অন্তরালের কথা পর্ব ১৩

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১৩
.
.
এমন সময় নজর গেল ছাদের কর্ণারে। তিহান ছাদের পেছনের সাইডের একেবারে কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যসময় হলে অতল এই বিষয়টি আমলে নিতো না। তবে কাল রাতের পর থেকে তিহানের কোনো বিষয়কেই সে ছোট করে দেখতে পারবে না। অতল নিজের মনের বিষন্নতাকে কিছুটা সময়ের জন্য ভুলে ছুটে গেল তিহানের কাছে। ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখতে পেল ছাদের কর্ণারে কদমফুল গাছের যে ডালটি নিচু হয়েছিল সেই ডাল থেকে একটি কদমফুল ছিঁড়ে হাতের মুঠির মাঝে নিয়ে ছাদের কার্নিশে বসে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে আর চোখের জল ফেলছে। অতল ধীর পায়ে ছাদের কর্ণারে গিয়ে তিহানের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” কিছু কিছু স্মৃতি রয়েছে যা মানুষকে বড্ড কষ্ট দেয়। সেসব স্মৃতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মনে না করাই শ্রেয়। ”
হঠাৎ বড় ভাই অতলের কন্ঠ শুনে তিহান চমকে উঠল! চোখের জল দ্রুত মুছে বলল,
” ভাইয়া তুমি? হঠাৎ এখানে এলে যে? ”
” বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। তখনি দেখলাম তুই ছাদে। তাই আড্ডা দিতে চলে এলাম। ”
” ওহ্। ”
” হুম, কেন খুশি হোসনি বুঝি? ”
” কি যে বলো না। হা হা.. ”
” হাসি যখন মন খুলে আসছে না তাহলে কেন মিথ্যে হাসি দেয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিস? না-ই বা হাসলি তা’তে তো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে না। ”
ভাইয়ের কথা শুনে তিহান চুপ হয়ে গেল। কোনো কথা মুখ থেকে বের করতে পারছে না। অতল ব্যাপারটি বুঝতে পেরে বলল,
” কি হয়েছে তোর? আমায় অন্তত খুলে বল নাকি আমাকেও বলা যাবে না! ”
” আসলে ভাইয়া তোমরা যেরকম ভাবছ সেরকম কিছুই হয়নি। ”
” কালকে রাতে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার পরেও বলবি যে কিছু হয়নি? ”
” দেখো ভাইয়া, আমরা সকলেই জানি কিছু কিছু প্রশ্ন আছে যার কোনো উত্তর হয় না। তেমনি কিছু কিছু ঘটনাও আছে যার কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। তো প্লিজ ভাইয়া আজকের পর থেকে কালকে রাতের বিষয় নিয়ে আমাকে কোনো প্রশ্ন করো না। সেই সাথে বাবা-মা’কেও নিষেধ করে দিও। নয়তো এই বাড়িতে যে ক’দিন-ই আছি সে’কদিন থাকাটাও দায় হয়ে পড়বে। ”
” আচ্ছা বেশ, আমরা কেউ তোকে এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা বলব না। কিন্তু একটি কথা আজ শেষবারের মতো বলব, যেকোনো সিচুয়েশনের সম্মুখে দাঁড়াবার সাহসটা অন্তত আমাদের রাখতে হয় । তা নাহলে নিজের জীবন তো শেষ হবেই, সেই সাথে দুর্বিষহ হয়ে উঠবে আমাদের অতি কাছের আপনজনদের জীবন। ”
” হুম। ”
” খেয়েছিস কিছু? ”
তিহান মাথা নেড়ে না করল। অতল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমিও কিছু খাইনি। চল তাহলে একসাথেই খেতে যাই। ”
” আমি এখন খাবো না ভাইয়া তুমি গিয়ে খেয়ে নাও। ”
” হসপিটালে কি বলেছিলি মনে আছে? ”
তিহান আর কথা বাড়ালো না। কদমফুলটি ছাদের কার্নিশে রেখে উঠে দাঁড়ালো। আর বলল,
” চলো ভাইয়া। ”
অতল মুচকি হেসে ছোট ভাই তিহানের কাঁধে হাত রেখে সামনে এগুতে লাগল।
.
তানহাকে রান্নাঘরে ডুকতে দেখে বুয়া বলল,
” খালা চইলা আইলেন যে? আফার ঘরে যান নাই? ”
” হুম গিয়েছিলাম কিন্তু দরজা আজানো ছিল তাই চলে এলাম। ”
” আল্লাহ দরজা লাগানো তো কি হইসে আপনে ডাক দিতেন তাইলেই হইতো।”
” না থাক সমস্যা নেই। এমন কোনো জরুরী বিষয় না যে,এখনি কথা বলতে হবে। পরে সময় করে বললেও হবে। এখন দেখি কী কী রান্নার জন্য নিয়েছেন। বাব্বাহ! এখানে তো দেখছি অনেক কিছু!”
” আপনে না কইলেন সবার পছন্দনুযায়ী রানবেন? ”
” হুম, তো কার কি পছন্দ শুনি? দেখি চেষ্টা করে পারি কি-না। ”
বুয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,
“চিন্তা কইরেন না। আস্তে আস্তে সব হইয়া যাইব। এখন শুনেন কে কি খাইতে ভালোবাসে। আপনের শ্বশুড়ের চিংড়ি মাছের মালাইকারি ভীষণ পছন্দ। আপনের শাশুড়ির লতি দিয়া চিংড়ি মাছ দিয়া পছন্দ। আপনের দেবরের… ”
তানহা হুট করে বুয়ার কথার মাঝে বলে উঠল,
” গরুর গোস্ত বেশ ঝাল দিয়ে ভুনা খুব পছন্দ। ”
বুয়া হা হয়ে গেল তানহার কথা শুনে! ভ্রু দুটো সামান্য পরিমাণ কুচকে বলল,
” খালা আপনে জানলেন কেমনে তিহান বাবার কি পছন্দ? না মানে আপনে তো কালকেই এ বাড়িতে আইলেন! তো আজকেই কি কইরা…. ”
বুয়ার প্রশ্ন শুনে তানহা থতমত খেয়ে যায়। বুয়ার সামনে থেকে সরে আমতা আমতা করে বলল,
” না মানে হয়েছে কি… আপনি যে সবার পছন্দ অপছন্দের কথা বলছিলেন তাই আমার মুখ দিয়ে আমার নিজের পছন্দের খাবারের কথাও বের হয়ে যায়।কিন্তু আমি কারো পছন্দের কথা জানি না। ”
” ওহ্! আর আমি আরও ভাবছি…! ”
” সে কথা বাদ দিন। এখন বলুন আর কার কি কি পছন্দ। ? ”
” হো হো কইতাছি। আপনের শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর তিনজনের টাই তো শুনছেন। এখন বাকি শুধু অতল বাবা। আর তার পছন্দ হইতাছে ছোট মাছের চচ্চড়ি। এই তরকারি পাইলে অতল বাবা আর কোনো তরকারির দিকে ফিরাও তাকায় না। ”
“ও,তাহলে তো দেখা যায় এসবকিছুই আমি পারি। আর কোনো ঝামেলাই রইলো না। ”
” ঝামেলা রইলো না মানে, আপনে রানবেন নাকি? ”
” হুম, তাহলে আর কে করবে? ”
” নতুন বউ হইয়া রান্না করবেন? এডা কেমন কথা? ”
” এটা তেমন কোনো কথাই না। আজকে থেকে আমিই রান্না করবো। আর মূলত আমি রান্না করতে বেশ পছন্দও করি। এখন দেখি সাইড দিন তো…. আচ্ছা আমি যদি আপনাকে খালা বলে ডাকি কোনো সমস্যা হবে? ”
” কি সমস্যা হইব? আপনার যা খুশি কইতে পারেন। এতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ”
তানহা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
” আচ্ছা, তো খালা আপনি কি ফ্রিজ থেকে ছোট মাছ, চিংড়ি মাছ আর গোস্ত নামিয়েছেন? ”
” হো অনেক আগেই। সাথে পিয়াজ, লতি সব কাইটা রাখছি। ”
“কখন করলেন এসব?আপনার সাথে আমার কথাই তো হলো একটু আগে। তাহলে আরও আগে বের করেন কীভাবে?”
“আসলে আমি তো জানতাম আজকে থেইকা আপা আপনেরে রান্নাঘরের দায়ভার দিব। আর আপনেও যে শ্বশুর বাড়ির প্রথম রান্না সবার পছন্দ অনুযায়ী করবেন তাও আন্দাজ করছিলাম। তাই আগেভাগে সব রেডি কইরা রাখছি।”
” বেশ তাহলে আজ আর আপনার কোনো কাজ নেই। বাকিটুকু আমি নিজেই করে নিতে পারবো। ”
” ও মা! কি কইতাছেন আপনে? ”
এমন সময় অস্থির হয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করল তানহার শাশুড়ি মরিয়ম বেগম। উত্তেজিত গলায় বললেন,
” তোমরা কি কেউ তিহানকে দেখেছ? ”
শাশুড়ির মুখে কথাটি শোনা মাত্র তানহার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। আর ভাবল,
” তাকে শাড়ি পড়া ভেজা চুল অবস্থায় দেখে তিহান আবার কিছু করে বসেনি তো! ”
ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো শাশুড়ি মায়ের কান্না জড়িত কন্ঠস্বর শুনে। কান্না করতে করতে বলল,
” তিহানকে ঘরে, বাথরুমে, বারান্দায় সব জায়গায় খুঁজেছি কিন্তু কোত্থাও খুঁজে পেলাম না। ছেলেটা আমার আবার কোথায় গেল? ”
তানহা কাঁপা গলায় শাশুড়ি মা’কে বুঝানোর জন্য যেই এগিয়ে গেলো ঠিক তখনি রান্নাঘরে এলো অতল ও তিহান। অতল মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কি হয়েছে মা? তুমি এভাবে কাঁদছ কেন? ”
” তিহান যে ঘরে নেই….”
অতলকে কথাটুকু বলতে বলতে পেছনে ফিরে তাকালো মরিয়ম বেগম। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখে অতলের সাথে তিহান দাঁড়িয়ে। তিহানের কাছে গিয়ে তিহানের দুগালে হাত রেখে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
” কোথায় চলে গিয়েছিলি বাবা? মা যে চিন্তা করবে তুই জানিস না? তুই জানিস আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ”
” কোথায় যাবো আমি? এ বাড়ি ছাড়া কি আমার কোনো জায়গা আছে যাওয়ার নেই তো। তাই ছাদে গিয়েছিলাম কদমফুলের গন্ধ নেবার জন্য। ”
” আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম কালকে রাতের কথা ভেবে। বাবা রে তুই আমাদের ফেলে কোত্থাও যাস না। আমাদের যে তোরা ছাড়া কেউ নেই। তোরাই যে আমাদের গোটা পৃথিবী। ”
মায়ের কথায় তিহান কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছে যেটা অন্য কেউ ধরতে না পারলেও অতল ধরে ফেলেছে। তাই অতল কথা ঘুরাবার জন্য বলল,
” মা এসব কথা পড়ে বললে হয় না, ক’টা বাজে খেয়াল করেছ? দুপুর ১১:৩০ বেজে গিয়েছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমাদের দু’ভাইয়ের পেটে খাবার যায়নি। ক্ষিদে পেট চোঁচোঁ করছে। ”
” দেখেছিস আমিতো ভুলেই গিয়েছি আয় আয় খেতে বস। আমি এক্ষুনি তোদের খেতে দিচ্ছি। ”
” হুম দাও। তাড়াতাড়ি দাও। ক্ষিদের যন্ত্রণায় পেট ব্যাথা করছে আমার। এই তিহান চল খেতে চল। ”
অতল যেতে যেতে কথাগুলো বলছিল। তিহানও ফিরিয়ে কোনো কথা বলল না কেবল অতলের পিছু পিছু যেতে লাগল। এমনকি একটিবারের জন্য চোখ উঠিয়ে তাকালো না তানহার দিকে। তানহার দিকে তাকালেই যে তার বুক ফেটে চোখ দিয়ে স্রোতের বন্যা বয়ে যাবে। যা তিহান এই মুহূর্তে হতে দিতে পারে না, তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে গেল।
অন্যদিকে তিহান চোখের জল না ফেললেও টুপটুপ করে চোখের ফেলছে তানহা। তবে সেই চোখের জল মুছে নিজের দূর্বলতা আড়াল করে ফেলল সবার অগোচরে। আর মনোনিবেশ দিল রান্নার কাজে।
.
তিহান খেতে বসে কেবলই মুখের সামনে লোকমা টা ধরেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে হলো তানহার কথা। তানহা খেয়েছে তো?
গলা দিয়ে ভাত নামছে না তিহানের। কি করবে সে? একবার কি জিজ্ঞেস করবে নাকি করবে না। এসব ভাবার মাঝেই অতলের দিকে তাকিয়ে তিহান বলে উঠল,
” এতটাই কি পর হয়ে গেলাম ভাইয়া যে, বিয়ের কথা আমায় বলা গেল না? ”
” ভুল বুঝছিস তিহান। তোকে অনেকবার ফোন করা হয়েছে। এমনকি কবুল বলার আগ মুহূর্তেও তোকে ফোন দিয়েছি কিন্তু তুই ধরিসনি। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমার যে গতকাল রাতে বিয়ে হবে সেইকথা আমি গতকাল সকালেও জানতাম না। ঠিক বিকেলে সবকিছু ঠিক হয় কারণ তানহার বাবা হঠাৎ করেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে যায়। তাই সকাল বেলা যে বিয়ে ৯ দিন পরে হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সেই বিয়ে কালই হওয়ার জন্য তারা ভীষণ ভাবে অনুরোধ করেছে। তাই আমরা কেউ ফেলতে পারিনি কিন্তু তোর সাথে যোগাযোগ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। ”
” হুম বুঝলাম। ”
” তোর ভাবিকে দেখেছিস? ”
” কিভাবে দেখব? তুমি কি পরিচয় করিয়ে দিয়েছ? ”
” কথায় পয়েন্ট আছে। দাঁড়া তোর ভাবিকে ডাক দেই। তানহা! তানহা! একটু এদিকে আসতো। ”
তানহা রান্নাঘরে কাজ করছিল। এরমাঝে অতলের ডাক পড়ায় তানহার বুকটা ধক করে উঠল। কারণ অতল যে খাবার রুমে একা নয়, অতলের সাথে রয়েছে তিহান। তবুও তাকে যেতে হবে। নাহলে যে একশ একটি প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে।
তাই গুটিগুটি পায়ে এগুলো তানহা খাবার রুমের দিকে।
ডাইনিং রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তানহা অতলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ডেকেছিলেন আমায়? ”
অতল ভাতের লোকমা মুখে দিতে দিতে তানহার দিকে তাকিয়ে বলল
” দরজায় দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো।”
তানহা ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। অতলের ঠিক ডানপাশে দাঁড়িয়ে নিচুস্বরে বলল,
” কিছু বলবেন? ”
” উহুম কিছু বলব না তবে পরিচয় করিয়ে দিব। ”
” ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনার কথা!”
” আসলে হয়েছে কি বিয়েতে তো তিহান মানে আমার ছোট ভাই উপস্থিত ছিল না তাই তোমার সাথে পরিচয় হয়নি। সেজন্য তোমাকে ডেকে আনলাম পরিচিতি পর্বটি শেষ করার জন্য। তিহানের একমাত্র ভাবী বলে কথা পরিচয় না করালে কি চলে? হা হা… ”
অতলের হাসির সাথে তিহান ও তানহা দুজনেই মুচকি হাসল। কিন্তু, এ হাসিতে না আছে প্রাণ আর না আছে উপভোগ। এ হাসিতে শুধুই রয়েছে এক লোক দেখানো রহস্য।
তিহানকে মাথা নিচু করে হাত দিয়ে ভাত নাড়তে দেখে অতল বলল,
” কি ব্যাপার তিহান? সেই কখন থেকে দেখছি ভাত নেড়েই যাচ্ছিস কিন্তু মুখে তো দিচ্ছিস না, কোনো সমস্যা? ”
” না না, কী সমস্যা হবে! এমনিতেই নাড়ছিলাম তবে এখনি খাবো। ”
” ওকে খাওয়া শুরু কর। ”
.
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here