অচিনপুর পর্ব -১৮

#অচিনপুর – ১৮

নাভিদ ভাইয়া একটু বিরক্ত সম্ভবত। তার ভুরু দুটোই কুচকে একসাথে মিশে আছে। চোখ মুখও শক্ত। নিচ থেকে উঠে এসেছে। এইজন্যই হাঁপাচ্ছে। জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,
— স্বর্ণ, বিনু, তোমরা এতক্ষণ উপরে কী করছ? সবাই চলে গেল যে!
ছোটো আপা মুখ বাঁকাল,
— গেলে গেছে। আপনিও কেন গেলেন না?
নাভিদ ভাইয়া চোখ থেকে চশমাটাকে নামাল। মুখ থেকে হাওয়া দিলো ওটার কাচে। তারপর গায়ের টিশার্টের কোণা দিয়ে মুছে নিয়ে আবার চোখে গলাল। চোখ বড়ো করে তাকিয়ে সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এমন ভাব করে বলল,
— দুটো মেয়ে একা যেতে পারতে না। রাস্তা খারাপ। পাহাড়ি-বাঙালি ঝামেলা হচ্ছে। আর্মি নেমেছে।
ছোটো আপাও অনেক বিরক্ত হয়েছে। ও কেমন জানি একটা মুখ করে বলল,
— আর্মি মানে কী? টাইগার? ম্যানইটার? নাকি ম্যানিয়াক ওরা? আমাদেরকে খেয়ে ফেলবে? বস্তায় বেঁধে গুম করে ফেলবে নাকি তপতীর পানিতে ডুবিয়ে দেবে?
নাভিদ ভাইয়ার মুখটা বোকা বোকা হয়ে গেল। ছোটো আপা কেন ক্ষেপে গেল ও বুঝতে পারছে না। আমিও কি ছাই বুঝতে পারছি?
নাভিদ ভাইয়া জিজ্ঞাসা করেই ফেলল,
— তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? আমি তো সাহায্য করতে এসেছি শুধুমাত্র। আর্মি নেমেছে সারা শহরে, সেজন্যই দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে।
— কেন আর্মিরা কি শুধু মেয়েদেরকে ধরবে? আমরা মেয়েরা এখন আমাদের এই অচিনপুরেও শান্তিতে চলতে পারব না? বডিগার্ড নিয়ে হাঁটতে হবে? আপনি আমাদের বডিগার্ড হয়েছেন? বেতন তো দিই না আপনাকে। বিনা বেতনের বডিগার্ড?
— আমি শুধুমাত্র সাহায্য করতেই এসেছি, বিনু!
— বিনু কে? কাকে বিনু বলে ডাকছেন আপনি? আমার বাবা, মায়ের রাখা নাম আপনি বিকৃত করেন কোন সাহসে?
নাভিদ ভাইয়া ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাতজোড় করে ফেলল। মুখ কাচুমাচু করে বলল,
— সরি। ওভাবে ভেবে বলিনি। প্লিজ, রাগ করো না। আমি এমনিতেই বলে ফেলেছি।
— মন থেকে সরি বলছেন তো? অনধিকার চর্চা আমার খুবই অপছন্দের। গায়ে পড়ে সখ্যতা করতে চাওয়াটা আরো বেশি অপছন্দ করি।
ওদেরকে ঝগড়া করতে রেখে আমি নিচে নেমে এলাম। একটা টোটো দাঁড়িয়ে ছিলো। উঠে পড়লাম একা একাই। চালককে বললাম,
— ঝাউতলা, সেতুলিতে চলেন।
— আর কেউ যাবে না?
— না। আমার কাছে ভাড়া আছে। চলেন।
আমার খুব হাসি পাচ্ছে। দুজনে বেদম ঝগড়া করবে এখন। ঝগড়ার চোটে ওদের খেয়ালই হয়নি, আমি নেমে এসেছি। যখন ঝগড়া থামবে, মুখ ভারী করে আমাকে খুঁজতে গিয়ে দেখবে, আমি নেই আশেপাশে। লাফিয়ে নেমে এসে টোটো ধরবে। আমাকে হারিয়ে ফেলেছে ভেবে ছোটো আপা ভয়েই কেঁদে ফেলবে। নাভিদ ভাইয়া ওকে স্বান্তনা দেবে। বলবে, ‘স্বর্ণ তো বড়ো মেয়ে। হারাবে কীভাবে? ও তো একা একাই অচিনপুর শহরে চলাফেরা করে! একা একা সেতুলিতে চলে গেছে হয়তো!’ ওদের তখন মিটমাট হয়ে যাবে। ভালোবাসাও হয়ে যেতে পারে!
এত সব চিন্তার মাঝে টোটোর দিক পাল্টেছে সেটা একদম খেয়াল করিনি। টোটোটা সেতুলির দিকে যাচ্ছিল না, অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে। মাঝখানে চেকপোস্টে আটকে পড়েছে। অনেকগুলো বস্তা দুইপাশে রেখে যানবাহন আটকে অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। চারিপাশে ইউনিফর্ম পরা আর্মি। ইউনিফর্ম পরা একজন এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে উঁকি দিলো,
— কোথায় যাও?
টোটোওয়ালা কিছু বলার আগেই আমি বললাম,
— ঝাউতলা, সেতুলি রেস্টুরেন্টে!
উর্দিপরা লোকটি ধমক দিয়ে বলল,
— ঝাউতলা তো এদিকে নয়। এদিকে তো ঝামেলা হচ্ছে। কয়েকজন বাঙালিকে অপহরণ করেছে উগ্র পাহাড়িরা। আবার বাঙালিরা মিলে নিরস্ত্র পাহাড়িদের আক্রমণ করে ঘর-বাড়ি পোড়াচ্ছে। এদিকে কেন এসেছ? নামো? আইডি দেখাও।
আমি লাফ দিয়ে নামলাম। বললাম,
— আমার কাছে তো আজকে আইডি কার্ড নেই! আমার বড়ো আপার বিয়ে। তাই আমরা খোলচিং চুড়ায় গিয়েছিলাম। আইডি কার্ড আনতে তো ভুলে গিয়েছি।
তিনি আমার কথায় সম্ভবত বিশ্বাস করলেন না। টোটোওয়ালার বডিচেক করে দুটো চাকু পেলেন। তার সন্দেহ আরো ঘনীভূত হলো। একজন আরেকজনকে বললেন,
— সব গুপ্ত সংগঠনের কর্মী! ছদ্মবেশে আছে।
আমি কেঁদে ফেললাম। বললাম,
— মোটেও না। আমার বাড়ি এই অচিনপুরে।
— অচিনপুর কোথায়?
— চেম্মুডুর ওই পাড়ে।
ওরা ওয়াকিটকিতে কী যেন বলল। তারপর আমাকে বলল,
— ওদিকে সব পাহাড়ীরা থাকে। আর সব উগ্রবাদী, গুপ্তদলের আস্তানা।
— আমি কিছু করিনি।
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেছিলাম। চেনা চিৎকারে ফিরে তাকালাম। সিতাংশু দাদা। মেখলীতে জুমে হলুদ, আদা আর কলার চাষ করে। মেখলীর আশেপাশে কিছু বেচে আর সাইকেলে চাপিয়ে বাকিটা নিয়ে আসে শহরে। বেশ স্বচ্ছল হয়ে উঠেছিল। বাঁশের চটার তৈরি মাচা ভেঙে দিয়ে সদ্য নতুন ঘর তুলেছে। দুই কামরার দালানের লাল টুকটুকে মেঝে। এক কোণে পানির ঘড়া। লাউয়ের খোলা দিয়ে তৈরি টুই জমা করে রাখা। অনেকগুলো টুই কাঁধের ঝুড়িতে করে নিয়ে মিকা বৌদি পাহাড়ের ছড়া থেকে পানি আনে, সেই সাত সকালে। ওপাশ দিয়ে গেলেই আমাকে ডাকে। নতুন বাড়ি দেখায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।
সিতাংশু দাদা চিৎকার করছে,
— ও আমাদের মেখলির সন্ন দিদি। ওকে কিছু করো না। ছেড়ে দাও এখনি!
সিতাংশু দাদাও চেকপোস্টে আটকে ছিল। এতক্ষণ ওর আওয়াজ শুনিনি। এখন আমাকে বিপদে দেখে চিৎকার করে উঠেছে। আর্মিদের হাতে লাঠি ছিল। একটা বাড়ি দিলো সিতাংশু দাদার পিঠে। ও হাতজোড় করে বলল,
— সন্ন দিদি মেখলির মেয়ে। ও আমাদের পাড়ার লক্ষ্মী। ওকে একদম কিছু করো না। ছেড়ে দাও বলছি!
আর্মিটি আমাকে ছাড়বে না মনে হচ্ছে। আমার টোটোওয়ালার গাড়ি থেকে লুকোনো বারুদের প্যাকেটও বের হয়েছে। ওরা সিতাংশু দাদাকে বলল,
— যাও, তুমি বাড়ি যাও!
সিতাংশু দাদা একদম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আবার ওর পিঠে বাড়ি পড়লে আমি জোরে কেঁদে দিলাম। সিতাংশু দাদা মাথা নিচু করে শক্ত করে বলল,
— তোমরা এই পাহাড়ের কেউ না। পাহাড় আমাদের। এখানে এসে আমাকে মেরেছ, আমাদের আরো অনেককে মেরেছ আমরা কিছু বলিনি। কিন্তু আমাদের মেয়েকে কিছু করলে ভালো হবে না, সৈনিক! সন্ন দিদিকে ছেড়ে দাও। আমাকে আটকে রাখো।
একজন আর্মি এগিয়ে এসে বলল,
— বাসায় ফোন করো। নম্বর বলো?
আমি ভয়ে ভয়েই বললাম,
— বাসায় তো ফোন নেই। মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই আমাদের মেখলিতে।
— আইডি নেই, মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই, টোটো নিয়ে এক জায়গায় এসেছে, অন্য জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছো, টোটোওয়ালার কাছে অস্ত্র রয়েছে৷ আর তুমি বোকা সাজছ! ইয়ার্কি?
— আমার বড়ো আপা আছে, এখন শহরেই আছে। এখন ওর মোবাইলে কল ঢুকবে।
আমি নম্বরটা দিলে, ওরা কল দিলে বড়ো আপা ধরল না। আমি কেঁদে দিলাম জোরে।
সিতাংশু দাদাও ক্ষেপে গেল সাথে সাথে। গরম গলায় বলল,
— খবরদার বলছি, সৈনিক। সন্ন দিদিকে কাঁদিয়ো না!
আর আমাকে বিস্ময়ে হতভম্ব করে দিয়ে ও একজন সেনার উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। একটা ক্যাওস শুরু হয়ে গেলে, আরো দুজন সৈনিক এসে ওকে ধরে ফেলল। ওদের গাড়িতে তুলল।
কার কার ফোন নম্বর মুখস্থ আছে মনে করার চেষ্টা করেই যাচ্ছি, ভয়ের চোটে একটাও মনে আসছে না! কলেজের জরুরি ফোন নম্বরগুলো, শম্পার বাবার ফোন নম্বর, কোচিংয়ের ভাইয়াদের নম্বর সব তো খাতায় নোট করা আছে। মুখস্থ নেই কোনোটাই! প্রমির নম্বর মুখস্থ করেছিলাম – কিন্তু ও তো এখন বরণপাড়ায়। কল ঢুকবে না। আর কার আছে মোবাইল? প্রহ্লাদ দাদা! কিন্তু তার নম্বরটাও তো মুখস্থ নেই। প্রভাত দাদার ফোন নম্বর মুখস্থ করেছিলাম, মনে পড়ছে না এখন! সৌমিকেরটা মনে আছে। ও রাজধানীতে চলে গেলে, ফোন করব বলে মুখস্থ করেছিলাম। কখনো ফোন না করা হলেও এখন টরটর করে বললাম নম্বরটা, ওরা মোবাইলে তুলেও নিলো। কিন্তু কল কি ঢুকবে? সৌমিক তো মেখলিতে এখন। ওখানে তো নেটওয়ার্ক নেই!
ইশ্বর আজ দয়ালু আমার প্রতি, ফোন ঢুকল। ডায়াল টোন শুনতে পাচ্ছি আমি। তার মানে সৌমিক শহরেই কোথাও আছে। এতক্ষণের ভয়, উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে বসে পড়লাম চুপ করে।
সৌমিক এলো চার পাঁচ মিনিটের মাথায়। মংসিকও এসেছে। আমি ছুটে গেলাম সৌমিকের কাছে। ও আমাকে মাথায় হাত দিয়ে নিজের কাঁধে মিশিয়ে আশ্বস্ত করল,
— আমি এসে গিয়েছি, আর টেনশন নেই!
আর্মিদের সাথে কথা বলে আমাকে নিয়ে ফিরে আসছিল ও, আমি বাধ সাধলাম,
— সিতাংশু দাদাকে না নিয়ে আমি ফিরব না! আমার জন্যই ওকে আটকে রেখেছে ওরা!
সৌমিক কথা বলে এসে জানালো,
— ওকেও ছেড়ে দেবে। তবে চোটপাট দেখাচ্ছিল বলে মেরেছে ওকে। ও একটু সুস্থ হলেই ছেড়ে দেবে।
আমি পিছু হটলাম। সিতাংশু দাদার ফিরতে দেরি হলে মিকা বৌদি খুব কাঁদবে। ছেলে কোলে নিয়ে একবার বাড়ি একবার রাস্তায় ছুটবে! ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম,
— সিতাংশু দাদাকে সাথে নিয়েই তবে যাব!
সৌমিক হাসল,
— তুমি বেশি বেশি মায়াবতী, ফুলপরী! আচ্ছা অপেক্ষা করো, আমি ওভাবেই নিয়ে আসি ওকে। তারপর মংসিককে ডেকে নিয়ে ওর কাঁধে চড়িয়ে সিতাংশু দাদাকে জিপে ওঠালো।
জিপে বসেও আমি একটু একটু কাঁপছি। সৌমিক আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
— আর ভয় নেই! কিন্তু ভয় ছিল। মস্ত বিপদ হতে পারত। টোটোওয়ালা লোকটা ভালো ছিল না। ওরা ছদ্মবেশে আছে। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস করে করে পাহাড়ি-বাঙালিদের সম্পর্ক অস্থিতিশীল করে তোলাই ওদের উদ্দেশ্য।
— কিন্তু আমাকে কেন এদিকে নিয়ে এলো? আমি তো ঝাউতলা যাব বলে টোটোওয়ালাকে বললাম। আমাকে এদিকে এনে ওর কী লাভ হতো?
সৌমিকের মুখ গম্ভীর হলো। আমার হাতটাকে দুহাতে জড়াল ও। তারপর থেমে থেমে বলল,
— অচিনপুর শহরটা গত দুয়েকদিনে বেশ অশান্ত হয়ে আছে। সমস্ত পাহাড়ে পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। যে পারছে, অন্যের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। মেয়েদের-বউদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর্মি নেমেছে শহরে, এসব নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই। আজকে ওরা না থাকলে কী সর্বনাশ ঘটে যেতে আমি কল্পনাতেও আনতে পারছি না! ভাগ্যিস ওরা ছিল!
— কিন্তু ওরাই তো হ্যারাজ করল আমাকে!
— না। ওরা ছিল বলেই সুস্থ তোমাকে ফিরে পেলাম আজ। ওই টোটোওয়ালা তোমাকে অপহরণ করতে চেয়েছিল! একটু আড়াল পেলেই তোমাকে বন্দী করে নিতো।
এর আগে আমি ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু এখন একটা আতঙ্ক মেরুদণ্ড বেয়ে নামতে থাকল যেন। ছোটো ছোটো বিপদে আমরা অস্থির হয়ে উঠি, অথচ এই ছোটো বিপদের মধ্য দিয়েই কত বড়ো বিপদের থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যাই!
ভয়ে অসার হয়ে সৌমিকের বুকে মাথা রাখলাম আমি। ও আস্তে মাথায় জাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
— ঝাউতলা কোথায় যাবে?
আমি একটু ইতস্তত করলাম। বড়ো আপার বিয়ের কথা কাউকে বলার কথা নয়। কিন্তু সৌমিক তো আর আমার পর কেউ নয়! একান্ত নিজের মানুষ ও আমার। আমি ওকে জানিয়ে দিলাম,
— বড়ো আপার বিয়ে ছিল আজ। সেতুলীতে যাওয়ার ছিল। চলো।
সৌমিক হেসে বলল,
— কিন্তু আমার তো দাওয়াত নেই!
— তুমি আমার মেহমান, চলো?
— শুধু মেহমান? আমি তো তোমার সব হতে চাই!
আমি মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেললাম। লজ্জাও পেলাম বেশ।
থেমে থেমে বললাম,
— দেরি আছে তো! বড়ো আপার বিয়ে হলো। এরপর মেজ আপার, তারপর ছোটো আপার – তারপর না আমার বিয়ে!
— সত্যি তো! কথা দিলে ফুলপরী, মনে থাকবে সেটা?
আমি উত্তর দিলাম না, মাথা নাড়লাম শুধু!
সৌমিক খুব অস্থির হলো হঠাৎ করে, অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
— আমার শরীরে প্রাণ ছিল না, ফুলপরী, যখন তুমি ফোনের এই প্রান্তে কেঁদে কেঁদে কথা বললে! আমার মনে হচ্ছিল আমার দুটো ডানা নেই কেন? আমি ম্যাজিক জানি না কেন? কেন জাদু করে তখনই উড়ে উড়ে তোমার কাছে আসতে পারছি না! মংসিককে নামিয়ে আমি নিজে জিপ ছুটিয়েছি, যেন উড়িয়েছি এটাকে! কী ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল আমার! আমি জানতাম তুমি সেইফ আছো, সেনাবাহিনীর অফিসাররা তোমাকে নিরাপদেই রাখবে, কিন্তু তুমি ভয় পেয়ে কাঁদছ, সেটাই আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দিচ্ছিল। তোমার সামান্য কষ্ট আমার সহ্য হয় না। তোমার এতটুকু মন খারাপে আমি অস্থির হই।
সৌমিকের গলা ধরে আছে। আমি হাত দিয়ে ওর চোখ পরীক্ষা করলাম। ভেজা ভেজা হয়ে আছে চোখের পাতা।
আমি ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম,
— তুমি কাঁদলেও তো আমার মন খারাপ হয়! এমন করো না তো! এত বেশি ভালোবাসো আমাকে?
সৌমিক আরো বেশি অস্থির হয়,
— একদিন তোমাকে সব বলব। সেদিন বুঝবে তুমি কতটা আমার আর কেন?
— এখন বলো!
— নাহ! এখনো বলার সময় হয়নি। আগে তোমাকে নিজের করে নিই! ওই যে তুমি বললে না, তোমার বোনেদের বিয়ের কথা। সেসব শেষ করে নিজের সিরিয়ালটা আনো তো তাড়াতাড়ি! আমিও আমার এই জনমের প্রতীক্ষা শেষ করি!

সেতুলীতে ভোজের পরে, উথাল-পাতাল কেঁদে বড়ো আপাকে রাজধানীর গাড়িতে তুলে দিয়ে মেখলি ফিরলাম আমরা সৌমিকের জিপে চড়ে। ছোটো আপাও কেঁদেছে অনেক। বেশি কথা বলছে না। পাহাড়ের উঁচুনিচু বাঁকগুলোতে চড়তে-নামতে যে অনুভূতি হয় সবসময় তাও যেন আজ টের পাচ্ছি না। আমার চারপাশটা অদ্ভুত রকম শূণ্যতায় ভরে উঠেছে!

বাড়ির সামনে এসে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। মেখলির সমস্ত মানুষ আমাদের এক চিলতে উঠোনে। ছুটে ঘরে উঠতে চাইলাম, থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম! বারান্দায় পাটির উপর মেজ আপাকে শুইয়ে রাখা! ওর শরীরের নিচের দিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কোমরের নিচ থেকে হাঁটু, হাঁটু ছেড়ে পায়ের পাতা, বারান্দা পেরিয়ে উঠোনেও গড়িয়ে এসেছে রক্তের ধারা। মায়ন্তী বুড়ি আর ওর বর হিতেন কবিরাজ অসহায় হয়ে বসে রয়েছে মেজ আপার নিথর শরীরটার পাশে।
মামি কেমন একটা পাগল পাগল হয়ে দৌড়ে এসে বলল,
— ও সৌমিক, তুমি এসেছ? তোমার আংকেল কখন গেছে টোটো আনতে। এখনো এলো না। তোমার জিপে করে মুন্নিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেবে?

চলবে
আফসানা আশা

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here