অন্যরকম ভালোবাসা, পর্ব:২

#অন্যরকম_ভালোবাসা

#আফসানানীতু

#পর্ব_২

সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল অন্তরার। অবশ্য এটাকে ডাকাডাকি না বলে চেঁচামেচি বলাই উত্তম। অন্তরার ধারণা ওর মা কীভাবে আস্তে কথা বলতে হয় সেটা জানেই না, তাই সবার যেখানে ঘুম ভাঙ্গে পাখির কলকাকলিতে ওর সেখানে ঘুম ভাঙ্গে মায়ের চেঁচামেচিতে।

-কিরে,এখনো শুয়ে আছিস ? সাতটা তো প্রায় বাজে, ওঠ।

অন্তরা আড়মোড়া ভেঙ্গে অলস ভঙ্গিতে বললো,
– আজকে কলেজ যাবনা আম্মা,ভাল লাগতেসে না।

অন্তরার মা সাবিনা জাহান মেয়ের মুখের দিকে বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলেন,
-শোন, সকাল সকাল প্রতিদিন তোর এই এক কেচ্ছা আমার আর ভাল লাগে না বুঝলি ? প্রীতি ফোন দিছিল, বলসে তুই যেনো অবশ্যই কলেজে ওর নোট খাতাটা সঙ্গে নিয়ে যাস। নেক্সট সানডে নাকি ওই বিষয়ে তোদের ক্লাস টেস্ট?

– হু…. !

অন্তরাকে ছোট্ট করে উত্তর দিতে দেখে সাবিনা জিজ্ঞেস করেন,
– তোর হইসেটা কি বলবি? কয়দিন ধরেই দেখতেসি মুখটা প্যাঁচা করে ঘুরতেসিস?

-কিছু হয় নাই। প্রীতু কি তোমার মোবাইলেও কল দিছিলো?
অন্তরা নিজের মোবাইল হাতে নিয়ে জানতে চায়।

– না দিয়ে কি করবে ?তোরে নাকি আগে কল দিসিলো অনেকবার, তুই ধরিস না তাই আমাকে দিসে।

অন্তরা মোবাইলের কল লিস্ট চেক দিয়ে দেখে নয়টা মিসকল। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ও বিছানা ছাড়ে। সকালের ঘুমটা ওর খুব প্রিয় , কিন্তু কলেজের জন্য শান্তি করে ঘুমাতে পারে না একদিনও। কাল কলেজ ছুটির সময় ও প্রীতিকে কত করে বলল নোটটা যাবার আগে যেনো ওর ব্যাগ থেকে বের করে নেয়। বেকুবটা যে নোটটা নেয়নি বাসায় এসেও সেটা দেখেনি অন্তরা। আর এখন জানতে পেরে ইচ্ছে করছে ওর মাথায় শক্ত করে দুটো গাট্টা মারে।

ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা সেরে বাবার সাথে বের হল অন্তরা। সকালে ক্লাস থাকলে বাবা ওকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যান।

কলেজে মোটেই ভালো লাগছে না অন্তরার। ফাইনাল পরীক্ষার আর বেশিদিন নেই , অথচ এত্ত এত্ত পড়া বাকী এখনো। এদিকে শত চেষ্টা করেও সে পড়ায় মন বসাতে পারছে না।সেদিন ওই হতচ্ছাড়াকে বকা দেবার পর থেকেই ওর এই অবস্থা! পড়ায় মন বসে না, আড্ডা দিতে, টিভি দেখতে ভালো লাগে না…. কি এক ভাল্লাগেনা টাইপ অসুখে যে ওকে ধরলো!

তিনমাস আগের কথা….

এক বান্ধবীর জন্মদিনের গিফট কেনার জন্য কলেজের পাশের ওয়ান নাইণ্টি নাইন শপে ঢুকেছিল অন্তরা। অনেক বেছে সুন্দর একটা কার্ড পছন্দ করে কাউন্টারে দিতেই পিছন থেকে কে যেনো বলে উঠলো ,
– আমাকেও এমন একটা কার্ড দেবেন জামান ভাই।

– ভাই,এইটা এই একটাই আছে।

দোকানী কার সাথে কথা বলছে দেখার জন্য অন্তরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে শ্যাম বর্ণের বেশ লম্বা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে।

ছেলেটা দোকানীকে উদ্দেশ্য করে বলল ,
– ধ্যাত্তরি কি! এমনেই আমি এগুলা পারিনা তারমধ্যে আপনি খালি আমারে আজাইরা প্যাঁচে ফালান জামান ভাই, খুব খারাপ!

ছেলেটার বেজার মুখ দেখে মায়া হয় অন্তরার। সে তাই শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে বলে,
– আচ্ছা ঠিক আছে …আপনি না হয় নিন এটা, আমি আর একটা দেখছি।

-আরে না নাহ্! আপনি রাখেন এটা, আমি দেখছি কি করা যায়।

বলেই ছেলেটা দুরদার করে দোকান থেকে বের হয়ে যায়।

পরদিন ক্লাস শেষে ছুটির পরে কলেজ থেকে বের হতেই অন্তরা সেই ছেলেটাকে চায়ের দোকানে বসে থাকতে দেখে। চোখাচোখি হতেই একটু হাসে অন্তরা, শুধুই ভদ্রতার হাসি ছিল সেটা। কিন্তু ওই হাসিই ওর কাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম ভাবতো, হয়তো ছেলেটা এদিকেই থাকে তাই এভাবে প্রতিদিন হুটহাট দেখা হয়ে যায় ওর সাথে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সে বুঝতে পারে ঘটনা তো ভিন্ন! ছেলেটা তো আসলে ওকে ফলো করছে!

গেলো তিনমাসে প্রতিদিন ছেলেটা কলেজ ছুটির পরে তার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে। এই তিনমাসে ছেলেটার অনেক সাহায্যকারী চামচাও জুটেছে যারা অন্তরা যখনই কলেজ থেকে বের হয় তখনই ওকে ডেকে আনে। এই চামচা শ্রেণীর সম্বোধন থেকেই অন্তরা জানতে পেরেছে ওর নাম স্পন্দন। ওকে দেখলেই স্পন্দন তার ঝকঝকে বত্রিশ পাটি দাঁত বিকশিত করে একটা পিত্তি জ্বলানি হাসি হাসে। তারপর ও রিকশা না নেয়া পর্যন্ত ছায়ার মতো ওর পিছে পিছে হাঁটে, ও ঘুরে তাকালেই মাথা নীচু করে মিটমিটিয়ে হাসে….ব্যস, এই পর্যন্তই তার দৌড়। বিগত তিন মাসে এর বেশী ঘটনা আর আগায়নি এক কদমও।

ধীরে ধীরে অন্তরার বন্ধু মহলের সবার জানা হয়ে গেছে যে স্পন্দন ওকে ফলো করে, কলেজে এই নিয়ে বেশ হাসাহাসিও করে সবাই। কিন্তু ওই বান্দার কার্যক্রমে এর বেশী আর কোনো অগ্রগতি নেই। বাপুরাম সাপুড়ের নিরীহ সাপের মতোই সে কোনরকম ফোসফাস কিংবা ঢুসঢাস ছাড়াই ওর আগে পিছে ঘুরে ফেরে। তাই অন্তরাও স্পন্দনকে কিছু বলতে পারে না আগ বাড়িয়ে।

অবশেষে সেদিন যখন স্পন্দন ফরিদকে দিয়ে চিঠি পাঠালো সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি অন্তরা। চিঠিতে কি লেখা ছিল সেটা একবার খুলে পড়েও দেখেনি সে। দীর্ঘদিনের চাপা রাগটা হঠাত্‍ কেমন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল।
স্পন্দনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাগজটা ছুঁড়ে দিয়েছিল ওর মুখের উপর, বলেছিল…
– আপনার সাহস তো কম না! হাতে হাতে চিঠি পাঠান কোন সাহসে!!? আর প্রতিদিন পিছে পিছে আসেন কেনো অযথাই? আর একদিন যদি আমার আশেপাশেও আপনারে দেখসি তবে সোজা ইভটিজিং এর কেসে শ্বশুরবাড়ি চালান দিয়ে দিব। চেনেন আমাকে?

স্পন্দন উত্তরে কিছুই বলেনি শুধু মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল…

সেদিনের পর থেকে স্পন্দনকে আর দেখতে পায়নি অন্তরা।প্রতিদিন কলেজ থেকে বের হয়েই ও আশেপাশে তাকায়, আতিপাতি করে খোজে ছেলেটাকে। কিন্তু কোথাও নেই হাঁদাটা! অন্তরার ভীষণ অভিমান হয়…আচ্ছা, রাগ করে না হয় দুইটা ভাল মন্দ বলেই ফেলেছে সে, না হয় একটু চেচিয়েই বলেছে! কিন্তু তাই বলে কিছু না বলে এভাবে হাওয়া হতে হবে!!

প্রীতির ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ে অন্তরার।
– কিরে,তোর হইসে কী? মুনি ঋষিদের মতো খালি বসে বসে ধ্যান করিস!

– প্রীতু! তোরে না কতদিন বলসি যে আকাশ ভেঙ্গে তোর মাথায় পড়লেও তুই আম্মারে কল দিবিনা, তাও তোর সেইটাই করা লাগে। তুই এত বিরক্ত করিস না মাঝে মাঝে!
অন্তরা প্রীতির প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে যায়।

প্রীতি বেজার মুখে বলে,
– তো হইসে কি? একটা কলই তো দিসি! শোন অন্তু, তুই না সবকিছু নিয়া একটু বেশী রকমের বাড়াবাড়ি করিস। আন্টি হইলো মায়ের মতো, তারে ফোন দিলে সমস্যা কি শুনি?

– বাংলা সিনেমার ডায়লগ ঝাড়বি না তো! আন্টি তোর মায়ের মতো… আল্লাদ করার জায়গা পাস না?

– আচ্ছা বাদ দে, যা…. তোর মা তোরেই মোবারক!
প্রীতি হঠাত্‍ প্রসঙ্গ পাল্টে উত্সুক কণ্ঠে বলে,
– শোন না,অন্তু! স্পন্দন নামের ওই পোলাটা আছে না, ও নাকি সেদিন তোর ক্যালানী খাবার পর থেকে লাপাত্তা?

জবাবে অন্তরা চুপ করে থাকে। কিন্তু প্রীতি থামে না, গদগদ কণ্ঠে বলে চলে…
– ওয়াও! মেরে শের, মেরে ডাকু মর্জিনা…লাভ ইউ! কত সহজে তুই তোর তিনমাসের দাঁত ব্যাথারে এক ঝটকায় সমূলে উত্পাটন করলি !!!! প্রাউড অফ ইউ দোস্ত ।

এদিকে অন্তরার অভিমানটা প্রীতির কথায় যেনো আরো বাড়লো! বুকের ভেতরে কেমন অজানা একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে অন্তরা ।

– প্রীতু প্লীজ! সবসময় ফাইজলামি ভাল্লাগে না , বুঝলি? আর এতো জায়গা থাকতে কোলের উপর উঠে বসতেসিস কেন তুই? দূরে সর…দূরে যাইয়া মর, যাহ্।

অন্তরার অকারণ রুঢ় আচরণে প্রীতি মুখটা বেজার করে ফেলে। – দোস্ত, শুধু শুধু চেতিস কেন, ঝামেলা কী হইসে বলবি তো!
তবে এটুকুই! আসলে অন্তরার ঠ্যাঙ্গানিতে প্রীতির তেমন কিছু একটা যায় আসে না, অন্তরার এমন বহু কড়া কড়া বকা সে এক তুড়িতে হজম করে ফেলে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। দশ সেকেন্ড পাড় হবার আগেই সে পুনরায় দ্বিগুন উত্সাহে শুরু করে,

– শোন না , দোস্ত! তোর ক্যালানীর গল্প তো এখন কলেজের সবার মুখে মুখে। তুই তো এই চান্সে নারীজাগরণের অগ্রদূত টাইপ বিরাট হিট হয়ে গেসিস কলেজে! একদম ঠিক হইসে! বুদ্ধি থাকলে আর ভুলেও তোর সামনে পড়বে না।

প্রীতির শেষ কথাটায় অন্তরার ভেতরটা যেনো জ্বলে ওঠে। সে হুট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে কঠিন কণ্ঠে প্রীতিকে বলে,
– প্রীতু,আমি লাইব্রেরীতে গেলাম। পিছে পিছে আসবি না প্লীজ।আমি এখন আড্ডার মুডে নাই।

বলেই আর দাঁড়ায় না অন্তরা, গটগট করে হেঁটে চলে যায় লাইব্রেরীর দিকে। পিছনে দাঁড়িয়ে প্রীতি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে ওর চলে যাওয়া দেখে ।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here