একটা মানুষকে দেখছিস। যেখানে সমস্ত রিপোর্ট বলে দিচ্ছে এটা অরন্যের লাশ। তার পরিবারও শনাক্ত করেছে সেখানে তুই বলছিস ও বেঁচে আছে৷ অপ্সরা নিজেকে সামলে নে। অতীতে এখনও ডুবে আছিস। এ অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। পেটে একজন আছে তার কথা ভাব।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
– তার কথায় ভাবতে গিয়েই তো এত ভাবছি। এ অতীত যে পিছু ছাড়ে না।
– তুই ছাড়লেই ছাড়বে। তুই যে ধরে আছিস তাই।
– বাদ দে। আইসক্রিম খেলে মাথা ঠিক হবে। মাথায় হয়তো জং ধরে গেছে। গাড়ি স্টার্ট দে।
সোহান চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে রেস্টুরেন্টে চলে আসি। রেস্টুরেন্টে গিয়ে আইসক্রিম অর্ডার করে দুজনেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। সোহান হাসতে হাসতে বলে উঠল
– আগে তো আমার আইসক্রিমে থুথু মিশিয়ে দিতি যাতে করে দুটোই তুই খেতে পারিস। এখন থুথু মিশালেও সমস্যা নেই আমি খেতে পারব।
বলেই হুহু করে হেসে দিল। আমি হালকা করে হাসলাম। আগে কত দুষ্টই না ছিলাম আমি। হাসতে হাসতে পাশ ফিরে তাকাতেই মনে হলো অরন্যকে দেখেছি। সে উঠেই বাইরের দিকে চলে গেল। আমিও বসা থেকে হুট করে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে আসলাম।
( কপি করা নিষেধ,)
( কপি করা নিষেধ। গল্পটা তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে চাচ্ছি না। গল্পটা আরও পর্ব হবে। যেহুত রমজান মাস গল্পটা দুই দিন পর পর দেওয়া হবে। রাত ১০ টা ৩০ এ কারণ তারাবীহ আছে।)