অচিনপুর পর্ব -১৭

#অচিনপুর – ১৭

অচিনপুরের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে তপতী নদী। অচিনপুর শহরের ইতিহাস এই নদীর বাঁকে বাঁকে লেখা। উঁচু নিচু সারি সারি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নেচে নেচে চলে যাওয়া এই নদী ক্রমশ নিজের শাখা-প্রশাখা বাড়িয়েছে আর সেগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছে সারা অচিনপুর শহর আর গ্রামগুলোতে, জালের মতো করে। তপতী নদীর উৎস তোপলং জলপ্রপাত। ওর নিচে দাঁড়িয়ে মাথাটাকে সবটুকু উঁচু করে দিলেও যার চূড়ার দেখা পাওয়া যায় না। পাহাড়টাও বেজায় খাড়া, বেয়ে উঠতে ভীষণ কষ্ট। আগে লোকশ্রুতি ছিল, জলদেবী বাস করেন তোপলং পাহাড়ের মাথায়। তার পরনে জলপাই পাতার জামা আর মাথায় পাহাড়ের রত্নখচিত মুকুট। এই পাহাড়ের মানুষগুলোর মা সে। তার সন্তানদের পানির কষ্ট দেখে সে তোপলংয়ের চূড়া ছুঁয়ে যাওয়া সমস্ত মেঘকে আদেশ করেছিলেন, জলের ধারা হয়ে বয়ে যেতে। সেই থেকে তোপলং থেকে অঝোর ঝর্ণাধারা নেমেই যাচ্ছে। আরেকটা জনশ্রুতি আছে এই ঝর্ণা ঘিরে, সেটা ভীষণ কষ্টদায়ক। ওই তোপলং পাহাড়ের চুড়ায় বাস করত এক কাঠুরে পরিবার। কাঠুরের ছোট্ট মাচায় তার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে বাস করত সে। রোজ সকালে সে নিচে নেমে আসত, বনে কাঠ কেটে বাজারে বেচে খাবার নিয়ে আসত। সন্ধ্যায় ফিরে কাঠুরের বউ রান্না করত আর চাঁদের আলোর নিচে বসে হাসিঠাট্টা করে খাবার খেত তারা। একদিন কাঠুরে বের হয়ে গেলে কাঠুরের বউকে তুলে নিয়ে গেল আকাশের অসুরেরা। আর কাঠুরে ফিরে এসে স্ত্রীকে খুঁজতে গিয়ে আকাশের মেঘ ধরে ঝুলে পড়লে, নিচে পড়ে মরে গেল সে। সেই থেকে কাঠুরের ছোটো মেয়েটা সেখানে বসে কেঁদেই যাচ্ছে আর তার চোখের জল ঝর্ণা হয়ে নেমে অবিরাম নেমে আসছে পৃথিবীর পরে!
এখন নিয়মিত ট্রেকিং দল উপরে ওঠে আর নামে। তারা কোনো দেব-দেবতার সাক্ষাৎ পায়নি। কোনো কাঁদতে থাকা ছোট্ট মেয়েকেও দেখতে পায়নি।
কিন্তু অচিনপুরের পুরোনো লোকেরা এখনো বিশ্বাস করে সেটা। তাদের ধারণা জলদেবী সবাইকে দেখা দেন না বলেই পাহাড় বেয়ে ওঠা মানুষগুলো কাউকে দেখতে পায় না। আর যারা বাচ্চা মেয়েটির কান্নার পুরান বিশ্বাস করে তারা বলে, মানুষকে ভয় পেয়েই বাচ্চাটা লুকিয়ে থাকে! আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওই বাচ্চাটার সাথে আমার খুব মিল আছে। পাহড়চুড়ায় একাকি কাঁদতে থাকা মেয়েটার কথা মনে করে আমার কান্না পায় খুব।
সৌমিক হাসল আমার কান্না দেখে। তোপলং ঝর্ণায় ওর সাথে ঘুরতে এসেছি আমি। আঁকাবাঁকা, পেছল পথে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেতে পারি আমি, এই আশংকা করে আমার হাতটাকে আলতো মুঠোয় ধরে রেখেছে ও।
তোপলং পাহাড়ের পাহাড়ের চারপাশ ঘুরিয়ে রাস্তা কাটা হয়েছে। রাস্তার দুইপাশে বুনো ফুলের বন। তাতে শতেক প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে নেচে নেচে৷ একটা নিলচে ফুলের ডাল যেন সোজা আকাশ থেকেই নেমে এসেছে। একদম আকাশের রঙের ফুলগুলো। ছোটো ছোটো নীল রঙের পাঁপড়ি, আর থোকায় থোকায় ছেয়ে আছে পুরো পাহাড়ের ছাদ জুড়ে। এক থোকা ফুলের খুব লোভ হলো আমার। সৌমিকের মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, একটা ডাল ভেঙে নিতে হাত বাড়ালাম আমি। নাগালে না পেয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিঁড়ে নিতে চাইতেই হোঁচট খেলাম! কত নীচে মাটি, ভেবে চিৎকার দিতেই সৌমিক তাকাল। ক্ষীপ্র গতিতে হাত বাড়িয়ে ধরে নিতে চাইল আমাকে। হঠাৎ করে আমার মনে হলো ওটা সৌমিক নয়, প্রভাত দাদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু প্রভাত দাদার মুখটা একদম আমার বাবার মতো। কেমন করে যেন বাবার মুখটা ক্রমাগত পালটে যেতে থাকল। এখন সেটা আকরামুজ্জামান চৌধুরীর মুখ হয়ে গিয়েছে। ভয়ংকর মানুষটার হাত থেকে নিজের হাতটাকে ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম আমি। আর পড়ে যেতে থাকলাম পাহাড়ের অতল খাদের ভেতর। পড়তেই থাকলাম… উপর থেকে ডাকছে প্রমি, মেজ আপা, কৃষ্ণা দিদি, লিটিনা… স্বর্ণ, স্বর্ণ করে চিৎকার করছে ওরা। আমার কান ফেটে যাচ্ছে। মাথা ফেটে যাচ্ছে। নিচে পড়ে যাওয়ার আগে আমি চোখ খুললাম। ওই যে আকাশ। আকাশের নিচে ছোটো আপার মুখ। ছোটো আপা ডাকছে আমাকে,
— স্বর্ণ, স্বর্ণ, কী হলো?
আমি বিহবল হয়ে তাকালাম।
ছোটো আপা জড়িয়ে ধরল আমাকে।
— কিছু না, স্বর্ণ। তুই স্বপ্ন দেখছিলি সোনামণি বোন আমার। কোনো ভয় নেই। এই দ্যাখ আমি ধরে আছি তোকে। তোর কোনো ভয় নেই, স্বর্ণ।
আমি কেঁদে ফেললাম ঝরঝর করে। এত ভয়ংকর স্বপ্ন আমি কেন দেখলাম!
ছোটো আপা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
— একটু বস তো চুপ করে। আমি একটু পানি পাই কি না দেখি! পানি খেলে ভালো লাগবে তোর।
— না, না, না, পানি লাগবে না। কিছু চাই না। তুমি যাবে না আমাকে ছেড়ে।
— আচ্ছা যাব না। এই যে আমি।
আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল ছোটো আপা। ভয়ে এখনো কাঁপছি আমি।
একটু সুস্থ হয়ে বললাম,
— বড়ো আপা কোথায়?
— ওরা তো নিচে চলে গেছে কখন? সেতুলীতে দাওয়াত আমাদের। আমি তোকে ডাকতেই এলাম। নেমে যাচ্ছিলাম তোকে ডেকে। কয়েক ধাপ নেমেও গিয়েছিলাম। পেছনে সাড়া না পেয়ে ফিরে দেখি তুই নেই। আবার উঠে এসে দেখলাম, অজ্ঞানের মতো হয়ে গেছিস। তোর সারা শরীর নীল হয়ে গিয়েছে। বসে বসে হাত পা ছুঁড়ছিস, কাঁদছিস আর কাঁপছিস। ভীষণ ভয়ও পেয়েছিস মনে হলো।
আমার ভয় এখনো কাটেনি। এদিক ওদিক তাকালাম। সব মনে পড়ল। খোলচিং পাহাড়ের চুড়ায়, ম্যারিজ রেজিস্ট্রারের অফিসের সামনের ছাউনিতে বসে ছিলাম আমি। ছোটো আপা আমাকে ডাকল। আমার মাথাটা কেমন যেন লাগছিল তখন। ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। বড়ো আপা চলে যাচ্ছে আজ, এটা মনে হয়ে বুক কাঁপতে শুরু করেছিল। আমার আশেপাশে কী ঘটছে টের পাচ্ছিলাম না। আমি কোথায় আছি, কী করছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর আর কিছু মনে নেই। ঘোর কেটেছে ছোটো আপার ডাক শুনে। আমি ঘোরভাঙা গলায় বললাম,
— কতক্ষণ এখানে আছি আমি?
— বেশিক্ষণ না। আমি দশটা কি বারোটা সিঁড়ি নিচে নেমেছিলাম। তারপর পেছন ফিরে কয়েকবার ডাকলাম তোকে। সাড়া দিলি না বলে উঠে এলাম। তোকে খুঁজে খুঁজে এখানে পেলাম। সব মিলিয়ে তিন কি চার মিনিট। বড়োজোর পাঁচ মিনিট!
পাঁচ মিনিট! অথচ আমার মনে হয়েছিল আমি অনন্ত কাল ধরে পাহাড় থেকে নিচে পড়েই যাচ্ছি! কী ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন ছিল ওটা!
নাভিদ ভাইয়াকে উঠে আসতে দেখলাম। বড়ো আপার ক্লাসমেট। ফুল ডাক্তার এখন। বড়ো আপার সমস্ত বন্ধুদের মাঝে শুধু এই নাভিদ ভাইই অচিনপুরের বাসিন্দা। এখানের সরকারি কলেজের ইংরেজির প্রফেসর ওনার বাবা। অচিনপুর শহরেরই একটু আড়ালে পাহাড়ের ঢালে বাড়ি করেছে ওরা। এখানেই ওদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গিয়েছে। চেম্মুডুর এই পাড়ে থাকে বলে এতদিন আমার নাভিদ ভাইয়াকে পছন্দ ছিল না। এখন ওকে খুব ভালো লেগে গেল। ওর সাথে ছোটো আপার বিয়ে হয়ে গেলে ভালো হতো। নদী পার হয়ে এত দূর আসলেও অন্তত অচিনপুরেই তো থাকত ছোটো আপা। মেজ আপাকেও নাভিদ ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখেছি, নাভিদ ভাইয়া বেশ চোখে হারায় ছোটো আপাকে। সেধে সেধে শুধু ছোটো আপার সাথেই কথা বলতে আসে। এই যে এখনও। অন্য সবাই থাকতে নাভিদ ভাইয়াই কেন আমাদেরকে খুঁজতে আবার এতটা খাড়া বেয়ে উঠে এলো? এটা কি ছোটো আপার জন্য? নাকি আমি ভুল ভাবছি? যেচে পড়ে কথা বলতে আসলেই কি সেটার অন্যরকম অর্থ হয়? এমনও তো হতে পারে, বড়ো আপার বোন বলেই, ছোটো আপার কদর করে। মেজ আপার সাথে পারে না, কেননা ও খুব বদমেজাজি। আর আমি তো ছোটোই!
আমার বাবা-মা নেই বলে সবাই করুণা করে, স্নেহ দেখায়, অকাতরে ভালোবাসে। সেইসব স্নেহপূর্ণ দৃষ্টির সাথে আমি পরিচিত। আমার একদম ছোটোবেলা থেকেই কাছের দূরের মানুষের মমতা আর ভালোবাসায় সিক্ত আমি। তাই চট করে কারো চোখে নতুন কোনো ভালোবাসা পড়তে পারি না। তবে, ছোটো আপা তো তা নয়। ও তো এতিম, অসহায় নয়। ওকে কেউ কেন করুণার চোখে দেখবে? ছোটো আপার দিকে নাভিদ ভাইয়ার বিশেষ দৃষ্টির অবশ্যই অন্য একটা অর্থ আছে।
আমাকে কথা বলতে হবে ওর সাথে। শিওর হতে হবে ব্যাপারটা। কারো দিকে বারবার তাকালেই কি প্রেম হয়? হয় কি না হয় নাভিদ ভাইয়াকে বলতে হবে এটা।
আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। এটা ব্যাপারটা খুব সিরিয়াসলি নিতে হবে আমাকে। ছোটো আপার একটা ব্যবস্থা অচিনপুরে করে দিতেই হবে। নইলে সৌমিকের আর আমার ভালোবাসার কথাটা যেদিন জানবে ও, অনেক দুঃখ পাবে। আমাকে ভুল বুঝবে। কিন্তু আমার তো দোষ নেই। সৌমিকই তো প্রথম বলেছে, আমাকে ও ভালোবাসে। আর আমিও তো ওকে ভীষণ পছন্দ করি…. আমাদের ভেতর প্রেম হয়ে গেলে আমি কী করে ফেরাব?
আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম, নাভিদ ভাইয়া কাছাকাছি এসে পড়েছে। আমাকে বলল,
— কী স্বর্ণ, এখানে এখনো কী করছ?

চলবে….
আফসানা আশা

(মাথায় ক্লিক বেইট ঘুরতেছে। প্রথম লাইন পড়েই গল্পে আছাড় দিয়ে পড়বে সবাই, তেমন টাইপ! এত কষ্টের অচিনপুর কেউ পড়ে না দেখে, আমারই স্বর্ণের মতো বোকা বোকা লাগে আর হাত-পা মেলে কাঁদতে ইচ্ছা হয়!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here