অন্তহীন পর্ব -০৪

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৪
#স্নিগ্ধা_আফরিন

“নতুন বউ কালো রঙের শাড়ি পরে শ্বশুর বাড়িতে যাবে?”চৈতি কে দেখে কথাটা বলে উঠলেন প্রহনের বড় মামি।লাল পেড় কালো শাড়ি পরিহিত কিশোরী চৈতি কে দেখে কিছুক্ষনের জন্য হৃদয়ের স্পন্দন থমকে গিয়েছিল প্রহনের।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চৈতির দিক থেকে চোখ ফেরালো ।বা হাত দিয়ে মাথার চুল এলোমেলো করতে করতে সোফায় বসে পড়লো।

জুনাইদা চৈতির ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,”রুমে চল। বিয়ের শাড়ি টা পড়িয়ে দিই।”
মায়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো চৈতি।
জুনাইদা চৈতির হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে চলে গেলেন।রুপা সাথে যেতে চাইলে বারন করে দেন তিনি। মেয়ের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে।যা সবার সামনে বলা যাবে না। আসলে মা মেয়ের অনেক কথাই সকলের সামনে বলা যায় না। থাক না মা মেয়ের মাঝে কিছু ব্যাক্তি গত কথা বার্তা। সবার সব কিছু জানতে হবে কেন?

চৈতির রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ের শাড়িটা খুঁজতে শুরু করলেন জুনাইদা। আলমারি খুলতেই পেয়ে গেলেন শাড়িটা।রুপা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে।

শাড়িটা নিয়ে এসে বিছানার উপর রাখলেন জুনাইদা। চৈতি বিছানার এক কোণে মন খারাপ করে বসে আছে।মা কিছু বলার আগেই চৈতি মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে যেতেই কি হবে আম্মু?”

জুনাইদা মেয়ের পাশে এসে বসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“এটা তো নিয়ম মা।”বিয়ের পর মেয়েদের বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে চলে যেতে হয়।”

“এমন নিয়ম শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই কেন?”

“তোকে আমি কী করে এইসব বুঝাই বল তো? আচ্ছা বাদ দে এই সব। আমি কী বলি শোন,
একটা মেয়ের যখন বিয়ে হয়ে যায় তখন তার দুটো পরিবার হয়।একটা তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে নিয়ে আরেক টা বাবার বাড়ির লোকজন কে নিয়ে।”

জুনাইদার এই সব কথায় কিছু টা বিরক্ত হলো চৈতি।কথা গুলো শুনতে ভালো লাগছে না তার।
মেয়ের মুখের ভাব ভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলেন জুনাইদা।কথা ঘুরানোর জন্য বলে উঠলেন,
“আমার চঞ্চল হরিণীর নেয় কন্যা আপনি আজ এত শান্ত হয়ে গেছেন কেন বলুন তো?”

মায়ের কথা বলার ধরন দেখে হেসে ফেললো চৈতি। গতকাল থেকে মেয়েকে হাসতে দেখেননি জুনাইদা। মেয়ের মুখের হাসি দেখে প্রানটা যেনো জুড়িয়ে গেল এক নিমেষে। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললেন,
“এই ভাবেই হাসি খুশি থাকবি সব সময়। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি বলে এই নয় যে পর করে ফেলেছি। তোর জন্য ভালোবাসা টা আমাদের কখনো কমবে না মা।”

মায়ের কথা শুনে মলিন হেসে চৈতি বললো,
“তাহলে এত জলদি বিয়ে দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলে কেন?”

জুনাইদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা অনেক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন করে ফেলছে তাকে। মেয়ের এত প্রশ্নের উত্তর কী করে দিবেন তিনি?
“তোর জীবনটা সুন্দর করতে হবে মা। এখান থেকে রিফাতের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে হবে তোকে। ছেলেটা যে অনেক খারাপ।একটা পরিচয় লাগতো তোর।”

“কিসের পরিচয়? আমি তোমাদের মেয়ে। সরদার পরিবারের একমাত্র ছোট মেয়ে চৈতি সরদার।এটা কী আমার পরিচয় না?”

“চুপ কর চৈতি।আর একটা ও কথা না।আমরা যা করেছি সব তোর ভালোর জন্য করেছি। এখন না হলেও এক দিন না এক দিন ঠিক বুঝবি। মিলিয়ে নিস তখন।”

চৈতি চুপ হয়ে গেল।আর একটাও কথা বাড়ালো না।যা হচ্ছে হোক। আটকানোর ক্ষমতা নেই তার।
জুনাইদা চৈতিকে লাল শাড়িতে সাজিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
.
“কী রে ভাই, ফার্স্ট নাইট কেমন কাটলো বল।”
ইফতির কথা শুনে মাথা তুলে ইফতির দিকে তাকালো প্রহন।
“দেখ ভাই,মন মেজাজ এখন কোনোটাই ভালো নেই।উল্টা পাল্টা কথা বলে রাগাবি না আমাকে।”

“তবে যাই বলিস না কেন, তোর কিশোরী বউটা কিন্তু অনেক জোস। আমি যদি তোর জায়গায় থাকতাম বিয়ে করতে পেরেও এত জেদ করে বসে থাকতাম না।”

ইফতির বলা কথাটা কর্ণ কুহরে যেতেই রাগে শরীর গিজগিজ করে উঠলো প্রহনের।ইফতিকে ঠাঁটিয়ে কয়েক টা চড় মারতে পারলে শান্তি লাগতো।
নিজেকে সামলিয়ে বসা থেকে উঠে বেরিয়ে গেল প্রহন।
.
মেয়ের বিদায়ের সময় সরদার সাহেব চৈতির হাত প্রহনের হাতে তুলে দিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে বলেছিলেন,
“ছোট থেকে খুব বেশি আদরেই বড় করেছি আমার কলিজার টুকরা মেয়েকে। আমার সেই যত্ন করে বড় করা সোনার টুকরা কে তোমার হাতে তুলে দিলাম সারা জীবনের জন্য। আমার মেয়েকে সুখে রেখো।”

প্রতি উত্তরে কী বলা উচিত?তা মাথায় আসছে না প্রহনের। শুধু মনের ভেতর প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,
“এতই যদি আদরের মেয়ে হয় তাহলে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিলো কেন?”
মনের কথা মনেই থেকে গেল। মুখ ফুটে আর বেড়িয়ে আসতে দেয়নি প্রহন। কিছু প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে।তখনই হঠাৎ মনে পড়লো,
“বেশি সুন্দরী দেখে কী এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলো?”
আবার মনে হলো,”না।এর চেয়ে ও কত সুন্দরী আছে।হয় তো অন্য কোনো কারণ।”
ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি ঘাটা ঘাটি করলো না প্রহন।

সরদার বাড়ির সবাই যখন চৈতি কে বিদায় দিতে ব্যস্ত তখন চৈতি অবাক হয়ে শুধু দেখছে সবাইকে। খারাপ লাগছে খুব।এই প্রথম নিজের চোখে বাবাকে কান্না করতে দেখলো চৈতি।
সবার চোখেই আজ শ্রাবণের ধারা।অথচ জৈষ্ঠ্যের রোদের মতো ঝলমল করা মেয়েটার চোখেও যে আজ শ্রাবণের ধারা নামার জন্য বেকুল হয়ে ছটফট করছে, সে খবর কে রাখে?কেউ না।
প্রিয় জন কে ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্ত গুলো ভীষণ বিষাদে ঘেরা থাকে। ছোট থেকে যাদের সাথে পথ চলা শুরু হঠাৎ করেই মাঝ পথে নতুন অতিথির সাথে জীবনের পথ চলতে হয়।কী অদ্ভুত নিয়ম।

প্রচন্ড কান্না পাওয়ার পর ও চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে দেয়নি চৈতি। বুকের ভেতর ঝড়ের সাথে নিজেই মোকাবেলা করে গেছে। তীব্র ভালোবাসা যেমন কাছে টানে, ঠিক তেমনি তীব্র অভিমান অনেক দূরে নিয়ে যায়।বাবা মায়ের প্রতি সেই অভিমান টাই জন্মে গেছে চৈতির মনে। মেয়েটা যে বড্ড অভিমানী।
.
সন্ধ্যা হলো।ঘরে ঘরে সাজঁক বাতি জ্বলে উঠলো।।একটু পরেই মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসবে নামাজের আহবানের সুর। মিনিট বিশেক আগেই বাড়ি এসে পৌঁছায় প্রহনরা।
প্রহনের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো চৈতি কে। মেয়েটা ক্লান্ত। নতুন জায়গা নতুন পরিবেশে কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছে চৈতির।সব অপরিচিত মুখ। পরিচিত বলতে শুধু রেদোয়ান চৌধুরী আর মিসেস ইয়াসমিন।এনাদের কে আরো কয়েক বার দেখেছে চৈতি।
প্রহনের বড় মামি আর কাজিনরা মিলে চৈতি কে যে ভাবে বসিয়ে দিয়ে গেছে সেই একই অবস্থায় থ মেরে বসে আছে সে। বাড়িতে হলে এতক্ষণে তিন চার বার সারা বাড়ি চক্কর দেওয়া হয়ে যেতো। চৈতির বেশ জল তেষ্টা পেয়েছে।প্রহনের রুমের কোথাও পানির জগ দেখলো না সে।
“এত বড় রুমে একটা পানির জগ বা বোতল নেই ধুর।”

রুমে কারো প্রবেশের শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকালো চৈতি। প্রহন এসেছে। বিছানার উপর বসে থাকা চৈতির দিকে এক পলক তাকিয়ে কাভার্ড থেকে ট্রাউজার আর গেঞ্জি নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেল।
এখন পর্যন্ত চৈতির গলার স্বর শুনতে পায়নি প্রহন।শুনতে পাবেই বা কী করে? চৈতি যে তার সামনে এখনো টু শব্দটি ও করেনি।

গোসল করে গা মোছার জন্য তোয়ালে নিতে ভুলে গেছে প্রহন।ওয়াস রুমের দরজা কিছুটা ফাঁক করে বিছানায় বসে থাকা চৈতির উদ্দেশ্য তার প্রথম কথা ছিলো,
“বেলকনিতে আমার তোয়াললেটা আছে।একটু এনে দিবা পিচ্চি?”

প্রহনের দিকে তাকালো চৈতি। অর্ধেক মাথা বের করে আছে। চুল থেকে টুপ টুপ করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। চৈতি বিছানা থেকে নেমে বেলকনি থেকে তোয়ালে টা এনে প্রহনের হাতে দিতেই তার হাতের সাথে স্পর্শ করে। মৃদু কেঁপে উঠলো চৈতি।
প্রহন ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজার কাছ থেকে সরে আসতে আসতে চৈতি ভাবলো,
এত ভীষণ অপরিচিত পুরুষ মানুষটির সাথে কী করে কাটাবে সে?ভাবতেই অস্থির অস্থির লাগছে মনে।
“উনি যে আমার ভীষণ অপরিচিত কেউ একজন।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here