অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -০৮+৯

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_০৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ভোররাতে ঘুম ভাঙলো এলার্মের শব্দে। খোলা চুল হাত খোঁপায় বেঁধে নিলো তরী। জানালায় চোখ রেখে দেখে নিলো প্রতিটি বিল্ডিং এ আলো জ্বলছে মিটিমিটি। দূর থেকে মনে হয় একঝাঁক জোনাকি পোকা দলবেঁধে আছে। কি অপরূপ দৃশ্য। যা কেবল রমজান মাসেই দেখা যায়। তরীদের বিল্ডিং এ একটা নিয়ম তরীর ভীষণ ভালোলাগে। ভোররাতে যে ফ্যামিলিই আগে জাগবে, তারা প্রতি তলায় গিয়ে কলিংবেল চাপ দেবে। দরজা না খোলা পর্যন্ত বেল দিতেই থাকে। দরজা খোলার পরই সবাই উঠে পড়েছে নিশ্চিত হয়ে ঘরে ফেরে।
মা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করছেন। তরী একে একে সবগুলো খাবার টেবিলে এনে রাখলো। বাবা বললেন,
-“তটিনী, আমার মা কে ডেকে তোলো।”

মিঠু ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে খাবার টেবিলে বসেছে। বাবার আদেশ পেতেই তরী চলে গেল অরুকে ডেকে তুলতে। আহ্লাদী অরু ঘুম থেকে উঠলেও পণ করলো সে ব্রাশ করবেনা। না মানে না। এসেই বাবার কোল দখল করে বসেছে। ছোট্ট হাত দুটো বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। ঘাড়ে মাথা রেখে চুপটি করে রইল অরু।
দুষ্টুমি না করলে মিঠু কিছুতেই শান্তি পায়না। তার এতক্ষণের ঢুলুঢুলু ঘুম পালিয়ে গেল। অরুকে খোঁচা মে*রে বলল,

-“আমার বাবার কোল থেকে এক্ষুণি নাম। তুই এসে আমাদের দুই ভাই-বোনের আদর-ভালোবাসা সব কেঁড়ে নিয়েছিস। কাল সকালেই তোকে যেখান থেকে দয়া করে নিয়ে এসেছি, সেখানে দিয়ে আসবো।”

অরু বাবার ঘাড় থেকে মাথা তুলে গরম চোখে তাকালো। গলায় তীব্র ক্ষোভ মিশিয়ে বলল,
-“মিঠু পঁচা কুমড়া। আমরা দুই বোন। রাস্তায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল এক গরিব ছেলে। আমি আর আপু বাবাকে বলে দয়া করে তাকে নিয়ে এসে নাম দিয়েছি মিঠু।”

মিঠু মিটিমিটি হেসে বলল,
-“বাবা তুমিই বলো, আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছো না-কি অরুকে?”

অরু বড়োবড়ো চোখ করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবা কিছুই বলছেন না। মিটিমিটি হাসছেন শুধু। চালাক অরু নিজের পক্ষে বাবাকে টে*নে নিতে অল্পস্বল্প ঘু*ষ দিলো । তুলতুলে নরম হাত দুটো বাবার গলা ছেড়ে গালে এসে ঠেকেছে। বাবার পুরো মুখ চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলে আদুরে গলায় বলল,
-“বলো বাবা, বলো মিঠু পঁচা কুমড়াকে কুড়িয়ে পেয়েছো।”

ভীষণ যত্নে দেওয়া আদর পেয়ে বাবা অরুর পক্ষে রায় দিলেন। মহাখুশি অরু। মিঠুকে ভেংচি কাটছে বারবার। মিঠুও থেমে নেই। এটা-ওটা বলে অরুকে ক্ষে*পি*য়ে যাচ্ছে।
সেহরি শেষ করে ফোন হাতে নিলো তরী। চোখের পাতায় ঘুম ধরা দিচ্ছে না। একবার উঁকি দিলো সোস্যাল মিডিয়ায়। অসংখ্য আইডির পাশে সবুজ বাতি জ্বলজ্বল করছে। কিছুক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। তখনই টুংটাং শব্দে বার্তা এলো।

❝এখনো ঘুমান নি কেন, তরী?❞

ফোনের আলো চোখে পড়তেই তরীর মনে হলো লোকটি স্বয়ং তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই তীক্ষ্ণ নজরে প্রশ্ন ছুঁড়ছে তাকে। গাল দুটো ধীরে ধীরে আরক্তিম হলো। তরী জবাব দিলোনা। ফোন উপুড় করে রেখেই বড়ো বড়ো শ্বাস নিলো। চোখ বুজে রইলো মিনিট খানেক। ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়লো সেদিনের ঘটনা। মাহমুদের উৎকন্ঠা, যত্নে আগলে রাখা। বেশ খানেক সময় পর নিজেকে ধাতস্থ করে ফোন হাতে নিলো তরী। কি-বোর্ডে হাত চলল বড্ড ধীর গতিতে।

❝ঘুম আসছে না।❞

লিখেই সেন্ড করলো। সিন হলো সাথে সাথেই। মাহমুদ কিছু লিখছে। তরীর বুকের ভেতর হাতুটি পেটার শব্দ হচ্ছে। ভয়া*নক অস্থিরতা থেকে বাঁচতে ওয়াই-ফাই কানেকশন অফ করে দিল। শুয়ে থেকেই আন্দাজ করতে পারছে তার শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। বুক ধুকপুক করছে।
আধার ডিঙিয়ে আলো ফোটলো। দূর থেকে ভোরের পাখি ডাকছে মধুর সুরে। আকাশ কাঁপিয়ে হুট করেই ঝরঝরে বৃষ্টি নামলো। তরী আর ঘুমাতে পারলোনা। একছুটে বারান্দার দরজা খুলে ঠিক দরজায় দাঁড়ালো। ভারিবর্ষণের সাথে সাথে বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। তরী কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলেও ভোরের বৃষ্টি হওয়া দেখলো। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার দেহখানা। মাহমুদের ঘর তিনতলায় তরীর ঘরের ঠিক বিপরীতে। কোনাকুনি বারান্দায় তাকাতে বেশ সুবিধা হলো। পকেটে হাত গুঁজে গভীর মনযোগে তরীকে অবলোকন করলো মাহমুদ। ওদিকে যে সে ভিজে একাকার সেই দিকে ধ্যান নেই। হুট করেই ডেকে উঠলো,

“তরী!”

দুই অক্ষরের ছোট্ট নামটি ঝংকার তুললো তরীর কানে। বৃষ্টির তালে তালে ছন্দিত হলো নামটি। শব্দের উৎস বরাবর তাকালো তরী। মুখোমুখি দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। মাহমুদ তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলো। তরীর নজর পড়লো অর্ধ ভেজা মাহমুদের শরীরে। জড়তা ভেঙে গলার স্বর বাড়ালো।

-“ভিজে যাচ্ছেন তো আপনি।”

কিছু বলছে তরী, বৃষ্টির কারণে স্পষ্ট শুনতে পারছেনা মাহমুদ। তরীর দু-ঠোঁট নাড়ার চমৎকার দৃশ্যে আটকে রইলো সে। মনে প্রাণে চাইলো তুমুল বর্ষনের এই স্নিগ্ধ সকালটা থেমে যাক। সময় না গড়াক। মাহমুদের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তরী খুব বেশি দেরি করলোনা, দ্রুত ঘরে ফিরলো। ফোন হাতে নিয়ে বার্তা পাঠালো,
❝বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন আপনি?❞

মাহমুদের পাঠানো পুরনো বার্তাটি একবার পড়ে নিলো।
❝ঘুমিয়ে পড়ুন, তরী। শরীর খা*রা*প করবে যে!❞

ফোন রেখে চোখ বুজলো তরী। রাজ্যের ঘুম এসে তার চোখের পাতায় ভীড় জমিয়েছে।

তরী সরে যেতেই সংবিৎ ফিরে পেলো মাহমুদ। নজরে পড়লো নিজের ভেজা শরীর। আনমনেই হেসে ফেললো সে। জামাকাপড় বদলে দোয়ালেতে চুল মুছে নিলো। এখন আর ঘুম হবে না তার। ফোন হাতে নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তা পেয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফোটে উঠলো। চোখ বুজে ঠোঁট নাড়িয়ে দু’বার উচ্চারণ করলো,
-“তরী! তরী!”
অধর কোণে লেপ্টে রইলো সুখ সুখ হাসি।

★★★

ইদের বাকি অল্প কিছুদিন। ব্যাগপত্র গুছিয়ে গতকালই বাড়ি ফিরে গেল মাহমুদরা সকলেই। ইদের ছুটি কাটবে বাড়িতে, সবার সাথে।
আয়েশা সুলতানা বারবার করে বলে গিয়েছেন তরী, অরু, মিঠুকে ইদের দিন মাহমুদ নিতে আসবে। তারা যেন তৈরি থাকে। প্রথমে তরীর বাবা নারাজ ছিলেন। তিন-চারমাসের পরিচিত ভাড়াটিয়ার বাড়িতে একা একা ছেলেমেয়েকে যেতে দেওয়া কেমন বেমানান। আয়েশা সুলতানা সবটা সামলে নিলেন। কথার মারপ্যাঁচে ফেলে ঠিকই রাজি করিয়ে নিলেন তরীর বাবাকে।

যথারীতি ইদের দিন বিকেলে এসেই হাজির মাহমুদরা তিনভাই। আসার সময় বড়ো ভাইয়াকেও নিয়ে এসেছে। তিনিও বেশ হাসিখুশি মানুষ। সহজেই সবার সাথে মিশে গেলেন। যেন পূর্ব পরিচিত সবাই। মাহমুদের পিপাসু দৃষ্টি খুঁজে যাচ্ছে তরীকে। কোথায় গিয়ে ঘাপটি মে*রে আছে মেয়েটা। অরুকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। গোলাপি রঙের একটা ফ্রক পরেছে। লম্বা চুল পিঠের উপর ছড়ানো। মাহমুদ টুক করেই কোলে তুলে নিলো তাকে। তরী নেমে যেতে চাইলো। তার ভেতরে এখনো ভ*য় রয়ে গিয়েছে। এই বুঝি মাহমুদ তাকে বুড়োলোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। অনেকটা সময় নিয়ে শান্ত করলো তাকে। হাতের মুঠোয় সালামি গুঁজে দিয়ে বলল,
-“এবার আমার সালামি দাও।”

অরু বড়োবড়ো চোখ করে তাকালো। ফোলা ফোলা গাল নিয়ে বলল,
-“আমিতো এইটুকুন ছোটো। ছোটোরা কি সালামি দিতে পারে?”

-“পারে।”

-“কিভাবে?”

-“তুমি আমার গালে আদর দিয়ে দাও। তাহলে সালামি দাওয়া হয়ে যাবে।”

অরু টুপ করেই চুমু দিলো মাহমুদের গালে। খিলখিল করে হেসে বলল,
-“দিয়েছি সালামি।”

মিঠু আগে থেকেই রামির সাথে যুদ্ধে নেমেছে। মিশন সালামি। একে অপরের কাছে সালামি চেয়ে ঝ*গ*ড়া শুরু করে দিয়েছে। রামি বলল,
-“আমি ছোটো মানুষ। জলদি জলদি সালামি বের কর।”

মিঠু রান্নাঘরে ছুটলো। অরুর ছোটোবেলার পিডার হাতে নিয়ে পানি ভর্তি করে আগের জায়গায় এলো।
-“নে ছোটো বাচ্চা পিডার খা। তুই ছোটো বাচ্চা, তুই পিডার না খেয়ে সালামি চাইবি কেন? চ*ড়ি*য়ে এই মাড়ির দাঁত ওই মাড়িতে নিয়ে যাবো।”

রামি ক্ষে*পে গেল। এতবড়ো অপমান সে বরদাস্ত করবেনা। কিছুতেই না। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে বলে উঠলো,
-“আমাদের বাসায় যাওয়ার সময় তোর চান্দি ছিলা করে কু*ত্তা*ধু*না দেবো। তোর এত বড়ো স্পর্ধা, তুই আমাকে অ*প*মা*ন করিস?”

-“তুই আমাকে কী কু*ত্তা*ধু*না দিবি? আমি এখনই তোকে বল বানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফুটবল খেলবো।”

অবশেষে তরীর দেখা মিললো। নাস্তা হাতে সামনে এসে সালাম দিলো। সকালে বান্ধবী আর মেহমানের ভীড়ে ঘোরাঘুরি হয়নি তার। মাহমুদ চোখের পলক ফেললোনা। নিঃসংশয়ে তাকিয়ে রইলো। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট মুগ্ধতা। তরী আড়চোখে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারলো লোকটি বিভোর হয়ে তাকেই দেখছে। অস্বস্তি নিয়ে এদিকওদিক তাকালো তরী। মাহমুদের বড়োভাই টুকটাক কথা বলছেন। তরী জবাব দিচ্ছে জড়তা নিয়ে। তিনি ফট করেই বলে ফেললেন,
-“তুমি দেখছি একেবারেই লাজুক, তরী। বড়োভাই ভেবে কথা বলো। দেখবে আর জড়তা কাজ করছেনা। তুমিতো আমার ছোটোবোনের মতোই।”

তরী অমলিন হেসে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো। হুট করে অপরিচিতদের সাথে মিশতে পারেনা সে।
সবাইকে নাস্তা নিতে বলেই একপাশে দাঁড়ালো তরী। মাহমুদ নাস্তা হাতে নিতে নিতেই নিচু স্বরে বলল,
-“ইদ মোবারক।”

তরী ভুলে যাওয়ার ভঙ্গিতে জিহ্বায় কামড় দিলো। লজ্জায় জবুথবু হয়ে সেও মাহমুদকে ইদের শুভেচ্ছা জানালো। তরীর বাবার সাথে কথা বলে তরী আর মিঠুকে নিয়ে বের হলো তারা। বাবা অরুকে যেতে দিলেন না। অরু ছোটো মানুষ। তাছাড়া সবগুলো ছেলেমেয়ে চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে।
মাহমুদের পেছন পেছন হেঁটে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো তরী। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-“শুনুন।”

চোখ বুজে হাসলো মাহমুদ। পিছু ফিরে তরীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। গভীর স্বরে বলল,
-“বলুন না, তরী।”

তরী ইতস্তত করে বলল,
-“আমি জানালার পাশেই বসবো।”

-“জানালার পাশের সিট খালিই আছে। আপনি সেখানেই বসবেন।”

তরী আঙ্গুল তাক করে দেখালো রামি আর মিঠুর দিকে। দুজনে মা*রা*মা*রি করে দুটো জানালার পাশের সিট দখল করে আছে। মাহমুদ রামিকে সরিয়ে পেছনে পাঠিয়ে দিলো। মুখ অন্ধকার করে পেছনে বসলো রামি। মিঠু তাকে বিদ্রুপ করে হাসছে। গাড়ি দশমিনিটের রাস্তা পার হওয়ার পরই রামি উঠে দাঁড়ালো। মিঠুর মাথার কাছে মুখ নিয়ে বমি করার চেষ্টা করছে। মিঠু পেছন ফিরে ঠা*স করে থা*প্প*ড় বসিয়ে দিলো রামির মাথায়। তাদের দুজনের কাজে বিরক্ত হয়ে মাহমুদ মিঠুকেও পেছনে পাঠিয়ে দিলো।
-“দুজনে পেছনে থেকে যা ইচ্ছে কর।”

রামি তৃপ্তির হাসি হাসছে। মিঠুর দিকে দু- হাত বাড়িয়ে বলল,
-“আসো শ*য়*তা*নে*র নানা। নানা, দাদা মিলে কোলাকুলি করি।”

-“তোর মতো শ*য়*তা*নে*র মুখে থু মা*রি থু।”

তরী জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে আছে। তার মাথা পেছনে টে*নে নিলো মাহমুদ। তরী প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই মাহমুদ শান্ত চোখে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল,
-”মাথা ভেতরে রেখে বসুন। যদি কিছু হয়ে যায়?”

তরী দ্বিরুক্তি করলোনা। দৃষ্টি নিচু করে মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে বসলো। মাহমুদের দৃষ্টি এখনো অবিচল। যেন শত বছরের দেখার স্বাদ সে এই মুহূর্তে মিটিয়ে নিতে চায়। মাহমুদ কোমল গলায় ডাকলো,
-“তরী।”

-“হু।”

-“আপনার বাবা যেন আপনায় কী নামে ডাকে?”

-“তটিনী।”

-“আপনি জানেন কি? তটিনী নামের মতোই আপনি যে-কাউকে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আমিও যে ভেসে যাচ্ছি, তরী।”

থমকে গেল তরী। চোখজোড়া বিচরণ করছে মাহমুদের আবেশিত চোখে। বড়োভাই সামনে বসেছেন ড্রাইভারের সাথে। মাহমুদ সবার অগোচরে তরীর নরম চিকন হাত নিজের হাতর মুঠোয় নিয়ে নির্লপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো। জমে গেল তরী। তার চোখেমুখে আতঙ্ক। বুকের ভেতর শিরশির করা অনুভূতি হচ্ছে। বারবার সামনে তাকিয়ে দেখছে কেউ দেখছে কি-না!
মাহমুদ সামনে দৃষ্টি রেখেই মৃদু স্বরে বলল,
-“কেউ দেখছে না, তরী।”

#চলবে……..#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_০৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বর্ষপঞ্জিকার পাতায় চলছে বৃষ্টিভেজা আষাঢ় মাস।
আষাঢ় হলো প্রেমময় মাস। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। গাছে গাছে কদম ফুলের থোকা। জৈষ্ঠ্যের জ্বালাময়ী রুক্ষতাকে বিদায়ী বার্তা জানিয়ে আগমন ঘটলো আষাঢ়ের। শুষ্কতা বিদায় নিয়ে ঝুম বৃষ্টি নামে। প্রকৃতি সেজে ওঠে নব রূপে। প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটায় প্রেম ঝরে পড়ে। প্রবল বর্ষণ বয়ে আনে শীতলতা। বৃষ্টির তালে তালে ময়ূর পেখম মেলে নাচে। বিলের জলে ফোটে ওঠে রঙিন পদ্ম। আষাঢের এই রহস্যময়ী রূপে জমে ওঠে কপোত-কপোতীর প্রেম। তরীর আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ভীষণ ইচ্ছে হলো। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছুটলো ছাদে। মনের আনাচ-কানাচে মিষ্টি ভালোলাগা। একটু একটু করে পুরোটাই বৃষ্টির আয়ত্তে চলে গেল তরী। ঝুমঝুমি বৃষ্টির তালে ঘুরে বেড়ালো পুরো ছাদ। নামলো সুখ অনুসন্ধানে। ঘন্টাখানেক মুষলধারে বৃষ্টি হলো। তরী ততক্ষণ ভিজলো। শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়া জামা টে*নে*টু*নে ঠিক করে নামলো সিঁড়ি বেয়ে। মাঝপথেই মাহমুদের সাথে দেখা। পা জোড়া থেমে গেলো সেখানেই। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো তরীর, সাথে আকাশস্পর্শী অস্বস্তি। এলোমেলো দৃষ্টিতে আশপাশে দেখলো। লজ্জাবতী গাছের পাতার মতো নুইয়ে পড়ছে যেন। বারবার জামা ঠিক করার চেষ্টা করছে।

মাহমুদ চোখ ফিরিয়ে নিলো। অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
-“আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে, তরী। দ্রুত ঘরে ফিরুন।”

তরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ছুটে পালিয়ে গেলো। আজ আর সে বাসার বাইরে বের হবেনা। কিছুতেই না।
তরীর ছুটে যাওয়া পথে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল মাহমুদ,
-“আমায় সামলে থাকতে দিচ্ছেন না কেন, তরী?”

তরী শুনলোনা প্রেমিক পুরুষের আকুলতা। সে ছুটে চললো এক সমুদ্র লজ্জা নিয়ে। পিছু ফিরলেই যে অনর্থ কিছু ঘটে যাবে।

জামা পাল্টে কাঁথামুড়ি দিলো তরী। মায়ের ডাকাডাকিতেও সাড়া দিলোনা। এখনো তার বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করে উঠছে। হাত-পা কাঁপছে। চোখেমুখে তার লজ্জার আভা। চোখ বুঝে বড়োসড়ো দুটো শ্বাস নিলো।
তখনই ফোনে টুংটাং শব্দ হলো। বার্তা এলো বিপরীত দিক থেকে।

❝বারান্দায় আসুন, তরী। অপেক্ষা করছি আমি।❞

তরী ফোন ওভাবেই রেখে দিলো। সে গেলোনা বারান্দায়। নাকচ করলো মাহমুদের আদেশ। সে যেমন পরিস্থিতিতে ছিলো, এই মুহূর্তে চোখে চোখ রাখতে পারবেনা। ইশ! কেনই বা ভিজতে গেল সে? নিজেকেই দো*ষা*র*প করে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে মাহমুদের সামনে পড়লে নির্ঘাত অস্বস্তিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে। নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস তার নেই। আধা ঘন্টা সময় পেরিয়ে গেলো। না তরী বারান্দায় গেলো আর না কোন বার্তা এলো। লোকটি কি এখনো দাঁড়িয়ে আছে? মনে মনে কৌতুহল হানা দিতেই ধীর গতিতে বিছানা ছাড়লো তরী। খট করেই বারান্দার দরজা খুলে দিলো। বাইরের ঝড়ো হওয়া উঠিয়ে দিলো তার ভেজা চুল। বাতাসের দাপটে ক্ষীণ হয়ে এলো চোখজোড়া। ঝট করেই ডান পাশে চোখ ফেরালো তরী। মানুষটি যায়নি। তার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে। বিভোর হয়ে তাকেই দেখছে। তরীর বার কয়েক পলক ঝাপটালেও মাহমুদের পলক পড়লোনা। গভীর অনুযোগের স্বরে মাহমুদ বলল,
-“এতক্ষণ আসেন নি কেন, তরী? আমি যে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।”

তরীর ভাসা ভাসা চোখে অবলোকন করলো মাহমুদকে। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখছে তাকে। অপলক, স্থির চাহনি। তরী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-“কেন অপেক্ষা করছিলেন?”

-“আমার ভালো থাকার জন্য।”

তরী জবাব দেওয়ার মতো কোন শব্দ খুঁজে পেলোনা। তার শব্দ ভান্ডার ফুরিয়ে এলো। শরীরে বয়ে গেল শীতল স্রোত। তরীর মনে হলো লোকটি এখনো তাকে দেখছে, বেশ মনযোগ দিয়ে দেখছে। তরতর করে তরীর অস্বস্তি বাড়লো। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
-“আমি ঘরে যাচ্ছি।”

তরী ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াতেই মাহমুদ বাদ সাধলো। গলায় তীব্র আকুলতা,
-“আরেকটু থাকুন না, তরী।”

তরী কেন যেন ফেলতে পারলোনা মানুষটির কথা। পা থামিয়ে দিল। আরেকটু সময় কাটলো বারান্দায়। যতবার আড়চোখে লোকটিকে দেখেছে, ততবারই নিজের জন্য মানুষটির চোখে মুগ্ধতা দেখেছে।

★★★

স্কুল ছুটির সময়। রাস্তায় দলবেঁধে নামলো বাচ্চারা। পরনে সাদা ইউনিফর্ম। তাদের মধ্যে রামি আর মিঠু বন্ধুদের সাথে বাসায় ফিরছে। সহপাঠীদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলো,
-“তোমাদের বাড়ি কোথায় রামি?”

রামি দু’আঙ্গুলে নাক উল্টে নাকের ছিদ্রপথ দেখিয়ে বলল,
-“এই জায়গায় আমাদের বাড়ি।”

মিঠু হেসে কুটিকুটি। হাসতে হাসতেই রাস্তায় বসে পড়লো। যে ছেলেটি প্রশ্ন করেছিল সে বোকা বনে গেল।
মিঠু বলল,
-“এরা হলো গরিবের জাত। বাড়িঘর নেই। আমি আবার দয়ালু ব্যক্তি। একবার এসে আমার পা ধরে গড়াগড়ি খেতেই বাড়িতে জায়গা দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন দেখি গরিবের আরেকটি পরিচয় বের হয়েছে। বেটা মীরজাফর। আমার বাসায় থেকেই আমার সাথে ছ*ল*চা*তু*রী করার চেষ্টা করে।”

রামি উত্তেজিত হলোনা। ঠান্ডা মাথায় নিচে বসে পড়লো। রাস্তার মধ্যেই মিঠুর প্যান্ট টে*নে ধরে বলল,
-“ভাই আপনি দয়ার সাগর, জমিদারের বংশধর। আপনার তুলনা হয়না। আপনার নিশ্চয়ই প্যান্টের অভাব হবেনা। হলেও গাছের ছাল, লতা-পাতা দিয়ে ইজ্জত ঢাকার মতো উদার আপনি। আমাকে এই প্যান্টটি দিন ভাই। আমি গরিব মানুষ। কাপড় কেনার টাকা নেই। আপনি প্যান্ট না দিলে বেইজ্জতি হয়ে মা*রা পড়বো আমি।”

মিঠু দুহাতে প্যান্টের কোমর চেপে ধরে রেখেছে। পা নাড়িয়ে রামিকে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
-“প্যান্ট ছাড় রামির বাচ্চা। থা*প*ড়ে তোর গাল লাল করে দেবো।”

★★★

ক্লাসের জন্য তৈরি হয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নামলো তরী। সাথে বাবা আছেন। তিনতলায় নামতেই মাহমুদকে বের হতে দেখলো। তরী তাড়া দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে নেমে গেল। মাহমুদ পেছন পেছন নেমে এলো।
বাবা তরীকে নিয়ে একটি সিএনজিতে উঠলেন। তরীকে বাস স্টপেজ এ নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে যাবেন। মাহমুদ সামনে ড্রাইভারের সাথে চেপে বসলো। তার দৃষ্টি সামনে।
অনেকটা রাস্তা পেরোনোর পর তরীর ধারণা ভ্রান্ত হলো। মাহমুদ রাস্তায় তাকিয়ে নেই। সামনের লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে তাকেই দেখছে। তরী জড়োসড়ো হয়ে বাবার সাথে চেপে বসে রইলো। তিনি ফোনে কথা বলছেন। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। এই বুঝি বাবা দেখে ফেললেন। আবারও আড়চোখে তাকালো তরী। মাহমুদ এখনো শান্ত চোখে তাকেই দেখছে।
তরীর চোখে স্পষ্ট ভীতি। মাহমুদ আর বাড়াবাড়ি করলোনা। তরীকে স্বস্তি দিয়ে সামনে তাকালো। প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো তরী। বাবা তাকে নামিয়ে হাতে কচকচে নোট গুঁজে দিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। তরী বাসে উঠে জানালার বাইরে চোখ রাখলো। বাস ছেড়ে দিতেই দোকানের ছাউনি ছেড়ে বেরিয়ে এলো মাহমুদ। দক্ষিণে পা চালিয়ে কলেজ গেইটে ঢুকে পড়লো।

আকাশে ঘন কালো মেঘ। ভার্সিটি থেকে বের হলো তরী। বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে বাস স্টপেজ এর দিকে কদম ফেললো।

-“তরী।”

পেছন ফিরে ভারি চমকালো তরী। ঘড়িতে সময় চেইক করে নিলো। তিনটা বেজে বিশ মিনিট। লোকটি এদিকে এসেছে কেন? এই সময়ে তো তার বাসায় থাকার কথা।
মাহমুদ দ্রুত পা চালিয়ে তরীর পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো।
-“চলুন।”

তরী আশেপাশে সাবধানী নজর বুলিয়ে নিলো। মাহমুদ শান্ত স্বরে বলল,
-“এটা আপনার এলাকা নয় তরী। কেউ চিনবে না। এত কেন ভয় পাচ্ছেন, বলুন তো?”

তরী রাস্তায় দৃষ্টি রেখে হাঁটলো। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি হঠাৎ এইদিকে?”

মাহমুদ তরীর দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। আবিষ্ট কন্ঠে বলল,
-“গুরুত্বপূর্ণ একজনের সাথে দেখা করার ছিল।”

-“ওহ।”

-“গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি আপনি, তরী।”

তরী চমকালো না। মনে মনে ভেবে রেখেছিল লোকটি এমন কিছুই বলবে। তবে কেমন একটা নতুন অনুভূতির আভাস পেলো। মাথানিচু করে মাহমুদের পাশাপাশি হঁটলো।
তুমুল ঝড়বৃষ্টির দাপটে ভেঙে পড়লো ফুল সমেত কদম ফুলের ডাল। একটি বাচ্চা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুল থেকে ফিরছে। হাতে একগুচ্ছ কদম। তরী মুগ্ধ হয়ে দেখছে ঝরে যাওয়া কদম ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য। মাহমুদ বাচ্চা মেয়েটিকে থামিয়ে একটি কদম ফুল চাইলো। না করলোনা মেয়েটি। মাহমুদের হাতে একটি কদম গুঁজে স্থান ত্যাগ করলো। মাহমুদ যত্ন করে তরীর কানের পাশে কদম গুঁজে দিলো। তরী ঘনঘন পলক ঝাপটালো। মাহমুদ তরীর চোখে চোখ রেখে বলল,
-“এই ফুল আপনার জন্যই সৃষ্টি, তরী। আর তরী নামক ফুলটি আমার জন্য।”

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here