সূর্যাস্ত,পর্ব:২

0
443

#সূর্যাস্ত
পর্ব- ২

শীতের সকালের নরম রোদ গায়ে রেশমী পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। সাথে বাতাসও আছে। জায়গাটার অন্যরকম নোনা পানির সাথে বুনো গন্ধ। ছুটে চলা লঞ্চের সাথে সাথে দূরে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে রোদ্দুরের। কী যেন খুঁজছে মন। অচেনা এক হাহাকার বুকে। সুন্দরবনে ঘুরতে আসার পর থেকে তার মনটা অস্থির লাগছে। ট্রাভেলিং এর ভয়ানক নেশা তার। বাড়ির বাইরে গেলে, খোলা মুক্ত জায়গার স্বাদ পেলে তার অদ্ভূত প্রশান্তি লাগে। যেটা এবার লাগছে না। সুন্দরবনে আগেও দু’বার এসেছে সে। তবে এরকম অচেনা অনুভূতি হয়নি কখনো। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিলো সে। দূরে পানিতে পানকৌড়িরা খেলা করছে। অপূর্ব সব দৃশ্য তার মনকে শান্ত করতে পারছে না।

শীতল পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই চমকে তাকালো রোদ্দুর।
“কিছু বলবি?”
“তোমার কী হয়েছে বলোতো?”
“জানি না।”
“মামীমণির কথা ভেবে মন খারাপ?”
“হয়তো, আবার হয়তো না।”
“ভেবো না। ঠিক হয়ে যাবে সব।”
“জানি। একটু একা থাকতে দে।”
“তোমার কি শরীর খারাপ?”
“নাহ।”

শীতল দাঁড়িয়ে আছে দেখে রোদ্দুর হেসে বলল, “তুই এনজয় কর না। মেয়েটা একা আছে।”
“ওর সাথেই তো আছি।”
“আবার যা। ওইযে ডাকছে মৃত্তিকা।”

রোদ্দুর আকাশের দিকে তাকালো। পরিষ্কার আকাশে দূরে হালকা মেঘের আভাস। হঠাৎ হেসে ফেলল রোদ্দুর। মনে হলো দূরের মেঘগুলো তার জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে আসছে। সেই বার্তাটা তার কাছে পৌঁছুতে ঠিক কত সময় লাগবে?

.
শ্রাবনী হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা গভীর বনে চলে গেল। গাছপালা বড্ড ঘন এদিকটায়। শীতও লাগছে। পানির পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে আছে। শ্রাবনী পানির খোঁজে আবার বিপরীত দিকে চলল। কিন্তু কোনদিক দিয়ে এসেছে সেই রাস্তাটা খুঁজেই পেল না। ঘুরতে ঘুরতে কাহিল হয়ে শেষ পর্যন্ত পানির সন্ধান পেল৷ তীরের পানি ঘোলা। হাঁটু পযন্ত পানিতে নেমে আঁজল ভরে পানি পান করল। হালকা লবণ লবণ তবু তো গলাটা ভিজল!

ঠিক সে সময় সে দেখতে পেল তার থেকে কয়েক গজ দূরে লম্বা একটা সাপ। পানিতে ভেসে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ভয়ে কাটা হয়ে সে তৎক্ষনাৎ তীরের দিকে ছুটলো। সাপটাও আসছে পিছু পিছু। তীরে নেমে দৌড়াতে গিয়ে একটা গাছের শ্বাসমূলের সাথে পা বেঁধে পড়ে গেল সে। কাছাকাছি আরও অনেকগুলো গাছের শ্বাসমূল, শিকড়। ভীষণ ব্যথা পেল শ্রাবনী। শরীরের অনেক জায়গা ছিলো গেছে তার। কিন্তু ব্যথার চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্ক তখন। সাপটা বুঝি গায়ে এসে পড়ল।

হিস হিস শব্দে কোনোরকমে হাঁচড়ে- পাঁচড়ে উঠে দাঁড়ালো শ্রাবনী। ঘুরে তাকাতেই জমে গেল একদম। সাপটা তার খুব কাছে। বিরাট ফনা তুলে আছে। জিভ বের করছে খানিক পর পর। এই সাপটার কথা জানে শ্রাবনী। শঙ্খচূড় সাপ। ইংরেজিতে যাকে বলে কিং কোবরা! সাপটা মাথা নামিয়ে শ্রাবনীর পায়ের কাছে চলে এল। শ্রাবনী চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। নড়ার শক্তি নেই তার।

অনেকটা সময় চলে গেলেও কোনো সাপের কামড়ের আভাস পেল না শ্রাবনী। কিন্তু সাপের নড়াচড়ার শব্দ আসছে কাছ থেকেই। শুকনো পাতার উপর সাপের গড়াগড়ির শব্দ। চোখ খুলে সে দেখতে পেল শঙ্খচূড়টা অন্য একটা সাপের সাথে লড়াই করছে। দেখতে দেখতে সেই সাপটাকে গিয়ে ফেলল শঙ্খচূড়। শ্রাবনী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সাপটা ব্যস্ত থাকার সুযোগে পালালো সে জায়গা থেকে।

ক্ষুধা লেগেছে ভীষন। অথচ কোনো গাছে কোনো ফলমূল কিচ্ছু নেই। খাওয়ার মতো কোনো জিনিস এই জঙ্গলে বোধহয় নেই। একটা গাছের নিচে বসে আছে শ্রাবনী। গাছের ওপর কয়েকটা টিয়ে পাখি অনবরত কিচিরমিচির করে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে পাখিগুলোকে ধরে খেয়ে নিতে!

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। পাখিদের চেঁচামেচির সাথে যোগ হলো বন্য প্রানীর ডাক। সবচেয়ে বেশি কিচকিচ বানরের। শ্রাবনীর শরীর এমনিতেই দুর্বল হয়ে আছে। সে নেতিয়ে পড়ল একদম। তাও শক্তি করে উঠে বসল। কিছু না খেলে চলবে না তার। অনেক খুঁজে গভীর বনে গিয়ে সে মধুর ঘ্রাণ পেয়ে থমকে দাঁড়ালো। উপরে তাকিয়ে দেখতে পেল একটা খোলা চাক। মৌমাছি নেই। মৌমাছির সুশৃঙ্খল জীবনেও কখনো কখনো ছন্দপতন ঘটে। রানী মৌমাছি নিয়ে যুদ্ধ হয়। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে করে চাক ছেড়ে চলে যায় মৌমাছিরা। শ্রাবনী গাছে উঠতে জানে না। চাকটা অনেক উঁচু। গালে হাত দিয়ে সে ভাবতে থাকে কী করা যায়।

আশেপাশে অনেকগুলো গাছে শক্ত লতানো পরগাছা দেখতে পায় সে। কিছু গাছের নিজস্ব লতানো শক্ত অংশ আছে। সেগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিল সে। হাতের অনেক জায়গা ছড়ে গেল এটা করতে গিয়ে। এবার শুকনো শক্ত লাকড়ি জোগাড় করে মইয়ের মতো বানালো। মই তো না, নড়বড়ে একটা জিনিস তৈরি হলো। শ্রাবনীর ওজন বেশি না, তবুও এই জিনিস টিকবে কি না সন্দেহ। সবচেয়ে কাছের যে ডালটা সেটাতে মই ঠেকিয়ে উঠতে শুরু করল শ্রাবনী।

পুরোটা উঠতে পারল না। তার আগেই মই ভেঙে গেল। সে ডালটা ধরে ফেলল। ঝুলে রইল কয়েক মুহূর্ত। এবার পা দিয়ে গাছটা পেঁচিয়ে ধরে ডালে উঠে গেল। আস্তে আস্তে একটা একটা ডাল পার হয়ে মধুর চাকে পোঁছে গেল সে। তৃপ্তি করে মধু খেল। পেট অনেকটাই ভরল তাতে। খাওয়া শেষে নিচে নেমে এল এক ডাল এক ডাল করে। সর্বশেষ ডাল থেকে লাফ দিল নিচে।

.
নৌকার ছাদে শুয়ে শুয়ে তারা দেখছিলো রোদ্দুর। নৌকার মাঝি তার পরিচিত। তাকে একলা থাকতে দিয়ে মাঝি কোথায় যেন গেছে। দূরে ধ্রুবতারাটা জ্বলজ্বল করছে। তার অদ্ভূত জীবনটার কথা ভাবতে বসল রোদ্দুর। স্কুলে সে ছিল ভীষণ দুরন্ত। কলেজে উঠে হয়ে গেল প্লেবয়। কত মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করেছে, কত মেয়ের সাথে একসাথে প্রেম করেছে হিসেব নেই। মেয়েগুলোও বোধহয় তার সাথে শুধু সময় কাটানোর জন্য থাকতো। সে যেমন কাউকে কখনো ভালোবাসেনি, তাকেও কেউ ভালোবাসেনি।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অর্ধেকে এসে সে সবকিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। তার বাবা সবসময় ব্যস্ত, মা ভালো, তবে নিজের দোষে সে মা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। রোদ্দুর একটা সময় বুঝতে পারল পৃথিবীতে মা ছাড়া কেউ তাকে আসলে তেমন করে ভালোবাসে না। তবে মা থেকেও সে দূরে।

এখন তার মনের কথাটা বলার মতো একটা মানুষ নেই। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “সকালবেলা বললে না, সুসংবা দেবে? সুসংবাদটা একটা মেয়ে জানি আমি। কোথায় সে? কতক্ষণ পর দেখা হবে? আর যে তর সইছে না!”

রোদ্দুর হাসলো। যে কেউ তার কথা শুনলে তাকে পাগল ভাববে। তবে কেউ জানে না সে প্রকৃতির কথা শুনতে পারে। আকাশ, মেঘ, গাছপালা, পাহাড়, নদী সবার ভাষা সে বোঝে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় বড় ঘটনাগুলোর পূর্বাভাস সে প্রকৃতি থেকেই সবসময় পায়। এবারও তার মনে হচ্ছে তার জীবনে কেউ আসছে। সে কেউটা আসলে কে? এই বনের দেবী বুঝি?

.
রাত বাড়লে শীত বাড়ল। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বন্য প্রানীর গা হিম করা ডাকও শুরু হলো। একটা থামলে আরেকটা শুরু হয়। শ্রাবনীর গায়ে গোল ফ্রক, জিন্স, একটা পাতলা জ্যাকেট। শীত মানছে না কোনোভাবেই। শীত আর বন্যপ্রানীর হাত থেকে বাঁচতে শ্রাবনী আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করলো। পাথরে পাথর ঘঁষলে আগুন জ্বলে একথা শুনেছিল, কিন্তু চেষ্টা করে লাভ হলো না। সেই সন্ধ্যা থেকে সে চেষ্টা করেই যাচ্ছে।

শরীর ক্লান্ত থাকায় এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও ঘুমিয়ে গেল শ্রাবনী। ঘুম থেকে উঠল ভোরবেলা। গাছের ফাঁক দিয়ে সকালের আলো উঁকি দিচ্ছে। ঘুমের রেশ ভালো করে কাটলে সে শুনতে পেল অদ্ভূত একটা শব্দ। চাপা গর্ গর্ শব্দটা। হিংস্র প্রানীর আওয়াজ যে তা বোঝাই যাচ্ছে। শ্রাবনী হঠাৎ বুঝে গেল প্রানীটা কী। তার চারপাশে অন্য কোনো প্রানীর ডাক শোনা যাচ্ছে না। একটা পাখিরও না। তার একটাই কারন হতে পারে। আশেপাশে কোথাও আছে সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার!
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here