#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩
চোখের জলটা মুছে দৌঁড়ে গেলাম গলির মাথায়। গলির মাথায় গিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। এপাশ ওপাশ তাকিয়েও আবিরকে পেলাম না। আবিরকে সাথে সাথে কল দিলাম। আবির কলটা ধরেই বলল
– তুমি কোথায়?
– আমি গলির মাথায়। তুমি কোথায় আর ঠিক আছো তো?
– আমি একটু সামনের দিকে। তুমি সামনের দিকে আগাও। আর কিছু ঠিক নেই। সব শেষ হয়ে গেল মনে হচ্ছে। অরন্যও যে কী করে বসে।
আবিরের কথাটা শুনে বুকটা মুচরাতে লাগল। চোখে মুখে শোকের গ্লানি ভেসে উঠল। পাগলের মতো গলির থেকে সামনের দিকে এগুলাম। গলির শেষ মাথায় তিন রাস্তার মোড়ে একটা বড় রেস্টুরেন্ট। সেটার সামনে যেতেই আচমকা পার্টি স্প্রে এর আক্রমণে মনে হচ্ছে সাদা মেঘে ভেসে যাচ্ছি। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে এসব। বাসায় গেলাম মাত্র আধা ঘন্টা হলো এর মধ্যেই এত জরুরী তলব এখন আসার পর এসব আচমকা পার্টি স্প্রে ছাড়ার কারণটা বুঝতে পারছি না। আমি বেশ রেগে গিয়েই চোখে মুখে থাকা পার্টি স্প্রেটা হাত দিয়ে সরিয়ে বললাম
– কী শুরু করেছো এসব? হুট করে এমন করে ডেকেছোই বা কেন? আবির বিষয়টা বেশ বিরক্তিকর লাগছে।
বলেই যখন আবিরের দিকে তাকালাম তখন খেয়াল করলাম অরন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমার জোরালো কন্ঠ শুনে অরন্যের পেছন থেকে আবির সামনে এসে বলল
– অপ্সরা রেগে গেলে নাকি?
– রাগব না তো কী করব বলো? এমনভাবে ডেকেছো আমি ভেবেছি কী না কী হয়েছে।৷ এসে দেখি এমন।আমি এর কোনো মানেই বুঝতেছি না।কতটা চিন্তিত ছিলাম আমি সেটা কী উপলব্ধি করতে পেরেছো?
আবিরের মুখটা চুপসে গেল। হালকা গলায় জবাব দিল
– অপ্সরা রাগ করো না। অরন্যের আজকে এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই ওর কাছে বারবার মনে হচ্ছিল আজকের দিনটা ওর এক্সিডেন্টের জন্য মাটি হয়ে যাচ্ছে। ও আগে থেকেই আমাদের জন্য প্ল্যান করে রেখেছিল।তবে এক্সিডেন্ট হওয়ার জন্য সে প্ল্যান সঠিক সময়ে কাজে লাগাতে পারে নি। তুমি হাসপাতাল থেকে আসার পর ওর খুব ইচ্ছা হলো আমাদের জন্য কিছু করার। তাই তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এভাবে আসতে বলল।
আবিরের মুখে কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার রাগটা সাথে সাথে দমে গেল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। মাথায় কিছুই কাজ করছে না। অরন্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে রহস্যময় হাসি দিচ্ছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই অরন্য বলে উঠল
– ভাবি আমি দুঃখিত যদি বিরক্ত করে থাকি। রাগানোর জন্য মোটেও এমন করি নি। আমি শুধু আপনাদের একটা সারপ্রাইজ দিতে এমন করেছি। আমি সত্যিই আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। বিষয়টা যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায় তাহলে আমাকে মাফ করে দিয়েন।
আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অরন্যকে না বুঝেই উত্তর দিলাম
– আমি একটু চিন্তিত ছিলাম। ভাবলাম আবিরের কিছু হয়ে গেল কী না। সে সাথে আপনিও অসুস্থ ছিলেন। তাই সবমিলিয়ে এমনটা আশা করতে পারে নি। তাই একটু উচ্চ সুরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। মনে করার কিছু নেই।
অরন্য আমার কথা শুনে মুখে হাসির রেখা টানল। মুখটাকে প্রশস্ত করে হাসি দিয়ে বলল
– তাহলে চলুন ভেতরে গিয়ে বসা যাক। আপনার জন্য বিশেষ একটা সারপ্রাইজ আছে।
আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম
– আবার কিসের সারপ্রাইজ। আর আপনার শরীর ঠিক আছে তো?
– আমার শরীর একদম ঠিক। ডাক্তারদের এত সহজে ভেঙ্গে পড়লে হয় না। ( বলায় তো হয়নি অরন্য পেশায় একজন ডাক্তার)।
পাশ থেকে আবির আমার হাতটা টেনে ধরে বলল
– হয়েছে সব বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। চলো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। অরন্য আমাদেরকে কী সারপ্রাইজ দেয় দেখি।
বলেই হাতটা টেনে রেস্টুরেন্টের দিকে যেতে লাগল।আমিও রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেলাম। রেস্টুরেন্টের এক কোণে আমি আর আবির বসলাম।অরন্য সে মুহূর্তে একটা কেক এনে বলল
– তোদের এনিভার্সারি সরি এনগেজমেন্ট উপলক্ষে একটা কেক আনলাম। অপ্সরাকে কেটে সিলেব্রেশন করতে বলবি। কেমন?
আবির উৎকন্ঠা নিয়ে কেকের বক্সটা অরন্যের হাত থেকে নিয়ে বক্সটা খুলল। বক্সটা খোলার সাথে সাথে আবিরের মুখটা মলিন হয়ে গেল। আবিবের মুখটা মলিন হতে দেখে আমি কিছুটা উৎসুক হয়ে কেকের দিকে তাকালম। কেকের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম।কারণ কেকে লেখা ” শুভ ৪র্থ তম বিবাহ বার্ষিকী”।
লেখাটা দেখেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। অরন্য কিসের সিলেব্রেশন করতে চাচ্ছে সে কী চার বছর আগে ঘটা বিয়ের সিলেব্রেশন করতে চাচ্ছে নাকি আমাদের এনগেজড এর। এসব ভাবতে ভাবতেই আবির অরন্যকে বলে উঠল
– কী রে অরন্য এ কেকের উপর এমন লেখা কেন?
অরন্য আবিবের কথায় সাড়া দিয়ে বলল
– কেন কী লেখা?
আবির অরন্যের দিকে কেকটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
– দেখ কী লেখা।
অরন্য কেকটা দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বলল
– হয়তো যারা লিখেছে তারা ভুল করেছে। এজন্যই সাথে দাঁড়িয়ে থেকে একটা জিনিস আনা উচিত।অনলাইনে অর্ডার দিলে এমনেই হয়। কী লিখতে বলে দিয়েছি আর কী লিখে দিয়েছে। এখন তো চাইলেও ঠিক করতে পারব না। এক্সিডেন্ট টা না হলে এমন হতো না।সব কাজে ঝামেলা হচ্ছে শুধু।
বলেই অরন্য উত্তেজিত হয়ে গেল।অরন্যের উত্তেজনা দেখে আবির অরন্যকে সাত্ত্বণা দিয়ে বলল
– এত রাগ করার মতো কিছু হয়নি।ভুল তো মানুষেই করে। হয়তো অন্য কাস্টমারেরটা ভুল করে এখানে লিখে ফেলেছে। সমস্যা নেই কেক তো কেটে খাবই।ভুল লেখা থাকলেই কী আর ঠিক লেখা থাকলেই কী। আমরা তো ভুল ঠিক জানি। কোনটা ভুল কোনটা ঠিক। আমরা বুঝে নিলেই হবে। তুই যে কষ্ট করে আমাদের জন্য এতকিছু করেছিস এটাই তো অনেক। ব্যপার না। এত প্যারা নিস না। আমি আর অপ্সরা কিছুই মনে করিনি।আমরা বিষয়টা ম্যানেজ করে নিচ্ছি।কী বলো অপ্সরা।
কথাটা শেষ করেই আবির আমার দিকে তাকাল।আবিরের চাহনী দেখে আমি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
– যা হয়েছে তো হয়েছেই। সমস্যা নেই এভাবে কেটে নিলেই হবে।
কথাটা বলা শেষ করতেই আবির আমার দিকে ছুরিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
– নাও। এবার কাটি চলো।
আমি ছুরিটা নিয়ে যখনই কেকটা কাটতে যাব ঠিক তখনেই আরন্য আটকে দিয়ে বলল
– একটু থাম আবির, ভাবির জন্য একটা উপহার আছে।
বলেই একটা বড় বক্স আমার দিকে এগিয়ে দিল। আবির বেশ উৎসাহ নিয়ে বক্সটা খুলতে গেলে অরন্য আটকে দিয়ে বলল
– আরে আবির গিফট টা আমি অপ্সরাকে দিয়েছি তোকে না। তুই পরে জেনে নিস কী দিয়েছি। আমার সামনেই বক্স খুলা শুরু করেছিস কেন? সত্যিই তুই কিছু বুঝিস না। বোকা বোকা কাজ করিস। বিয়ের এক্সসাইটমেন্টে ইদানীং একটু বেশিই বোকা হয়ে যাচ্ছিস।
অরন্যের কথা শুনে আবির মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমার দিকে তাকাল। গালটা হালকা ফুলা করে পরক্ষণেই গালের ভেতরের সবটা বাতাস বের করে বলল
– বাসায় গিয়ে বলো কিন্তু কী দিয়েছে। আর চলো কেকটা কেটে ফেলি।
আমি আর আবির কেকটাতে ছুরি লাগালাম। মনে হচ্ছিল ছুরিটা আমার বুকে আঘাত করছিলাম। কী থেকে কী হচ্ছে সব যেন এলোমেলো লাগছে। কেকটা কেটে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম। রাত তখন নয়টা বাজে। মায়ের কল পাওয়ার পর মনে হলো বেশ রাত হয়ে গেছে। আমি কলটা ধরতেই মা বলল
– কী রে কোথায় তুই? রাত নয়টা বাজে এখনও বাসায় আসছিস না।
– মা আবিরের সাথে। এইতো চলে আসবো এখনি।
– আবিরকে দে তো।
মায়ের কথা মতো আমি আবিরের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলাম। আবির মায়ের সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে বলল
– তোমার মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। চলো দিয়ে আসি তোমায়।
আমিও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। এর মধ্যে অরন্য বলে উঠল
– আবির তুই অপ্সরাকে দিয়ে আয়। আমি অন্য গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি।
– আরে বোকা তোকে একা ছাড়ব নাকি। এমনিই চুট পেয়েছিস। আমাদের সাথেই চল। অপ্সরাকে নামিয়ে আমি আর তুই চলে আসব।
অরন্য আর না করলো না। এর মধ্যে আবির বলল
– আমি ওয়াশ রুম থেকে আসতেছি একটু। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো অপ্সরা। দুই মিনিট লাগবে শুধু।
আমি মাথা নাড়লাম। আবির ওয়াশ রুমে গেল। অরন্য হালকা হেসে এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-চার বছর আগে যে ইচ্ছা পোষণ করেছিলে চার বছর পর সেটা পূরণ করে দিলাম। আমাদের চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী পালন করে ফেললাম। কেমন লেগেছে বলো?
আমার বুক তখন কাঁপতে লাগল। কেন জানি না সবকিছু একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আর এত দ্রূতই সবকিছু হচ্ছে যে কী করা ঠিক বা ঠিক না সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। এখনও আমার আর অরন্যের ডিভোর্স হয়নি। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ বা আইনের দৃষ্টিতে ও আমি আর অরন্য স্বামী স্ত্রী। যদিও সে সম্পর্কটাকে আমি মন থেকে ঘৃনা করি। সে সাথে অরন্যকে। তবুও কেন জানি না তার প্রতি আমার ক্ষীণ অনুভূতি চলে আসে। যদি তার প্রতি আমার অনুভূতির ঘর ভর্তি শূন্যতা থাকত তাহলে এতটা দূর্বলতা তার প্রতি এত বছর পরও কাজ করত না। কিন্তু যত দূর্বলেই আমি তার প্রতি হই না কেন মন থেকে আমি তাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করি। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী তাকে মনে করি। যে কী না আমাকে এতকিছুর পরও টাকার জন্য ছেড়েছিল। কিন্তু আজ চার বছর পর কেনই বা সে এমন করছে। হুট করে তার এ পরিবর্তন আমাকে একটু হলেও ভাবাচ্ছে। আমি চুপচাপ এসব ভেবে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যেই আবির এসে বলল
– চলো তাড়াতাড়ি।
তিনজনেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমি আর আবির সামনে বসলাম আর অরন্য পেছনে। আমি এবার কিছুটা ইচ্ছা করেই আবিরের কাঁধে মাথাটা হেলিয়ে দিলাম। আবির আমার মাথার সামনে থাকা কয়েকটা চুল আঙ্গুলে প্যাঁচ দিয়ে একটু টেনে পরক্ষণেই তা ছেড়ে দিয়ে বলল
– কী হয়েছে?
– মাথা ব্যথা করছে। একটু এভাবে থাকি।
আমি মোটেও আবিরের সাথে এত খোলামেলা ছিলাম না। আবিরের সাথে আমার পরিচয় পাঁচ মাসের। পাঁচ মাসে আবিরের সাথে বেশ ফ্রি হয়ে গেলেও এভাবে কখনও মাথা রাখে নি৷ আজকে হুট করে এভাবে মাথা রাখতেই আবিরও হালকা অবাক হলেও চুপ ছিল। আবির গাড়িটা স্টার্ট দিল। গাড়ির সামনের আয়নায় পেছনে থাকা অরন্যের মলিন মুখটা ভেসে আসছে। বেশ শান্তি লাগছে এখন।
বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে পা টা বাড়াতেই অরন্য পিছু ডেকে বলল
– ভাবি গিফট টা রেখে যাচ্ছেন।
বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকিয়ে গিফটটা হাতে নিলাম। তাড়াতাড়ি করে বাসায় এসে রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকেই শাড়িটা প্রথমে পাল্টে নিলাম। তারপর অনেকটা ফ্রেশ হয়ে বিছানার কাছে এসে বক্সটা খুললাম। বক্সটা খোলার পর আমার অস্থিরতা আরও বাড়তে লাগল। এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল সব। পুরনো অতীত,পুরনো স্মৃতি সব সামনে এসে জমা হলো। আগে সবাই বলত সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে যাবে। তবে এখন মনে হচ্ছে কোনো কোনো সময় অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে গিয়েও সময়ের পরিক্রমায় তা পুনরায় ব্যগরা দিয়ে বসে।#প্রাক্তন
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৪
তবে এখন মনে হচ্ছে কোনো কোনো সময় অতীত ধুয়ে মুছে বিনষ্ট হয়ে গিয়েও সময়ের পরিক্রমায় তা পুনরায় ব্যগরা দিয়ে বসে।
কারণ বক্সটা খুলে দেখলাম চারটা সাদা গোলাপ, চারটা চন্দ্রমল্লিকা,চারটা সূর্যমূখী ফুল দিছে। সে সাথে চারটা কিটকাট চকলেট। চারটা ছোটো টেডি। আমার প্রিয় কিছু জিনিস যেগুলো আমি অরন্যকে দিছিলাম। এতবছর পরও অরন্য জিনিসগুলো আগলে রেখেছে ভেবে কিছুটা বিস্মিত হলাম। বুঝায় যাচ্ছিল সে আমাদের বিয়ের চার বছর সিলেব্রেশন করেছে। কিন্তু এটা কেন সে করছে। সে বিয়ে করেছে চার বছর আগেই। আমার সাথে ওর লুকিয়ে বিয়ে হওয়ার বিষয়টা কেউ জানত না। ছয়মাস পড়েই অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের ব্যপারটা পরিবারকে না জানিয়েই আমরা পরিবার মানিয়ে নিয়েছিলাম। হুট করে তার কী অনুভূতি হলো জানি না সে বিয়ে টা ভেঙ্গে দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে। তখন আমার কাছে বিয়ের কোনো কাগজ ছিল না। কোনো প্রমাণ ও ছিল না। রাস্তাঘাট খুব একটা চিনতাম না তখন। কোন কাজী অফিসে গিয়ে যে বিয়ে করেছিলাম সেটাও বেমালুম ভুলে গেছিলাম। যেখানে বিয়ে করেছি সেটারেই প্রমাণ ছিল না সেখানে এ বিয়ে নিয়ে লড়াটা যুক্তিহীন মনে হয়েছিল। কারণ আমি লড়তে গেলেই তখন আইন আমার কাছে প্রামাণ চাইত। কিন্তু সে প্রমাণ আমার কাছে ছিল না। সব প্রমাণ ছিল অরন্যের কাছে৷
পরবর্তীতে অরন্যের অন্যত্র বিয়ের পর এ বিষয়টা আমি ভুলার চেষ্টা করেছি বহুবার। একটা সময় পর নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলাম। অরন্যের সাথে যোগাযোগ টাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল পুরোপুরি। তাই যেখানে বিয়ের অস্তিত্ব ছিল না সেখানে নতুন করে আমার ডিভোর্স দেওয়ার ও কোনো উপায় ছিল না। বলা যায় অনেকটা মাঝ নদীতে পড়ে ডুবে মরার মতো অবস্থা। এখন এত বছর পর অরন্যের হাবভাব দেখে কেন জানি না আমার কাছে ব্যপারটা বেশ স্বাভাবিক লাগছে না। বারবার বিষয়টা গোলমেল লাগছে। আবিরের সাথে অরন্যের যোগসূত্র কী। অরন্যই বা চারবছর পর অতীতটা সামনে আনতে কেন চাচ্ছে। যে অতীতটা সে নিজে বিলীন করে দিয়েছিল।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। বুঝতে গেলেও সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। অরন্যের প্রতি ঘৃনাটা আরও বাড়তে লাগল। এ মানুষটা সারাটা জীবন আমাকে কষ্টের অনলে পুড়িয়েছি। আর আজকেও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। আবিরকে আমার অতীত সম্পর্কে কিছুই বলে নি। কারণ আমি আমার অতীতটা নিচ্ছিন্ন করে সামনে এগুতে চেয়েছিলাম। আর সেটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবিরকে সবটা বলা দরকার। কিন্তু কীভাবে বলব। হাত পা কাঁপছে। জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার পরও যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় আবিরের কল আসলো। রাত তখন বারোটা। ভাবতে ভাবতে কখন যে এত রাত হয়ে গেছে খেয়ালেই করিনি। কলটা ধরে হ্যালো বলার আগেই অবির উচ্ছাস নিয়ে বলল
– অরন্য তোমায় কী দিয়েছে বললে না তো?
আবিরের কথা শুনে আমার বিরক্তি বেড়ে গেল। বিরক্তির সুরে বলে উঠলাম
– অরন্যকে ছাড়া কী আর কোনো কথা তোমার মুখে নেই? এ পাঁচ মাসে এ লোকটার কথা একবারও শুনলাম না। আর আজকে হুট করে তোমাদের সাথে উনি আসলো আর আসার পর থেকে শুধু উনাকে নিয়ে প্রসঙ্গ উঠছে। আমাদের আজকে এনগেজমেন্ট হয়েছে আবির। আমাদের নিজেদের কত কথায় থাকতে পারে। তুমি তা ‘ না করে শুধু অরন্য ভাইয়ার কথায় বলে যাচ্ছ। একই প্রসঙ্গে কথা আর ভালো লাগছে না আবির।
আবির আমার রাগের কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে অনেককটা চুপ থেকে বলল
– অপ্সরা তুমি হঠাৎ করে এভাবে রেগে গেলে কেন? অরন্যের সাথে তোমার আগে পরিচয় ছিল না তাই ওর কথা তোমাকে বলিনি। আর আজকে তোমাকে কী দিয়েছে জানার জন্য প্রশ্ন করলাম। এতে রাগ করার মতো কী বলেছি বুঝতে পারিনি। যদিও একটু ঝামেলা আজকে হয়েছে অরন্যের এক্সিডেন্ট এই সেই মিলিয়ে তবুও তো দিনটা ভালোই কেটেছে। আর আমি তো তোমাকে যতদূর চিনি অল্পতে বিরক্ত হয়ে যাওয়ার মেয়ে না। যথেষ্ট শক্ত এবং গুছালো মেয়ে। আজকে তোমার মধ্যে আমি কেন জানি না খুব অস্থিরতা আর বিরক্তি লক্ষ্য করছি। আমাকে খুলে বলো। তুমি যদি মনে চেপে রাখো আমি তো বুঝতে পারব না।
আমি কী আবিরকে সবটা বলে দেবো এখনি নাকি সময় নিব। স্থির হয়ে ভাবতে লাগলাম। ভাবনাটা ব্যাগরা দিয়ে আবির বলল
– কী হলো অপ্সরা কখন থেকে হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছি। চুপ হয়ে কী ভাবছো? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছো?
আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী জবাব দেবো। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বললাম
– আমার একটু ঘুমেই পাচ্ছে।
– আচ্ছা তাহলে ঘুমাও।
বলে ফোনটা রাখতে নিলে আমি আবিরকে ডেকে বললাম
– আমার কথায় কী রাগ করেছো?
– রাগ করিনি। তবে তোমাকে বুঝার চেষ্টা করেও আজকে বুঝতে পারছি না তাই নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে।
– থাক এত বুঝতে হবে না। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছিল তাই এমন করে ফেলেছিলাম। এখন একটু ভালো লাগছে। আচ্ছা আবির…
বলেই থেমে গেলাম। আবির আমাকে থেমে যেতে দেখে বলে উঠল
– কী বলবে বলো।
– কখনও যদি শুনো আমি তোমার কাছে কিছু লুকিয়েছি তুমি তা জানার পর কী করবে?
– লুকানো বিষয়টাতে যদি তুমি দোষী না হও। আর সেটা যদি তুমি তোমার সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য লুকিয়ে থাকো এবং আমার দিক ভেবে লুকিয়ে থাকো আমি ক্ষমা করে দেবো। কারণ মানুষের জীবনে এমন কিছু থাকেই যেটা একমাত্র সৃষ্টি কর্তা ব্যতীত আর কাউকে বলা যায় না। বলতে গেলেও বারবার আটকে যায়। কিন্তু হঠাৎ এমন বলছো কেন?
আবিরের কথাগুলো শুনে মনে বেশ শান্তি পাচ্ছিলাম। আবিরকে হালকা গলায় বললাম
– না এমনি। তবে কিছু যদি তোমার কাছে কখনও আড়াল করেও থাকি সময় সুযোগ বুঝে সঠিক সময়ে বলব। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো এমন কিছুই করব না যাতে করে তুমি কষ্ট পাও। একদম ঠকাব না তোমায়। কারণ ঠকানোর কষ্ট কতটা প্রখর সেটা খুব কাছ থেকে উপভোগ করেছি। তোমাকে একদিন বলেছিলাম না আজকের এ অপ্সরা এমনি এমনি নিজেকে গড়ে তুলে নি। বরং বাস্তবতার চরম আঘাতে নিজেকে শক্ত করে এ পর্যায়ে এসেছে।
– সে জন্যই তোমাকে আমার বেশি ভালো লেগেছিল। যদিও কারণটা বলো নি তবে যে মেয়ে একটা ধাক্কা থেকে নিজেকে শেষ করে না দিয়ে গড়ে নিতে পারে সে আর যাই করুক অন্যায় করবে না। আমি তোমাকে অনেক ভরসা করি বলেই তোমার প্রতিটা কথাকে সম্মান করি। অপ্সরা পাঁচ বছর যাবত হয়তো তোমাকে চিনি না, চিনি পাঁচমাস যাবত। তবে তোমাকে এতটা ভালোবেসেছি বুঝাতে পারব না। ভালোবাসতে যুগ যুগান্তরের সময় লাগে না কখনও কখনও ক্ষণিকের একটু দেখায় ভালোবাসা যায়। হাসপাতালে যেদিন তোমায় দেখেছিলাম সেদিন থেকেই তোমার প্রতি একটা দূর্বলতা কাজ করা শুরু করেছে। আর সে থেকেই এত কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা তোমায়। মানুষ বলে দূর্বলতা প্রকাশ করা উচিত না এতে অবহেলা বাড়ে। কিন্তু তোমার কাছে দূর্বলতা প্রকাশ করে দিলাম অবহেলা করো না।
– আবির… যে তোমাকে চায় সে তুমি দূর্বলতা প্রাকশ করার পর আরও আগলে রাখবে আর যে চায় না সে তুমি দূর্বলতা প্রকাশ না করলেও চলে যাবে। আমি তোমায় কথা দিলাম তোমাকে কষ্ট দিব না। তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করব৷ তোমার দূর্বল জায়গা নিয়ে খেলব না বরং ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবো। ঘুমাবে কখন?
– ঘুম তো উড়ে গেছে তোমার মিষ্টি কথায়। এত গুছিয়ে কথা বলো।
আমি মুচকি হাসলাম
– তুমিও তো কম কথা জানো না। এতক্ষণ তো ঘুমে গড়িয়ে পড়ছিলি এখন তো দেখি তোমার চোখের ঘুমও উড়ে গেছে।
– তা তো একটু গেছেই। আবির আকাশটার দিকে একটু তাকাও।
– বিছানায় আছি শুয়ে। জানালার পাশে যেতে হবে। ঠান্ডা, ঠান্ডা লাগছে একটু। বাইরে থেকে হালকা ঠান্ডা বাতাস ও আসছে। আর বিশেষ কথা অরন্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে কী যেন বিড়বিড় করছে। এখন ঐখানে যাওয়াটা কী ঠিক হবে।
আবিরের মুখে পুনরায় অরন্যের কথা শুনে একটু বিরক্তি আসলেও সামলে নিলাম। অরন্যের সাথে এখন আমার অদ্ভুত মিল আছে সে আকাশ দেখছে আর আমিও। আমি আবিরকে হালকা গলায় বললাম
– ভাইয়া কী তোমাদের সাথেই থাকে। আর ভাইয়াকে চেনো কতদিন যাবত?
– অনেকদিন। আর আমাদের সাথে থাকে না। আমাদের কমপ্লেক্সের পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। আগে পোস্টিং ছিল গ্রামে। দুই বছর চাকুরির পর ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে। এরপর থেকেই আমাদের পাশের কমপ্লেক্সেই থাকে।
– আজকে বাসায় যায়নি? উনার পরিবার কী চিন্তা করবে না?
– এখানে ও একাই থাকে। ওর বাবা,মা বাড়িতে থাকে। আর ভাই বোন গুলো যে জায়গায় পড়ে সে জায়গায় হোস্টেলে থাকে।
– উনার স্ত্রী?
আবির আমার কথায় আচমকা হেসে জবাব দিল
– ও তো এখনও বিয়ে করে নি। স্ত্রী আসবে কোথায় থেকে?
আবিরের মুখে কথাটা শুনে আমি চমকালাম। অরন্য বিয়ে করেনি এটা কী করে সম্ভব।৷ অরন্যের বিয়ের ছবি আমি নিজে দেখেছি। বিয়ের পর প্রতিদিন সে তার বউকে নিয়ে ঘুরতে যেত আর সেটার ছবি নিজের ওয়ালে দিত। আর সবাই সে ছবি আমাকে স্ক্রিনশট দিয়ে পাঠাত। এ ছবির অত্যচারে আমি আমার আইডি ডিএকটিভ রাখি বহুদিন। কারণ নিজেকে সামলে নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিই। সে সময় টা কাটিয়ে উঠা এত সহজ ছিল না। বলতে যতটা সহজ লাগে সংগ্রাম করাটা ঠিক তার বিপরীতে ছিল। অতীত ভুলাটা সহজ না।
“যে অতীতে একবার দাগ লেগে যায় সে অতীত ভুলা কঠিন।কাগজে যেমন পেন্সিলের দাগ টানার পর তা রাবার দিয়ে ঘষে তুলার পরও অস্পষ্ট দাগ বিদ্যমান থাকে। অতীতও ঠিক তেমন তাকে যতই মন থেকে মুছে ফেলা হোক না কেন অস্পষ্ট হয়ে সেটা মনের এক কোণে গেঁথে থাকে।”
আর আমি সে অতীতটাকে পেছনে ফেলে নিজেকে যোগ্য করে তুলি। কিন্তু আবির এসব কী বলছে। মিনেট পাঁচেক আমি চুপ। আবির কথা বলে যাচ্ছে হ্যালো হ্যালো বলছে আমি কিছুই বলছি না। কী বলব ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছি না। আবির একটু জোরালো গলায় বলল
– অপ্সরা তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো?
আমি এবার উত্তরে বললাম
– হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কী জানি বলতেছিলাম আমি?
– অরন্যের বিয়ে নিয়ে।
– হ্যাঁ। আচ্ছা উনাকে চেনো কতদিন যাবত?
– বারবার এত প্রশ্ন করছো কেন? ওকে আমি ছোট থেকেই চিনি।
বুঝতে পারলাম আবির একটু বিরক্ত হয়েছে।।এভাবে বারবার অরন্যের বিষয়ে জেরা করা উচিত হচ্ছে না। এ রহস্যের উদঘাটন আমাকেই করতে হবে। আমি আবিরকে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম
– ঘুম পাচ্ছে অনেক। ঘুমানো দরকার। মা কী কিছু বলেছে বাসায় গিয়ে?
– মা রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়েছে আমরা বাসায় আসি রাত সাড়ে এগারটায়। মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ এখনও হয়নি। হলে জানাব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আর অপ্সরা….
বলেই আবির থেমে গেল। আমি আবিরকে ডেকে বললাম
– বলো আবির কী বলবে?
– বড্ড ভালোবাসি তোমায়?
– আমিও বড্ড ভালোবাসি।
বলেই কলটা রেখে দিলাম। কাল কলেজে ক্লাস নেই। তাই দেরি করে ঘুমালেও সমস্যা হবে না। তবে অরন্য বিয়ে করেনি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। হুট করেই আমার আইডির ব্লক লিস্টে গিয়ে অরন্যের আইডিটা খু্ঁজতে লাগলাম। এতদিন ব্লক ছিল আর মুভ করার পর থেকে তার আইডি দেখার মতো রুচিও জাগে নি কখনও। তবে আজকে আইডিটা দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি সাথে সাথে ব্লক লিস্ট খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতেই অরন্যের আইডিটা দেখে আমি পুনরায় আশ্চর্য হলাম।
( কপি করা নিষেধ চাইলে বেশি বেশি শেয়ার করে পাশে থাকতে পারেন। সবাইকে কমেন্ট করার অনুরোধ রইল।)
(কপি করা নিষেধ।চাইলে শেয়ার করে পাশে থাকতে পারেন। আর সবাইকে কমেন্ট করার অনুরোধ রইল)