অতিরিক্ত চাওয়া পর্ব ৩৫

অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৩৫|

বেলী উইন্ডো দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলো। অন্ধকারে গাড়ির আলোয় পরিবেশ সতেজ। আকাশ ডাকছে। শীতল বাতাস ছেড়েছে। হয়তো বৃষ্টি হবে তীব্র। বেলীর মনে পড়ে গেলো তার আর তৃষ্ণার বৃষ্টি ভেজার সময়ের কথা। কি সুন্দর অনুভূতি। সেদিনের অনুভূতি গুলো বেলীকে একদম স্বাশ গেপে মেরে ফেলতে নিচ্ছিলো। পাশে তৃষ্ণা এখনও বেলীর দিক তাকিয়ে। তার জন্য বেলী ভুলেও সেদিক তাকাচ্ছে না। তৃষ্ণা কয়েকবার বেলীর ওড়না ধরে টান মারল। এক পর্যায়ে ওড়না খুলে আসলো। বেলী দ্রুত ওড়না টেনে নিয়ে পড়ে ফেলল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তৃষ্ণা হাসতে লাগলো। আবিদ বলল,
— ভাইর বঁধু, তুমু কী জানো ভাইর জন্মদিন পরশু।
বেলীর অবাকের আগে আরিকার চিৎকার,
— ও মাই গড। সিরিয়াসলি? দ্যাটস গুড। আমি তাহলে ভাইর জন্মদিন পালন করতে পারব।
বেলী তৃষ্ণার দিক তাকালো। তৃষ্ণা দুষ্টু হাসলো,
— সেদিন কিন্তু যা চাই দিতে হবে।
বেলীর বুক কেঁপে উঠলো। সে কিছুটা সরে বসলো জানালার সাথে লেগে৷

চৌধুরী বাড়ি ডিসিশন নিলো বিমান-কে সোজা অভিদের বাড়ি উঠানো হবে। মাঝরাস্তায় গাড়ি ঘোরাতে হয়েছে সকলের। তৃষ্ণা বিরক্ত বেলীর চুল টানতে টানতে বলল,
— আবিদ ল্যান্ডলাইন কল দিয়ে বলে দে আমরা চলে এসেছি।
আবিদের জবাব এলো,
— ড্রাইভিং করছি।
আরিকা বলল,
— ফোন কোথায়? দাও আমি বলছি৷
আরিকা কল লাগালো অভিদের বাড়ির ল্যান্ডলাইন এ, এবং ফোন আবিদের মুখের সামনে ধরলো,
— গেইট ক্লিয়ার করে ফেলো। আমরা চলে এসেছি।
অভিদের আলিশান বাড়ি আলোতে ঝলমলে। বাড়ির সামনে গাড়ির লাইন লেগে আছে। যেগুলোকে সরানোর জন্য চেঁচাচ্ছে দারোয়ান। বরের সবগুলো গাড়ি গেইটে পৌঁছাতেই দারোয়ান চেঁচিয়ে গেইট খুলছেন। ভেতরে গাড়ি লাইন বাই থেমেছে।
গাড়ি থামতেই বেলী নামার জন্য ফরফর করতে লাগলো। কিন্তু তৃষ্ণা দিচ্ছেই না। আরিকা হাসতে হাসতে বলল,
— ভাই বিয়েটা করে ফেলো। আই জাস্ট কান্ট টেইক ইওর পেইন।
তৃষ্ণা অসহায় গলায় বেলীকে ইঙ্গিত করে বলল,
— আমার পেইন আরিকাও দেখতে পাচ্ছে।
বেলী আঁড়চোখে বলল,
— বেরোবো। হাত ছাড়ুন।
তৃষ্ণা ছাড়লো না। বরং আবিদকে ইশারা করলো বেরোতে। আরিকা মিটিমিটি হাসতে হাসতে বেরোচ্ছে। আবিদ বেরোতে নিয়ে বলল,
— চাচি খুঁজবেন কিন্তু।
ওঁরা চলে যেতেই বেলী তৃষ্ণার দিক ফিরলো,
— আপনি এমন কেন? ওদের সামনে এমন করাটা কী প্রয়োজন ছিলো?
তৃষ্ণা বেলীর গাল টেনে ধরলো,
— কী করেছি?
বেলী অসহায় গলায় বলল,
— এভাবে দেখতে পেলে কী ভাববে। আপনি কেনো এমন?
ছাড়ুন আমি যাবো।
— আজ সারাদিন কিছু খাইনি তোর চিন্তায়। খিদে পেয়েছে।
বলতে বলতে তৃষ্ণা নিজের মাথা বেলীর কোলে রাখল।
তৃষ্ণা আবারও বলল,
— টায়ার্ড লাগছে। চুলগুলো একটু টেনে দে।
— আপনাকে খুঁজবে। এভাবে দেখলে ছিঃ। উঠুন।
ভিতরে গিয়ে না শুবেন।
তৃষ্ণা বেলীকে নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো । এবং ধরছেও। তৃষ্ণার জবাব না পেয়ে বেলী অগ্যত তৃষ্ণার চুলে হাত ছোঁয়ালো। আসলেই লোকটার চুলগুলো বড্ড স্মুথ। বেলীর ধরতে ভালো লাগে। বড্ড ভালো লাগে। হঠাৎ, মাথা উঁচু করে তৃষ্ণা বেলীর গালে চুমু খেয়ে বসলো। তারপর আবার কোলে মাথা রেখে বেলীকে দেখতে লাগলো। চমকে থাকা বেলীর নাক টেনে ধরে বলল,
— বিয়ে তো তোকে তুলে নিয়ে গিয়েই করতে হবে। তোর বাপের ওই যুক্তিবাদী কথায় বসে থাকতে পারব না। ইন্টার শেষ হতে হতে আমিই শেষ হয়ে যাব। অপেক্ষা আর আমার ধারা হবে না।
বহুত অপেক্ষা করেছি। এবার ডিরেক্ট তুলে বিয়ে। শুধু এগুলো মিটমাট হতে দে।
তৃষ্ণার শান্ত কথায় প্রবল মনোভাব দেখে বেলী চুপ মেরে গেলো। সে তখনই বুঝে নিয়েছে ধুমধামে বিয়ে তার নসিবে নেই। দেখা গেলো পরক্ষণেই তৃষ্ণা চোখ বুঝে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেলী চুপচাপ তৃষ্ণার চুল টেনে দিচ্ছে আর তাকে দেখছে।
তৃষ্ণা তার মায়ের ফর্সা গায়ের রঙ পেয়েছে। বিলাই চোখ গুলো আল্লাহর দেওয়া হয়তো। চৌধুরী বাড়ির কারো বিলাই চোখ নেই। নাকটা একদম উঁচু। বাবার নাক পেয়েছে। চেহারার গঠনে আমিদ এবং জয়া দুজনের আভাস রয়েছে। এবং কিছুটা নিজের মতো। সব মিলিয়ে বেশ সুদর্শন। বেলীর মনে পড়লো তার ক্লাস এঈটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা।

সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। বেলী সদা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিতো। সেইবার ও নেওয়ার কথা ছিলো। পুরো স্কুল সাজানো। গ্রামের বাচ্চারা মুরব্বিরা উঁকি দিয়ে আছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখবে। দারোয়ান তাদের ঢুকতে দিচ্ছেনা। বেলী তখন স্কুল ড্রেসে দাঁড়িয়ে গেইটের সামনে। খিদে পেয়েছে। ফুচকা খাবে। অর্ডার ও দিয়েছিল। হঠাৎ দারোয়ান গেইট লাগিয়ে দিলো। এবং আর ফুচকা খেতে দিবেনা বলে ঘোষণা দিলো। বেলী বারবার দারোয়ানকে বলেই যাচ্ছিলো,
— আমি বিশ টাকা দিয়ে দিয়েছি। আমার টাকাটা তো নিতে দিন মামা। আমার টাকাটা। একটু বেরোতে দিন টাকাটা এনেই ঢুকবো।
কিন্তু দারোয়ান শুনছিলোই না। বেলী গেইটের ফাঁক দিয়ে দেখলো ফুচকা ওয়ালা চলে যাচ্ছে। বেলী চেঁচাতে চেঁচাতে কেঁদেই দিলো। দারোয়ান ও আহম্মক হয়ে গেলো। দ্রুত গেইট খুলে দেখলো ততক্ষণে দারোয়ান চলে যাচ্ছে৷ তখনই তৃষ্ণা হাজির তার তিন চাচাতো ভাই নিয়ে। চশমা-টশমা পড়ে রাজা ধীরাজ সেজে বেলীর সামনে দাঁড়িয়ে। সেদিন তৃষ্ণার একবার জিজ্ঞেস করাতেই,
– কী হয়েছে?
বেলী গরগর করে বলে দিচ্ছিলো,
— আমার খিদে পেয়েছিলো। তাই ফুচকার অর্ডার দিয়েছিলাম। বিশ টাকাও দিয়ে দিয়েছি। তখনই এই মামা গেইট লাগিয়ে ফুচকা ওয়ালাকে ভাগিয়ে দিলো। এখন আমার বিশ টাকা?
আমার দু’দিনের টাকা।
বেলীর কাঁদা দেখে শিক্ষক ও কিছু হাজির। তৃষ্ণার কথায় তারা চলেও গেলেন। সেদিন তৃষ্ণা সেই ফুচকা ওয়ালাকে আবারও স্কুলের সামনে হাজির করেছিল। বেলীর বিশ টাকা তো দিয়েছেই সাথে বেলীকে তিন প্লেট ফুচকাও খাইয়েছে। সেদিন তৃষ্ণা প্রথম হালকা হেসে বেলীর বেনী টেনে দিয়ে বলেছিল,
— আমার বেনীওয়ালি।
কিন্তু তখন বুদ্ধু বেলী কিছুই বোঝেনি ‘ আমার বেনীওয়ালির ‘ মানে। এখন তো সে বুঝতে পারছে। তৃষ্ণা ঘুমিয়ে পড়েছে। বেলীর ইচ্ছে করছে তৃষ্ণার কপালে চুমু খেতে। কিন্তু লজ্জায় আর দ্বিধায় পারছে না। সে তৃষ্ণার মুখ ছুঁতে লাগলো। সত্যি লোকটা তাকে সেই পিচ্চি থেকে পছন্দ করতো? যখন বেলী নাকে, মুখে পানি এনে কাঁদতেই থাকতো সদা। বেলী হেসে ফেলল।

তৃষ্ণা ঘন্টা খানিকের মাঝে নিজেই উঠলো। দেখলো বেলী তার দিক তখনও তাকিয়ে। তৃষ্ণাকে উঠতে দেখে বেলী দ্রুত অন্যদিকে ফিরলো। তৃষ্ণা উঠে বসলো। ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ক’টা বাজে?
— সাত টা।
— চল।
তৃষ্ণা বেরিয়ে বেলীকেও ওপাশ থেকে গেইট খুলে বের করলো। পাশাপাশি ঝলমলে আলোর মাঝে হাঁটতে গিয়ে বেলী বারবার তৃষ্ণার দিক তাকাচ্ছে। এই একটা ঘন্টা সে তাকিয়েই ছিলো তৃষ্ণার দিক। ভাবতেই বেলীর লজ্জা লাগতে লাগলো। এটা শুধু সম্ভব হয়েছে কারণ তৃষ্ণা ঘুমিয়ে নাহলে কখনোই বেলী পারতো না। আজকে উঁচু জুতার কারণে তাদের হাইট বেমানান লাগছে না। বেশ মানাচ্ছে। বেলীর ইচ্ছা করলো তৃষ্ণার হাত ধরে হাঁটতে। পরক্ষণেই খেয়াল করলো তার বাড়ির সামনে। বেলী ইচ্ছাটাকে দমিয়ে আঁড়চোখে তৃষ্ণাকে দেখতে লাগলো। তার রাগ-অভিমান কি অল্পতেই ভেঙে গেলো। কেন পারে নি আরও কিছুদিন রেগে থাকতে? এইযে তৃষ্ণার মুখে ‘ আই লাভ ইউ’ শুনে বেলীর অভিমানী মন একদম শীতল পানিতে ভেসে গেলো। অশান্ত মন নিমিষেই জেন শান্ত হয়ে গেলো। সতেজ আনন্দে বেলীর আর এই রাগ-অভিমান নিয়ে চলতে ইচ্ছে করলো না। বরং সব ভুলে গিয়ে তৃষ্ণায় মেতে থাকতেই মন চাইলো।

ড্রয়িংরুমে দৌঁড়ঝাপের অবস্থা চলছে। তৃষ্ণা গিয়ে সোফায় বসে পড়লো। দুরবর্তীতে দাঁড়িয়ে থাকা জয়াকে বলল,
— মা…. ঠান্ডা পানি পাঠাও না।
জয়া ছেলের আবদারে নিজেই নিয়ে আসলো পানি। এবং ছেলের পাশে বসতে বসতে বলল,
— ছোট ভাই বিয়ে করে ফেলল আর তুই এখনও না।
তৃষ্ণা একটানে গ্লাস খালি করে বলল,
— আমিতো রাজি মা।
— রাজি? রাজি দিয়ে হবে কী? মেয়ে পছন্দ করেছিস হাটুবয়সী। যাকে দিতে তার বাপ-মায়ের বুক কাঁপে।
তৃষ্ণা হাসতে লাগলো। জয়া গ্লাস নিয়ে মিনমিন গলায় কথা বলতে বলতে রান্নাঘর যেতে লাগলো। বেলী তখন অভির মায়ের হাতে। বেলীর মনে হলো বয়স অনুযায়ী মহিলাটি এখনও চমতকার। দুটো ছেলে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে গুঁছিয়ে রেখেছে। অভি আম্মু বেলীর মাথা ছুঁইয়ে বলল,
— মাশাল্লাহ। সুন্দর। আমাদের তৃষ্ণার জন্য ছোট হয়ে যায়। তাও মেনে নিয়েছি। আমাদের ছেলে খুশি থাকলেই হলো।
তিনি নিজে বেলিকে ডাইনিং এ বসালো, টুকটাক খাওয়ালেন। এবং বেলীকে উপরের একটা রুমে দিয়ে বললেন,
— নিচে অনেক ঝামেলা। তুমি রুম আটকে শুয়ে থাকো। বোনের চিন্তা করিয় না। আমি আছি তো। সামলে রাখবো।
বেলীর মনে হলো তার মন জুড়িয়ে গেলো। মহিলাটি যেতেই বেলী গেইট লাগিয়ে ফ্রেস বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলো।

বেলীর ঘুম ভাঙলো আয়েশার ডাকে। ঘুম কাতুরে বেলীর ইচ্ছা করলো না গেইট খুলতে। তাও উঠে খুলে দেখলো সব গুলো হাজির। এবং সবাই গিয়ে রুমের খাট দখল করে নিলো। বাবলু অভির ফোন টিপতে টিপতে বিছানার এক কোনায় উল্টো শুয়ে পড়লো। আবিদ, আয়ুশ বালিশ নিয়ে আরামে আধশোয়া হয়ে বসলো। অঞ্জলি এসে বেলীর পাশে দাঁড়ালো। তৃষা বেলীর কোমর জড়িয়ে। এমন কিছু বেলী আসাই করেনি। আবিদ বলল,
— ভাইর বঁধু ঘুম কেমন হলো?
বেলী ঘুমন্ত কন্ঠে বলল,
— লাউকে লাউ বলতে শিখুন
কদুকে কদু
আমাকে আমি বলতে শিখুন
নাকি আপনার ভাইর বঁধু

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here